রোববার, ১৬ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

বামপন্থির ব্যক্তিগত সম্পত্তি

আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:০৮ পিএম

আওয়ামী রাজনীতির একটা সুবিধা আছে। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিরও সেই সুবিধা আছে। তাদের কোনো নেতা বা কর্মীর ব্যক্তিগত স্খলন-পতন, আয়-উপার্জন, খরচ-সম্পত্তিÑ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না পাবলিক বা পেপার। তারা আগে থেকেই সম্পদের মালিক হোক বা ক্ষমতায় এসেই হোক, তা নিয়ে দু-চারজনের চোখ টাটালেও, আলোচনায় কোনো ইতরবিশেষ হয় না। সেটি তাদের জন্য কোনো অপরাধ হিসেবে তেমন বিচার্য বা আলোচিত হয় না।

কিন্তু বামপন্থি নেতা বা কর্মীর ব্যক্তিগত সম্পদ বা পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা হবেই। আলোচনা হবেই তার চালচলন নিয়ে। তিনি কোনো দামি পোশাক পরলে, তিনি কোনো বিলাসিতা করলে, তার গাড়ি থাকলে, তার বউয়ের গহনা থাকলে, সেগুলো অবশ্যই মানুষের কটাক্ষের বিষয় হবে।

এমন প্রশ্ন কেন উঠবে? উঠতে পারে তখন যদি এসব সম্পদ বামনেতা বা কর্মী অবৈধ পন্থায় অর্জন করে থাকেন। অন্য দলের নেতাকর্মীরা পাঁচ বছরে যত সম্পদের মালিক হন, বাম কর্মীরা যদি একই রকম সম্পদ অর্জন করেন, তাহলেও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি যদি ধনী পরিবারের সন্তান হয়ে থাকেন, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে থাকেন, যদি সৎভাবে মাঝারি আকারের ব্যবসার মালিক হয়ে থাকেন, যদি আয়কর ফাঁকি না দিয়ে থাকেন, তবু তার এই সম্পদ অন্যদের কাছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় কেন?

দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ ঘটলে বাম নেতাকর্মীর সম্পদও চলে যাবে রাষ্ট্রের হাতে। কিন্তু তার আগে? যত দিন দেশ পুঁজিবাদী পথে হাঁটবে, তত দিন কী করবেন বাম নেতা? তিনি কি তার সম্পদ বিলিয়ে দেবেন ফকির-মিসকিনদের মধ্যে? তারপর নিজেও যাপন করবেন ফকির-মিসকিনের জীবন? নিন্দাকারীরা এ রকমটাই চান। তারা দেখতে চান বাম নেতারা পরবেন ছত্রিশ ইঞ্চি ঘেরের লংক্লথের পাজামা, আধা ময়লা শার্ট বা পাঞ্জাবি, চটি স্যান্ডেল। তাদের চেহারায় থাকবে একবেলা না খেয়ে থাকার ছাপ। কাঁধের ঝোলাতে থাকবে খুব মলিন হয়ে যাওয়া একটি বা দুটি বই। বড়জোর সঙ্গে সস্তা সিগারেট বা বিড়ির বান্ডিল। তিনি কখনো সিএনজি, উবার এমনকি রিকশাতেও চড়বেন না। ঝুলবেন বাসের হ্যান্ডেল ধরে। অথবা হেঁটে যাবেন মাইলের পর মাইল। তারা নিজের উপার্জনের টাকাতেও চায়নিজে যেতে পারবেন না, বেনসন খেতে পারবেন না, ট্রেনে-স্টিমারে ফার্স্ট ক্লাসে উঠতে পারবেন না, দূরপাল্লায় এসি বাসে টিকিট কাটতে পারবেন না, বছরে-দুই বছরে একবার বউ-ছেলে-মেয়ে সঙ্গে নিয়ে কক্সবাজার বা রাঙ্গামাটি বা সাজেক বেড়াতে যেতে পারবেন না। আর ছেলেমেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো তো তার জন্য কবিরা গুনাহ। তার মানে, তারা বামপন্থিদের দেখতে চান সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর চেহারায়। এই মনোভঙ্গিটা তৈরি হলো কেমন করে?

প্রথম যুগের বাম নেতারা এর জন্য কিছুটা দায়ী। জমিদারের ছেলেরা প্রথমে স্বদেশি, পরে বাম রাজনীতির দীক্ষা নিয়েছেন। নিজেদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি বিলিয়ে দিয়ে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় দিন কাটিয়েছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য একেবারে সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভালো কিছু যে ঘটেনি তা নয়, তবে খুব ভালো কিছু হয়নি। না পার্টির হয়েছে, না পার্টির নেতার হয়েছে। মণি সিংহকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, তারা বলতেন যে আত্মগোপনে থাকার সময়ও তিনি নিজের রান্না নিজে করতেন, বাসন ধুতেন, ঘরদোর পরিষ্কার করতেন। এগুলো খুবই অনুসরণযোগ্য কাজ। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি কাজ তো মণি সিংহকে করতে হতো। ঘরের কাজগুলোর জন্য সময় ব্যয় না করে সেই সময়টুকু তিনি অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যয় করলে পার্টি এবং পার্টির কর্মীরা বেশি উপকৃত হতো বলেই মনে করা যায়। এসব আচরণ তো গান্ধীবাদী বা আশ্রমবাসীদের করার কথা। বিপ্লবী পার্টির কর্মীদের নয়।

আরেক ধরনের প্রচারণা ইদানীং অনেক বেশি চলছে। আশির দশক পর্যন্ত বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর দাপট ছিল যথেষ্ট। সে সময় বাম সংগঠন করা অনেকটা ফ্যাশন হয়েও দাঁড়িয়েছিল বটে। মুখে বিপ্লবী বুলি না থাকলে তার কোনো মর্যাদা থাকত না সংগঠনে বা ক্যাম্পাসে। তো যাদের কাছে বাম রাজনীতি ছিল ফ্যাশন, তারা যে ছাত্রজীবন শেষেই রাজনীতি থেকে ঝরে যাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তারা কেউ আমলা হন, কেউ ব্যবসায়ী হন, কেউ প্রবাসী হন, কেউ ঠিকাদার হন, কেউ পুলিশ অফিসার হন, সামরিক অফিসার হন, কেউ বড় দলে যোগ দেন। মোটকথা, তারা আর বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে কোনো সংস্রব রাখেন না। তাদের কথা তুলে খোঁচা মারার চল ইদানীং অনেক বেড়েছে। যে বিপ্লবী রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন, তিনি তো আর বামপন্থি নেই। তিনি চলতি হাওয়ার পন্থি হয়েছেন। পুরোপুরি গেরস্থ হয়েছেন। তাদের উদাহরণ হিসেবে সামনে এনে যখন কেউ বলেন, অনেক বামপন্থি দেখেছি, তখন তিনি আসলে বামপন্থার সংগ্রামী অংশটিকে অপমান করেন। অবশ্য আসল উদ্দেশ্য তার সেটাই। নিজে যে সমাজের অসংগতিগুলো মেনে নিয়ে জীবনযাপন করছেন, সেই যাপন এবং অবস্থানকে বৈধতা দেওয়ার জন্য তিনি ওই সব ঝরে যাওয়া ছেলেমেয়েদের উদাহরণ হিসেবে সামনে আনতে চান।

নব্বই দশকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে বিপর্যয় নেমে আসার পর আমাদের দেশের বাম নেতারা দলে দলে হিজরত করেছিলেন আওয়ামী লীগে। কিছু অংশ বিএনপিতেও। আর বাকিরা বসে গেছেন। রাজনীতির নাম মুখে আনেন না। নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের ছিল না কোনোদিনই। সিদ্ধান্ত আসত হয় মস্কো অথবা পিকিং থেকে। সেই মস্কো-পিকিংয়ের পতন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তারা বিশ্ব পরিস্থিতির পর্যালোচনা করার অবকাশটুকুও বরাদ্দ করলেন না নিজেদের জন্য।

 

কিন্তু এখন তো এ দেশের বাম রাজনীতি সেই আশির দশকে নেই। শক্তিতে ক্ষীণ হলেও পার্টি এখন স্বাধীন। নিজের দল, জাতীয় এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত তাদের নিজেদেরই গ্রহণ করতে হয়। বাম ছাত্ররাজনীতি এখন আর ফ্যাশন নয়। বরং পাটের বস্তায় সরিষার তেল ধরে রাখার মতোই কঠিন। কাজে তো বটেই, চিন্তার দিক থেকেও গড্ডলিকা প্রবাহের বাইরে অবস্থান নেওয়ার মতো ছেলেমেয়ে খুঁজে পাওয়া এখন দুরূহ। এখন যারা আসছেন বা কাজ করছেন, তাদের বাইরের সমালোচনা বা বিরূপতার মুখোমুখি হওয়ার পাশাপাশি নিজেকেও অবিরাম প্রশ্নের মুখে ফেলতে হয়। এখন আর যান্ত্রিকভাবে মার্কসবাদী তত্ত্বগুলো অনুসরণ করার মতো অবস্থা নেই। বরং তত্ত্বগুলোকে বারবার বাস্তবতার কষ্টিপাথরে ঘষে পরীক্ষা করে নিয়ে পথ চলতে হয়।

বামপন্থিদের ওপর নানা ধরনের আক্রমণ চলে। অধুনা শুরু হয়েছে তাদের জীবনযাপন নিয়ে আদর্শবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা। বামপন্থিদের এটা ভাবতে বাধ্য করার চেষ্টা চলছে যে, তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন করার অধিকার নেই। তাদের নিজেদের উপার্জিত সম্পদ বা সম্পত্তি ভোগ করার অধিকার নেই। সব সম্পত্তি তাদের দান করে দিতে হবে, বিলিয়ে দিতে হবে। আর তারা যাপন করবে কৃচ্ছ্রের জীবন, দারিদ্র্যের জীবন। যারা এমন প্রচার চালান, সেই জ্ঞানপাপীদের বলিÑ অ্যাঙ্গেলস কি পৈতৃকসূত্রে পাওয়া ম্যাঞ্চেস্টারের কাপড়ের কল বিলিয়ে দিয়েছিলেন? বরং তিনি তার উপার্জনের একটা অংশ কাজে লাগিয়েছিলেন বন্ধু কার্ল মার্কসের যুগান্তকারী মতবাদটিকে গড়ে তোলা এবং পূর্ণাঙ্গ করার সহযোগিতায়। অ্যাঙ্গেলসের চেয়ে বড় বামপন্থি কজন আছেন? তার উদাহরণ সামনে থাকতে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ে দ্বিধায় থাকার কোনো কারণ বামপন্থিদের আপাতত নেই।

জাকির তালুকদার

লেখক

কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত