দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে চলছে নানা সমীকরণ। ছোট ছোট ইসলামপন্থি দল যেমন আসছে, তেমনি নতুন নিবন্ধন পাওয়া দলগুলোও বিরোধী দল হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে, সরকারের বিশেষ পরিকল্পনায় এ দলগুলোকে নির্বাচনে আনা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাপ দেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু প্রলোভন বা চাপ কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে একসময়ের প্রভাবশালী দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) বেশ কয়েকটি বামপন্থি দল নিজেদের মতো আন্দোলন করছে।
সিপিবি-বাসদের বাম গণতান্ত্রিক জোট ও কয়েকটি বাম দলের নেতারা বলছেন, ‘একতরফা’ নির্বাচনে করতে ‘কেনা-বেচা’ চলছে। বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের কাছেও এমন প্রলোভন এসেছে। কিন্তু তারা মনে করেন, জনগণের চাওয়া উপেক্ষা করে কোনো প্রলোভনে পা দেওয়া তাদের উচিত হবে না।
বাম দলগুলোর নেতারা বলছেন, সরকার একতরফা নির্বাচনের তকমা ঘোচাতে বিভিন্ন দল ও ব্যক্তিকে নির্বাচনে আনার জন্য নানা অপকৌশল ব্যবহার করছে। তবে এসব যে একটি কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হচ্ছে, তা গোপন থাকছে না। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট দূর হবে না; বরং দেশ ও দেশের মানুষ নতুন সংকটে পড়বে।
সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে আসছে বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ সমমনা দলগুলো। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও ঋণখেলাপি-ব্যাংক ডাকাত, অর্থ পাচারকারী, কালোটাকার মালিক, দুর্নীতিবাজদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা, না ভোটের বিধান, প্রতিনিধি প্রত্যাহারসহ নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কার দাবিও রয়েছে।
বামপন্থিদের মধ্যে রাশেদ খান মেননের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু) ও দিলীপ বড়ুয়ার সাম্যবাদী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক। আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে মাঠের রাজনীতিতে অবস্থান তৈরি করতে চাইছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। এ জোটে ছয়টি দল রয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দল দুটি। জোটের অন্য শরিকরা হচ্ছে বাসদ (মার্ক্সবাদ), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টি।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে সদ্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন পাওয়া শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ। দলটির নেতারা মনে করেন, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কোনো পরিবেশ নেই। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া নির্বাচন হলে দেশ সংঘাতের দিকে যাবে।
এদিকে সরকার হঠানোর আন্দোলনে গতি আনতে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সঙ্গে আন্দোলন করছে ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা নামে আরেক জোট। বাসদের সাবেক নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সাম্যবাদী আন্দোলন, আ ফ ম মাহবুবুল হক (প্রয়াত) নেতৃত্বাধীন বাসদ রয়েছে এই মোর্চায়। এ ছাড়া রয়েছে নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চা, গণমুক্তি ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট ইউনিয়ন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চ।
অন্যদিকে বাম গণতান্ত্রিক জোট ছেড়ে আসা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও গণসংহতি আন্দোলনও তফসিল বাতিলের দাবিতে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে। ঘোষিত তফসিল বাতিলের দাবিতে বিএনপির সঙ্গে অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচিও পালন করছে দল দুটি।
নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে সিপিবির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা নীতিগতভাবে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা কোনো দল বা জোটকে সমর্থন করে ভোট বর্জন করছি না। আমাদের দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মনে করে দলীয় সরকারের অধীনে নিজের ভোট নিজে দিতে পারবে না। জনগণের চাওয়াকে যৌক্তিক মনে করে আমরা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন করেছি।’
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘জনমত উপেক্ষা করে সরকারের তল্পিবাহক নির্বাচন কমিশন একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। সুতরাং এই কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর দেশে এ পর্যন্ত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ৭টি দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ৪টি নির্বাচনকে মোটামুটি সুষ্ঠু ধরা হয়।
বজলুর রশীদ ফিরোজ মনে করেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার জানে যে সুষ্ঠু নির্বাচনে তার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। সে জন্য তারা দলীয় সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচন চায়।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো পাতানো নির্বাচনে পা দেব না।’
বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, ‘সরকারের পাতানো নির্বাচনে আমরা যাব না। আমরা বারবার সরকারকে বলেছি তফসিল পিছিয়ে দিয়ে আলোচনা করুন। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করুন।’
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ভোট করতে পারবে, এটা আমরা বিশ্বাস করি না। ফলে তাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা-সংলাপের মাধ্যমে একটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি না করা হয়, ততক্ষণ আমাদের আন্দোলন চলবে।’
বাম দলগুলোর ভোটের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বামপন্থি দলগুলো সংসদে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সিপিবি পাঁচটি, ন্যাপ (মুজাফফর) একটি, গণতন্ত্রী পার্টি একটি, জাসদ একটি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি একটি আসনে জয়লাভ করে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনে যায়নি বামপন্থিরা। ওই বছরই অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে তখনকার ঐক্যবদ্ধ জাসদ নেতা রব ছাড়া আর কোনো বাম নেতা আসন পাননি।
২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ছিল বামপন্থিদের জন্য আরও শোচনীয়। অংশগ্রহণকারী বামদলগুলোর প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ২৩৭ এবং তারা সবাই পরাজিত হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে প্রায় সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাসদ (খালেকুজ্জামান), সিপিবি, ন্যাপ, জাসদ (ইনু), গণতন্ত্রী পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দলসহ (এমএল) ১৫টি বাম রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকে নির্বাচন করে শরিক বামদলগুলো। এদের মধ্যে জাসদ (ইনু) তিন ও ওয়ার্কার্স পার্টি দুটি আসনে জয়লাভ করে। দেশের অন্যতম বড় বাম দল সিপিবি ও বাসদ মিলে প্রাপ্ত মোট ভোটের পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ।
২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দলগুলো ছাড়া আর কোনো বাম দল অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালে দলের নিবন্ধন ধরে রাখতে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচনে অংশ নেয় বাম জোট। ১৭৩টি আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছিল তারা। যদিও নির্বাচনের সময় ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করেছিল বাম জোটগুলো।