
তবলায় কী বাজে? তাল বাজে। শুনলে আপনা-আপনি মাথা দুলে ওঠে। তাই তো? কিন্তু ‘সোলো’ বা একক বাদনে তবলাশিল্পী যে গান ফুটিয়ে তোলেন তবলার মৃত চামড়ার গায়ে শ্রোতা হিসেবে সেই গানটিকে, লয়-তালের গ্রাফ্ কাগজে আঁকা, সম্ থেকে সমে আবর্তিত, সূক্ষ্ম এক সাংগীতিক আনুভূতিক তরঙ্গের মতো করে দেখতে চাইলে অর্থাৎ, তবলার রস পুরোপুরি আস্বাদ করতে চাইলে, শুধু মাথা দোলালে হয় না আরও কিছু বিষয়ে একটু ধারণা থাকতে হয়।
ভাষা
‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েনে’ আমরা সবাই তবলার ভাষার নমুনা দেখেছি ‘তাগ্-ধিন্ ধিনা ধিন্তা আর নাইকো মোদের চিন্তা’। পাখোয়াজ থেকে পাওয়া তবলার এই ভাষা অতি প্রাচীন। তার ভেতর বর্ণমালা আছে। যেই বর্ণ দিয়ে তবলার ‘শব্দ’ রচিত হয়। শব্দ দিয়ে হয় ‘বাক্য’। বাক্য দিয়ে ‘কবিতা’। পেশকার, কায়দা, লগ্গী, রেলা প্রভৃতির চেহারা প্রায় কাপ্লেটের মতো। জোড়ায় জোড়ায় আসা ফ্রেজ নির্দিষ্ট তালের বন্ধনে আবদ্ধ। প্রতিটা বন্দিশ বা রচনার প্রথম বাক্যটি এমন যে, তবলায় বাজালে ধ্বনির একটা বিশেষ জ্যামিতিক থিম্ ফুটে উঠবে। তারপর সেই থিম্ বজায় রেখে বিস্তার হবে। দীর্ঘ আলুলায়িত পয়ারের মতো। আস্তে আস্তে একটা গল্প, একটা ছবি ফুটে উঠবে। সূক্ষ্ম, নাজুক, বিমূর্ত উপায়ে।
তবলার গায়ে আঙুল ফেলে ফেলে উৎপন্ন প্রতিটা ধ্বনি একেকটা ‘সিলেবল্’। নিজস্ব নাম আছে তাদের। ডান হাতের তর্জনীর মাথা ‘ডাইনা’-র ‘কিনারে’ (ছোট, treble ড্রামটির periphery অংশে) ফেললে যে স্বর বা মিউজিক্যাল নোট উৎপন্ন হয়, তার নাম ‘না’। ডাইনার ‘সুর’ নামক অংশে (‘কিনার’ ও ‘চাঁদির’ মধ্যবর্তী) আঘাত করলে যে নোট বাজে, তার নাম ‘নি’ ইত্যাদি। যাই বাজবে তবলায়, তার প্রতিটি ধ্বনি তবলা ভাষার কোনো না কোনো সিলেবল্ দিয়ে প্রকাশ করা যাবেই যাবে। যদি না যায়, সেই বাজনায় গোঁজামিল আছে।
ছন্দ
একটা তালের প্রাথমিক ও পোশাকি পরিচয় পাওয়া যায় মাত্রা গুণে, আর গভীর পরিচয়টা পাওয়া যায় তার মাত্রাবিভাগে। রাগের যেমন ‘চলন’ থাকে, তালের থাকে ছন্দ (groove)। পর্বভাগ মারফত যা নির্দিষ্ট হয়। যেমন রূপক তালের পর্ববিভাগ ৩।২।২। অর্থাৎ, রূপকের আছে তিনটি পর্ব। প্রথম পর্ব ৩ মাত্রা, দ্বিতীয়টি ২, শেষটিও ২।
ছন্দের চরিত্র গঠন করে, এমন আরেকটা বিষয় হচ্ছে ‘তালি’ ও ‘খালি’। তালি হলো সেই যৌগিক সিলেবল খোলা বায়া (open bass) ও ডাইনার treble মিলিত বাদনে যা উৎপন্ন। এবং ‘খালি’ নির্দেশ করে সেই সিলেবল, যেখানে শুধু ডাইনা বাজে, বায়া (bass) বন্ধ থাকে। তবলায়, নানা মাত্রার স্থলে, খোলা বায়ার (open bass) উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির মধ্য দিয়ে ছন্দের গতিপ্রকৃতি ফুটে ওঠে। এই ‘ত ালি’ ও ‘খালি’ বিশ্বসংগীতে তবলার দান।
লয়
সরলার্থে, লয় হচ্ছে মাত্রার গতিবেগ। মেট্রোনোমে লয় নির্দিষ্ট হতে পারে। ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা যেমন এক সেকেন্ড পর পর ঘোরে, মেট্রোনোমে তেমনি একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর একটা করে মাত্রা (নবধঃ) বাজে। ওস্তাদ শিল্পীরা ওনাদের স্নায়ুর ভেতর একটা লয় একবার স্থির করে বসিয়ে নিলে, সেই লয় আর নড়চড় করে না। একই বেগে চলতে থাকে। একে বলে ‘লয়দার’ অবস্থা। লয়দার হওয়া ‘লয়কার’ হওয়ার পূর্বশর্ত।
লয়কারী
ধরা যাক একটা যেকোনো লয় আপনি ঠিক করে নিলেন আপনার মেট্রোনোমে। ধরা যাক ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাই আপনার সেই লয়ের মেট্রোনোম। এবার প্রতি সেকেন্ডে যদি আপনি একটা করে তালি দেন, সেটা হবে ‘বরাবর’ লয়। ২ সেকেন্ডে ৩টা তালি দিলে তা ‘দেড়িয়া’ বা ‘আড়’ লয়। সেকেন্ডে দুটা করে তালি দিলে হবে ‘দ্বিগুণা’। তিনটা করে তালি দিলে ‘ত্রিগুণা’ ইত্যাদি।
এবার, তালি দিয়ে দিয়ে যে কাজটা আমরা করলাম, তবলায় একটা নির্দিষ্ট তালের সাপেক্ষে সেই কাজটা করা হবে কীভাবে? একইভাবে! শুধু একেকটা তালির বদলে, তবলার সিলেবল দিয়ে তৈরি ফ্রেজ বাজবে! কোনো নির্দিষ্ট তালে বাঁধা বন্দিশ- কায়দা, টুকরা, গৎ, চক্রদার ইত্যাদি রচনার অংশ হিসেবে। একটা নির্দিষ্ট লয়ের জমিনে সম্পাদিত এরূপ লয়কারীর মাধ্যমে তবলায় অপরূপ সাংগীতিক মূর্ছনা তৈরি সম্ভব। সুরের মেলোডি যেমন তৈরি হয় সা রে গা মা... অর্থাৎ মিউজিক্যাল নোটের ভেতর বিচরণের মাধ্যমে, তেমনি তবলায় লয়ের মেলোডি তৈরি করা সম্ভব, এক ছন্দ থেকে আরেক ছন্দে বিচরণের মাধ্যমে।
উপজ্
গান-বাজনার যেকোনো পরিণত ফর্মের মতো তবলাও চিন্তানির্ভর, বৈজ্ঞানিক একটা শাস্ত্র। কোনো শর্টকাট নাই। ফাঁকিবাজির রাস্তা নেই। দীর্ঘ, নিমগ্ন সাধনা ছাড়া উন্নতি অসম্ভব। অপূর্ব সব ম্যাটেরিয়ালের শপিংমল বানিয়ে রেখে গেছেন তবলার ছয় ঘরানার পণ্ডিতরা। শিখতে শিখতে বিদ্যার্থী একসময় তাল বিষয়টা ‘চোখে দেখতে’ visualize) শুরু করে। আরও শিখতে শিখতে একসময় চোখে দেখতে শুরু করে ‘লয়’ বিষয়টাকে। এরপর, ধীরে ধীরে, শাস্ত্র আর টেকনিকের স্তর পার হয়ে, প্রকৃত সংগীতের জগতে গ্র্যাজুয়েট করে সে। নিজেও নানান বন্দিশ, পাল্টা ইত্যাদি রচনা করতে শুরু করে। improvised বাজনার স্তরে পৌঁছায়। এর নাম ‘উপজ্’ অঙ্গ।
জাকির হুসেইন প্রমুখরা এত মহান, তার অন্যতম কারণ এই উপজ্ অঙ্গে ওনাদের অবিশ্বাস্য সাবলীলতা। মঞ্চে বসে, কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই, যাকে বলে on-the-spot, লয়তালের মেলবন্ধন বজায় রেখে, বিস্ময়কর পর্যায়ের সুন্দর সব রচনা, রীতিমতো ‘নাজিল’ করে করে অবলীলায় বাজিয়ে ফ্যালেন ওনারা।
এ শহরে প্রকাশ্যে গান গাওয়ার জায়গাগুলো যেন বেশ কমে গেছে। আকাশছোঁয়া দালানের প্রকোপে খেলার মাঠের মতোই গানের মঞ্চগুলো যেন উধাও হয়ে যাচ্ছে! ঢাকাতে গাড়ির তীব্র হর্নের মধ্যে গান শোনা তো আসলে অসম্ভবই বটে। শব্দদূষণ বাদেও ওপেন এয়ার কনসার্ট এখন খুব অপ্রতুল। নাগরিক শ্রোতা ও গায়কদের ভেতরে সুষম সংমিশ্রণের জায়গা খুবই অল্প। তবুও তরুণরা বসে নেই, নতুন অনেক গান তারা তৈরি করছে, প্রকাশ করছে এবং বিভিন্ন মঞ্চে পরিবেশনা করে চলেছে। আপনার কাছে বিকল্প সেইসব মঞ্চের খোঁজ আছে তো? সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইন প্লাটফর্মে গান প্রকাশ করার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার ফলে শ্রোতা এবং শিল্পীর সাধারণ মিলন খুব কম ঘটে। এই লেখাতে ঢাকার অন্যরকম কিছু মঞ্চ নিয়ে আমি কথা বলব যেখানে গায়ক এবং শ্রোতার বাস্তব ও ভার্চুয়াল এই উভয় যোগাযোগই হয়ে থাকে।
ঝিড়ঝিড় ক্যাম্পফায়ার সেশন
২০২২ সালের শেষে শীতকাতুরে সন্ধ্যায় যখন ধলেশ্বরী কায়াকিং রিসোর্টে ঢুকে ঝিড়ঝিড় ক্যাম্পফায়ার সেশনের সেটে যাই তখন বেশ নাটকীয় লাগে পরিবেশটা। দুটি তাঁবু টাঙানো এবং দুপাশে দুটি মশাল জ্বলছে! দুই তাঁবুর ঠিক মাঝ বরাবর ফাঁকা জায়গাটিতে একটি গাছের গুঁড়িতে বসে গায়ক গান গাইবে! পাশেই স্রোতস্বিনী ধলেশ্বরী নদী, আকাশ ভর্তি ঝিকিমিকি অজস্র তারা! নদীর ওপর পেতে রাখা মাচাতে অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে তারা দেখলাম। অনেকক্ষণ গুনগুন করে গান গাইলাম! দু-একটা জোনাক পোকা ঢুকে গেল যেন ঠিক আমার মাথার ভেতরে! মশালের দপদপে আগুনের পাশে নড়ছে আমার ছায়া! ঠিক সে সময়ে আমার ডাক এলো! কিবোর্ডে ছিল জাফরি, হারমোনিতে রুদ্র, আর ভারতীয় মুদ্রায় ঘাসের গালিচায় বসে ভায়োলিন বাজাল প্রাঞ্জল! অ্যাকশন শব্দ শুনে চোখ বন্ধ করে গেয়ে উঠলাম ‘চোখ মেলেছি যেই’! ঝিড়ঝিড় ক্যাম্প ফায়ার সেশনে ঠিক এমনটাই ছিল আমার গানের দৃশ্যপট!
প্রতি বছর শীতে ঝিড়ঝিড় আয়োজন করে ক্যাম্পফায়ার সেশন। ঝিড়ঝিড় একটি অডিও ভিজ্যুয়াল প্ল্যাটফর্ম। ঝিড়ঝিড়ের প্রোডিউসার জাফরি আবেদীন নিজেও একজন মিউজিশিয়ান। সহজিয়া ব্যান্ডের বেস গিটারিস্ট হিসেবে সে কাজ করছে অনেকদিন হলো। পাহাড়ি ম্রো শিশুদের শিক্ষার সহায়তায় পাওমুম থারক্লা স্কুলের তহবিল সংগ্রহের জন্য তারা আয়োজন করেছিল ‘পাওমুমের জন্য গান’। সেই কনসার্টেও আমি গান গেয়েছিলাম।
ঝিড়ঝিড়ের প্লাটফর্ম থেকে অচিরেই বের হচ্ছে আমার সালো অ্যালবাম ‘বাতিঘরে রাত জাগা প্যাঁচা’। এই অ্যালবামের প্রথম গান “প্লাস্টিকে ডুবে আছি”। ঝিড়ঝিড় ইউটিউব চ্যানেল : https://www.youtube.com/@ZhirZhir হাতিরপুল সেশনস
২০১৯ সালের একটি শীতের সকালে আমি তুহিন এবং নাঈম মাহমুদ দেখা করলাম হাতিরপুল কাঁচাবাজারের সামনে। তারপর ছয় তালা সিঁড়ি ঠেঙিয়ে উঠে পড়লাম হাতিরপুল সেশনসের আঁতুড় ঘরে। এর ঠিক তিন দিন আগে আমাকে কল দিয়েছিল হাতিরপুল সেশনস-এর কিউরেটর অনিরুদ্ধ অনু। সে জানাল তারা একটি এভি প্লাটফর্ম করেছে যারা মূলত নিজেদের গান নিয়ে কাজ করছে তাদের জন্য, এছাড়াও ভিন্নধর্মী কভারেও তারা আগ্রহী। সবিনয়ে জানতে চাইল আমি গান করব কি না। আমি সানন্দে জানালাম অবশ্যই করব। তখন হাতিরপুল সেশনস-এর প্রথম সিজনের শ্যুট চলছে, ছাদের উন্মুক্ত সেটে টাঙানো তারে ক্লিপ দিয়ে আটকানো, শার্ট, জামা-কাপড়, প্যান্ট, ওড়না, বাচ্চার ছোট ছোট পাজামা, মোজা ইত্যাদি শুকাচ্ছে। ঢাকার যেকোনো ছাদের রঙিন বাস্তবতার সাধারণ চিত্র এটি। পরিবেশন আর ঢংটি খুবই ভালো লেগে গেল, কেননা নাটক সিনেমা কিংবা হাল আমলের সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্টে যেরকম অতি নাটকীয় জিনিসপত্র দেখি সেরকম কোনো কিছুই এরা রাখেনি। বরং বাস্তবতাকে রঙিন করেছে হাতির পুলের সচেতন নির্দেশনা। একটি জুম রেকর্ডারের সামনে গেয়ে ফেললাম গান, পেছনে অনেক বিল্ডিং-এর ব্যাক ড্রপ নিয়ে এবং একটা বিশাল আকাশ মাথার ওপর রেখে হাতিরপুল সেশনসের প্রথম সিজনে গেয়েছিলাম চিত্রকর গানটি।
২০২২ এর দ্বিতীয় সিজনের পরিবেশনায় একটু ভিন্নতা এনেছে হাতিরপুল সেশরস। এবার একটা ঘরের ভেতরে সেট। রঙতুলির ব্যবহার করে ছাদের হলুদ-কমলা রোদটাকে ওরা ঘরে নিয়ে এলো। এবার তারা হাউজব্যান্ড স্টাইলে কাজ করছে। আর লাইভ রেকর্ডিং সিস্টেমেও এসেছে অভিনবত্ব এবং পেশাদারিত্ব। জুমের বদলে এবার সাউন্ড কার্ড, ল্যাপটপে উঅড এবং সিনেমাটোগ্রাফিতে দুটি ক্যামেরা। এই কাজে ওদের কোনো স্পন্সর ছিল না। নিজস্ব অর্থায়নে সম্পূর্ণ অলাভজনকভাবেই হাতিরপুল সেশন্স এখনো কাজ করে যাচ্ছে।
যাইহোক। হাতিরপুল সেশনসে এবার হোমব্যান্ড পাওয়ার ফলে আমার সঙ্গে যুক্ত হলো বেস গিটারে অমিত হাসান রুদ্র, লিড গিটারে অনিরুদ্ধ অনু, ড্রামসে হাসিন আরিয়ান ও স্যাক্সোফোনে রাহিন হায়দার। তিন চার দিন প্র্যাকটিস করে শুভ একটা ক্ষণ বেছে আমার গান ‘ বিষাদের পরমাণু’ শ্যুট হয়ে গেল। আর সেটি প্রকাশ পেল ডিসেম্বর ২০২২-এর মাঝামাঝি।
হাতিরপুল সেশনসের গানগুলো রিলিজ হয় তাদের ইউটিউব চ্যানেলে। হাতিরপুল সেশনস হাউজব্যান্ড তাদের প্রকাশিত গানগুলো লাইভেও পারফর্ম করে থাকে।
হাতিরপুল সেশনস ইউটিউব : https://www.youtube.com/@HatirpoolSessions যাত্রা বিরতি
মানুষ যাত্রাপথে একটু জিরোয়, একসঙ্গে এক কাপ চা খেতে খেতে জেনে নেয় সহযাত্রীর যাত্রাহেতু। যদি আড্ডা জমে যায় তাহলে আরও এক কাপ চা কিংবা কফির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও বেশ কিছু খাবারের পদ। সহযাত্রীদের নানান ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এবং দার্শনিক আলোচনায় প্রশমিত হয়ে যাত্রীদের ভ্রমণ অবসাদ, ক্লান্তিতে আনে আবেগের রঙিন ছোঁয়া। আর সেই যাত্রা বিরতিতে যদি গায়ক গেয়ে ওঠে গান তাহলে তো কথাই নেই!! তাই না? ঢাকার প্রচ- ব্যস্ত এই নাগরিক জীবনে আমাদের যেন যাত্রা বিরতির সুযোগ নেই কোনো! আর সেই যাত্রা বিরতির একটি সাংগীতিক সুযোগ পাবেন যাত্রা বিরতির মিউজিক লাউঞ্জে।
বহু বছর আগে বনানীর দেশীয় ফ্যাশন হাউজ যাত্রার ছাদে মিউজিক লাউঞ্জ যাত্রা বিরতির যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে যাত্রার ছাদেই গানের আয়োজন ছিল। তবে বিগত বেশ কয়েক বছর হলো চার তলাতে এখন গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। বহুদিন ধরেই ঢাকাতে অন্যরকম গান শোনার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সবার কাছে জনপ্রিয় এই যাত্রা বিরতির মিউজিক লাউঞ্জটি। মঞ্চে নকশিকাঁথার ব্যাকড্রপে ও আধো আলোর রহস্যময় পরিবেশে গায়কের প্রাণবন্ত গানে গানে নাগরিকদের অত্যন্ত প্রিয় একটি জায়গা এই যাত্রা বিরতি। ছাদে তাদের আছে নিরামিষ প্রধান নানান পদের খাবারের একটি রেস্টুরেন্ট।
গত ৩০ দিনের ভেতরেই যাত্রা বিরতিতে আমি তিনবার গান করলাম তিনটা ভিন্ন অনুষ্ঠানে। ‘মাঘের গান’ ‘স্বায়ত্ত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ এবং ‘বসন্তের গান’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে আমি ছাড়াও ছিলেন আরও অনেকে। মাঘের গানে ছিল ব্যান্ড কাকতাল, সানি অ্যান্ড দ্য রেভলিউশনস, শুভ সুলতান, নাঈম মাহমুদ এবং আকাশ গায়েন। আর স্বায়ত্ত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস কলকাতার একটি স্বনামধন্য ব্যান্ড। বেমানান ব্যান্ডের গুণী শিল্পী ও গায়ক স্বায়ত্ত মল্লিকের আরেকটি ব্যান্ড প্রজেক্ট এটি। গিটারে জুবিন ও ইলেকট্রিক গিটারে উৎসব গুহ ঠাকুরতা ও ভোকালে স্বায়ত্ত এই লাইন আপে স্বায়ত্ত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস পারফর্ম করেছিল যাত্রা বিরতিতে। সেদিন যৌথভাবে আরও গান করেন চেতনা রহমান ভাষা, আসির আরমান ও আমি।
আর বসন্তের গানে গান করেছিল কাকতা সানি অ্যান্ড দ্য রেভলিউশনস, আসির আরমান এবং আমি মুয়ীয মাহফুজ। ‘বসন্তের গান’ ছিল আবেশী গানের আসরের দ্বিতীয় পর্ব। বাংলাদেশের বর্তমান সময়কার নিজের গান নিয়ে এগিয়ে চলা কিছু গায়কদের একটি পরিবেশনার সিরিজ হলো এই আবেশী গানের আসর। আবেশী গান হলো সেই গান যা আপনাকে ভাবাবে, আপনি গায়কের আবেগের সঙ্গে একাত্ম হবেন এবং তার আবেশ রয়ে যাবে আরও অনেক দিন। আবেশী গানের আসরের প্রথম আয়োজন হয়েছিল বারবিকিউ স্কাইলাইন-এর রুফটপে। প্রথমবারে গান করেছিল দ্যা রেহমান ডুও, ব্যান্ড কাকতাল, সানি অ্যান্ড দ্য রেভলিউশনস এবং আমি।
আমার কৈশোর ছিল সাইকাডেলিক রক আর হেভি মেটাল মিউজিকের আবহে নিমজ্জিত। আশির দশকে সামরিক জান্তা আর স্বৈরশাসকের নিপীড়ন আর নিষ্পেষণকালের দোহাই দেব না। কিন্তু রাষ্ট্রকে যদি একটা এস্টাবলিশমেন্ট ধরি তাহলে তার সব রুচিগত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিজের পছন্দ-অপছন্দকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আকাক্সক্ষা তো ছিলই। সেই সময়টা পুরোপুরি প্রতিবাদী মানসিকতার কাছে সমর্পিত ছিল। যার প্রভাব আমরা দেখতে পাই আশির দশকজুড়ে। তবে গ্লোবাল স্পেকট্রামে যেসব সাংস্কৃতিক উপাদান বা এক্সপ্রেশন জনপ্রিয় হয় তার ঢেউ বাংলাদেশ অথবা আরও বিস্তৃত করে বললে ভারতীয় উপমহাদেশের তটে আছড়ে পড়ে এক দশক পরে। পশ্চিমে তখন সাইকাডেলিক রক, অলটারনেটিভ রক কিংবা হেভি মেটাল সংগীতের ধারা জনপ্রিয়তার অংশীদার হয়ে গেছে। মূলধারাকে প্রশ্ন করতে অন্য একটা সাংগীতিক এক্সপ্রেশন তখন প্রতিবাদের স্রোত তৈরির রসদ জোগাচ্ছে। মার্কিন মুলুকে থাকা আফ্রো আমেরিকান জনগোষ্ঠীর তরুণরা এক অন্যরকম জীবনধারণের কথা বলতে শুরু করেছে বর্ণবাদ আর সাদার সুপ্রিমেসিকে নাকচের মধ্য দিয়ে। তাকে বেশির ভাগ ক্রিটিকরা হিপহপ সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করতে শুরু করে। এই সংস্কৃতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল সংস্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে জীবনকে উপভোগ।
বাংলাদেশের মানুষ তখন হিপহপ শুনত না এমন নয়। তখনো হিপ হপ সংস্কৃতি সেই অর্থে দ্যোতনা তৈরি করেনি। এমসি হ্যামার কিংবা ডিজে কুলদের বিটনির্ভর উপস্থাপন শুনতাম। কিন্তু ওইভাবে আকৃষ্ট হয়ে শোনা শুরু হয়নি। আর সংস্কৃতিগত ধারণা থেকেই ওই ঘরানার হিপহপকে ঠিক নিজের মনে হতো না।
হিপহপ সংস্কৃতির বেড়ে ওঠা ডায়াসপোরা আর তার ডিস্টোপিয়ান আগ্রহ থেকে। অভিবাসনের মধ্য দিয়ে যে নিঃসঙ্গ তৈরি হয় তার প্রকাশ ঘটে বিমূর্তকরণে; সামাজিক রুচিবোধকে মেনে না নেওয়ার সে এক তীব্র বহিঃপ্রকাশ। বিংশ শতকের প্রায় শেষভাগে পশ্চিমে আফ্রো আমেরিকান বা আফ্রো ব্রিটিশদের মতো, ইন্দো আমেরিকান অথবা ইন্দো ইউরোপিয়ান তরুণরাও হিপহপ করতে শুরু করে আর জনপ্রিয়তার হাতছানি দেখতে পায়। তাদের একজনের নাম না বললেই নয় সেই অ্যাপাচে ইন্ডিয়ান পশ্চিমা ঘরানার র্যাপ কিংবা হিপহপের সঙ্গে পাঞ্জাবি ইন্ডিয়ান মিউজিকের ফিউশন করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর প্রভাবে কয়েক বছর পর আশরাফ বাবু, পার্থ বড়ুয়া আর আজম বাবু এই তিনজন একটা অ্যালবাম রেকর্ড করে। ত্রিরত্নের খ্যাপা নামের সেই অ্যালবাম শহুরে তরুণদের একটা সুনির্দিষ্ট অংশের মধ্যে ভালোই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাদের গানের মূল বিষয় ছিল পুরনোকে অস্বীকার আর ব্যবচ্ছেদ করে তার অপ্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। কিন্তু এই হিপহপ অ্যালবাম কোনো আন্দোলনের অংশ ছিল না। তিন তরুণ সংগ্রামী ব্যান্ড মিউজিশিয়ান ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইংলিশ অ্যাপাচি ইন্ডিয়ানকে অনুসরণ করে দেখতে চেয়েছিলেন হয়তো। যদি ক্যাসেটের বিক্রিবাট্টা ভালো হতো তাহলে আবার কিছু করা যাবে। কিন্তু তাদের সেই আশার গুড়ে বালি দিয়ে প্রজেক্ট সেখানেই সমাপ্ত হয়।
নব্বইয়ের দশকে মার্কিনি সামাজিক সাংস্কৃতিক কারণেই হিপহপ কিংবা জঅচ সব বর্ণের তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করতে শুরু করে। শুধু আফ্রো আমেরিকান নয় নেটিভ আমেরিকানরাও রাইমিং শুরু করে ভালোভাবেই। এখানে বলে নেওয়া ভালো, জঅচ কোনো শব্দ নয়, এর মূল অর্থ জযুসব ধহফ চড়বঃৎু। ছন্দোবদ্ধ করে কবিতা আবৃত্তির মতো করে গান গাওয়া। এই সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বিনোদনদাতারা। শুরুর সময়টায় হিপহপাররা দর্শকদের সঙ্গে কথা বলে বিট তৈরি করে যোগাযোগ করত। তারা মূলত অনুষ্ঠান পরিচালকের ভূমিকা নিত। এ কারণে অনেক জঅচচঊজ। তাদের নামের আগে ইংরেজি বর্ণ এমসি ব্যবহার করত। বাংলাদেশেও শহুরে তরুণদের একটা গ্রুপ নিজেদের ভেতর জঅচ চর্চা করত, আর তারা নিজেদের নাম পাল্টে এমসি অমুক, এমসি তমুক নামে পরিচিত হতে শুরু করল।
পশ্চিমা যেকোনো বিষয়ের চর্চা যেভাবে বাংলাদেশে শুরু হয় এই ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। রাষ্ট্রের উচ্চবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত শহুরে শিক্ষিত তরুণরাই পুরোধা হলো। তাদের অনুপ্রেরণায় কিছু শহুরে মধ্যবিত্তরাও যুক্ত হলো। পশ্চিমে যেমন বিকল্পধারা হিসেবে যেকোনো সাংস্কৃতিক এক্সপ্রেশন শুরু হয়েছে প্রতিবাদী বা পাল্টানোর মানসিকতা নিয়ে; অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে বসা মানুষ অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য চিৎকার করেছে অথবা ছন্দ তৈরি করেছে। বাংলাদেশে অস্তিত্বওয়ালারাই বরং তাদের ঘোষণা আরও পোক্ত করে এসব নতুন ঘরানাকে অভিযোজন করে। বাংলাদেশি এমসিরা মূলত ঘরে বসে ছন্দ তৈরি করা তরুণ হলেও শুরুতে তারা পাশ্চাত্যের মতো এলাকার দখলের ঘোষণা দিয়ে গালাগাল-সমৃদ্ধ কিছু একটা করত। বেশির ভাগ ইংরেজি মাধ্যমে পড়া আরাম-আয়েশে জীবন কাটানো তরুণদের কণ্ঠে এসব গালাগাল খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি প্রথম দশকের শেষ আর দ্বিতীয় দশকের শুরুতে। কিন্তু সরকারি কলোনিতে বড় হওয়া একদল ছেলে নিজেদের আপটাউন লোকালজ বলে যখন জঅচ করতে শুরু করল, তারা সীমিত পরিসরে হিপহপ চর্চারত ধনিক শ্রেণির জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হলো।
বাংলাদেশে হিপহপের পুরোধারা নিজেদের পরিচয় দিত দেশি এমসি হিসেবে। আপটাউন লোকালজদের নাম ছিল বর্ণময় আবার খানিকটা ডার্ক। তবে এর মধ্য দিয়েই হিপহপ সংস্কৃতির বাংলাদেশ চ্যাপ্টার পূর্ণতা পেল। যদিও উপস্থাপন কিংবা সুরে পশ্চিমের অনুবাদ করত উভয় পক্ষই। নিজস্বতা বলে কিছু ছিল না হিপহপারদের। অন্য রক কিংবা মেটাল মিউজিকের মতোই, অনুকরণপ্রিয় হিসেবেই বাংলাদেশি হিপহপারদের উত্থান।
কিন্তু কেউ কেউ যেন অন্যরকম ভাবে। তাউরা সাফা নাম নিয়ে পরিচিত হওয়া এক জঅচচঊজ তেমনি একজন। পুরান ঢাকায় একেবারে স্ট্রিট কালচারে বড় হওয়া সাফা তার অস্তিত্ব জানান দিল দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝিতে। হিপহপাররা জেগে উঠল। দেশের বিভিন্ন কোণে জঅচ করতে শুরু করল তরুণরা। এ সময়টায় সিলেট, ফরিদপুর, কুমিল্লা এমনকি কক্সবাজারেও নতুন হিপহপাররা তাদের জঅচ ইউটিউবে প্রকাশ করতে শুরু করল। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করে তারা যেন নিজেদের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে ব্যস্ত হলো।
আমি আগে জঅচ বা হিপহপকে মিউজিকের ঘরানা হিসেবে গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু জালালি সেট বলে একটা প্রজেক্টের গান শুনে থমকে গিয়েছিলাম ২০১৬-এর গোড়ার দিকে। এই প্রজেক্টের নেতৃত্ব অথবা মূল প্রণেতা ছিল সেই শুরুর জমানার একজন, যে নিজেকে এমসি মাগজ বলে পরিচয় দিত। উচ্চবিত্ত পরিবারের ইংরেজি মাধ্যমে পড়া এই এমসি সমাজের নানা স্তরের আরও চারজন হিপহপারের সঙ্গে মিলে বেশ কিছু ট্র্যাক তৈরি করল। এবার যেহেতু জঅচ-এর একটা ভূমি তৈরি ছিল তাই গালাগাল নিয়ে সমস্যা হলো না। কিন্তু তারা নাড়া দিল সমাজের প্রচলিত নানা সংস্কার নিয়ে। দলবাজি না করেও কেমন রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করা যায় এস্টাবলিশমেন্টকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তার নমুনা হিসেবে একেকটা ট্র্যাক যেন নিজের সঙ্গে পাল্লা দিল।
পরে যারা হিপহপ সংস্কৃতি অথবা জঅচ তৈরির চেষ্টা করছে তাদের অনেকে এই সংস্কৃতিকে জড়িয়ে নিয়েছে নিজেদের জীবনবোধে। আবার অনেকে এটাকে শুধু একটা এক্সপ্রেশন হিসেবে দেখেছে। তবে একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, বাংলাদেশের জঅচচঊজরা এখন শুধু প্রতিবাদ কিংবা পরিবর্তনের কথাই বলে না, তাদের ছন্দোবদ্ধতায় কবিতা তৈরি হয়। তাদের শরীরী ভঙ্গিতেও দেশি ভাব দেখা যায়। দেশি পুঁথিপাঠ কিংবা কবির লড়াইয়ের ধরনে তারা ব্যাটল রাইম করে। সম্ভবত দেশের অনেক হিপহপারই নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে নিজস্ব ধরন তৈরি করেছে। পশ্চিমের অনুকরণ না করে, অনুগত না থেকে কীভাবে একটা সাংস্কৃতিক এক্সপ্রেশনকে নিজেদের করে নেওয়া যায় তার নিদর্শন হিসেবে আপনারা বাংলাদেশি হিপহপার কিংবা জঅচচঊজদের কথা বলতে পারেন নিঃসংশয়ে।
একুশ শতকের প্রথম দশকেই নতুন স্বাদের যে গান বাংলাভাষীদের চাঙ্গা করেছে তা হলো বাংলা র্যাপ। নিউ ইয়র্ক বেজড স্টোয়িক ব্লিসের ‘আবার জিগায়’ নামের হিপহপ ঘরানার গানটি রিলিজের সঙ্গে সঙ্গেই শ্রোতাদের প্লে-লিস্টে উঠে আসে; তবে প্রচুর ইংরেজি শব্দের ব্যবহারের কারণে একে পুরোপুরি বাংলা র্যাপ বলা যাবে না। একই ধারাবাহিকতায় ‘দেশি এমসি’জ’ ‘ব্যানড’ নামের অ্যালবাম রিলিজ করে তাতেও বাংলা র্যাপের ভিত্তি পাকাপোক্ত করার মতো ট্র্যাক ছিল না। তবে এরা বাংলা হিপহপে তাদের জায়গা তৈরি করে নেয়।
ডেডলাইন এন্টারটেইনমেন্ট লেভেল ‘টিওআর’-এর ‘বাংলা হিপহপ জাতি’ এবং ‘আপটাউন লোকলজ’ এর ‘কাহিনি সিনপাট’ নামের দুটি এলবাম রিলিজ করে পরপর। টিওআর-এর অ্যালবামে বাংলা র্যাপের শক্তির জায়গাগুলো পরিষ্কার হয় আর আপটাউন লোকলজ বলা যায় বাংলা র্যাপের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। কাহিনি সিনপাট বাংলা হিপহপে বাংলা র্যাপের একটা পূর্ণাঙ্গ অ্যালবাম। জেসপার আল রাশিদের জাদুকরী মিক্সিং আর মাস্টারিং-এ দুটি অ্যালবাম শ্রোতাদের কানের রুচির স্বাদ মিটিয়েছে।
যদিও মেইনস্ট্রিমে আসার আগে আপটাউন লোকলজ’র সদস্য ব্ল্যাক জ্যাং, তাউড়া সাফাদের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্র্যাক ছিল কিছু। যার মধ্যে ‘ঠোলার পোলা’ নামের একটা গানের জন্য তাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেডকোয়ার্টারেও জবাবদিহি করতে হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। গানগুলো মেমোরি কার্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল, আর ২০০৯-এ অ্যালবাম রিলিজ হলে গান বাজত এফএমে।
কাহিনি সিনপাট অনন্য এর বাংলা ভাষা ব্যবহার আর লোকাল লোকজনের মুখের ভাষা তুলে আনায়। পুরান ঢাকার টোন আর একই সঙ্গে খেটে খাওয়া মানুষের কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার আলাদা উত্তেজনা তৈরি করে। এলিফ্যান্ট রোডের জুতার দোকানিদের নিজেদের মধ্যকার কোড ল্যাঙ্গুয়েজ আছে কিছু; ওখানে বেশ দামাদামি করে জুতা কিনতে হয়, এখানে কখনো ক্রেতা জিতে কখনো বিক্রেতা। হুট করে ‘উস্সাই’ বলে উঠে কোনো কোনো বিক্রেতা, এতে তার সহকর্মী বুঝতে পারে, লাভ হয়েছে বিক্রিতে। এমন আরও কিছু শব্দ কাহিনি সিনপাটে লক্ষ করার মতো। এছাড়াও অ্যালবামের প্রথম থেকে শেষ বেশ একটা হিপহপ জার্নির মতো। গানগুলোর বিষয়বস্তুতে যেমন পার্টি মুড আছে একই সঙ্গে দেশপ্রেম, সমাজ ও প্রতিবাদী চিন্তার প্রতিফলনও ঘটেছে। হিসাবের কথা, সিভিল সমাজ ও পিস্তলের জীবন গানগুলোতে তৎকালীন সময়ের একটা রূপও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তবে এই অ্যালবামের সবচেয়ে জনপ্রিয় হয় ‘এই মামা এই’ গানটি। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এই গানগুলোর প্রভাব থেকে এখনো বের হতে পারেনি বাংলা র্যাপাররা, এতটাই সমৃদ্ধ এই অ্যালবামটি।
আপটাউন লোকলজ ভেঙে যাওয়ার পর সাফা দেশি এমসিজ’র মাগজ’র সঙ্গে নতুন করে দল গোছায়। জালালি নামে দলটির আত্মপ্রকাশের আগেই ‘এলাকা’ নামের একটি ট্র্যাকও প্রকাশ করে ইউটিউবে। পরে সাফার অংশ বাদ দিয়ে আবার একই ট্র্যাক রেকর্ড করে জালালি সেট নামের হিপহপ দলটি। বেশ কিছু গান আনে তারা ইউটিউবে। এর মধ্যেই জালালি সেট সদস্য শাফায়েত মমতাজের সঙ্গে ‘লোকাল বাসের’ মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পায় তবে দল হিসেবে শ্রোতাদের নতুন কিছু দিতে ব্যর্থ হয় তারা। অন্যদিকে ‘ভব’ নামে হিপহপ ক্ল্যান তৈরি করে বেশ কিছু ট্র্যাক রিলিজ করে তাউড়া সাফা। হিপহপ তৎপরতা লক্ষ করা যায় বিভিন্ন অঞ্চলেও; নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, টাঙ্গাইল, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ বেশ কিছু অঞ্চলে সেখানকার আঞ্চলিক ভাষাতেও র্যাপ করা শুরু করে র্যাপাররা। উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছে আপটাউন লোকোলজের ব্ল্যাক জ্যাং, সে বেশ কিছুদিন পরপরই নিজের ট্র্যাক রিলিজ করছে একই সঙ্গে হিপহপের নানা রকম মুভমেন্টের সঙ্গেও জড়িত।
ইংরেজি র্যাপ থেকে সরে এসে হালে বাংলা র্যাপের স্বকীয়তার জায়গা হলো ফোক গানের সঙ্গে ফিউশন ও বাংলার নিজেদের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে বাংলার ভাব ও আঞ্চলিকতা।
বিজ্ঞাপনগুলোতে হিপহপ ড্যান্স ও বাংলা র্যাপের ব্যবহার হচ্ছে প্রচুর। বিটের তালে র্যাপ গানে পণ্যের গুণগান করাটা অভিনব এবং আকর্ষণীয় বটে। তবে পূর্ণাঙ্গ বাংলা র্যাপের যাত্রাটা যেভাবে ধানম-ির ফুটপাত থেকে শুরু হয়েছিল, ভাইরাল ভাইরাস বা বিজ্ঞাপনী সংস্থার হাতে এ গান বেশিদিন থাকবে না। বাংলা র্যাপ হতে যাচ্ছে মুখবন্ধ রাখতে বাধ্য মানুষদের মুখোশ পরে ‘কথা বলার’ মাধ্যম। কথা নিষিদ্ধ জগতে সিধাসাদা কথা বলার জন্য বিটের তাল হলে রাস্তাপ্রিয় লোকদের আর কী চাই!
The culture of all oppressed is the culture of resistance... Thus all artists coming from an oppressed people must represent resistance in their art form.
-Kwame Ture
ঊনসত্তর-একাত্তর হয়ে বাহাত্তরেও যে জঙ্গম বাস্তবতার আঘাত ও ক্ষত দেশের শরীরে দপদপ করছিল, তাকে কোনো সুকুমার ভাষায় প্রকাশ করা কি যেত? সে সময়ের তরুণের মন চিৎকার করছে হাহাকারে, ফেটে পড়ছে বিদ্রোহে, তাদের দরকার ছিল খোলা গলার চিৎকারের ভাষা। ‘হায় আমার বাংলাদেশ’ বলে আজম খান সেটাই দিলেন। আর তাতেই বদলে গেল বাংলা গানের ইতিহাস। তার গান অসন্তোষের তারে বাঁধা হলেও তার তলায় ঠিকই শোনা যায় ভালোবাসার অফুরান কুলকুল জলধারা।
তারপর এক দিন বুকের ভেতর একটা ধস। আজম খান আর নেই। এই ‘নেই’ কি নতুন? অনেক দিনই তিনি তো ছিলেন না বললেই চলে। রোগশয্যায় কোমায় চলে যাওয়ারও আগে, বহুদিন ধরে গানের বাজারের বাজারিরা তো তাকে একরকম ‘কোমা’র মধ্যেই রেখেছিল। তিনি গান বাঁধতেন, কিন্তু কেউ সেধে প্রকাশের গরজ দেখাত না। তিনি সেই বুক তোলপাড় করা আজম খানই ছিলেন, তবু টিভি বা কনসার্টে গাওয়ার ডাক কমে গিয়েছিল। রক্তমাংসের মানুষটি মরে যাওয়ার আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল তার সাংস্কৃতিক মৃত্যুর পরিবেশ। তার দিন সত্যিই ফুরিয়ে আসছিল।
সময় বদলে যাচ্ছিল, মন বদলে যাচ্ছিল, রাজধানী-শহর-মফস্বল সব বদলে যাচ্ছিল। বদলে যাচ্ছিল পপগানের জনপ্রিয়তার ব্যাকরণ। এ যুগ ডিজিটাল, এ মন লিকুইড, এর চাওয়া পিচ্ছিল, এর প্রেম অস্থির। সত্তর বা আশির দশকের সেই রোখা মন, চোখা গায়কি, বুনো আবেগের ভাষায় আর সাড়া দেয় না আজকের তরুণ। তাদের মনের পর্দায় এখন অন্য ছায়া, অন্য ছবি, অন্য সুর। কানে আইপড লাগানো রঙ করা চুলের বাহারি তরুণী কিংবা কোমরঢিলা জিন্স আর ব্র্যান্ডে ব্র্যান্ডে ব্র্যান্ডেড তরুণ মনে আজম খান কতটা সাড়া তুলবেন আর? তিনি তো আর লিকুইড মডার্নিটির তারুণ্যের ভাবভঙ্গি বোঝেন না। তার দিন ছিল সত্তর দশকের অশান্ত ও প্রতিবাদী চৈতন্যে গড়া। দেশায়ত আধুনিকতার সেই যুগে শহুরে তারুণ্য একধরনের প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাবকালচার গড়ে নিয়েছিল। তখনো নাগরিকতার ঠাটবাট থেকে তারা দূরে ছিল, দূরে ছিল পণ্যাসক্ত ভোগবাদিতা থেকেও। সেই দিন, সেই মন যত ফুরাচ্ছিল, ততই তার দিনও বুঝিবা ফুরিয়ে যাচ্ছিল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী উত্তাল সময়ে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া তারুণ্য অশান্ত ও হতাশ হয়ে উঠেছিল। আজম খানের গান তখন তাদের ভাষা দিচ্ছিল, জাগিয়ে রাখছিল। তিনিই ঢাকার তরুণদের চিৎকার করে মনের কথা বলার ভাষা ও ভঙ্গি দিয়েছিলেন। তার পুরুষালি গলা ও ঢং তাকে পুরুষ-তারুণ্যের জননায়ক করে তুলেছিল। সনাতন বাংলা গানের পুতুপুতু সুরেলা আমেজ ভেঙেচুরে শিরায় শিরায় রাগী ছন্দের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বাবা তাকে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে যাচ্ছিস যা, দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না।’ তিনি কথা রেখেছিলেন। গেরিলা যোদ্ধার বেশ আর ছাড়েননি, কেবল রাইফেল-গ্রেনেড ফেলে গিটার তুলে নিয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন আহত কিন্তু প্রতিবাদী বাংলাদেশের তরুণদের প্রতীক। সত্যিই সেই দিন কি আর নেই, সেই তরুণেরাও কি হারিয়ে গেছে? তারা আছে নিশ্চয়, কিন্তু তাদের মনের পিপাসা মেটাবার দায়িত্ব গানের বাজারিরা আর নিচ্ছেন না। কালচার ইন্ডাস্ট্রি এখন ফাঁকা আবেগ আর মোহরতিবাসনার প্রজননক্ষেত্র হয়ে তারুণ্যের দাহিকাশক্তি নিঃশেষ করে ফেলছে। এসব দেখেই দেখেই আজম খানের মনে সংশয় জেগেছিল, ‘আমার গান একসময় মানুষকে জাগাইছে হয়তো, তখন ছিল যুদ্ধের পরবর্তী সময়, মানুষের মধ্যে দরকার ছিল যুদ্ধের চেতনা। এখনকার তরুণদের কাছে আমার গান কী সেটা বুঝলে বুঝবেন আমি আসলে কী করছি। ...আমার গান এখনকার অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের অন্তরকে জাগায় কি না।’
তার স্মরণে অনেক অনুষ্ঠান হলো টিভি চ্যানেলগুলোতে। একটিতে তিনি শিল্পী আসিফের উপস্থাপনায় দুর্বল শরীরে আসিফের কাঁধে ভর দিয়ে গান গাইছিলেন। শেষ গান হিসেবে গাইলেনÑ ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে!’ গাইতে গাইতে এক্কেবারে হৃদয়ের তন্ত্রীতে বাড়ি মেরে যতবার হায় বলছিলেন, মনে হচ্ছিল সেটা তার কলিজাচেরা হাহাকার।
আধুনিক বাংলা গানের রয়েছে অমৃত ভান্ডার। বিশেষ করে, বাংলাদেশে যেসব সুরবোদ্ধা আধুনিক বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করে গেছেন, সেইসব সংগীত ব্যক্তিত্ব জ্বলজ্বল করছেন সুরের আকাশে। বর্তমানেও সেই গানের, জনপ্রিয়তা কমেনি। সেইসব গান শোনামাত্র, আমরা স্মৃতিকাতর হই। খুঁজে বেড়াই, হারানো ভালোবাসা। অথবা উদ্বুদ্ধ হই, গভীর দেশপ্রেমে। সেইসব গান আমাদের ভেতর জাগিয়ে তোলে দ্রোহ, যন্ত্রণা, ভালোবাসার কাতরতা। কখনো আবার স্বপ্ন দেখায়, নতুন জীবনের।
একটি গীতিকবিতা প্রাণ পায়, সুরে। সুরকারের জাদুস্পর্শে তা ধ্বনিত হয়, শিল্পীর কণ্ঠে। হারানো দিনের সেই সব গানের উল্লেখযোগ্য সুরকার নিয়েই এই লেখা। সেইসব গানের অধিকাংশই, স্থান পেয়েছে চলচ্চিত্রে।
সুরকার আলতাফ মাহমুদ একুশের প্রভাত ফেরির গান আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো/একুশে ফেব্রুয়ারি গানে সুরারোপ করে অমর হয়ে থাকবেন।
সুরকার সুবল দাস। ১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানী পরিচালিত আকাশ আর মাটি’ চলচ্চিত্রে প্রথম সংগীত পরিচালনা করেন। এরপর অসংখ্য চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন, সংগীত পরিচালক হিসেবে। জন্ম নিয়েছে, শত শত জনপ্রিয় গান। ঢাকাই চলচ্চিত্র দর্পচূর্ণ ছবিতে তুমি যে আমার কবিতা/ আমারও বাঁশীর রাগিণী/ আমারও স্বপন আধো জাগরণ/ চিরদিন তোমারে চিনি, ‘আলো তুমি আলেয়া’ চলচ্চিত্রে আমি সাতসাগর পাড়ি দিয়ে, যোগ-বিয়োগ চলচ্চিত্রে এই পৃথিবীর পান্থশালায় গানগুলো মনের গভীরে স্থায়ী আসন করে নেয়।
এরপরই আমরা পেয়ে যাই, সুরকার সত্য সাহাকে। যিনি অসংখ্য চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে সুতরাং, নীল আকাশের নীচে, অশিক্ষিত, আবির্ভাব, ছুটির ঘণ্টা, অমর প্রেম, আগুনের পরশমণি, দীপু নাম্বার টু ছবি উল্লেখযোগ্য। এসব চলচ্চিত্রের অনেক গান সমাদৃত হয়েছে মানুষের কাছে।
১৯৬০-এর দশকে দেবু ভট্টাচার্য পাকিস্তানের কণ্ঠশিল্পী গজল সম্রাট মেহেদী হাসান, সুরাইয়া মুলতানীকর ও আহমদ রুশদী এবং বাঙালি সংগীতশিল্পীদের মধ্যে বশির আহমেদ, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, ফেরদৌসী রহমান, রুনা লায়লা প্রমুখের মাধ্যমে উপমহাদেশে বাংলা সংগীত ও সংস্কৃতিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
খন্দকার নুরুল আলম স্বনামধন্য সংগীত পরিচালক ও সুরকার। তার সুর করা চোখ যে মনের কথা বলে, আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে, এতো সুখ সইবো কেমন করে, তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে ইত্যাদি জনপ্রিয় গানের কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও সমাদৃত। তার চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা শুরু হয় উর্দু চলচ্চিত্র দিয়ে। প্রথম সুরকৃত চলচ্চিত্র ইস ধরতি পার। বাংলা চলচ্চিত্রে সুর ও সংগীত পরিচালনা শুরু করেন ১৯৬৮ সালে, অন্তরঙ্গ ও যে আগুনে পুড়ি দিয়ে।
১৯৭০ সালে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানে সুরারোপ করে, আনোয়ার পারভেজ বাঙালির হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেড়ে নেন। ১৯৭০ সালেই খান আতাউর রহমান (খান আতা) ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির বিভিন্ন গানে সুরারোপ করে, সংগীত বোদ্ধাদের নজর কাড়েন। এই ছবির ‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে’ গানটির কণ্ঠশিল্পীও তিনিই ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সমর দাস, মুজিবনগর থেকে পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ও প্রধান পরিচালক ছিলেন। এ সময় বহু গানে তিনি সুর দেন। তার সুর করা গান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও দেশবাসীকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। মুক্তিযুদ্ধে তার সুর করা ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’ প্রভৃতি গান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে।
এরপর আমরা পাই, সুরকার প্রণব ঘোষ ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। তারা চলচ্চিত্রে তেমন সক্রিয়ভাবে যুক্ত না থাকলেও, বাংলাদেশের অডিও শিল্পে স্থায়ী আসন করে নেন। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরারোপিত ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না/ আমি গাইবো’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ টেলিভিশনে ৮টা ও ১০টার সংবাদের আগে এই গানের মিউজিক মানুষের হৃদয়ে সৃষ্টি করে অন্যরকম দ্যোতনা।
নবীন সুরকার: শওকত আলী ইমন, বাপ্পা মজুমদার, প্রিন্স মাহমুদ, রাজেশের সুরে বেশকিছু গান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হারিয়ে যাওয়া সুরকার-সংগীত পরিচালকের উত্তরসূরি হিসেবে, একদিন এইসব গুণী সুরকারও ঠাঁই নেবেন ইতিহাসের পাতায়।
আগের ইনিংসের মতোই ব্যর্থ উসমান খাজা। পারেননি ডেভিড ওয়ার্নারও। প্রথম ইনিংসের দুই সেঞ্চুরিয়ানও ফিরে গেছেন। দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিংয়ে তাই খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই অস্ট্রেলিয়া। তবুও তৃতীয় দিন শেষে এগিয়ে আছে তারা।
ওভালে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতকে ২৯৬ রানে আটকে দেওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ উইকেট হারিয়ে ১২৩ রান করে অসিরা। এগিয়ে আছে ২৯৬ রানে।
দ্বিতীয় ইনিংসে বোলিংয়ের শুরুটা ভালো করেছে ভারত। অস্ট্রেলিয়াকে চেপে ধরেছে তারা।
দুই ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার ও উসমান খাজা ফেরেন ২৪ রানের মধ্যেই। মারনাস লাবুশান ও স্টিভেন স্মিথের ৬২ রানের জুটি ভাঙেন রবীন্দ্র জাদেজা, পরে ট্রাভিস হেডকেও ফেরান এই স্পিনার। টেস্ট ক্যারিয়ারে অষ্টমবারের মতো স্মিথকে আউট করেছেন জাদেজা।
তৃতীয় দিন শেষে মারনাস লাবুশানের সঙ্গে অপরাজিত আছেন ক্যামেরুন গ্রিন।
সংক্ষিপ্ত স্কোর: অস্ট্রেলিয়া: ৪৬৯ ও ৪৪ ওভারে ১২৩/৪ (লাবুশেন ৪১*, স্মিথ ৩৪; জাদেজা ২/২৫, উমেশ ১/২১)ভারত ১ম ইনিংস: ৬৯.৪ ওভারে ২৯৬ (রাহানে ৮৯, শার্দূল ৫১, জাদেজা ৪৮; কামিন্স ৩/৮৩, গ্রিন ২/৪৪, বোল্যান্ড ২/৫৯)।
আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিজের পালন করা সাড়ে ২১ মণ ওজনের গরু উপহার দিতে চেয়েছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার চরকাউনা গ্রামের সাধারণ কৃষক বুলবুল আহমেদ ও তার স্ত্রী ইসরাত জাহান। তাদের এই ভালোবাসার প্রতি সম্মান জানিয়ে উপহারের এই গরু গ্রহণে সম্মতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
শুক্রবার (৯ জুন) সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি কৃষিবিদ মশিউর রহমান হুমায়ুন বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী উপহারের গরু গ্রহণে সম্মতি দেন।
প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী খুশি হয়েছেন এবং এই বিরল ভালোবাসার জন্য বুলবুল আহমেদ ও তার স্ত্রীকে ধন্যবাদ দেন।
হাসান জাহিদ তুষার জানান, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা এই গরু বুলবুল আহমেদের নিজ বাড়িতেই থাকবে এবং সেখানেই কোরবানি হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোরবানির গরুর মাংস স্থানীয় দরিদ্র-অসহায় জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
গরুটি ক্রস ব্রাহমা প্রজাতির। এতে আনুমানিক ৮০০ কেজি মাংস হতে পারে বলে জানিয়েছেন বুলবুল আহমেদ। বুলবুল জানান, ২০২০ সালে নেত্রকোনা জেলা থেকে আড়াই লাখ টাকায় প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেওয়ার জন্য তিনি এই গরু কেনেন। গরু কেনার পর কিশোরগঞ্জের বিখ্যাত পাগলা মসজিদে পাঁচ হাজার টাকা মানতও করছিলেন তিনি যেন তার গরুটি সুস্থ থাকে।
তিনি আরও জানান, তিনি ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে মাঠকর্মী হিসেবে কর্মরত তার স্ত্রী ইসরাত জাহান আওয়ামী লীগ সরকারের একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্প থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে এবং নিজের জমানো টাকা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্য এই গরু কেনেন। তারা গত তিন বছর গরুটির নিবিড় পরিচর্যা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আবেগ ও ভালবাসা থেকে তারা এই গরু ক্রয় ও লালন পালন করেছেন বলে জানান।
উপহার হিসেবে তার গরুটি গ্রহণ করার সম্মতি দেওয়ায় বুলবুল আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। বুলবুল আহমেদ কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
ষাটের দশকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের আগুন তরুণদের বুকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠান ক্ষেত্র তৈরি করতে গড়ে তুলেছিলেন ‘নিউক্লিয়াস’। স্বাধীনতার পর তিনি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের বাঁধভাঙা ঢেউ তুলেছিলেন। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সবকিছু থেকে দূরে আড়ালে চলে যান। রাজনীতিতে তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল রহস্য। সেই রহস্য নায়ক সিরাজুল আলম খান চলে গেলেন চিররহস্যের দেশে।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠক গতকাল শুক্রবার দুপুর আড়াইটার কিছু পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক।
সিরাজুল আলম খানের ব্যক্তিগত সহকারী রুবেল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অসুস্থ অবস্থায় তাকে রাজধানীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে প্রথমে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে গত ১ জুন নেওয়া হয় আইসিইউতে। এরপর গত বৃহস্পতিবার রাতে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন সিরাজুল আলম খানের জন্ম নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে, ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি। তার বাবা খোরশেদ আলম খান ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন গৃহিণী ছিলেন। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সিরাজুল আলম খান।
১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদক হন সিরাজুল আলম খান। ১৯৬৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করেন।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান (মান্না), জনসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণ অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক (নুর)।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তার আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান তিনি। শোক জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন সংগঠন।
প্রয়াত সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠ ও নাট্য পরিচালক সাকিল সৈকত দেশ রূপান্তরকে বলেন, সিরাজুল আলম খানের মরদেহ বিকেলে হাসপাতাল থেকে মোহাম্মদপুরের আল-মারকাজুলে নেওয়া হয়েছে। সেখানে গোসল শেষে রাতে শমরিতা হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে। আজ শনিবার সকাল ১০টায় বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে জানাজা শেষে নোয়াখালীতে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে পুনরায় জানাজা শেষে বেগমগঞ্জের আলীপুরে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হবে রাজনীতির এ নায়ককে।
১৯৪১ সালে জন্ম নেওয়া এ কিংবদন্তি রাজনীতিককে বিগত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত হাসপাতালে যেতে হয়েছে। দেশে এবং বিদেশে দীর্ঘ সময় চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি।
জন্মের কয়েক বছর পর পিতার চাকরির সুবাদে সিরাজুল আলম খুলনায় চলে যান। ১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে এসএসসি ও ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অনার্স ডিগ্রি অর্জনের পর কনভোকেশন মুভমেন্টে অংশ নেওয়ার কারণে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনায় ১৯৬২ ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। পরে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা। বঙ্গবন্ধুরও ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন এ ছাত্রনেতারা। ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন সিরাজুল আলম খান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন তিনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি কখনো নেতৃত্বে না এলেও জাসদ নেতাদের পরামর্শ দিয়ে তাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে খ্যাতি পান। অনুসারী সবাই তাকে ‘দাদা ভাই’ নামেই ডাকতেন।
মূলত নব্বইয়ের দশকে সিরাজুল আলম খান কখনো জনসমক্ষে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন না; আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিতি পান। নব্বই পর্যন্ত একাধিকবার জেল-জুলুম খেটেছেন তিনি।
দাদা ভাইয়ের মৃত্যুত গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চেয়ারপারসন অধ্যাপক আলতাফুন্নেসা, গণফোরাম একাংশে সভাপতি মোস্তফা মোহসিন মন্টু ও সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান।
বেশ ক'দিন তীব্র তাপদাহের পর গতকাল রাজধানী ঢাকাজুড়ে হয়েছে স্বস্তির বৃষ্টি। এতে তাপমাত্রা এসেছে কমে, পরিচ্ছন্ন হয়েছে পরিবেশ। তবুও আজ সকালে বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষ পাঁচে আছে ঢাকা। বৃষ্টিধোয়া রাজধানী ঢাকা আজ সকাল সাড়ে ৮টায় ১৫৫ স্কোর নিয়ে দূষণের তালিকায় চতুর্থ।
আজ শনিবার (১০ জুন) সকাল সাড়ে ৮টায় বায়ুমানের সূচক (একিউআই) অনুযায়ী ঢাকায় বাতাসের স্কোর ছিল ১৫৫। বায়ুর মান বিচারে এ মাত্রাকে 'অস্বাস্থ্যকর' বলা হয়। একই সময়ে একিউআই স্কোর ১৬৮ নিয়ে প্রথম অবস্থানে আছে পাকিস্তানের লাহোর। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভিয়েতনামের হ্যানয়, স্কোর ১৫৬। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইসরায়েলের তেলআবিব। আর পঞ্চম স্থানে আছে চীনের শেংডু, স্কোর ১৪৯।
একইসময়ে ১৩৮ স্কোর নিয়ে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহেনেসবার্গ। ১৩২ স্কোর নিয়ে সপ্তম স্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। অষ্টম নেপালের কাঠমান্ডু, স্কোর ১২৭। ১১৮ স্কোর নিয়ে নবম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট আর ১১৭ স্কোর নিয়ে দশম সৌদি আরবের রিয়াদ।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার দূষিত বাতাসের শহরের এ তালিকা প্রকাশ করে। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই স্কোর একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের কোনো ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে কি না, তা জানায়।
তথ্যমতে, একিউআই স্কোর শূন্য থেকে ৫০ ভালো হিসেবে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ মাঝারি হিসেবে গণ্য করা হয়। আর সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত 'অস্বাস্থ্যকর' হিসেবে বিবেচিত হয়। একইভাবে একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে থাকলে 'খুব অস্বাস্থ্যকর' এবং স্কোর ৩০১ থেকে ৪০০ এর মধ্যে থাকলে 'ঝুঁকিপূর্ণ' বলে বিবেচিত হয়।
কুমিল্লার বরুড়া উপজেলায় ১২ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে মো. রহুল আমিন (৫৬) নামের এক ব্যক্তিকে আটক করেছে পুলিশ।
শুক্রবার (৯ জুন) শিশুটির বাবা বাদী হয়ে বরুড়া থানায় মামলা করলে তাকে আটক করা হয়।
আটক মো. রহুল আমিন উপজেলার ঝলম ইউনিয়নের বেওলাইন গ্রামের মৃত আব্দুল হকের ছেলে।
ঘটনা সত্যতা নিশ্চিত করে বরুড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. ফিরোজ হোসেন বলেন, ধর্ষণের শিকার শিশুটির বাবা বাদী হয়ে বরুড়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা রুজু করেছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে ধর্ষককে আটক করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়।
মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ মার্চ ভোর আনুমানিক ৬টায় দিকে উপজেলার ঝলম ইউনিয়নের বেওলাইন গ্রামে ১২ বছরের শিশুকে গোয়ালঘরের পেছনে ধর্ষণ করেন মো. রহুল আমিন। এবিষয়ে এতোদিন জানাজানি না হলেও ৪ জুন (রোববার) হঠাৎ শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে পরিবারের লোকজন স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। সেখানে পল্লী চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যাওয়ার পর পরীক্ষা করে কর্তবরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসা জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ প্রদান করেন। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত হন। তারপর ভুক্তভোগী শিশুর পরিবারকে বিষয়টি জানান। ভুক্তভোগী শিশুটি এখন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের মেয়ে অর্পিতা শাহরিয়ার কবির মুমুর (৪১) ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মৃত্যুর আগে তিনি চিরকুট লিখে গেছেন। তবে সেখানে কি লেখা আছে তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি।
বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর মহাখালীর আমতলী এলাকার বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। রাতেই পরিবারের দাবির প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়ায় মরদেহ হস্তান্তর করেছে পুলিশ। বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. জাহাঙ্গীর আলম। পুলিশের ধারণা, অর্পিতা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ বাসা থেকে লাশটি উদ্ধার করে। পরে স্বজনের অনুরোধে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়।
জানা গেছে, লন্ডনে আইন বিষয়ে পড়ালেখা করতেন অর্পিতা। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মা ফাতেমা কবিরের মৃত্যুর কারণে তিনি দেশে আসেন। এরপর দেশেই ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পর মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ ছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার তার লণ্ডনে ফেরার কথা ছিল। মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া একটি চিরকুটে (সুইসাইড নোট) তিনি আত্মহত্যার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
মেয়ের মৃত্যুতে শোকে বিবহবল লেখক–কলামিস্ট শাহরিয়ার কবির গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। তবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল বলেন, রাজধানীর মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে অর্পিতাকে তাঁর মায়ের কবরে দাফন করা হয়েছে। রবিবার তাঁর কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের মেয়ে অর্পিতা শাহরিয়ার কবির মুমুর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (৮ জুন) রাতে বনানীর বাসা থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। রাতেই পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করেছে পুলিশ।
তবে কী কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।
শুক্রবার সকালে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বনানীর একটি বাসা থেকে অর্পিতা শাহরিয়ার কবির মুমুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়, যা ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। পরে রাতেই পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।
এর আগে, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে স্ত্রী হারান শাহরিয়ার কবির।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’