যে চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ রাসায়নিক অগ্নিবিস্ফোরণে ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে, চুড়িহাট্টার ব্যবসায়ীরা সেই রাসায়নিক দ্রব্যের পক্ষেই সাফাই গাইছেন। শুধু তাই নয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্সের অভিযানকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে গতকাল রবিবার দুপুরে মিছিল ও অভিযানকারীদের অবরুদ্ধও করেন তারা। ‘অবৈধ অভিযান মানি না, মানব না’ সেøাগান দিয়ে তারা চুড়িহাট্টার বিভিন্ন গলি প্রদক্ষিণ করেন। ব্যবসায়ীদের এ কর্মকাণ্ডকে ভালো চোখে দেখছেন না স্থানীয় বাসিন্দারাও।
গতকাল দুপুরে পুরান ঢাকার রাজনারায়ণ রোডে অভিযানে গিয়ে ২/৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে অননুমোদিত চারটি প্লাস্টিক কারখানা এবং একটি পাঁচতলা ভবনে রাসায়নিক দ্রব্য ও প্লাস্টিক কারখানার সন্ধান পান টাস্কফোর্স দল-২-এর সদস্যরা। এরপর পরিসেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে ব্যবসায়ী-শ্রমিকরা কারখানার ভেতরে ঢাকা জেলা পরিষদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুবর্ণা শিরীন ও ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর জাহিদ হাসানসহ টাস্কফোর্স সদস্যদের অবরুদ্ধ করেন। পরে লালবাগ থানা পুলিশ তাদের উদ্ধার করে।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে ৬৭ জনের মৃত্যু হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় আরও চারজনের। প্রাথমিক তদন্তে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার নেপথ্যে দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্যের তথ্য পাওয়া যায়। এরপরই ডিএসসিসি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের মাধ্যমে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান শুরু হয়। গত বৃহস্পতিবার অভিযানের প্রথম দিনে ইসলামবাগ ও শহীদনগরে ২১টি হোল্ডিংয়ের পরিসেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তারপর থেকে স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। গত শনিবার বকশিবাজারের জয়নাগ রোডে ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে পড়েন টাস্কফোর্সের সদস্যরা। পরে উত্তেজনা প্রশমনে মেয়র সাঈদ খোকন ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। ওই দিন ১৩টি হোল্ডিংয়ের পরিসেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
স্থানীয় আশরাফউদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চুড়িহাট্টার আগুনে এত মানুষের মৃত্যুর পরও তাদের হুঁশ হয়নি। আসলে তারা ব্যবসা ছাড়া কিছুই বুঝতে চান না। তবে আমরাও আমাদের আবাসিক এলাকায় কোনো কেমিক্যালের গোডাউন দেখতে চাই না।’
ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায় জানান, গতকাল চুড়িহাট্টাসহ পুরান ঢাকার লালবাগ ও বংশালের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৩টি হোল্ডিংয়ের পরিসেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আগামী ১ এপ্রিল পর্যন্ত টাস্কফোর্সের এ অভিযান ধারাবাহিকভাবে চলবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে তারপর সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে কেমিক্যাল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের দাবি জানাই। পাঁচ-ছয় বছর আগেই আমরা বিভিন্ন দাহ্য কেমিক্যাল সরিয়ে কেরানীগঞ্জ, শ্যামপুর, গাজীপুর ও সাভারে নিয়ে গেছি। এখনো অনেকে চুরি করে ব্যবসা করছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযানকে স্বাগত জানাই।’
চুড়িহাট্টায় অভিযানবিরোধী ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ মিছিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সেখানে তো প্রায় ২০ হাজারের মতো বিভিন্ন পণ্যের কারখানা রয়েছে। মিছিল তারাই করেছেন।’
টাস্কফোর্সের সদস্যরা জানান, অভিযানের তৃতীয় দিন গতকাল বেলা ১১টায় একটি দল চুড়িহাট্টা এলাকায় অভিযান শুরু করে। রাসায়নিক দ্রব্যের গুদামের খোঁজে আজগর লেন, নন্দকুমার দত্ত লেন ও হায়দার বক্স লেনের বিভিন্ন গলিতে ছয়টি ভবনের নিচে থাকা গুদামে তল্লাশি চালানো হয়। এর মধ্যে তিনটিতে প্লাস্টিক দানার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পরিবেশগত ছাড়পত্র ও ব্যবসা করার অনুমতি না থাকায় সেগুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। বাকি তিনটি গুদামে প্লাস্টিক দানা ও রাসায়নিক দ্রব্য না থাকায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। চুড়িহাট্টা এলাকায় অভিযান চলাকালে স্থানীয় ও ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে পড়ে টাস্কফোর্সের এই দলটি।
ব্যবসায়ী সালাহউদ্দিন বলেন, ‘এখানে কেউ তিতাসের গ্যাস ঠিকমতো পায় না। বাধ্য হয়ে সবাই এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে। এই আগুনের ঘটনায় দায়ী স্প্রে গোডাউন ও গ্যাস সিলিন্ডার। এখানে প্লাস্টিক দানার কোনো ভূমিকা নেই। অভিযান চালালে ভেজাল গ্যাস সিলিন্ডারের বিরুদ্ধে চালান, প্লাস্টিক গোডাউনের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে দেব না।’
ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ খান বলেন, ‘অভিযানের তৃতীয় দিনে চকবাজারের ছয়টি হোল্ডিংয়ে অভিযান পরিচালনা করেছি। এর মধ্যে দুটির গোডাউনে কাচের চুড়ি ও বাচ্চাদের খেলনা ছিল, যা আমাদের অভিযানের মধ্যে পড়ে না। তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আর একটি হোল্ডিংয়ের গোডাউন থেকে মালিক মালামাল সরিয়ে ফেলায় আমরা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাকি তিনটি হোল্ডিংয়ে আমরা প্লাস্টিক গোডাউনের সন্ধান পেয়েছি। ওই তিনটির ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।’ স্থানীয়রা জানায়, এখান বেশিরভাগ কারখানার কোনো অনুমোদন নেই। তাই এসব ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে একজোট হচ্ছেন। তারা কোনোভাবেই টাস্কফোর্সের অভিযান মেনে নিতে পারছেন না। তাই বিভিন্নভাবে অভিযানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে প্লাস্টিক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্লাস্টিক তো কেমিক্যাল নয়। কাজেই প্লাস্টিক কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান হলে ব্যবসায়ীরা তো প্রতিবাদ করবেনই।’