দেশে দীর্ঘদিন ধরে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সিনথেটিক ড্রাগস বা কৃত্রিম মাদক ইয়াবা নিয়ে। মিয়ানমারে তৈরি করা এই ট্যাবলেট মূলত বান্দরবান-কক্সবাজারসহ কয়েকটি সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে পাচার হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব বড় নগর-বন্দর-শহরের পাশাপাশি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে বিষাক্ত মাদক ইয়াবা। নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও দেশের লাখ লাখ কিশোর-তরুণ-যুবকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ বিগত এক দশকে ইয়াবাসেবীতে পরিণত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ইয়াবার বিপুল বিস্তার দেশে গত শতকের আশি-নব্বই দশকে ফেনসিডিল নামক সিরাপ সেবনে নেশার মারাত্মক বিস্তারের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে ইয়াবার ক্ষতি ও ব্যাপকতা আরও মারাত্মক। ইয়াবা সেবনের কারণে œায়বিক বৈকল্য, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, কিডনি নিষ্ক্রিয় হওয়া, ফুসফুসে পানি জমা, যৌন ও প্রজননক্ষমতা নষ্ট হওয়া এবং লিভার সিরোসিস থেকে ক্যানসারের আশঙ্কার কথা বলে আসছেন চিকিৎসকরা।
গত বছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরুর সময় থেকে ইয়াবা নির্মূলের প্রসঙ্গটি আবার সামনে আসে। এ সময়ে র্যাব-পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একের পর এক মাদকপাচারকারী নিহত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর বিশেষ অভিযান। কিন্তু অভিযোগ আছে, দেশজুড়ে এসব অভিযানে ইয়াবা কিংবা মদ-গাঁজাসহ অন্যান্য নেশাদ্রব্য সেবনকারীরা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছোট কারবারিরা শাস্তি ও হয়রানির শিকার হলেও ইয়াবা সরবরাহ ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত বড় চক্রগুলো নির্বিঘেœ কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে। বিশেষত, সীমান্তবর্তী এলাকায় ইয়াবার পাচারকারী এবং শীর্ষ কারবারিরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী কক্সবাজার ও বান্দরবানের উখিয়া-টেকনাফ-নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা দেশে ইয়াবার প্রবেশ এবং সরবরাহ নেটওয়ার্কের কেন্দ্রস্থল। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা প্রতিবেদনে এখানকার ইয়াবা পাচার ও ব্যবসার সঙ্গে পুলিশ-র্যাব-বিজিবি এবং প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রভাবশালী রাজনীতিকদের সংশ্লিষ্টতার কথা উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলে থাকেন, পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবে পরিচিত একটি অংশ মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে বেশি তৎপর ইয়াবা পাচার ও সরবরাহের নেটওয়ার্কে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে বিষয়গুলো এক রকম ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে থাকলেও সরকার এসব পাচারকারী ও ব্যবসায়ীচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই প্রতীয়মান।
দেশ রূপান্তরে কয়েকদিন ধরে প্রকাশিত ধারাবাহিক সরেজমিন প্রতিবেদনে কক্সবাজার-বান্দরবানে ইয়াবা কারবারের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। কয়েক বছরের ব্যবধানে ইয়াবা কারবারিদের সম্পদের পাহাড় গড়ে ওঠা এবং তাদের দ্রুততম সময়ে ক্ষমতার শীর্ষে উঠে যাওয়ার ঘটনায় বোঝা যায়, সেখানে কী মচ্ছব চলেছে এতদিন। এখনো ওই তিন উপজেলার ৩৮টি স্থান দিয়ে ইয়াবার চালান আসছে বলে সরেজমিনেই দেখা গেছে। পাশাপাশি সেখানে ইয়াবা কারবারিদের কথিত আত্মসমর্পণ নিয়ে রমরমা বাণিজ্য চলতে দেখা গেছে। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে দালালচক্র এসব কারবারিকে পুলিশের হেফাজতে নিরাপদে রাখছে বলে নানা তথ্য থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন বিষয়টিকে স্বীকার করছে না।ইয়াবা ব্যবসার ‘মাফিয়া ডন’দের নির্মূল না করে কিংবা সরষের মধ্যে ভূত
থাকার মতোই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘ছত্রছায়াতেই’ ইয়াবার পাচার ও সরবরাহ নেটওয়ার্ক চলতে থাকলে কীভাবে সমাজ থেকে সর্বনাশা এই মাদক নির্মূল করা সম্ভব? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত তালিকাতেও দেশের শীর্ষ ইয়াবা কারবারি হিসেবে বিগত ১০ বছর ধরে কক্সবাজারের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির নাম এলেও কখনোই তাকে ধরা হয়নি। অবশ্য এবার তাকে বাদ দিলেও ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন তার স্ত্রী শাহীন আক্তার চৌধুরী। সমালোচিত ওই সাবেক সাংসদের ২৬ আত্মীয়ের নাম রয়েছে ইয়াবাচক্রের অন্যতম কারবারি হিসেবে। কিন্তু তাদের ধরবে কে?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিষাক্ত মাদক ইয়াবা নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা সরকার কেউই ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। কিন্তু সমাজ থেকে ইয়াবাসহ মাদক নির্মূলে একদিকে যেমন দেশের তরুণ ও নবীন প্রজন্মের সংস্কৃতি ও বিনোদনের বিষয়ে জোরালো মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন, তেমনি অন্যদিকে প্রয়োজন ক্ষতিকর মাদক নির্মূলে সরকারের সত্যিকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এই দুইয়ের সম্মিলন ছাড়া দেশকে ইয়াবাসহ সর্বনাশা মাদকের চক্র থেকে রক্ষা করা সম্ভব না।ইয়াবা নির্মূলে বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো