
আজ থেকে বহু বছর আগে দেশের কথা বলার জন্য একতারাকেই বেছে নিয়েছিলেন দেশবরেণ্য কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ। সেই সাদাকালো সময় পেরিয়ে দেশ আজ ইউটিউব আর গানের নানা অ্যাপের যুগে। একতারা, দোতারা, সারিন্দা, খমক, হারমোনিয়াম, তবলা থেকে এখন আমরা পৌঁছে গেছি বর্ণিল সব গিটার, সিনথেসাইজার আর টেকনো সাউন্ডের যুগে।
ফেরদৌসী রহমনের ‘এসো গান শিখি’ থেকে বাংলা সিনেমা সবেতেই দেখা মিলত নানা বাদ্যযন্ত্রের। বাঁশি, হারমোনিয়াম, সন্তুর, সরোদ, সেতার, তানপুরা থেকে সুরবাহার-সুরমণ্ডল। আবার ওদিকে এস্রাজ, সারেঙ্গি বা বেহালা থেকে ঢাক-ঢোল-খোল-মাদল। বাংলা গানকে বরাবরই সমৃদ্ধ করে গেছে এসব যন্ত্র। যন্ত্রের পণ্ডিতরা নীরবে নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে গেছেন বাংলা সংগীতের উন্নতি সাধনে।
স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে সংগীতের ইতিহাস অত্যন্ত শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। আমাদের যেমন আছেন সুরসাধক, তেমনই আছেন যন্ত্রসংগীতের ওস্তাদি। আমাদের যেমন আছেন নামি গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী- তেমনি আছেন যন্ত্র নিয়ে সুরের খেলায় মেতে থাকা সংগীত পরিচালকরা।
প্রথমেই আমরা আমাদের নিজেদের গান নিয়ে কিছু কথা বলি। নিজেদের গান মানে আমাদের মাটির গান। আমাদের মাঠের গান, ঘাটের গান, নৌকার গান, গুন টানার গান, গরুগাড়ি চালানোর গান, বৈঠকের গান, ঢেঁকিপাড়ার গান। এসবই আমাদের নিজেদের গান। এসব গান গাইতে খুব একটা বেশি যন্ত্র বা যন্ত্রীর প্রয়োজন হতো না। গ্রামীণ মানুষের যাপিত জীবনের নানা কথা উঠে আসে এসব গানে। প্রেম-ভালোবাসা, স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, গৃহস্থালি কাজকর্ম, দেবর-ভাবির সম্পর্ক, বিয়ে-যৌতুক, নতুন বৌয়ের নাইয়র, সমাজচিত্র, অতিথি আপ্যায়ন, বন্যা-নদীভাঙনের কথা রয়েছে। আছে আধ্যাত্মিকতাও।
ঐতিহাসিক ও আঞ্চলিক বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হতো এসব গানে। এর মধ্যে রয়েছে একতারা, দোতারা, ডুবকি, ঢোল, খঞ্জনি, করতাল, বাঁশি, খমক, গাবগুবি ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ শেষের বাদ্যযন্ত্রটির (গাবগুবি) নাম দিয়েছিলেন আনন্দলহরী।
অঞ্চলভেদে নানা গানের মতো এসব ক্ষেত্রে যন্ত্র ব্যবহারের বৈচিত্র্য রয়েছে। আমাদের রয়েছে জারি-সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, নানারকম পল্লীগীতি, গম্ভীরাসহ বিভিন্ন সুর ও তালের লোকগীতি। এসব গানে ব্যবহৃত হয় নানারকম বাদ্য ও সুরযন্ত্র। একনিঃশ্বাসে এমন বেশ কিছু যন্ত্রের কথা বলা যায় করকা, ঢোলক, বেঞ্জু, সানাই, একতারা, খঞ্জরি, খমক, ঘুণ্টি, ঢাক, ঢোল, খোল, বীণা, কাঁশি, বাঁশি, ডুগডুগি, করতাল, মৃদঙ্গ, ভেউরি, ঝাঁঝরি, জয়ঢাক, শঙ্খ, তাসা, খেমচা, পাখোয়াজ, মাদল, মুহরি, তুরি, ভেরি, টঙ্কার, কাহাল, বরগা, মন্দিরা, মুহরি, মুরলি বা বংশি, ভেউর, করনাল, পিনাক, দোতারা, সেতারা, মরুজ, টিকারা, ধাঙসা, সারিন্দা, খটক, কিঙ্কিনি-কঙ্কণ, তম্বুরা, ঘুঙুর, সিংহা, ঝাম ইত্যাদি।
এ তো গেল লোকজ গানের কথা। এবার আসা যাক আধুনিক গানে। যেহেতু লোকজ গানই আছে আমাদের মূলে, তাই আধুনিক গানেও লোকজ গানের সুর ও যন্ত্র অনেকটাই ঠাঁই পেয়েছে। যন্ত্র যতই আধুনিক হোক, আমরা চাইলেও তো আমাদের মাটিকে অস্বীকার করতে পারি না। তাই আমাদের আধুনিক গানেও রয়ে গেছে সেই লোকজ গানের ছোঁয়া।
আসা যাক আধুনিক গানের কথায়। সত্তর ও আশির দশকে আমাদের যন্ত্রসংগীত জগৎ অল্পকিছু সংগীতযন্ত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। গান বাঁধা বা সুর তোলার জন্য ছিল হারমোনিয়াম বা তানপুরা। তালযন্ত্র বলতে ছিল তবলা আর ঢোল। সঙ্গে বাঁশি-সেতার, কখনো কখনো পাখোয়াজ। সময় বদলাল। আশির দশকের শেষ থেকেই বিদেশি নানা যন্ত্রের প্রবেশ শুরু হলো। এলো নানারকম গিটার (ইলেকট্রিক, অ্যাকুস্টিক, বেজ), কি-বোর্ড, ড্রামস। এর পর যেন তাদেরই আধিপত্য। এ সময়ের গান যেন আর এসব যন্ত্র ছাড়া চলেই না। বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী ব্যান্ড সংগীতও মূলত এই তিনটি যন্ত্রনির্ভর।
