বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

সমাজ বদলে ছিলেন লড়াকু

আপডেট : ০৪ মার্চ ২০১৯, ০৩:২০ এএম

প্রগতিবাদী রাজনীতির সঙ্গে খানিকটা সংযোগের মধ্যদিয়ে ১৯৭৪ সালের দিকে পরিচয় ঘটে সব সময়ের থেকে যাওয়া একজন আদর্শবাদী, বিপ্লবী এবং সমাজ বদলের বিশ^াসে দৃঢ় ও অটল পুরুষ মহসিন শস্ত্রপাণির সঙ্গে। রাজনৈতিক আদর্শকে চিন্তাজগতে দৃঢ় করতে, মানুষের চেতনা জগতে শিল্প-সাহিত্যের ভূমিকাকে     লাগসই করতে এবং নিপীড়িত মানুষকে চেতনাগত দিক থেকে জাগ্রত করতে তখন ‘উন্মেষ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ’ শিল্প-সাহিত্যচর্চার সংগঠনটি নিয়মিত সাপ্তাহিক সভা করত রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। প্রগতিপন্থি ও প্রগতির রাজনীতির প্রতি নিষ্ঠ লেখক-সাহিত্যিক-কবিরা সে সব অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তাদের লেখা চর্চায় যেমন পড়তেন, শুনাতেন এবং একই সঙ্গে অন্যের লেখার সঙ্গে পরিচিত হতেন, আলোচনা করতেন এবং কেমন হওয়া উচিত একজন লেখকের লেখা, কী দায়িত্ব নিয়ে তার লেখা উচিত, কতটা তা সার্থক হয়েছে সে অনুভব ইত্যাদি আলোচনায় অনুশীলনে অংশ নিয়ে নিজেকে যেমন সমৃদ্ধ করতে পারতেন তেমনি সহযোগিতাও দিতেন। এই সংগঠনের কর্ণধার ছিলেন মহসিন শস্ত্রপাণি এবং তিনি সেকালের কমিউনিস্ট পার্টির [একটি অংশের] সদস্য ছিলেন। ওই সংগঠনটি মূলত ছিল একটি আদর্শবাদী সংগঠন এবং সর্বশেষ সময় পর্যন্ত [মাঝে কিছু সময় বাদে] তিনিই ছিলেন তার টানা সভাপতি। তার সঙ্গে আমার বা আমাদের  সখ্য গড়ে ওঠে এই সংগঠনের মধ্যদিয়ে। এখানে তখন যারা নিয়মিত আসতেন তাদের মধ্যে ছড়াকার ইন্দু সাহা, আবু সালেহ, যোশেফ শতাব্দি, আব্দুর রাজ্জাক, সমুদ্রগুপ্ত, মুনীর সিরাজ, কাজী মনজুর, সালাদীন আহমদ,  সালেহা আনোয়ার উদ্দীন, রফিকুল আমীন, জহিরুল ইসলাম, আহমাদ কাফিল, শফিউদ্দিন সরকার, শরীফ হারুন,  গৌতম মুনশী, স্বপন মাঝি এবং আরও অনেক প্রগতিবাদী তরুণ। এখানেই আমার কবিতাচর্চা শুরু। পরবর্তী সময়ে নানা জায়গায় আমাদের সাপ্তাহিক সভাগুলো চলমান ছিল এবং শেষতক আজিজ মার্কেটে কয়েক বছর অতিক্রম করার পর স্থগিত হয়ে যায়। এখানে নিয়মিত আসতেন পুরনো-নতুন মিলে আরও অনেকে। এর মধ্যে ফরিদুজ্জামান, ভজন সরকার, শাহ কামাল, ইসহাক খান, সুনীল শীল, সিরাজুল এহসান, আজাদ আলাউদ্দিন এবং নিশাত খানসহ একঝাঁক সৃষ্টিশীল তরুণ। এরা সবাই এই মানুষটিকে শিক্ষকতুল্য মানতেন। বহু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে বহু সংগঠনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে এই মানুষটি তার বিশ^াসের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। হয়নি এতে তার কোনো খেদ ছিল না, বা বলা যায় কোনো অনুতাপও দেখিনি প্রকাশে। সব মত তিনি মানতেন না কিন্তু কেউ এসে বললে তাদের সংগঠনের সহযোগিতায় তাকে কার্পণ্য করতে দেখিনি। ১৯৭৬ সালে তার নেতৃত্বে ঢাকায় দুদিনব্যাপী প্রগতিশীল সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তৎকালীন ঢাকা জেলা ক্রীড়া মিলনায়তনে।

উন্মেষ সংগঠনটি ছিল তার প্রাণ, তার প্রিয়তায় একসময় দেশের বহু জায়গায় এর বিস্তৃতি ঘটেছিল। অনেক প্রগতিবাদী তরুণের আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল। যশোরের উন্মেষের সদস্য ছিলেন কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, দারা মাহমুদ। অনেক শুভানুধ্যায়ীর প্রীতি ও ভালোবাসা পেয়েছিলাম আমরা। দেশের খ্যাতিমান লেখক, সাংবাদকি-বুদ্ধিজীবীরা ‘উন্মেষের’ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসেছেন, কথা বলেছেন, মতামত দিয়েছেন এবং খোঁজখবর রেখেছেন।

