‘আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিচার কার কাছে চাইব। পুলিশ তো আরও জঘন্য কাজ করল আমার সঙ্গে। এখন আল্লাহ ছাড়া আমার আর কেউ নেই। সমাজে মুখ দেখাতে পারি না। মরতেও ভয় হয়। আমি নির্দোষ হয়েও ঘরের ভেতর লুকিয়ে আছি, আর যারা নির্যাতন করল তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন পুলিশ দেখলেই মনে হয় এই বুঝি আবার ধরতে আসছে।’
চট্টগ্রামে ধর্ষণের পর ইয়াবাসহ পুলিশকে দিয়ে সাজানো মামলায় ফাঁসানো হয় এক গৃহবধূকে। তিনি চার মাস কারাভোগ করে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। গতকাল রবিবার দুপুরে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে একান্ত আলাপে তিনি আরও বলেন, ‘ভয়ংকর সেই রাতের নির্যাতনের কথা মনে পড়লে এখনো আঁতকে উঠি।’
গত বছরের ২৯ আগস্ট চট্টগ্রামে ওই গৃহবধূকে ধর্ষণের পর গাড়িতে তুলে নির্জন স্থানে ফেলে রাখা হয়। সীতাকু- থানার সাবেক ওসিসহ তিন পুলিশ গিয়ে ওই নারীর কাছ থেকে দুই হাজার ইয়াবা উদ্ধার দেখিয়ে মামলা করে। পুলিশকে সাহায্য করে গৃহবধূর স্বামীর প্রথম স্ত্রীর সন্তানসহ ১৩ জন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশ ও পিবিআইয়ের পৃথক দুটি তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের পর এই গৃহবধূ জামিনে বের হয়ে আসেন। মামলার বাদী গৃহবধূর স্বামী নাছিরউদ্দিন গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘স্ত্রীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগে আদালতে মামলা করি আমি। আদালত ডিবি পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। জামিনের আবেদন করলে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালত বিষয়টি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। এরমধ্যে আমার স্ত্রী আদালতের সামনে জবানবন্দি দেন। ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর বিষয়ে আমিও আদালতে জবানবন্দি দিয়েছি। পুলিশের করা মাদক মামলাটি প্রত্যাহার চেয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি ডিবি ও পিবিআইয়ের প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে। একই সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করা হবে।’
পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর আবু জাফর মোহম্মদ ওমর ফারুক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিষয়টি মর্মান্তিক। সম্পত্তির ভাগ না দিতে ওই গৃহবধূকে তার স্বামী নাছিরউদ্দিনের প্রথম স্ত্রীর সন্তানরা ধর্ষণের পর ষড়যন্ত্র করে ইয়াবাসহ পুলিশে ধরিয়ে দেয়। তদন্তে তিন পুলিশ সদস্য সম্পৃক্ত থাকার সত্যতা পাওয়া গেছে। একই বিষয় নিয়ে চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মঈনুল ইসলামও তদন্ত করেছেন।’
মামলাটি তদন্ত করে ঘটনার বিস্তরিত বর্ণনা দিয়ে আদালতে পিবিআই ও ডিবি প্রতিবেদন দিয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ঘটনায় জড়িতরা হলোÑ ওই গৃহবধূর স্বামীর প্রথম স্ত্রীর মেয়ে শামসুন নাহার আরজু, মেয়ের স্বামী মিজানুর রহমান সুমন, ছেলে কামরুল হাসান খোকন, খোকনের স্ত্রী রোকেয়া বেগম রেখা, খোকনের শ্যালক রাকিব, সীতাকু- উপজেলার আলী শাহ, একই এলাকার সাহাব উদ্দিন, মো. কামাল উদ্দিন, নাছির উদ্দিন, হালিশহরের মো. জহিরুল আলম ও গৃহবধূর সাবেক স্বামী মো. জোবায়ের। ওই নারীকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর সঙ্গে সীতাকু- থানার তৎকালীন ওসি ইফতেখার হাসান ও এসআই সিরাজ মিয়ার জড়িত থাকার প্রমাণও মিলেছে।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছয় বছর আগে হালিশহর থানার উত্তর হালিশহর মইন্যাপাড়া এলাকার নাছির আহমেদের প্রথম স্ত্রী মারা যান। প্রথম সংসারে তার এক ছেলে, তিন মেয়ে রয়েছে। ওই এলাকায় তার পাঁচতলা ভবন রয়েছে। সন্তানরা তার দেখাশোনা না করায় স্ত্রী মারা যাওয়ার সাড়ে পাঁচ বছরের মাথায় গত বছর ২৪ মার্চ দ্বিতীয় বিয়ে করেন তিনি। এ বিয়ে মেনে নেয়নি তার সন্তানরা। গত বছর ২৯ আগস্ট বিকেলে নাছির আহমেদ ও তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে প্রথম ঘরের সন্তান কামরুল হাসান খোকন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন; নইলে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে জেলে পাঠাবার হুমকি দেন।
হুমকি পাওয়ার পর নাছির তার স্ত্রীকে নিয়ে হালিশহর থানায় অভিযোগ করেন। সন্ধ্যায় স্ত্রীকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে চলে যান তিনি। এই ফাঁকে খোকন, রেখা, আরজু, সুমন ও রাকিব নাছিরের দ্বিতীয় স্ত্রীকে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে। রেখা ও আরজু তার গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন ছিনিয়ে নেয়। একপর্যায়ে সবাইকে বের করে দিয়ে সৎ ছেলে কামরুল হাসান খোকন তাকে ধর্ষণ করে। এরপর তাকে বেঁধে একটি মাইক্রোবাসে তোলা হয়।
পরে ওই নারীকে নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে ঝোপের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। আসামিরা চলে গেছে মনে করে ওই নারী তার শরীরের বাঁধন খোলার চেষ্টা করেন। বিষয়টি দেখে ফেলে আসামিরা। তারা তাকে পুনরায় শক্ত করে বেঁধে মারধর করলে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। তাকে আবার মাইক্রোবাসে তোলা হয়। এ সময় আলী শাহ ফোন করে কামাল উদ্দিন ও সাহাব উদ্দিনকে সীতাকু- থানার কুমিরা রয়েল গেট এলাকায় আসতে বলেন। মাইক্রোবাস কুমিরা রয়েল গেট এলাকায় পৌঁছলে কামাল ও সাহাবউদ্দিনও মাইক্রোবাসে ওঠে। রয়েল গেট থেকে কিছুদূর সামনে গিয়ে ওই নারীকে রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর মাইক্রোবাস নিয়ে সটকে পড়ে রাকিব ও নাসির।
এদিকে সেদিন রাত ১টা ২৩ মিনিটে ইয়াবাসহ একজন নারীকে আটক করা হয়েছে জানিয়ে সীতাকু- থানার এএসআই জাকির হোসেনকে খবর দেন আলী শাহ। জাকির হোসেন ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর দেখতে পান অজ্ঞান অবস্থায় এক নারী পড়ে আছে। বিষয়টি তিনি থানার তৎকালীন ওসি ইফতেখার হাসানকে জানান। ইফতেখার হাসান এসআই সিরাজ মিয়াকে ঘটনাস্থলে পাঠান। সিরাজ মিয়া এসে ওই নারীর মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরান।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, নিয়মানুযায়ী সংবাদদাতা আলী শাহকে মামলার বাদী করা হয়নি। ইয়াবা জব্দকারী কর্মকর্তা হিসেবে সিরাজ মিয়াও বাদী হননি। পরদিন আগে থেকে তৈরি করা এজাহারে ওসির নির্দেশে স্বাক্ষর করেন এএসআই জাকির হোসেন। এছাড়া নিরপেক্ষ কাউকে মামলার সাক্ষী না করে আলী শাহ, কামাল উদ্দিন ও সাহাব উদ্দিনকে সাক্ষী করেন এসআই সিরাজ। অপহরণের দিন ওসি ইফতেখার হাসান ও এসআই সিরাজ মিয়ার সঙ্গে ইয়াবাসহ নারী আটকের খবর দেওয়া আলী শাহর একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ হয়। অন্য দুই সাক্ষীর সঙ্গেও এসআই সিরাজ মিয়ার ফোনে কথোপকথনের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা।