মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৮ মাঘ ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

বাংলাদেশের সেই ‘হারকিউলিস’ এখন আলজাজিরায়

আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:০২ পিএম

বাংলাদেশে ধর্ষকদের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা ওঠে এলো কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার প্রতিবেদনে। সোমবার সংবাদমাধ্যমটিতে বলা হয়, সম্প্রতি ধর্ষণের বিরুদ্ধে জনরোষ বৃদ্ধি পাওয়ায় অভিযুক্তদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গত দুই সপ্তাহে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত অন্তত তিন ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। তাদের গলায় পাওয়া গেছে ধর্ষণের ‘স্বীকারোক্তির চিরকুট’।

ঝালকাঠির এক গ্রামে ২৬ জানুয়ারি ধর্ষণে অভিযুক্ত এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায় ধানক্ষেতে। তার গলায় চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমার নাম সজল। আমি মিতার (ছদ্মনাম) ধর্ষক। ইহাই আমার পরিণতি।’

একই মামলায় গত ১ ফেব্রুয়ারি ঝালকাঠির রাজাপুরে রাকিব নামে আরেক আসামির গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের গলায় ধর্ষণের স্বীকারোক্তি সম্বলিত লেমিনেটিং করা চিরকুট ঝোলানো ছিল।

ওই চিরকুটে লেখা ছিল- “আমার নাম রাকিব। আমি মিতার (ছদ্মনাম) ধর্ষক। ইহাই আমার পরিণতি। ধর্ষকরা সাবধান। হারকিউলিস।”

এর সপ্তাহখানেক আগে একইভাবে সাভারে রিপন (৩৯) নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। এ বছরের শুরুতে এক গার্মেন্টস কর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। নিহত রিপনের লাশের সঙ্গে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমি ধর্ষণ মামলার মূলহোতা।’

কে এই হারকিউলিস

এখনো এই হারকিউলিসের পরিচয় বের করতে পারেনি স্থানীয় পুলিশ। এছাড়া ধর্ষণে অভিযুক্তদের নিহতের ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, এ নিয়ে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে কোনো তদন্তও শুরু হয়নি।

পুলিশ সদরদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা এআইজি সোহেল রানা আলজাজিরাকে বলেন, “স্থানীয় পুলিশ তদন্ত করছে। আমরা মনে করি না সদরদপ্তর থেকে এ নিয়ে তদন্ত চালানোর প্রয়োজন আছে।”

তিনি বলেন, “যে কোনো ব্যক্তিই এ হারকিউলিস হতে পারে।”

এদিকে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা দাবি করছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাদা পোশাকের সদস্যরা এসে বাড়ি থেকে তাদের তুলে নিয়ে যায়।

রাকিবের বাবা আবুল কালাম বলেন, “ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর সে গ্রাম থেকে পালিয়ে রাজধানী ঢাকার কাছাকাছি নবীনগরে আশ্রয় নেয়। ২৫ জানুয়ারি এক বন্ধুর সঙ্গে চা খাচ্ছিল রাকিব। এমন সময় সাদা পোশাক পরা ব্যক্তিরা তাদের দুজনকেই মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়।”

তিনি বলেন, “তার বন্ধুকে ছেড়ে দেওয়া হলেও রাকিবকে আটকে রাখা হয়। বন্ধু জানায়, পুলিশ তাদেরকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তার মা স্থানীয় থানায় একটি অভিযোগ দায়ের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পুলিশ তা গ্রহণ করেনি।”

“পরে তো আমরা তার লাশ পেলাম। আমি বিশ্বাস করি, পুলিশই তাকে হত্যা করেছে” অভিযোগ করেন আবুল কালাম।

এদিকে রিপনের স্ত্রী রিক্তা বেগম বলেন, “১১ জানুয়ারি সাদা পোশাকে কিছু লোক তার স্বামীকে ঢাকার নিকটবর্তী আশুলিয়া থেকে তুলে নিয়ে যায়।” এসব লোককে তিনি পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা ডিবির লোক বলে দাবি করেছেন।

রিক্তা বলেন, “ছয় দিন পর আমরা তার লাশ পাই।”

আশুলিয়ায় ৭ জানুয়ারি ঘর থেকে ১৮ বছর বয়সী এক গার্মেন্টস নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে এ নারী তাকে ধর্ষণের একটি অভিযোগে রিপন ও তিন সহযোগীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন।

এদিকে সাভার পুলিশের ইন্সপেক্টর (তদন্ত) শওকত আলম এ ঘটনার সঙ্গে ডিবি পুলিশ জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি রিপন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করছেন।

একইভাবে রাকিব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চালানো রাজাপুর পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদ হোসাইন বলেন, “আমরা এখনো এ ঘটনার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।” তবে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সাদা পোশাকের পুলিশের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি।

এছাড়া ২৮ জানুয়ারির সোমবার রাতে চট্টগ্রামে এক মাদ্রাসা ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় সন্দেহভাজন এক ব্যক্তি পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়।

চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন জানান, এ ঘটনায় রাতে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। নিহত শাহাবুদ্দিন ও গ্রেপ্তার শ্যামল দে পেশায় গাড়ি চালক। গত ২৭ জানুয়ারি তারা দুজন অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক পরিচালক লিটন বলেন, “চারটির ধর্ষণের ঘটনায় তিনটিতেই একই উপায়ে অভিযুক্তদের হত্যা করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি উদ্বেগজনকভাবে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে। ২০১৮ সালেই ৭৩২ নারী এবং ৪৪৪ শিশুর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।”

এদিকে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এ বছর শুধু জানুয়ারিতেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৯ নারী যার মধ্যে ২২ জনই গণধর্ষণের শিকার।

এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল জানিয়েছিলেন, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ১৭,২৮৯ টি ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে দেশজুড়ে। এর ৮০ ভাগ ঘটনার তদন্তই এখনো ঝুলে আছে।

লিটন বলেন, “এসব ব্যক্তির হত্যাকাণ্ড এমন সময় ঘটলো, যখন ধর্ষণের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের পরপরই নোয়াখালীর সুবর্ণচরে চার সন্তানের এক মাকে গণধর্ষণের ঘটনাও ছিল।”

তিনি বলেন, “এসব ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করছে। যেহেতু দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ রেকর্ড রয়েছে। সরকারের উচিত এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত শুরু করা। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানোর কারও অধিকার নেই।”

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত