মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত ৭ বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট কীভাবে খুঁজে পেলেন ফার্স্টলেডি? রিডার্স ডাইজেস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন রানা মিত্র
বীজ থেকে ভালোবাসার ফুল
ফ্রান্সের নানতোসে বাবার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল এক ছোট্ট ছেলে। বয়স মাত্র ১২। তার বাবা রাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের জন্য সে দেশে এসেছেন। এক বাড়িতে সেই বাড়ির গৃহকর্তার ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হলো। মেয়েটির বয়স মাত্র চার, নাম লুইসা ক্যাথেরিন জনসন। প্রথম আলাপের বছরটি ১৭৭৯ সাল। এরপর আর আলাপ বা দেখা হলো না। ১৬ বছর পর ফের দেখা হলো লন্ডনে। মেয়েটি তখন তুমুল সুন্দরী। বছর ২০ বয়স। জন কুইন্সি অ্যাডামসেরও অনেক উন্নতি হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের মন্ত্রী তিনি। প্রেম হতে দেরি হলো না। বছর দুয়েক পর বিয়ে। তবে প্রথম চারটি মাস এই বিয়ের কথা একেবারেই গোপন রাখা হলো। কারণ মেয়েটি লন্ডনের বাইরে জন্ম নিয়েছে। তখন জনের বাবা মার্কিন উপ-রাষ্ট্রপতি। তবে শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার কাছে কিছুই গোপন থাকল না। পরপর চারটি ভ্রণ নষ্ট হয়ে গেল লুইসার। তারপর তাকে এতটুকু অবহেলা করেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ৫০ বছরের দাম্পত্য জীবনে তাদের তিনটি মেয়ে ও একটি ছেলে হয়েছে। রাজনৈতিক পরিবারে ভালোই মানিয়ে নিয়েছিলেন লুইসা। তিনি মার্কিন রাষ্ট্রপতির (১৮২৫ থেকে ১৮২৯) রাজনৈতিক সঙ্গী ছিলেন বলে অবলীলায় স্বীকার করেছেন জন অ্যাডামস। তার মৃত্যুর এক বছর পরই স্ত্রীর মৃত্যু হয়।
প্রিয়তম বন্ধুকে বিয়ে করেছেন হিলারি
মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে বিতর্কিত সম্পর্ক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় নৈতিক অধঃপতনের দায়ে দুষ্ট বিল ক্লিনটন অসাধারণ জনপ্রিয় মানুষ। ব্যক্তিত্ববানও প্রচন্ড। স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তাকে পুরোপুরি ক্ষমা করে দিয়ে ইতিহাস তৈরি করেন। তিনিও প্রথম নারী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বিল-হিলারির জীবন মুখরোচক ও আদর্শ গল্প। তাদের প্রেম কাহিনীও খুব মজার। অসাধারণ ভালো এই ছাত্রছাত্রীর প্রথম দেখা এক আইনের ক্লাসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বছরে। পড়ানোর বিষয়ের নাম ছিল ‘পলিটিক্যাল অ্যান্ড সিভিল রাইটস’। প্রথম দেখেই সুন্দরী, স্বর্ণোজ্জ্বল চুলের, বড় চশমার মেধাবী ও প্রসাধনবিহীন সাধারণ মানুষের মতো চলাফেলার মেয়েটিকে ভালো লাগল বিলের। মনে মনে খুঁজলেও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির আর কোথাও হিলারিকে পেলেন না। বেশ কিছুদিন পর আইনের এক লাইব্রেরিতে আবার দেখলেন। মেয়েটি এক কোনায় দাঁড়িয়ে বই দেখছে। ছেলেটি অপলক তাকিয়ে আছে দেখে সরাসরি তার দিকে হিলারি এগিয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমি হিলারি ডায়ান রডহ্যাম। তুমি?’ দারুণভাবে বিস্মিত হলেন বিল। মেয়েটি এত স্মার্ট ও ব্যক্তিত্ববান? ‘আমি উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটন, ডাকনাম বিল।’ দুজনের কিছু আলাপও হলো বিলের আগ্রহে। চার বছর বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার পর বিলকে বিয়ে করতে হিলারি রাজি হলেন। অবশ্য এর আগে তিনবার বিয়ের প্রস্তাব ‘সঙ্গত’ কারণেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ ছিল, প্রিয়তম বন্ধুকে কোনোদিন বিয়ে করতে হবে হিলারি ভাবতে পারেননি, মনকেও তৈরি করা হয়নি। ১১ অক্টোবর, ১৯৭৫ সালে তাদের বিয়ে হলো। বিল জেফারসন ক্লিনটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪২তম রাষ্ট্রপতি।
হলিউডে হলো দুজনের ভালোবাসা
রোনাল্ড রিগ্যান তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ন্যান্সি ডেভিসের সঙ্গে তার প্রথম আলাপ হয়েছিল সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যমে। রিগ্যান তখন ‘স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড’-এর প্রেসিডেন্ট। ন্যান্সি নামে আরেকটি মেয়ে হলিউডের ছবিতে নিষিদ্ধ ছিল বলে কাজ পাচ্ছিলেন না। ওই মেয়েটিকে কমিউনিজমের সঙ্গে যুক্ত বলে দায়ী করা হয়েছিল। ফলে ন্যান্সি নির্দোষ থাকলেও নামের বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন। তবে জন উইনারের বই ‘প্রফেসরস অ্যান্ড পপ’ বলে ন্যান্সির নিষিদ্ধ তালিকার নামটি বিরল ঘটনার মতো কাটা পড়ে। তার এক বছর আগেই অবশ্য তারা বিয়ে করেছিলেন। ৪০তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের আত্মজীবনী লেখক অ্যান এডওয়ার্ডস বলেন, ১৯৪৯ সালে এমজিএম (মেট্রো গোল্ডওয়েন মেয়ার) নামের মিডিয়া কোম্পানিতে কোম্পানির কনসার্ট শিল্পী হিসেবে কাজ করা শুরু করেন অ্যান। তখনই তাদের প্রথম দেখা। তখনই এক বন্ধুকে ন্যান্সি বলেছিলেন, তিনি রিগ্যানের সঙ্গে দেখা করতে চান। বন্ধুটি একটি ছোট্ট ডিনার পার্টির আয়োজন করে দুজনকে এক করে দিলেন। এরপর তো ইতিহাসের জন্ম।
প্রথম দেখাতেই প্রেম
জর্জ ডব্লুউ (ওয়াকার) বুশ ও লরা ওয়েলসের প্রথম দেখা ১৯৭৭ সালের জুলাইতে। কাছের বন্ধুর মাধ্যমে তার বাড়িতেই দুজনের আলাপ। সেই পার্টিতে খুব জমেছিল দুজনের। প্রথম দেখাতেই ঘায়েল বুশ। পরে ঘনিষ্ঠতা। জুলাই মাসেই বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। লরা সময় নিলেন আরও চার মাস। ৩০ বছরের কনে ও ৩১ বছরের বরের বিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডল্যান্ড ইউনাইটেড মেথডিস্ট চার্চে হলো। তাদের যমজ সন্তান হয়েছে। লরার প্রশংসায় সবসময়ই পঞ্চমুখ ৪৩ মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ‘লরা অসাধারণ সঙ্গী, ভালো মানুষ।’
আমিও তোমার পথযাত্রী হব
১৭৫৭ সালে আগের স্বামী মারা গেলেন। মার্থার বয়স তখন ২৭, চারটি সন্তান। তিনি খুব ধনী, ন্যায়পরায়ণ। পরের বছর ভার্জিনিয়াতে বসন্তে সামাজিক অনুষ্ঠানে জর্জ ওয়াশিংটনের সঙ্গে পরিচয়। তিনি যুদ্ধ ফেরত সৈনিক। ছুটি কাটাতে এসেছেন। আরও তিনবার দেখা হলো।
তৃতীয়বার বিয়ের প্রস্তাব দিলেন জর্জ। মার্থা রাজি। ১৯৫৯ সালের ছয় জানুয়ারি তাদের বিয়ে হয়। কোনোদিন তাকে অসম্মান করেননি জর্জ, অসম্ভব ভালোবেসেছেন। মার্থা বলেছেনও, জর্জ অমায়িক। বিয়ের পর জর্জ ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজ প্ল্যানটেশন নামের বাড়িতে চার সন্তানসহ উঠেছিলেন মার্থা। সেটিই ছিল জর্জের জীবনের সবচেয়ে সুখের কাল। ৪১ বছরের বিবাহিত জীবনে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্টের কোনো সন্তান হয়নি। তাতে তার দুঃখ ছিল না। তিনি স্বাধীন দেশকে গড়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তার স্ত্রীর চিঠির শুরু ছিল ‘প্রিয়তম’, শেষ ‘তোমার স্নেহ পাওয়া মার্থা’। ১৭৯৯ সালে জর্জ ওয়াশিংটনের মৃত্যুর পর স্ত্রী বলেছিলেন, ‘প্রিয়তম কিছুদিন অপেক্ষা করো, আমিও তোমার পথযাত্রী হবো।’ এরপর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, শরীরও খারাপ হয়ে যায়। তিন বছর পর মৃত্যু ঘটে।
ভালোবাসার জীবন
এক আইনের অফিসে প্রথম দেখা। বছরটি স্পষ্ট মনে আছে তাদেরÑ ১৯৮৯। একজন বারাক হুসেইন ওবামা, অন্যজন মিশেল লাভোন রবিনসন, পরবর্তীকালে নামের সঙ্গে ‘ওবামা’ যুক্ত করেন। সেদিন নতুন পরিচিত মেয়েকে সিনেমা দেখান বারাক। নাম, ‘ডু দি রাইট থিংস’। সারাটি দিন এর আগে ও পরে একত্রে বেড়িয়েছেন তারা। অসাধারণ ব্যক্তিত্ববান ছেলেটিকে দেখেই মুগ্ধ হন মিশেল। সিদ্ধান্ত নিতে তার একদিনও দেরি হলো না, ‘আমি সম্পর্কে জড়াব।’ দুটি বছর প্রেম করেই কাটালেন। ১৯৯১ সালে এক রেস্তোরাঁতে খেতে খেতে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন ওবামা। মিশেলও রাজি। পরের বছর পরিণয়। এখনো তাদের দাম্পত্য জীবন অটুট আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভবিষ্যতের স্ত্রীকে? মিশেল হেসে ফেলেন, “আমাকে ধন, দৌলত, ঐশ^র্য কোনোকিছুরই প্রতিশ্রুতি সেদিন দিতে পারেনি বারাক ওবামা। চাইওনি। শুধু বলেছিল, ‘ভালোবাসার জীবন উপহার দেব।’ ২৮ বছরের সংসারে সেই আগের মতোই একে অন্যের জন্য আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রবাহিত হচ্ছে।” মিশেলের ৫৫তম জন্মদিনে প্রথম দেখার ছবিটি পোস্ট করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট। বলেছিলেন, ‘অনেক আগের ছবি জানি, কিন্তু এখনো আমি নিশ্চিত, তুমি অসাধারণ এক মানুষ। শুভ জন্মদিন, মিশেল ওবামা।’ মিশেল ভালোবাসার উত্তর দিতে দেরি করেননি। ফিরতি টুইট করেছিলেন, ‘আমার জন্মদিনে ভালোবাসা জানানোর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ বারাক ওবামা। আগের মতোই সবকিছু দিয়েই তোমায় ভালোবাসি।’
একমাত্র অবিবাহিত প্রেসিডেন্ট
১৮১৯ সালের গ্রীষ্মে, জেমস বুচানন নামের ২৮ বছরের এক তরুণ ২৩ বছরের অ্যান কোলম্যান নামের এক তরুণীর সঙ্গে আংটি বিনিময় করলেন। অ্যান পেনসেলভানিয়ার ধনী লোহা ব্যবসায়ীর আদরের দুলালী। বাগদানের প্রথম কয়েকটি মাস হবু স্ত্রীর সঙ্গে মিশতে পেরেছিলেন বুচানন। পরে আইন পেশায় ভয়াবহ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে সমালোচকের মুখ বন্ধ থাকেনি। তারা গুজব ছড়িয়ে দেন, টাকার লোভে বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করেছে বুচানন। সে অন্য নারীদের সঙ্গেও মিশছে। গুজবে অনেকে বিশ্বাস করলেন। অ্যানও তাদের ফাঁদে পা দিলেন। বিহ্বল কয়েকটি সপ্তাহ কাটানোর পর মেয়েটি হবু স্বামীর কাছে চিঠি লিখলেন, তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ। তবে নিজেকে সামলাতে পারলেন না অ্যান। সে বছরের ডিসেম্বরের নয় তারিখে অতিরিক্ত মদ ও মরফিন পানে তার মৃত্যু ঘটে। সম্ভবত এটি আত্মহত্যাই ছিল, বিশেষজ্ঞরা ধারণা করলেন। শোকে বিধ্বস্ত বুচানন ছুটে গেলেন, কিন্তু অ্যানের পরিবার তাকে মৃতদেহ এমনকি শেষকৃত্যানুষ্ঠানেও উপস্থিত হতে দেয়নি। কিছুদিন হতাশার সাগরে কাটিয়ে তিনি আবার ল্যাংকাস্টারে কাজে ফিরে এলেন। অ্যানের মৃত্যুর পর বুচানন প্রতিজ্ঞা করলেন আর বিয়ে করবেন না। তিনিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র ‘অবিবাহিত’ প্রেসিডেন্ট।