
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যবিদ্যা বিষয়ক পাঠ্যক্রমে ‘বাংলার গীতরঙ্গ’ অধ্যয়ন ও চর্চার প্রস্তাব করা হলে বেশ একটা লম্বা সময় ধরে তুমুল আলোচনায় মুখ্যত যে বিষয়গুলো উঠে আসে, তা হলো গ্রামের গায়েন-বয়াতি-পালাকার থেকে নগরের কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় ‘গীতরঙ্গ’ নাম-পরিচয়ের অস্তিত্ব থাকলেও আমাদের এখনকার শব্দ ও শব্দার্থবোধে তা এতটাই অচেনা বা দুর্বোধ্য মনে হয় যে তাকে বুঝতে হয় ইংরেজি ‘পারফরমিং আর্ট’ পরিভাষা দিয়ে। যেমন আমরা এখন ‘স্নাতক’ মানে ‘গ্র্যাজুয়েট’, ‘ধর্ম’ মানে ‘রিলিজিয়ন’, ‘আলো’ মানে ‘লাইট’ ... বুঝে থাকি।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নাট্যবিদ্যা বিষয়ে যে পাঠ্যক্রম চালু আছে, সেখানে এই গীতরঙ্গ কিংবা ‘পারফরমিং আর্টস’ অনুপস্থিত। সেখানে আছে, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ বর্ষে, ‘লোকনাট্য’ কোর্স ‘ফোকলোর’ তত্ত্ব-পদ্ধতি ও বর্গীকরণ ইত্যাদি। এই লোকনাট্য কোর্সের আওতায় ‘কিস্সাপালা’ ‘রামায়ণ গান’, ‘সঙযাত্রা’, ‘যাত্রা’ ‘গাজীর গান’ ‘জারি গান’ ইত্যাদি বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে এক এক সময়ে এক একটি মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করা হয় মাত্র। অথচ নাট্যকলা বিষয়ের শিক্ষার্থীদের নাট্যশিক্ষার আরম্ভেই যদি নিজস্ব বা দেশজ যাবতীয় গীত-বাদ্য-নৃত্য-নাট্যের বিষয় ও প্রয়োগশৈলীর প্রাথমিক পরিচয় ঘটে এবং এসবের নন্দন-দর্শন-জ্ঞানবিষয়ে যদি অনুধাবন করতে পারে তাহলে তার পক্ষে আধুনিক-উত্তরাধুনিক সব প্রসঙ্গ আয়ত্ত করা বেশ ফলপ্রসূ হতে পারে।
মহাবিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ বিভাগসমূহে দেশের প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যের পাঠদান করা হয়। যেমন ‘মনসামঙ্গল’বা ‘পদ্মাপুরাণ’ নিশ্চয়ই অনেক গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হয়। কিন্তু দেশের প্রায় সমগ্র জনপদে এখনো ঐ কাব্যকে কেন্দ্র করে ‘মনসার গান’, ‘কান্দনি বিষহরির গান’, ‘রয়ানি গান’, ‘পদ্মার নাচন’ ‘বেহুলা লখিন্দরের পালা’ সমূহের যে আসর অনুষ্ঠিত হয়, তার সঙ্গে স্নাতক সম্মান স্নাতকোত্তর পঠন-পাঠনে কোনো সংযোগ তাদের ঘটে না। যে আবেগ আকাক্সক্ষা ও আকুতি নিয়ে শ্রাবণভর গ্রামের পর গ্রাম ধরে বিশেষত নারীদের গায়নে বাদনে যে পদ্মাপুরাণ চর্চা হয়, তার সঙ্গে শ্রেণিকক্ষের পাঠ আলোচনা তথা পরীক্ষাদির সঙ্গে সামান্য যোগসূত্রও থাকে না।
দেশজ কিংবা ঐতিহ্যবাহী শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির বিষয়াদি কেবল যদি বিদেশাগত তত্ত্ব-পদ্ধতির নিরিখে দেখতে থাকি, বিচার করতে থাকি তাহলে ওসবের সারবস্তু বা মর্ম অনুধাবন তো হবেই না বরং নিজস্ব জ্ঞানবিহীন অর্থাৎ মূলহারা হয়েই আমাদের থাকতে হবে। সেই যে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় জার্মানির গ্রিম দুই ভাই (জ্যাকব গ্রিম ও উইলহেল্ম গ্রিম) তাদের দেশের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া গল্পগাথা রূপকথা সংগ্রহ করে (‘চিলড্রেন্স অ্যান্ড হাউসহোল্ড টেলস’ ১৮১২) প্রকাশ করলেন, এরপর এসবের ধারাক্রমে প্রায় একশো বছরের মধ্যে লন্ডন আমেরিকায় ‘ফোকলোর সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ঘটনায় বিশ্বব্যাপী ফোকলোর তৎপরতা শুরু হয়। এমনকি উনিশশো আশির দশকে মার্কিন ফোকলোরবিদ অ্যালান ডন্ডেস (১৯৩৪-২০০৫) আমাদের বাংলাদেশে এসে বাংলা একাডেমিতে ফোকলোর বিষয়ে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করেন। যার ফলে আমাদের শিক্ষা গবেষণা কার্যক্রমে জেঁকে বসে ফোকলোর তথা ‘লোকসংস্কৃতি’ চর্চা। আমাদের ঐতিহ্যবাহী গীতরঙ্গসমূহের নিজস্ব নাম-পরিভাষা ভুলে গিয়ে ‘ফোক সং’ ‘ফোক ড্রামা’ সূত্রে ‘লোক সংগীত’ ‘লোকনাট্য’ ইত্যাদি নাম-পরিভাষায় অভ্যস্ত হয়ে যাই। গ্রামের গায়েন বয়াতিরা নিজেদের পদবি-পরিচয় ছেঁটে ফেলে হয়ে যান কেবল ‘লোকশিল্পী’। অথচ আমরা লক্ষ্য করলাম না যে, পাশ্চাত্য দুনিয়ায় নগরায়ণের ফলে তাদের হারিয়ে যাওয়া গীতরঙ্গ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য ফোকলোর তত্ত্ব-পদ্ধতি যতটা সংগত, আমাদের এখানে তা সর্বতো প্রাসঙ্গিক নয়। কেননা আমাদের জনপরিসরে গ্রামীণ গীতরঙ্গ এখনো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। বরং এসবের প্রাণবন্ত চর্চা এখনো বহমান। তাই প্রশ্ন তুলতেই পারি, বিলুপ্ত বিষয়াদি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের তত্ত্ব-পদ্ধতি দিয়ে সজীব বিষয়-আঙ্গিকের সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কি সংগত?
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভের নাম দিয়ে ইন্টারনেটে তালাশ করলে একটা ছবি বেশ দেখা যায় যেখানে ক্লাইভকে নতজানু হয়ে কুর্নিশ জানায় সাঙ্গপাঙ্গসহ মীর জাফর। এ আমাদের এখনকার মন-মানসিকতারই প্রতিচ্ছবি যেন। পাশ্চাত্য উপনিবেশের আনুষ্ঠানিক বিদায় ঘটলেও সেই উপনিবেশ ও তার জ্ঞানকা-ের প্রতি আমাদের নতজানু মনমানসিকতা এখনো নানাভাবে বিরাজমান। স্বাধীনতার অর্ধশত বছরেও নিজস্ব জ্ঞানকা- বা তত্ত্ব-পদ্ধতি আমরা তৈরি করতে পারিনি। আমাদের নিজস্ব গীত-বাদ্য-নৃত্য-নাট্যের বিষয় আঙ্গিকের তথ্যপঞ্জি সংগ্রহ সংকলন অনেকটা সম্পন্ন করতে পারলেও এসবের আসর-তত্ত্ব এখনো প্রণীত হয়নি। এমনকি এসবের অভাবও অনুভব করছি না। বরং পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রণীত ‘পারফরমেন্স স্টাডিজ’ ‘পারফরমেন্স থিওরি’ দেদার মুখস্থ করাচ্ছি, পরীক্ষা নিচ্ছি, সনদপত্র দিচ্ছি! নাট্যকলা নামে প্রতিষ্ঠিত বিষয় বা বিভাগের নাম পাল্টে ফেলে নামকরণ হয়ে যায় ‘থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ’। কোথাও বা অনুবাদকৃত নাম ‘পরিবেশনা বিদ্যা বিভাগ’। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তর আসে জুুতসই বাংলা নাম নেই!
আসলে এ বিষয়ের সংকট অনেক গভীরে। এই পরিসরে তা আলোচনা সম্ভব নয়। পাশ্চাত্য জ্ঞানকা- দ্বারা আমরা এতটাই প্রভাবিত যে, আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলাকে তার নিজস্ব তাৎপর্যপূর্ণ অর্থের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ও সংকুচিত করে কেবল প্রতীকী শব্দ ও অর্থে ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছি। ‘গীত’ ‘গান’ শব্দ এখন শুধু ইংরেজি সং বা মিউজিক অর্থে বুঝে থাকি। অথচ আমাদের সাধক বাউলরা কত সহজেই গানকে বলেন জ্ঞান। ‘রঙ্গ’ শব্দটি শুধু তামাশা অর্থে জারি থাকা মানে বহু বিচিত্র ক্রিয়া ও অর্থ থেকে বঞ্চিত থাকা। ‘পালা’ শব্দের ভেতরে যে পালন ও লালন প্রসঙ্গ আছে তা বর্তমানের অর্থবোধ দ্বারা অনুভব করা যাবে না। ‘ট’ বর্ণে যে টঙ্কার ক্রিয়া আছে তা বুঝতে পারলেই আমরা পক্ষে নট-নাট্য-নাটক শব্দাবলির প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করা সম্ভব। এজন্য এখন বাংলা শব্দ ও ভাষার ক্রিয়াভিত্তিক বর্ণভিত্তিক অর্থের জগতে মনোনিবেশ করা খুব প্রয়োজন। তবেই আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির সর্বত্র ঔপনিবেশিক অসুখগুলো দূর করা সম্ভব।
এ শহরে প্রকাশ্যে গান গাওয়ার জায়গাগুলো যেন বেশ কমে গেছে। আকাশছোঁয়া দালানের প্রকোপে খেলার মাঠের মতোই গানের মঞ্চগুলো যেন উধাও হয়ে যাচ্ছে! ঢাকাতে গাড়ির তীব্র হর্নের মধ্যে গান শোনা তো আসলে অসম্ভবই বটে। শব্দদূষণ বাদেও ওপেন এয়ার কনসার্ট এখন খুব অপ্রতুল। নাগরিক শ্রোতা ও গায়কদের ভেতরে সুষম সংমিশ্রণের জায়গা খুবই অল্প। তবুও তরুণরা বসে নেই, নতুন অনেক গান তারা তৈরি করছে, প্রকাশ করছে এবং বিভিন্ন মঞ্চে পরিবেশনা করে চলেছে। আপনার কাছে বিকল্প সেইসব মঞ্চের খোঁজ আছে তো? সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইন প্লাটফর্মে গান প্রকাশ করার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার ফলে শ্রোতা এবং শিল্পীর সাধারণ মিলন খুব কম ঘটে। এই লেখাতে ঢাকার অন্যরকম কিছু মঞ্চ নিয়ে আমি কথা বলব যেখানে গায়ক এবং শ্রোতার বাস্তব ও ভার্চুয়াল এই উভয় যোগাযোগই হয়ে থাকে।
ঝিড়ঝিড় ক্যাম্পফায়ার সেশন
২০২২ সালের শেষে শীতকাতুরে সন্ধ্যায় যখন ধলেশ্বরী কায়াকিং রিসোর্টে ঢুকে ঝিড়ঝিড় ক্যাম্পফায়ার সেশনের সেটে যাই তখন বেশ নাটকীয় লাগে পরিবেশটা। দুটি তাঁবু টাঙানো এবং দুপাশে দুটি মশাল জ্বলছে! দুই তাঁবুর ঠিক মাঝ বরাবর ফাঁকা জায়গাটিতে একটি গাছের গুঁড়িতে বসে গায়ক গান গাইবে! পাশেই স্রোতস্বিনী ধলেশ্বরী নদী, আকাশ ভর্তি ঝিকিমিকি অজস্র তারা! নদীর ওপর পেতে রাখা মাচাতে অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে তারা দেখলাম। অনেকক্ষণ গুনগুন করে গান গাইলাম! দু-একটা জোনাক পোকা ঢুকে গেল যেন ঠিক আমার মাথার ভেতরে! মশালের দপদপে আগুনের পাশে নড়ছে আমার ছায়া! ঠিক সে সময়ে আমার ডাক এলো! কিবোর্ডে ছিল জাফরি, হারমোনিতে রুদ্র, আর ভারতীয় মুদ্রায় ঘাসের গালিচায় বসে ভায়োলিন বাজাল প্রাঞ্জল! অ্যাকশন শব্দ শুনে চোখ বন্ধ করে গেয়ে উঠলাম ‘চোখ মেলেছি যেই’! ঝিড়ঝিড় ক্যাম্প ফায়ার সেশনে ঠিক এমনটাই ছিল আমার গানের দৃশ্যপট!
প্রতি বছর শীতে ঝিড়ঝিড় আয়োজন করে ক্যাম্পফায়ার সেশন। ঝিড়ঝিড় একটি অডিও ভিজ্যুয়াল প্ল্যাটফর্ম। ঝিড়ঝিড়ের প্রোডিউসার জাফরি আবেদীন নিজেও একজন মিউজিশিয়ান। সহজিয়া ব্যান্ডের বেস গিটারিস্ট হিসেবে সে কাজ করছে অনেকদিন হলো। পাহাড়ি ম্রো শিশুদের শিক্ষার সহায়তায় পাওমুম থারক্লা স্কুলের তহবিল সংগ্রহের জন্য তারা আয়োজন করেছিল ‘পাওমুমের জন্য গান’। সেই কনসার্টেও আমি গান গেয়েছিলাম।
ঝিড়ঝিড়ের প্লাটফর্ম থেকে অচিরেই বের হচ্ছে আমার সালো অ্যালবাম ‘বাতিঘরে রাত জাগা প্যাঁচা’। এই অ্যালবামের প্রথম গান “প্লাস্টিকে ডুবে আছি”। ঝিড়ঝিড় ইউটিউব চ্যানেল : https://www.youtube.com/@ZhirZhir হাতিরপুল সেশনস
২০১৯ সালের একটি শীতের সকালে আমি তুহিন এবং নাঈম মাহমুদ দেখা করলাম হাতিরপুল কাঁচাবাজারের সামনে। তারপর ছয় তালা সিঁড়ি ঠেঙিয়ে উঠে পড়লাম হাতিরপুল সেশনসের আঁতুড় ঘরে। এর ঠিক তিন দিন আগে আমাকে কল দিয়েছিল হাতিরপুল সেশনস-এর কিউরেটর অনিরুদ্ধ অনু। সে জানাল তারা একটি এভি প্লাটফর্ম করেছে যারা মূলত নিজেদের গান নিয়ে কাজ করছে তাদের জন্য, এছাড়াও ভিন্নধর্মী কভারেও তারা আগ্রহী। সবিনয়ে জানতে চাইল আমি গান করব কি না। আমি সানন্দে জানালাম অবশ্যই করব। তখন হাতিরপুল সেশনস-এর প্রথম সিজনের শ্যুট চলছে, ছাদের উন্মুক্ত সেটে টাঙানো তারে ক্লিপ দিয়ে আটকানো, শার্ট, জামা-কাপড়, প্যান্ট, ওড়না, বাচ্চার ছোট ছোট পাজামা, মোজা ইত্যাদি শুকাচ্ছে। ঢাকার যেকোনো ছাদের রঙিন বাস্তবতার সাধারণ চিত্র এটি। পরিবেশন আর ঢংটি খুবই ভালো লেগে গেল, কেননা নাটক সিনেমা কিংবা হাল আমলের সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্টে যেরকম অতি নাটকীয় জিনিসপত্র দেখি সেরকম কোনো কিছুই এরা রাখেনি। বরং বাস্তবতাকে রঙিন করেছে হাতির পুলের সচেতন নির্দেশনা। একটি জুম রেকর্ডারের সামনে গেয়ে ফেললাম গান, পেছনে অনেক বিল্ডিং-এর ব্যাক ড্রপ নিয়ে এবং একটা বিশাল আকাশ মাথার ওপর রেখে হাতিরপুল সেশনসের প্রথম সিজনে গেয়েছিলাম চিত্রকর গানটি।
২০২২ এর দ্বিতীয় সিজনের পরিবেশনায় একটু ভিন্নতা এনেছে হাতিরপুল সেশরস। এবার একটা ঘরের ভেতরে সেট। রঙতুলির ব্যবহার করে ছাদের হলুদ-কমলা রোদটাকে ওরা ঘরে নিয়ে এলো। এবার তারা হাউজব্যান্ড স্টাইলে কাজ করছে। আর লাইভ রেকর্ডিং সিস্টেমেও এসেছে অভিনবত্ব এবং পেশাদারিত্ব। জুমের বদলে এবার সাউন্ড কার্ড, ল্যাপটপে উঅড এবং সিনেমাটোগ্রাফিতে দুটি ক্যামেরা। এই কাজে ওদের কোনো স্পন্সর ছিল না। নিজস্ব অর্থায়নে সম্পূর্ণ অলাভজনকভাবেই হাতিরপুল সেশন্স এখনো কাজ করে যাচ্ছে।
যাইহোক। হাতিরপুল সেশনসে এবার হোমব্যান্ড পাওয়ার ফলে আমার সঙ্গে যুক্ত হলো বেস গিটারে অমিত হাসান রুদ্র, লিড গিটারে অনিরুদ্ধ অনু, ড্রামসে হাসিন আরিয়ান ও স্যাক্সোফোনে রাহিন হায়দার। তিন চার দিন প্র্যাকটিস করে শুভ একটা ক্ষণ বেছে আমার গান ‘ বিষাদের পরমাণু’ শ্যুট হয়ে গেল। আর সেটি প্রকাশ পেল ডিসেম্বর ২০২২-এর মাঝামাঝি।
হাতিরপুল সেশনসের গানগুলো রিলিজ হয় তাদের ইউটিউব চ্যানেলে। হাতিরপুল সেশনস হাউজব্যান্ড তাদের প্রকাশিত গানগুলো লাইভেও পারফর্ম করে থাকে।
হাতিরপুল সেশনস ইউটিউব : https://www.youtube.com/@HatirpoolSessions যাত্রা বিরতি
মানুষ যাত্রাপথে একটু জিরোয়, একসঙ্গে এক কাপ চা খেতে খেতে জেনে নেয় সহযাত্রীর যাত্রাহেতু। যদি আড্ডা জমে যায় তাহলে আরও এক কাপ চা কিংবা কফির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও বেশ কিছু খাবারের পদ। সহযাত্রীদের নানান ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এবং দার্শনিক আলোচনায় প্রশমিত হয়ে যাত্রীদের ভ্রমণ অবসাদ, ক্লান্তিতে আনে আবেগের রঙিন ছোঁয়া। আর সেই যাত্রা বিরতিতে যদি গায়ক গেয়ে ওঠে গান তাহলে তো কথাই নেই!! তাই না? ঢাকার প্রচ- ব্যস্ত এই নাগরিক জীবনে আমাদের যেন যাত্রা বিরতির সুযোগ নেই কোনো! আর সেই যাত্রা বিরতির একটি সাংগীতিক সুযোগ পাবেন যাত্রা বিরতির মিউজিক লাউঞ্জে।
বহু বছর আগে বনানীর দেশীয় ফ্যাশন হাউজ যাত্রার ছাদে মিউজিক লাউঞ্জ যাত্রা বিরতির যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে যাত্রার ছাদেই গানের আয়োজন ছিল। তবে বিগত বেশ কয়েক বছর হলো চার তলাতে এখন গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। বহুদিন ধরেই ঢাকাতে অন্যরকম গান শোনার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সবার কাছে জনপ্রিয় এই যাত্রা বিরতির মিউজিক লাউঞ্জটি। মঞ্চে নকশিকাঁথার ব্যাকড্রপে ও আধো আলোর রহস্যময় পরিবেশে গায়কের প্রাণবন্ত গানে গানে নাগরিকদের অত্যন্ত প্রিয় একটি জায়গা এই যাত্রা বিরতি। ছাদে তাদের আছে নিরামিষ প্রধান নানান পদের খাবারের একটি রেস্টুরেন্ট।
গত ৩০ দিনের ভেতরেই যাত্রা বিরতিতে আমি তিনবার গান করলাম তিনটা ভিন্ন অনুষ্ঠানে। ‘মাঘের গান’ ‘স্বায়ত্ত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ এবং ‘বসন্তের গান’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে আমি ছাড়াও ছিলেন আরও অনেকে। মাঘের গানে ছিল ব্যান্ড কাকতাল, সানি অ্যান্ড দ্য রেভলিউশনস, শুভ সুলতান, নাঈম মাহমুদ এবং আকাশ গায়েন। আর স্বায়ত্ত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস কলকাতার একটি স্বনামধন্য ব্যান্ড। বেমানান ব্যান্ডের গুণী শিল্পী ও গায়ক স্বায়ত্ত মল্লিকের আরেকটি ব্যান্ড প্রজেক্ট এটি। গিটারে জুবিন ও ইলেকট্রিক গিটারে উৎসব গুহ ঠাকুরতা ও ভোকালে স্বায়ত্ত এই লাইন আপে স্বায়ত্ত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস পারফর্ম করেছিল যাত্রা বিরতিতে। সেদিন যৌথভাবে আরও গান করেন চেতনা রহমান ভাষা, আসির আরমান ও আমি।
আর বসন্তের গানে গান করেছিল কাকতা সানি অ্যান্ড দ্য রেভলিউশনস, আসির আরমান এবং আমি মুয়ীয মাহফুজ। ‘বসন্তের গান’ ছিল আবেশী গানের আসরের দ্বিতীয় পর্ব। বাংলাদেশের বর্তমান সময়কার নিজের গান নিয়ে এগিয়ে চলা কিছু গায়কদের একটি পরিবেশনার সিরিজ হলো এই আবেশী গানের আসর। আবেশী গান হলো সেই গান যা আপনাকে ভাবাবে, আপনি গায়কের আবেগের সঙ্গে একাত্ম হবেন এবং তার আবেশ রয়ে যাবে আরও অনেক দিন। আবেশী গানের আসরের প্রথম আয়োজন হয়েছিল বারবিকিউ স্কাইলাইন-এর রুফটপে। প্রথমবারে গান করেছিল দ্যা রেহমান ডুও, ব্যান্ড কাকতাল, সানি অ্যান্ড দ্য রেভলিউশনস এবং আমি।
আমার কৈশোর ছিল সাইকাডেলিক রক আর হেভি মেটাল মিউজিকের আবহে নিমজ্জিত। আশির দশকে সামরিক জান্তা আর স্বৈরশাসকের নিপীড়ন আর নিষ্পেষণকালের দোহাই দেব না। কিন্তু রাষ্ট্রকে যদি একটা এস্টাবলিশমেন্ট ধরি তাহলে তার সব রুচিগত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিজের পছন্দ-অপছন্দকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আকাক্সক্ষা তো ছিলই। সেই সময়টা পুরোপুরি প্রতিবাদী মানসিকতার কাছে সমর্পিত ছিল। যার প্রভাব আমরা দেখতে পাই আশির দশকজুড়ে। তবে গ্লোবাল স্পেকট্রামে যেসব সাংস্কৃতিক উপাদান বা এক্সপ্রেশন জনপ্রিয় হয় তার ঢেউ বাংলাদেশ অথবা আরও বিস্তৃত করে বললে ভারতীয় উপমহাদেশের তটে আছড়ে পড়ে এক দশক পরে। পশ্চিমে তখন সাইকাডেলিক রক, অলটারনেটিভ রক কিংবা হেভি মেটাল সংগীতের ধারা জনপ্রিয়তার অংশীদার হয়ে গেছে। মূলধারাকে প্রশ্ন করতে অন্য একটা সাংগীতিক এক্সপ্রেশন তখন প্রতিবাদের স্রোত তৈরির রসদ জোগাচ্ছে। মার্কিন মুলুকে থাকা আফ্রো আমেরিকান জনগোষ্ঠীর তরুণরা এক অন্যরকম জীবনধারণের কথা বলতে শুরু করেছে বর্ণবাদ আর সাদার সুপ্রিমেসিকে নাকচের মধ্য দিয়ে। তাকে বেশির ভাগ ক্রিটিকরা হিপহপ সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করতে শুরু করে। এই সংস্কৃতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল সংস্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে জীবনকে উপভোগ।
বাংলাদেশের মানুষ তখন হিপহপ শুনত না এমন নয়। তখনো হিপ হপ সংস্কৃতি সেই অর্থে দ্যোতনা তৈরি করেনি। এমসি হ্যামার কিংবা ডিজে কুলদের বিটনির্ভর উপস্থাপন শুনতাম। কিন্তু ওইভাবে আকৃষ্ট হয়ে শোনা শুরু হয়নি। আর সংস্কৃতিগত ধারণা থেকেই ওই ঘরানার হিপহপকে ঠিক নিজের মনে হতো না।
হিপহপ সংস্কৃতির বেড়ে ওঠা ডায়াসপোরা আর তার ডিস্টোপিয়ান আগ্রহ থেকে। অভিবাসনের মধ্য দিয়ে যে নিঃসঙ্গ তৈরি হয় তার প্রকাশ ঘটে বিমূর্তকরণে; সামাজিক রুচিবোধকে মেনে না নেওয়ার সে এক তীব্র বহিঃপ্রকাশ। বিংশ শতকের প্রায় শেষভাগে পশ্চিমে আফ্রো আমেরিকান বা আফ্রো ব্রিটিশদের মতো, ইন্দো আমেরিকান অথবা ইন্দো ইউরোপিয়ান তরুণরাও হিপহপ করতে শুরু করে আর জনপ্রিয়তার হাতছানি দেখতে পায়। তাদের একজনের নাম না বললেই নয় সেই অ্যাপাচে ইন্ডিয়ান পশ্চিমা ঘরানার র্যাপ কিংবা হিপহপের সঙ্গে পাঞ্জাবি ইন্ডিয়ান মিউজিকের ফিউশন করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর প্রভাবে কয়েক বছর পর আশরাফ বাবু, পার্থ বড়ুয়া আর আজম বাবু এই তিনজন একটা অ্যালবাম রেকর্ড করে। ত্রিরত্নের খ্যাপা নামের সেই অ্যালবাম শহুরে তরুণদের একটা সুনির্দিষ্ট অংশের মধ্যে ভালোই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাদের গানের মূল বিষয় ছিল পুরনোকে অস্বীকার আর ব্যবচ্ছেদ করে তার অপ্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। কিন্তু এই হিপহপ অ্যালবাম কোনো আন্দোলনের অংশ ছিল না। তিন তরুণ সংগ্রামী ব্যান্ড মিউজিশিয়ান ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইংলিশ অ্যাপাচি ইন্ডিয়ানকে অনুসরণ করে দেখতে চেয়েছিলেন হয়তো। যদি ক্যাসেটের বিক্রিবাট্টা ভালো হতো তাহলে আবার কিছু করা যাবে। কিন্তু তাদের সেই আশার গুড়ে বালি দিয়ে প্রজেক্ট সেখানেই সমাপ্ত হয়।
নব্বইয়ের দশকে মার্কিনি সামাজিক সাংস্কৃতিক কারণেই হিপহপ কিংবা জঅচ সব বর্ণের তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করতে শুরু করে। শুধু আফ্রো আমেরিকান নয় নেটিভ আমেরিকানরাও রাইমিং শুরু করে ভালোভাবেই। এখানে বলে নেওয়া ভালো, জঅচ কোনো শব্দ নয়, এর মূল অর্থ জযুসব ধহফ চড়বঃৎু। ছন্দোবদ্ধ করে কবিতা আবৃত্তির মতো করে গান গাওয়া। এই সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বিনোদনদাতারা। শুরুর সময়টায় হিপহপাররা দর্শকদের সঙ্গে কথা বলে বিট তৈরি করে যোগাযোগ করত। তারা মূলত অনুষ্ঠান পরিচালকের ভূমিকা নিত। এ কারণে অনেক জঅচচঊজ। তাদের নামের আগে ইংরেজি বর্ণ এমসি ব্যবহার করত। বাংলাদেশেও শহুরে তরুণদের একটা গ্রুপ নিজেদের ভেতর জঅচ চর্চা করত, আর তারা নিজেদের নাম পাল্টে এমসি অমুক, এমসি তমুক নামে পরিচিত হতে শুরু করল।
পশ্চিমা যেকোনো বিষয়ের চর্চা যেভাবে বাংলাদেশে শুরু হয় এই ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। রাষ্ট্রের উচ্চবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত শহুরে শিক্ষিত তরুণরাই পুরোধা হলো। তাদের অনুপ্রেরণায় কিছু শহুরে মধ্যবিত্তরাও যুক্ত হলো। পশ্চিমে যেমন বিকল্পধারা হিসেবে যেকোনো সাংস্কৃতিক এক্সপ্রেশন শুরু হয়েছে প্রতিবাদী বা পাল্টানোর মানসিকতা নিয়ে; অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে বসা মানুষ অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য চিৎকার করেছে অথবা ছন্দ তৈরি করেছে। বাংলাদেশে অস্তিত্বওয়ালারাই বরং তাদের ঘোষণা আরও পোক্ত করে এসব নতুন ঘরানাকে অভিযোজন করে। বাংলাদেশি এমসিরা মূলত ঘরে বসে ছন্দ তৈরি করা তরুণ হলেও শুরুতে তারা পাশ্চাত্যের মতো এলাকার দখলের ঘোষণা দিয়ে গালাগাল-সমৃদ্ধ কিছু একটা করত। বেশির ভাগ ইংরেজি মাধ্যমে পড়া আরাম-আয়েশে জীবন কাটানো তরুণদের কণ্ঠে এসব গালাগাল খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি প্রথম দশকের শেষ আর দ্বিতীয় দশকের শুরুতে। কিন্তু সরকারি কলোনিতে বড় হওয়া একদল ছেলে নিজেদের আপটাউন লোকালজ বলে যখন জঅচ করতে শুরু করল, তারা সীমিত পরিসরে হিপহপ চর্চারত ধনিক শ্রেণির জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হলো।
বাংলাদেশে হিপহপের পুরোধারা নিজেদের পরিচয় দিত দেশি এমসি হিসেবে। আপটাউন লোকালজদের নাম ছিল বর্ণময় আবার খানিকটা ডার্ক। তবে এর মধ্য দিয়েই হিপহপ সংস্কৃতির বাংলাদেশ চ্যাপ্টার পূর্ণতা পেল। যদিও উপস্থাপন কিংবা সুরে পশ্চিমের অনুবাদ করত উভয় পক্ষই। নিজস্বতা বলে কিছু ছিল না হিপহপারদের। অন্য রক কিংবা মেটাল মিউজিকের মতোই, অনুকরণপ্রিয় হিসেবেই বাংলাদেশি হিপহপারদের উত্থান।
কিন্তু কেউ কেউ যেন অন্যরকম ভাবে। তাউরা সাফা নাম নিয়ে পরিচিত হওয়া এক জঅচচঊজ তেমনি একজন। পুরান ঢাকায় একেবারে স্ট্রিট কালচারে বড় হওয়া সাফা তার অস্তিত্ব জানান দিল দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝিতে। হিপহপাররা জেগে উঠল। দেশের বিভিন্ন কোণে জঅচ করতে শুরু করল তরুণরা। এ সময়টায় সিলেট, ফরিদপুর, কুমিল্লা এমনকি কক্সবাজারেও নতুন হিপহপাররা তাদের জঅচ ইউটিউবে প্রকাশ করতে শুরু করল। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করে তারা যেন নিজেদের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে ব্যস্ত হলো।
আমি আগে জঅচ বা হিপহপকে মিউজিকের ঘরানা হিসেবে গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু জালালি সেট বলে একটা প্রজেক্টের গান শুনে থমকে গিয়েছিলাম ২০১৬-এর গোড়ার দিকে। এই প্রজেক্টের নেতৃত্ব অথবা মূল প্রণেতা ছিল সেই শুরুর জমানার একজন, যে নিজেকে এমসি মাগজ বলে পরিচয় দিত। উচ্চবিত্ত পরিবারের ইংরেজি মাধ্যমে পড়া এই এমসি সমাজের নানা স্তরের আরও চারজন হিপহপারের সঙ্গে মিলে বেশ কিছু ট্র্যাক তৈরি করল। এবার যেহেতু জঅচ-এর একটা ভূমি তৈরি ছিল তাই গালাগাল নিয়ে সমস্যা হলো না। কিন্তু তারা নাড়া দিল সমাজের প্রচলিত নানা সংস্কার নিয়ে। দলবাজি না করেও কেমন রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করা যায় এস্টাবলিশমেন্টকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তার নমুনা হিসেবে একেকটা ট্র্যাক যেন নিজের সঙ্গে পাল্লা দিল।
পরে যারা হিপহপ সংস্কৃতি অথবা জঅচ তৈরির চেষ্টা করছে তাদের অনেকে এই সংস্কৃতিকে জড়িয়ে নিয়েছে নিজেদের জীবনবোধে। আবার অনেকে এটাকে শুধু একটা এক্সপ্রেশন হিসেবে দেখেছে। তবে একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, বাংলাদেশের জঅচচঊজরা এখন শুধু প্রতিবাদ কিংবা পরিবর্তনের কথাই বলে না, তাদের ছন্দোবদ্ধতায় কবিতা তৈরি হয়। তাদের শরীরী ভঙ্গিতেও দেশি ভাব দেখা যায়। দেশি পুঁথিপাঠ কিংবা কবির লড়াইয়ের ধরনে তারা ব্যাটল রাইম করে। সম্ভবত দেশের অনেক হিপহপারই নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে নিজস্ব ধরন তৈরি করেছে। পশ্চিমের অনুকরণ না করে, অনুগত না থেকে কীভাবে একটা সাংস্কৃতিক এক্সপ্রেশনকে নিজেদের করে নেওয়া যায় তার নিদর্শন হিসেবে আপনারা বাংলাদেশি হিপহপার কিংবা জঅচচঊজদের কথা বলতে পারেন নিঃসংশয়ে।
একুশ শতকের প্রথম দশকেই নতুন স্বাদের যে গান বাংলাভাষীদের চাঙ্গা করেছে তা হলো বাংলা র্যাপ। নিউ ইয়র্ক বেজড স্টোয়িক ব্লিসের ‘আবার জিগায়’ নামের হিপহপ ঘরানার গানটি রিলিজের সঙ্গে সঙ্গেই শ্রোতাদের প্লে-লিস্টে উঠে আসে; তবে প্রচুর ইংরেজি শব্দের ব্যবহারের কারণে একে পুরোপুরি বাংলা র্যাপ বলা যাবে না। একই ধারাবাহিকতায় ‘দেশি এমসি’জ’ ‘ব্যানড’ নামের অ্যালবাম রিলিজ করে তাতেও বাংলা র্যাপের ভিত্তি পাকাপোক্ত করার মতো ট্র্যাক ছিল না। তবে এরা বাংলা হিপহপে তাদের জায়গা তৈরি করে নেয়।
ডেডলাইন এন্টারটেইনমেন্ট লেভেল ‘টিওআর’-এর ‘বাংলা হিপহপ জাতি’ এবং ‘আপটাউন লোকলজ’ এর ‘কাহিনি সিনপাট’ নামের দুটি এলবাম রিলিজ করে পরপর। টিওআর-এর অ্যালবামে বাংলা র্যাপের শক্তির জায়গাগুলো পরিষ্কার হয় আর আপটাউন লোকলজ বলা যায় বাংলা র্যাপের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। কাহিনি সিনপাট বাংলা হিপহপে বাংলা র্যাপের একটা পূর্ণাঙ্গ অ্যালবাম। জেসপার আল রাশিদের জাদুকরী মিক্সিং আর মাস্টারিং-এ দুটি অ্যালবাম শ্রোতাদের কানের রুচির স্বাদ মিটিয়েছে।
যদিও মেইনস্ট্রিমে আসার আগে আপটাউন লোকলজ’র সদস্য ব্ল্যাক জ্যাং, তাউড়া সাফাদের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্র্যাক ছিল কিছু। যার মধ্যে ‘ঠোলার পোলা’ নামের একটা গানের জন্য তাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেডকোয়ার্টারেও জবাবদিহি করতে হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। গানগুলো মেমোরি কার্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল, আর ২০০৯-এ অ্যালবাম রিলিজ হলে গান বাজত এফএমে।
কাহিনি সিনপাট অনন্য এর বাংলা ভাষা ব্যবহার আর লোকাল লোকজনের মুখের ভাষা তুলে আনায়। পুরান ঢাকার টোন আর একই সঙ্গে খেটে খাওয়া মানুষের কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার আলাদা উত্তেজনা তৈরি করে। এলিফ্যান্ট রোডের জুতার দোকানিদের নিজেদের মধ্যকার কোড ল্যাঙ্গুয়েজ আছে কিছু; ওখানে বেশ দামাদামি করে জুতা কিনতে হয়, এখানে কখনো ক্রেতা জিতে কখনো বিক্রেতা। হুট করে ‘উস্সাই’ বলে উঠে কোনো কোনো বিক্রেতা, এতে তার সহকর্মী বুঝতে পারে, লাভ হয়েছে বিক্রিতে। এমন আরও কিছু শব্দ কাহিনি সিনপাটে লক্ষ করার মতো। এছাড়াও অ্যালবামের প্রথম থেকে শেষ বেশ একটা হিপহপ জার্নির মতো। গানগুলোর বিষয়বস্তুতে যেমন পার্টি মুড আছে একই সঙ্গে দেশপ্রেম, সমাজ ও প্রতিবাদী চিন্তার প্রতিফলনও ঘটেছে। হিসাবের কথা, সিভিল সমাজ ও পিস্তলের জীবন গানগুলোতে তৎকালীন সময়ের একটা রূপও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তবে এই অ্যালবামের সবচেয়ে জনপ্রিয় হয় ‘এই মামা এই’ গানটি। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এই গানগুলোর প্রভাব থেকে এখনো বের হতে পারেনি বাংলা র্যাপাররা, এতটাই সমৃদ্ধ এই অ্যালবামটি।
আপটাউন লোকলজ ভেঙে যাওয়ার পর সাফা দেশি এমসিজ’র মাগজ’র সঙ্গে নতুন করে দল গোছায়। জালালি নামে দলটির আত্মপ্রকাশের আগেই ‘এলাকা’ নামের একটি ট্র্যাকও প্রকাশ করে ইউটিউবে। পরে সাফার অংশ বাদ দিয়ে আবার একই ট্র্যাক রেকর্ড করে জালালি সেট নামের হিপহপ দলটি। বেশ কিছু গান আনে তারা ইউটিউবে। এর মধ্যেই জালালি সেট সদস্য শাফায়েত মমতাজের সঙ্গে ‘লোকাল বাসের’ মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পায় তবে দল হিসেবে শ্রোতাদের নতুন কিছু দিতে ব্যর্থ হয় তারা। অন্যদিকে ‘ভব’ নামে হিপহপ ক্ল্যান তৈরি করে বেশ কিছু ট্র্যাক রিলিজ করে তাউড়া সাফা। হিপহপ তৎপরতা লক্ষ করা যায় বিভিন্ন অঞ্চলেও; নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, টাঙ্গাইল, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ বেশ কিছু অঞ্চলে সেখানকার আঞ্চলিক ভাষাতেও র্যাপ করা শুরু করে র্যাপাররা। উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছে আপটাউন লোকোলজের ব্ল্যাক জ্যাং, সে বেশ কিছুদিন পরপরই নিজের ট্র্যাক রিলিজ করছে একই সঙ্গে হিপহপের নানা রকম মুভমেন্টের সঙ্গেও জড়িত।
ইংরেজি র্যাপ থেকে সরে এসে হালে বাংলা র্যাপের স্বকীয়তার জায়গা হলো ফোক গানের সঙ্গে ফিউশন ও বাংলার নিজেদের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে বাংলার ভাব ও আঞ্চলিকতা।
বিজ্ঞাপনগুলোতে হিপহপ ড্যান্স ও বাংলা র্যাপের ব্যবহার হচ্ছে প্রচুর। বিটের তালে র্যাপ গানে পণ্যের গুণগান করাটা অভিনব এবং আকর্ষণীয় বটে। তবে পূর্ণাঙ্গ বাংলা র্যাপের যাত্রাটা যেভাবে ধানম-ির ফুটপাত থেকে শুরু হয়েছিল, ভাইরাল ভাইরাস বা বিজ্ঞাপনী সংস্থার হাতে এ গান বেশিদিন থাকবে না। বাংলা র্যাপ হতে যাচ্ছে মুখবন্ধ রাখতে বাধ্য মানুষদের মুখোশ পরে ‘কথা বলার’ মাধ্যম। কথা নিষিদ্ধ জগতে সিধাসাদা কথা বলার জন্য বিটের তাল হলে রাস্তাপ্রিয় লোকদের আর কী চাই!
The culture of all oppressed is the culture of resistance... Thus all artists coming from an oppressed people must represent resistance in their art form.
-Kwame Ture
ঊনসত্তর-একাত্তর হয়ে বাহাত্তরেও যে জঙ্গম বাস্তবতার আঘাত ও ক্ষত দেশের শরীরে দপদপ করছিল, তাকে কোনো সুকুমার ভাষায় প্রকাশ করা কি যেত? সে সময়ের তরুণের মন চিৎকার করছে হাহাকারে, ফেটে পড়ছে বিদ্রোহে, তাদের দরকার ছিল খোলা গলার চিৎকারের ভাষা। ‘হায় আমার বাংলাদেশ’ বলে আজম খান সেটাই দিলেন। আর তাতেই বদলে গেল বাংলা গানের ইতিহাস। তার গান অসন্তোষের তারে বাঁধা হলেও তার তলায় ঠিকই শোনা যায় ভালোবাসার অফুরান কুলকুল জলধারা।
তারপর এক দিন বুকের ভেতর একটা ধস। আজম খান আর নেই। এই ‘নেই’ কি নতুন? অনেক দিনই তিনি তো ছিলেন না বললেই চলে। রোগশয্যায় কোমায় চলে যাওয়ারও আগে, বহুদিন ধরে গানের বাজারের বাজারিরা তো তাকে একরকম ‘কোমা’র মধ্যেই রেখেছিল। তিনি গান বাঁধতেন, কিন্তু কেউ সেধে প্রকাশের গরজ দেখাত না। তিনি সেই বুক তোলপাড় করা আজম খানই ছিলেন, তবু টিভি বা কনসার্টে গাওয়ার ডাক কমে গিয়েছিল। রক্তমাংসের মানুষটি মরে যাওয়ার আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল তার সাংস্কৃতিক মৃত্যুর পরিবেশ। তার দিন সত্যিই ফুরিয়ে আসছিল।
সময় বদলে যাচ্ছিল, মন বদলে যাচ্ছিল, রাজধানী-শহর-মফস্বল সব বদলে যাচ্ছিল। বদলে যাচ্ছিল পপগানের জনপ্রিয়তার ব্যাকরণ। এ যুগ ডিজিটাল, এ মন লিকুইড, এর চাওয়া পিচ্ছিল, এর প্রেম অস্থির। সত্তর বা আশির দশকের সেই রোখা মন, চোখা গায়কি, বুনো আবেগের ভাষায় আর সাড়া দেয় না আজকের তরুণ। তাদের মনের পর্দায় এখন অন্য ছায়া, অন্য ছবি, অন্য সুর। কানে আইপড লাগানো রঙ করা চুলের বাহারি তরুণী কিংবা কোমরঢিলা জিন্স আর ব্র্যান্ডে ব্র্যান্ডে ব্র্যান্ডেড তরুণ মনে আজম খান কতটা সাড়া তুলবেন আর? তিনি তো আর লিকুইড মডার্নিটির তারুণ্যের ভাবভঙ্গি বোঝেন না। তার দিন ছিল সত্তর দশকের অশান্ত ও প্রতিবাদী চৈতন্যে গড়া। দেশায়ত আধুনিকতার সেই যুগে শহুরে তারুণ্য একধরনের প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাবকালচার গড়ে নিয়েছিল। তখনো নাগরিকতার ঠাটবাট থেকে তারা দূরে ছিল, দূরে ছিল পণ্যাসক্ত ভোগবাদিতা থেকেও। সেই দিন, সেই মন যত ফুরাচ্ছিল, ততই তার দিনও বুঝিবা ফুরিয়ে যাচ্ছিল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী উত্তাল সময়ে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া তারুণ্য অশান্ত ও হতাশ হয়ে উঠেছিল। আজম খানের গান তখন তাদের ভাষা দিচ্ছিল, জাগিয়ে রাখছিল। তিনিই ঢাকার তরুণদের চিৎকার করে মনের কথা বলার ভাষা ও ভঙ্গি দিয়েছিলেন। তার পুরুষালি গলা ও ঢং তাকে পুরুষ-তারুণ্যের জননায়ক করে তুলেছিল। সনাতন বাংলা গানের পুতুপুতু সুরেলা আমেজ ভেঙেচুরে শিরায় শিরায় রাগী ছন্দের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বাবা তাকে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে যাচ্ছিস যা, দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না।’ তিনি কথা রেখেছিলেন। গেরিলা যোদ্ধার বেশ আর ছাড়েননি, কেবল রাইফেল-গ্রেনেড ফেলে গিটার তুলে নিয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন আহত কিন্তু প্রতিবাদী বাংলাদেশের তরুণদের প্রতীক। সত্যিই সেই দিন কি আর নেই, সেই তরুণেরাও কি হারিয়ে গেছে? তারা আছে নিশ্চয়, কিন্তু তাদের মনের পিপাসা মেটাবার দায়িত্ব গানের বাজারিরা আর নিচ্ছেন না। কালচার ইন্ডাস্ট্রি এখন ফাঁকা আবেগ আর মোহরতিবাসনার প্রজননক্ষেত্র হয়ে তারুণ্যের দাহিকাশক্তি নিঃশেষ করে ফেলছে। এসব দেখেই দেখেই আজম খানের মনে সংশয় জেগেছিল, ‘আমার গান একসময় মানুষকে জাগাইছে হয়তো, তখন ছিল যুদ্ধের পরবর্তী সময়, মানুষের মধ্যে দরকার ছিল যুদ্ধের চেতনা। এখনকার তরুণদের কাছে আমার গান কী সেটা বুঝলে বুঝবেন আমি আসলে কী করছি। ...আমার গান এখনকার অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের অন্তরকে জাগায় কি না।’
তার স্মরণে অনেক অনুষ্ঠান হলো টিভি চ্যানেলগুলোতে। একটিতে তিনি শিল্পী আসিফের উপস্থাপনায় দুর্বল শরীরে আসিফের কাঁধে ভর দিয়ে গান গাইছিলেন। শেষ গান হিসেবে গাইলেনÑ ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে!’ গাইতে গাইতে এক্কেবারে হৃদয়ের তন্ত্রীতে বাড়ি মেরে যতবার হায় বলছিলেন, মনে হচ্ছিল সেটা তার কলিজাচেরা হাহাকার।
আধুনিক বাংলা গানের রয়েছে অমৃত ভান্ডার। বিশেষ করে, বাংলাদেশে যেসব সুরবোদ্ধা আধুনিক বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করে গেছেন, সেইসব সংগীত ব্যক্তিত্ব জ্বলজ্বল করছেন সুরের আকাশে। বর্তমানেও সেই গানের, জনপ্রিয়তা কমেনি। সেইসব গান শোনামাত্র, আমরা স্মৃতিকাতর হই। খুঁজে বেড়াই, হারানো ভালোবাসা। অথবা উদ্বুদ্ধ হই, গভীর দেশপ্রেমে। সেইসব গান আমাদের ভেতর জাগিয়ে তোলে দ্রোহ, যন্ত্রণা, ভালোবাসার কাতরতা। কখনো আবার স্বপ্ন দেখায়, নতুন জীবনের।
একটি গীতিকবিতা প্রাণ পায়, সুরে। সুরকারের জাদুস্পর্শে তা ধ্বনিত হয়, শিল্পীর কণ্ঠে। হারানো দিনের সেই সব গানের উল্লেখযোগ্য সুরকার নিয়েই এই লেখা। সেইসব গানের অধিকাংশই, স্থান পেয়েছে চলচ্চিত্রে।
সুরকার আলতাফ মাহমুদ একুশের প্রভাত ফেরির গান আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো/একুশে ফেব্রুয়ারি গানে সুরারোপ করে অমর হয়ে থাকবেন।
সুরকার সুবল দাস। ১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানী পরিচালিত আকাশ আর মাটি’ চলচ্চিত্রে প্রথম সংগীত পরিচালনা করেন। এরপর অসংখ্য চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন, সংগীত পরিচালক হিসেবে। জন্ম নিয়েছে, শত শত জনপ্রিয় গান। ঢাকাই চলচ্চিত্র দর্পচূর্ণ ছবিতে তুমি যে আমার কবিতা/ আমারও বাঁশীর রাগিণী/ আমারও স্বপন আধো জাগরণ/ চিরদিন তোমারে চিনি, ‘আলো তুমি আলেয়া’ চলচ্চিত্রে আমি সাতসাগর পাড়ি দিয়ে, যোগ-বিয়োগ চলচ্চিত্রে এই পৃথিবীর পান্থশালায় গানগুলো মনের গভীরে স্থায়ী আসন করে নেয়।
এরপরই আমরা পেয়ে যাই, সুরকার সত্য সাহাকে। যিনি অসংখ্য চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে সুতরাং, নীল আকাশের নীচে, অশিক্ষিত, আবির্ভাব, ছুটির ঘণ্টা, অমর প্রেম, আগুনের পরশমণি, দীপু নাম্বার টু ছবি উল্লেখযোগ্য। এসব চলচ্চিত্রের অনেক গান সমাদৃত হয়েছে মানুষের কাছে।
১৯৬০-এর দশকে দেবু ভট্টাচার্য পাকিস্তানের কণ্ঠশিল্পী গজল সম্রাট মেহেদী হাসান, সুরাইয়া মুলতানীকর ও আহমদ রুশদী এবং বাঙালি সংগীতশিল্পীদের মধ্যে বশির আহমেদ, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, ফেরদৌসী রহমান, রুনা লায়লা প্রমুখের মাধ্যমে উপমহাদেশে বাংলা সংগীত ও সংস্কৃতিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
খন্দকার নুরুল আলম স্বনামধন্য সংগীত পরিচালক ও সুরকার। তার সুর করা চোখ যে মনের কথা বলে, আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে, এতো সুখ সইবো কেমন করে, তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে ইত্যাদি জনপ্রিয় গানের কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও সমাদৃত। তার চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা শুরু হয় উর্দু চলচ্চিত্র দিয়ে। প্রথম সুরকৃত চলচ্চিত্র ইস ধরতি পার। বাংলা চলচ্চিত্রে সুর ও সংগীত পরিচালনা শুরু করেন ১৯৬৮ সালে, অন্তরঙ্গ ও যে আগুনে পুড়ি দিয়ে।
১৯৭০ সালে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানে সুরারোপ করে, আনোয়ার পারভেজ বাঙালির হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেড়ে নেন। ১৯৭০ সালেই খান আতাউর রহমান (খান আতা) ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির বিভিন্ন গানে সুরারোপ করে, সংগীত বোদ্ধাদের নজর কাড়েন। এই ছবির ‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে’ গানটির কণ্ঠশিল্পীও তিনিই ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সমর দাস, মুজিবনগর থেকে পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ও প্রধান পরিচালক ছিলেন। এ সময় বহু গানে তিনি সুর দেন। তার সুর করা গান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও দেশবাসীকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। মুক্তিযুদ্ধে তার সুর করা ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’ প্রভৃতি গান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে।
এরপর আমরা পাই, সুরকার প্রণব ঘোষ ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। তারা চলচ্চিত্রে তেমন সক্রিয়ভাবে যুক্ত না থাকলেও, বাংলাদেশের অডিও শিল্পে স্থায়ী আসন করে নেন। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরারোপিত ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না/ আমি গাইবো’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ টেলিভিশনে ৮টা ও ১০টার সংবাদের আগে এই গানের মিউজিক মানুষের হৃদয়ে সৃষ্টি করে অন্যরকম দ্যোতনা।
নবীন সুরকার: শওকত আলী ইমন, বাপ্পা মজুমদার, প্রিন্স মাহমুদ, রাজেশের সুরে বেশকিছু গান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হারিয়ে যাওয়া সুরকার-সংগীত পরিচালকের উত্তরসূরি হিসেবে, একদিন এইসব গুণী সুরকারও ঠাঁই নেবেন ইতিহাসের পাতায়।
বর্তমান চ্যাম্পিয়ন গুজরাট লায়ন্স ও চারবারের চ্যাম্পিয়ন চেন্নাই সুপার কিংসের ম্যাচ দিয়ে শুক্রবার মাঠে গড়াবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ষোড়শ আসর।
আহমেদাবাদে আইপিএলের উদ্বোধনী ম্যাচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায়। দশ দলকে নিয়ে আট সপ্তাহে ১২টি ভেন্যুতে এবারের আসরের খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হবে। মোট ম্যাচের সংখ্যা ৭৪টি।
গেল বছর আইপিএলে নতুন দুটি দল যুক্ত হয়- গুজরাট ও লখনউ সুপার জায়ান্টস। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই দারুণ ক্রিকেট খেলে তারা। লিগ পর্ব শেষে টেবিলের শীর্ষে ছিল হার্ডিক পান্ডিয়ার নেতৃত্বাধীন গুজরাট। রাজস্থান রয়্যালসের সাথে পয়েন্ট সমান হলেও রান রেটে পিছিয়ে তৃতীয় হয় লখনউ।
কিন্তু টুর্নামেন্টের ফাইনালে ঠিকই জায়গা করে নেয় গুজরাট। ফাইনালে রাজস্থানকে হারিয়ে শিরোপা জিতে গুজরাট। এবারও শিরোপা ধরে রাখার মিশন গুজরাটের। যথারীতি দলকে নেতৃত্ব দিবেন পান্ডিয়া।
টুর্নামেন্ট ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চারবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মহেন্দ্র সিং ধোনির চেন্নাই। ধোনির নেতৃত্বেই রেকর্ড নয়বার ফাইনালে খেলেছে তারা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দুই বছর আগে অবসর নিলেও এখনও আইপিএল খেলছেন ৪১ বছর বয়সী ধোনি। চেন্নাই দলের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে ধোনির উপর। ধরনা করা হচ্ছে এবারের আইপিএল ধোনির ক্যারিয়ারের শেষ আইপিএল।
আইপিএলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পাঁচবার শিরোপা জয়ের রেকর্ডের মালিক মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। গেল বছর টেবিলের তলানিতে থেকে আসর শেষ করে রোহিত শর্মার দল। দ্বিতীয় সফল দল চেন্নাইও ভালো করতে পারেনি। দশ দলের মধ্যে নবম ছিল চেন্নাই। মুম্বাই শেষ করেছিল সবার শেষে থেকে। এবার এই দুই দলের ওপরই আলাদা নজর থাকবে সবার।
আগামী ২৮ মে ফাইনাল দিয়ে পর্দা নামবে আইপিএলের এবারের আসরের।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।