
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর এই সময়ে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মুহূর্তে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়ে গেছেন বলেই আজ স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা নিজ দেশে বসবাস করার সুযোগ পেয়েছি। সারা পৃথিবীতে আমরা স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে বিচরণ করি। একই সঙ্গে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে ত্রিশ লাখ মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়ে গেছে; তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
যখন পেছনে ফিরে তাকাই অনেক কিছুই স্মৃতিতে ভেসে আসে। স্বাধীন বাংলাদেশ। রাষ্ট্রীয় কোষাগার একেবারে শূন্য। দেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে গিয়েছে পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী। সেই জায়গায় বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করলেন। তখন বহু বৈপ্লবিক পরিবর্তন, বহু বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন।
এর মধ্যে একটি হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা। বঙ্গবন্ধু সঠিকভাবেই মনে করতেন যে, একটা দেশের ভিত রচনা করে তার শিক্ষাব্যবস্থা। সেই সময়ে যখন মানুষের অন্নের অভাব, বস্ত্রের অভাব, বাসস্থানের অভাব, চিকিৎসার অভাব; এই অভাবের মাঝেও তিনি মনে করলেন যে সুশিক্ষার দরকার আছে এবং এর জন্য শুরু করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। তিনি বাংলাদেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে এলেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য হলেও প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সব রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর ন্যস্ত করলেন। একই সঙ্গে তিনি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করে দিলেন। বাধ্যতামূলক ঘোষণা দিয়ে তিনি বসে থাকলেন না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে অবৈতনিক করে দিলেন। কারণ তিনি জানেন যে বাংলাদেশে বহু পরিবার আছে যাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর মতো আর্থিক সংগতি নেই। অতএব এটাকে অবৈতনিক না করলে বাধ্যতামূলক অর্থপূর্ণ হয় না। অতএব তিনি অবৈতনিক করলেন। একই সঙ্গে আবার তিনি বলে দিলেন, প্রাথমিক শিক্ষা হবে একমুখী। স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগী শিক্ষা। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি সমন্বয়ে যে শিক্ষা কার্যক্রম সেটি চালু করার জন্য তিনি নির্দেশ দিলেন। দেশে একমুখী শিক্ষা দিয়ে তিনি যে দর্শন আমাদের সামনে উপস্থিত করলেন, যেটি বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের দর্শন। সামনের বাংলাদেশ, মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ। সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ। এগুলো আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা। সেই ঘোষণায় স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা আছে যেটি বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের মধ্যে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শিশুদের একই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ শিশুদের মনে যেন কোনো বৈষম্যবোধ সৃষ্টি না হয়। যে বিত্তবান পরিবারের ছেলেমেয়েরা এক ধরনের স্কুলে যাচ্ছে। বিত্তহীন পরিবারের ছেলেমেয়েরা আরেক ধরনের স্কুলে যাচ্ছে। এই ধরনের কোনো বৈষম্য থাকবে না। বিত্তবান বিত্তহীন নির্বিশেষে সব শিশু একই পোশাকে একই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেএটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন।
শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা বোঝা যায় যখন তিনি ড. কুদরত-এ খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শিক্ষা কমিশনকে তিনি বলেন, আপনারা আমাকে একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা সুপারিশ করেন। ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ১৯৭৪ সালে সম্ভবত ৭ জুন তারিখে বঙ্গবন্ধুর হাতে সেই সুপারিশ হস্তান্তর করে। বঙ্গবন্ধু সেদিন এই খসড়া রিপোর্ট গ্রহণ করে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমি অতি দ্রুত এই শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করব।
এই রিপোর্টে মূল যে পরিবর্তনের কথাগুলো বলা হয়েছিল সেটি ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত থাকবে। প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি যে শিক্ষাটি এটি সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই পাঠ্যক্রমে চলবে। একমুখী শিক্ষা হবে। বঙ্গবন্ধুর যে ইতিপূর্বে ঘোষণা দেওয়া প্রাথমিক শিক্ষা হবে অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক ও একমুখী। এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কার্যক্রমে থাকতে হবে এই ছিল কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ। নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা। এই নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা এটি সাধারণ শিক্ষার কার্যক্রমে থাকবে। ছেলেমেয়েদের যাদের ইচ্ছা তারা কারিগরি শিক্ষায় যাবে, ধর্মীয় শিক্ষায় যাবে। এইখানে এসে একটি অপশন বা তাদের পছন্দ অনুযায়ী একটি ধারা নির্বাচনের একটি সুযোগ দেওয়া ছিল। পরে মাধ্যমিক পর্যায়ে নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির লেখাপড়া শেষ করে কেউ যদি উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হয় তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ ছিল। ১৯৭৪ সালেই স্বাধীন বাংলাদেশে যে সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল সেটি আজ উন্নত বিশ্ব যেভাবে শিক্ষাব্যবস্থা সাজিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে সেইরকম একটি শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ করেছিল কুদরত-এ-খুদার সেই শিক্ষা কমিশন।
সেখানে প্রাথমিক শিক্ষাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল সেটি বুঝা যায় যে, প্রজাতন্ত্রের শিক্ষা খাতে যত বরাদ্দ থাকবে তার ৬৫ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে। ২০ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং ১৫ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি আমরা পিরামিড চিন্তা করি তাহলে পিরামিডের ফাউন্ডেশন বা ভিত সেটা হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। অতএব সেখানে প্রজাতন্ত্রের আর্থিক বরাদ্দের সর্বোচ্চ বরাদ্দ সেই জায়গায় দরকার আছে। কারণ এখানে প্রজাতন্ত্রের সব শিশু বাধ্যতামূলকভাবে যাচ্ছে। অতএব সব শিশুকে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়াটা এটা প্রজাতন্ত্রের দায়িত্ব এবং বঙ্গবন্ধু সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যাকান্ডের শিকার হলেন। বঙ্গবন্ধু যে কথা বলেছিলেন, শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট আমি অত্যন্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করব, সেটি আর বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়ন করতে পারলেন না। বঙ্গবন্ধুর পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরাই যেহেতু এ দেশ পরিচালনা করছে দশকের পর দশক অতএব কুদরত-এ-খুদার শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। এটাই হলো বাস্তবতা। পরে আমরা দেখেছি ১৯৭৫ থেকে ২০১০ এই পুরোটা সময় আমাদের দেশে কোনো শিক্ষানীতি ছিল না। অবশেষে ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একটি শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করে জাতিকে উপহার দিলেন। এখন আমরা সেই শিক্ষানীতি নিয়ে এগিয়ে চলছি।
আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর কুদরত-এ-খুদা কমিশনের শিক্ষা রিপোর্ট সেই সময়ে বাস্তবায়ন করতে পারতাম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আজ ২০২১ সালে এসে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় ধরনের উন্নয়ন আমরা লক্ষ করতাম। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে যেমন গুরুত্ব দিতেন সেইভাবে তিনি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। তিনি একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে গোটা দেশের শিক্ষা কার্যক্রম নতুন করতে সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে কেরানি বানানোর শিক্ষার যে পদ্ধতি, সেটা আমি থাকতে দেব না। এটা পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার যে সম্প্রসারণ ঘটানো, এটার জন্যও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের দেশে বিএ এমএ পাস বেকার লোকের সংখ্যা অসংখ্য। এটা নিয়েও বঙ্গবন্ধু কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কেরানিগিরির শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার প্রসারে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি কোনোরকম কেক কেটে বা অনুষ্ঠান করে জন্মদিন উদ্যাপন করতেন না। তিনি শিশুদের নিয়ে জন্মদিনে আনন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের দিনটিই এখন আমাদের জাতীয় শিশু দিবস। বঙ্গবন্ধু সব সময়ই শিশুবান্ধব একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। চেয়ারম্যান বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং সভাপতি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর।
অনেক কিছুই স্মৃতিতে আছে আবার অনেক কিছু ভুলেও গেছি। ষাটের দশকে স্বাধীনতা-স্বাধিকার ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মুজিব ভাই। নিজের আত্মত্যাগ, দক্ষতা-যোগ্যতায় সেই সময়ের অনেক নেতাকে ছাপিয়ে স্বপ্নের নায়ক হয়ে ওঠেন মুজিব ভাই। ৩৫ বার জেল খেটেছেন। খুব কাছ থেকে দেখেছি তেজোদ্দীপ্ত বিশাল মাপের মানুষ মুজিব ভাইকে। পাকিস্তানের বৈরী এবং বন্ধুর পরিবেশে তিনি ছিলেন সবার নির্ভরতার কান্ডারি, বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দলীয় নেতার পরিচয় অতিক্রম করে তিনি দলের সীমা-পরিসীমা মাড়িয়ে সবার পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের মতো মাঠকর্মীরা বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন ও সুভাষ বসুকে দেখিনি। কিন্তু তাদের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। জাতির আশা-আকাক্সক্ষা তাকে ঘিরে আবর্তিত হতো সেই দিনগুলোতে। গণতন্ত্র, বাঙালিত্ব, অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন সমাজের জন্য আন্দোলন সংগ্রামে সেদিন দলমত নির্বিশেষে কর্মী বাহিনীর কাছে তিনি প্রকৃত জাতীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তার অনন্য সাধারণ সাহস জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা, দুঃসহ কষ্ট ও কারা যন্ত্রণা ভোগ করে ও ত্যাগের নজির হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে মুজিব ভাই জনমনে হিমালয়ের উচ্চতা অর্জন করেছেন। এমনকি ভিন্নমতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার উষ্ণ আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল ঈর্ষণীয়। এখন মনে হয় যেন তিনি এক একান্নবর্তী রাজনৈতিক পরিবারের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন সেই দিনগুলোতে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, জাতীয়তাবাদী বাম প্রগতিশীল দলের কর্মীবাহিনী মুজিব ভাইয়ের কাছে পেতেন অঢেল স্নেহ, ভালোবাসা, অফুরন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা। আজ কল্পনা করতেও কষ্ট হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি কত মানবিক কত সমন্বিত কত উচ্চ এবং উন্নত স্তরে ছিল সেই দিনগুলোতে। এই স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে আমি বলব, জাতীয় কর্তব্য পালনের অঙ্গ হিসেবে আজ অনেকেই তাকে ব্যবহার করছেন দলীয় বিবেচনায়। কেউবা অতি মানব হিসেবে চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক স্বার্থ উদ্ধারের কারণে তাকে ব্যবহার করছেন। অথবা রাজনৈতিক বৈরিতায় তাকে খাটো করার যে প্রয়াস বর্তমানে চলছে ইতিহাস তা মেনে নেবে না, মানতে পারে না। ১৯৬৩ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন এবং ছাত্র আন্দোলনে পরামর্শ এবং আর্থিক সহায়তার জন্য মুজিব ভাইয়ের কাছে একাধিকবার গিয়েছি ৩২ নম্বরের বাসভবনে। কখনো রেজা আলী, সাইফুদ্দিন মানিক এবং প্রকৌশলী গোলাম মর্তুজা তাদের সঙ্গে। আন্তরিকতায় সিক্ত তার পরামর্শ-সহযোগিতা সবসময়ই পেয়েছি। নিজের কর্মীদের জন্য সংগৃহীত, সীমিত সঞ্চয়ের মধ্য থেকে তিনি আমাদের বড় অনুষ্ঠানের জন্য হাজার টাকাও দিয়েছেন। এমনকি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীর কাছে তিনি আমাদের পাঠাতেন অধিক অর্থের প্রয়োজনে। একাধিকবার দেখেছি মফস্বল থেকে আসা আওয়ামী লীগের গরিব ও নিঃস্ব এবং মধ্যবিত্ত কর্মীরা নেতার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তাদের তিনি মধুর ব্যবহারে তুষ্ট করে সংগঠন ও আন্দোলনের কাজে জোরদারভাবে নামতে উৎসাহিত করতেন। বিদায়ের আগে তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে পকেটে ভরে দিতেন একটি হোমিওপ্যাথিক পুরিয়ার মতো জিনিস। পরে মুজিব ভাইকে প্রশ্ন করে জেনেছি গরিব কর্মীরা কষ্ট করে ঢাকায় আসে তাদের কিছুটা কষ্ট লাঘব করতে তিনি পঞ্চাশ, একশো এবং দুশো টাকার পুরিয়া বানিয়ে জমা রাখতেন। সেদিনকার সংগ্রাম ও আন্দোলনের কাজে ওই পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া যেত নেতার কাছ থেকে যা ছিল উদ্দীপনার রসদ। আজকের বাস্তবতায় এই নজির কল্পকাহিনীর মতো শোনাবে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল। সময়ে সময়ে তীব্র বৈরিতাও হয়েছে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে ৬ দফা ও ১১ দফা গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর ক্ষেত্রে অবিচ্ছিন্ন-ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ অব্যাহত থাকার পশ্চাতে ছিল মুজিব ভাইয়ের দূরদর্শী রাজনৈতিক লক্ষ্যসীমা ও তাগিদ। এই কাজে মণিসিংহ, মোজাফ্ফর আহমেদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, পীর হাবিবুর রহমান, খোকা রায়, মো. ফরহাদ, মানিক মিয়া, মিজানুর রহমান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও শহীদুল্লা কায়সার পালন করতেন যথাযোগ্য, পরিপূরক ও সম্পূরক ভূমিকা। পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরাচারী সরকার পূর্ব বাংলার বিশেষত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, নরসিংদী, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলে ১৯৬৪ সালে ১৪ জানুয়ারি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেয়। কাশ্মীরে হযরতবাল মসজিদে পয়গম্বরের রক্ষিত পবিত্র চুল চুরির প্রতিক্রিয়ায় পূর্ববঙ্গে এই দাঙ্গা রটায় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে ভয়ার্ত-উদ্বাস্তু নর-নারী-শিশুরা আশ্রয় গ্রহণ করেছিল মাসাধিককাল আজও তিনিই নায়ক ধরে। তখন জগন্নাথ হলে ছাত্রদের উদ্যোগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সংসদ ভবনে একটি আশ্রয় শিবির স্থাপিত হয়। দুই হাজারের বেশি শরণার্থীর খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমি পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য ও মহিউদ্দিন আহমেদ মুজিব ভাইয়ের কাছে চাল-ডাল, লণ্ঠনসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি চেয়ে পত্রবাহক আখলাকুর রহমানকে পাঠিয়েছিলাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ বস্তা চাল, এক বস্তা ডাল দুই হাজার টাকা পাঠান মুজিব ভাই। পরের দিন মহিউদ্দিন ভাইও পাঠান প্রায় কাছাকাছি পরিমাণ সাহায্য সামগ্রী।
১৯৬৭ সালের ১৭ অক্টোবর আমি গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদের শিকার হই। আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে স্বাধীনবাংলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত করে জেলখানায় পাঠানো হয়। কারাগারে ঢুকেই দেখি কারাগার হাসপাতালে অপেক্ষা করেছেন মুজিব ভাই। জিজ্ঞাসাবাদের বিস্তারিত বিষয় তাকে জানালাম। যার সিংহভাগই ছিল মুজিব ভাইয়ের বিরুদ্ধে। মানিক চৌধুরী, বিধান কৃষ্ণ সেন, চট্টগ্রামের ডা. জাফর, হান্নান সাহেব, একে খান প্রমুখের সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠক ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় আমাকে। পাশাপাশি কয়েকজন সেনা অফিসারের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গও ছিল ওই জিজ্ঞাসাবাদে। যা হোক ’৬৭ সালের অক্টোবরের ২০ তারিখে আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিই এই মর্মে যে, সেনা আমলা যুক্ত হয়ে মুজিব ভাইয়ের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র মামলা তৈরি করা হচ্ছে যা পরবর্তীকালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে খ্যাতি পায়। কারাগারে অবস্থানকালে ওই সময় আমি ১৯দিন মুজিব ভাইয়ের সান্নিধ্যে ছিলাম। তিনি দেওয়ানি নামক একটি কক্ষে থাকতেন তার বিপরীত দিকে ২০ নম্বর সেল নামক একটি সেলে আমাকে রাখা হয়েছে। পরে জেনেছি উনিই সেই ব্যবস্থা করেছিলেন জেল কর্র্তৃপক্ষকে বলে। উনি তার পাশেই আমাকে রাখতে চেয়েছেন। সেই সময়ে বহু ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ হয়েছে। পারিবারিক, সংসার, তার জীবন সংগ্রাম বহু বিষয়ে। ঠাট্টার ছলে অনেক কথা তুলে ধরতেন। সেই সময়ে কথা প্রসঙ্গে একবার মুজিব ভাইকে একটা বইয়ের কথা বলেছিলাম। বইটির নাম অ্যান অ্যাকাডেমিকাল স্টাডি অব পাকিস্তান। বইটির লেখক ছিলেন অধ্যাপক গনোকভস্কি। সোভিয়েত ইউনিয়নের। যে গ্রন্থে পাকিস্তানের জাতিসমূহের বিশেষত বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রশ্নের দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি ঘটবে বলে ভাষ্য দেওয়া ছিল। কবি জসীম উদ্দীন এই বইটি রাশিয়া থেকে নিয়ে আসেন। তার পুত্র জামাল আনোয়ার বাসুর বন্ধুদের কাছ থেকে বইটি নিয়ে আমি পড়ার সুযোগ পাই। মুজিব ভাই এই তথ্যটি নিয়ে একাধিকবার তর্ক করেন এই মর্মে যে, প্রচ- জনমত সৃষ্টি হলে শাসক গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক চাপে ৬ দফা মেনে নিতে বাধ্য হবে। তাছাড়া সশস্ত্র যুদ্ধের পার্টি তো আওয়ামী লীগ নয়, এমনকি ন্যাপও নয়। অবশ্য সে কথাও তিনি বলেছিলেন সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হবে। তবে আমি হিসাব করে দেখেছি ২৭ জনের বেশি লোক পাব না। সম্ভাব্যদের মধ্যে তৎকালীন ছাত্রনেতাদের নাম তিনি বলেছিলেন। এরমধ্যে বিভিন্ন জেলার সার্বক্ষণিক কিছু কর্মীর নাম তিনি বলেছিলেন। যাদের মধ্যে একজন ছিলেন সন্দ্বীপের লোক সম্ভবত আবদুর রহমান বয়াতি। যিনি ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় জনসভার আগে লোকগান পরিবেশন করে জনগণকে মাতিয়ে তুলতেন। যাক আমার জামিনে মুক্ত হওয়ার দিনে তিনি আমাকে জেলগেট পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। কানে কানে এসে বলেছিলেন মামাকে (শহীদুল্লা কায়সার) দিয়ে বইটা পাঠিয়ে দিস। এই কথা বলে জেলগেটের সামনে এসে তিনি তৎকালীন ডেপুটি জেলার নির্মল সিনহাকে বলেন, আমার ছোট ভাই জেল থেকে জামিনে বাইরে যাচ্ছে তাকে মুক্ত করে দিতে আমি সঙ্গে এসেছি। খিড়কি দরজা দিয়ে সে যাবে না। মূল ফটক খুলে দাও। উচ্চৈঃস্বরে তিনি এ কথা বললেন। নির্মল সিনহা এসে জমাদারকে বললেন, মূল ফটক খুলে দাও। তারপর বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে বেলী ফুলের একটা মালা আমার গলায় পরিয়ে দিলেন। আমার জীবনের সর্বশেষ সংবর্ধনা আমি পেয়েছি সেদিন। এবং মূল ফটক দিয়ে আমি জেল থেকে বেরিয়েছি। বঙ্গবন্ধু ঠাট্টা করে বললেন আমি পাইপটা মুখে দিয়ে জেলে ঢুকি। আমি খিড়কি দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকি না। মাধা উঁচু করে জেলে ঢুকি, মাথা উঁচু করে জেল থেকে বের হই। এই কথা এখনো কানে বাজে। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে বিশ্বজয়ী তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১২ জানুয়ারি তাকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলাম। তিনি আবেগ-আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। বললেন, রাশিয়ান বইটা তো দিলি না। বইয়ের কথা অনুযায়ী কাজ তো করেছি। কী বলিস? অবাক হলাম মুজিব ভাইয়ের ঈর্ষণীয় স্মরণশক্তির বহর দেখে ও শুনে। একাধারে গর্বিত এবং লজ্জিত হলাম। অথচ ঘটনাটি ভুলেই গিয়েছিলাম বলা চলে। ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। তখন জাতীয়করণকৃত জুট মিলগুলোতে সাবেক মালিকদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সাবেক মালিকরা ১৮টি মিলের যাবতীয় অর্থ একই দিনে তুলে নিয়ে মিলগুলোকে দেউলিয়া করার উদ্যোগ নেন। এই সংবাদ আগের রাতে পেয়ে তৎকালীন পিএস ফরাসউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে বলি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে। পরের দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে জুট মিলের অ্যাকাউন্ট খোয়া যাবে, উঠিয়ে নেবে সাবেক মালিকরা এই কথা বলাতে তিনি আর কাউকে জিজ্ঞাসা না করে সরাসরি ডিসিকে টেলিফোন করে ওই জুটমিলগুলোর সব অ্যাকাউন্ট জব্দ করার ব্যবস্থা করেন।
১৯৭৪ সালে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপসহ বিভিন্ন কারণে তার সঙ্গে বহুবার সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছি। সারা জীবন তার সান্নিধ্য-সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতায় পূর্ণ করেছে স্মৃতির ভান্ডার। সর্বশেষ সাক্ষাৎ করি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১২ জুলাই। তৎকালীন বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূত ছিলেন বরিস বায়েজডিগ। তিনি হিটলারের বন্দিশিবিরে অত্যাচারিত মানুষ। বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ মধ্যম পর্যায়ের একটি সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা অচিরেই ঘটতে পারে বলে সংবাদটি তিনি আমাকে জানান ১১ জুলাই। আমি সেই ঘটনা শুনে তাকে বললাম আমার করণীয় কী? তিনি বললেন, আপনি আপনার রাষ্ট্রপতিকে বিষয়টি জানান উপযুক্ত ব্যবস্থাবলি গ্রহণ করার জন্য। আমি সেই কথা কিছু সুপারিশসহ বঙ্গবন্ধুকে জানাই। তিনি প্রথমে স্বভাবজাত ঔদার্য নিয়ে বিষয়টি হালকাভাবে নেন। বলেন, আমি কিছুই দিতে না পারি ভাত দিতে না পারি, কাপড় দিতে না পারি স্বাধীনতা তো দিয়েছি। আমার বুকে বন্দুক চালাতে ওদের হাত কাঁপবে না? আমার চাপাচাপিতে পরে তিনি বলেন, রক্ষীবাহিনীর প্রধান নুরুজ্জামানকে মার্শাল টিটোর কাছে তিনি পাঠিয়েছেন। অ্যান্টি ট্যাংক গান আনতে । ওই সময়ে ট্যাংক ছিল মিসরের সেনাবাহিনীর। কিন্তু অ্যান্টি ট্যাংক গান ছিল না। সেটা এক মাসের মধ্যে পাওয়া যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এসব আলোচনাকালে একজন ভদ্রলোক একটা ফাইল নিয়ে ঢোকেন। পরে তার পরিচয় জানলাম উনি একজন সাবেক পুলিশ কর্তা ও তৎকালীন সচিব। যিনি আমাকেও ইন্টারোগেশন করেন। তিনি আকস্মিকভাবে ঘরে ঢুকেন একটা ফাইল নিয়ে। আমি বঙ্গবন্ধুর হাঁটুতে চাপ দিয়ে বোঝাই ওই প্রতিষেধক বিষয়টি যেন না বলেন। তিনি হেসে বলেন ও আমার লোক। এ কথা বলে কী ব্যবস্থা এক মাসের মধ্যে নেবেন তা একটু পুনরুক্তি করেন। কথা শেষে যখন বেরিয়ে আসি তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তি করি আমি যখন জানতে পারি আর কেউ যখন জানতে পারে যে, এক মাসের মধ্যে অ্যান্টি ট্যাংক গান আসবে তাহলে এক মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে হয়তো আমরা হারাব। বিষয়টি অত্যন্ত ত্বরিত জানাই মোজাফ্ফর আহমেদ, কমরেড ফরহাদ ও মণি সিংহকে। সেদিন মুজিব ভাইয়ের কাছ থেকে বেরিয়ে আসার সময় তিনি রসিকতা করে বললেন আমি তোদের বিপদ নিয়ে ভাবি, তোরা সাবধানে থাকিস। আমি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে গলায় চাদরটা ঝুলিয়ে জনতার ভিড়ে হারিয়ে যাব। বিপদ হবে তোদের। রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে বের হওয়ার পথে হঠাৎ দেখি হন হন করে খোন্দকার মোশতাক টুপিটা ঠিক করতে করতে ঢুকছেন। বঙ্গবন্ধু রসিকতা করে বললেন কী রিঅ্যাকশনারি নেতা? কেমন আছেন? মোশতাক ত্বরিত জবাব দিলেন, নেতা আমি আপনার জীবদ্দশায় আপনার বিরোধিতা করব না। খুনি মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরে ৭৫-এর ১৫ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণ করেন। খুনিও তার কথা রেখেছেন। প্রিয় মুজিব ভাই, দেশবাসীর প্রিয় মৃত্যুঞ্জয়ী মৃত্যুহীন চিরভাস্বর হয়ে বাংলার মানুষের অন্তরে। চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। শতবর্ষেও তিনিই আমাদের নায়ক।
লেখক : প্রবীণ রাজনীতিবিদ
এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষমুজিববর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। তার এই জন্মদিন বিশেষভাবে উদযাপন করছি আমরা। পুরো দেশ দিনটিতে তাকে স্মরণ করবে। তিনি আমাদের একটি জাতিরাষ্ট্র দিয়েছেন, আমাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন। তাই তার এই জন্মদিন উদযাপন করার মধ্য দিয়ে আমরা তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করার একটি সুযোগ পাচ্ছি। আমাদের দেশকে স্বাধীন করতে তার যে কষ্টকর প্রচেষ্টা, সেটা শুরু হয়েছিল একেবারে ভাষা আন্দোলন থেকে। তিনি শুরু থেকেই একজন মাটির মানুষ, শেকড় থেকে তিনি জননেতায় পরিণত হয়েছিলেন। জননেতা থেকে তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে একটি রাষ্ট্রের একক নেতায় পরিণত করেছিলেন। একটি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। তাকে আমরা জাতির জনক বলে অভিহিত করেছি।
আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথকে তার বাবা ছোটবেলায় হিমালয়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, যাতে তিনি বড় মনের অধিকারী হতে পারেন, প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে পারেন এই চিন্তা থেকে। বঙ্গবন্ধুও তেমন প্রকৃতির সন্তান ছিলেন। তিনি জেলখানায় বসে বলেছেন, এখন যদি আমি আমার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে পারতাম! এই যে একটি শিশুসুলভ মানুষকে আমরা দেখি এটাই আসল বঙ্গবন্ধু। তার মনের কথা এবং মুখের কথা একই ছিল। তিনি বলেছেন, দেশের জন্য প্রাণ দেব। দেশের মানুষের জন্য তো আমরা রক্ত দিয়েছি। প্রয়োজনে আরও দেব রক্ত। তখন আমরা বুঝতে পারি, তিনি সত্যিকার অর্থেই কথাগুলো বলেছেন।
গণতন্ত্রের কথা মানেই হচ্ছে দেশ, দেশের মাটি ও মানুষের কথা বলা। বঙ্গবন্ধু সবসময় সেটাই ছিলেন। তিনি ছিলেন মাটির কাছাকাছি। জনমানুষের মনের কথাই তিনি বলতেন। মানুষের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষাই তার বক্তব্যে পাওয়া যেত। এদিক দিয়ে তিনি বিশ্বের অন্যান্য নেতাদের থেকেও ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন। আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিংয়ের বক্তব্যও তাৎক্ষণিক ছিল না। কিন্তু আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বক্তব্য তাৎক্ষণিক ছিল। আমরা যদি ১৯৪৭-এ জওয়াহেরলাল নেহরুর বক্তব্যর দিকে তাকাই সেটিকে এর কাছাকাছি বলতে পারি, তাৎক্ষণিক বক্তব্য বলে ধরতে পারি। ’৪৭-এ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হলো। একটি হলো পাকিস্তান, অপরটি ভারত। আমরা রইলাম পাকিস্তানে। সে সময়ে ভারতের নেতা নেহরু যেভাবে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার বক্তব্য স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। সেইদিন তিনি সুস্থ ছিলেন না। এটি আমরা আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অনেকবার শুনেছি। তিনি বলেছেন, আব্বার শরীরটা ভালো ছিল না। আমি তার মাথা টিপে দিচ্ছিলাম। রেসকোর্সে যাওয়ার আগে মা আব্বাকে বললেন, আপনি কারও কথা শুনবেন না। আপনার মনে যা আসে, আপনি কেবল সেই কথাই বলবেন। পরে আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধু তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। যার সঙ্গে কোনো ভাষণের তুলনা চলে না। তার সেদিনের বক্তব্য জুলিয়াস সিজারের বক্তব্যের মতো রক্তঝরানো বক্তব্যই কেবল ছিল না, সেটি ছিল একইসঙ্গে একটি রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশনামূলক বক্তব্য। একজন রাষ্ট্রনেতার মতো বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। একটি বক্তব্য দিয়ে তিনি ত্রিশ লাখ লোককে জীবন দিয়ে যুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুই লাখ মা-বোনকে নির্যাতিত হতে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে। তার বক্তব্যটিই ছিল বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে নিয়ে যাওয়া চূড়ান্ত প্রেরণামূলক বক্তব্য।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসম্ভব সাহসী। ২৫ মার্চ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল ফাঁসিকাষ্ঠের কাছে। তাকে মৃত্যুর ভয় দেখানো হয়েছিল। দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু বললেন, তার জন্য কবর খনন করে তাকে দেখানো হয়েছিল। তবুও তিনি পাকিস্তানিদের সঙ্গে আপস করেননি। এদিকে তারই বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশে চলছে মুক্তিসংগ্রাম। আর তাকে রাখা হয়েছে দূর দেশে কারবন্দি করে। অবশেষে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে দেশ স্বাধীন হলো।
স্বাধীনতার পরেও প্রিয় নেতাকে মুক্তি দিতে পাকিস্তানিরা গড়িমসি করল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশে-বিদেশে জনমত গড়ে ওঠে। পরে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের প্রায় একমাস পরে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তাকে বিশ্বজনমতের চাপে মুক্তি দেওয়া হলো। প্রথমে তিনি বিলেত গেলেন। সেখান থেকে ভারত হয়ে দিশে ফিরলেন। তার ফেরার সময়ে ভুট্টো বলেছিলেন রাতের পাখি উড়ে গেছে। অর্থাৎ বোঝানো হয়েছে যে, রাতের পাখিকে কেউ আটকাতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমেই কেঁদে ফেললেন। মানুষের উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা ও অশ্রুসিক্ত সংবর্ধনার পরেই তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে উচ্চারণ করলেন ‘নমোনমো নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!’।
রবীন্দ্রনাথ তার ঠোঁটস্থ ছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা তিনি সময় পেলেই পাঠ করতেন। বঙ্গবন্ধু জীবনের অনেকটা অংশ জেলখানায় কাটিয়েছেন। তিনি এই সময়ে প্রচুর বই পড়েছেন। তার লেখা কারাগারের রোজনামচা বইটি পড়লেই আমরা এসব বিষয়ে ধারণা পাই। জীবনের দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকার সময়ে তিনি ৩টি বই লিখেছেন। তার এসব বই পড়লে আমরা সহজেই বুঝতে পারি তিনি লেখক হিসেবেও অনেক উঁচু মানের লেখক। তার ৩টি বই জুড়েই দেশ, দেশের মানুষের মুক্তির কথা লেখা রয়েছে। দেশভাবনা জানতে পারি তার লেখার মধ্য দিয়ে।
তিনি ছিলেন শৃঙ্খলিত মানুষের মুক্তির দূত। দেশ স্বাধীনের পরে মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন তিনি। এই তিন বছরেই একটি সদ্য স্বাধীন দেশ গড়তে তিনি মনোনিবেশ করলেন। তিনি পুরো দেশকে নিজের পরিবারের মতো করে আগলে রাখতে চেয়েছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি লক্ষাধিক মানুষকে চিনতেন। কারও সঙ্গে দেখা হলেই নাম ধরে ডাকতেন। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অবিশ্বাস্য রকমের ভালো। তার সঙ্গে আমারও দেখা হয়েছিল। কাছ থেকে তাকে দেখার সুযোগ হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর মনপ্রাণ জুড়ে ছিল বাঙালি ও বাংলাদেশ। তাকে মনে না করে আমাদের কোনো উপায় নেই। দেশের প্রতিটি মানুষের মাঝেই তিনি আছেন, থাকবেন।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গুণাবলি পেয়েছেন তারই তনয়া আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই করোনা মহামারীর সময়েও তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। আমরা নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করতে পারছি। ঢাকায় মেট্রোরেল হচ্ছে। ভবিষ্যতে পাতাল রেল, টানেলসহ আরও উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা আমরা জানতে পারছি। এই সময়ে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ মুজিববর্ষ উদযাপন করতে পারা আমাদের মতো বয়সের লোকেদের জন্য সত্যি আনন্দের এবং সৌভাগ্যের। দেশের স্বাধীনতা দেখেছি, বঙ্গবন্ধুর ৫০ বছর পূর্তি দেখেছি। এখন আবার স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন করতে পারছি এটা পরম সৌভাগ্যের।
বঙ্গবন্ধু কখনো আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবেন না। পুরাণের মৃত্যুঞ্জয়ী ফিনিক্স পাখির মতো তিনি আমাদের মাঝে থাকবেন। বারবার তিনি ফিরে আসবেন। তখন শেক্সপিয়র থেকে আগামীর প্রজন্মে উদ্দেশে তিনি বলবেন ‘মানুষ কত সুন্দর হয়; হে সাহসী বিশ্ব!’
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক; বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।
বঙ্গবন্ধু কখনো আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবেন না। পুরাণের মৃত্যুঞ্জয়ী ফিনিক্স পাখির মতো তিনি আমাদের মাঝে থাকবেন। বারবার তিনি ফিরে আসবেন। তখন শেক্সপিয়র থেকে আগামীর প্রজন্মে উদ্দেশে তিনি বলবেন ‘মানুষ কত সুন্দর হয়; হে সাহসী বিশ্ব!’
৮ জানুয়ারি ১৯৭১ অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এবং রয়টার সদ্য কারামুক্ত ও লন্ডনে উপস্থিত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে দুটি ডেসপাচ লন্ডন থেকে ছেড়েছে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই সেই ডেসপাচের ওপর ভিত্তি করে তা উদ্ধৃত করে সংবাদ প্রকাশ করেছে। ‘ডেসপাচটি’ অনুবাদ করেছেন আন্দালিব রাশদী
মুজিব লন্ডনে
শেখ মুজিবুর রহমান আজ (৮ জানুয়ারি ১৯৭২) ঘোষণা করলেন ‘বাংলাদেশ এখন চ্যালেঞ্জের ঊর্ধ্বে এক বাস্তবতা’, তিনি পৃথিবীর স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্তির আহ্বান জানালেন।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে মুক্তি দিয়েছেন, আজ লন্ডনে পৌঁছে একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিতদের কনডেমড সেলে রাখা হয়েছে, ৯ মাসের কারাবাসের সময় তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে প্রাণনাশের আদেশ হয়েছিল।
সাহসী কণ্ঠে অসুস্থতার কোনো লক্ষণ না দেখিয়ে ৫১ বছর বয়সী বঙ্গপিতা (বাঙালিদের জনক) বললেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করার কোনো প্রতিশ্রুতি তিনি মিস্টার ভুট্টোকে দেননি।
অভিজাত ক্ল্যারিজেস হোটেলের বলরুমে চিত্রিত দেয়াল আয়না প্রেক্ষাপটে রেখে টেলিভিশন আলোর ঝলকের নিচে শেখ মুজিব যখন সংবাদ সম্মেলন করছিলেন, বাইরে বহুসংখ্যক উল্লসিত বাঙালি জমায়েত হয়েছেন।
তাকে প্রথম দিকেই যে প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হয়েছে, তা হচ্ছে : উড়োজাহাজে ঢাকায় যাওয়ার বদলে আপনি লন্ডনে কেন এলেন?
শেখ জবাব দিলেন : আমি ছিলাম কয়েদি, এটা পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছেতে হয়েছে, আমার ইচ্ছেতে নয়।
শেখ বললেন, লন্ডনে কতক্ষণ থাকবেন তা তখনো নির্ধারিত হয়নি। তবে যাওয়ার আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখেন।
কর্মকর্তারা পরে জানান, সন্ধ্যায় শেখ মুজিব মিস্টার হিথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
শেখ সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি যোগসূত্র রক্ষা করার জন্য মিস্টার ভুট্টো তাকে অনুরোধ করেছেন।
তিনি বলেছেন, আমার জনগণের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমি কিছুই বলতে পারব না। শেখ মুজিবকে সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলা হয়, ‘আমাদের প্রিয় নেতা, মুক্ত মানুষের স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বাধীন রাষ্ট্রপতি।’
কালো টিউনিক ধাঁচের স্যুট পরা শেখ বাংলাদেশ সৃষ্টির সংগ্রামে জীবন বিসর্জন দেওয়া লাখ লাখ মানুষের প্রতি তখনই শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের যে সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রত্যাশাকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে নির্মম হত্যাকান্ডের জন্য তারা অপরাধী। তিনি আরও যোগ করেন, হিটলার আজ বেঁচে থাকলে তিনিও লজ্জা পেতেন।
শেখ মুজিব সরাসরি ভুট্টোর কোনো সমালোচনায় যাননি। তিনি বলেছেন, ‘আমি তার মঙ্গল কামনা করি।’
ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ব্রিটেন, ফ্রান্সকে শুভেচ্ছা জানান এবং যুক্তরাষ্ট্র সহ পৃথিবীর সব স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য শুভ কামনা ব্যক্ত করেন।
পৃথিবীর দেশগুলোকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আহ্বান জানিয়ে ‘বঙ্গপিতা’ বলেন, ‘আমার দেশের লাখ লাখ ক্ষুধার্ত মানুষকে বাঁচাতে আমি পৃথিবীর নাগরিকদের কাছে আবেদন জানাই।’
কারাবন্দি থাকাকালীন তার ওপর কোনো ধরনের শারীরিক অনাচার ও নির্যাতন হয়েছে কি না জানতে চাওয়া হয়।
তিনি জবাব দেন, তাকে জনশূন্য একটি কারাগারে ফাঁসির প্রকোষ্ঠে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বন্দি করে রাখা হয় কোনো দর্শনার্থী নেই, কোনো চিঠিপত্র নেই, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।
শেখ মুজিব বলেন, তাকে একটি ‘প্রহসনের বিচারের’ মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, শুনানি যখন মাঝপথে তিনি নিজেই তার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করেন। তারপর পাকিস্তান সরকার তার পক্ষে লড়ার জন্য একজন উকিল নিয়োগ করে।
‘এটা কি একজন বেসামরিক নাগরিকের জন্য কোর্ট মার্শাল?’
তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে ফাঁসি দিতে চেয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকার তাকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিয়েছিল। এই সরকারকে প্রতিস্থাপনকারী ভুট্টো সরকার তার দ-াদেশ কার্যকর করতে অস্বীকার করে।’
কারাগার এলাকায় বিমান আক্রমণের আশঙ্কায় ব্ল্যাকআউট হওয়ার কারণেই তিনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা জানতে পেরেছেন। তিনি আরও যোগ করলেন, ভুট্টো না বলা পর্যন্ত তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের কথা জানতে পারেননি।
শেখ বললেন, ‘আমি এখন স্বাধীন মানুষ কিন্তু পৃথিবী থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। তিনি সাংবাদিকদের জানান, প্রহসনের বিচারের পর ‘আমি মরার মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে রেখেছিলাম।’
‘যেদিন আমাকে জেলে ঢোকানো হয়, আমি মরব না বেঁচে থাকব তা জানতাম না। কিন্তু আমি জানতাম যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।’
ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে সমর্থন করায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে তার মনোভাব কী হবে জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রশ্নটিকে পাশ কাটিয়ে বলেন, ‘আমি কারাগারে ছিলাম, আমি এখনো অনেক কিছুই জানি না। আমি যখন ঢাকায় ফিরব, এ বিষয় নিয়ে আমার দলের সঙ্গে আলাপ করব।
শেখের পুরনো পরিচিতরা বলেছেন, তিনি আগের চেয়ে চিকন হয়ে গেছেন কিন্তু এত ভোগান্তির পরও তার মনোবল ও আত্মবিশ্বাস এখনো পুরোপুরি অক্ষুণœ রয়েছে। তিনি রাওয়ালপিন্ডি থেকে উড়োজাহাজে এ পর্যন্ত এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন এই বলে সংবাদ সম্মেলন শেষ করে দেন এবং স্বর উঁচিয়ে বিজয়ের ধ্বনি দেন ‘জয় বাংলা’।
হোটেলের বাইরে প্রতি মিনিটে তার সমর্থক জমায়েত বেড়ে চলেছে এবং তারাও পরস্পরকে আলিঙ্গন করে জয় বাংলা বিজয়ী স্লোগান দিচ্ছেন।
রয়টার আরও যোগ করেছে :
শেখ ঘোষণা করেছেন, ‘আমার মানুষের কাছে ফিরে যেতে আমি আর এক মুহূর্তও দেরি করতে চাই না।’ তিনি আশা করছেন, কাল বা পরশু ঢাকা পৌঁছাবেন।
আবেগকম্পিত কণ্ঠে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মতো অন্য কোনো দেশের মানুষকে এত মূল্য দিতে হয়নি এত জীবনদান, এত ভোগান্তি!’
তিনি কুড়ি মিনিট দেরিতে সাংবাদিকদের সামনে হাজির হন এবং জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে তাদের স্বাগত জানান। তিনি বলেন, ‘আজ আমি স্বাধীনতা-সংগ্রামে মুক্তির অসীম আনন্দ উদযাপন করছি।’ বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন ঢাকায় যাওয়ার আগে তার একটু বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। তাকে দেখতে এয়ারপোর্টে দশ লাখ লোকের জমায়েত হবে।
‘পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ যে আচরণ করেছে, তারপরও তাদের বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই। তারা যখন আমাকে গ্রেপ্তার করল আমার সন্তানদেরও গ্রেপ্তার করে আটকে রাখল, আমার বড়ি পুড়িয়ে দিল।’
তিনি বলেন, শত শত বছর ধরে বাংলাদেশ শোষণের শিকার এজন্য ব্রিটেনেরও কিছু দায়িত্ব আছে, যদিও ব্রিটিশ সরকার বরাবরই ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করেছে। বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা বলেন, তিনি ৪২ পাউন্ড (১৯ কিলোগ্রাম) ওজন হারিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স ও বৈদেশিক বাণিজ্য জাতীয়করণ করতে চাচ্ছে বলে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা যথার্থ এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের নির্বাচন মেনিফেস্টোতেই এসব নির্ধারিত হয়ে আছে। তার সহকর্মীরা বাংলাদেশে যা করছে তিনি তার ওপর সম্পূর্ণ আস্থাশীল।
শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি আমার স্বাধীনতা কোনো যুদ্ধে আর হারাতে চাই না। আমি যে কারও সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’
তিনি বলেন, পাকিস্তান একটি নোংরা খেলা খেলেছে এবং এই গণহত্যার বিচার হতে হবে। কিন্তু এখন আমার মানুষ স্বাধীন হয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই। আমি মিস্টার ভুট্টোর সাফল্য ও সৌভাগ্য কামনা করি।
(এপি, রয়টার, লন্ডন, ৮ জানুয়ারি ১৯৭২)
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হওয়ার মাত্র ১০ দিন পূর্বে ৫ আগস্ট ১৯৭৫ তৎকালীন পিজি হাসপাতালে ঐতিহাসিক ‘সমকাল’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্প্রাদক সিকান্দার আবু জাফর মৃত্যুবরণ করেন।
প্রথমে পিতৃসম ‘দাদাভাই’য়ের, অতঃপর জাতির জনকের মৃত্যু শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরকে শোক-বিহ্বল করে ফেলে। কে এখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পশ্চাদ্গতি রোধ করার কাজে সাময়িকপত্র হাতে সাংস্কৃতিক সংগ্রামে আত্মাহুতিদানের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বেন? যেমন পাকিস্তান আমলে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন অসীম-সাহসী বীর-সেনানী সিকান্দার আবু জাফর?
শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর শোককে পরিণত করলেন ‘শক্তি’তে। সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য তিনিই ‘সমকাল’ পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের সংকল্প গ্রহণ করলেন। ‘এবারের সংগ্রাম চলবেই’ বলে অগ্রজের উত্তোলিত সংগ্রামের পতাকা তুলে নিলেন যোদ্ধা চারুশিল্পী। হজরত ইমাম হোসেনের রক্তরঞ্জিত দুঃসহ স্মৃতিবক্ষে ধারণ করে, তদীয় পুত্র জয়নুল যেভাবে ক্রোধোন্মত্ত রুদ্ররূপে কারবালা প্রান্তরে বুদ্ধিবৃত্তিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছিলেন; তেমনি কৌশলী পদক্ষেপে যুদ্ধযাত্রার বন্দনা-সংখ্যারূপে সমকালের ‘সিকান্দার আবু জাফর স্মৃতি সংখ্যা’ প্রকাশের মাধ্যমে শুভ উদ্বোধন ঘটালেন ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ’, আর ‘পাকিস্তানি-আদলের বাংলাদেশ’ গড়ার প্রতিরোধক কার্যক্রমের।
কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না এ কাজ। খুনি সামরিক শাসকরা সমকাল প্রকাশের অনুমোদন ঠেকিয়ে রাখে বহুদিন। যদিও এটি ১৯৫৭ সাল থেকে চালু সুবিখ্যাত পত্রিকা।
পাকিস্তান ভাঙার কাজ করেছে ‘সমকাল’। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা তাদের চেতনার বাতিঘর। তাদের ভয় পায় পাকিস্তানি ভাবধারায় প্রত্যাবর্তনকারী তখনকার স্বৈরশাসকরাও। আবার মৃত বঙ্গবন্ধুর মতোই সিকান্দার আবু জাফরও মৃত্যুর পরেও থেকে গিয়েছিলেন অসীম বীর্যবান পৌরুষের প্রতীক। তাই তার প্রতিষ্ঠিত ‘সমকাল-এর ‘ডিক্লারেশন’ ঠেকিয়ে রাখে কার সাধ্য? তার ‘সংগ্রাম চলবেই’ সেই যে ১৯৬৭ সাল থেকে দুঃশাসকের বুকে কম্পন তুলেছিল, সে কম্পনের রিনিধ্বনি তখনো তারা শুনতে পেয়েছিল।
বিভীষিকাময় আগস্টের অত্যল্পকালের মধ্যে, ১৯৭৬ সালের পূর্বেই ‘সমকাল’ পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের অনুমোদন লাভ করল। শুরু হলো পত্রিকা প্রকাশের আন্জাম-আয়োজন। প্রকাশক মুদ্রক মালিক সব ঝক্কি-ঝামেলায় শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর। সম্পাদক কবি হাসান হাফিজুর রহমান; যিনি ছিলেন প্রথম পর্বের সহকারী সম্পাদক। বাংলাদেশ আমলে ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সাড়ে তিন বছর, ৪০ মাস সমকাল প্রকাশিত হয়। দেড় বছর পর, দ্বিতীয় বর্ষ সপ্তম সংখ্যা থেকে তৃতীয় বর্ষ ষষ্ঠ বা শেষ পর্যন্ত সম্পাদক ছিলেন ইসমাইল মোহাম্মদ।
উল্লেখ্য, ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৬-এ আঠারো বছর হয় বলে বাংলাদেশ আমলের সংখ্যাগুলোর গায়ে লেখা হয়েছিল ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ বর্ষ। তাই এ যুগের প্রথম সংখ্যা হলো ১৮ বর্ষ ১ম সংখ্যা, মাঘ ১৩৮২। শেষ ২১ বর্ষ ৬ষ্ঠ, আষাঢ় ১৩৮৬। সিকান্দার আবু জাফরের নাম ‘প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক’ হিসেবে মুদ্রিত হতো। ইসমাইল মোহাম্মদের সম্পাদনা-কালে আবু জাফর শামসুদ্দীনের নাম ছাপা হতো ‘সম্পাদকম-লীর সভাপতি’ হিসেবে।
একালের সমকালেও সিকান্দার আবু জাফরের কালজয়ী, বীরত্বব্যঞ্জক রচনাসমূহ পুনর্মুদ্রণের মধ্য দিয়ে তাকে জীবন্ত লেখক হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। পাঠকদের কাছেও সমকাল পড়ার সময় একবারও মনে হয়নি যে, তিনি নেই। ঘোষণায় বলা হয় :
“নব-পর্যায়ে সমকালের প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হলো। এই সংখ্যাটি পুরোপুরিই প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কবি সিকান্দার আবু জাফরের স্মৃতির উদ্দেশে নিবেদিত। কবির বন্ধু-বান্ধব এবং অনুরাগীবৃন্দ তাকে যে চোখে দেখেছেন, যেভাবে বিচার করেছেন, আমরা কোনো রকম সম্পাদকীয় কর্র্তৃত্ব না খাটিয়ে তা-ই ছাপিয়ে দিয়েছি। ***বর্তমান সংখ্যাটিতে প্রকাশিত রচনাগুলোতে কবির চরিত্র-ব্যক্তিত্বের অনন্যতা সঠিকভাবে প্রকটিত হয়েছে তেমন কথা আমরা বলি না। এই সংখ্যাটিকে গুণমুগ্ধ এবং অনুরাগীজনেরা কবির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে বিচার করলেই যথার্থ হবে। ডিক্লারেশন-সংক্রান্ত নানা জটিলতার কারণে আমাদের ঘোষণা অনুসারে সমকাল বের হতে পারেনি। আমরা এই অনিচ্ছাকৃত বিলম্বের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।”
স্মৃতি সংখ্যায় প্রকাশিত অন্যতম রচনা কবি আহসান হাবীবের ‘নেতৃচরিত্র বন্ধু সিকান্দার আবু জাফর’ শীর্ষক স্মৃতিকথার একটি উক্তি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন :
“.... বন্ধুমহলে জাফর ছিল ব্যতিক্রম চরিত্রের বন্ধু, প্রায় মুরুব্বীর মত। ঢাকায় এসে দেখেছি, সমকালের লেখা দিতে কেউ দেরী করলে মিনমিনে গলায় অনুরোধ জানাতো না কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের লেখককে। সোজা বলে দিতো, কাল দিনের মধ্যে... কাউকে-বা বলতো, লেখাটি কালই দেবে, না হলে গু-া লাগিয়ে রাস্তায় ঠ্যাং ভেঙে দেব। এমন যে জাফর, সে যে মৃত্যুর পরেও কারও গলা টিপে ধরে লেখা আদায় করতে পারে, এও যেনো বিশ্বাস করা চলে। কিন্তু কোথা থেকে জাফর পেয়েছিলো এই জোর? পেয়েছিলো তার নিজের মধ্যেই। তার ভালোবাসায় কৃত্রিমতা ছিলো না।...”
অনুজ সৈয়দ জাহাঙ্গীরও ছিলেন প্রকৃতপক্ষে ব্যাঘ্র-প্রকৃতির পুরুষ। তাই চার-পাঁচ মাসের মধ্যে প্রকাশের অনুমোদন তিনি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দুর্দান্ত সব ‘বঙ্গবন্ধুবিষয়ক পঙ্ক্তিমালা’ পত্রিকায় প্রকাশের পরও নিবন্ধন বাতিল রোধ করে রাখতে পেরেছিলেন। অন্যান্য পত্রিকায় যেখানে ‘জয় বাংলা’, ‘৩২ নম্বর’, ‘শেখ মুজিব’ প্রভৃতি উচ্চারণ করত না ভয়ে, তখন সমকাল তা করেছে উন্মুক্ত মঞ্চের মতো।
‘সিকান্দার আবু জাফর স্মৃতি সংখ্যা’য় লিখেছিলেন আবুল ফজল, মোহাম্মদ মোদাব্বের, আবুজাফর শামসুদ্দীন, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, কামরুল হাসান, আবদুল আহাদ, নির্মল সেন, সুধীন দাশ, সুফিয়া কামাল, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ্, হাসান হাফিজুর রহমান, আবদুল হাফিজ, এব্নে গোলাম সামাদ প্রমুখ।
বঙ্গবন্ধুর চেহারা ও স্বভাবের সঙ্গে সাদৃশ্য ছিল তার বন্ধু সিকান্দার আবু জাফরের। অতএব সিকান্দার আবু জাফরকে নিয়ে লিখলে মনে হয় বুঝিবা বঙ্গবন্ধুকেই আঁকা হচ্ছে! অবরুদ্ধ মানসের পাঠককুল বীর-রসাত্মক সাহিত্য-পাঠের মধ্য দিয়ে খেদ-ক্লেদ মুক্তির আনন্দদায়ক আস্বাদ লাভ করলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ যখন লিখলেন ‘আত্মপ্রতিকৃতি’ (সিকান্দার আবু জাফরকে স্মরণ করে) তখন এক শাশ্বত শৌর্যবানের প্রতিকৃতিই মূর্ত হয়ে উঠল :
“... ... কি ভালো লাগতো আমার যদি সুন্দর বনের বাঘ/হয়ে আমি জন্মাতাম/কি ভালো লাগতো আমার যদি আমার ঘাড়ের উপরে/থাকতো সিংহের কেশর/ও সব পাইনি;
তবে একরাশ কেশ আছে থমকে দাঁড়ানো ঘূর্ণিঝড়/তার নিচে ম্যাকমি কলার ফুটানি করছি না যদিও ভিতরে/ঘাম চিটচিটে ময়লা গেঞ্জি ফালগুন-ছোপ শার্ট পরে/আমি ঘুরে বেড়াই/বলতেও পারেন যুবরাজ।”
এ-ফোর সাইজ, দুই কলাম ১০৮ পৃষ্ঠার পত্রিকায় যে-চেতনা পরিস্ফুট হয়েছিল, তাতে মনে হয়েছে, ভয় নেই, অভয় রয়েছেন সঙ্গে। নির্ভয় সাংবাদিক নির্মল সেনের রচনার শিরোনামও চমৎকার : ‘জাফর ভাই : একটি সাহস’। এই নামের থেকে সাহস সঞ্চার করে ‘সমকাল’ এরপর প্রবন্ধে কবিতায় গল্পে বাঙালি জাতিকে পঁচাত্তর-পরবর্তী কালপর্বে জুগিয়েছে বরাভয়।
বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছে সমকাল। সৃষ্টি করেছে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক অমর-ঐতিহাসিক সাহিত্য-সামগ্রী। ‘স্মৃতি সংখ্যা’য় প্রকাশিত হয় সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ক্রন্দনমথিত একটি স্মৃতিকথা ‘জাফর ভাই : আমার দাদাভাই’। এই রচনায় বিধৃত আছে বঙ্গবন্ধু বিষয়ের কয়েকটি মূল্যবান মন্তব্য ও উক্তি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সিকান্দার আবু জাফরের ঐতিহাসিক কথোপকথনের দলিল শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরের এই ‘স্মৃতিকথা’ এখনো অগ্রন্থিত। এতে রয়েছে, সিকান্দার আবু জাফরের ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কেও কতিপয় জ্ঞাতব্য। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সিকান্দার আবু জাফরের কথোপকথনের অংশটি ছিল উদ্ধৃতরূপে :
“এমনি আরো হাজারো ঘটনা একের পর এক চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যেতে লাগল। আওয়ামী লীগ সরকারের ভয়ে কেউ যখন গণকণ্ঠ আর হলিডে মুদ্রণে রাজী হলেন না, তখন দাদা ভাই সম্মতি দিয়ে দিলেন। দুটি সংবাদ-পত্রই সমকাল মুদ্রায়ণের নামে প্রকাশিত হয় বেশ-কিছুদিন। পরে কোন একসময় শেখ সাহেব বলেছিলেন, তোর এত সাহস কোত্থেকে হ’ল? তোকে যদি তিন মাস ধরে জেলে রেখে দিই, তোর শরীরের যা অবস্থা এমনিতেই মরে যাবি...।”
তিনি জবাবে বলেছিলেন “কিন্তু গণতন্ত্রের নামে এই প্রহসন সিকান্দার আবু জাফরকে দিয়ে বরদাশত্ করাতে পারবে না। ‘হলিডে’ আর ‘গণকণ্ঠে’র বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার প্রমাণিত অভিযোগ যদি তোমার কাছে থেকে থাকে, তাহলে ওদের ডিক্লারেশন বন্ধ করে দাও। কেউ আপত্তি করবে না। অথচ তা না করে প্রকারান্তরে হুমকি দিচ্ছ যেন কোন প্রেস তাদের সংবাদ-পত্র না ছাপে। এটা কোন জাতীয় রসিকতা? সেই দুটি কাগজ মুদ্রণের দায়িত্ব নেয়ার মত একটিও সাহসী লোক বাংলাদেশে নেই এ কথা কেন ভাবছ?”
“ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের বন্ধুত্ব ছিল তা বলাই নি®প্রয়োজন। আক্ষেপ করে বহুবার বলেছেন, এসবই হচ্ছে, কারণ, সেই যে আমি লিখেছিলাম, ...প্রয়োজন হলে দেব এক নদী রক্ত, আসলে রক্তটা এক নদী হয়নি, হয়েছে এক খাল, তাই এ রকম হচ্ছে। দেশটাকে মুজিব যেখানে নিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে আর ফেরার পথ থাকবে না। কতবার বলেছি, লেখেন না কেন? বলতেন, কী লিখব? লিখব কার বিরুদ্ধে? জাতির পিতার বিরুদ্ধে? কিন্তু ও বুঝল না ...বুঝল না জাতির পিতার অর্থ কি? কতবার বলেছি, বন্ধু, জাতির পিতা আমরা ইতিপূর্বেও দেখেছি ...সাবধান! শোনেনি।”
দুই.
কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদী-সাহিত্যচর্চার সূচনা করা হলো সিকান্দার আবু জাফরের প্রাণ-পক্ষী ‘সমকাল ভবন’ থেকেই ১৯৭৬-এর সূচনা থেকেই, যখন কেউই ভয়ে প্রতিবাদের পথে পা-ও বাড়াননি। এই সমকালেই মুদ্রিত হয় কামাল চৌধুরীর অবিস্মরণীয় ‘রক্তাক্ত পঙ্ক্তিমালা’, নির্মলেন্দু গুণের ‘আমি আজ কারও রক্ত চাইতে আসিনি’, মহাদেব সাহার ‘আরো একজন’ বা ‘কফিন কাহিনী’, মোহাম্মদ রফিকের ‘ব্যাঘ্রবিষয়ক’ কবিতা। সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক ইতিহাসের আকর, সাহিত্য-মূল্যে ভাস্বর শতাধিক কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল সমকালে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় চৈত্রদিনের গান, বসন্তকালের আলো-হাওয়া প্রবাহিত তখন, আর এরই মাঝে আবির্ভূত হলেন বাংলার সহস্র বর্ষের সাধনার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাধিত সেই ধন্য পুরুষের জন্মশতবর্ষে বাঙালি জাতি নতুন উদ্দীপনায় তারই নির্দেশিত পথে মুক্তির রথে চলেছে এগিয়ে। জাতি পালন করছে তার পিতার জন্মশতবর্ষ, মুজিববর্ষ। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটি পালিত হয় জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস হিসেবে।
তিনি শুধু একটি নাম নন, হলেন একটি জাগ্রত ইতিহাস। একটি স্বাধীন জাতিসত্তার অপরিমেয় অহংকার, বর্ণিল ঐশ্বর্য। বঙ্গবন্ধু, বাঙালি এবং স্বাধীনতা একসূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের অস্তিত্বস্পর্শী অমর নাম। ন্যায়, সত্য, কল্যাণ এবং আত্মমুক্তির পক্ষে সোচ্চার উদার হৃদয় মহান মানুষ। কোনো প্রকার সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তাকে স্পর্শ করেনি কখনো। বাঙালিত্ব ছিল তার অহংকার। এই বাঙালিকে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক দক্ষতায়। কোটি কোটি মানুষের ইচ্ছার অনিন্দ্য কুসুম ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। বাঙালি জাতি তারই আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধজয়ের রক্তাক্ত অধ্যায়ে। সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস। জাতির শাণিত শিরায় অকুতোভয় সাহস ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দুঃসময়, হতাশার সব বাধার দেয়াল ভেঙে দীর্ঘ পরাজিত, শোষিত, বঞ্চিত জাতিকে স্বাধীনতার সূর্যস্নানে স্নাত করিয়েছেন। তাই তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম উচ্চারিত হয় ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমায় সিক্ত একটি নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নাম অবিরাম প্রতি সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্তে অক্ষয়-অম্লান। চিরদিন বাংলার আকাশে-বাতাসে-মাটিতে শৌর্যে-বীর্যে বহমান নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের প্রিয় নাম হয়ে প্রজ্বলিত যুগ থেকে যুগে।
‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ হিসেবে জেনেছেন তিনি। ঘুমন্ত জাতির প্রতিটি শিরা-উপশিরায় রক্তপ্রবাহের উত্তাপ বঙ্গবন্ধু ধারণ করতেন। তাই জাতিকে নিজের মতো করে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। হাজার বছর ধরে পরাধীন-পর্যুদস্ত থেকে থেকে যে জাতিটি আধমরা থেকে পুরো মরায় পরিণত হচ্ছিল ক্রমশ; বজ্রহুংকারে শুধু নয়, আদরে-সোহাগে প্রাণের প্রবাহে স্পন্দন তুলে একটি বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন।
অভাব, বাসস্থানের অভাব, চিকিৎসার অভাব; এই অভাবের মাঝেও তিনি মনে করলেন যে সুশিক্ষার দরকার আছে এবং এর জন্য শুরু করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। তিনি বাংলাদেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে এলেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য হলেও প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সব রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর ন্যস্ত করলেন। একই সঙ্গে তিনি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করে দিলেন। বাধ্যতামূলক ঘোষণা দিয়ে তিনি বসে থাকলেন না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে অবৈতনিক করে দিলেন। কারণ তিনি জানেন যে বাংলাদেশে বহু পরিবার আছে যাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর মতো আর্থিক সংগতি নেই। অতএব এটাকে অবৈতনিক না করলে বাধ্যতামূলক অর্থপূর্ণ হয় না। অতএব তিনি অবৈতনিক করলেন। একই সঙ্গে আবার তিনি বলে দিলেন, প্রাথমিক শিক্ষা হবে একমুখী। স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগী শিক্ষা। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি সমন্বয়ে যে শিক্ষা কার্যক্রম সেটি চালু করার জন্য তিনি নির্দেশ দিলেন। দেশে একমুখী শিক্ষা দিয়ে তিনি যে দর্শন আমাদের সামনে উপস্থিত করলেন, যেটি বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের দর্শন। সামনের বাংলাদেশ, মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ। সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ। এগুলো আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা। সেই ঘোষণায় স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা আছে যেটি বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের মধ্যে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শিশুদের একই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ শিশুদের মনে যেন কোনো বৈষম্যবোধ সৃষ্টি না হয়। যে বিত্তবান পরিবারের ছেলেমেয়েরা এক ধরনের স্কুলে যাচ্ছে। বিত্তহীন পরিবারের ছেলেমেয়েরা আরেক ধরনের স্কুলে যাচ্ছে। এই ধরনের কোনো বৈষম্য থাকবে না। বিত্তবান বিত্তহীন নির্বিশেষে সব শিশু একই পোশাকে একই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেএটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা বোঝা যায় যখন তিনি ড. কুদরত-এ খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শিক্ষা কমিশনকে তিনি বলেন, আপনারা আমাকে একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা সুপারিশ করেন। ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ১৯৭৪ সালে সম্ভবত ৭ জুন তারিখে বঙ্গবন্ধুর হাতে সেই সুপারিশ হস্তান্তর করে। বঙ্গবন্ধু সেদিন এই খসড়া রিপোর্ট গ্রহণ করে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমি অতি দ্রুত এই শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করব। এই রিপোর্টে মূল যে পরিবর্তনের কথাগুলো বলা হয়েছিল সেটি ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত থাকবে। প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি যে শিক্ষাটি এটি সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই পাঠ্যক্রমে চলবে। একমুখী শিক্ষা হবে। বঙ্গবন্ধুর যে ইতিপূর্বে ঘোষণা দেওয়া প্রাথমিক শিক্ষা হবে অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক ও একমুখী। এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কার্যক্রমে থাকতে হবে এই ছিল কুদরত[1]এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ। নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা। এই নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা এটি সাধারণ শিক্ষার কার্যক্রমে থাকবে। ছেলেমেয়েদের যাদের ইচ্ছা তারা কারিগরি শিক্ষায় যাবে, ধর্মীয় শিক্ষায় যাবে। এইখানে এসে একটি অপশন বা তাদের পছন্দ অনুযায়ী একটি ধারা নির্বাচনের একটি সুযোগ দেওয়া ছিল। পরে মাধ্যমিক পর্যায়ে নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির লেখাপড়া শেষ করে কেউ যদি উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হয় তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ ছিল। ১৯৭৪ সালেই স্বাধীন বাংলাদেশে যে সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল সেটি আজ উন্নত বিশ্ব যেভাবে শিক্ষাব্যবস্থা সাজিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে সেইরকম একটি শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ করেছিল কুদরত-এ-খুদার সেই শিক্ষা কমিশন।সেখানে প্রাথমিক শিক্ষাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল সেটি বুঝা যায় যে, প্রজাতন্ত্রের শিক্ষা খাতে যত বরাদ্দ থাকবে তার ৬৫ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে। ২০ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং ১৫ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি আমরা পিরামিড চিন্তা করি তাহলে পিরামিডের ফাউন্ডেশন বা ভিত সেটা হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। অতএব সেখানে প্রজাতন্ত্রের আর্থিক বরাদ্দের সর্বোচ্চ বরাদ্দ সেই জায়গায় দরকার আছে। কারণ এখানে প্রজাতন্ত্রের সব শিশু বাধ্যতামূলকভাবে যাচ্ছে। অতএব সব শিশুকে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়াটা এটা প্রজাতন্ত্রের দায়িত্ব এবং বঙ্গবন্ধু সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। বঙ্গবন্ধু যে কথা বলেছিলেন, শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট আমি অত্যন্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করব, সেটি আর বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়ন করতে পারলেন না। বঙ্গবন্ধুর পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরাই যেহেতু এ দেশ পরিচালনা করছে দশকের পর দশক অতএব কুদরত-এ-খুদার শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। এটাই হলো বাস্তবতা। পরে আমরা দেখেছি ১৯৭৫ থেকে ২০১০ এই পুরোটা সময় আমাদের দেশে কোনো শিক্ষানীতি ছিল না। অবশেষে ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একটি শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করে জাতিকে উপহার দিলেন। এখন আমরা সেই শিক্ষানীতি নিয়ে এগিয়ে চলছি। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর কুদরত-এ-খুদা কমিশনের শিক্ষা রিপোর্ট সেই সময়ে বাস্তবায়ন করতে পারতাম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আজ ২০২১ সালে এসে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় ধরনের উন্নয়ন আমরা লক্ষ করতাম। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে যেমন গুরুত্ব দিতেন সেইভাবে তিনি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। তিনি একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে গোটা দেশের শিক্ষা কার্যক্রম নতুন করতে সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে কেরানি বানানোর শিক্ষার যে পদ্ধতি, সেটা আমি থাকতে দেব না। এটা পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার যে সম্প্রসারণ ঘটানো, এটার জন্যও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের দেশে বিএ এমএ পাস বেকার লোকের সংখ্যা অসংখ্য। এটা নিয়েও বঙ্গবন্ধু কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কেরানিগিরির শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার প্রসারে তিনি গুরুত্বম আরোপ করেছিলেন। তিনি শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি কোনোরকম কেক কেটে বা অনুষ্ঠান করে জন্মদিন উদ্যাপন করতেন না। তিনি শিশুদের নিয়ে জন্মদিনে আনন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের দিনটিই এখন আমাদের জাতীয় শিশু দিবস। বঙ্গবন্ধু সব সময়ই শিশুবান্ধব একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। চেয়ারম্যান বাংলাদেশ সংবাদ
সংস্থা এবং সভাপতি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর।
অপেক্ষা আর মাত্র ৩ দিনের। তারপরই শুরু হয়ে যাবে ওয়ানডে বিশ্বকাপ, ইংল্যান্ডের চার বছরের রাজত্ব আরও চার বছর টিকিয়ে রাখার আর বাকিদের সেই মুকুট কেড়ে নেওয়ার লড়াই শুরু হবে গতবারের দুই ফাইনালিস্টের লড়াই দিয়েই।
শাহরুখ খানকে দিয়ে প্রোমো আর রণবীর সিংকে দিয়ে থিম সং, আইসিসি জানান দিয়েছে ক্রিকেটে বলিউডি আবেগের মিশেল ভালোই থাকবে। কিং খানের ‘জাওয়ান’ কাঁপাচ্ছে পর্দা, কাটতি বাড়ছে বক্স অফিসে; বিশ্বকাপে আইসিসির পকেট ভরবে তো?