শাস্ত্রীয় বা মূলধারার সংগীতের মতো যন্ত্রসংগীতেও অনেক ওস্তাদকে পেয়েছি আমরা। আমরা তাদের বাদন শুনেছি। আমরা বিভিন্ন গানে তাদের ব্জনা উপভোগ করেছি। কানকে ঋদ্ধ করেছি। আমাদের আছেন বারী সিদ্দিকী। ‘আমার অনেক বাঁশের বাঁশি আছে মিছেই কেন কিনবি চাটাই বাঁশ’ নিজের গাওয়া গানের মতোই ছিলেন আমাদের বাঁশিওয়ালা এবং আড় বাঁশির জাদুকর এই মানুষটি। তার চলে যাওয়ার পর শূন্যস্থানটি পূরণের চেষ্টা করছেন জালাল আহমেদ। বেহালার মানুষ সুনীল চন্দ্র দাস, তার অবদান ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গিটারে আছেন আরেক মহারাজ- নিলয় দাস। যিনি নিজেকে সাধকের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার পথে ঝাণ্ডা ধরে দাঁড়িয়ে ইব্রাহিম আহমেদ কমল। আর হালের ইমন চৌধুরীর নাম না নিলে হয়তো অন্যায় করা হবে। তবে সাধক নিলয় দাসের পর যার নাম নেওয়া জরুরি ছিল তিনি আজ প্রয়াত। তিনি আর কেউ নন- ওয়ান অ্যান্ড ওনলি আইয়ুব বাচ্চু।
প্রায় সব সুরযন্ত্রকে যে যন্ত্রটি এক শিরোনামে নিয়ে এসেছে সেটি হলো কি-বোর্ড। আশ্চর্য এই আধুনিক সংগীত যন্ত্রটিতে আছেন আমাদের মানাম আহমেদ। বেজ গিটারে আছেন সুমন, অনুরাগীরা যাকে ভালোবেসে ডাকেন ‘বেজবাবা’। এখন খুব সক্রিয় রিদম সেকশনের প্রিয় মুখ এহসান এলাহি ফান্টি। তবে ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের আরও আছেন পিলু খান, পিয়ারু খান, মিল্টন আকবর (প্রয়াত), শেখ মনিরুল আলম টিপুর মতো রিদম স্পেশালিস্টরাও।
শূন্য দশকের শুরুতে এই মহানগরীর ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছিল স্টুডিও। তখন সবাই ছিলেন মিউজিক ডিরেক্টর। এরপর ধীরে ধীরে সে আগুনে আর ঘি পড়েনি। তবুও এখন আর বড় পরিসরে সেই স্টুডিও নেই। নেই মিউজিশিয়ানদের আড্ডা। অডিও ক্যাসেট সিডির যুগ পরপারে চলে যাওয়ায় এখন আর নেই সেই অডিও জৌলুশ। এখন বেশির ভাগ মানুষই ঝুঁকছে অটোটিউনে। যে কোনোদিন গিটার ছুঁয়ে দেখেনি, প্রযুক্তির কল্যাণে সে আজ মিউজিক ডিরেক্টর। ...কি-বোর্ডে একাই বাজাচ্ছেন সব যন্ত্র। প্রয়োজন হচ্ছে না শব্দ প্রকৌশলীর, সব করে দিচ্ছে সফটওয়্যার। তার পরও- সবই যে কৃত্রিম হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। ভালো কিছু তো হচ্ছেই। ভালো যন্ত্রীরা মঞ্চে উঠছেন তাদের প্রিয় গিটার বা কি-বোর্ড নিয়ে। ঘরে ঘরে এখনো ছেলে-মেয়েরা হারমোনিয়াম বাজিয়ে শিখছে গান। ছোট্ট সোনামণিরা গিটার শিখতে গিয়ে কেটে ফেলছে আঙুল।
এখনো মানাম আহমেদ সারা দিন সুরের খোঁজে পড়ে থাকছেন প্রিয় কি-বোর্ড নিয়ে, প্রতিদিন নিয়ম করে চার ঘণ্টা অনুশীলন করছেন ইব্রাহিম কমল। আর যন্ত্রের আবেদন যে চিরস্থায়ী এটা বোঝাতেই ‘বেজবাবা’ নামে একজন মানুষকে তার বাজানো যন্ত্র দিয়েই ভালোবেসে ফেলছেন অনুরাগীরা।
এ শহরে প্রকাশ্যে গান গাওয়ার জায়গাগুলো যেন বেশ কমে গেছে। আকাশছোঁয়া দালানের প্রকোপে খেলার মাঠের মতোই গানের মঞ্চগুলো যেন উধাও হয়ে যাচ্ছে! ঢাকাতে গাড়ির তীব্র হর্নের মধ্যে গান শোনা তো আসলে অসম্ভবই বটে। শব্দদূষণ বাদেও ওপেন এয়ার কনসার্ট এখন খুব অপ্রতুল। নাগরিক শ্রোতা ও গায়কদের ভেতরে সুষম সংমিশ্রণের জায়গা খুবই অল্প। তবুও তরুণরা বসে নেই, নতুন অনেক গান তারা তৈরি করছে, প্রকাশ করছে এবং বিভিন্ন মঞ্চে পরিবেশনা করে চলেছে। আপনার কাছে বিকল্প সেইসব মঞ্চের খোঁজ আছে তো? সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইন প্লাটফর্মে গান প্রকাশ করার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার ফলে শ্রোতা এবং শিল্পীর সাধারণ মিলন খুব কম ঘটে। এই লেখাতে ঢাকার অন্যরকম কিছু মঞ্চ নিয়ে আমি কথা বলব যেখানে গায়ক এবং শ্রোতার বাস্তব ও ভার্চুয়াল এই উভয় যোগাযোগই হয়ে থাকে।
ঝিড়ঝিড় ক্যাম্পফায়ার সেশন
২০২২ সালের শেষে শীতকাতুরে সন্ধ্যায় যখন ধলেশ্বরী কায়াকিং রিসোর্টে ঢুকে ঝিড়ঝিড় ক্যাম্পফায়ার সেশনের সেটে যাই তখন বেশ নাটকীয় লাগে পরিবেশটা। দুটি তাঁবু টাঙানো এবং দুপাশে দুটি মশাল জ্বলছে! দুই তাঁবুর ঠিক মাঝ বরাবর ফাঁকা জায়গাটিতে একটি গাছের গুঁড়িতে বসে গায়ক গান গাইবে! পাশেই স্রোতস্বিনী ধলেশ্বরী নদী, আকাশ ভর্তি ঝিকিমিকি অজস্র তারা! নদীর ওপর পেতে রাখা মাচাতে অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে তারা দেখলাম। অনেকক্ষণ গুনগুন করে গান গাইলাম! দু-একটা জোনাক পোকা ঢুকে গেল যেন ঠিক আমার মাথার ভেতরে! মশালের দপদপে আগুনের পাশে নড়ছে আমার ছায়া! ঠিক সে সময়ে আমার ডাক এলো! কিবোর্ডে ছিল জাফরি, হারমোনিতে রুদ্র, আর ভারতীয় মুদ্রায় ঘাসের গালিচায় বসে ভায়োলিন বাজাল প্রাঞ্জল! অ্যাকশন শব্দ শুনে চোখ বন্ধ করে গেয়ে উঠলাম ‘চোখ মেলেছি যেই’! ঝিড়ঝিড় ক্যাম্প ফায়ার সেশনে ঠিক এমনটাই ছিল আমার গানের দৃশ্যপট!
প্রতি বছর শীতে ঝিড়ঝিড় আয়োজন করে ক্যাম্পফায়ার সেশন। ঝিড়ঝিড় একটি অডিও ভিজ্যুয়াল প্ল্যাটফর্ম। ঝিড়ঝিড়ের প্রোডিউসার জাফরি আবেদীন নিজেও একজন মিউজিশিয়ান। সহজিয়া ব্যান্ডের বেস গিটারিস্ট হিসেবে সে কাজ করছে অনেকদিন হলো। পাহাড়ি ম্রো শিশুদের শিক্ষার সহায়তায় পাওমুম থারক্লা স্কুলের তহবিল সংগ্রহের জন্য তারা আয়োজন করেছিল ‘পাওমুমের জন্য গান’। সেই কনসার্টেও আমি গান গেয়েছিলাম।
ঝিড়ঝিড়ের প্লাটফর্ম থেকে অচিরেই বের হচ্ছে আমার সালো অ্যালবাম ‘বাতিঘরে রাত জাগা প্যাঁচা’। এই অ্যালবামের প্রথম গান “প্লাস্টিকে ডুবে আছি”। ঝিড়ঝিড় ইউটিউব চ্যানেল : https://www.youtube.com/@ZhirZhir হাতিরপুল সেশনস
২০১৯ সালের একটি শীতের সকালে আমি তুহিন এবং নাঈম মাহমুদ দেখা করলাম হাতিরপুল কাঁচাবাজারের সামনে। তারপর ছয় তালা সিঁড়ি ঠেঙিয়ে উঠে পড়লাম হাতিরপুল সেশনসের আঁতুড় ঘরে। এর ঠিক তিন দিন আগে আমাকে কল দিয়েছিল হাতিরপুল সেশনস-এর কিউরেটর অনিরুদ্ধ অনু। সে জানাল তারা একটি এভি প্লাটফর্ম করেছে যারা মূলত নিজেদের গান নিয়ে কাজ করছে তাদের জন্য, এছাড়াও ভিন্নধর্মী কভারেও তারা আগ্রহী। সবিনয়ে জানতে চাইল আমি গান করব কি না। আমি সানন্দে জানালাম অবশ্যই করব। তখন হাতিরপুল সেশনস-এর প্রথম সিজনের শ্যুট চলছে, ছাদের উন্মুক্ত সেটে টাঙানো তারে ক্লিপ দিয়ে আটকানো, শার্ট, জামা-কাপড়, প্যান্ট, ওড়না, বাচ্চার ছোট ছোট পাজামা, মোজা ইত্যাদি শুকাচ্ছে। ঢাকার যেকোনো ছাদের রঙিন বাস্তবতার সাধারণ চিত্র এটি। পরিবেশন আর ঢংটি খুবই ভালো লেগে গেল, কেননা নাটক সিনেমা কিংবা হাল আমলের সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্টে যেরকম অতি নাটকীয় জিনিসপত্র দেখি সেরকম কোনো কিছুই এরা রাখেনি। বরং বাস্তবতাকে রঙিন করেছে হাতির পুলের সচেতন নির্দেশনা। একটি জুম রেকর্ডারের সামনে গেয়ে ফেললাম গান, পেছনে অনেক বিল্ডিং-এর ব্যাক ড্রপ নিয়ে এবং একটা বিশাল আকাশ মাথার ওপর রেখে হাতিরপুল সেশনসের প্রথম সিজনে গেয়েছিলাম চিত্রকর গানটি।
২০২২ এর দ্বিতীয় সিজনের পরিবেশনায় একটু ভিন্নতা এনেছে হাতিরপুল সেশরস। এবার একটা ঘরের ভেতরে সেট। রঙতুলির ব্যবহার করে ছাদের হলুদ-কমলা রোদটাকে ওরা ঘরে নিয়ে এলো। এবার তারা হাউজব্যান্ড স্টাইলে কাজ করছে। আর লাইভ রেকর্ডিং সিস্টেমেও এসেছে অভিনবত্ব এবং পেশাদারিত্ব। জুমের বদলে এবার সাউন্ড কার্ড, ল্যাপটপে উঅড এবং সিনেমাটোগ্রাফিতে দুটি ক্যামেরা। এই কাজে ওদের কোনো স্পন্সর ছিল না। নিজস্ব অর্থায়নে সম্পূর্ণ অলাভজনকভাবেই হাতিরপুল সেশন্স এখনো কাজ করে যাচ্ছে।
যাইহোক। হাতিরপুল সেশনসে এবার হোমব্যান্ড পাওয়ার ফলে আমার সঙ্গে যুক্ত হলো বেস গিটারে অমিত হাসান রুদ্র, লিড গিটারে অনিরুদ্ধ অনু, ড্রামসে হাসিন আরিয়ান ও স্যাক্সোফোনে রাহিন হায়দার। তিন চার দিন প্র্যাকটিস করে শুভ একটা ক্ষণ বেছে আমার গান ‘ বিষাদের পরমাণু’ শ্যুট হয়ে গেল। আর সেটি প্রকাশ পেল ডিসেম্বর ২০২২-এর মাঝামাঝি।
হাতিরপুল সেশনসের গানগুলো রিলিজ হয় তাদের ইউটিউব চ্যানেলে। হাতিরপুল সেশনস হাউজব্যান্ড তাদের প্রকাশিত গানগুলো লাইভেও পারফর্ম করে থাকে।
হাতিরপুল সেশনস ইউটিউব : https://www.youtube.com/@HatirpoolSessions যাত্রা বিরতি
মানুষ যাত্রাপথে একটু জিরোয়, একসঙ্গে এক কাপ চা খেতে খেতে জেনে নেয় সহযাত্রীর যাত্রাহেতু। যদি আড্ডা জমে যায় তাহলে আরও এক কাপ চা কিংবা কফির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও বেশ কিছু খাবারের পদ। সহযাত্রীদের নানান ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এবং দার্শনিক আলোচনায় প্রশমিত হয়ে যাত্রীদের ভ্রমণ অবসাদ, ক্লান্তিতে আনে আবেগের রঙিন ছোঁয়া। আর সেই যাত্রা বিরতিতে যদি গায়ক গেয়ে ওঠে গান তাহলে তো কথাই নেই!! তাই না? ঢাকার প্রচ- ব্যস্ত এই নাগরিক জীবনে আমাদের যেন যাত্রা বিরতির সুযোগ নেই কোনো! আর সেই যাত্রা বিরতির একটি সাংগীতিক সুযোগ পাবেন যাত্রা বিরতির মিউজিক লাউঞ্জে।
বহু বছর আগে বনানীর দেশীয় ফ্যাশন হাউজ যাত্রার ছাদে মিউজিক লাউঞ্জ যাত্রা বিরতির যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে যাত্রার ছাদেই গানের আয়োজন ছিল। তবে বিগত বেশ কয়েক বছর হলো চার তলাতে এখন গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। বহুদিন ধরেই ঢাকাতে অন্যরকম গান শোনার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সবার কাছে জনপ্রিয় এই যাত্রা বিরতির মিউজিক লাউঞ্জটি। মঞ্চে নকশিকাঁথার ব্যাকড্রপে ও আধো আলোর রহস্যময় পরিবেশে গায়কের প্রাণবন্ত গানে গানে নাগরিকদের অত্যন্ত প্রিয় একটি জায়গা এই যাত্রা বিরতি। ছাদে তাদের আছে নিরামিষ প্রধান নানান পদের খাবারের একটি রেস্টুরেন্ট।
