সংখ্যায় কম হলেও বিরল রোগ জিবিএসে (গুলেন ব্যারি সিনড্রোম) আক্রান্ত হচ্ছে দেশের মানুষ। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে এ রোগ নিয়ে রাজধানীর জাতীয় নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে আসছে রোগীরা। সময়মতো শনাক্ত না হওয়ায় অনেক রোগীর হাত-পা অবশ হয়ে পড়ছে। আবার শনাক্ত হলেও খুবই ব্যয়বহুল হওয়ায় চিকিৎসা নিতে পারছে না অধিকাংশ রোগীই। এমনকি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাও যাচ্ছে রোগীরা।
গতকাল রবিবারও জিবিএসে আক্রান্ত হয়ে ১৮ বছরের এক কলেজপড়–য়া ছাত্র নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড কলেজের ওই ছাত্রের নাম রমিম হাসান। তিনি হাসপাতালের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৬১২ নম্বর কক্ষের ৫ নম্বর শয্যায় অধ্যাপক ডা. বদরুল আলমের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন।
রমিমের মা রওশন আক্তার নার্গিস গাজীপুরের একটি হাই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত কয়েক দিন ধরে রমিম শ্বাসকষ্টে ভুগছিল। শরীর অবশ হয়ে আসছিল। কিছুই খেতে পারছিল না। গাজীপুর সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসকরা রমিম বিরল স্নায়ুরোগ ‘জিবিএস’-এ আক্রান্ত হতে পারে বলে ধারণা দেন। পরে তাদের পরামর্শে নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে আনলে এখানকার চিকিৎসকরা জিবিএস রোগ নিশ্চিত করেন। ডাক্তাররা বলেছেন, রমিম জিবিএসে আক্রান্ত। প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে একজনের মধ্যে এ রোগ দেখা দিতে পারে। শিগগির চিকিৎসা শুরু করা না গেলে ওর হাত-পা মারাত্মক আকারে দুর্বল হয়ে কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি এ ধরনের রোগীদের চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। অথচ চিকিৎসা খুবই ব্যয় বহুল।’
রমিমের মা দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, ‘রমিমের ভ্যাকসিন দিতে হবে। পাঁচ দিনে ১০ লাখ টাকা দরকার। আমরা না হয় কষ্ট করে আমাদের ছেলের জন্য এ টাকা জোগাড় করলাম। কিন্তু গরিব মানুষ এত টাকা কোথায় পাবে? আল্লাহ যেন আর কারও এ রোগ না দেন।’
জিবিএস রোগ কী জানতে চাইলে নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বদরুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এটি এক ধরনের বিরল স্নায়ুরোগ। এর মূল কারণ “ক্যাম্পাইলো ব্যাকটর জেজুনি” নামে এক ধরনের জীবাণু। এই জীবাণু শরীরে বাসা বাঁধলে শরীরের জীবাণু-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। সে থেকে জিবিএস দেখা দেয়। সাধারণত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যাপক হ্রাস পেলে জিবিএস ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে। এটি অন্য ভাইরাসের মতো সংক্রামক নয়। ফলে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা নেই, তবে চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল।’
এ রোগের উপসর্গ কী জানতে চাইলে নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. সাদেকুর রহমান সরকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাধারণত ডায়রিয়া বা ইনফ্লুয়েঞ্জা জ¦রে আক্রান্ত হওয়ার প্রায় দুই সপ্তাহ পর রোগী হঠাৎ করে প্রথমে দুই পায়ে দুর্বলতা বোধ করে। যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ও ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় এই দুর্বলতা মেরুদ-, দুই হাত, বুক ও মুখের মাংসপেশিতে ছড়িয়ে পড়ে। কখনো কখনো দুর্বলতা এত বেশি হয় যে, রোগী হাত-পায়ের আঙুল একটুও নাড়াতে পারে না।’
এই চিকিৎসক আরও জানান, ১০-১২ ধরনের স্নায়ু রোগের মধ্যে জিবিএস সবচেয়ে বিরল। প্রতি লাখে তিন-পাঁচজন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হন। এই হাসপাতালে দুয়েক দিন পরপরই এ ধরনের রোগী পান তারা। ব্যয়বহুল চিকিৎসা হওয়ায় অনেকেই চিকিৎসা নিতে পারেন না। ফলে দেশে এর মৃত্যু হার ১০ শতাংশ। উন্নতবিশ্বে সময়মতো চিকিৎসা নেওয়ায় মৃত্যুহার ৫ শতাংশেরও কম।
অবশ্য এ বিরল রোগ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে জানান ডা. সাদেকুর রহমান। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যয়বহুল হলেও এ রোগের চিকিৎসা আছে। দেশে একমাত্র নিউরো সায়েন্স হাসপাতালেই এ রোগের চিকিৎসা হচ্ছে।
এই চিকিৎসক আরও জানান, রোগীকে আইভিআইজি (ইমুনো ইন্ট্রাভেনাস গ্লোবিভিন) নামে দামি ইনজেকশন দিতে হয়। এটা দেশের বাইরে থেকেও আসে। আবার দেশের ইনসেপ্টা কোম্পানিও তৈরি করে। রোগীর ওজন বুঝে ইনজেকশন দিতে হয়। ইনসেপ্টার ইনজেকশন প্রতি গ্রামের দাম ৫০ হাজার টাকা। বাইরেরটা এর দ্বিগুণ। চিকিৎসাধীন রমিমের ওজন ৯০ কেজি। পাঁচ দিনে প্রতি কেজি ওজনে দুই গ্রাম করে ১৮০ গ্রাম ইনজেকশন দিতে হবে। দাম পড়বে ৯ লাখ টাকা।
‘তবে রক্তে প্লাজমা এক্সচেঞ্জ করেও চিকিৎসা করা যায়’- উল্লেখ করে ডা. সাদেকুর রহমান সরকার বলেন, রক্ত পরিবর্তন করতে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাগে। এই হাসপাতালেই হয়। এক দিন পরপর পাঁচটি পর্বে প্লাজমা দিতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে পাশর্^প্রতিক্রিয়া কিছু বেশি। জ¦র-খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। শ্বাসকষ্টও হয়। তবে এই দুই ধরনের চিকিৎসা সমান কার্যকর।