বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

পারমাণবিকীকরণের পথে সৌদি আরব

আপডেট : ১০ মার্চ ২০১৯, ১০:০০ পিএম

পুরনো বদহজমের সমস্যা যেমন প্রায়ই ভোগায়, তেমনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জামাতা আবার পাদপ্রদীপের আলোয় এসে অনেক সাধারণ মানুষের অস্বস্তির কারণ হলেন। আলজাজিরার খবর অনুযায়ী, জ্যারেড কুশনার সাংবাদিক খাশোগি হত্যার পর থেকে প্রথমবারের মতো সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) সঙ্গে দেখা করেছেন অতি সম্প্রতি। খবরে বলা হয়, তাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল ওয়াশিংটন ও রিয়াদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং তার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া। তবে আরেক দফা অর্থহীন ‘শান্তি প্রক্রিয়া’ ছাড়াও তাদের মধ্যে আরও কিছু বিষয়ে আলোচনা হয়ে থাকতে পারে। সৌদি যুবরাজের বিশাল পকেটে আয়েশে বসে থাকা কুশনারের বড়

চিন্তার বিষয় ছিল দুটি নিজের আর্থিক লাভের ব্যবস্থা করা এবং দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিনের যা অবশিষ্ট আছে তা-ও ইসরায়েলকে কেড়ে নিতে সাহায্য করা। অন্যদিকে কুশনারের সঙ্গে খেলায় এমবিএসেরও দুটি লক্ষ্য আছে। এক, ইরানকে মোকাবিলা করা আর দুই, নিজেকে কেবল সৌদি আরব নয়; বরং আরব তথা মুসলিম বিশ্ব জুড়ে এক একচ্ছত্র শাসকে পরিণত করা। ইয়েমেনে নিরীহ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ আর জামাল খাশোগিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে এমবিএসের আরব বসন্তের প্রথম কটি ফুল। তবে খুন আর ধ্বংসের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা আর গৌরব অর্জনের অভিযাত্রায় তিনি দৃশ্যত প্রচলিত উপায়েই সন্তুষ্ট নন। মনে হচ্ছে, এখন তিনি পরমাণু শক্তিধর হওয়ার মহাস্বপ্ন লালন করছেন। আর তার সে স্বপ্ন পূরণে ট্রাম্প প্রশাসনেরও আগ্রহের কমতি নেই।

নিউ ইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি লিখেছে, ট্রাম্প প্রশাসন সৌদি আরবের সঙ্গে দেশটির পরমাণু জ্বালানি খাতের বিকাশ নিয়ে চুক্তির জন্য কাজ করছে। পত্রিকাটি লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্র আট হাজার কোটি ডলার মূল্যের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বিক্রি করতে পারে সৌদির কাছে। এর মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন এমন একটি সরকারকে স্পর্শকাতর প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম দিচ্ছে, যার কার্যত নেতা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ইরানের বিরুদ্ধে সুরক্ষা হিসেবে কোনো একসময় পরমাণু অস্ত্র চাইতে পারেন বলে আগেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মন্তব্য : বাকি বিশ^ কী ভাবল তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি মোহাম্মদ বিন সালমানকে।

পরমাণু-সংক্রান্ত এসব তৎপরতার সামনের সারিতেই রয়েছেন স্বয়ং ট্রাম্পজামাতা কুশনার আর তার ব্যবসায়িক স্বার্থ। জানা গেছে, কুশনার পরিবারকে ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের সময় সাহায্য করা একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান সৌদি আরবে পরমাণু চুল্লি বেচতে চায়। এটিসহ দুই পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়ার আরও কিছু সন্দেহজনক বিষয় নিয়ে মার্কিন নিরাপত্তা কর্তাদের কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। তবে নিরাপত্তার যুক্তিতে এ বিষয়ে কুশনারকে ঠেকানোর একাধিক চেষ্টা হলেও তা ভেস্তে দিতে পেরেছেন তার ক্ষমতাধর শ্বশুরমশাই।

যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া এ বিষয়টি ঠিকভাবে প্রকাশ করলেও দুটি অনুমানভিত্তিক ধারণা করছে, যা নিতান্ত ভুল। এক, সৌদি আরবের সঙ্গে পরমাণুবিষয়ক চুক্তি ইসরায়েলি নেতাদের স্বার্থের পরিপন্থী। দুই, এটি উপসাগরীয় অঞ্চলেরই কোনো আর্থিক ফাঁদের ঘটনার ফল।

নিউ ইয়র্ক টাইমসে মার্কিন সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টফ যৌক্তিকভাবেই বলেছেন, সৌদি আরবের উচ্চাভিলাষকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউসের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্নই আছে, যার উত্তর মিলছে না। কিন্তু ইসরায়েলি সরকার সৌদি আরবের পারমাণবিকীকরণের বিরোধিতা করছে বলে তিনি যে কথা বলেছেন, তা একেবারেই ভুল। কুশনার পরিবারের যে শুধু ইসরায়েলের তেলআবিবে ব্যাপক ব্যবসা-বাণিজ্য আছে তা-ই নয়, তারা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অবৈধ বসতিরও জোরদার সমর্থক। তাই জ্যারেড কুশনার ইসরায়েলি স্বার্থবিরোধী কিছু করবেন, তা ভাবাটা বাতুলতা মাত্র। আর ইসরায়েল যদি ট্রাম্প প্রশাসনকে ইরানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে বোঝাতে পারে, তাহলে কি চাইলে সৌদির সঙ্গে পরমাণু শক্তি নিয়ে চুক্তির ক্ষেত্রেও তা করতে পারবে না? দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা নীতি হচ্ছে : মধ্যপ্রাচ্যের আর কোনো দেশকেই পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হতে না দেওয়া যারা কিনা তার প্রতি হুমকি হতে পারে। এ উদ্দেশ্য থেকেই ইরান ও ইরাকের পরমাণু স্থাপনায় অন্তর্ঘাতমূলক হামলা চালিয়েছে দেশটি। সৌদি আরবের পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হওয়া নিয়ে ইসরায়েলি

নেতৃত্বের এখন বেশি মাথা না ঘামানোর বিষয়টি তাই বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, সৌদি-ইসরায়েলি সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া এতটাই এগিয়েছে, তেলআবিব এখন সৌদি আরবের পরমাণু কর্মসূচিকে ঝুঁকির বিষয় মনে করছে না। এটা আরও বোঝায়, ইসরায়েল বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং সৌদিরা যেন প্রতিরক্ষায় তাদের সমকক্ষ না হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করতে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতেও চায়।

সৌদি আরবের পরমাণু কর্মসূচি যে কারণে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের স্বার্থে কাজ করবে, তা নিতান্তই সহজ। এটি সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব উসকে দেবে, যাতে দুই দেশ স্থায়ীভাবে যুদ্ধাবস্থায় থাকবে। এটি ইসরায়েলের জায়নবাদের জন্য ভালো। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য তো বটেই। এতে সৌদি আরব ও ইরানের জনগণ কল্পিত শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকবে। তাতে ফিলিস্তিনিদের দুর্গতি আর জেরুজালেমের পবিত্র স্থানগুলোর অবমাননার বিষয়টি ক্রমেই বেশি করে বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাবে। এভাবে দুই আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীর স্থায়ী বৈরিতায় লিপ্ত থাকার বিষয়টি ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনের বাকি অংশ গ্রাস করার সুযোগ করে দেবে। ইসরায়েল তার নিজের সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ধারণাটি প্রচারে সদা তৎপর, সেই মিথ্যাটিকেও পোক্ত করবে এটি। তা হচ্ছে, ‘মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরে ইসরায়েল গণতন্ত্রের নীড় এক দ্বীপ।’

ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যাডওয়ার্ড লুস তার ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের কলামে এমবিএসের সঙ্গে কুশনারের লেনদেনের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু কূটনীতিকে বলা হতো ‘শান্তির জন্য আণবিক শক্তি’। কিন্তু উল্লিখিত দুজনের এ ঘটনাকে বরং ‘কাউকে পার করার জন্য আণবিক শক্তি’ বলাই বেশি সংগত হবে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচনা করলেও অ্যাডওয়ার্ড লুস প্রাচ্য সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সাবেকি গৎবাঁধা বুলিই আওড়েছেন। লুসের দাবি, ‘মার্কিন প্রশাসন অতীতে মধ্যপ্রাচ্য ও তার সীমানা ছাড়িয়ে সর্বোত্তম করণীয়ের বার্তা পৌঁছে দিতÑ অন্তত মুখে সে কথাই বলত। ট্রাম্পের অধীনে ধারাটির গতিপথ পাল্টে গেছে। ওয়াশিংটন এখন উপসাগরীয় অঞ্চলের দেওয়া-নেওয়ার রাজনীতি আমদানি করছে।’

তা, যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কবে মধ্যপ্রাচ্য ও তার সীমানা ছাড়িয়ে সর্বোত্তম করণীয়ের বার্তা পৌঁছে দিত, বলুন তো? যখন ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইরানে সামরিক অভ্যুত্থান করে জনপ্রিয় নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে সরানো হয়, তখন? কিংবা যখন সাদ্দাম হোসেনের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ্যা দাবি করে জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে ইরাকে হামলা করা হয়? রাজ্যের প্রতারণা ও কর ফাঁকির দায়ে অভিযুক্ত একেবারেই ‘দেশীয়’ এক রিয়েল এস্টেট মোগলের অসৎ কায়কারবার আর তার একই মাত্রার গোলমেলে জামাতার লোভের উৎসই বা কীভাবে ‘উপসাগরীয় অঞ্চলের দেওয়া-নেওয়ার রাজনীতির মধ্যে’ নিহিত থাকে?

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জনমত গঠনকারীরা প্রাচ্য সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধারণার ভয়াবহতা কীভাবে বেমালুম ভুলে থাকতে পারেন, তা দেখলে আমার গা গুলিয়ে ওঠে। এরা এতটাই বিস্মৃতিপ্রবণ, বিশ^জুড়ে তাদের দেশ যেসব ভয়াবহ কা- ঘটিয়ে চলেছে, সেগুলোর মূল্যায়ন চলার মধ্যেই আমাদের ওপর করা অন্যায়ের জন্য আমাদেরই দোষী করে!

ডোনাল্ড ট্রাম্প হচ্ছেন টনি ব্লেয়ারের মতোই কিংবা আরেক কাঠি বেশি অসাধু। তারা আপনাদেরই সন্তান। আপনাদের সমাজেরই সৃষ্টি। সুতরাং তাদের নিজের বলে স্বীকার করে নিন। ট্রাম্প ও ব্লেয়ার দুজনেই যে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য গোলযোগের বীজ বপনের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও বৈশি^ক শান্তি বিপন্ন করেছেন, তার পেছনে তাদের নিজ নিজ ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি অনেকটাই দায়ী। তাদের প্রচারিত ও ব্যবহৃত ওই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই মধ্যপ্রাচ্য এবং এর সীমানা পেরিয়ে দেওয়া-নেওয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি, দুর্নীতি আর কর্র্তৃত্ববাদিতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য অনেকখানি দায়ী।

আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর আবু ইউসূফ

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত