বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। এতদিন মূলত পুরুষ শ্রমিকরাই মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করছিলেন। নারী শ্রমিকের সংখ্যা নেহাতই কম ছিল। সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে নারীদের পাঠানোর সম্ভাবনায় তাই নতুন আশা তৈরি হয়েছিল। দেশের নিম্নবিত্ত নারীরা এতে বেশ সাড়া দিয়েছিলেন। অনেকে বিনা খরচে বা অল্প খরচে সেখানে পৌঁছে কাজও শুরু করছিলেন। কিন্তু তাদের যাত্রা সুখকর হয়নি। সেখানকার নিয়োগকর্তারা শুধু শারীরিক নিপীড়ন ও বেশি কাজ করিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, অনেক নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাতে অনেক নারীই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এই নির্যাতনের যে চিত্র পাওয়া গেছে তা ভয়াবহ। সৌদি আরবে কর্মরত নারীদের ফেরত আনার ব্যাপারে ব্যাপক মতামতও সৃষ্টি হযেছে। ফেরত আনার প্রক্রিয়াতেই এই নারীদের একটি অংশকে সৌদি আরবে বাংলাদেশি দূতাবাসের সেইফ হোমে নিয়ে আসা হয়েছিল। দেশ রূপান্তরের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তারা শুধু তাদের সৌদি নিয়োগকর্তাদের হাতেই নির্যাতিত হননি, উপরন্তু সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের সেইফ হোমেও যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এটি ভীষণ উদ্বেগের।
সরকারের জনশক্তি রপ্তানিকারক ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সর্বশেষ তথ্যমতে, সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিক আছে প্রায় সাড়ে ৩৬ লাখ। তাদের মধ্যে নারী প্রায় ৩ লাখ। নির্যাতনের শিকার হয়ে গত চার বছরে সাড়ে ছয় হাজার নারী ফেরত এসেছেন। এদিকে এ বছর এরমধ্যে ফিরে এসেছেন চার শতাধিক। ফেরার অপেক্ষায় সেইফ হোমে আছেন আরও পাঁচ শতাধিক। সৌদিতে নিপীড়িত হয়ে দেশে ফেরত আসা ৯১ জন নারী শ্রমিক দূতাবাসের সেইফ হোমে যে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন তা খুবই আশঙ্কার এবং লজ্জাকর। তাদের অভিযোগ সেইফ হোমের কিছু অসাধু কর্মকর্তা তাদের ওপর শুধু যৌন নির্যাতন চালিয়েই ক্ষান্ত হননি তাদের পতিতাবৃত্তি এবং ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করেছেন। এর জেরে সেখানে একজন নারীর আত্মহত্যা ও দুইজন কর্মচারীকে বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে। তাই দ্রুত এই সব অভিযোগকে আমলে এনে দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনার উদঘাটন এবং কেউ যদি দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনুনাগ ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগ পুরনো ও সর্বজনবিদিত এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি নেপাল, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ সেখানে গৃহকর্মী হিসেবে নারী শ্রমিক পাঠানো স্থগিত রেখেছে। এরপরও বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী পাঠানো শুরু করে। প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, ২০১৫ সালে শ্রমিক পাঠানোর চুক্তিতে নানা ধরনের দুর্বলতা রয়েছে যার খেসারত দিতে হচ্ছে নারী শ্রমিকদের। তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) দেশগুলোর মধ্যে বাহরাইন ছাড়া অন্য দেশগুলোর শ্রম আইনে গৃহকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিতের সুযোগ নেই। আইনি সুরক্ষা না থাকায় কম বেতন কিংবা বিনা বেতনে কাজ করা, কাজের সময়ের কোনো পরিসীমা না থাকা, ছুটি না থাকা, শারীরিক-মানসিক নির্যাতনসহ সব ধরনের নিপীড়নের ঝুঁকি থাকে নারী গৃহকর্মীদের। কাজেই সুরক্ষার এ দিকগুলো নিশ্চিত করার আগেই তাড়াহুড়া করে সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি করাটা সুচিন্তিত হয়নি। গৃহকর্মীদের অধিকার, নিরাপত্তা ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। কিন্তু এখন এর প্রতিফলনও দেখা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ফেরত আসা নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সরকারকে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি সেইফ হোমে যাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে তারা যদি প্রকৃত দোষী হয় তবে তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করার ব্যবস্থা করা, নির্যাতিতদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রাপ্য মজুরি নিশ্চিত করা জরুরি। নির্যাতিতদের যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে এনে তাদের পরিবারে পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি। বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর সংবেদনশীল সক্ষমতা ও কার্যকারিতাও নিশ্চিত করতে হবে। শারীরিক-মানসিক নির্যাতনে জর্জরিত, নিঃস্ব হয়ে ফেরত আসা এসব নারীর বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া যেমন এখন জরুরি, তেমনি সামাজিকভাবে তাদের যাতে কোনো হয়রানির শিকার হতে না হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।