সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

কে এই সিনিয়র বুশ?

আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০১৮, ১১:৪৮ এএম

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ হারবার্ট ওয়াকার (এইচ ডব্লিউ) বুশ ৩০ নভেম্বর সকালে মারা যান। দেশটির ৪১তম এই প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তারই ছেলেই জর্জ ডব্লিউ বুশ হয়েছিলেন দেশটির ৪৩তম প্রেসিডেন্ট। বাবা-ছেলে দুজনই প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন রিপাবলিকান পার্টি থেকে।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসয়ের মিলটন শহরে ১৯২৪ সালের ১২ জুন জন্মগ্রহণ করে এইচ ডব্লিউ বুশ। ১৯৬৬ সালেই তিনি দেশটির প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর দুই মেয়াদে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে তিনি নিজেই দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি বিল ক্লিনটনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। পরে বিল ক্লিনটনকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তার ছেলে ডব্লিউ বুশ।

রিগানের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই ১৯৬৩ সালে হ্যারিস কাউন্টির রিপাবলিকান পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বুশ। এরপরেই সিনেট সদস্য হওয়ার প্রচেষ্টা চালান তিনি। অবশ্য দুই বছর পর সফলতার মুখ দেখে তার ক্যাম্পেইন এবং দুই মেয়াদে প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য হন। পরবর্তীতে দেশের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এর মধ্যে ১৯৭১ সালে জাতিসংঘে মার্কিন প্রতিনিধি নিয়োগ পান। চীনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করে। এরপর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ডিরেক্টর হন ১৯৭৬ সালে।

এইচ ডব্লিউ বুশ ১৯৬৪ সালে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেওয়ার আগে টেক্সাসের একজন তেল ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ৪০ বছর বয়সেই একজন মিলিয়নিয়ার হন। যদিও জীবনের শুরুটা হয়েছিল তার পাইলট হিসেবেই। পাইলট হিসেবেও অসাধারণ দক্ষতা দেখান তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনিই এখন পর্যন্ত মার্কিন ইতিহাসে একমাত্র পাইলট, যিনি সবচেয়ে কম বয়সে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

তিনি ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট পদে পার্টির মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হন। এই দৌড়ে রোনাল্ড রিগান মনোনয়ন পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু রিগান ঠিকই নিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট বানিয়ে হোয়াইট হাউজে নিয়ে আসেন তাকে। রিগান পরাজিত করেছিলেন ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারকে। তবে পরবর্তীতে মনোনয়ন পেয়ে তিনি হোয়াইট হাউজের শীর্ষ আসনে চলে আসেন এইচ ডব্লিউ বুশ। ১৮৩৭ সালের পর ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে তিনিই প্রথম প্রেসিডেন্ট হন মার্কিন ইতিহাসে।

প্রেসিডেন্ট থাকাকালে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিতে মুন্সিয়ানা দেখান বুশ। তার দায়িত্ব নেয়ার কয়েক মাস পরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার জন্য তাকে দায়ী করা হয় অনেকটা। স্নায়ুযুদ্ধের শেষ দিকে তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেন্ট স্কুক্রফ্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকারকে নিয়ে দেশের জন্য কাজ করেন।

তার পররাষ্ট্রনীতিকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিলেন ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। ১৯৯০ সালের আগস্টে সাদ্দাম হোসাইন কুয়েতে হামলা চালান। এসময় বুশের সিদ্ধান্তে গঠিত কোয়ালিশনের অভিযানে কুয়েত থেকে পিছু হটে ইরাক। দেশটির সরকার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সহয়তা চাইলে সিনিয়র বুশ তাতে সাড়া দিয়ে চার লাখের বেশি মার্কিন সেনা কুয়েত পাঠান তিনি। এ ঘটনাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বুশের বড় ধরনের সাফল্য হিসেবে দেখা হয়।

প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গেও নিরাপদ কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন রিপাবলিকান পার্টি থেকে নির্বাচিত এ প্রেসিডেন্ট। আলোচনার মাধ্যমে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সংকট সমাধানের পথও তিনিই দেখান। তার দেখানো সেই পথ ধরেই বিল ক্লিনটনের শাসনামলে ‘অসলো চুক্তি’ হয়।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য কুড়ালেও নিজের ঘরে এক পর্যায়ে বুশ জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেননি। ১৯৯২ সালে মার্কিন ইতিহাসে বড় ধরনের অর্থনীতি ধস মোকাবেলায় ব্যর্থ তিনি। এর ফলে দ্বিতীয় মেয়াদে তাকে আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখা যায়নি। শুরুর দিকে তুমুল জনপ্রিয়তা থাকলেও শেষের দিকে এসে এই ঘটনার জন্যই দ্বিতীয়বার তাকে নির্বাচিত করেনি মার্কিনরা।

প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব শেষেও দেশের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা রেখে গেছেন গেছেন তিনি। ২০০৫ স্মরণকালের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হ্যারিকেন ক্যাটরিনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে তিনি এগিয়ে আসেন। দুর্যোগ মোকাবেলায় একসাথে কাজ করেন সেসময়কার ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সাথে, যার কাছেই তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। হ্যারিকেনে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিতে একসঙ্গে গঠন করেছিলেন বুশ-ক্লিনটন ফান্ড। কয়েক মাসেই তারা ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ সংগ্রহ করতে সমর্থ হন।

বিল ক্লিনটনের কাছে হারলেও ডেমোক্রেটদের থেকে ঠিকই তিনি ক্ষমতা ফিরিয়ে আনেন নিজের ছেলে জুনিয়র বুশকে দিয়ে। ছেলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মনোনয়ন এবং নির্বাচিত হওয়ার পেছনে বড় ধরনের ভূমিকা ছিল তার। নির্বাচনী প্রচারণায় সিনিয়র বুশের তৎপরতা গভীর প্রভাব ফেলেছিল ছেলেকে জিতিয়ে আনতে।

রিপাবলিকান হয়েও ২০১১ সালে আরেক ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কর্তৃক তিনি ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’-এ ভূষিত হন।

২০১২ সালে ৮৮ বছর বয়সী এ সাবেক প্রেসিডেন্ট কফজনিত অসুস্থতায় হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর থেকে তার শারীরিক পরিস্থিতি অবনতির দিকে যেতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি রক্তসংক্রামক রোগে ভুগছিলেন। একপর্যায়ে তিনি হুইলচেয়ার ছাড়া চলতে পারতেন না। চলতি বছরের এপ্রিলে স্ত্রী বারবারা বুশ মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পর তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়।

নিজের শারীরিক অক্ষমতার মধ্য দিয়েও এ বছর জুলাইয়ে অনন্য এক দৃষ্টান্ত দেখান। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত ছেলের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে তিনিও তার মাথার চুলে ফেলে দিয়ে ন্যাড়া হয়ে গিয়েছিলেন। বুশ এবং তার স্ত্রী দুইজনে তার জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করেন।

এত সাফল্যের পরও নেতিবাচক কর্মকাণ্ডেও সমালোচিত ছিলেন তিনি। বিশেষ করে ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে। এই বছর নারীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার বিরুদ্ধে আলোচিত ‘মি টু’ আন্দোলনে  প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও হলিউড নেতাদের সাথে তার নামও উচ্চারিত হয়। হলিউডের দুই অভিনেত্রী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, মঞ্চে হুইল চেয়ারে বসেই আলাদা আলাদা ঘটনায় দুইজনের নিতম্বে স্পর্শ করেছিলেন তিনি এবং মঞ্চেই অশ্লীল কৌতুক শুনিয়েছিলেন। তবে এ অভিযোগের পর তার আচরণে কেউ মনক্ষুন্ন হলে ক্ষমা চান তিনি।

চলতি বছরের ২৫ নভেম্বর মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সী সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে জীবিত ছিলেন তিনি। সেইদিন তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর ১৬৬ দিন। যদিও আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এখনো জীবিত আছেন, তবে বয়সে বুশের চেয়ে কয়েক মাস পিছনে তিনি।

শেষ বয়সে বেশিরভাগ সময় তিনি হস্টন বা কেনেবাঙ্কপোর্টে নিজের বাড়িতেই থাকতেন। তার স্ত্রী বারবারা বুশের সাথে ছিল তার ৭০ বছরের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তাকে বিয়ে করেন তিনি। সেসময় প্রেমিকা বারবারার বয়স ছিল ১৬। অল্প বয়সে তিনি ফিলিপ ম্যাসাচুসেটসে বিমান বাহিনীর ফিলিপ একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন বারবারার সাথে তার প্রেম শুরু হয়। মৃত্যুর সময় পাঁচ সন্তান এবং তাদের স্ত্রী, ১৭ নাতি-নাতনি, আট প্রপৌত্র এবং দুই ভাইবোন রেখে যান।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত