কেন সংসার হলো না টেবিল টেনিসের রাণী জোবেরা রহমান লিনুর? ১৬ বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ও প্রথম বিশ্ব রেকর্ড করা এই অ্যাথলেট তার ব্যক্তিগত জীবনের কথা বললেন শাওন আবদুল্লাহকে
বন্ধু আমার
বাবা শেখ আব্দুর রহমানই আমার সবচেয়ে ভালো ও প্রিয় বন্ধু। তিনিই আমার ভালোবাসার জন। তিনি ছয় মাস আগে মারা গেছেন। তারপরও খালা আনোয়ারা বেগমকে আমি ভালোবাসি। বাবার মতো তিনিও আর নেই। মামা তরিকুল আলমকেও আমি ভালোবাসি। এভাবে আশেপাশে ভালোবাসার অনেক মানুষকে পেয়েছি। তারা আমাকে জীবনে ভালো করার, লেখার, খেলায় সেরা হবার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। নিজের মধ্যে আশার জন্ম দিয়েছেন। সেটি লাভ করার প্রেষণা তারা আমাকে দিয়েছেন। কোনো ব্যক্তিগত মানুষকে নয়, সামগ্রিক ভালোবাসায় বিশ্বাস করার বোধ তারা আমাকে দিয়েছেন। তবে সব মানুষই ভালোবাসা খোঁজে, একজন মানুষের মধ্যে সেটি পেতে চায়। কেউ পায়, কেউ পায় না। সে গল্প না বলাই থাক। তাতেও তো সুখ আছে। বেদনার অনুভব আছে। সেসব বোধ আমার নিশ্চয়ই আছে।
কাদামাটির সম্পর্ক
আসলেই সম্পর্ক তাই। নিজের মতো করে সেটি তৈরি করে, গড়ে নিতে হয়। তাতে কোনো অন্যায় হয় না। আরেকজনকে দেখে সে নিজেকে বদলে ফেলবে, এটি মানুষের সহজাত। আর ছোটখাট বিষয়গুলো থেকেই আমাদের শেখা হয়। বদলানোটা যেন কারো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে অসুবিধা তৈরি না করে, তাকে নিজের সম্মানবোধ থেকে দূরে সরিয়ে না দেয় সেটি বিবেচনা করা খুব জরুরী। নিজেকে নষ্ট করা কোনোভাবেই কোনো সম্পর্কে থাকলে করা যাবে না। এটি মনুষ্যত্বের প্রতি আঘাত। মানবতার প্রতি অন্যায়।
আমার আমি
আমি দেখতে খুব ভালো, স্মার্ট। এটি ছোটবেলা থেকেই জেনে আসছি। স্কুলে পড়ার সময় থেকে অনেক ছেলে আমাকে পছন্দ করেছে। এখনো সেই বোধ তাদের মাধ্যমে আমার মধ্যে হয়। অনেকের আমাকে ভালো লাগে। কিন্তু তাতে নিজের লক্ষ্য থেকে কখনো সরে আসিনি। ছোটবেলায় অবশ্য এসব বোঝার বোধ আমার ছিল না। ভাবতাম, যে পাড়ায় থাকি, সেখানকার মানুষ তো আমাকে পছন্দ করবেই। পাড়ার ছেলেরাও তাই। আরো একটু বড় হলে দেখি, মানুষ কেন যেন আমাকে ভয় করে। ছেলেরাও সামান্য ভয় পেয়ে দূরে দূরে থাকে। পরে জানলাম, চিন্তাও করে দেখলাম, নিজেকে গুটিয়ে রাখাই আমার এই অনুভূতির জন্ম দেবার কারণ। আমি খেলার বাইরে, খেলা শেষে এই ভুবনের কারো সঙ্গে কখনো কোনোদিন গল্প করিনি। ফলে আমার সঙ্গে মেশার লোকের অভাব ছিল। দূর থেকে তাদের মধ্যে আমি নানা অনুভূতির জন্ম দিয়েছি।
খেলাই আমার জীবন
আমি টেবিল টেনিস খেলেছি। ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও নামটি আছে। খেলা ছাড়া লিনুর কোনো জীবন নেই বলে অনেকে একসময় খুব বিশ্বাস করতো। আমিও খেলা নিয়ে মেতে থাকতাম। আর কিছু করার সুযোগই হয়নি, নিজেকে দেইওনি। আর বাইরে বেরুলেও খেলার সেই একাগ্রতা আমার চলাফেরার মধ্যে মানুষ দেখতে পারতেন। হাসাহাসি, গল্প, আড্ডা তুমুল যৌবনে দেইনি। ফলে এই ব্যক্তিত্বকে ছেলেরা ভয় পেয়েছে, নিজেকেও কারো সঙ্গে মেশার মতো অবস্থায় নিয়ে যাইনি। কাউকে আমার সঙ্গে মেশার সুযোগ দেইনি। খেলা এবং একান্ত ব্যক্তিগত, ঘরোয়া জীবনে আমি থেকেছি সবসময়। এটি এখনো আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এভাবেই আমি চলি। এখন বয়স হয়েছে। এখন লিনু আলাদা হয়েছে। সে অনেকের সঙ্গে মিশে, সম্পর্ক করে। তবে সেটিও গন্ডীর মধ্যে। বাইরে নয়। তাতে আমার জীবন ভালো থেকেছে বলে আমার মনে হয়। গন্ডীর বাইরে গেলে ভুল মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়, তাতে নানা অসুবিধা ঘটে। জীবনে ভালো কিছু মানুষ পেয়েছি, তাদের কাছ থেকে অনেক শিখেছি এই বোধ ও প্রভাব তৈরির পর আলাদা সমাজের মানুষের প্রতি ভালোবাসার, আগ্রহের বোধ আমার থাকেনি।
পুরুষের প্রভাব
একসময় এত ব্যস্ত থেকেছি যে এসব নিয়ে ভাবার, এদিকে সময় দেওয়ার কোনো সময়ই আমার ছিল না। যখন আমি তেমন সময় পেয়েছি, তখন ভালোবাসার জন অনেক দূরে চলে গেছে। তার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। নামটি এখন আর বলতে চাই না। ফিরে আসতে সে পারেনি। এসব নিয়ে এখন মাঝেমধ্যে আমার ভাবনা হয়। তখন উপলব্ধি করি, এই খেলা, সেই সময় আমার কাছ থেকে অনেক ব্যক্তিগত সুখ, অনুভূতি কেড়ে নিয়েছে। তাতে অবশ্য কোনো আফসোস হয় না। আল্লাহ আমাকে সংসার দেননি সত্য, কিন্তু অনেক কিছু দিয়েছেনও যেগুলো মানুষ পায় না। না পাওয়া নিয়ে কোনো আফসোস আমার নেই, কাউকে দোষারোপ করাও আমার স্বভাব নয়।
কী ছিল প্রয়োজন, কী ছিল না
অনেক প্রয়োজনীয় কিছু পাইনি, আগেই বলেছি। যখন বন্ধুদের নিয়ে অন্যরা ঘুরে বেড়িয়েছে, আমি তখন প্রাণ দিয়ে খেলেছি। আমার দেশকে, সমাজকে ও টেবিলটেনিসকে দিয়েছি। কী জোবেরা রহমান লিনু এই খেলাকে দিয়েছেন, সেটি ইতিহাস বলবে। আমি দেশ-বিদেশে ঘুরে ঘুরে খেলেছি। বন্ধুদের বিয়ে শাদিতেও যেতে পারিনি। এই কাজ করতে করতে একসময় এমন হয়েছে আমি আর কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি। আমার সেসব জায়গায় যেতে আর ভালো লাগতো না। গেলে খারাপ লাগতো। তখন আমি কোনো না কোনো প্র্যাকটিস বা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ভালো করার চেষ্টা করেছি। তাতে কার কী লাভ হয়েছে, সেটি মানুষ বলবেন; আমি নই। তবে ব্যক্তি আমি এই সময়গুলো খেলায় দেওয়ায় আমার ক্যারিয়ার হয়েছে। এই যে এত প্রাপ্তি তাতে আমার অনেক লাভ হয়েছে। আমি আমি হয়েছি। আর প্রতিটি মানুষের মতো আমারও অনেক না পাওয়া আছে। তবে জীবন তো ভালোভাবেই কাটছে। এখন আমি সুস্থ আছি। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। মানসিক অসুবিধাগুলোকে মোকাবেলা করতে পারছি। ভালো শরীর না থাকলে সেসব আমি পারতাম না। শরীর ভালো না থাকলে তো আমার পুরো দুনিয়াটিই খারাপ হয়ে যেত। বাংলাদেশের অনেক নারীর চেয়ে আমার শরীর যে অনেক ভালো, সেটিও তো খেলারই দেওয়া। সুস্থ শরীরে আমি যে কোনো কাজেই আনন্দ পাই।
ভালোবাসা পেয়েছি
অনেক মানুষের ভালোবাসায় এই জীবন আমার ধন্য। রাস্তায় বেরুলে মেয়েরা আমার হাত ধরে বলেন, আপনার খেলা আমাদের খুব ভালো লাগে। আপনার সঙ্গে সেলফি তুলবো। অসংখ্য মেয়ের কাছে শুনেছি, লিনু আপা আপনার খেলা দেখে আমরা খেলায় এসেছি, টেবিল টেনিস খেলা শিখেছি। এই কথাগুলোর অনেক দাম আমার জীবনে। একবার একটি কাজে একটি ব্যাংকে গিয়েছিলাম। তখন এক ভদ্রলোক এসে বললেন, আপা আপনার নামে আমি আমার মেয়ের নাম রেখেছি। লিনু নামটি বাংলাদেশে অপ্রচলিত, খেলাটিও। সেই লিনুর নামে নাম রেখে তিনি আমাকে সম্মানিত করেছেন। আর খেলোয়াড় লিনু তো এখনো সম্মান পায়। সে সারাজীবনই পাবে বলে আমার বিশ^াস।
তবুও পেয়েছি কম
খেলা থেকে নয়, ব্যক্তিগত জীবন থেকে পেয়েছি কম। অন্যদের থেকে আমার বিয়ের প্রস্তাব কম এসেছে। গুটানো, একদিকে থাকা মেয়েটিকে দেখে অনেকের মতো হতো হয়তো লিনুর কোনো সম্পর্ক আছে। তাকে আর প্রস্তাব দিয়ে কী লাভ? একথা আমি শুনেছিও। যারাও বা সাহস করে এসেছেন, তাদের নানা কারণে ভালো লাগেনি। ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। নিজের সংসার হয়নি। বাবার সংসার দেখাশোনা করি। বাবার সব কাজ একা হাতে আমি সামলাতাম। ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া বা তোলা থেকে শুরু করে তার সব ব্যক্তিগত কাজ তিনি অন্য ভাই-বোনদের না দিয়ে আমাকে দিয়ে করাতেন। পুরুষ নারীর এই ব্যতিক্রমী ও অন্যরকম সার্বজনীন সম্পর্ক আমার আছে। তিনি আমাকে এই কাজের যোগ্য ভেবেছিলেন বলে আমি তার কাছে ঋণী।
এখন আছে সন্তান
আমার ভাইয়ের একটি ছেলে আছে। ওর নাম ইয়াদ আলাভি। একদিন বয়স থেকে তাকে আমি লালন-পালন করি। অবচেতন মন আমাকে বলে আমি তার মা। ছেলেটিও আমাকে মা বলে ডাকে। সন্তান হিসেবেই সে আমার কাছে থাকে। সবার কাছে তাকে এই পরিচয়েই পরিচিত করি। ফলে তারাও তাতে অভ্যস্ত। এই যে মা ডাক আমি প্রতিদিন শুনতে পাই, তাতে আমি মাতৃত্বের স্বাদ পাই। আমার কাছে মা ডাকই যথেষ্ট, তাতেই আমার মায়ের অনুভূতি তৈরি হয়। জন্ম দিলেই সন্তানের মা হওয়া যায় তাতে আমার বিশ্বাস নেই। ফলে আমার বাবাকে ঘিরে, ভাইয়ের ছেলেকে ঘিরে একটি সংসার হয়েছে। তাতে আমি মোটেও একা নই। সংসারের মধ্যে থেকেও যারা একা থাকেন, আমি তাদের মতো নই। আগেও আমার সংসার ছিল, এখনো আছে। আর সুস্থ থাকলে কোনোদিন একা থাকলেও আমি ভালো থাকবো। তবে জীবনে অন্য সবার মতোই কখনো না কখনো আমার একা লাগে। আমি যেহেতু চিরকালের নিঃসঙ্গ, ফলে নিসঙ্গতাই ভালো।
মেয়েরাও একা থাকে
সেটি আমি ভুল প্রমাণ করেছি। এখন আমার মতো একা থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তারা ভালো আছে, ভালোভাবে বাঁচছে। পরিচিতদের মধ্যেও এমন অনেককে পেয়েছি। মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই ঘর, পরিবারের মধ্যে কাটায় বলে তারা পরিবারের মধ্যে থাকে। একা বোধ পায় না। কিন্তু ছেলেদের একা থাকা খুব কঠিন। সমাজের কোনো ভূমিকাকে আমি মানি না। দেখিওনি কোনোদিন। আমি আমার জীবনকে পরিচালিত করি। সমাজের জীবনকে নয়। সমাজকে খুশি করার দিকে আমার কোনো আগ্রহ নেই, করিও না। আমি আমার মনের দাম দেই। সমাজে কোনো অন্যায় করি না।
বিয়ে নয় নিরাপত্তা
সামাজিক, পারিবারিক নিরাপত্তার জন্য বিয়ে করার বিষয়ে আমার বিশ^াস নেই। নারীরা অনেকেই এই কারণটিকে সামনে নিয়ে আসেন। আমি বলি বিয়ে হলো বন্ধন। সংসার, ছেলেমেয়ে, স্বামী থাকবেন। এই চাওয়াগুলো আমারও ছিল। আমিও সংসার চেয়েছিলাম। হয়নি বলে খেদ নেই, কষ্ট আছে, অনিরাপত্তার কোনো বোধই আমার নেই।
অনিচ্ছায় বিয়ে নয়
এই দেশের মেয়েদের বিয়ের জন্য তৈরি করা হয়। তারা জন্মের পর থেকে সেটি শুনে ও জেনে, অভ্যাস করে বেড়ে ওঠে। বিয়ের পর মেয়েটির কী অবস্থা হয়, তাকে শান্তি, ভালোবাসা কতটুকু দেওয়া হচ্ছে সেই বিষয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা আমি দেখি না। তারা আলাপ করেন মেয়েটি মোটা না শুকিয়ে দিয়েছে। ফলে এই সমাজের এই বোধগুলো, চর্চাগুলো বদলাতে হবে। মেয়েদের অনিচ্ছায় বিয়ে দেওয়া যাবে না। তারা বিয়ের পর কেমন আছে সেই খোঁজ রাখতে হবে ও তাদের সংসার যাতে ভালো থাকে, সেজন্য সবার চেষ্টা করতে হবে। আর তারা জীবনে যা হতে চায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সাহায্য না করলে তারা কিভাবে এগুবে? একটি মেয়ে সংসার, মা-বাবাকে কতটা সাহায্য করে, সেই খোঁজ কেউ নেয়?