গত ৩০ দিনের ভেতরেই যাত্রা বিরতিতে আমি তিনবার গান করলাম তিনটা ভিন্ন অনুষ্ঠানে। ‘মাঘের গান’ ‘স্বায়ত্ত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ এবং ‘বসন্তের গান’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে আমি ছাড়াও ছিলেন আরও অনেকে। মাঘের গানে ছিল ব্যান্ড কাকতাল, সানি অ্যান্ড দ্য রেভলিউশনস, শুভ সুলতান, নাঈম মাহমুদ এবং আকাশ গায়েন। আর স্বায়ত্ত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস কলকাতার একটি স্বনামধন্য ব্যান্ড। বেমানান ব্যান্ডের গুণী শিল্পী ও গায়ক স্বায়ত্ত মল্লিকের আরেকটি ব্যান্ড প্রজেক্ট এটি। গিটারে জুবিন ও ইলেকট্রিক গিটারে উৎসব গুহ ঠাকুরতা ও ভোকালে স্বায়ত্ত এই লাইন আপে স্বায়ত্ত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস পারফর্ম করেছিল যাত্রা বিরতিতে। সেদিন যৌথভাবে আরও গান করেন চেতনা রহমান ভাষা, আসির আরমান ও আমি।
আর বসন্তের গানে গান করেছিল কাকতা সানি অ্যান্ড দ্য রেভলিউশনস, আসির আরমান এবং আমি মুয়ীয মাহফুজ। ‘বসন্তের গান’ ছিল আবেশী গানের আসরের দ্বিতীয় পর্ব। বাংলাদেশের বর্তমান সময়কার নিজের গান নিয়ে এগিয়ে চলা কিছু গায়কদের একটি পরিবেশনার সিরিজ হলো এই আবেশী গানের আসর। আবেশী গান হলো সেই গান যা আপনাকে ভাবাবে, আপনি গায়কের আবেগের সঙ্গে একাত্ম হবেন এবং তার আবেশ রয়ে যাবে আরও অনেক দিন। আবেশী গানের আসরের প্রথম আয়োজন হয়েছিল বারবিকিউ স্কাইলাইন-এর রুফটপে। প্রথমবারে গান করেছিল দ্যা রেহমান ডুও, ব্যান্ড কাকতাল, সানি অ্যান্ড দ্য রেভলিউশনস এবং আমি।
আমার কৈশোর ছিল সাইকাডেলিক রক আর হেভি মেটাল মিউজিকের আবহে নিমজ্জিত। আশির দশকে সামরিক জান্তা আর স্বৈরশাসকের নিপীড়ন আর নিষ্পেষণকালের দোহাই দেব না। কিন্তু রাষ্ট্রকে যদি একটা এস্টাবলিশমেন্ট ধরি তাহলে তার সব রুচিগত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিজের পছন্দ-অপছন্দকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আকাক্সক্ষা তো ছিলই। সেই সময়টা পুরোপুরি প্রতিবাদী মানসিকতার কাছে সমর্পিত ছিল। যার প্রভাব আমরা দেখতে পাই আশির দশকজুড়ে। তবে গ্লোবাল স্পেকট্রামে যেসব সাংস্কৃতিক উপাদান বা এক্সপ্রেশন জনপ্রিয় হয় তার ঢেউ বাংলাদেশ অথবা আরও বিস্তৃত করে বললে ভারতীয় উপমহাদেশের তটে আছড়ে পড়ে এক দশক পরে। পশ্চিমে তখন সাইকাডেলিক রক, অলটারনেটিভ রক কিংবা হেভি মেটাল সংগীতের ধারা জনপ্রিয়তার অংশীদার হয়ে গেছে। মূলধারাকে প্রশ্ন করতে অন্য একটা সাংগীতিক এক্সপ্রেশন তখন প্রতিবাদের স্রোত তৈরির রসদ জোগাচ্ছে। মার্কিন মুলুকে থাকা আফ্রো আমেরিকান জনগোষ্ঠীর তরুণরা এক অন্যরকম জীবনধারণের কথা বলতে শুরু করেছে বর্ণবাদ আর সাদার সুপ্রিমেসিকে নাকচের মধ্য দিয়ে। তাকে বেশির ভাগ ক্রিটিকরা হিপহপ সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করতে শুরু করে। এই সংস্কৃতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল সংস্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে জীবনকে উপভোগ।
বাংলাদেশের মানুষ তখন হিপহপ শুনত না এমন নয়। তখনো হিপ হপ সংস্কৃতি সেই অর্থে দ্যোতনা তৈরি করেনি। এমসি হ্যামার কিংবা ডিজে কুলদের বিটনির্ভর উপস্থাপন শুনতাম। কিন্তু ওইভাবে আকৃষ্ট হয়ে শোনা শুরু হয়নি। আর সংস্কৃতিগত ধারণা থেকেই ওই ঘরানার হিপহপকে ঠিক নিজের মনে হতো না।
হিপহপ সংস্কৃতির বেড়ে ওঠা ডায়াসপোরা আর তার ডিস্টোপিয়ান আগ্রহ থেকে। অভিবাসনের মধ্য দিয়ে যে নিঃসঙ্গ তৈরি হয় তার প্রকাশ ঘটে বিমূর্তকরণে; সামাজিক রুচিবোধকে মেনে না নেওয়ার সে এক তীব্র বহিঃপ্রকাশ। বিংশ শতকের প্রায় শেষভাগে পশ্চিমে আফ্রো আমেরিকান বা আফ্রো ব্রিটিশদের মতো, ইন্দো আমেরিকান অথবা ইন্দো ইউরোপিয়ান তরুণরাও হিপহপ করতে শুরু করে আর জনপ্রিয়তার হাতছানি দেখতে পায়। তাদের একজনের নাম না বললেই নয় সেই অ্যাপাচে ইন্ডিয়ান পশ্চিমা ঘরানার র্যাপ কিংবা হিপহপের সঙ্গে পাঞ্জাবি ইন্ডিয়ান মিউজিকের ফিউশন করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর প্রভাবে কয়েক বছর পর আশরাফ বাবু, পার্থ বড়ুয়া আর আজম বাবু এই তিনজন একটা অ্যালবাম রেকর্ড করে। ত্রিরত্নের খ্যাপা নামের সেই অ্যালবাম শহুরে তরুণদের একটা সুনির্দিষ্ট অংশের মধ্যে ভালোই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাদের গানের মূল বিষয় ছিল পুরনোকে অস্বীকার আর ব্যবচ্ছেদ করে তার অপ্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। কিন্তু এই হিপহপ অ্যালবাম কোনো আন্দোলনের অংশ ছিল না। তিন তরুণ সংগ্রামী ব্যান্ড মিউজিশিয়ান ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইংলিশ অ্যাপাচি ইন্ডিয়ানকে অনুসরণ করে দেখতে চেয়েছিলেন হয়তো। যদি ক্যাসেটের বিক্রিবাট্টা ভালো হতো তাহলে আবার কিছু করা যাবে। কিন্তু তাদের সেই আশার গুড়ে বালি দিয়ে প্রজেক্ট সেখানেই সমাপ্ত হয়।
নব্বইয়ের দশকে মার্কিনি সামাজিক সাংস্কৃতিক কারণেই হিপহপ কিংবা জঅচ সব বর্ণের তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করতে শুরু করে। শুধু আফ্রো আমেরিকান নয় নেটিভ আমেরিকানরাও রাইমিং শুরু করে ভালোভাবেই। এখানে বলে নেওয়া ভালো, জঅচ কোনো শব্দ নয়, এর মূল অর্থ জযুসব ধহফ চড়বঃৎু। ছন্দোবদ্ধ করে কবিতা আবৃত্তির মতো করে গান গাওয়া। এই সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বিনোদনদাতারা। শুরুর সময়টায় হিপহপাররা দর্শকদের সঙ্গে কথা বলে বিট তৈরি করে যোগাযোগ করত। তারা মূলত অনুষ্ঠান পরিচালকের ভূমিকা নিত। এ কারণে অনেক জঅচচঊজ। তাদের নামের আগে ইংরেজি বর্ণ এমসি ব্যবহার করত। বাংলাদেশেও শহুরে তরুণদের একটা গ্রুপ নিজেদের ভেতর জঅচ চর্চা করত, আর তারা নিজেদের নাম পাল্টে এমসি অমুক, এমসি তমুক নামে পরিচিত হতে শুরু করল।
পশ্চিমা যেকোনো বিষয়ের চর্চা যেভাবে বাংলাদেশে শুরু হয় এই ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। রাষ্ট্রের উচ্চবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত শহুরে শিক্ষিত তরুণরাই পুরোধা হলো। তাদের অনুপ্রেরণায় কিছু শহুরে মধ্যবিত্তরাও যুক্ত হলো। পশ্চিমে যেমন বিকল্পধারা হিসেবে যেকোনো সাংস্কৃতিক এক্সপ্রেশন শুরু হয়েছে প্রতিবাদী বা পাল্টানোর মানসিকতা নিয়ে; অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে বসা মানুষ অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য চিৎকার করেছে অথবা ছন্দ তৈরি করেছে। বাংলাদেশে অস্তিত্বওয়ালারাই বরং তাদের ঘোষণা আরও পোক্ত করে এসব নতুন ঘরানাকে অভিযোজন করে। বাংলাদেশি এমসিরা মূলত ঘরে বসে ছন্দ তৈরি করা তরুণ হলেও শুরুতে তারা পাশ্চাত্যের মতো এলাকার দখলের ঘোষণা দিয়ে গালাগাল-সমৃদ্ধ কিছু একটা করত। বেশির ভাগ ইংরেজি মাধ্যমে পড়া আরাম-আয়েশে জীবন কাটানো তরুণদের কণ্ঠে এসব গালাগাল খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি প্রথম দশকের শেষ আর দ্বিতীয় দশকের শুরুতে। কিন্তু সরকারি কলোনিতে বড় হওয়া একদল ছেলে নিজেদের আপটাউন লোকালজ বলে যখন জঅচ করতে শুরু করল, তারা সীমিত পরিসরে হিপহপ চর্চারত ধনিক শ্রেণির জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হলো।
বাংলাদেশে হিপহপের পুরোধারা নিজেদের পরিচয় দিত দেশি এমসি হিসেবে। আপটাউন লোকালজদের নাম ছিল বর্ণময় আবার খানিকটা ডার্ক। তবে এর মধ্য দিয়েই হিপহপ সংস্কৃতির বাংলাদেশ চ্যাপ্টার পূর্ণতা পেল। যদিও উপস্থাপন কিংবা সুরে পশ্চিমের অনুবাদ করত উভয় পক্ষই। নিজস্বতা বলে কিছু ছিল না হিপহপারদের। অন্য রক কিংবা মেটাল মিউজিকের মতোই, অনুকরণপ্রিয় হিসেবেই বাংলাদেশি হিপহপারদের উত্থান।
কিন্তু কেউ কেউ যেন অন্যরকম ভাবে। তাউরা সাফা নাম নিয়ে পরিচিত হওয়া এক জঅচচঊজ তেমনি একজন। পুরান ঢাকায় একেবারে স্ট্রিট কালচারে বড় হওয়া সাফা তার অস্তিত্ব জানান দিল দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝিতে। হিপহপাররা জেগে উঠল। দেশের বিভিন্ন কোণে জঅচ করতে শুরু করল তরুণরা। এ সময়টায় সিলেট, ফরিদপুর, কুমিল্লা এমনকি কক্সবাজারেও নতুন হিপহপাররা তাদের জঅচ ইউটিউবে প্রকাশ করতে শুরু করল। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করে তারা যেন নিজেদের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে ব্যস্ত হলো।
আমি আগে জঅচ বা হিপহপকে মিউজিকের ঘরানা হিসেবে গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু জালালি সেট বলে একটা প্রজেক্টের গান শুনে থমকে গিয়েছিলাম ২০১৬-এর গোড়ার দিকে। এই প্রজেক্টের নেতৃত্ব অথবা মূল প্রণেতা ছিল সেই শুরুর জমানার একজন, যে নিজেকে এমসি মাগজ বলে পরিচয় দিত। উচ্চবিত্ত পরিবারের ইংরেজি মাধ্যমে পড়া এই এমসি সমাজের নানা স্তরের আরও চারজন হিপহপারের সঙ্গে মিলে বেশ কিছু ট্র্যাক তৈরি করল। এবার যেহেতু জঅচ-এর একটা ভূমি তৈরি ছিল তাই গালাগাল নিয়ে সমস্যা হলো না। কিন্তু তারা নাড়া দিল সমাজের প্রচলিত নানা সংস্কার নিয়ে। দলবাজি না করেও কেমন রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করা যায় এস্টাবলিশমেন্টকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তার নমুনা হিসেবে একেকটা ট্র্যাক যেন নিজের সঙ্গে পাল্লা দিল।
পরে যারা হিপহপ সংস্কৃতি অথবা জঅচ তৈরির চেষ্টা করছে তাদের অনেকে এই সংস্কৃতিকে জড়িয়ে নিয়েছে নিজেদের জীবনবোধে। আবার অনেকে এটাকে শুধু একটা এক্সপ্রেশন হিসেবে দেখেছে। তবে একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, বাংলাদেশের জঅচচঊজরা এখন শুধু প্রতিবাদ কিংবা পরিবর্তনের কথাই বলে না, তাদের ছন্দোবদ্ধতায় কবিতা তৈরি হয়। তাদের শরীরী ভঙ্গিতেও দেশি ভাব দেখা যায়। দেশি পুঁথিপাঠ কিংবা কবির লড়াইয়ের ধরনে তারা ব্যাটল রাইম করে। সম্ভবত দেশের অনেক হিপহপারই নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে নিজস্ব ধরন তৈরি করেছে। পশ্চিমের অনুকরণ না করে, অনুগত না থেকে কীভাবে একটা সাংস্কৃতিক এক্সপ্রেশনকে নিজেদের করে নেওয়া যায় তার নিদর্শন হিসেবে আপনারা বাংলাদেশি হিপহপার কিংবা জঅচচঊজদের কথা বলতে পারেন নিঃসংশয়ে।
একুশ শতকের প্রথম দশকেই নতুন স্বাদের যে গান বাংলাভাষীদের চাঙ্গা করেছে তা হলো বাংলা র্যাপ। নিউ ইয়র্ক বেজড স্টোয়িক ব্লিসের ‘আবার জিগায়’ নামের হিপহপ ঘরানার গানটি রিলিজের সঙ্গে সঙ্গেই শ্রোতাদের প্লে-লিস্টে উঠে আসে; তবে প্রচুর ইংরেজি শব্দের ব্যবহারের কারণে একে পুরোপুরি বাংলা র্যাপ বলা যাবে না। একই ধারাবাহিকতায় ‘দেশি এমসি’জ’ ‘ব্যানড’ নামের অ্যালবাম রিলিজ করে তাতেও বাংলা র্যাপের ভিত্তি পাকাপোক্ত করার মতো ট্র্যাক ছিল না। তবে এরা বাংলা হিপহপে তাদের জায়গা তৈরি করে নেয়।
ডেডলাইন এন্টারটেইনমেন্ট লেভেল ‘টিওআর’-এর ‘বাংলা হিপহপ জাতি’ এবং ‘আপটাউন লোকলজ’ এর ‘কাহিনি সিনপাট’ নামের দুটি এলবাম রিলিজ করে পরপর। টিওআর-এর অ্যালবামে বাংলা র্যাপের শক্তির জায়গাগুলো পরিষ্কার হয় আর আপটাউন লোকলজ বলা যায় বাংলা র্যাপের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। কাহিনি সিনপাট বাংলা হিপহপে বাংলা র্যাপের একটা পূর্ণাঙ্গ অ্যালবাম। জেসপার আল রাশিদের জাদুকরী মিক্সিং আর মাস্টারিং-এ দুটি অ্যালবাম শ্রোতাদের কানের রুচির স্বাদ মিটিয়েছে।
যদিও মেইনস্ট্রিমে আসার আগে আপটাউন লোকলজ’র সদস্য ব্ল্যাক জ্যাং, তাউড়া সাফাদের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্র্যাক ছিল কিছু। যার মধ্যে ‘ঠোলার পোলা’ নামের একটা গানের জন্য তাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেডকোয়ার্টারেও জবাবদিহি করতে হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। গানগুলো মেমোরি কার্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল, আর ২০০৯-এ অ্যালবাম রিলিজ হলে গান বাজত এফএমে।
কাহিনি সিনপাট অনন্য এর বাংলা ভাষা ব্যবহার আর লোকাল লোকজনের মুখের ভাষা তুলে আনায়। পুরান ঢাকার টোন আর একই সঙ্গে খেটে খাওয়া মানুষের কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার আলাদা উত্তেজনা তৈরি করে। এলিফ্যান্ট রোডের জুতার দোকানিদের নিজেদের মধ্যকার কোড ল্যাঙ্গুয়েজ আছে কিছু; ওখানে বেশ দামাদামি করে জুতা কিনতে হয়, এখানে কখনো ক্রেতা জিতে কখনো বিক্রেতা। হুট করে ‘উস্সাই’ বলে উঠে কোনো কোনো বিক্রেতা, এতে তার সহকর্মী বুঝতে পারে, লাভ হয়েছে বিক্রিতে। এমন আরও কিছু শব্দ কাহিনি সিনপাটে লক্ষ করার মতো। এছাড়াও অ্যালবামের প্রথম থেকে শেষ বেশ একটা হিপহপ জার্নির মতো। গানগুলোর বিষয়বস্তুতে যেমন পার্টি মুড আছে একই সঙ্গে দেশপ্রেম, সমাজ ও প্রতিবাদী চিন্তার প্রতিফলনও ঘটেছে। হিসাবের কথা, সিভিল সমাজ ও পিস্তলের জীবন গানগুলোতে তৎকালীন সময়ের একটা রূপও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তবে এই অ্যালবামের সবচেয়ে জনপ্রিয় হয় ‘এই মামা এই’ গানটি। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এই গানগুলোর প্রভাব থেকে এখনো বের হতে পারেনি বাংলা র্যাপাররা, এতটাই সমৃদ্ধ এই অ্যালবামটি।
আপটাউন লোকলজ ভেঙে যাওয়ার পর সাফা দেশি এমসিজ’র মাগজ’র সঙ্গে নতুন করে দল গোছায়। জালালি নামে দলটির আত্মপ্রকাশের আগেই ‘এলাকা’ নামের একটি ট্র্যাকও প্রকাশ করে ইউটিউবে। পরে সাফার অংশ বাদ দিয়ে আবার একই ট্র্যাক রেকর্ড করে জালালি সেট নামের হিপহপ দলটি। বেশ কিছু গান আনে তারা ইউটিউবে। এর মধ্যেই জালালি সেট সদস্য শাফায়েত মমতাজের সঙ্গে ‘লোকাল বাসের’ মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পায় তবে দল হিসেবে শ্রোতাদের নতুন কিছু দিতে ব্যর্থ হয় তারা। অন্যদিকে ‘ভব’ নামে হিপহপ ক্ল্যান তৈরি করে বেশ কিছু ট্র্যাক রিলিজ করে তাউড়া সাফা। হিপহপ তৎপরতা লক্ষ করা যায় বিভিন্ন অঞ্চলেও; নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, টাঙ্গাইল, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ বেশ কিছু অঞ্চলে সেখানকার আঞ্চলিক ভাষাতেও র্যাপ করা শুরু করে র্যাপাররা। উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছে আপটাউন লোকোলজের ব্ল্যাক জ্যাং, সে বেশ কিছুদিন পরপরই নিজের ট্র্যাক রিলিজ করছে একই সঙ্গে হিপহপের নানা রকম মুভমেন্টের সঙ্গেও জড়িত।
ইংরেজি র্যাপ থেকে সরে এসে হালে বাংলা র্যাপের স্বকীয়তার জায়গা হলো ফোক গানের সঙ্গে ফিউশন ও বাংলার নিজেদের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে বাংলার ভাব ও আঞ্চলিকতা।
বিজ্ঞাপনগুলোতে হিপহপ ড্যান্স ও বাংলা র্যাপের ব্যবহার হচ্ছে প্রচুর। বিটের তালে র্যাপ গানে পণ্যের গুণগান করাটা অভিনব এবং আকর্ষণীয় বটে। তবে পূর্ণাঙ্গ বাংলা র্যাপের যাত্রাটা যেভাবে ধানম-ির ফুটপাত থেকে শুরু হয়েছিল, ভাইরাল ভাইরাস বা বিজ্ঞাপনী সংস্থার হাতে এ গান বেশিদিন থাকবে না। বাংলা র্যাপ হতে যাচ্ছে মুখবন্ধ রাখতে বাধ্য মানুষদের মুখোশ পরে ‘কথা বলার’ মাধ্যম। কথা নিষিদ্ধ জগতে সিধাসাদা কথা বলার জন্য বিটের তাল হলে রাস্তাপ্রিয় লোকদের আর কী চাই!
The culture of all oppressed is the culture of resistance... Thus all artists coming from an oppressed people must represent resistance in their art form.
-Kwame Ture
ঊনসত্তর-একাত্তর হয়ে বাহাত্তরেও যে জঙ্গম বাস্তবতার আঘাত ও ক্ষত দেশের শরীরে দপদপ করছিল, তাকে কোনো সুকুমার ভাষায় প্রকাশ করা কি যেত? সে সময়ের তরুণের মন চিৎকার করছে হাহাকারে, ফেটে পড়ছে বিদ্রোহে, তাদের দরকার ছিল খোলা গলার চিৎকারের ভাষা। ‘হায় আমার বাংলাদেশ’ বলে আজম খান সেটাই দিলেন। আর তাতেই বদলে গেল বাংলা গানের ইতিহাস। তার গান অসন্তোষের তারে বাঁধা হলেও তার তলায় ঠিকই শোনা যায় ভালোবাসার অফুরান কুলকুল জলধারা।
তারপর এক দিন বুকের ভেতর একটা ধস। আজম খান আর নেই। এই ‘নেই’ কি নতুন? অনেক দিনই তিনি তো ছিলেন না বললেই চলে। রোগশয্যায় কোমায় চলে যাওয়ারও আগে, বহুদিন ধরে গানের বাজারের বাজারিরা তো তাকে একরকম ‘কোমা’র মধ্যেই রেখেছিল। তিনি গান বাঁধতেন, কিন্তু কেউ সেধে প্রকাশের গরজ দেখাত না। তিনি সেই বুক তোলপাড় করা আজম খানই ছিলেন, তবু টিভি বা কনসার্টে গাওয়ার ডাক কমে গিয়েছিল। রক্তমাংসের মানুষটি মরে যাওয়ার আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল তার সাংস্কৃতিক মৃত্যুর পরিবেশ। তার দিন সত্যিই ফুরিয়ে আসছিল।
সময় বদলে যাচ্ছিল, মন বদলে যাচ্ছিল, রাজধানী-শহর-মফস্বল সব বদলে যাচ্ছিল। বদলে যাচ্ছিল পপগানের জনপ্রিয়তার ব্যাকরণ। এ যুগ ডিজিটাল, এ মন লিকুইড, এর চাওয়া পিচ্ছিল, এর প্রেম অস্থির। সত্তর বা আশির দশকের সেই রোখা মন, চোখা গায়কি, বুনো আবেগের ভাষায় আর সাড়া দেয় না আজকের তরুণ। তাদের মনের পর্দায় এখন অন্য ছায়া, অন্য ছবি, অন্য সুর। কানে আইপড লাগানো রঙ করা চুলের বাহারি তরুণী কিংবা কোমরঢিলা জিন্স আর ব্র্যান্ডে ব্র্যান্ডে ব্র্যান্ডেড তরুণ মনে আজম খান কতটা সাড়া তুলবেন আর? তিনি তো আর লিকুইড মডার্নিটির তারুণ্যের ভাবভঙ্গি বোঝেন না। তার দিন ছিল সত্তর দশকের অশান্ত ও প্রতিবাদী চৈতন্যে গড়া। দেশায়ত আধুনিকতার সেই যুগে শহুরে তারুণ্য একধরনের প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাবকালচার গড়ে নিয়েছিল। তখনো নাগরিকতার ঠাটবাট থেকে তারা দূরে ছিল, দূরে ছিল পণ্যাসক্ত ভোগবাদিতা থেকেও। সেই দিন, সেই মন যত ফুরাচ্ছিল, ততই তার দিনও বুঝিবা ফুরিয়ে যাচ্ছিল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী উত্তাল সময়ে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া তারুণ্য অশান্ত ও হতাশ হয়ে উঠেছিল। আজম খানের গান তখন তাদের ভাষা দিচ্ছিল, জাগিয়ে রাখছিল। তিনিই ঢাকার তরুণদের চিৎকার করে মনের কথা বলার ভাষা ও ভঙ্গি দিয়েছিলেন। তার পুরুষালি গলা ও ঢং তাকে পুরুষ-তারুণ্যের জননায়ক করে তুলেছিল। সনাতন বাংলা গানের পুতুপুতু সুরেলা আমেজ ভেঙেচুরে শিরায় শিরায় রাগী ছন্দের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বাবা তাকে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে যাচ্ছিস যা, দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না।’ তিনি কথা রেখেছিলেন। গেরিলা যোদ্ধার বেশ আর ছাড়েননি, কেবল রাইফেল-গ্রেনেড ফেলে গিটার তুলে নিয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন আহত কিন্তু প্রতিবাদী বাংলাদেশের তরুণদের প্রতীক। সত্যিই সেই দিন কি আর নেই, সেই তরুণেরাও কি হারিয়ে গেছে? তারা আছে নিশ্চয়, কিন্তু তাদের মনের পিপাসা মেটাবার দায়িত্ব গানের বাজারিরা আর নিচ্ছেন না। কালচার ইন্ডাস্ট্রি এখন ফাঁকা আবেগ আর মোহরতিবাসনার প্রজননক্ষেত্র হয়ে তারুণ্যের দাহিকাশক্তি নিঃশেষ করে ফেলছে। এসব দেখেই দেখেই আজম খানের মনে সংশয় জেগেছিল, ‘আমার গান একসময় মানুষকে জাগাইছে হয়তো, তখন ছিল যুদ্ধের পরবর্তী সময়, মানুষের মধ্যে দরকার ছিল যুদ্ধের চেতনা। এখনকার তরুণদের কাছে আমার গান কী সেটা বুঝলে বুঝবেন আমি আসলে কী করছি। ...আমার গান এখনকার অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের অন্তরকে জাগায় কি না।’
তার স্মরণে অনেক অনুষ্ঠান হলো টিভি চ্যানেলগুলোতে। একটিতে তিনি শিল্পী আসিফের উপস্থাপনায় দুর্বল শরীরে আসিফের কাঁধে ভর দিয়ে গান গাইছিলেন। শেষ গান হিসেবে গাইলেনÑ ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে!’ গাইতে গাইতে এক্কেবারে হৃদয়ের তন্ত্রীতে বাড়ি মেরে যতবার হায় বলছিলেন, মনে হচ্ছিল সেটা তার কলিজাচেরা হাহাকার।
আধুনিক বাংলা গানের রয়েছে অমৃত ভান্ডার। বিশেষ করে, বাংলাদেশে যেসব সুরবোদ্ধা আধুনিক বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করে গেছেন, সেইসব সংগীত ব্যক্তিত্ব জ্বলজ্বল করছেন সুরের আকাশে। বর্তমানেও সেই গানের, জনপ্রিয়তা কমেনি। সেইসব গান শোনামাত্র, আমরা স্মৃতিকাতর হই। খুঁজে বেড়াই, হারানো ভালোবাসা। অথবা উদ্বুদ্ধ হই, গভীর দেশপ্রেমে। সেইসব গান আমাদের ভেতর জাগিয়ে তোলে দ্রোহ, যন্ত্রণা, ভালোবাসার কাতরতা। কখনো আবার স্বপ্ন দেখায়, নতুন জীবনের।
একটি গীতিকবিতা প্রাণ পায়, সুরে। সুরকারের জাদুস্পর্শে তা ধ্বনিত হয়, শিল্পীর কণ্ঠে। হারানো দিনের সেই সব গানের উল্লেখযোগ্য সুরকার নিয়েই এই লেখা। সেইসব গানের অধিকাংশই, স্থান পেয়েছে চলচ্চিত্রে।
সুরকার আলতাফ মাহমুদ একুশের প্রভাত ফেরির গান আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো/একুশে ফেব্রুয়ারি গানে সুরারোপ করে অমর হয়ে থাকবেন।
সুরকার সুবল দাস। ১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানী পরিচালিত আকাশ আর মাটি’ চলচ্চিত্রে প্রথম সংগীত পরিচালনা করেন। এরপর অসংখ্য চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন, সংগীত পরিচালক হিসেবে। জন্ম নিয়েছে, শত শত জনপ্রিয় গান। ঢাকাই চলচ্চিত্র দর্পচূর্ণ ছবিতে তুমি যে আমার কবিতা/ আমারও বাঁশীর রাগিণী/ আমারও স্বপন আধো জাগরণ/ চিরদিন তোমারে চিনি, ‘আলো তুমি আলেয়া’ চলচ্চিত্রে আমি সাতসাগর পাড়ি দিয়ে, যোগ-বিয়োগ চলচ্চিত্রে এই পৃথিবীর পান্থশালায় গানগুলো মনের গভীরে স্থায়ী আসন করে নেয়।
এরপরই আমরা পেয়ে যাই, সুরকার সত্য সাহাকে। যিনি অসংখ্য চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে সুতরাং, নীল আকাশের নীচে, অশিক্ষিত, আবির্ভাব, ছুটির ঘণ্টা, অমর প্রেম, আগুনের পরশমণি, দীপু নাম্বার টু ছবি উল্লেখযোগ্য। এসব চলচ্চিত্রের অনেক গান সমাদৃত হয়েছে মানুষের কাছে।
১৯৬০-এর দশকে দেবু ভট্টাচার্য পাকিস্তানের কণ্ঠশিল্পী গজল সম্রাট মেহেদী হাসান, সুরাইয়া মুলতানীকর ও আহমদ রুশদী এবং বাঙালি সংগীতশিল্পীদের মধ্যে বশির আহমেদ, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, ফেরদৌসী রহমান, রুনা লায়লা প্রমুখের মাধ্যমে উপমহাদেশে বাংলা সংগীত ও সংস্কৃতিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
খন্দকার নুরুল আলম স্বনামধন্য সংগীত পরিচালক ও সুরকার। তার সুর করা চোখ যে মনের কথা বলে, আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে, এতো সুখ সইবো কেমন করে, তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে ইত্যাদি জনপ্রিয় গানের কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও সমাদৃত। তার চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা শুরু হয় উর্দু চলচ্চিত্র দিয়ে। প্রথম সুরকৃত চলচ্চিত্র ইস ধরতি পার। বাংলা চলচ্চিত্রে সুর ও সংগীত পরিচালনা শুরু করেন ১৯৬৮ সালে, অন্তরঙ্গ ও যে আগুনে পুড়ি দিয়ে।
১৯৭০ সালে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানে সুরারোপ করে, আনোয়ার পারভেজ বাঙালির হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেড়ে নেন। ১৯৭০ সালেই খান আতাউর রহমান (খান আতা) ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির বিভিন্ন গানে সুরারোপ করে, সংগীত বোদ্ধাদের নজর কাড়েন। এই ছবির ‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে’ গানটির কণ্ঠশিল্পীও তিনিই ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সমর দাস, মুজিবনগর থেকে পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ও প্রধান পরিচালক ছিলেন। এ সময় বহু গানে তিনি সুর দেন। তার সুর করা গান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও দেশবাসীকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। মুক্তিযুদ্ধে তার সুর করা ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’ প্রভৃতি গান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে।
এরপর আমরা পাই, সুরকার প্রণব ঘোষ ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। তারা চলচ্চিত্রে তেমন সক্রিয়ভাবে যুক্ত না থাকলেও, বাংলাদেশের অডিও শিল্পে স্থায়ী আসন করে নেন। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরারোপিত ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না/ আমি গাইবো’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ টেলিভিশনে ৮টা ও ১০টার সংবাদের আগে এই গানের মিউজিক মানুষের হৃদয়ে সৃষ্টি করে অন্যরকম দ্যোতনা।
নবীন সুরকার: শওকত আলী ইমন, বাপ্পা মজুমদার, প্রিন্স মাহমুদ, রাজেশের সুরে বেশকিছু গান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হারিয়ে যাওয়া সুরকার-সংগীত পরিচালকের উত্তরসূরি হিসেবে, একদিন এইসব গুণী সুরকারও ঠাঁই নেবেন ইতিহাসের পাতায়।
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।