প্রস্তুতি বলছে, ভরবে। উইকেটে হবে রান উৎসব, লড়াই হবে ধুন্ধুমার। তাতেই ২০২৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপ হবে এক ব্লকবাস্টার মেগা হিট।
মাস তিনেক আগে, বিশ্বকাপের মূলপর্বের ম্যাচগুলো যে ১০ ভেন্যুতে আয়োজন করা হবে সেই ভেন্যুগুলোর কিউরেটরদের সঙ্গে বসেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান কিউরেটর। সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছেন বিশ্বকাপের একটাই মন্ত্র, রান চাই।
বিশ্বকাপ শুরুর আগে, ভারত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যে ৩ ওয়ানডের সিরিজ খেলেছে সেই ম্যাচগুলো যদিও বিশ্বকাপের ভেন্যুতে হয়নি তবে সেই সব ম্যাচেও রানের বন্যা বয়েছে।
প্রথম দুটো ওয়ানডেতে বিরাট কোহলি-রোহিত শর্মাদের ছাড়াই অস্ট্রেলিয়ার করা ২৭৬ রান অনায়াসে তাড়া করে ৫ উইকেটে জিতেছে ভারত। পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের ঠেঙিয়ে তুলেছেন ৩৯৯ রান। তিন নম্বর ম্যাচে আবার অস্ট্রেলিয়া করেছে ৩৫২ রান, যা তাড়া করে ভারতও গিয়েছিল ২৮৬ অবধি।
উদ্বোধনী ম্যাচ হবে গুজরাতের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে। এখানে সবশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয় গত ১ ফেব্রুয়ারি, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩ ম্যাচ সিরিজের তৃতীয় টি-টোয়েন্টি। ম্যাচে শুভমান গিল করেন সেঞ্চুরি, ভারত করে ৪ উইকেটে ২৩৪ রান আর জবাবে নিউজিল্যান্ড অলআউট হয় ৬৬ রানে।
বোঝাই যাচ্ছে, উইকেটের ধরন বুঝে ব্যাট করতে পারলে ৫০ ওভারে এখানে রানবন্যা হবে। বিশ্বকাপে ভারত-অস্ট্রেলিয়া মুখোমুখি হবে চেন্নাইয়ের চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে। দুই দল এখানে মুখোমুখি হয়েছে বহুবার, পোশাকের রঙ কখনো রঙিন কিংবা কখনো সাদা হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজ কমেনি। এই মাঠে অস্ট্রেলিয়া ২৬৯ রান করে ভারতকে ২১ রানে হারিয়েছে সবশেষ ম্যাচে।
আইপিএল চ্যাম্পিয়ন চেন্নাই সুপার কিংসের ঘরের মাঠে সবশেষ মৌসুমে ধোনির ‘ইয়েলো আর্মি’ ৮ ম্যাচ খেলে ২০০ রানের ওপরে করেছে দুইবার, একবার জিতেছে অন্যবার হেরেছে। তবে দুই ইনিংসেই ২০০’র বেশি রান হয়েছে দুটো ম্যাচেই। অর্থাৎ চাইলে চেন্নাইকেও ব্যাটিং স্বর্গে পরিণত করা সম্ভব।
বিশ্বকাপের আগে দারুণ ছন্দে আছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ হারার পর টানা তিন ওয়ানডে জিতে সিরিজ তো নিশ্চিত করেছেই, টানা তিন ম্যাচে ৩০০’র ওপর রান করেছে। চতুর্থ ওয়ানডেতে তো ৪০০ পার করেছে প্রোটিয়ারা। ব্যাটিং উইকেটে তারাও যে কোনো প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। হেনরিক ক্লাসেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ৮৩ বলে খেলেছেন ১৭৪ রানের ইনিংস। বিধ্বংসী রূপে ফিরছেন ডেভিড মিলারও।
প্রোটিয়ারা প্রথম ম্যাচ খেলবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, দিল্লির অরুন জেটলি স্টেডিয়ামে। সেখানে অবশ্য সবশেষ হয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক ম্যাচেও খেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচে তারা অলআউট হয়েছিল মাত্র ৯৯ রানে। দিল্লির মাঠটা হয়তো খানিকটা স্পিনারদের দিকেই ঝুঁকবে, তবে অন্য মাঠগুলোতে প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানদের রান উৎসবে মেতে উঠতে দেখার সম্ভাবনা জোরালো। তাই অনেক সাবেক ক্রিকেটারই প্রোটিয়াদের দেখছেন শেষ চারে।
বিশ্বকাপের আগে ক্লাসেন ছাড়াও ইংল্যান্ডের বেন স্টোকস খেলেছেন ১৮২ রানের ইনিংস, দারুণ ছন্দে ইংল্যান্ডের ডাভিড মালানও। তবে সেরা ছন্দে নিঃসন্দেহে শুভমান গিল। সবশেষ ৫ ইনিংসে দুটো শতরান আর একটা হাফসেঞ্চুরি। নিউজিল্যান্ডের ড্যারিল মিচেলও আছেন দারুণ ছন্দে। দুটো হাফসেঞ্চুরি আর একটা সেঞ্চুরি সবশেষ ৫ ইনিংসে। হায়দ্রাবাদে বিশ্বকাপের অফিশিয়াল প্রস্তুতি ম্যাচে পাকিস্তানের ৩৪৫ রান কিউইরা তাড়া করেছে ৩৮ বল হাতে রেখে।
বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল মনে করেন, এই বারের বিশ্বকাপে রানবন্যায় বোলারদের জন্য কাজটা হবে কঠিন। দেশ রূপান্তরকে আশরাফুল বলেন, ‘আমাদের পেসাররা গত এক দেড় বছর ধরে খুবই ভালো করছে। তবে যেহেতু ভারতের মাটিতে খেলা, আমরা দেখেছি যে সাড়ে ৩০০’র বেশি রান হচ্ছে প্রতিটা ম্যাচে। কেউ যদি ভালো না করে, তাকে মনে রাখতে হবে যে টুর্নামেন্টে পরের ম্যাচে ফিরে আসতে হবে। একজনের দিন খারাপ যেতেই পারে, কোনো ম্যাচে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ রান উঠেই যেতে পারে। ৯টা ম্যাচের ভেতর ৪-৫টা ম্যাচে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ রান হতে পারে। তাই বোলারদের ফিরে আসার মানসিকতা থাকতে হবে।’
বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীন ফাহিমও বলেছেন যে দেড় মাসের আসরে প্রস্তুত থাকতে হবে যে কোনো কিছুর জন্যই, ‘দেড় মাসের আসর, ৯টা ম্যাচ এই সময়ে খেলতে হবে বা তারও বেশি। অনেক উত্থান-পতন হবে। যে কোনো কিছুর জন্যই তৈরি থাকতে হবে।’
রান উৎসবের বিশ্বকাপ যে হতে যাচ্ছে, তার সব রসদই মজুদ। মাঠগুলোকে করা হয়েছে ব্যাটিং স্বর্গ, বিশ্বকাপে আসার আগে সেরা সেরা ব্যাটসম্যানরাও আছেন ছন্দে। শুধু প্রশ্ন এটাই, রান উৎসবের এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে রান করবেন কে? সাম্প্রতিক সময়ের ব্যাটিংয়ের ছবিটা যে মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়।
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়া হচ্ছে না। তার পরিবারের পক্ষ থেকে করা আবেদনের ওপর গতকাল রবিবার আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে বলেছে, সাজা স্থগিত থাকাবস্থায় তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নেই।
যদি যেতে হয়, তাহলে সাজা স্থগিতের আদেশ বাতিল করতে হবে। কিন্তু সেটা করে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তবে বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি।
আইন মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিএনপি বলছে, আন্দোলনের মাধ্যমেই সুরাহার পথ বের করতে হবে। সরকারের এমন নেতিবাচক সিদ্ধান্তের পর এখন পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি দেয়নি দলটি। তবে এই ইস্যুতে ধারাবাহিক কর্মসূচি এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে যোগ হতে পারে বলে জানা গেছে।
৫৩ দিন ধরে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া। বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ও দলীয় নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা গুরুতর। বিদেশে নেওয়া ছাড়া তার উন্নত চিকিৎসা সম্ভব নয়। সম্প্রতি বিএনপির চেয়ারপারসনকে বিদেশে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ চেয়ে তার ভাই শামীম এস্কান্দার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করেন। এতে মতামত দিতে আবেদনটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এর ধারাবাহিকতায় আইন মন্ত্রণালয় এতে মতামত দেয়। এ বিষয়ে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়টি উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেছেন, তার সাময়িক মুক্তির আদেশটা বাতিল করে তাকে (খালেদা জিয়া) কারাগারে নেওয়া হলে তিনি আদালতে যেতে পারেন। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া বাসায় চিকিৎসা নেবেন এবং বিদেশে যেতে পারবেন না এমন দুটো শর্ত সাপেক্ষে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে দন্ডাদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। দরখাস্তটা নিষ্পত্তি করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে আটবার দন্ড স্থগিত করা হয়েছে।’
আনিসুল হক বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় কোনো দরখাস্ত যদি একবার নিষ্পত্তি করা হয়, সেই নিষ্পত্তিকৃত দরখাস্ত পুনর্বিবেচনা করার কোনো সুযোগ আইনে থাকে না। আমরা ৪০১ ধারার উপধারা ১, ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬ ব্যাখ্যা করে মতামত পাঠিয়েছি। আমাদের মতামত হলো, ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে যে দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে, সেটা অতীত এবং মীমাংসিত। এটা আর খোলার কোনো উপায় নেই।’
এক প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তাকে (খালেদা জিয়া) সাজা স্থগিত রেখে যে শর্তযুক্ত মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, সেটা বাতিল করে তারপর পুনরায় বিবেচনা করার সুযোগ থাকলে সেটা করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এই উপমহাদেশে ৪০১ ধারার ক্ষমতা যখন প্রয়োগ করে, তখন এটি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না বলে সিদ্ধান্তের নজির আছে। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এখন যে আদেশটা আছে, সেটা যদি বাতিল করা হয়, বাতিল করে তাকে (খালেদা জিয়া) যদি আবার কারাগারে নেওয়া হয়, তাহলে তিনি আদালতে যেতে পারেন। কিন্তু এ অবস্থায় আদালতে যেতে পারবেন না।’ খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের বিষয়টি বাতিল করা হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা অমানবিক হবে, বাতিল করব না।’
আইনমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল এক বার্তায় বলেন, ‘আজকের এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, দেশে আইনের শাসন নেই। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক ভয়ংকর তামাশা করা হচ্ছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, নির্বাহী বিভাগ চাইলেই কাউকে মুক্তি দিতে পারে।’
খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি না দেওয়ায় বিএনপি কী এখন ভাবছে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আন্দোলনের মাধ্যমেই সুরাহার পথ বের করতে হবে।’
আর গতকাল সংবাদ সম্মেলনে দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্ত পূর্বপরিকল্পিত ও গভীর নীলনকশার অংশ। মানবতাবিরোধী ও সরকারের বর্বর ইচ্ছা পূরণের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনগণ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।’
দলটির নেতাদের অভিযোগ, বিএনপির চেয়ারপারসনের বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদন আইনগতভাবে বিবেচনা না করে, রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। ফলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন সরকারের বিদায়ের ওপর নির্ভর করছে। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বিদায় করতে না পারলে বিএনপিপ্রধানের মুক্তি এবং বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলবে না। তাই এখন আন্দোলনের মাধ্যমেই এই ইস্যুর সুরাহা করতে চায় দলটি।
কায়সার কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেখানে বলা হয়েছে, তাকে “দেশে চিকিৎসা নিতে হবে”, তার বদলে “দেশে বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন” বলাই যথেষ্ট। কিন্তু দেশে চিকিৎসা গ্রহণের শর্তারোপ করা হলে তা যে চিকিৎসার বিবেচনায় না করে রাজনীতির বিবেচনায় করা হবে, সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি সাধারণ মানুষের আছে।’
অসুস্থতার কারণে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের মার্চে করোনার সময় টানা দুই বছর কারাভোগের পর সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় ফিরেছিলেন খালেদা জিয়া। পরে এ পর্যন্ত তার মুক্তির মেয়াদ আটবার বাড়িয়েছে সরকার।
এরই মধ্যে অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় তাকে বিদেশে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ দিতে পরিবারের পক্ষে ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার ২৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এ বিষয়ে আইনি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে আবেদনটি পাঠায়।
বিএনপিপ্রধানকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন ছিল ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি সরকার ইতিবাচকভাবে দেখতে পারে’। কিন্তু সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ‘বিদেশে যাওয়ার আবেদন করতে হলে খালেদা জিয়াকে কারাগারে ফেরত গিয়ে করতে হবে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের পর সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় এবারও ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত আসবে না। গত শনিবার এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লা বুলু, যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এ শঙ্কাই প্রকাশ করেছিলেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনা আছে, যেকোনো মূল্যে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকার মরিয়া। সে কারণে হয়তো খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি ঝুঁলিয়ে রাখতে চাইছে এমনটাই মনে করছে সরকারবিরোধীরা। বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দিলেই সরকারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে বলেও বিরোধী নেতাদের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে। তবে শর্ত দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসার বিষয়ে দল যাতে সম্মত না হয়, সে কথাই নেতাদের বলে রেখেছেন খালেদা জিয়া।
বিএনপির হাইকমান্ড মনে করছেন, এ অবস্থায় চলমান এক দফার আন্দোলনে খালেদা জিয়ার মুক্তি বিষয়টি থাকলেও সেটাকে আরও জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে; যাতে সরকারবিরোধী আন্দোলন বড় ধরনের মোড় নেয়।
জানা গেছে, এই ইস্যুতে ধারাবাহিক কর্মসূচি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে দলটি। আজ সোমবার রাতে দলটির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠক রয়েছে। সূত্র বলছে, জোটগত ছাড়াও দলীয়ভাবেও কর্মসূচি আসতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খালেদা জিয়ার এক চিকিৎসক জানান, হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় তার কেবিনে এক্স-রে মেশিন নেওয়া হয়েছিল গতকাল ভোরে। শ্বাসকষ্ট নিয়ন্ত্রণে না এলে সিসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ ছিল। দুপুরে তার ইসিজি ও ইকো ডায়াগ্রাম করানো হয়েছে। ফুসফুসের পানি অপসারণের জন্য তার ডান পাশে যে ক্যাথেটার লাগানো ছিল, সেটা আপাতত খুলে ফেলা হয়েছে।
লিভার জটিলতা ছাড়াও ৭৮ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী ফুসফুস, কিডনি, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। গত ৯ আগস্ট ফিরোজায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে দলীয় মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) সেটআপে কেবিনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছে।
জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ‘ওনার লিভার প্রতিস্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। সে জন্য তাকে দ্রুত বিদেশে উন্নত মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেন্টারে পাঠানো দরকার।’
সুরের মূর্চ্ছনায় মোহাচ্ছন্ন শ্রোতারা হারিয়ে যাবেন। তারপর নৃত্যের তালে মেতে উঠবে আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি ক্রিকেট স্টেডিয়াম। আগামী বুধবার (৪ অক্টোবর) বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। আয়োজনকে বর্ণাঢ্য করে তুলতে এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
এবারের বিশ্বকাপ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কী থাকছে, এ নিয়ে আয়োজক ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) এখনো চুপ। দর্শকদের চমকে দিতে এমন গোপনীয়তার চেষ্টা অবশ্য প্রায় সব আয়োজকেরাই করে থাকেন।
তবে ভারতীয় গণমাধ্যম পিটিসি পাঞ্জাবের সূত্রে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইনসাইডস্পোর্ট।
খবরে বলা হয়, বিশ্বকাপের উদ্বোধনী বিভিন্ন পরিবেশনায় থাকবেন বেশ কয়েকজন বলিউড অভিনেতা–অভিনেত্রী ও গায়ক–গায়িকা। এর মধ্যে গান পরিবেশনে থাকবেন কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী আশা ভোসলে, গায়ক ও সংগীত পরিচালক শঙ্কর মহাদেভান, কণ্ঠশিল্পী শ্রেয়া ঘোষাল ও অরিজিত সিং।
নাচের পরিবেশনায় দেখা যাবে রণবীর সিং ও তামান্না ভাটিয়াকে। রণবীর বিশ্বকাপের অফিশিয়াল থিম সংয়েও অংশ নিয়েছিলেন।
নাচ–গানের পাশাপাশি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তুলে ধরা হবে ভারতের ইতিহাস–ঐতিহ্য ও ক্রিকেট উন্মাদনা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খেলোয়াড়দের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ১০ দলের অধিনায়ক। এ ছাড়া আয়োজক বিসিসিআই ও আইসিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তো থাকবেনই।
নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আবাসন এখনো অধরা। দেশের দরিদ্র মানুষের একাংশ ভাসমান তারা ফুটপাত, পার্ক ও উন্মুক্ত স্থানে মানবেতর জীবন কাটায়। আর বড় অংশটি বস্তিতে ও নিম্নমানের পরিবেশে দিনাতিপাত করছে। সরকারের নীতিসহায়তার অভাবে স্বল্প আয়ের মানুষ বাসযোগ্য আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
বছরের পর বছর আবাসন নিয়ে নৈরাজ্য চললেও সরকারের কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় বিশ্ব বসতি দিবস পালন করছে বাংলাদেশ। এ দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ‘স্থিতিশীল নগর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও পুনরুদ্ধারে টেকসই নগরসমূহই চালিকাশক্তি’। দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা বাণী দিয়েছেন। দেশজুড়ে দিবস উদযাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। র্যালি, সেমিনার, ব্যানার ও ফেস্টুনের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হবে। পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে। টেলিভিশনে স্ক্রলও প্রচার করা হচ্ছে।
‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী, দেশে ভাসমান মানুষের সংখ্যা ২২ হাজার ১১৯। এ তালিকায় রয়েছে যারা রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, মাজার, ফুটপাত, সিঁড়ি, ওভারব্রিজের নিচে, লঞ্চ টার্মিনাল, ফেরিঘাট, মার্কেটের বারান্দায় দিন কাটান। আর বস্তিতে বসবাস করছে ১৮ লাখ ৪৮৬ জন। তারা মূলত শহর ও উপশহর এলাকায় টিনের ঘর, সেমিপাকা ঘর বা ঘিঞ্জি পাকা ঘরে বাস করে। তবে বস্তিবাসী কারা সে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০১৬ সালে সরকার আবাসন নীতিমালা করেছে। আবাসন উন্নয়ন তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। আবাসন সংকট নিরসন করতে হলে সরকারকে আবাসন তহবিল করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বস্তিবাসী, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত কারা তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে হবে। না হলে বোঝা যাবে না কত মানুষ বস্তিতে থাকে।’
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট কামাল মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারের নীতিসহায়তার অভাবে আবাসন সংকট কাটছে না। স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে আবাসন।’
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করে ৯ লাখ গৃহহীন মানুষকে চিহ্নিত করে। ইতিমধ্যে আট লাখ মানুষের গৃহের ব্যবস্থা করেছে; প্রায় ৪০ লাখ মানুষের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বাকিদের জন্যও শেখ হাসিনা ব্যবস্থা করবেন। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্যও আবাসনের ব্যবস্থার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা তার সৈনিক হিসেবে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
জানা যায়, বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার সবার জন্য আবাসন। অঙ্গীকার পূরণে সরকার নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সারা দেশে ৩০টি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, নোয়াখালী, যশোর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, মাগুরা, শরীয়তপুর, নড়াইল, খুলনা, মৌলভীবাজার, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এসব প্রকল্পে ৬ হাজার ৪৩২টি পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ২৭টি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১৪টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পে ৫ হাজার ৯৩০টি পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থা হবে। শেরপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, হবিগঞ্জ, সিলেট, ঝিনাইদহ, ঝালকাঠি, মাদারীপুর, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে ১৩টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১ হাজার ৯৩৫টি পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় রাজউক পূর্বাচল, ঝিলমিল, উত্তরা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় আবাসন প্রকল্পে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ফ্ল্যাটগুলো উচ্চমূল্যের কারণে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। পূর্বাচল, ঝিলমিল ও উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প গ্রহণ করছে সরকার। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনেও বিভিন্ন সংস্থা আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন শহরে বসবাসরত সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সম্পদশালী ব্যক্তিরা। যাদের অনেক ফ্ল্যাট আছে তারা আরও ফ্ল্যাট কিনছেন। কিন্তু বাস্তুহারা, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সরকারি এসব আবাসনের সুবিধা পাচ্ছেন না। অল্প দামে জমি অধিগ্রহণ করে সরকার আবাসন প্রকল্প তৈরি করে যাদের নামে বরাদ্দ দিচ্ছে তারা রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে জমির মালিক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত।
জাতিসংঘ ১৯৮৫ সালে বিশ্ব বসতি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৬ সাল থেকে সারা বিশে^ অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার এ দিবসটি পালিত হয়।
শিশুরাই আগামী দিনের কান্ডারি। তাদের হাতেই অর্পিত হবে আগামী দিনের নেতৃত্ব। দেশের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে শিশুদের সুন্দর, স্বাভাবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুদের সুস্থ, সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার গুরুত্ব অনুভব করে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। এর ফলে শিশুদের জন্য ‘হ্যাঁ’ বলুন, সবার আগে শিশু ইত্যাদি স্লোগান যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি শিশু অধিকার নিয়ে কাজও হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বাংলাদেশের সফলতা দৃশ্যমান। বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ছেলের ক্ষেত্রে ২১ এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর নির্ধারণ করেই সরকার দায়িত্ব শেষ করেনি, বরং তা পালিত হচ্ছে কি না তাও নজরদারিতে রেখেছে। ফলে, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের ঘটনা এখন নেই বললেই চলে। বরং, পত্রপত্রিকায় বাল্যবিয়ে প্রতিহত করতে পাত্র/পাত্রীর সহপাঠী, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তার (ইউএনও, সমাজসেবা অফিসার) ভূমিকার কথা প্রকাশিত হয়। কিন্তু এর উল্টোচিত্রও রয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশু দিবস। প্রতিবছর ২০ নভেম্বর জাতিসংঘ বিশ্ব শিশু দিবস পালন করে। তবে অন্যদিনেও এই দিবসটি পালনের নজির রয়েছে। যেমন ভারতে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জন্মদিন ১৪ নভেম্বর শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়। আমাদের দেশেও ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস এবং এরপরের এক সপ্তাহ শিশু অধিকার সপ্তাহ হিসেবে পালন করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এই কর্মসূচিগুলোর সুফল ইতিমধ্যেই পরিলক্ষিত হয়েছে।
নাগরিকের পাঁচটি মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা; যা শিশুদের জন্যও প্রযোজ্য তার শতভাগ বাস্তবায়ন দেখা যায় না। রাতে ফুটপাতে শুয়ে থাকা পথশিশু, দিনের বেলা পার্ক-রাস্তার ফুল বিক্রেতা শিশু, লেগুনার হেলপার, খাবার হোটেল, চায়ের দোকানে ফুট-ফরমাশ খেটে দুবেলা আহার জোগানো শিশুরা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত নয়। শুধু যে নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র শিশুরাই আমাদের অবিমৃশ্যকারিতার শিকার তা নয়। ঝুঁকিতে পড়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াও।
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে লাগাতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কোচিং ক্লাসের চাপ, জিপিএ ৫ পাওয়ার জন্য অভিভাবকের চাপ সব মিলিয়ে শিশু-কিশোররা অতিক্রম করছে এক ক্রান্তিকাল। পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্য বাবা-মা ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাদের ওপর যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে তার ফলাফল দেখা যায় প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় কাক্সিক্ষত ফল না পাওয়ায় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা।
পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের মৌলিক অধিকার পাঁচটি হলেও একজন শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য দাবি করে আরও বেশি। তার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন খেলাধুলার সুব্যবস্থা। রাজধানীসহ সারা দেশে আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে খেলার মাঠ। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসারে যেকোনো এলাকায় প্রতি পাঁচ হাজার মানুষের জন্য একটি করে খেলার মাঠ প্রয়োজন। যে মাঠের আকার হতে হবে এক একরের। ঢাকার শহরের জনসংখ্যা যদি আড়াই কোটি ধরা হয় তাহলে এই বিশাল জনসংখ্যার জন্য মাঠের প্রয়োজন হবে পাঁচ হাজার। কিন্তু ২০০০ সালের এক জরিপ অনুসারে এই মাঠের সংখ্যা মাত্র ১৫০টি। গত ২৩ বছরে এই সংখ্যা আরও হ্রাস পেয়েছে বলাই বাহুল্য।
মাঠহীন এই শহরে শিশুদের জন্য তৈরি হয়েছে আরেকটি ফাঁদ ফাস্ট ফুড দোকানের প্লে-জোন। প্লে-জোন নির্মাণ করে শিশুদের মনোযোগ আকর্ষণ করছেন ফাস্ট ফুড ব্যবসায়ীরা। ফাস্ট ফুড শিশু স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। ফাস্ট ফুড শিশুদের বার্গার, স্যান্ডউইচ, পেস্ট্রি, কেক, সফট ড্রিংকসের কুফল সম্পর্কে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা নানাভাবে আমাদের সতর্ক করেছেন। ফাস্ট ফুড ও সফট ড্রিংকস গ্রহণের ফলে অতি স্থূলতা, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, অ্যালার্জির সমস্যা, ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতা সৃষ্টি হতে পারে।
স্বাভাবিকভাবেই খেলার মাঠহীন এই খাবারের দোকানগুলো শিশুদের ভীষণ প্রিয়। আর এই সুযোগটিই নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। প্লে-জোন সংযুক্ত এই বিশেষ দোকানের খাবারের মূল্য অন্য সাধারণ দোকানের থেকে অনেক বেশি। কিন্তু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে এই বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হয় অভিভাবকদের। খেলার মাঠের সংকট সৃষ্টি করেছে ইনডোর প্লে-শপ। এই ইনডোর প্লে-শপে খেলার জন্য ঘণ্টা অনুসারে অর্থব্যয় করতে হয় অভিভাবকদের। দোকান অনুসারে এই অর্থ ঘণ্টাপ্রতি ৩৫০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
চিকিৎসা, শিক্ষা থেকে শুরু করে এখন খেলাধুলার মতো মৌলিক অধিকারও যখন অর্থের বিনিময়ে কিনতে হয়, তখন বলা যায় না আমাদের শিশুরা নিরাপদ আছে, বলতে হয় তাদের শৈশব নানা চাপে সংকুচিত হয়ে আছে। একটি নিরাপদ, বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার শুধু নথিতে পড়ে রবে না, বাস্তবায়িতও হবে বিশ্ব শিশু দিবসে এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিশ্বকাপের দল ঘোষণা নিয়ে চলছে নানা নাটকীয়তা। রাতটা পোহালেই বাংলাদেশ দল উড়াল দেবে ভারতের গোয়াহাটিতে। তবে এখনও ঘোষণা করা হয়নি দল। বিসিবি জানিয়েছে, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে চলমান তৃতীয় ওয়ানডের ম্যাচ শেষেই জানানো হবে বিশ্বকাপের দল।
প্রচুর আলোচনা ও জল্পনা–কল্পনার পর আজ বিশ্বকাপে নিজেদের স্কোয়াড ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বিসিবির ফেসবুক পেজে আজ দুপুর ১টা ২৮ মিনিটে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। সেখানে দেখা যায় বিসিবির লোগোসংবলিত বক্সে করে গুরুত্বপুর্ণ কিছু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভিডিও–র শেষে প্রশ্ন করা হয়েছে, বলুন তো ভেতরে কি?
বিকেল ৫টা ৪৩ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় সন্ধ্যা পৌণে ৬টায় ঘোষণা করা হবে দল। কিন্তু ৫টা ৪০ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় তৃতীয় ওয়ানডের শেষেই দল ঘোষনা করা হবে।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।