বিভিন্ন সময় ভূমি মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ অধিদপ্তর, পরিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়া হলেও তা কখনই পর্যালোচনা করা হয়নি। এমনকি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে যারা অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। এ কারণে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার ঘোষণা এবারও কাগুজে ঘোষণা হিসেবেই থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।
নতুন ভূমিমন্ত্রী গত শনিবার চট্টগ্রামে বলেছেন, ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ সব দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব দিতে হবে। তার এ বক্তব্য সারা দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও সংশ্লিষ্ট ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নির্বিকার রয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শুধু ভূমি মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাবই নেওয়া হবে না, আমার সম্পদের হিসাবও দেব। যা আমি সবসময় প্রকাশ করে আসছি। আর সম্পদের হিসাব নিয়ে তা ফেলে রাখা হবে না। পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সর্বশেষ ২০১৫ সালে ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়া হয়। ওই বছরের ১০ মার্চ ছিল সম্পদের হিসাব জমা নেওয়ার শেষ দিন। ওই দিনের মধ্যেই ভূমি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়। তবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ভূমি সংস্কার বোর্ড, ভূমি আপিল বোর্ড, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর, জোনাল সেটেলমেন্ট অফিস, ডিসি অফিসের এলএ ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব-এর দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মহানগর ভূমি অফিস কিংবা উপজেলা ভূমি অফিসে কর্মরত এসিল্যান্ড, কানুনগো, সার্ভেয়ার, নামজারি সহকারী, অফিস সহকারী ও এমএলএসএসদের কাছে সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয় হচ্ছে নীতিনির্ধারক। আর মাঠ প্রশাসন হচ্ছে বাস্তবায়নের বিভিন্ন স্তর। বাস্তবায়ন পর্যায়ে দুর্নীতি বেশি হয়। বিশেষ করে মহানগর ও উপজেলা ভূমি অফিসের প্রতি সাধারণ মানুষের অভিযোগ বেশি। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে শুধু মন্ত্রণালয়ে কর্মরতদের সম্পদের হিসাব চাওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয়েছিল ভূমি মন্ত্রণালয়কে।
স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে কৃষি ও অকৃষি জমি, ইমারত, বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তথ্য চাওয়া হয়েছিল। অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে অলঙ্কার, শেয়ার, বীমা, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, মোটর ভেহিকল, কম্পিউটার, টেলিভিশন, এয়ারকুলার, রেফ্রিজারেটর, ওভেনসহ ব্যবহার্য সম্পদের বিবরণ দিতে বলা হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মতো সংশ্লিষ্টরা সম্পদের হিসাব জমা দিলেও তা পর্যালোচনা করে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই সময়ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব চাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী আজকের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন পূর্ণমন্ত্রীর বিরোধিতায় ওই উদ্যোগ পূর্ণতা পায়নি।
এর আগে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নেওয়া হয়। ওই হিসাবও বস্তাবন্দি হয়ে পড়ে আছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। জনপ্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওই সময়ের সম্পদের হিসাব চাওয়ার পর সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ ওই সময় রাজনীতির রাঘববোয়ালদের বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল। ট্রুথ কমিশন গঠন করে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনকারীদের স্বেচ্ছায় স্বীকার করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় কমিশনে তিন শতাধিক আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ তাদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে শতাধিক আমলাও ছিলেন। যদিও পরে এ কমিশন বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং কমিশনে স্বীকার করার পরও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। উল্টো তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়। এমনকি তাদের ধাপে ধাপে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে প্রবেশের সময় তার ও তার পরিবারের সদস্যদের দখলে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা দেওয়া বাধ্যতামূলক। একই বিধিমালা অনুযায়ী প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে প্রতি পাঁচ বছর পরপর সম্পদের হ্রাস ও বৃদ্ধি উল্লেখ করে সরকারের কাছে দাখিল করাও বাধ্যতামূলক। উল্লিখিত বিধিতে ক্যাডার কিংবা নন-ক্যাডার কর্মকর্তার কোনো উল্লেখ নেই। সব গণকর্মচারীর জন্য একই বিধান প্রযোজ্য।