মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক খাদ্য। খাদ্য ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। সেই খাদ্য যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে ভেজাল খাদ্য খেয়ে মানুষের জীবনহানিও ঘটতে পারে। ফলে প্রতিটি মানুষই নিরাপদ ভেজালমুক্ত খাবার খেতে চায়। কিন্তু বর্তমানে দেশে যেভাবে ভেজালের আগ্রাসন চলছে, তাতে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি অনেকাংশেই কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি মানুষের মৌলিক অধিকার। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ভেজালমুক্ত ও উন্নত পরিবেশে তৈরি খাবার সরবরাহে কাজ করছেন ঠিকই, কিন্তু নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করতে পারছেন না। এ জন্য মানুষকে বিবেকসম্পন্ন হতে হবে। ভাবতে হবে, নিরাপদ খাদ্যকে নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে মানুষকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হবে।
অতি সম্প্রতি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে হোটেল রেস্তোরাঁগুলোয় ভ্রাম্যমাণ অভিযান চালায়। এতে দেখা গেছে, কম বেশি প্রতিটি হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবার মান এবং খাবার তৈরির পরিবেশের বড়ই অভাব। ফলে ভ্রাম্যমাণ আদালত জেল-জরিমানা করেছেন। প্রকৃত পক্ষে উন্নত পরিবেশে খাবার তৈরি ও পরিবেশনে অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ অনেক পুরনো। এ প্রসঙ্গে কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ খাদ্য উৎপাদন থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত সার্বিক বিষয়ে তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা রাখে। তবে কারও একার পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব নয়। এ জন্য নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে ১৯টি মন্ত্রণালয় ও ৫টি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার বিধান রয়েছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী সেভাবে কাজ না হওয়ায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। তা নাহলে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি সহজ হবে না।
গত ৩ জানুয়ারি রোববার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে ‘জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, খাদ্যে ভেজাল দিয়ে মানুষের জীবন ধ্বংসের অধিকার কারও নেই। খাদ্যে ভেজাল দেওয়াও এক ধরনের দুর্নীতি, এটা বন্ধ করতেই হবে। তিনি বলেন, খাদ্যে ভেজালরোধে আমি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ করে দিয়েছি। যারা ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করবেন। যেহেতু খাদ্যে ভেজালও দুর্নীতি, সেহেতু ভেজালরোধে অভিযানকে আরও জোরদার করতে হবে মর্মেও তিনি মন্তব্য করেন। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে যারা যেখানে দায়িত্ব পান, সে সুযোগকে তিনি কাজে লাগিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায় করেন। ফলে সরকারি এমন বিভাগ আছে, যেখানে স্বল্প বেতনের একজন কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী অঢেল অর্থে-বিত্তে সমৃদ্ধ হচ্ছেন। শুধু খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মধ্যেই যে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে, তা নয়। এর বাইরেও উৎপাদনকৃত খাদ্যদ্রব্যের মাঝেও ভেজালের প্রমাণ মিলেছে। যেমন আমাদের দেশে শস্য উৎপাদনে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের দেদার ব্যবহার চলছে। এমনকি ক্ষেতে বাড়তি ফলন ও তাড়াতাড়ি পাকানোর ক্ষেত্রে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ জন্য দেশে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে অর্গানিক চাষাবাদের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। সাধারণভাবে জৈব খাদ্য অথবা অর্গানিক ফুড বলতে কোনো ধরনের রাসায়নিক, হরমোন বা কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই উৎপাদিত খাদ্যকে বোঝায়। এ কারণে অর্গানিক খাবার শতভাগ নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। ফলে গোটা বিশ্বেই এখন সুস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিয়ে অর্গানিক চাষাবাদ বাড়ছে। সে তুলনায় বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে।
সারা বিশ্বে যে সব দেশে ১ শতাংশের কম জমিতে অর্গানিক চাষাবাদ হচ্ছে, সেই তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। সূত্রমতে, এখন আমাদের দেশে মাত্র ৬ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে নিরাপদ অর্গানিক চাষাবাদ হচ্ছে, যা মোট চাষযোগ্য জমির মাত্র দশমিক ১ শতাংশ। কৃষিই আমাদের অন্যতম অবলম্বন। অথচ বাংলাদেশের চাষযোগ্য জমির বিশাল অংশে জৈব উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে কৃষিতে অপরিকল্পিত নিবিড়করণ, পরিকল্পনাহীন শস্য আবর্তন, নানা উচ্চফলনশীল শস্যের চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় মাটিতে জৈব উপাদানের ঘাটতি হয়েছে। যা বিশেষজ্ঞরা বারংবার স্মরণ করে দিচ্ছেন। এরপরও সচেতনতার অভাবেই রাসায়নিক সারের ব্যবহার, কীটনাশকের ব্যবহার এখনো আশানুরূপ ভাবে কমেনি।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে লবণাক্ততার কারণে এরই মধ্যে দেশের ১৮ জেলার ৯৩ উপজেলায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর কৃষিজমির মাটি কমবেশি দূষিত হয়ে পড়েছে। আর জৈব উপাদানের ঘাটতি ধরা পড়েছে ৫২ লাখ হেক্টর জমিতে। সাধারণত সুষম মাটিতে ৪৫ শতাংশ খনিজ বা মাটির কণা, ৫ শতাংশ জৈব এবং ২৫ শতাংশ করে পানি ও বাতাস থাকার কথা। এর মধ্যে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান জোগান দেয় মাটিতে থাকা ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ। অথচ মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমে আসছে। এ জন্য এখন খাদ্যশস্যের গাছ, ডালপালা ভালো হলেও দেখা দেয় ফলন বিপর্যয়। মূলত চাষের জমিতে কোন উপাদান কী পরিমাণ আছে, তা পরীক্ষা করে কৃষিবিদদের প্রেসক্রিপশন মোতাবেক জৈব সার এবং কী পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহার করা উচিত, সে নির্দেশনা মোতাবেক চাষাবাদ করতে হবে। অর্থাৎ এখন মাটি পরীক্ষা করে অর্গানিক চাষাবাদের দিকেই আমাদের এগুতে হবে। তা নাহলে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। আর নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ছাড়া নিরাপদ খাদ্যের জোগান পাওয়াও কঠিন হবে। অর্থাৎ সুস্থ দেহে বেঁচে থাকতে হলে নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই। এটাই নিখাদ সত্য।
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ও কলামনিস্ট