উচ্চ আদালতের রায়ে বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে কোনো নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ বা ‘আইনি সত্তা’ ঘোষণার মর্যাদা লাভ করল বাংলাদেশ। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের বেঞ্চের এই রায়ে তুরাগ নদের সূত্র ধরে দেশের সব নদ-নদীকে একটি ‘একীভূত সত্তা’ হিসেবে উল্লেখ করা সত্যিই যুগান্তকারী। এর অর্থ দেশের সব নদ-নদী-খাল-বিল-জলাশয়ও পরস্পর সম্পৃক্ত বা একীভূত সত্তা হিসেবে একই সাংবিধানিক অধিকার ও মর্যাদা পেতে পারে। ‘তুরাগ’ নদের এই স্বীকৃতির আগে ২০১৬ সালের নভেম্বরে কলম্বিয়ার ‘আত্রাতো’ নদী, ২০১৭ সালের মে মাসে নিউজিল্যান্ডের ‘হোয়াঙ্গানুই’ নদী এবং ভারতের উত্তরাখণ্ডের ‘গঙ্গা-যমুনা’ নদী এরকম ‘জীবন্ত সত্তা’ বা ‘আইনি সত্তা’র স্বীকৃতি লাভ করে। প্রবলভাবে শিল্পায়িত এই বিশ্বসভ্যতায় নদীবিষয়ক এই রায়গুলো প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রশ্নে মানবজাতির আগামীর পথচলার দিকনির্দেশনামূলক।
প্রকৃতির সঙ্গে দেশের জনগণ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে মৌলিক সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হয় এই রায়ে। সংবিধানের তিনটি অনুচ্ছেদ তুলে ধরে যুগান্তকারী এই রায়ে বলা হয়, দেশের সব নদ-নদী-খাল-বিল-হাওর-বাঁওড়-জলাশয়-পাহাড়-পর্বত-সমুদ্রসৈকতের মালিকানা রাষ্ট্রকে নিরঙ্কুশভাবে দেওয়া হয়নি, রাষ্ট্র এখানে জনগণের পক্ষ থেকে ট্রাস্টি বা দেখভালকারী। একই সঙ্গে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে’ দেশের সব নদ-নদী-জলাশয়ের অভিভাবক ঘোষণা করে অবিলম্বে কমিশনকে স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গরূপে শক্তিশালী করার জন্য আইন সংশোধনেরও নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। এজন্য ছয় মাসের সময় বেঁধে দিয়ে আদালতে হলফনামা জমাদানের নির্দেশ এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে রায়ের কপি পৌঁছানোর নির্দেশ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। রায়ের চারটি মৌলিক সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনাসমূহ বাস্তবায়নে সরকারের যথাযথ সংস্থা ও কর্র্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।
স্পারসোর স্যাটেলাইট সার্ভের মাধ্যমে দেশের নদ-নদীগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান নির্ধারণ এবং সে-সংক্রান্ত ডিজিটাল ডেটাবেইস জেলা-উপজেলা-পৌরসভা-ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার যে নির্দেশ উচ্চ আদালত দিয়েছে তার বাস্তবায়ন বহু আগেই করা জরুরি ছিল। এই বিষয়টির সঙ্গে নদী-জলাশয়ের সীমানা নির্ধারণের প্রশ্নটি যুক্ত বিধায় তা খুবই স্পর্শকাতর। কেননা, এখানে নদী-জলাশয় তীরবর্তী ব্যক্তিমালিকানার জমি থেকে শুরু করে খাসজমিসহ নানা রকমের মালিকানার ভূমি রয়েছে। বিষয়গুলো ভূমি মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের নানা সংস্থা ও দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত।
এমতাবস্থায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী কর্র্তৃপক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই তাকে একটি সমন্বিত কার্যক্রমের আধেয় হয়ে উঠতে হবে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে সম্প্রতি সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করা বন্যা, নদীভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে বহু আলোচিত ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’-এর কথা। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে এই বদ্বীপ পরিকল্পনার সামঞ্জস্য বিধানের বিষয়টি অবশ্যই সরকারকে আমলে নিতে হবে। বদ্বীপ পরিকল্পনার সঙ্গে আদালতের এই নির্দেশনা সমন্বয় করার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
উচ্চ আদালতের এই রায়ে নদ-নদীর একটি আইনি অভিভাবক নির্ধারণ করার পাশাপাশি প্রায়োগিক ও সামাজিক পর্যায়ে নদীসংশ্লিষ্ট কতগুলো নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, নদ-নদী-সংশ্লিষ্ট কিংবা নদী-জলাশয়ের তীরবর্তী কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে হলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছ থেকে ‘অনাপত্তি’ সনদ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা এবং নদী দখলকারী ব্যক্তিকে সব ধরনের জাতীয় নির্বাচনে অযোগ্য এবং ব্যাংকঋণ গ্রহণে অযোগ্য ঘোষণা করা। একই সঙ্গে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নদীবিষয়ক সচেতনতার পাঠ প্রদানে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে অনুসরণ করাটা জরুরি।