প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের সঙ্গে চিকিৎসক-নার্সদের নিয়মানুবর্তী সেবা পেয়ে সুস্থ হওয়ার আশায়ই হাসপাতালে আসে রোগীরা। তবে সঠিক তদারকির অভাবে দেশের অনেক সরকারি হাসপাতালেই দেখা যায় এর উল্টোচিত্র। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা আর অবহেলার কারণে সরকারি হাসপাতালে রোগ সারাতে গিয়ে আরেক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে রোগীরা। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সম্ভবত চিকিৎসা ও সেবার সবচেয়ে বাজে অবস্থা ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা মিটফোর্ড হাসপাতালের। ভেতরে-বাইরে ময়লা-আবর্জনা আর ওষুধের বর্জ্যে ‘আঁস্তাকুড়’ হয়ে ওঠা হাসপাতালটির কর্মচারীরাই সেখানে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার ভরসা পান না।
হাসপাতালে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, চিকিৎসক, নার্স, আয়া ও সুইপার থেকে শুরু করে কেউ তাদের দায়িত্ব পালন করেন না এখানে। কর্র্তৃপক্ষও এই বিষয়ে আশ্চর্যজনকভাবে ভূমিকাহীন। হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষের ভাষ্য, শয্যা সংখ্যার চাইতে বেশি রোগী ও তাদের সঙ্গে থাকা স্বজনদের কারণেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা যায় না।
জানা যায়, ১৮৫৮ সালে পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরে নির্মিত হাসপাতালটি ১৯১৭ সালে প্রথম শ্রেণির হাসপাতালের স্বীকৃতি লাভ করে। পরে সেটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়। ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী ৯০০ শয্যার হাসপাতালটি নিম্ন আয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্তদের চিকিৎসাসেবার জন্য অন্যতম ভরসাস্থল। প্রতিদিন ঢাকা ও এর আশপাশের বেশ কয়েকটি জেলার প্রায় ৪ হাজার রোগী সেখানে আসে সেবা নিতে। তবে হাসপাতালটির যে চিত্র তাতে রোগীরা সুস্থ হওয়ার চাইতে নতুন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিই বেশি।
গেল কয়েক বছরে হাসপাতালটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও পরিবেশগত মান উল্টো নেমেছে। নোংরা টয়লেট, যত্রতত্র ছড়ানো ময়লার স্তূপ, বিছানাপত্রে ছারপোকা-তেলাপোকাসহ বিভিন্ন পোকামাকড়ের বসতি। নোংরা পরিবেশের কারণে শুধু যে রোগীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা নয়। রোগীর স্বজনরাও আক্রান্ত হচ্ছেন নানা সংক্রামক রোগে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে তেলাপোকা, ছারপোকা, মশা, মাছিসহ বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের উৎপাত। জরুরি বিভাগের ঠিক পাশেই রয়েছে খোলামেলা ময়লার ডাস্টবিন। ডাস্টবিনের চারপাশের রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আবর্জনা। হাসপাতালে আসা রোগীদের যেন এই আবর্জনার স্তূপ দিয়েই স্বাগত জানানো হচ্ছে!
হাসপাতালে ঢোকার পর অবস্থা প্রায় একই রকম। ওয়ার্ডগুলোর মেঝেতে টিস্যু, ফলের খোসা, তুলা, কাগজের টুকরো যেখানে সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ভবনগুলোর দেয়ালগুলোও নোংরা। যেখানে সেখানে কফ থুতু পানের পিকের ছোপ।
তবে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হাসপাতালের টয়লেটগুলোর। নাকে-মুখে কাপড় না চেপে সেগুলোর সামনে দিয়েই যাওয়া দায়। আর ভেতরের অবস্থা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। টয়লেট উপচে পড়ছে ময়লা পানি। বেসিন উপচে পড়েছে ময়লায়। মেঝে খাবারের উচ্ছিষ্ট থেকে শুরু করে মল-মূত্রে সয়লাব।
রোগীদের বেডের বিছানো চাদরগুলোও নোংরা। কয়েক রোগী জানালেন, সপ্তাহে মাত্র একবার চাদর পরিবর্তন করে দেওয়া হয়।
কয়েক রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও ঠিকমতো কাজ করে না। তারা শুধু লোক দেখানো পরিষ্কার করে। তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করলে হাসপাতাল আরও বেশি পরিষ্কার থাকত।
হাসপাতালে সেবা নিতে আসা শ্রাবণী আক্তার নামে এক তরুণী বলেন, খরচ কম বলেই নিরুপায় হয়েই সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে আসি। কিন্তু হাসপাতালের যা পরিবেশ এখানে রোগী সুস্থ হওয়ার বদলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। এর চাইতে ডাস্টবিনের পাশের ফুটপাতে থাকাও ভালো।
খায়রুল হক নামে আরেকজন জানান, সিট পাইনি বলে মেঝেতে ফোম বিছিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মেঝে ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না। বেডের মধ্যে ছারপোকা আর ছোট ছোট তেলাপোকার বাসা। হাসপাতালের পরিবেশ যদি এমন হয়, তবে মানুষ কোথায় গিয়ে সুস্থ হবে।
তবে প্রশাসনিক এলাকায় গিয়ে দেখা যায় সেখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। হাসপাতালের এই অংশটি দারুণ পরিষ্কার, বেশ পরিপাটি।
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশিদ-উন-নবী বলেন, আউটডোরে সেবা নিতে আশা রোগী এবং যারা করোনার টিকা নিতে আসে তাদের জন্য ৪টি নতুন টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। আউটডোরের রোগীদের অসন্তোষ থাকার কথা নয়।
তিনি বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে বেড ৪০টি হলেও রোগী ভর্তি থাকে ১২০ জন। এই রোগীদের সঙ্গে ২-৩ জন করে অ্যাটেনডেন্সও থাকে। বাথরুমটা করা হয়েছে কিন্তু ৪০ জনের জন্য। ব্যবহার করছে ৩০০ জনের বেশি মানুষ। এত বেশি লোক হলে তাদের মেইনটেন করাও কষ্টকর। এ ছাড়া উন্নয়ন কাজ চলার কারণে কিছু বাথরুম বন্ধ আছে। এজন্য হয়তো একটু কষ্ট হচ্ছে।
অতিরিক্ত রোগীর চাপের কারণে বিছানার চাদর অনেক সময় ঠিকমতো দেওয়া যায় না স্বীকার করে পরিচালক রশিদ-উন-নবী বলেন, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ঠিকমতো কাজ করেন। তবে রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনদের কারণে হাসপাতাল ঠিকমতো পরিষ্কার থাকে না। অতিরিক্ত রোগী এবং তাদের স্বজনরা হাসপাতাল অপরিচ্ছন্ন থাকার সবচেয়ে বড় কারণ।