
লেখার নিমন্ত্রণ কখনো নিমন্ত্রকের গুণে বিশেষ হয়ে ওঠে। কখনো কখনো এর বিষয়বস্তুর গুণে তা অনন্য হয়ে যায়। নাহলে এই পত্রিকার পাতায় প্রথমবারের মতো হাজির হওয়ার জন্য চলচ্চিত্র বিষয়ক কোনো রচনা আমার জন্য সেরা বাছাই নাও হতে পারত। কিন্তু হয়েছে। বিলীয়মান কারখানার শিল্পীদের বিষয়ে রচনা নিজগুণে বড় হাতছানি। বিশেষত তাদের নিয়ে যারা খোদ সচলকালেও ছিলেন অতিশয় মুস্কিলের এক বর্গ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কৌতুকাভিনেতা।
সাহিত্যের দাপ্তরিক ভাষায় যতই ‘কৌতুকাভিনেতা’ বলা হোক, সাধারণ কথ্যভাষাতে এদের পরিচয় ছিল কমেডিয়ান বা ভাঁড় হিসেবে। স্বাধীনতার আগে থেকেই, আরও নিবিড়ভাবে তদন্ত করে বললে, নিম্ন ৭০’র দশক থেকে সুপ্রতিষ্ঠিতভাবে, বাণিজ্যসফল বা বাণিজ্যপ্রবণ ছায়াছবিগুলোতে কৌতুকাভিনেতার দাবি ও প্রচলন দুই-ই ব্যাপক হারে ছিল। একজন অন্তত শক্তিমান এবং/বা জনপ্রিয় কৌতুকাভিনেতা প্রায় সব ব্যবসাকারী ছবিরই বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রায়শই, নায়ক বা প্রটাগনিস্ট চরিত্রের নিকটজন বা সমর্থক হিসেবে এরা এসেছেন। কিছু বিরল ক্ষেত্রে কৌতুকাভিনেতাকে পাওয়া যায় খলের সমান্তরালে, তার অনুগত হিসেবে। খান জয়নুল, আনিস, রবিউল, টেলিসামাদ, এ টি এম শামসুজ্জামান, আশীষ কুমার লোহ, দিলদার প্রমুখ অনেক নাম এই কাতারে আসবে। কিছু পরের প্রজন্ম চিনেছেন আফজাল শরীফকে। খুব বেশি নাম এই পর্বকাল থেকে নেওয়া যে যায় না সেটার কারণ আসলে চলচ্চিত্রের ধারণাগত কারিগরি বদলের মধ্যেই। কৌতুকাভিনেতাদের গুরুত্ব দিয়ে স্ক্রিপ্টে রাখার কাজই কমে গেছে। কিংবা, তাদের চরিত্রগুলোর ধার-ভার কমে গেছিল। আবার, অভিনেতাদের শৈলী নিয়ে আলাপ উঠতেই পারে।
চরিত্রের ভার কিংবা ধার, আর অভিনেতাদের শৈলী প্রসঙ্গে তর্ক লম্বা হতে পারে। কিন্তু এই মীমাংসা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে যে কৌতুকাভিনেতার সাংস্কৃতিক বা মর্যাদাগত মূল্য চিরকালই ঊণ থেকে গেছে। সেই পরিস্থিতিটার একটা গুরুতর উদাহরণ পাওয়া যায় যখন ‘কমলা রকেট’ ছায়াছবির জন্য মোশাররফ করিমকে ‘কৌতুক অভিনেতা’ হিসেবে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেওয়া হয় এবং তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। পুরস্কার প্রদানকারীদের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন করা অতীব জরুরি, বিশেষত ছায়াছবিটির সারবস্তু বিবেচনা করলে। কৌতুকাভিনেতাদের যে চাকরিবিধি বাংলাদেশের ছায়াছবিতে আগের বছরগুলো থেকে এসেছিল, তার বিচারে কোনোভাবেই মোশাররফ করিম কৌতুক চরিত্রে অভিনয় করেননি। তবে বাংলাদেশে যেসব প্রতিষ্ঠান সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিল্প নিয়ে পর্যালোচনা করেন, তাদের কাছে চিন্তাশীল লোকজন অনেক দিন ধরেই আর কাণ্ডজ্ঞান আশাও করেন না। মোশাররফ করিম পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করে খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বলে আমি মনে করি। তবে ‘সিরিয়াস’ বনাম ‘কৌতুক’ বা ‘নায়ক’ বনাম ‘নায়কের বিশ্বস্ত কমেডিয়ান অনুচর’ এই বিভাজনের গল্পরেখা নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ-আস্থা নেই। প্রসঙ্গটির গুরুত্ব বিবেচনা করে আমার ‘সাহিত্যবোধ’ আমি বলতে ছাড়লাম না আরকি!
মোশাররফ করিম একভাবে চিত্তাকর্ষক উদাহরণ। কারণ তার অভিনয় দক্ষতা অমিত হলেও, টেলিভিশনে তিনি বছরের পর বছর আসলে কোনো না কোনোভাবে ‘কৌতুকাভিনেতা’ হিসেবে পরিসীমিত হয়ে ছিলেন। বরং, চলচ্চিত্রেই তিনি তার অভিনয় দক্ষতার প্রমাণ রাখবার বিস্তর সুযোগ পেয়েছেন। বিষয়টা ভাববার মতো, আয়রনিক। লক্ষণীয় যে, আমাদের তালিকাতে যে নামগুলো এলো তার প্রায় সবগুলোই চলচ্চিত্রের নাম, কেবল আফজাল শরীফ এর ব্যতিক্রম। তিনি টিভিতে জনপ্রিয়তার সূত্র ধরে চলচ্চিত্রের কাজে গিয়েছিলেন। বাকিদের ক্ষেত্রে তা নয়। এই বাস্তবতাটা খোদ মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের বয়স আর টেলিভিশনের বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত। টেলিভিশন যেকালে একটা মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, ততদিনে বাকিরা চলচ্চিত্রের প্রতিষ্ঠিত তারকা। অধিকাংশই টেলিভিশনে কখনো কাজ করেননি। বা করলেও নগণ্য। এখানেও ব্যতিক্রম আছেন একজন এ টি এম শামসুজ্জামান। তিনি টেলিভিশনে দোর্দণ্ড প্রতাপে কাজ করেছেন। এমনকি মধ্যবিত্তের যে প্রজন্ম তেমন একটা প্রেক্ষাগৃহে যাননি কখনো, তারা একে আনকোরা চেনার সুযোগ পেয়েছেন মুখ্যত টেলিভিশনে। টেলিভিশনে জনাব শামসুজ্জামানের কৌতুকাভিনয় দক্ষতারই বহুবিধ প্রয়োগ করার সুযোগ নিয়েছেন নির্মাতারা। চাইলে কেউ আশীষ কুমারের নামও সংযোজন করতে পারবেন; তবে তিনিও চলচ্চিত্র কাঁপানোর পরের ধাপে টেলিভিশনে আসেননি।
দারুণ প্রতিভাবান এই অভিনেতা (এ টি এম) অবশ্য কেবল চলচ্চিত্রের মধ্যেও স্বতন্ত্র কারণে উল্লেখের দাবিদার থাকেন। কৌতুকাভিনেতা এবং খল অভিনেতা হিসেবে যুগল-মুকুট ধারণের কৃতিত্ব খুব কম অভিনেতার রয়েছে। তিনি সেখানে প্রায় অনন্য। এটা বলবার সময়ে দুজন অভিনেতাকে স্মরণে আনছি। একজন অবশ্যই মুম্বাই কারখানার উৎপল দত্ত। তবে উৎপল দত্তের বেলায় বিষয়টা ঠিক শামসুজ্জামানের মতো নয়। শামসুজ্জামানের প্রধানত খল হিসেবে আবির্ভাব আর প্রধান কৌতুকাভিনেতা হিসেবে আবির্ভাব প্রায়শই ভিন্ন প্রকল্পের বা ছায়াছবির ছিল। আরও গবেষণা করলে সম্ভবত এই প্রস্তাবটা দেওয়া যেত যে, এ টি এম খল হিসেবে দুর্দান্ত সফল হওয়ার পর কৌতুকের কাজগুলো কম পেতেন বা নিতেন। পক্ষান্তরে, উৎপলের অনেকগুলো খল চরিত্রই মৃদুখলত্বের ওপর দাঁড়ানো এবং সেখানে কৌতুকগিরি তার খলত্বের সঙ্গে মেশানোই থাকত; প্রায়শই পারিবারিক পরিমণ্ডলের গল্পে। তবে ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে তার কৌতুকদক্ষতাকে নির্মাতা তীব্রভাবে খলগিরিতে প্রয়োগ করিয়েছিলেন। অন্য উদাহরণ হচ্ছেন ডিপজল। তার অভিনয় বা চলচ্চিত্রীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণ জনজবানে আছে। আমি আজ উল্লেখ করব প্রথমত এটা যে, নৃশংস খল হিসেবে ডিপজল অভিনয়-যাত্রার/অ্যাক্টিং-লাইনের গুরুতর রদবদল করেছেন। উপরন্তু, তিনি খুবই অসচরাচর কিছু সংলাপ ও ভঙ্গি/এট্যিটুড খল চরিত্রে সংযোগ ঘটিয়েছিলেন। সেই হিসেবে তার দ্বারা রূপায়িত খল চরিত্রগুলোর একটা কমিক্যাল বৈশিষ্ট্য বেশ সহজেই পাঠ করা যায়। যেহেতু তার অভিনীত ছবিগুলোর বেশ বড় একটা অংশের তিনি নিজেই প্রযোজক, কখনো কখনো প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে স্ক্রিপ্টকার/সংলাপ-রচয়িতা, তাই নির্মাণীয় কৃতিত্ব/ অকৃতিত্বের সিংহভাগও তারই পাওনা।
খুব কম আলাপের মধ্যেও চলচ্চিত্রের কৌতুকাভিনেতাদের নিয়ে যে আলাপটা কখনো চোখে বা কানে পড়েনি আমার, তা হচ্ছে যৌন পরিসরের দেনদরবারে এদের ভূমিকা। বাস্তবে কৌতুকাভিনেতা প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে পুরুষ, আর যৌন-উদ্ভাসক চরিত্রগুলো ব্যতিক্রমহীনভাবেই নারী (ছিলেন); সেখানে পুরুষ-কৌতুকাভিনেতাদের যৌন-পরিসরীয় ভূমিকা নিয়ে আলাপ তোলা বেশ খাপছাড়া লাগতে পারে। কিন্তু, একটু শান্তভাবে মনোযোগ দিলে সেই প্রবণতাটা ছায়াছবির ইতিহাসে দেখা সম্ভব। ‘ভালমানুষ’ নায়ক, যার কি না একটা হেটারোসেক্সুয়াল চুমু দিতে গেলেও নির্মাতাদের বাগানের দুইটা বাতাসে-চঞ্চল ফুল দেখাতে হয়, কিছুতেই যৌনতার দায়/ভার যখন গ্রহণ করবেন না, তখন পুরুষজাতির বেজায় চেপে-রাখা-যৌনেচ্ছার একটা পর্দারূপী অবতার হিসেবে এসব কৌতুকাভিনেতার জব ডেস্ক্রিপশন নির্ধারিত হয়েছিল। দিলদারের জীবনে এটা হয়তো দৃষ্টান্তমূলকভাবে বেশি ছিল, তবে অন্য অনেকেরই কাছাকাছি কর্মকাণ্ড করতে হয়েছে। যে নায়িকার উরুপানে ‘চরিত্রবান’ নায়ক কিছুতেই ‘ভালোমতো’ তাকাবেন না, সেই নায়িকারই সখীর উরু বা কোমরপানে নায়কের ‘সখা’ কৌতুকাভিনেতা এমনভাবে তাকাবেন যে দর্শকও (অন্তত পুরুষ দর্শক) না বুঝে থাকতে পারবেন না যে ‘কী দেখা হচ্ছে’ ও ‘কীভাবে’। এরকম কাজ আশীষ কুমারকেও করতে হয়েছে (ছবির নাম এখন পুনরাবিষ্কার করা কঠিন)। আবার রবিউল তার সহশিল্পী নারীর সঙ্গে ঠোঁট দিচ্ছেন ‘ও ছুঁড়ি তোর গাছের পাকা জাম্বুরা ফল কে খাবে’ (সহশিল্পী বা ছায়াছবি এখন পুনরাবিষ্কার অসম্ভব)। বাস্তবে এখানে ‘জাম্বুরা’র উপমার গুণ ও রুচি নিয়ে সারা দিন আপনারা তর্ক করতে পারেন; কিন্তু এটা ছায়াছবির জন্য তখন অবধারিত ছিল, এবং সেটা কিছুতেই ‘চরিত্রবান’ নায়ক ‘সুশীলা’ নায়িকার সঙ্গে (তখন) করতেন না। এই কাজগুলো তখন রবিউল সাহেবদের জন্যই নির্ধারিত ছিল। ফলত, প্রায় অযৌন নায়কের সঙ্গে এই চরিত্রগুলোর সম্পর্ক অত্যাবশ্যক সহগের।
ইরটিক ইঙ্গিতবাহী কাজকর্মে এরা না থাকলে নায়করা আলু বা মুলার মতো ভেজিটেবল থাকেন বা থাকতেন এই অনুভূতি-রাজ্যে। যেমনটা আগেই বলেছি, দিলদার এই বিশেষ ভূমিকায় সম্ভবত সবচেয়ে দায়িত্বশীল হিসেবে ছিলেন। উত্তরকালে নায়করা খোদ এসব কাজের জন্য মনোনীত হলেন, তাই নায়িকারাও। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ইরটিসিজমের রাজদণ্ড, বলা চলে, কৌতুকাভিনেতারা ঐতিহাসিকভাবেই হারালেন। ঠিক এই কারণেই উত্তরকালে কৌতুকময় চরিত্রের অবলোপ বা গুরুত্বহানি হতে শুরু করেছে সেটা আমার বক্তব্য বা থিসিস নয়। কিন্তু রূপান্তরটাকে আঙুল তুলে দেখানোতে বাধা পাই না কোনো।
আজীবন কৌতুকাভিনেতা হিসেবে বিরাজমান অভিনেতাদের কেন্দ্রীয় চরিত্র বানিয়ে ছায়াছবি হয়েছে। কলকাতায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে, কিংবা মুম্বাইতে মেহমুদকে নিয়ে। সেসব ছবির কিছু ব্যবসাসফল, কিছু মর্মান্তিক লোকসান করেছে। বাংলাদেশেই তুলনামূলকভাবে উদাহরণ কম পাওয়ার কথা। এমনকি সাবেক কালের কথাই হচ্ছে। তবে একটা বা দুটো ব্যবসাসফল ছবি থাকলেই সাংস্কৃতিক মর্যাদার প্রশ্নে এই অভিনেতাদের উল্লম্ফন ঘটে যায় না। এই কাজগুলো পর্দায় যতটা চঞ্চল যতটা কৌতুকাশ্রয়ী (বা অন্তত তৎপর), পর্দার বাইরে চলচ্চিত্র বা শিল্পচর্চার ইতিহাসে ততটাই মর্মস্পর্শী। এই মুহূর্তে গোটা আলাপটাই আরও নিরর্থক যখন বড় পর্দার অস্তিত্বই আসলে আর নেই। নেই সেসব মিলনায়তন যেখানে নানান রুচির সংঘর্ষের মধ্যেও, নানান শ্রেণির মানুষের অভ্যন্তরীণ লড়াই সত্ত্বেও, প্রেক্ষাগৃহের পর্দা ছিল তুলনামূলকভাবে সর্বজনীন। সর্বজনীন পর্দার বিলুপ্তি একটা গভীর রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, বিষাদেরও; আর কদিন পরেই বিস্মৃতিরও প্রসঙ্গ হবে তা। ঠিক যেমন এই হাসিমুখ অভিনেতারা!
একটি সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সূচনা। ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে যখন পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা জেগে ওঠে, তখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন রাষ্ট্রের রয়েছে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পার করে আমাদের সাংস্কৃতিক রূপরেখাটিও সময়ের সাথে সাথে নানা রূপ পরিগ্রহ করেছে। দেশ রূপান্তরের চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির এই পরিক্রমাটিকে আমরা ধরতে চেয়েছি। চার পর্বের এই বিশেষ আয়োজনটি সাজানো হয়েছে– ‘পর্দান্তর’, ‘সুরান্তর’, ‘চিত্রান্তর’ ও ‘প্রান্তর’ শিরোনামে।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অর্জন ও রূপান্তর নিয়ে আলোচনা শুরুর একটি সূত্র হতে পারে এই আয়োজনটি।
পর্দান্তর শিরোনামে প্রথম পর্বের আয়োজনে খোঁজ করেছি মঞ্চ, টেলিভিশন, সিনেমা, ওটিটি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত ৫২ বছরের বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অর্জন ও হালহকিকত।
আমাদের আন্দোলনকাল, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়টা স্মরণ করি। সে সময় রাজনীতি করা মানুষ ছাড়াও সাধারণের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ, সমীহ ছিল। এটাকে মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা ধরে নেওয়া যায়। সচেতনতা ছিল বলেই নেতা প্রবল আত্মবিশ্বাসে উন্মুখ জনসমুদ্রের সামনে করেছিলেন সেই প্রাণপণ উচ্চারণএবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। আমরা দেখি, গর্জে ওঠে বাংলাদেশ। দেখতে পাই, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল জাতি। আমরা অর্জন করলাম স্বাধীনতা।
মানুষের স্বপ্ন, সাধের মধ্যে কোনো বীজ রোপিত হলে ফলবান বৃক্ষের আশা অপূর্ণ থাকে না। আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমাদের এটাও জানিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, বিশ্বাসী হওয়া, নিবেদিত নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপালনে দৃঢ়চিত্ত হওয়া মানুষের জন্য খুবই জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মানুষ একসময় নিজেকে ছাপিয়ে নিজ নিজ আশা, স্বপ্নকে বড় ভেবেছে। সে সামর্থ্য ছিল, তার প্রচুর উদাহরণ হাজির করা যায়। স্বপ্ন সাধ পূরণের জন্য তখন অঙ্ক কষাকষি হয়নিস্রেফ ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই যে সাত পাঁচ না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঝোঁক, তা আমাদের গৌরব করার মতো বহু কিছু দিয়েছে।
আমরা যদি পেছন ফিরে তাকাই, দেখতে পাব অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে মানুষ পাশাপাশি ছবি এঁকে, গান লিখে সুর করে গেয়ে, খেলে যুদ্ধ চালিয়েছে সগৌরবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নানা প্রত্যয় জাগানিয়া অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো, তার মধ্যে চরমপত্র ছিল কথা বলার অনুষ্ঠান। কথাও আগ্রহ নিয়ে শোনার বিষয় ছিল। কথাও ছিল যুদ্ধাস্ত্র।
সময় মানুষকে শেখায়, নির্মাণ করে। কোনো কোনো মানুষের কাছে উপযুক্ত হওয়া বড় কথা আবার বহু মানুষ সময়ের উপযুক্ত হয়ে ওঠাকেই জরুরি বলে বিবেচনা করে। একটা সময় মানুষের মধ্যে এই ভেদ থাকলেও তেমন দৃশ্যমান হতো না। দৃশ্যমান ছিল, নানা ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রমাণের তুমুল চেষ্টা, তাগিদ।
স্বাধীনতার পরের বাংলাদেশে বিবিধ ক্ষেত্রে যা যা ঘটেছে সবই বিস্ময় জাগানোর মতোএমনটা বলাবলি হয়। সাহিত্য, সিনেমা, সংগীত, ক্রীড়া, টেলিভিশন বা মঞ্চনাটকসবকিছু মাতামাতি করার বিষয় হয়ে ওঠে।
যখন মানুষ দলে-বলে স্বপ্নের হাত ধরে এগিয়ে যেতে চাইবেযেমনটা হওয়ার কথা, তেমনই প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। সিনেমা ঘর, থিয়েটারের মিলনায়তন, খেলার মাঠ, সাহিত্য সভা, সংগীত নৃত্যকলার উৎসব, সার্কাস যাত্রার প্যান্ডেলসর্বত্রই ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়। এই ভিড় প্রেমের কারণে, আগ্রহ কৌতূহল ও আনন্দসন্ধানের অশেষ উৎসাহে।
চিত্র বদলে গেছে, অস্বীকার করা যাবে না। নানা কারণের কথা হয়তো বলা যাবে কিন্তু সত্য এইযা যা কিছু মানুষের ভেতর বদলে দিতে পারত, সবকিছুতেই এসেছে বদল। প্রায়ই শুনতে হয়, সিনেমা আগের মতো নেই। টেলিভিশন বা মঞ্চনাটকও আগের মতো নেই। এমন অভিযোগের তীর লক্ষ্য বেছে বেছে ছুড়ে কী লাভ! আমরা তো সবাই জানি, নিজেসহ কেউ, কোনো কিছুই আগের মতো নেই। থাকবার কথাও নয়। বরং ভেবে সন্তুষ্ট হওয়া যাক, নানা প্রতিকূলতা, অস্বস্তির মধ্যেও সুন্দরের জন্য, ভালোর জন্য চেষ্টা করে চলেছেন মানুষ।
মানুষের এখন সবচেয়ে বড় সংকট, কীভাবে ভালো ও মন্দ বুঝবে! একসময়ে যোগাযোগ মাধ্যমের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও জানা-বোঝা দুষ্কর ছিল না। সব ক্ষেত্রে আলাদা, নতুন কিছু ঘটা মাত্র বিশেষ হয়ে উঠতে পেরেছে, পারত। প্রশংসা পাওয়ার বিষয় দ্বিধাহীন প্রশংসিত হয়েছে, হওয়ার নিয়ম ছিল। বদল এসেছে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে। কর্মের আগে হিসাব-নিকাশ, স্বার্থপরতা গোটা মানুষের নিত্যদিনের জীবন কীভাবে পর্যুদস্ত করে চলেছেভেবে দেখার সময় হাতে নেই।
সময় এখন স্বার্থরক্ষার। কোন স্বার্থ কীভাবে রক্ষিত হচ্ছে তার বিচার-বিশ্লেষণেও হওয়া জরুরি। একটু গভীরে নেমে তলিয়ে দেখলে মনে খানিকটা সংকোচ জন্মাততাতে ক্ষতির গতি সামান্য হলেও হয়তো কমতে পারত।
ধদিকহারা হলে যে অবস্থা হওয়ার কথা তেমনই দশাচারদিকে দৃশ্যমান অস্থিরতা। দেখতে বসে দেখছি না, শুনতে বসে শোনা হচ্ছে কি খেয়াল করছি না কেউই। আমাদের মন আছে, সে মনের কথা শোনা বাদ দিয়ে অন্যের বলা কথায় কান পাতছি। হুজুগে বললে মানতে নারাজ আমরা কিন্তু অজান্তে সে ফাঁদেই পা দিয়ে ফেলছি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একালের অসাধারণ একটা প্রাপ্তি। পারস্পরিক যোগাযোগ মানুষের সমৃদ্ধি ঘটায়, মানুষকে সম্পন্ন করে। এর অন্যদিকও রয়েছে। পৃথিবীর নিয়ম যেমনআলোর অপর পিঠেই থাকে অন্ধকার। সবার জন্য যখন একটা মাঠ উন্মুক্তসেখানে নিয়মশৃঙ্খলা কিছুই টিকে থাকার কথা নয়। রাজা আর রাজত্বের মানে না বুঝে, সুরের ধারণা থাকা ও না থাকা মানুষরা একত্রে আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে গাইলে যেমনটা হওয়ার, তেমনই প্রত্যক্ষ করা হচ্ছে। তবুও হাল ছাড়েননি সব ক্ষেত্রের সৃজনশীল মানুষ। বিপন্নবোধ করার মতো বহু কিছু ঘটলেও অটুট রেখেছে মনোবল। একটা কথা জরুরি মনে করে বলা দরকার, সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে মেতে থাকা মানুষরা অন্য সবার মতো নয়হয় একটু ভিন্ন রকমের। কর্মের চেয়ে আর কোনো কিছুই এসব মানুষের কাছে বড়, বিশেষ হয়ে ওঠে না। প্রতিকূলতা এসব মানুষকে তেমন বিপর্যস্ত করতে পারে না কিন্তু উপেক্ষা, মানুষের হীনমন্যতা ও স্বার্থপর কাণ্ডকীর্তি পীড়িত করে।
যা ভালো তা প্রেরণা জোগায়। চিত্রকলা সম্পর্কে বিশেষ ধারণা না থাকা সত্ত্বেও চিত্র প্রদর্শনীতে গেলে ভালো ছবির সামনেই সাধারণ দর্শককে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। সংগীত বিষয়ে খুব জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও যেসব গান, শিল্পী আমাদের মুগ্ধ করেছে, যুগের পর যুগ ভালো লাগার তালিকায় স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেকী তার পেছনের কারণ, কারও অজানা নয়। সিনেমা ঘর উঠে যাচ্ছে, গড়ে উঠছে শপিং মলএটা বিনিয়োগকারীর ভালো থাকা, টিকে থাকার কৌশল। সাধারণ মানুষের মধ্যে ভালো টিকিয়ে রাখা কৌশল কী?
ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ উদ্যম প্রচেষ্টা থেমে নেই। নতুন মাধ্যমের আগমন ঘটেছে। দায়িত্বশীলতা নিয়ে নতুন মাধ্যমের দর্শকের চমকে দেওয়ার মতো প্রযোজনা ছোটপর্দায় বড় আশা জাগিয়ে হাজির হয়ে চলেছে একের পর এক। এই ভালো, এই আলো ও আশা টিকিয়ে রাখা সমষ্টির জন্য খুবই জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি বলি, এটা অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না।
আমাদের দেশকে আমরা চিনি। পৃথিবীকে যদি চিনিয়ে দেওয়ার আকাক্সক্ষা থাকেযেসব মাধ্যম, মানুষ ও কর্মের সাধ্য রয়েছে বিশেষ করে চিনিয়ে দেওয়ার সবার পাশে আপন হয়ে দাঁড়াতে হবে। আমরা দাঁড়াইও, দাঁড়াতে হবে সব আন্তরিক চেষ্টার পেছনে, পাশেশুধু সাফল্য পাওয়া মানুষ ও কর্মের সঙ্গে নিজেকে জুড়ে দিয়ে যে আনন্দলাভতা সংগ্রামের অংশ হওয়া নয়, উপভোগের জোয়ারের অংশ হওয়া।
আলমগীর কবির (১৯৩৮-৮৯) এই এক নামে তিনি পরিচিত হলেও প্রতিভার বিচ্ছুরণে তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক। তিনি ছিলেন সাংবাদিক, সমালোচক, রাজনৈতিক কর্মী, চিত্রপরিচালক, প্রযোজক, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার, সংগীতকার, পরিবেশক, চলচ্চিত্র প্রশিক্ষক, চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, সংগঠক, বিশ্লেষক, প্রকাশক, সম্পাদক, গ্রন্থকার, টিভি ও বেতার সমালোচক, মুক্তিযোদ্ধা। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে তিনি ‘চলচ্চিত্রচার্য’।
আলমগীরের প্রতিভা ও কর্মের সৌরভে প্রাণায়িত হয়েছে আমাদের দেশ-সমাজ ও সংস্কৃতি। ১৯৫৮ সালে তিনি লন্ডন গিয়েছিলেন অঙ্ক ও পদার্থবিজ্ঞানে পড়তে। কিন্তু ওখানে জড়িয়ে পড়েন বিশ্বরাজনীতি ও হতাশাবাদের সঙ্গে। বার্গম্যানের ‘সেভেনথ সিল’ চলচ্চিত্র দেখে তিনি চরম অস্থিরতায় ভোগেন। তিনি অতীত জীবনের সব শিক্ষাগত সার্টিফিকেট লন্ডনের টেমস নদীতে ছিঁড়ে ফেলে দেন। তিনি আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতে জড়িত হন। ভর্তি হন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউটে। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ফ্রন্টে যোগ দেন। ফিলিস্তিন ও আলজেরীয় আন্দোলনেও জড়িত হন। নির্মাণ করেন চলচ্চিত্রও। ব্রিটেনের ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার সমালোচনা।
এদিকে দেশে তিনি সামরিক সরকারের চোখে তখন অবাঞ্ছিত ঘোষিত। ১৯৬৬ সালে দেশে ফিরে ‘চিত্রালী’, ‘পাকিস্তান অবজারভার’ ও সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে তুমুল বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকেন শব্দে, বাক্যে, চিন্তায়, মননে, উপস্থাপনায়। সরকারের নিষেধাজ্ঞায় তার গতিবিধি হয় নিয়ন্ত্রিত। তবে বেনামে গোপনে চলতে থাকে তার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সাংবাদিক কর্ম। তিনি জড়িত হন পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদে। ১৯৬৯ সালে তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কাজ করেন। তিনি রচনা করেন পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্রের ইতিহাস ‘সিনেমা ইন পাকিস্তান’, গঠন করেন ‘ঢাকা সিনে ক্লাব’ এবং প্রতিষ্ঠা করেন ‘ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট’।
১৯৭০ সালে আলমগীর কবির, জহির রায়হান ও অন্যান্য মিলে বের করেন ‘এক্সপ্রেস’ নামে ইংরেজি সাপ্তাহিক এবং নিজে প্রকাশ করেন সিনে ম্যাগাজিন ‘সিকোয়েন্স’। আর ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি গেরিলা হয়ে কাজ করেন সরকারের প্রধান প্রতিবেদক, স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান প্রযোজক-পাঠক হিসেবে এবং জহির রায়হানের সঙ্গে মিলে তৈরি করেন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র : ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’, ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নর্স’-এর ধারাভাষ্যকার এবং ‘লিবারেশন ফাইটার্স’-এর পরিচালক হিসেবে। এসবই ছিল আজীবন মুক্তিযোদ্ধা আলমগীর কবিরের আত্মিক ও সাত্মিক আদর্শের নান্দনিক বিচ্ছুরণ।
১৯৭২ সালের পর মুক্ত স্বাধীন দেশে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির নব উদ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন নতুন কলম্বাস। চলচ্চিত্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু, নতুন নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণ (ধীরে বহে মেঘনা, রুপালি সৈকতে, পরিণীতা) এবং গ্রন্থ রচনা, ফিল্ম আর্কাইভ ও ইনস্টিটিউট গঠনে সহায়তা এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে তার বহুমাত্রিক কর্মের বিচ্ছুরণ ঘটতেই থাকে।
অতঃপর মহাশোকের বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি। লন্ডনের টেমস নদীতে যে প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল বাংলাদেশের যমুনা নদীর গর্ভে সেই প্রতিভা তলিয়ে গেল চিরতরে। আলমগীর কবির এক অম্লান নক্ষত্র। বিচ্ছুরণের নান্দনিকতায় আছেন তিনি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অনুভবে।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে নাট্যসাহিত্য ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানামুখী নিরীক্ষা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালে যারা নাট্যসাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মমতাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিম আল দীন, মান্নান হীরা, আবদুল্লাহ হেল মাহমুদ, মাসুম রেজা প্রমুখ। একই সঙ্গে নির্দেশনার ক্ষেত্রে আমাদের আলোচনায় থাকেন আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, সৈয়দ জামিল আহমেদ, তারিক আনাম খান প্রমুখ। তারা আমাদের পথপ্রদর্শক, সেই পথ অনুসন্ধানের নিমিত্ত লেখা।
রাজনীতির ভাষ্য : সৈয়দ শামসুল হকের নাটক
সৈয়দ শামসুল হক একাধারে কাব্যের জমিন, উপন্যাসের আকাশ, গল্পের নদী আর নাটকের ভূমিতে কর্ষণ করেছেন। সমকালীন রাজনীতি ও গণসংগ্রামকে কেন্দ্র করে রচিত তার কাব্যনাটক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের শিল্পভাষ্য। তার রচিত প্রথম নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৫)। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে রচিত এ নাটকে তিনি একটি গ্রামের মানুষের যুদ্ধকালীন ভূমিকাকে উপস্থাপন করেছেন।
সৈয়দ শামসুল হক রচিত গণনায়ক যেন তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের ক্ষমতার লড়াইয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর অংশগ্রহণকে চিত্রিত করে। ইতিহাসের চরিত্রকে শিল্পের ঘরে স্থাপন করে রচিত হয়েছে কাব্যনাটক নূরলদীনের সারাজীবন। ইংরেজ শাসনামলে কৃষক বিদ্রোহকে অবলম্বন করে রচিত হয় এ নাটক।
ঈর্ষা (১৯৯০) নাটকেও ব্যক্তির মানসজগৎ ও রাজনীতিকে একীভূত করে উপস্থাপন করেছেন। নাটকটিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে স্বাধীনতা-উত্তর দেশের সামাজিক ও নৈতিক পতনের চিত্র পাওয়া যায়।
পলাশী যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে রচিত হয় নারীগণ (২০০৭)। সিরাজের মর্মান্তিক পরাজয়ের পর তার প্রাসাদের নারীদের জীবন ও ভাবনার রূপায়ণ এই নাটকে লভ্য। তার রাজনৈতিক ধারার আরেকটি নাটক উত্তরবংশ। দেশ স্বাধীনের পর পরাজিত শক্তির পক্ষাবলম্বনকারীর উত্থানকে তিনি নাটকের বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
তার নাটকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতি একীভূত হয়। তার নাটক রচনার প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক রচনা করেন নাটক লেখা হয় সত্যের শুদ্ধতম তাগিদে।
নাটকে জীবন্ত মানুষের সঙ্গে জীবন্ত মানুষের সংযোগ।
সেলিম আল দীন বহমান বাংলায়
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাঙালির নাট্যভাবনায় সেলিম আল দীন প্রবল শক্তিতে প্রবহমান। তার নাট্যচর্চায় অনেকগুলো পর্ব চিহ্নায়ন করা যায়। প্রাথমিকপর্বে সদ্যস্বাধীন দেশের মানুষের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, রাজনীতির ক্ষয় ইত্যাকার বিক্রিয়া তার নাট্যসাহিত্যে দৃষ্ট। পাশ্চাত্য বাস্তববাদ, প্রকৃতিবাদ, অভিব্যক্তিবাদ, কিমিতিবাদ ভাবনায় জারিত হয়ে রচনা করেছেন সর্প বিষয়ক গল্প, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, সংবাদ কার্টুন, মুনতাসির প্রভৃতি নাটক। একজন অনুসন্ধানী নাট্যকার হিসেবে পথ সন্ধানের ফলস্বরূপ রচিত হয়েছে আতর আলীদের নীলাভ পাট, চর কাঁকড়ার ডকুমেন্টারি ইত্যাদি। তারপরশকুন্তলা নাটকে পুরাণের বিষয় ভেঙে তাকে প্রতিস্থাপিত করেন পাশ্চাত্য আঙ্গিকে। শকুন্তলার পথ বেয়ে কেরামতমঙ্গল ও কিত্তনখোলায় আসেন। শুরু হয় আঙ্গিকের নিরীক্ষা। হাত হদাই নাটকে সমুদ্রভ্রমণের পুরাণ তৈরি করে পাঠক-দর্শকসহ সেই পুরাণে ডুব দেন। চাকা নাটকে বিষয় ও আঙ্গিক সব ক্ষেত্রেই দেশজ ধারার দিকেই পক্ষপাত। চাকা রচনাকালীন বাংলাদেশে সামরিক বুটের দাপট। নাট্যকার পাঠক-দর্শককে স্মরণ করিয়ে দেন, রাষ্ট্র যখন বিশেষ বাহিনীর হাতে পরিচালিত সেই সময়ে সাধারণ মৃত্যুর উৎসবেই জীবনের মানে খোঁজে।
আঙ্গিক নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করেছেন সেলিম আল দীন। একই সঙ্গে আঙ্গিক বিলোপের মধ্য দিয়ে বাঙালির শিল্পরীতি নির্মাণের পথে অবিরত চলেছেন। এমনি করেই রচিত হয়েছে হরগজ, প্রাচ্য, বনপাংশুল, ধাবমান হয়ে নিমজ্জন। হাজার বছরের বাংলা নাট্যরীতি সন্ধানে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন সমকালীন শিল্পরীতি, ইতিহাস থেকে তুলে এনেছেন বাঙালির নাট্যরীতির নন্দনভাবনা। বাঙলা পরিবেশনা শিল্পকলার গবেষণা-অন্তে একটি নতুন বিশ্বাসে এই বলে উপনীত হয়েছেন যে বাঙালির নাট্যরীতি নৃত্য-গীত-সংলাপের আশ্রয়ে নির্মিত।
একটা ছোট গল্প বলি, বাস্তব অভিজ্ঞতা। ঘটনাটা এ রকমকয়েক মাস আগে শ্যুটিং করতে গিয়েছিলাম গোয়ালন্দ, রাজবাড়ীতে। রাতে শ্যুটিং চলাকালীন একটা দৃশ্য শেষ করে পরবর্তী দৃশ্যের সেট এবং লাইটিংয়ের কাজ চলছিল। আমি এই বিরতিতে সাধারণত একটু নির্জন জায়গায় একাকী গিয়ে পরবর্তী দৃশ্যের শট, ব্লকিং, অভিনয়-কৌশল নিয়ে চিন্তা করতে থাকি। তা-ই করছিলাম, অন্ধকার রাতে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই পাশের একটা রেললাইনে। হাঁটছি আর চিন্তা করছি, এমন সময় পাশের টিনের ঘর থেকে ভেসে আসা টেলিভিশনের শব্দ আমার মনঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন করল। একটু এগিয়ে ঘরের ভেতরের পরিবেশটা দেখতে থাকি। একটা কমদামি কালার টেলিভিশনে কোনো চ্যানেলের নাটক চলছে। দর্শক দুজন বুড়ো-বুড়ি। তাদের মুখের এক্সপ্রেশন দেখার জন্য আরও কাছে গেলাম। দেখলাম আনন্দিত মুখ। ভালো লাগল দেখে। নাটকের মাঝখানে বিজ্ঞাপন বিরতি এলো, তবুও তারা চ্যানেল পরিবর্তন করলেন না। অনেকটা সময় ধরে আমি বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুজন প্রতিনিধিকে দেখলাম। তারা আনন্দ নিয়ে টেলিভিশন দেখছেন। টেলিভিশনে কাজ করা একজন মানুষ হিসেবে এই দৃশ্য আমাকে নিঃসন্দেহে ভীষণ আনন্দিত করবেএটাই স্বাভাবিক। মাঝেমধ্যেই আমরা আমাদের কলিগ এবং শহুরে মানুষের মুখে শুনি‘এখন আর কেউ টেলিভিশনে নাটক দেখে না।’ কথাটার সবটুকু সত্যি না। অনেকেই দেখে অথবা অনেকের না দেখে কোনো উপায় থাকে না। কারণ দরিদ্র মানুষজন একশ-দেড়শ টাকা দিয়ে মাসব্যাপী ডিশের কানেকশন পায়, সুতরাং সেই কানেকশনের বদৌলতে যা দেখা যায় তাই দেখে। এখন কথা আসে, তারা ভোক্তা হিসেবে দেখে, কিন্তু আমরা তাদের কাছে কী সার্ভ করছি?
আমার মনে হয় না আমরা খুব গবেষণা করে দেশের সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছি। আমাদের বর্তমান টিভি নাটকের ধরন-ধারণ দেখে মনে হয় যেন আমরা ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার লঞ্চযাত্রী। কোনো মতে রাতটা পার করে দিতে পারলেই হয়। কোনো মতে সময়টা পার করাই যেন বর্তমান টিভি নাটকের মূল উদ্দেশ্য। না আছে কোনো নতুনত্ব, না আছে কোনো উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া।
বিশ বছর আগের রঙের মানুষ আর হুমায়ূন আহমেদের কমেডি নাটকের ফর্মূলায় দুর্বল ভার্সন অথবা প্রেমের নামে আজগুবি প্রহসন। এই চক্র ভেদ করা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে আমাদের জন্য। কারণটা খুবই স্পষ্ট। এই সেক্টরে কাজ করা মেধাবী মানুষদের খুবই সুকৌশলে বের করে দেওয়া হয়েছে। সেই জায়গায় নেওয়া হয়েছে চাকর-শ্রেণির একদল নির্মাতা আর লেখকদের। যাদের না আছে কোনো মেধার জোর, না আছে শক্ত মেরুদন্ড।
ইয়েস স্যার, আই অ্যাম, অলওয়েজ অ্যাট ইউর সার্ভিসযাদের মূলমন্ত্র। হরে-দরে সবাই যে এমন তা অবশ্য আমি বলছি না, কেউ কেউ হয়তো নিভৃতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম।
একটু মেধাবীরা হয় ওটিটি মাধ্যমে কাজ করছেন, নয়তো টেলিভিশনের ভূত কাঁধ থেকে নামিয়ে অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। ওমুক স্টারের শ্যুটিং দেখতে এসে তমুকের মনে সাধ জাগে আমিও একজন লেখক অথবা পরিচালক হতে চাই। তখন সে অমুক স্টার ভাইকে হাতে-পায়ে ধরে যদি দুইটা দিন সময় বের করতে পারেন তাহলে কেল্লাফতে। বছর না ঘুরতেই তিনি হয়ে ওঠেন সময়ের সেরা হিট পরিচালক। মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ তাকে মানব থেকে দানব বানিয়ে তোলে। তখন তিনি ভুলে যান তার নিকট অতীত। হয়তো এক বছর আগে তিনি কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা ছিলেন, সময়ের হাওয়া বদলে এখন তিনি কারওয়ান বাজারে নাটক বিক্রি করেন। ব্যাপারটা হলো বিক্রি করা। মাছের তুলনায় নাটকে ভালোই লাভ হয়। লাভ-ক্ষতির চক্করে আমরা অনেক সম্ভাবনার অপমৃত্যু দেখতে পাই। কিন্তু ঘটনাটা আরও অন্য রকম হতে পারত।
একজন ডাক্তার হতে গেলে যেমন আপনাকে দীর্ঘ বছর ধরে একটা লেখাপড়া, বাস্তব অভিজ্ঞতা শেষ করে নিজের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হবে, ঠিক তেমনি অডিও ভিজ্যুয়াল সেক্টরে কাজ করতে গেলে আপনাকে নির্দিষ্ট বৈতরণি পাড়ি দিয়ে তবেই একজন চিত্রনাট্যকার কিংবা পরিচালক পদে আসীন হতে হবে। বিষয়টা আমরা যেমন বানিয়ে ফেলেছি, ততটা সহজ কিন্তু না এই পথচলা। ফলাফল হিসেবে আমরা শুধু ভয়াবহ ভবিষ্যৎকেই কল্পনা করতে পারি। অন্তত এই সেক্টরে কিন্তু সিনেমা এবং ওটিটি মাধ্যমে অসংখ্য নতুন চিন্তার প্রকাশ দেখতে পাই, যা আমাদের আশায় বুক বাঁধতে সাহায্য করে। টেলিভিশন নাটকের শেষ পরিণতি কী? আমি নাদান তা বলতে অপারগ। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট যে, এত বিশাল একটা গণমাধ্যম। সেটা নিয়ে সরকার এবং নীতিনির্ধারকদের যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। কী হবে টেলিভিশনের চেহারা, কেন হবে, এর পরিণতি কীএসব বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এবং গাইডলাইন ঠিক করে না দিলে যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতা চলতেই থাকবে। যত দিন পর্যন্ত আমরা নাটক-ফাটক প্রবণতা ত্যাগ করতে না পারব, তত দিন বারো ভূতে লুটেপুটে খাবে আমার সাধের টেলিভিশনকে। অতি অনিচ্ছায় লেখাটা লিখেছি। তার পরও জানি অনেকের মনে আঘাত লাগবে। আঘাত লেগে ধ্বংসের পরও যদি নতুন কিছু ঘটে সেটাই হবে আনন্দের প্রহর।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
বুধবার (২৯ মার্চ) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
হেফাজতে সুলতানার মৃত্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মোমেন বলেন, ‘হঠাৎ করে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। আপনি প্রায় প্রতিদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের দুর্ঘটনা দেখতে পাবেন।’
‘এই সপ্তাহে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি গণগুলিতে শিশু নিহত হয়েছে। কারও সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে? আমি মনে করি না এই ধরনের দুর্ঘটনা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নষ্ট করবে।’
এর আগে, নওগাঁ পৌরসভা-চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহকারী সুলতানাকে (৩৮) র্যাব-৫ এর একটি টহল দল ২২ মার্চ সকালে কাজে যাওয়ার সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ধরে নিয়ে যায়। হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতাল এবং তারপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ মার্চ তার মৃত্যু হয়।
মোমেন বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে অন্যদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ার দরকার নেই।
‘বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের সংগ্রামে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে। অন্য দেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের কোনো পাঠের প্রয়োজন নেই।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন খুবই শক্তিশালী।
যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সমস্যা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের গণতন্ত্র খুবই দুর্বল। তাই তারা দেশে ও বিদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষে ওকালতি করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র দেশে ও বিদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের বিষয়ে আরও সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি। আমরা এটি সম্পর্কে একই পৃষ্ঠায় আছি। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গত এক দশকে ব্যাপক সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা ভুয়া ভোটারদের মোকাবিলা করার জন্য ছবিসহ ভোটার আইডি তৈরি করেছি। বিগত ১৪ বছরে নির্বাচন কমিশন হাজার হাজার নির্বাচন পরিচালনা করেছে। তাদের প্রায় সবগুলোই ছিল স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য। এবং ভবিষ্যতেও আমাদের নির্বাচন হবে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য।’
মোমেন বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন বৈশ্বিক গণমাধ্যমে ‘জাদুকরী’ হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্বব্যাপী আমাদের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। এবং ক্রমাগত উন্নয়নের কারণে, বিশ্বের অনেক দেশ এখন আমাদের সঙ্গে বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।’
তিনি আরও বলেন,‘এই স্বাধীনতা দিবসে এবং রমজানের শুরুতে, আমরা অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাছ থেকে অভিনন্দনমূলক চিঠি পেয়েছি।’
মেয়েদের বয়সভিত্তিক দল নিয়ে বাফুফে যতটা তৎপর, সিনিয়র জাতীয় দল নিয়ে ততটাই উদাসীন। আরো একবার দেশের ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থার সিদ্ধান্ত সেটাই প্রমাণ করল। অর্থাভাবের অজুহাত দিয়ে সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানী সরকারদের অলিম্পিক বাছাইয়ে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বাফুফে বলেছে, ‘মায়ানমার যাতায়াতের বিমান ভাড়া, ইনস্যুরেন্স ফি, সেখানে থাকা-খাওয়া ও ট্রান্সপোর্টশনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচের সংকুলান না হওয়ায় উক্ত প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ মেয়েদের জাতীয় ফুটবল দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
অলিম্পিক বাছাইয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা আছে ‘বি’ গ্রুপে। স্বাগতিক মায়ানমারের সঙ্গে গ্রুপে আরও আছে ইরান ও মালদ্বীপ। গ্রুপের খেলাগুলো হবে আগামী ৫ থেকে ১১ এপ্রিল।
বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে চেয়েছিলাম এই বাছাই পর্বের স্বাগতিক হতে। কিন্তু স্বাগতিক মর্যাদা মায়ানমারকে দেওয়া হয়। টুর্নামেন্টের নিয়ম অনুযায়ী এখানে অংশ নিতে হলে সব খরচ নিজেদের বহন করতে হবে, যা বহন করার মতো অবস্থায় নেই বাফুফের।’
আবু নাঈম সোহাগ আরও বলেন, ‘আমরা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। সেই সাহায্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এরপরই আমরা দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
গত সেপ্টেম্বরে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর আর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেননি সাবিনারা। এই সফর বাতিল হওয়ায় মাঠে নামার অপেক্ষাটা তাদের আরো বাড়ল।
মেয়েদের জাতীয় দল নিয়ে বাফুফের উদাসীনতার নজির এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৯ সালের এসএ গেমসে মেয়েদের দল পাঠায়নি বাফুফে।
সেবার যুক্তিটা ছিল অদ্ভুত। যেহেতু তখন মেয়েদের জাতীয় দলটি মূলত বয়সভিত্তিক দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া ছিল, তাই শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে খারাপ করলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারে। এই কারণের কথা বলে সেবার এসএ গেমসে দল পাঠায়নি বাফুফে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’