মহসিন শস্ত্রপাণি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দৈনিক আজাদ, দৈনিক জনপদ, গণবাংলা, সাপ্তাহিক জয় বাংলাসহ আরও কিছু পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি উন্মেষ সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক এবং পরবর্তীকালে ‘নয়া দুনিয়া’ নামে আরও একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। উন্মেষ প্রকাশনী নামে একটি প্রকাশনাও তিনি পরিচালনা করেছেন বেশ কিছুদিন এবং লিখেছেন অনেক। তার লেখা বিপ্লবী হো চি মিন, লালতারার কাহিনী, আজালিয়া পর্বত (নাটক), উত্তরদেশের গল্প, উপন্যাস জোছনায় কালো মেঘ, ছোটগল্প  জনশ্রুতি, প্রবন্ধ শেষ যুদ্ধের ডাক, সংস্কৃতি আন্দোলনের প্রমাণ্যবই ‘লাল পতাকার নীচে’ অনুবাদ ইত্যাদি গ্রন্থগুলো উল্লেখযোগ্য পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল।

 

মহসিন ভাই সাহিত্যকর্মী কেবল নন, একজন আদর্শবাদী পরিচ্ছন্ন সমাজচিন্তক, সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। বিশ^ পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত জীবনবদলের আদর্শে নানা ক্ষত তৈরি হলেও তিনি তাঁর বিশ^াস থেকে টলেননি একচুলও। প্রতিমুহূর্তে অনুসন্ধান করেছেন সত্যের, উদারতা দেখিয়েছেন সাথী ও সঙ্গীদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে এবং নিজে থেকেছেন অনড় অটল সমাজবদলের বিশ^াসে। আদর্শ বিচ্যুতিতে অনেকেই সুবিধাগুলো কুড়িয়েছেন কিন্তু কোনো সরকারি-বেসরকারি সুবিধার লোভে একতিল পরিমাণ চ্যুতি তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। নানা সময়ে শারীরিক কারণে অসমর্থ থাকলেও মানুষের প্রয়োজনে রাজনীতির সংগঠন ও কর্মীর সকল ভার বয়েছেন বিনা দ্বিধায়। নিজ জীবনাচরণেও তিনি ছিলেন একজন আদর্শস্থানীয় মানুষ। কোনো একটি ঘটনাকে দেখার এবং তা বিশ্লেষণে তার দক্ষতা ছিল অসামান্য। মেধা ও যোগ্যতায় বহু প্রগতিবাদী রাজনীতিকের তিনি শিক্ষকতুল্য ছিলেন এবং তত্ত্বজ্ঞান ছিল শক্ত-পোক্ত ভিতে দাঁড়ানো। রাজনৈতিক পালাবদলে তার অনেক ঘনিষ্ঠজন বন্ধু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন কিন্তু তিনি কোনোদিন তাদের ক্ষমতা গ্রহণের পর দেখাও করতে যাননি। নেননি কোনো সুবিধা। নির্বিকার ছিলেন সমস্ত লোভের ইশারা থেকে।

মহসিন ভাই ইউরোপের প্রায় সব দেশ ঘুরেছিলেন। ঘুরেছিলেন আমেরিকা, ভারত, চীন, কোরিয়া, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড। ইউরোপ ভ্রমণের ওপর তিনি লিখছিলেন কিন্তু শেষ হলো কি না জানাননি। হঠাৎই শরীর খারাপ হচ্ছিল তার। তার রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কিডনি সমস্যা প্রকট হচ্ছিল কিন্তু তিনি ছিলেন নির্বিকার। তার চীন ভ্রমণের বই ‘দেশের নাম চীন’ চমৎকার একটা ভ্রমণ সাহিত্য। তিনি কবিতাও লিখতেন, কিন্তু কোনো কাব্যরূপ দেননি। এমন মানুষটিই ছিল আমার বন্ধু, পথপ্রদর্শক, এবং আমার চিন্তাভ্রান্তির মূল চিকিৎসক। অথচ আমি তাকে হারিয়ে ফেললাম। তিনি হয়তো অভিমান করেই ঢাকা থেকে তার নিজগ্রামে শেষ শয্যাটি নিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন আমাদের আগোচরে। আর ৭৪ বছর বয়সের প্রান্তে এসে চলে গেলেন।

 সেদিন রাতে আমজাদ হোসেন [আমজাদ ভাই] টেলিফোনে জানালেন তার চিরবিদায়ের কথা।

ব্যক্তিগত জীবনকে যে সামগ্রিক জীবনের উপযোগী করতে পারে সে-ই আদর্শ মানুষ এমন সাধনায় নিয়ত লড়াইরত ওই মানুষটি বহুদিন প্রগতিপ্রিয় মানুষের প্রিয় হয়ে থাকবেন । তিনি ভাবি রাজিয়া সুলতানা, একপুত্র শশাঙ্ক সাদী পাভেল ও দুই কন্যা দ্যুতি ও সেবতীকে রেখে গেছেন। তারাও স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সফল পুত্রকন্যা।

 লেখক : কবি

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত