নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টা বড় দুই অগ্নিকাণ্ডে এত প্রাণহানির কারণ রাসায়নিক গুদাম মজুদ। পুরান ঢাকা থেকে এসব রাসায়নিক দ্রব্য সরানোর জোর দাবি থাকলেও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও তাদের মদদদাতাদের কারণে আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। চুড়িহাট্টার ঘটনার পর রাসায়নিকবিরোধী টাস্কফোর্স অভিযান চালাতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছে। অভিযানের দ্বিতীয় দিন গতকাল শনিবার বকশীবাজারের জয়নাগ রোডে স্থানীয়
ব্যবসায়ীদের ক্ষোভের মুখে টাস্কফোর্সের সদস্যরা অভিযান স্থগিত করতে বাধ্য হন। প্রত্যক্ষদর্শী, এলাকাবাসী, পুলিশ ও অভিযানসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পরে দক্ষিণ সিটি মেয়রের উপস্থিতিতে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর পুনরায় অভিযান শুরু হলেও অনেক গুদাম ও কারখানা মালিককে খুঁজে না পাওয়ায় টাস্কফোর্সের সদস্যরা ফিরে যান।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলছেন, একজন বিএনপি নেতার উসকানি ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে বকশীবাজারের ব্যবসায়ীরা টাস্কফোর্স টিমের উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গতকাল সকালে রাসায়নিকবিরোধী টাস্কফোর্সের পাঁচটি দল পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় একযোগে অভিযানে নামে। তারা একের পর এক অনুমোদনহীন রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানার ইউলিটি সার্ভিস যেমন- গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করে। একপর্যায়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ১৭/২ নম্বর জয়নাগ রোডের একটি কারখানার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে স্থানীয়দের তোপের মুখে পড়ে টাস্কফোর্স। একপর্যায়ে তারা নগর ভবনে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। খবর পেয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর আবার অভিযান শুরু হয়।
মেয়র সাঈদ খোকন সাংবাদিকদের বলেন, দুই পক্ষের ভুল বোঝাবুঝির কারণে অভিযান কিছু সময়ের জন্য ব্যাহত হয়েছিল। এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল করিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দাহ্য কেমিক্যালের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নাই। তাই বলে গোডাউনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে পুরো বাসাবাড়ির সংযোগ কেটে দেবেন, তা মেনে নেব না। ছেলেমেয়েকে অন্ধকারে রাখবেন, চুলা জ্বালাতে দেবেন না, তা হতে পারে না।’
এ সম্পর্কে বাংলাদেশ প্লাস্টিক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত ২৯টি বিস্ফোরক আইটেমের বাইরে টাস্কফোর্স অন্য কোনো আইটেমের গোডাউন কিংবা কারখানার ইউলিটি সার্ভিস বন্ধ করতে পারবে না। কোনো বাড়িতে যদি কোনো কেমিক্যালের গোডাউন বা কারখানা থাকে সেই ক্ষেত্রে কেবল ওই গোডাউন বা কারখানারই সংযোগ তারা বিচ্ছিন্ন করতে পারে, তাই বলে সম্পূর্ণ ভবনের সংযোগ কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। এসব বিষয় নিয়েই প্রতিবাদ করা হয়েছে। পরে মেয়রের সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি উপস্থাপন করা হলে তিনিও আমাদের দাবির সঙ্গে একমত হয়েছেন।’
পুলিশের লালবাগ জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘পুরান ঢাকার সব বাসাবাড়িতে ওয়াসা, বিদ্যুৎ ও পানির এক সংযোগেই চলছিল কারখানা ও বাসাবাড়ির সংযোগ। এ ক্ষেত্রে কারখানা বা গোডাউনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ফলে স্বাভাবিকভাবেই আবাসিকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিষয়।’
ব্যবসায়ীরা জানান, অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তারা গোডাউন বা কারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে বাসাবাড়ির সব ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। এতে আবাসিক বাসিন্দারা গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ছিলেন। এ কারণে গত বৃহস্পতিবার প্রথম দফা অভিযানের পর থেকেই পুরান ঢাকার শহীদনগর ও ইসলামবাগের বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় গতকাল সকালে ১৭/২ জয়নাগ রোডে হাজি বুলবুলের প্লাস্টিক কারখানার বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে তারা স্থানীয়দের বাধার মুখে পড়েন। এ সময় স্থানীয়রা অভিযানকারী কর্মকর্তাদের ঘিরে ধরে প্রতিবাদ শুরু করলে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে দুপুর আড়াইটার দিকে ডিএসসিসির মেয়র সাইদ খোকনের নেতৃত্বে অভিযান শুরু হয়। এ সময় জয়নাগ রোডের কয়েকটি রাসায়নিক গুদামের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
এরপর বেলা ৩টার দিকে প্লাস্টিক ও কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন মেয়র। এর আগে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো গোডাউনের মালামাল জব্দ করছি না। কাউকে শাস্তিও দিচ্ছি না। আমরা কেবল হাজার হাজার মানুষের জীবন রক্ষা করছি।’
ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায় জানিয়েছেন, গতকালের অভিযানে ১৩টি হোল্ডিংয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এর মধ্যে শহীদনগর এলাকার ৮ ও ২৯ নম্বর রোডের ৯টি বাসায় প্লাস্টিকের গোডাউন থাকায় ৩৫, ৩৫/১, ৮, ১১, ৬/এ, ৬/বি, ২৫২, ২৯০/২, ৪২/৫ হোল্ডিংয়ের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৭ নং ওয়ার্ডের জয়নাগ রোড, বকশীবাজার এলাকার ১৭, ১৬/২/বি, ৮/৩, ১৬/২ নম্বর হোল্ডিংয়ে গুদামের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আর ১৯ ও ৮/এ-এ দুটি হোল্ডিংয়ের গোডাউনের মালামাল তাৎক্ষণিকভাবে সরিয়ে নেওয়ায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইসলামবাগের ৭৫/২ নম্বর হোল্ডিংয়ের বেইজমেন্টের মালামাল সরিয়ে নেওয়ার কারণে গতকাল ওই হোল্ডিংয়ে পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়েছে।’ বিএনপি নেতার উসকানিতে অভিযান বাধাগ্রস্ত হয়েছে : সাঈদ খোকন
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছেন, ‘একজন বিএনপি নেতার উসকানি ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে বকশীবাজারের ব্যবসায়ীরা টাস্কফোর্স টিমের উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দিয়েছে।’ গতকাল শনিবার দুপুরে রাসায়নিকবিরোধী অভিযান স্থগিত হওয়ার পর বকশীবাজারের জয়নাগ রোডে এসে তিনি এ কথা বলেন।
ডিএসসিসি মেয়র সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকালে নানাভাবে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যার কারণে অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন ও কারখানার বিরুদ্ধে টাস্কফোর্সের অভিযান বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এটি মহানগর বিএনপির একজন নেতার কারণে হয়েছিল। আমি এখানে উপস্থিত হওয়ার পর তার বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো বন্ধ হয়েছে।’
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে টাস্কফোর্সের একটি দল জয়নাগ রোডের একটি আবাসিক ভবনে রাসায়নিকের গুদাম খুঁজে পায়। এরপর ভবনটির বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে ব্যবসায়ীরা স্লোগান দিতে শুরু করে এবং তাদের তোপের মুখে অভিযান স্থগিত করতে বাধ্য হয় টাস্কফোর্স।
সাঈদ খোকন আরও বলেন, ‘আমি নিজে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নগর প্রশাসনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা চেয়েছি। আমার ডাকে তারা সাড়া দিয়েছেন। এখন আর কোনো সমস্যা নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির লোকজন প্রচার করেছে যে, অভিযান পরিচালনাকারী টিম জোর-জবরদস্তি করে বাসাবাড়ি সিলগালা করছে, মালামাল ফেলে দিচ্ছে। এসব অপপ্রচারের কারণেই বাধার সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের টিম এ ধরনের কোনো কাজ করেনি। শুধু যেসব বাসাবাড়িতে গোডাউন আছে, সেসব বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে; যাতে তারা গোড়াউনের মালামাল নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান।’