বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৭৮৬ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। রোববার মনোনয়ন বাছাইয়ে বাদ পড়েন বিএনপি ও জাতীয় পার্টির ’হেভিওয়েট’ অনেক নেতা।
ঋণখেলাপি, কারাদণ্ডাদেশ পাওয়াসহ নানা কারণে দুই দলের কয়েক ডজন নামিদামি প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়।
তবে মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া প্রার্থীরা ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনে আপিল করতে পারবেন। আপিলের ওপর শুনানি হবে ৬, ৭ ও ৮ ডিসেম্বর।
সোমবার ২২ মনোনয়নপ্রত্যাশী রাজধানীর নির্বাচন কমিশন ভবনে মনোনয়ন ফিরে পেতে আপিল করেন।
বাদ পড়াদের অধিকাংশই বিএনপির প্রার্থী। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। তবে দলটির মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী (বিদ্রোহী) হিসেবে যারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাদের অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের মিত্র জাতীয় পার্টির মহাসচিবসহ দলটির কয়েকজনের মনোনয়নপত্রও বাতিল হয়েছে।
খালেদা জিয়া ছাড়া মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, বিএনপি নেতা মীর মো. নাছির উদ্দিন ও তার ছেলে মীর মো. হেলাল উদ্দিনসহ অনেক নেতার। রোববার সারাদেশে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে বাদ পড়াদের নাম ঘোষণা করা হয়।
দেখা গেছে, খেলাপি ঋণ ও আদালতে সাজার বাইরে প্রার্থীর সই না থাকা, দলীয় প্রত্যয়নপত্র ছাড়া দলের নাম ব্যবহার, হলফনামায় তথ্য গোপন, সরকারি সেবার বিলখেলাপি হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অনেকের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে।
উপজেলা, পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যারা পদে থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন, তাদের প্রায় সবার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। অনেকে পদত্যাগ করলেও পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়ার চিঠি না থাকায় মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়।
খালেদা জিয়ার তিনটি মনোনয়নপত্রই বাতিল: খালেদা জিয়া ফেনী-১, বগুড়া-৬ ও বগুড়া-৭ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। দুটি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার কথা উল্লেখ করে ফেনীর রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদ উজ জামান তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেন। খালেদা জিয়া ছাড়াও ওই আসনে বিএনপির আরেক প্রার্থী ছাগলনাইয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি নূর আহম্মদ মজুমদার এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মিজানুর রহমান ও আবুল বাশার চৌধুরীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে।
মামলায় সাজার বিষয়টি উল্লেখ করে বগুড়া-৬ ও ৭ আসনে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল করেন বগুড়ার রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ। বগুড়া-৬ আসনে বগুড়া পৌরসভার মেয়রের পদ থেকে পদত্যাগ না করায় খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এ কে এম মাহবুবুর রহমানের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে।
বিএনপি বগুড়া-৭ আসনে খালেদা জিয়ার বিকল্প প্রার্থী করেছিল গাবতলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোরশেদ মিলটনকে। তবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেননি উল্লেখ করে তার মনোনয়নপত্রও বাতিল করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
এদিকে বগুড়া-৬ আসনে জাকের পার্টির ফয়সাল বিন শফিক এবং বগুড়া-৭ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) জেলা সভাপতি মোস্তফা আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। মোস্তফা আলম আওয়ামী লীগের হয়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও দলীয় মনোনয়ন না থাকায় তা বাতিল করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
ঢাকা মহানগরে বাতিল ৫২ : ঢাকা মহানগরের মোট ১৫ আসনে (ঢাকা-৪ থেকে ঢাকা-১৮) বিভিন্ন দলের ২১৩ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। এর মধ্যে বাতিল হয়েছে ৫২টি।
বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের স্ত্রী ও ঢাকা-৯ আসনে দলের প্রার্থী আফরোজা আব্বাসের, ঢাকা-১৭ আসনে সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার, ঢাকা-৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী সেলিম ভূঁইয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। ঢাকা-৬ আসনে ১৩ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। এর মধ্যে তিনজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। ঢাকা-৫ আসনে প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ১৩ জন। এর মধ্যে চারজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। ঢাকা-৪ আসনে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন ১৫ জন। বাতিল করা হয়েছে ৬ জনের। ঢাকা-৪ আসনে বিকল্প ধারার কবির হোসেনের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে।
চট্টগ্রাম: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৫ আসনে বিএনপি নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মীর মো. নাছির উদ্দিন ও তার ছেলে মীর মো. হেলাল উদ্দিনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। মামলা রয়েছে উল্লেখ করে ওই দুজনের মনোনয়নপত্র বাতিল করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হওয়া সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ভাই ও ভাতিজার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) ও চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসন থেকে সাকা চৌধুরীর ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং তার ছেলে সামির কাদের চৌধুরী চট্টগ্রাম–৬ (রাউজান) আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। ঋণ খেলাপি বলে তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়।
কাদের সিদ্দিকীর মনোনয়নপত্র বাতিল: খেলাপি ঋণের কারণে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকীর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। তিনি টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) এবং টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। এ ছাড়া টাঙ্গাইল-১ ও টাঙ্গাইল-৬ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীসহ আরও অন্তত ১২ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। টাঙ্গাইলের জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলাম রোববার দুপুরে যাচাই-বাছাইয়ের পর ঋণখেলাপিসহ বিভিন্ন ত্রুটির কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এসব মনোনয়নপত্র বাতিল করেন।
জাপা মহাসচিব ও বিএনপির রনির মনোনয়নপত্র বাতিল: ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে পটুয়াখালী-১ আসনে জাতীয় পার্টির মহাসচিব (জাপা) এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এ ছাড়া হলফনামায় স্বাক্ষর না থাকায় পটুয়াখালী-৩ আসনের বিএনপির প্রার্থী গোলাম মাওলা রনির মনোনয়নপত্রও বাতিল করা হয়েছে। রোববার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী তাঁদের মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেন।
রেজা কিবরিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল: হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে গণফোরামের প্রার্থী অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। ঋণখেলাপির কথা উল্লেখ করে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয় বলে জানিয়েছেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহমুদুল কবীর মুরাদ। রেজা কিবরিয়া সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে। এ ছাড়াও সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীসহ তিনজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে কেয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন।
বিএনপির আসলামের মনোনয়নপত্র বাতিল: ঋণ খেলাপের কারণে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম-৪ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। বিএনপির আরেক প্রার্থী এ কে এম আবু তাহেরের মনোনয়নপত্রও বাতিল করা হয়েছে। তিনি দলীয় মনোনয়নের চিঠি জমা না দিয়ে দলটির প্রার্থী হতে চেয়েছেন।
এ আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল বাকের ভুঁইয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী সামছুল আলম হাসেমের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।
ইমরান এইচ সরকারের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। তালিকায় দেওয়া সমর্থক ভোটারের সংখ্যায় ভুল থাকায় ইমরানসহ আরও কয়েকজনের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।
দুলুসহ ৬ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল: নাটোর-২ (সদর ও নলডাঙ্গা) আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। দুটি মামলায় তার দণ্ডাদেশ থাকায় মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। জাতীয় পার্টির প্রার্থী আলাউদ্দিন মৃধার মনোনয়নপত্রও বাতিল হয়েছে।
বগুড়ার আশরাফুল ইসলাম আলম ওরফে হিরো আলমের মনোনয়নপত্রও বাতিল করা হয়েছে। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন।
তফসিল অনুযায়ী ২৮ নভেম্বর মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল।