বসন্ত এসে গেছে? হ্যাঁ, আজ ‘আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিছে নেশা/ কারা যেন ডাকিছে পিছে, বসন্ত এসে গেছে।’ ফাল্গুন মাস বসন্ত কাল। বসন্ত মনকে প্রেমিক করে তোলে। কী এক রঙিন ছোঁয়ায় দুলে ওঠে মন। বসন্ত মনের অনেক গভীরে ভালোবাসার বীজ বুনে দেয়। ফাল্গুনে দেখা হয়ে যায় অনেক আকাক্সক্ষার মানুষের সঙ্গে ‘এতদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে, দেখা পেলেম ফাল্গুনে...।’
ফাল্গুন বা বসন্ত এলেই কেন জানি প্রেম-ভালোবাসা-সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। আর প্রেম-ভালোবাসা শব্দগুলো মানুষের মনকে হালকা একটা নাড়া দেবেই। জীবনে কখনো কারও প্রেমে পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। হোক সে বিয়ে পূর্ববর্তী প্রেম, বা বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে প্রেম। মানুষের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে আমরা প্রত্যেকেই ভালোবাসা পেতে চাই, কেউ আমাকে বিশেষ ‘কেয়ার’ করে এমনটা দেখতে চাই। আমরা হতে চাই কারও জীবনের ‘স্পেশাল’ একজন।
বসন্ত বুকে জাগিয়ে তোলে ভালোবাসার বোধ। অন্তত কবি-সাহিত্যিকরা তেমনটাই ফুটিয়ে তুলেছেন। ভালোলাগা ভালোবাসার সৌরভ ছড়ানো ছাড়াও মিলনের বার্তা দেয় বসন্ত। এমন লগ্নে প্রিয়জনের কাছে দেহ-মন সঁপে দিতে যেন বাধা নেই কোনো। ভীরু প্রাণে কেবলই বাজে ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন রটাতেৃ।’ উতলা বাউলও গেয়ে ওঠেন ‘বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ, আমার বাড়ি আসে। বন্ধুর বাড়ির ফুল বাগান, নানান রঙের ফুল, ফুলের গন্ধে মন আনন্দে ভ্রমর হয় আকুল (শাহ আবদুল করীমের গান)।’ এভাবে বসন্ত এলে উচাটন হয়ে ওঠে মন। পুরনো বেদনা, হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ভালোবেসে এর পেছনে ছুটতে ইচ্ছে করে।
মানুষ কেন ভালোবাসে, প্রেমে পড়ে বা প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়Ñ এটা বলা খুব মুশকিল। কারও কারও মতে, ভালোবাসা মানে পাগলামি। একে অপরকে কাছে পাওয়ার একটা অনুভূতি। পারস্পরিক মুগ্ধতা, নির্ভরতা, মিল, আকর্ষণ। যখন নিজেদের শেকড় একে অপরের সঙ্গে এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যাতে কিনা এটা ভাবাই যায় না যে, আলাদা হওয়াটা সম্ভব। এই বোধ বা অনুভূতিই হচ্ছে ভালোবাসা।
তবে প্রেম মানে শুধু দম বন্ধ হয়ে আসা উত্তেজনা নয়। এই আকাক্সক্ষা নয় যে কবে মিলিত হবো। বা শুয়ে শুয়ে এটা কল্পনা করা নয় যে কখন প্রেমিকার স্পর্শ ছুঁয়ে যাবে সারা শরীর। এগুলো সবই প্রেমে পড়ার সঙ্কেত। যা দেখে যে কোনো মানুষ ভাবতে পারেন যে তিনি ভালোবাসছেন। ভালোলাগা-ভালোবাসা আচ্ছন্ন করে রাখে মনকে। ভালোবাসার মধ্যেও তো এক ধরনের জঙ্গিপনা আছে। সে কখন কোত্থেকে ফেরে, কোন বাসে সাধারণত কোন সিটে বসে, কোন স্টপেজে উঠলে তার পাশের সিট খালি পাওয়ার একটা হাল্কা সম্ভাবনা থাকতে পারে, এসব হিসাব কষে বের করা কঠিন।
মানুষ প্রেমে পড়ে, ভালোবাসে। এটাই যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। অনেকে আবার একাধিক জনের প্রেমে পড়ে। আসলে সম্পর্কের তল পাওয়া ভার। নিখাদ-নিপাট সম্পর্কের ভেতরও কখনো কখনো ঘনিয়ে ওঠে অন্ধকার। মন চলে যায় অন্য কোনো দিকে। সেখানেই মেলে আর এক আলোর সন্ধান। কখনো আবার বিনা অন্ধকারেই এক সম্পর্ক থেকে মন ডানা মেলে অন্য সম্পর্কের দিকে। আর ঠিক এখান থেকেই শুরু অপরাধবোধের। একজনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও আর একজনকে ভালোবাসার ভেতর অন্যায় দেখেন অনেকে। দ্বন্দ্বে পড়ে যন্ত্রণাদীর্ণ হন। অথচ এর থেকে পরিত্রাণ পান না।
আসলে সম্পর্ক শব্দটিকে কোনো একছাঁচে ফেলা যায় না। আর তাই এক সম্পর্কের ভেতরে থেকেও অন্য সম্পর্কের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যায়। মনোবিদদের মতও তাই। এ অসম্ভব কিছু নয়। কেননা ভালোবাসাকে আমরা অনেক সময়ই কোনো একক আস্বাদের বলে ধরে নিই। কিন্তু আদতে ভালোবাসার স্বরূপ বেশ আলাদা ও জটিলও। কোনো স্থির সম্পর্কে থাকতে থাকতেই, অন্য কারও কোনো গুণ ভালো লেগে যাতে পারে। সেই অনুভূতির শরিক হতে গিয়েই সেই মানুষটির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যায়।
মনোবিদদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, যখন কেউ নিজেকে বেশি ভালোবাসতে শুরু করেন তখনই এই প্রবণতা মাথাচাড়া দেয়। ধরা যাক, চাকরিক্ষেত্রে বা শারীরিকভাবে কেউ খুব সন্তোষজনক একটি স্থানে রয়েছেন। জীবনের এই স্বস্তিই তার অন্য আবেগগুলোকে উসকে দেয়। নিজেকেই আরও বেশি করে ভালোবাসতে চান। আর তাই নিজের বিভিন্ন অনুভূতির মর্যাদা বা নানা আবেগের সহমর্মী মানুষ যাদের পান, তাদের সঙ্গেই একটি আত্মিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে চান। চেনা সম্পর্কের বাঁধা ছকে তা গর্হিত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু মানুষের মনের গতিবিধি এতই জটিল ও বহুমুখী পথে যে, এ ঘটনা প্রায়শই ঘটে।
এটা কি অন্যায়? এ নিয়ে নানামত সমাজে। বিশেষত নির্দিষ্ট সামাজিক কাঠামোর ভেতরে ভালোবাসার এই পরিসর অনেকেই মেনে নেন না। শারীরিক বা মানসিক বহুগামিতাকে তাই স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। এখানে বলা ভালো যে, যুক্তিগতভাবে একইসঙ্গে দুজনকে ভালোবাসা সম্ভব হলেও, মানসিক দিক থেকে তা বেশ কষ্টকর। বিশেষত উল্টোদিকের মানুষটির ক্ষেত্রে। কারও সঙ্গী অন্য একজনকে ভালোবাসে, এটা মেনে নেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। সেখান থেকেই বিবাদের শুরু।
একজন বিখ্যাত মনোবিদ বলেছেন: আসলে জীবনে একজনকেই বেছে নিতে হবে, হয়। এটাই সমাধান। যদিও এ সমাধানের কোনো নির্দিষ্ট গাণিতিক সূত্র নেই। তবে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, যে আবেগ বা অনুভূতির জন্য অন্য মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন, তার মধ্যে, কোনটি আপনার জন্য বেশি জরুরি। কোনটি ছাড়া আপনি অপ্রাসঙ্গিক। সেটি ঠিক করতে পারলেই সঙ্গী বেছে নেওয়াও অসুবিধার হবে না। আপনার সংস্কৃতি অনুরাগকে কেউ তৃপ্ত করতে পারে, কিন্তু আপনার ঘোর অসুখের সময়ও তিনি পাশে এসে দাঁড়াবেন তো? আপনার শারীরিক সৌন্দর্যে কেউ বিবশ হতে পারেন, কিন্তু আপনার ৯০ বছর বয়সেও তিনি এতটাই মুগ্ধ থাকবেন তো? ক্ষণিকের মোহ নয়, ভাবতে হবে সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়েও। এইভাবেই ভাবতে ভাবতেই সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে পারবেন।
ভালোবাসা খুঁজে ফেরেন সকলেই। স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতেই তাই বাঁধা পড়েন সম্পর্কে। কিন্তু তাহলে আবার সেই সম্পর্কের বাঁধন ছেড়েই কেন বেরিয়ে পড়তে চায় মানুষ? তবে কি চেনা সম্পর্কের আড়ালেই কোথাও থেকে যায় দমবন্ধ করা পরিবেশ? নাকি নিছক অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় সম্পর্কের খোলস কাটিয়ে বেরিয়ে পড়তে চান অনেকে?
আসলে সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই অনেকে যে কোনো সঙ্গীর সঙ্গে বিয়েকে মেনে নেন। কিন্তু যত দিন যায় তত বাড়তে থাকে অসন্তুষ্টি। সঙ্গীকে ঠিকভাবে চেনা না থাকার ফলে বাহ্যিক গাঁটছড়া পড়ে বটে, কিন্তু মনের খাঁজগুলো মেলে না। আর তাই জীবনের গতিপথে যদি কেউ এসে পড়েন, যার সঙ্গ পেলে মনের তারে সাড়া পড়ে, মানুষ জড়িয়ে পড়তে চায় তার সঙ্গেই।
সংসারের নানা ঝামেলা সময় সময় অনেককে ক্লান্ত করে। যত দিন যায় মানুষের জীবনে তত দায়িত্ব বাড়তে থাকে। এর থেকে মুক্তি পেতেই নতুন সম্পর্কের দিকে হাত বাড়ায় বিবাহিতরা। অনেকে আবার নিছক কামনার বশে নতুন সম্পর্কে জড়ান। এক্ষেত্রে যৌনতাটাই প্রধান হয়ে পড়ে। শারীরিক আকর্ষণই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়ও অনেক নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়।
তবে মনের যোগাযোগটাই নতুন সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান প্রভাবক। চেনা সম্পর্কও ভালোভাবে চলতে পারে। কিন্তু জীবন তো অদ্ভুত। আচমকা জীবনে এমন কারোর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, যার সঙ্গে অনেক বিষয়ে মনের মিল পাওয়া যায়। হয়তো একই শখ বা একই জিনিস পছন্দ করার ক্ষেত্রে, কিংবা রুচির ক্ষেত্রে অসম্ভব মিল দেখা যায়। অথবা নিজের সঙ্গীর মধ্যে ঠিক যে যে অভাবগুলো অনুভব করেন কেউ কেউ, অন্য কারোর মধ্যেই আচমকা তা খুঁজে পেয়ে যান। আর এর ফলেই সম্পর্কে থাকা সত্ত্বেও নতুন সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেন অনেকে। মনের তল পাওয়া ভার। কে কখন কার প্রতি আকৃষ্ট হবে সেটা বলা কঠিন। প্রশ্ন হলো, একসঙ্গে একাধিক জনকে ভালোবেসে কি আদৌ সুখী হওয়া যায়? না তা জীবনে আরও জটিলতা বাড়ায়? কাউকে বঞ্চিত করে নিজের সুখটুকু চরিতার্থ করাটা কি মানবধর্ম হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরই নির্ভর করছে, আমরা কে, কার সঙ্গে কতটুকু সম্পর্কে জড়াব!
লেখাটির ইতি টানছি শ্রীজাতের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে: ‘সম্পর্ক তো একটা সেতু, তাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে পরিণত মনের দরকার পড়ে। প্রথম প্রেমের সময় সেই পরিণতি হয়তো থাকে না, কিন্তু যে-উদ্যম, যে-তীব্রতা, যে-আগুন থাকে প্রথম প্রেমে, তা ওই কম বয়েসেই আসতে পারে হয়তো। ফুল তুলে আনা আর গাছে জল দেওয়ার মধ্যে যে তফাত, প্রথম প্রেম আর স্থায়ী সম্পর্কের মধ্যেও সেটাই পার্থক্য।’