
লেখার নিমন্ত্রণ কখনো নিমন্ত্রকের গুণে বিশেষ হয়ে ওঠে। কখনো কখনো এর বিষয়বস্তুর গুণে তা অনন্য হয়ে যায়। নাহলে এই পত্রিকার পাতায় প্রথমবারের মতো হাজির হওয়ার জন্য চলচ্চিত্র বিষয়ক কোনো রচনা আমার জন্য সেরা বাছাই নাও হতে পারত। কিন্তু হয়েছে। বিলীয়মান কারখানার শিল্পীদের বিষয়ে রচনা নিজগুণে বড় হাতছানি। বিশেষত তাদের নিয়ে যারা খোদ সচলকালেও ছিলেন অতিশয় মুস্কিলের এক বর্গ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কৌতুকাভিনেতা।
সাহিত্যের দাপ্তরিক ভাষায় যতই ‘কৌতুকাভিনেতা’ বলা হোক, সাধারণ কথ্যভাষাতে এদের পরিচয় ছিল কমেডিয়ান বা ভাঁড় হিসেবে। স্বাধীনতার আগে থেকেই, আরও নিবিড়ভাবে তদন্ত করে বললে, নিম্ন ৭০’র দশক থেকে সুপ্রতিষ্ঠিতভাবে, বাণিজ্যসফল বা বাণিজ্যপ্রবণ ছায়াছবিগুলোতে কৌতুকাভিনেতার দাবি ও প্রচলন দুই-ই ব্যাপক হারে ছিল। একজন অন্তত শক্তিমান এবং/বা জনপ্রিয় কৌতুকাভিনেতা প্রায় সব ব্যবসাকারী ছবিরই বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রায়শই, নায়ক বা প্রটাগনিস্ট চরিত্রের নিকটজন বা সমর্থক হিসেবে এরা এসেছেন। কিছু বিরল ক্ষেত্রে কৌতুকাভিনেতাকে পাওয়া যায় খলের সমান্তরালে, তার অনুগত হিসেবে। খান জয়নুল, আনিস, রবিউল, টেলিসামাদ, এ টি এম শামসুজ্জামান, আশীষ কুমার লোহ, দিলদার প্রমুখ অনেক নাম এই কাতারে আসবে। কিছু পরের প্রজন্ম চিনেছেন আফজাল শরীফকে। খুব বেশি নাম এই পর্বকাল থেকে নেওয়া যে যায় না সেটার কারণ আসলে চলচ্চিত্রের ধারণাগত কারিগরি বদলের মধ্যেই। কৌতুকাভিনেতাদের গুরুত্ব দিয়ে স্ক্রিপ্টে রাখার কাজই কমে গেছে। কিংবা, তাদের চরিত্রগুলোর ধার-ভার কমে গেছিল। আবার, অভিনেতাদের শৈলী নিয়ে আলাপ উঠতেই পারে।
চরিত্রের ভার কিংবা ধার, আর অভিনেতাদের শৈলী প্রসঙ্গে তর্ক লম্বা হতে পারে। কিন্তু এই মীমাংসা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে যে কৌতুকাভিনেতার সাংস্কৃতিক বা মর্যাদাগত মূল্য চিরকালই ঊণ থেকে গেছে। সেই পরিস্থিতিটার একটা গুরুতর উদাহরণ পাওয়া যায় যখন ‘কমলা রকেট’ ছায়াছবির জন্য মোশাররফ করিমকে ‘কৌতুক অভিনেতা’ হিসেবে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেওয়া হয় এবং তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। পুরস্কার প্রদানকারীদের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন করা অতীব জরুরি, বিশেষত ছায়াছবিটির সারবস্তু বিবেচনা করলে। কৌতুকাভিনেতাদের যে চাকরিবিধি বাংলাদেশের ছায়াছবিতে আগের বছরগুলো থেকে এসেছিল, তার বিচারে কোনোভাবেই মোশাররফ করিম কৌতুক চরিত্রে অভিনয় করেননি। তবে বাংলাদেশে যেসব প্রতিষ্ঠান সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিল্প নিয়ে পর্যালোচনা করেন, তাদের কাছে চিন্তাশীল লোকজন অনেক দিন ধরেই আর কাণ্ডজ্ঞান আশাও করেন না। মোশাররফ করিম পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করে খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বলে আমি মনে করি। তবে ‘সিরিয়াস’ বনাম ‘কৌতুক’ বা ‘নায়ক’ বনাম ‘নায়কের বিশ্বস্ত কমেডিয়ান অনুচর’ এই বিভাজনের গল্পরেখা নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ-আস্থা নেই। প্রসঙ্গটির গুরুত্ব বিবেচনা করে আমার ‘সাহিত্যবোধ’ আমি বলতে ছাড়লাম না আরকি!
মোশাররফ করিম একভাবে চিত্তাকর্ষক উদাহরণ। কারণ তার অভিনয় দক্ষতা অমিত হলেও, টেলিভিশনে তিনি বছরের পর বছর আসলে কোনো না কোনোভাবে ‘কৌতুকাভিনেতা’ হিসেবে পরিসীমিত হয়ে ছিলেন। বরং, চলচ্চিত্রেই তিনি তার অভিনয় দক্ষতার প্রমাণ রাখবার বিস্তর সুযোগ পেয়েছেন। বিষয়টা ভাববার মতো, আয়রনিক। লক্ষণীয় যে, আমাদের তালিকাতে যে নামগুলো এলো তার প্রায় সবগুলোই চলচ্চিত্রের নাম, কেবল আফজাল শরীফ এর ব্যতিক্রম। তিনি টিভিতে জনপ্রিয়তার সূত্র ধরে চলচ্চিত্রের কাজে গিয়েছিলেন। বাকিদের ক্ষেত্রে তা নয়। এই বাস্তবতাটা খোদ মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের বয়স আর টেলিভিশনের বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত। টেলিভিশন যেকালে একটা মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, ততদিনে বাকিরা চলচ্চিত্রের প্রতিষ্ঠিত তারকা। অধিকাংশই টেলিভিশনে কখনো কাজ করেননি। বা করলেও নগণ্য। এখানেও ব্যতিক্রম আছেন একজন এ টি এম শামসুজ্জামান। তিনি টেলিভিশনে দোর্দণ্ড প্রতাপে কাজ করেছেন। এমনকি মধ্যবিত্তের যে প্রজন্ম তেমন একটা প্রেক্ষাগৃহে যাননি কখনো, তারা একে আনকোরা চেনার সুযোগ পেয়েছেন মুখ্যত টেলিভিশনে। টেলিভিশনে জনাব শামসুজ্জামানের কৌতুকাভিনয় দক্ষতারই বহুবিধ প্রয়োগ করার সুযোগ নিয়েছেন নির্মাতারা। চাইলে কেউ আশীষ কুমারের নামও সংযোজন করতে পারবেন; তবে তিনিও চলচ্চিত্র কাঁপানোর পরের ধাপে টেলিভিশনে আসেননি।
দারুণ প্রতিভাবান এই অভিনেতা (এ টি এম) অবশ্য কেবল চলচ্চিত্রের মধ্যেও স্বতন্ত্র কারণে উল্লেখের দাবিদার থাকেন। কৌতুকাভিনেতা এবং খল অভিনেতা হিসেবে যুগল-মুকুট ধারণের কৃতিত্ব খুব কম অভিনেতার রয়েছে। তিনি সেখানে প্রায় অনন্য। এটা বলবার সময়ে দুজন অভিনেতাকে স্মরণে আনছি। একজন অবশ্যই মুম্বাই কারখানার উৎপল দত্ত। তবে উৎপল দত্তের বেলায় বিষয়টা ঠিক শামসুজ্জামানের মতো নয়। শামসুজ্জামানের প্রধানত খল হিসেবে আবির্ভাব আর প্রধান কৌতুকাভিনেতা হিসেবে আবির্ভাব প্রায়শই ভিন্ন প্রকল্পের বা ছায়াছবির ছিল। আরও গবেষণা করলে সম্ভবত এই প্রস্তাবটা দেওয়া যেত যে, এ টি এম খল হিসেবে দুর্দান্ত সফল হওয়ার পর কৌতুকের কাজগুলো কম পেতেন বা নিতেন। পক্ষান্তরে, উৎপলের অনেকগুলো খল চরিত্রই মৃদুখলত্বের ওপর দাঁড়ানো এবং সেখানে কৌতুকগিরি তার খলত্বের সঙ্গে মেশানোই থাকত; প্রায়শই পারিবারিক পরিমণ্ডলের গল্পে। তবে ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে তার কৌতুকদক্ষতাকে নির্মাতা তীব্রভাবে খলগিরিতে প্রয়োগ করিয়েছিলেন। অন্য উদাহরণ হচ্ছেন ডিপজল। তার অভিনয় বা চলচ্চিত্রীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণ জনজবানে আছে। আমি আজ উল্লেখ করব প্রথমত এটা যে, নৃশংস খল হিসেবে ডিপজল অভিনয়-যাত্রার/অ্যাক্টিং-লাইনের গুরুতর রদবদল করেছেন। উপরন্তু, তিনি খুবই অসচরাচর কিছু সংলাপ ও ভঙ্গি/এট্যিটুড খল চরিত্রে সংযোগ ঘটিয়েছিলেন। সেই হিসেবে তার দ্বারা রূপায়িত খল চরিত্রগুলোর একটা কমিক্যাল বৈশিষ্ট্য বেশ সহজেই পাঠ করা যায়। যেহেতু তার অভিনীত ছবিগুলোর বেশ বড় একটা অংশের তিনি নিজেই প্রযোজক, কখনো কখনো প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে স্ক্রিপ্টকার/সংলাপ-রচয়িতা, তাই নির্মাণীয় কৃতিত্ব/ অকৃতিত্বের সিংহভাগও তারই পাওনা।
খুব কম আলাপের মধ্যেও চলচ্চিত্রের কৌতুকাভিনেতাদের নিয়ে যে আলাপটা কখনো চোখে বা কানে পড়েনি আমার, তা হচ্ছে যৌন পরিসরের দেনদরবারে এদের ভূমিকা। বাস্তবে কৌতুকাভিনেতা প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে পুরুষ, আর যৌন-উদ্ভাসক চরিত্রগুলো ব্যতিক্রমহীনভাবেই নারী (ছিলেন); সেখানে পুরুষ-কৌতুকাভিনেতাদের যৌন-পরিসরীয় ভূমিকা নিয়ে আলাপ তোলা বেশ খাপছাড়া লাগতে পারে। কিন্তু, একটু শান্তভাবে মনোযোগ দিলে সেই প্রবণতাটা ছায়াছবির ইতিহাসে দেখা সম্ভব। ‘ভালমানুষ’ নায়ক, যার কি না একটা হেটারোসেক্সুয়াল চুমু দিতে গেলেও নির্মাতাদের বাগানের দুইটা বাতাসে-চঞ্চল ফুল দেখাতে হয়, কিছুতেই যৌনতার দায়/ভার যখন গ্রহণ করবেন না, তখন পুরুষজাতির বেজায় চেপে-রাখা-যৌনেচ্ছার একটা পর্দারূপী অবতার হিসেবে এসব কৌতুকাভিনেতার জব ডেস্ক্রিপশন নির্ধারিত হয়েছিল। দিলদারের জীবনে এটা হয়তো দৃষ্টান্তমূলকভাবে বেশি ছিল, তবে অন্য অনেকেরই কাছাকাছি কর্মকাণ্ড করতে হয়েছে। যে নায়িকার উরুপানে ‘চরিত্রবান’ নায়ক কিছুতেই ‘ভালোমতো’ তাকাবেন না, সেই নায়িকারই সখীর উরু বা কোমরপানে নায়কের ‘সখা’ কৌতুকাভিনেতা এমনভাবে তাকাবেন যে দর্শকও (অন্তত পুরুষ দর্শক) না বুঝে থাকতে পারবেন না যে ‘কী দেখা হচ্ছে’ ও ‘কীভাবে’। এরকম কাজ আশীষ কুমারকেও করতে হয়েছে (ছবির নাম এখন পুনরাবিষ্কার করা কঠিন)। আবার রবিউল তার সহশিল্পী নারীর সঙ্গে ঠোঁট দিচ্ছেন ‘ও ছুঁড়ি তোর গাছের পাকা জাম্বুরা ফল কে খাবে’ (সহশিল্পী বা ছায়াছবি এখন পুনরাবিষ্কার অসম্ভব)। বাস্তবে এখানে ‘জাম্বুরা’র উপমার গুণ ও রুচি নিয়ে সারা দিন আপনারা তর্ক করতে পারেন; কিন্তু এটা ছায়াছবির জন্য তখন অবধারিত ছিল, এবং সেটা কিছুতেই ‘চরিত্রবান’ নায়ক ‘সুশীলা’ নায়িকার সঙ্গে (তখন) করতেন না। এই কাজগুলো তখন রবিউল সাহেবদের জন্যই নির্ধারিত ছিল। ফলত, প্রায় অযৌন নায়কের সঙ্গে এই চরিত্রগুলোর সম্পর্ক অত্যাবশ্যক সহগের।
ইরটিক ইঙ্গিতবাহী কাজকর্মে এরা না থাকলে নায়করা আলু বা মুলার মতো ভেজিটেবল থাকেন বা থাকতেন এই অনুভূতি-রাজ্যে। যেমনটা আগেই বলেছি, দিলদার এই বিশেষ ভূমিকায় সম্ভবত সবচেয়ে দায়িত্বশীল হিসেবে ছিলেন। উত্তরকালে নায়করা খোদ এসব কাজের জন্য মনোনীত হলেন, তাই নায়িকারাও। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ইরটিসিজমের রাজদণ্ড, বলা চলে, কৌতুকাভিনেতারা ঐতিহাসিকভাবেই হারালেন। ঠিক এই কারণেই উত্তরকালে কৌতুকময় চরিত্রের অবলোপ বা গুরুত্বহানি হতে শুরু করেছে সেটা আমার বক্তব্য বা থিসিস নয়। কিন্তু রূপান্তরটাকে আঙুল তুলে দেখানোতে বাধা পাই না কোনো।
আজীবন কৌতুকাভিনেতা হিসেবে বিরাজমান অভিনেতাদের কেন্দ্রীয় চরিত্র বানিয়ে ছায়াছবি হয়েছে। কলকাতায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে, কিংবা মুম্বাইতে মেহমুদকে নিয়ে। সেসব ছবির কিছু ব্যবসাসফল, কিছু মর্মান্তিক লোকসান করেছে। বাংলাদেশেই তুলনামূলকভাবে উদাহরণ কম পাওয়ার কথা। এমনকি সাবেক কালের কথাই হচ্ছে। তবে একটা বা দুটো ব্যবসাসফল ছবি থাকলেই সাংস্কৃতিক মর্যাদার প্রশ্নে এই অভিনেতাদের উল্লম্ফন ঘটে যায় না। এই কাজগুলো পর্দায় যতটা চঞ্চল যতটা কৌতুকাশ্রয়ী (বা অন্তত তৎপর), পর্দার বাইরে চলচ্চিত্র বা শিল্পচর্চার ইতিহাসে ততটাই মর্মস্পর্শী। এই মুহূর্তে গোটা আলাপটাই আরও নিরর্থক যখন বড় পর্দার অস্তিত্বই আসলে আর নেই। নেই সেসব মিলনায়তন যেখানে নানান রুচির সংঘর্ষের মধ্যেও, নানান শ্রেণির মানুষের অভ্যন্তরীণ লড়াই সত্ত্বেও, প্রেক্ষাগৃহের পর্দা ছিল তুলনামূলকভাবে সর্বজনীন। সর্বজনীন পর্দার বিলুপ্তি একটা গভীর রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, বিষাদেরও; আর কদিন পরেই বিস্মৃতিরও প্রসঙ্গ হবে তা। ঠিক যেমন এই হাসিমুখ অভিনেতারা!
একটি সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সূচনা। ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে যখন পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা জেগে ওঠে, তখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন রাষ্ট্রের রয়েছে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পার করে আমাদের সাংস্কৃতিক রূপরেখাটিও সময়ের সাথে সাথে নানা রূপ পরিগ্রহ করেছে। দেশ রূপান্তরের চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির এই পরিক্রমাটিকে আমরা ধরতে চেয়েছি। চার পর্বের এই বিশেষ আয়োজনটি সাজানো হয়েছে– ‘পর্দান্তর’, ‘সুরান্তর’, ‘চিত্রান্তর’ ও ‘প্রান্তর’ শিরোনামে।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অর্জন ও রূপান্তর নিয়ে আলোচনা শুরুর একটি সূত্র হতে পারে এই আয়োজনটি।
পর্দান্তর শিরোনামে প্রথম পর্বের আয়োজনে খোঁজ করেছি মঞ্চ, টেলিভিশন, সিনেমা, ওটিটি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত ৫২ বছরের বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অর্জন ও হালহকিকত।
আমাদের আন্দোলনকাল, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়টা স্মরণ করি। সে সময় রাজনীতি করা মানুষ ছাড়াও সাধারণের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ, সমীহ ছিল। এটাকে মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা ধরে নেওয়া যায়। সচেতনতা ছিল বলেই নেতা প্রবল আত্মবিশ্বাসে উন্মুখ জনসমুদ্রের সামনে করেছিলেন সেই প্রাণপণ উচ্চারণএবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। আমরা দেখি, গর্জে ওঠে বাংলাদেশ। দেখতে পাই, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল জাতি। আমরা অর্জন করলাম স্বাধীনতা।
মানুষের স্বপ্ন, সাধের মধ্যে কোনো বীজ রোপিত হলে ফলবান বৃক্ষের আশা অপূর্ণ থাকে না। আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমাদের এটাও জানিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, বিশ্বাসী হওয়া, নিবেদিত নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপালনে দৃঢ়চিত্ত হওয়া মানুষের জন্য খুবই জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মানুষ একসময় নিজেকে ছাপিয়ে নিজ নিজ আশা, স্বপ্নকে বড় ভেবেছে। সে সামর্থ্য ছিল, তার প্রচুর উদাহরণ হাজির করা যায়। স্বপ্ন সাধ পূরণের জন্য তখন অঙ্ক কষাকষি হয়নিস্রেফ ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই যে সাত পাঁচ না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঝোঁক, তা আমাদের গৌরব করার মতো বহু কিছু দিয়েছে।
আমরা যদি পেছন ফিরে তাকাই, দেখতে পাব অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে মানুষ পাশাপাশি ছবি এঁকে, গান লিখে সুর করে গেয়ে, খেলে যুদ্ধ চালিয়েছে সগৌরবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নানা প্রত্যয় জাগানিয়া অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো, তার মধ্যে চরমপত্র ছিল কথা বলার অনুষ্ঠান। কথাও আগ্রহ নিয়ে শোনার বিষয় ছিল। কথাও ছিল যুদ্ধাস্ত্র।
সময় মানুষকে শেখায়, নির্মাণ করে। কোনো কোনো মানুষের কাছে উপযুক্ত হওয়া বড় কথা আবার বহু মানুষ সময়ের উপযুক্ত হয়ে ওঠাকেই জরুরি বলে বিবেচনা করে। একটা সময় মানুষের মধ্যে এই ভেদ থাকলেও তেমন দৃশ্যমান হতো না। দৃশ্যমান ছিল, নানা ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রমাণের তুমুল চেষ্টা, তাগিদ।
স্বাধীনতার পরের বাংলাদেশে বিবিধ ক্ষেত্রে যা যা ঘটেছে সবই বিস্ময় জাগানোর মতোএমনটা বলাবলি হয়। সাহিত্য, সিনেমা, সংগীত, ক্রীড়া, টেলিভিশন বা মঞ্চনাটকসবকিছু মাতামাতি করার বিষয় হয়ে ওঠে।
যখন মানুষ দলে-বলে স্বপ্নের হাত ধরে এগিয়ে যেতে চাইবেযেমনটা হওয়ার কথা, তেমনই প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। সিনেমা ঘর, থিয়েটারের মিলনায়তন, খেলার মাঠ, সাহিত্য সভা, সংগীত নৃত্যকলার উৎসব, সার্কাস যাত্রার প্যান্ডেলসর্বত্রই ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়। এই ভিড় প্রেমের কারণে, আগ্রহ কৌতূহল ও আনন্দসন্ধানের অশেষ উৎসাহে।
চিত্র বদলে গেছে, অস্বীকার করা যাবে না। নানা কারণের কথা হয়তো বলা যাবে কিন্তু সত্য এইযা যা কিছু মানুষের ভেতর বদলে দিতে পারত, সবকিছুতেই এসেছে বদল। প্রায়ই শুনতে হয়, সিনেমা আগের মতো নেই। টেলিভিশন বা মঞ্চনাটকও আগের মতো নেই। এমন অভিযোগের তীর লক্ষ্য বেছে বেছে ছুড়ে কী লাভ! আমরা তো সবাই জানি, নিজেসহ কেউ, কোনো কিছুই আগের মতো নেই। থাকবার কথাও নয়। বরং ভেবে সন্তুষ্ট হওয়া যাক, নানা প্রতিকূলতা, অস্বস্তির মধ্যেও সুন্দরের জন্য, ভালোর জন্য চেষ্টা করে চলেছেন মানুষ।
মানুষের এখন সবচেয়ে বড় সংকট, কীভাবে ভালো ও মন্দ বুঝবে! একসময়ে যোগাযোগ মাধ্যমের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও জানা-বোঝা দুষ্কর ছিল না। সব ক্ষেত্রে আলাদা, নতুন কিছু ঘটা মাত্র বিশেষ হয়ে উঠতে পেরেছে, পারত। প্রশংসা পাওয়ার বিষয় দ্বিধাহীন প্রশংসিত হয়েছে, হওয়ার নিয়ম ছিল। বদল এসেছে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে। কর্মের আগে হিসাব-নিকাশ, স্বার্থপরতা গোটা মানুষের নিত্যদিনের জীবন কীভাবে পর্যুদস্ত করে চলেছেভেবে দেখার সময় হাতে নেই।
সময় এখন স্বার্থরক্ষার। কোন স্বার্থ কীভাবে রক্ষিত হচ্ছে তার বিচার-বিশ্লেষণেও হওয়া জরুরি। একটু গভীরে নেমে তলিয়ে দেখলে মনে খানিকটা সংকোচ জন্মাততাতে ক্ষতির গতি সামান্য হলেও হয়তো কমতে পারত।
ধদিকহারা হলে যে অবস্থা হওয়ার কথা তেমনই দশাচারদিকে দৃশ্যমান অস্থিরতা। দেখতে বসে দেখছি না, শুনতে বসে শোনা হচ্ছে কি খেয়াল করছি না কেউই। আমাদের মন আছে, সে মনের কথা শোনা বাদ দিয়ে অন্যের বলা কথায় কান পাতছি। হুজুগে বললে মানতে নারাজ আমরা কিন্তু অজান্তে সে ফাঁদেই পা দিয়ে ফেলছি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একালের অসাধারণ একটা প্রাপ্তি। পারস্পরিক যোগাযোগ মানুষের সমৃদ্ধি ঘটায়, মানুষকে সম্পন্ন করে। এর অন্যদিকও রয়েছে। পৃথিবীর নিয়ম যেমনআলোর অপর পিঠেই থাকে অন্ধকার। সবার জন্য যখন একটা মাঠ উন্মুক্তসেখানে নিয়মশৃঙ্খলা কিছুই টিকে থাকার কথা নয়। রাজা আর রাজত্বের মানে না বুঝে, সুরের ধারণা থাকা ও না থাকা মানুষরা একত্রে আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে গাইলে যেমনটা হওয়ার, তেমনই প্রত্যক্ষ করা হচ্ছে। তবুও হাল ছাড়েননি সব ক্ষেত্রের সৃজনশীল মানুষ। বিপন্নবোধ করার মতো বহু কিছু ঘটলেও অটুট রেখেছে মনোবল। একটা কথা জরুরি মনে করে বলা দরকার, সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে মেতে থাকা মানুষরা অন্য সবার মতো নয়হয় একটু ভিন্ন রকমের। কর্মের চেয়ে আর কোনো কিছুই এসব মানুষের কাছে বড়, বিশেষ হয়ে ওঠে না। প্রতিকূলতা এসব মানুষকে তেমন বিপর্যস্ত করতে পারে না কিন্তু উপেক্ষা, মানুষের হীনমন্যতা ও স্বার্থপর কাণ্ডকীর্তি পীড়িত করে।
যা ভালো তা প্রেরণা জোগায়। চিত্রকলা সম্পর্কে বিশেষ ধারণা না থাকা সত্ত্বেও চিত্র প্রদর্শনীতে গেলে ভালো ছবির সামনেই সাধারণ দর্শককে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। সংগীত বিষয়ে খুব জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও যেসব গান, শিল্পী আমাদের মুগ্ধ করেছে, যুগের পর যুগ ভালো লাগার তালিকায় স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেকী তার পেছনের কারণ, কারও অজানা নয়। সিনেমা ঘর উঠে যাচ্ছে, গড়ে উঠছে শপিং মলএটা বিনিয়োগকারীর ভালো থাকা, টিকে থাকার কৌশল। সাধারণ মানুষের মধ্যে ভালো টিকিয়ে রাখা কৌশল কী?
ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ উদ্যম প্রচেষ্টা থেমে নেই। নতুন মাধ্যমের আগমন ঘটেছে। দায়িত্বশীলতা নিয়ে নতুন মাধ্যমের দর্শকের চমকে দেওয়ার মতো প্রযোজনা ছোটপর্দায় বড় আশা জাগিয়ে হাজির হয়ে চলেছে একের পর এক। এই ভালো, এই আলো ও আশা টিকিয়ে রাখা সমষ্টির জন্য খুবই জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি বলি, এটা অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না।
আমাদের দেশকে আমরা চিনি। পৃথিবীকে যদি চিনিয়ে দেওয়ার আকাক্সক্ষা থাকেযেসব মাধ্যম, মানুষ ও কর্মের সাধ্য রয়েছে বিশেষ করে চিনিয়ে দেওয়ার সবার পাশে আপন হয়ে দাঁড়াতে হবে। আমরা দাঁড়াইও, দাঁড়াতে হবে সব আন্তরিক চেষ্টার পেছনে, পাশেশুধু সাফল্য পাওয়া মানুষ ও কর্মের সঙ্গে নিজেকে জুড়ে দিয়ে যে আনন্দলাভতা সংগ্রামের অংশ হওয়া নয়, উপভোগের জোয়ারের অংশ হওয়া।
আলমগীর কবির (১৯৩৮-৮৯) এই এক নামে তিনি পরিচিত হলেও প্রতিভার বিচ্ছুরণে তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক। তিনি ছিলেন সাংবাদিক, সমালোচক, রাজনৈতিক কর্মী, চিত্রপরিচালক, প্রযোজক, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার, সংগীতকার, পরিবেশক, চলচ্চিত্র প্রশিক্ষক, চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, সংগঠক, বিশ্লেষক, প্রকাশক, সম্পাদক, গ্রন্থকার, টিভি ও বেতার সমালোচক, মুক্তিযোদ্ধা। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে তিনি ‘চলচ্চিত্রচার্য’।
আলমগীরের প্রতিভা ও কর্মের সৌরভে প্রাণায়িত হয়েছে আমাদের দেশ-সমাজ ও সংস্কৃতি। ১৯৫৮ সালে তিনি লন্ডন গিয়েছিলেন অঙ্ক ও পদার্থবিজ্ঞানে পড়তে। কিন্তু ওখানে জড়িয়ে পড়েন বিশ্বরাজনীতি ও হতাশাবাদের সঙ্গে। বার্গম্যানের ‘সেভেনথ সিল’ চলচ্চিত্র দেখে তিনি চরম অস্থিরতায় ভোগেন। তিনি অতীত জীবনের সব শিক্ষাগত সার্টিফিকেট লন্ডনের টেমস নদীতে ছিঁড়ে ফেলে দেন। তিনি আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতে জড়িত হন। ভর্তি হন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউটে। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ফ্রন্টে যোগ দেন। ফিলিস্তিন ও আলজেরীয় আন্দোলনেও জড়িত হন। নির্মাণ করেন চলচ্চিত্রও। ব্রিটেনের ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার সমালোচনা।
এদিকে দেশে তিনি সামরিক সরকারের চোখে তখন অবাঞ্ছিত ঘোষিত। ১৯৬৬ সালে দেশে ফিরে ‘চিত্রালী’, ‘পাকিস্তান অবজারভার’ ও সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে তুমুল বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকেন শব্দে, বাক্যে, চিন্তায়, মননে, উপস্থাপনায়। সরকারের নিষেধাজ্ঞায় তার গতিবিধি হয় নিয়ন্ত্রিত। তবে বেনামে গোপনে চলতে থাকে তার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সাংবাদিক কর্ম। তিনি জড়িত হন পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদে। ১৯৬৯ সালে তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কাজ করেন। তিনি রচনা করেন পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্রের ইতিহাস ‘সিনেমা ইন পাকিস্তান’, গঠন করেন ‘ঢাকা সিনে ক্লাব’ এবং প্রতিষ্ঠা করেন ‘ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট’।
১৯৭০ সালে আলমগীর কবির, জহির রায়হান ও অন্যান্য মিলে বের করেন ‘এক্সপ্রেস’ নামে ইংরেজি সাপ্তাহিক এবং নিজে প্রকাশ করেন সিনে ম্যাগাজিন ‘সিকোয়েন্স’। আর ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি গেরিলা হয়ে কাজ করেন সরকারের প্রধান প্রতিবেদক, স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান প্রযোজক-পাঠক হিসেবে এবং জহির রায়হানের সঙ্গে মিলে তৈরি করেন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র : ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’, ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নর্স’-এর ধারাভাষ্যকার এবং ‘লিবারেশন ফাইটার্স’-এর পরিচালক হিসেবে। এসবই ছিল আজীবন মুক্তিযোদ্ধা আলমগীর কবিরের আত্মিক ও সাত্মিক আদর্শের নান্দনিক বিচ্ছুরণ।
১৯৭২ সালের পর মুক্ত স্বাধীন দেশে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির নব উদ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন নতুন কলম্বাস। চলচ্চিত্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু, নতুন নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণ (ধীরে বহে মেঘনা, রুপালি সৈকতে, পরিণীতা) এবং গ্রন্থ রচনা, ফিল্ম আর্কাইভ ও ইনস্টিটিউট গঠনে সহায়তা এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে তার বহুমাত্রিক কর্মের বিচ্ছুরণ ঘটতেই থাকে।
অতঃপর মহাশোকের বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি। লন্ডনের টেমস নদীতে যে প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল বাংলাদেশের যমুনা নদীর গর্ভে সেই প্রতিভা তলিয়ে গেল চিরতরে। আলমগীর কবির এক অম্লান নক্ষত্র। বিচ্ছুরণের নান্দনিকতায় আছেন তিনি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অনুভবে।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে নাট্যসাহিত্য ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানামুখী নিরীক্ষা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালে যারা নাট্যসাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মমতাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিম আল দীন, মান্নান হীরা, আবদুল্লাহ হেল মাহমুদ, মাসুম রেজা প্রমুখ। একই সঙ্গে নির্দেশনার ক্ষেত্রে আমাদের আলোচনায় থাকেন আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, সৈয়দ জামিল আহমেদ, তারিক আনাম খান প্রমুখ। তারা আমাদের পথপ্রদর্শক, সেই পথ অনুসন্ধানের নিমিত্ত লেখা।
রাজনীতির ভাষ্য : সৈয়দ শামসুল হকের নাটক
সৈয়দ শামসুল হক একাধারে কাব্যের জমিন, উপন্যাসের আকাশ, গল্পের নদী আর নাটকের ভূমিতে কর্ষণ করেছেন। সমকালীন রাজনীতি ও গণসংগ্রামকে কেন্দ্র করে রচিত তার কাব্যনাটক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের শিল্পভাষ্য। তার রচিত প্রথম নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৫)। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে রচিত এ নাটকে তিনি একটি গ্রামের মানুষের যুদ্ধকালীন ভূমিকাকে উপস্থাপন করেছেন।
সৈয়দ শামসুল হক রচিত গণনায়ক যেন তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের ক্ষমতার লড়াইয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর অংশগ্রহণকে চিত্রিত করে। ইতিহাসের চরিত্রকে শিল্পের ঘরে স্থাপন করে রচিত হয়েছে কাব্যনাটক নূরলদীনের সারাজীবন। ইংরেজ শাসনামলে কৃষক বিদ্রোহকে অবলম্বন করে রচিত হয় এ নাটক।
ঈর্ষা (১৯৯০) নাটকেও ব্যক্তির মানসজগৎ ও রাজনীতিকে একীভূত করে উপস্থাপন করেছেন। নাটকটিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে স্বাধীনতা-উত্তর দেশের সামাজিক ও নৈতিক পতনের চিত্র পাওয়া যায়।
পলাশী যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে রচিত হয় নারীগণ (২০০৭)। সিরাজের মর্মান্তিক পরাজয়ের পর তার প্রাসাদের নারীদের জীবন ও ভাবনার রূপায়ণ এই নাটকে লভ্য। তার রাজনৈতিক ধারার আরেকটি নাটক উত্তরবংশ। দেশ স্বাধীনের পর পরাজিত শক্তির পক্ষাবলম্বনকারীর উত্থানকে তিনি নাটকের বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
তার নাটকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতি একীভূত হয়। তার নাটক রচনার প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক রচনা করেন নাটক লেখা হয় সত্যের শুদ্ধতম তাগিদে।
নাটকে জীবন্ত মানুষের সঙ্গে জীবন্ত মানুষের সংযোগ।
সেলিম আল দীন বহমান বাংলায়
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাঙালির নাট্যভাবনায় সেলিম আল দীন প্রবল শক্তিতে প্রবহমান। তার নাট্যচর্চায় অনেকগুলো পর্ব চিহ্নায়ন করা যায়। প্রাথমিকপর্বে সদ্যস্বাধীন দেশের মানুষের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, রাজনীতির ক্ষয় ইত্যাকার বিক্রিয়া তার নাট্যসাহিত্যে দৃষ্ট। পাশ্চাত্য বাস্তববাদ, প্রকৃতিবাদ, অভিব্যক্তিবাদ, কিমিতিবাদ ভাবনায় জারিত হয়ে রচনা করেছেন সর্প বিষয়ক গল্প, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, সংবাদ কার্টুন, মুনতাসির প্রভৃতি নাটক। একজন অনুসন্ধানী নাট্যকার হিসেবে পথ সন্ধানের ফলস্বরূপ রচিত হয়েছে আতর আলীদের নীলাভ পাট, চর কাঁকড়ার ডকুমেন্টারি ইত্যাদি। তারপরশকুন্তলা নাটকে পুরাণের বিষয় ভেঙে তাকে প্রতিস্থাপিত করেন পাশ্চাত্য আঙ্গিকে। শকুন্তলার পথ বেয়ে কেরামতমঙ্গল ও কিত্তনখোলায় আসেন। শুরু হয় আঙ্গিকের নিরীক্ষা। হাত হদাই নাটকে সমুদ্রভ্রমণের পুরাণ তৈরি করে পাঠক-দর্শকসহ সেই পুরাণে ডুব দেন। চাকা নাটকে বিষয় ও আঙ্গিক সব ক্ষেত্রেই দেশজ ধারার দিকেই পক্ষপাত। চাকা রচনাকালীন বাংলাদেশে সামরিক বুটের দাপট। নাট্যকার পাঠক-দর্শককে স্মরণ করিয়ে দেন, রাষ্ট্র যখন বিশেষ বাহিনীর হাতে পরিচালিত সেই সময়ে সাধারণ মৃত্যুর উৎসবেই জীবনের মানে খোঁজে।
আঙ্গিক নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করেছেন সেলিম আল দীন। একই সঙ্গে আঙ্গিক বিলোপের মধ্য দিয়ে বাঙালির শিল্পরীতি নির্মাণের পথে অবিরত চলেছেন। এমনি করেই রচিত হয়েছে হরগজ, প্রাচ্য, বনপাংশুল, ধাবমান হয়ে নিমজ্জন। হাজার বছরের বাংলা নাট্যরীতি সন্ধানে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন সমকালীন শিল্পরীতি, ইতিহাস থেকে তুলে এনেছেন বাঙালির নাট্যরীতির নন্দনভাবনা। বাঙলা পরিবেশনা শিল্পকলার গবেষণা-অন্তে একটি নতুন বিশ্বাসে এই বলে উপনীত হয়েছেন যে বাঙালির নাট্যরীতি নৃত্য-গীত-সংলাপের আশ্রয়ে নির্মিত।
একটা ছোট গল্প বলি, বাস্তব অভিজ্ঞতা। ঘটনাটা এ রকমকয়েক মাস আগে শ্যুটিং করতে গিয়েছিলাম গোয়ালন্দ, রাজবাড়ীতে। রাতে শ্যুটিং চলাকালীন একটা দৃশ্য শেষ করে পরবর্তী দৃশ্যের সেট এবং লাইটিংয়ের কাজ চলছিল। আমি এই বিরতিতে সাধারণত একটু নির্জন জায়গায় একাকী গিয়ে পরবর্তী দৃশ্যের শট, ব্লকিং, অভিনয়-কৌশল নিয়ে চিন্তা করতে থাকি। তা-ই করছিলাম, অন্ধকার রাতে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই পাশের একটা রেললাইনে। হাঁটছি আর চিন্তা করছি, এমন সময় পাশের টিনের ঘর থেকে ভেসে আসা টেলিভিশনের শব্দ আমার মনঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন করল। একটু এগিয়ে ঘরের ভেতরের পরিবেশটা দেখতে থাকি। একটা কমদামি কালার টেলিভিশনে কোনো চ্যানেলের নাটক চলছে। দর্শক দুজন বুড়ো-বুড়ি। তাদের মুখের এক্সপ্রেশন দেখার জন্য আরও কাছে গেলাম। দেখলাম আনন্দিত মুখ। ভালো লাগল দেখে। নাটকের মাঝখানে বিজ্ঞাপন বিরতি এলো, তবুও তারা চ্যানেল পরিবর্তন করলেন না। অনেকটা সময় ধরে আমি বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুজন প্রতিনিধিকে দেখলাম। তারা আনন্দ নিয়ে টেলিভিশন দেখছেন। টেলিভিশনে কাজ করা একজন মানুষ হিসেবে এই দৃশ্য আমাকে নিঃসন্দেহে ভীষণ আনন্দিত করবেএটাই স্বাভাবিক। মাঝেমধ্যেই আমরা আমাদের কলিগ এবং শহুরে মানুষের মুখে শুনি‘এখন আর কেউ টেলিভিশনে নাটক দেখে না।’ কথাটার সবটুকু সত্যি না। অনেকেই দেখে অথবা অনেকের না দেখে কোনো উপায় থাকে না। কারণ দরিদ্র মানুষজন একশ-দেড়শ টাকা দিয়ে মাসব্যাপী ডিশের কানেকশন পায়, সুতরাং সেই কানেকশনের বদৌলতে যা দেখা যায় তাই দেখে। এখন কথা আসে, তারা ভোক্তা হিসেবে দেখে, কিন্তু আমরা তাদের কাছে কী সার্ভ করছি?
আমার মনে হয় না আমরা খুব গবেষণা করে দেশের সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছি। আমাদের বর্তমান টিভি নাটকের ধরন-ধারণ দেখে মনে হয় যেন আমরা ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার লঞ্চযাত্রী। কোনো মতে রাতটা পার করে দিতে পারলেই হয়। কোনো মতে সময়টা পার করাই যেন বর্তমান টিভি নাটকের মূল উদ্দেশ্য। না আছে কোনো নতুনত্ব, না আছে কোনো উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া।
বিশ বছর আগের রঙের মানুষ আর হুমায়ূন আহমেদের কমেডি নাটকের ফর্মূলায় দুর্বল ভার্সন অথবা প্রেমের নামে আজগুবি প্রহসন। এই চক্র ভেদ করা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে আমাদের জন্য। কারণটা খুবই স্পষ্ট। এই সেক্টরে কাজ করা মেধাবী মানুষদের খুবই সুকৌশলে বের করে দেওয়া হয়েছে। সেই জায়গায় নেওয়া হয়েছে চাকর-শ্রেণির একদল নির্মাতা আর লেখকদের। যাদের না আছে কোনো মেধার জোর, না আছে শক্ত মেরুদন্ড।
ইয়েস স্যার, আই অ্যাম, অলওয়েজ অ্যাট ইউর সার্ভিসযাদের মূলমন্ত্র। হরে-দরে সবাই যে এমন তা অবশ্য আমি বলছি না, কেউ কেউ হয়তো নিভৃতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম।
একটু মেধাবীরা হয় ওটিটি মাধ্যমে কাজ করছেন, নয়তো টেলিভিশনের ভূত কাঁধ থেকে নামিয়ে অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। ওমুক স্টারের শ্যুটিং দেখতে এসে তমুকের মনে সাধ জাগে আমিও একজন লেখক অথবা পরিচালক হতে চাই। তখন সে অমুক স্টার ভাইকে হাতে-পায়ে ধরে যদি দুইটা দিন সময় বের করতে পারেন তাহলে কেল্লাফতে। বছর না ঘুরতেই তিনি হয়ে ওঠেন সময়ের সেরা হিট পরিচালক। মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ তাকে মানব থেকে দানব বানিয়ে তোলে। তখন তিনি ভুলে যান তার নিকট অতীত। হয়তো এক বছর আগে তিনি কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা ছিলেন, সময়ের হাওয়া বদলে এখন তিনি কারওয়ান বাজারে নাটক বিক্রি করেন। ব্যাপারটা হলো বিক্রি করা। মাছের তুলনায় নাটকে ভালোই লাভ হয়। লাভ-ক্ষতির চক্করে আমরা অনেক সম্ভাবনার অপমৃত্যু দেখতে পাই। কিন্তু ঘটনাটা আরও অন্য রকম হতে পারত।
একজন ডাক্তার হতে গেলে যেমন আপনাকে দীর্ঘ বছর ধরে একটা লেখাপড়া, বাস্তব অভিজ্ঞতা শেষ করে নিজের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হবে, ঠিক তেমনি অডিও ভিজ্যুয়াল সেক্টরে কাজ করতে গেলে আপনাকে নির্দিষ্ট বৈতরণি পাড়ি দিয়ে তবেই একজন চিত্রনাট্যকার কিংবা পরিচালক পদে আসীন হতে হবে। বিষয়টা আমরা যেমন বানিয়ে ফেলেছি, ততটা সহজ কিন্তু না এই পথচলা। ফলাফল হিসেবে আমরা শুধু ভয়াবহ ভবিষ্যৎকেই কল্পনা করতে পারি। অন্তত এই সেক্টরে কিন্তু সিনেমা এবং ওটিটি মাধ্যমে অসংখ্য নতুন চিন্তার প্রকাশ দেখতে পাই, যা আমাদের আশায় বুক বাঁধতে সাহায্য করে। টেলিভিশন নাটকের শেষ পরিণতি কী? আমি নাদান তা বলতে অপারগ। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট যে, এত বিশাল একটা গণমাধ্যম। সেটা নিয়ে সরকার এবং নীতিনির্ধারকদের যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। কী হবে টেলিভিশনের চেহারা, কেন হবে, এর পরিণতি কীএসব বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এবং গাইডলাইন ঠিক করে না দিলে যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতা চলতেই থাকবে। যত দিন পর্যন্ত আমরা নাটক-ফাটক প্রবণতা ত্যাগ করতে না পারব, তত দিন বারো ভূতে লুটেপুটে খাবে আমার সাধের টেলিভিশনকে। অতি অনিচ্ছায় লেখাটা লিখেছি। তার পরও জানি অনেকের মনে আঘাত লাগবে। আঘাত লেগে ধ্বংসের পরও যদি নতুন কিছু ঘটে সেটাই হবে আনন্দের প্রহর।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতি জোর করে হারানো হয়েছে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন তেমনি যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।