
শাস্ত্রীয় সংগীতের আধুনিক ইতিহাস এবং উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এক রেখায় বয়নি। তারই ধারাবাহিকতায় বোধ করি অবিভক্ত বাংলার, বর্তমান বাংলাদেশ অংশে জন্ম নিয়েছেন, রাগ সংগীতের এমন মহান শিল্পীদের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে আমাদের ইতস্তত করতে দেখা যায়। তার ওপর, কাকে কোন বর্গে ফেললে যথাযথ হয়, তাই নিয়েও বিশেষজ্ঞরা সংকটে পড়েন। যে শিল্পী জন্মেছেন পদ্মার পাড়ে কিন্তু প্রশিক্ষণ ও গুণের কদর পেয়েছেন কলকাতায়, তিনি কতটা আমাদের, আর কতটা ‘ওদের’? যে শিল্পী জন্মেছেন লাহোরে, গাণ্ডাবদ্ধ শিষ্য হয়েছেন উর্দুভাষী উস্তাদের, আর মুক্তিযুদ্ধের পর পাকাপাকিভাবে চলে এসেছেন ঢাকায়, তিনি কি ঢাকার শিল্পী নাকি লাহোরের শিল্পী?
গানকে গানের মতোই শিখতে গিয়ে বা গাইতে গিয়ে বা শুনতে গিয়ে সংগীততত্ত্ব নিয়ে আমরা ভাবি না; ভাবি না রাজনীতি নিয়েও। ওইসব বিতর্ক চলবেই। তাই ওইসবকে সরিয়ে রেখেই আমাদের মাটি থেকে উঠে আসা, তর্কাতীতভাবে প্রণম্য পাঁচজন শিল্পীর কথা অল্প কিছু শব্দে লিখে রাখতে চাই। এই তালিকা মূলত আমার নিজের পছন্দের অনুসারী, তবে এতে শুধু আমার রুচিগত পক্ষপাতই আছে, এমনটা মনে করি না। এতে শিক্ষার্থী হিসেবে আমার নিজের চর্চা ও আমার গুরুদের হাতে পাওয়া কিছু সাংগীতিক বিচারও প্রতিফলিত হয়েছে। তালিকাটি গবেষকদের কোনো কাজে আসবে না বলেই মনে হয়; এতে একেবারেই গানপ্রিয় মানুষদের কথা মাথায় রেখেছি : অভিজ্ঞতা বলে, এই মানুষেরা রাগ সংগীতকে বৈয়াকরণিকের জ্ঞান দিয়ে বুঝুন কিংবা না-বুঝুন, রসগ্রাহী শ্রোতা হওয়ার উৎসাহ তাদের আছে।
মহাকাব্যে পাঁচ প্রাতঃস্মরণীয় নারীর কথা বলা হয়েছে অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা, মন্দোদরি, এই পাঁচজন হচ্ছেন ‘পঞ্চকন্যা’। সেইমতো এই পাঁচজনও, পঞ্চরত্ন; প্রাতঃস্মরণীয় বললেও বেশি বলা হয় না।
১) বাবা আলাউদ্দিন খাঁ : ১৮৬২ সালে জন্ম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সত্যিকার অর্থেই যাকে ‘পলিম্যাথ’ অর্থাৎ বহু মাধ্যমে কৃতবিদ্য বলা যায়, আমাদের সর্বজনাব ‘বাবা’ আলাউদ্দিন খাঁ, সেই উচ্চতার শিল্পী। সেতার, সানাই, সরোদ, বেহালা, বাঁশি, মৃদঙ্গ, রবাব সঙ্গে আরও-আরও বাদ্যযন্ত্রের সম্ভাবনাকে উন্মোচন করার এক বিস্ময়কর অভিযানে ছিলেন তিনি। তার হাতে তৈরি হয়েছেন অসংখ্য যুগস্রষ্টা ও গুণিজন। পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আলি আকবর খাঁ (পুত্র), অন্নপূর্ণা দেবি (কন্যা), পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি, পণ্ডিত ভি জি যোগ, বিদূষী শরণ রানি এদের প্রত্যেকের শিল্পী হয়ে ওঠার শুরু বাবা আলাউদ্দিন খাঁ’র শিষ্যত্ব গ্রহণের মধ্যে দিয়ে। মাইহারের রাজদরবারে সভাবাদক হিসেবে ছিলেন দীর্ঘদিন; সেইভাবেই পত্তন করেন সেনিয়া-মাইহার ঘরানার। শিক্ষক হিসেবে তার মেজাজ ছিল কুখ্যাত: খোদ অন্নদাতা রাজামশাইকেই তবলা পেটানোর হাতুড়ি ছুড়ে মেরেছিলেন, এমন গল্প চালু আছে। সংগীতকারদের রাজা বলেই মান্য করা হয় তাকে। নিজের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় দেখেছি ও শুনেছি যে উপমহাদেশের সংগীতশিক্ষার উচ্চতর পীঠস্থানগুলোতে তাকে রাগদারি ও তন্ত্রকারির গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়। ২০২৩-এ এসেও কোনো নতুন রাগের তালিম নেওয়ার সময় যখন গুরুকে জিজ্ঞেস করি, কার গায়ন বা বাজনা শুনলে রাগের স্বরূপ অনুধাবন করা সহজ হবে, অবধারিতভাবে বাবা আলাউদ্দিনের নাম আসে। মানুষ হিসেবে ও গুরু হিসেবে তিনি কতখানি অবিস্মরণীয় ছিলেন, তার নমুনা পাওয়া যায় রবিশঙ্করের ‘রাগ-অনুরাগ’ গ্রন্থে, ও পুত্র আলি আকবর খাঁ’র ‘আপনাদের সেবায়’ গ্রন্থে। তার সাংগীতিক উৎকর্ষের অজস্র নমুনার মধ্য থেকে ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় জায়গা দিয়েছি রাগ হেম (তার সিগনেচার রাগ) আর রাগ জয়জয়ন্তীকে। জানি না, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার ভিটার যে অংশটুকু ধর্মান্ধ উন্মাদদের হাতে সম্প্রতি তছনছ হয়েছে, তার কতটুকু সংস্কার করা সম্ভব হয়েছে।
২) পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তী : জন্ম ১৯০৯ সালে, ফরিদপুরের কোটালীপাড়ায়। শুরু করেছিলেন তবলা শিল্পী হিসেবে, কিন্তু অমর হয়ে রয়েছেন কণ্ঠশিল্পী হিসেবে অনন্য অবদানের জন্য। তার গায়নের অসংখ্য নমুনা হয়তো সেইভাবে সংরক্ষিত হয়নি (যদিও ইউটিউবে ছায়া-হিন্দোল ও ছায়ানট রাগসহ বেশ কয়েকটা পরিবেশনা আছে), তবে তার সাংগীতিক যাত্রা জনশ্রুতিতে ধরা আছে। সতের বছর বয়সে কলকাতা যাত্রা করলেও শাস্ত্রীয় সংগীতের পথে তাকে অজস্র ঘাত-প্রতিঘাতের সামনে পড়তে হয়েছিল। বেতারে চাকরি করেছেন বেশ কিছুদিন, তার আগে শরণার্থী হিসেবে কুলিগিরি আর বাড়ি-বাড়ি চাল বিক্রি করার কাজও করেছেন। বার্ধক্যে এসে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী খেতাব ফিরিয়ে দেন, হয়তো অল্প বয়সের সংগ্রামের কথা ভুলতে পারেননি বলেই। বিষ্ণুপুর আর কিরানা ঘরানার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন তিনি নিজের গানে; একই সঙ্গে বাংলা খেয়াল গানের ধারাও তার প্রবর্তিত। তার অজস্র সুযোগ্য শিষ্যের মধ্যে আছেন পণ্ডিত মানস চক্রবর্তী ও বিদুষী শ্রীলা চক্রবর্তী (দুই সন্তান)। আরেকটু কম গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু চমৎকার তথ্যাণু হচ্ছে : এখনকার কবি শ্রীজাত, পণ্ডিত তারাপদরই দৌহিত্র।
৩) পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ : ১৯১১ সালে জন্মেছেন, অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলায়। মূলত তার কারণেই বাদ্যযন্ত্র হিসেবে বাঁশিকে “পল্লীগ্রামের ব্যাপার-স্যাপার” বলে অন্ত্যজ করে দেখার আর উপায় রইল না। পেশাগত জীবনের প্রথম অধ্যায়ে থিয়েটার কোম্পানিতে কাজ করেছেন, সংগীতায়োজক হিসেবে বম্বের সিনেমাতেও কাজ করেছেন। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ’র সংস্পর্শে এসে নিমরাজি বাবাকে রাজি করিয়ে অতঃপর মার্গ সংগীতের উচ্চতর জ্ঞানে ঋদ্ধ হয়েছেন। তার সবচেয়ে স্মরণীয় কীর্তি হলো বাদ্যযন্ত্র হিসেবে বাঁশিকে ভেঙে নতুন করে গড়া। বাঁশির যে আধুনিক রূপটি আমরা দেখি, সেটি পান্নালাল ঘোষের উদ্ভাবন। ৩২ ইঞ্চি আকৃতির সাত ছিদ্রবিশিষ্ট বাঁশির প্রথম প্রচলন তিনিই করেছিলেন। এর আগে ‘সোলো ইন্সট্রুমেন্ট’ অর্থাৎ একক বাদনের যন্ত্র হিসেবে রাগ সংগীতে বাঁশির কোনো জায়গাই ছিল না। বছর কয়েক আগে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়াম যেদিন ভেঙে পড়ল পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাজনা শুনতে, সেইদিন বরিশালের ছেলে পান্নালালও হয়তো সেই কীর্তির অংশভাক হয়েছিলেন।
৪) পণ্ডিত রাধিকা মোহন মৈত্র : রাজশাহীর জমিদার পরিবারে জন্ম ‘রাধুবাবু’র, ১৯১৭ সালে। পুরো উপমহাদেশের সরোদ বাদনকে তিনি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন – শিল্পী এবং গুরু, দুই ভূমিকাতেই। তার সবচেয়ে বিখ্যাত শিষ্য পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর (অধুনা-প্রয়াত) মুখ থেকে তার সাধনা ও শিষ্যদের প্রতি পিতৃসুলভ প্রশ্রয়ের গল্প শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। শিল্পী হিসেবে তার মধ্যে সত্যিকারের আন্তর্জাতিকতাবাদ ও আঞ্চলিকতার মিশ্রণ ঘটেছিল: যেমন দাপটে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অভ্যাগত কলাকার হিসেবে বাজিয়ে গেছেন, তেমনই নিবেদনের সঙ্গে মেধাবী-তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়ে গেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর শিক্ষালাভ করেছিলেন, গবেষক ও সংগীততাত্ত্বিক হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। ইউটিউবে কাফি রাগের ওপর তার এগার মিনিট একচল্লিশ সেকেন্ডের একটা গৎ আছে (ঝাঁপতালের ওপর নিবদ্ধ)। আমার ব্যক্তিগত জীবনযুদ্ধের অ্যান্টিডোট সেই বাজনাটি।
৫) উস্তাদ বিলায়েত খাঁ : গৌরীপুরের (ময়মনসিংহ) বিলায়েত খাঁকে বলা যায় সমগ্র উপমহাদেশের সেতারবাদনের শেষ কথা: ‘গায়কি-অঙ্গের’ শিরোমণি। ১৯২৮ সালে জন্মেছেন, পঞ্চরত্নের বাকি চারজনদের অনুজ তিনি; তাই তার অসংখ্য বাজনার রেকর্ড উচ্চমানের শ্রাব্যতার সুবিধাসহ শুনতে পাওয়া যায়। ইমদাদখানি ঘরানায় সেতার-সুরবাহার বাজিয়েছেন; উপমহাদেশের আধুনিক ইতিহাসে দীর্ঘতম পারিবারিক সংগীতপরম্পরার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সেতারকে নিজের মতো ভেঙে গড়েছেন তিনিও; মানুষের কণ্ঠ যেমন সুরসৃষ্টি করতে পারে, সেতারে সেই আওয়াজের ও সেই মেজাজের সুর উৎপাদন করতে পারার মতো অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। তার বাজনা বেছে শুনতে গেলে অজস্র বৈচিত্র্যময় রাগের মধ্যে আমি বেছে নিই বড়-বড় আদি রাগ: ইমন, তোড়ি, দরবারি, ভৈরবী।
অনেকেই বলে থাকেন, উপমহাদেশের রাগ সংগীতের চর্চা, সাধনা এবং পরিবেশনের ধারায় বিভিন্ন শ্রেণি, ধর্ম ও জাতির যে সংশ্লেষ ঘটেছে, সংস্কৃতির অন্য কোনো মাধ্যমে তা বিরল। মহারাষ্ট্রের নিরামিষভোজী ব্রাহ্মণ থেকে শুরু করে, এক বসায় একখানা আস্ত বাছুর খেয়ে ফেলা খাঁ সাহেব: সংগীত মোটামুটিভাবে সবাইকেই জায়গা দিতে পেরেছে। সংগীতের এই ধারার উৎকর্ষের ইতিহাসে জমিদারনন্দন যেমন পাওয়া যাবে, অন্ত্যজ শ্রেণি থেকে উঠে আসা সাধক-সাধিকাও পাওয়া যাবে। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে যদিও জীবৎকালে তাদের সবার তুলনামূলক আর্থসামাজিক ক্ষমতা সমান ছিল না, শ্রেণিবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য আর প্রাদেশিকতায় যদিও ভুগতে হয়েছিল অনেককেই, তবু সময় সেই ভঙ্গিলতাকে অনেকাংশে সমান করে দিয়েছে; কারণ সময় মূলত সংগীতকেই ধারণ করেছে, প্রতিভাকেই মনে রেখেছে। আর কে না জানে, আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে আমাদের সময়েরই সন্তান? সন্তানের অধিকারে তাই আজ, যারা সত্যিই চিহ্ন রেখে গেছেন, তাদের অবদানকে স্মরণ করলাম।
এ শহরে প্রকাশ্যে গান গাওয়ার জায়গাগুলো যেন বেশ কমে গেছে। আকাশছোঁয়া দালানের প্রকোপে খেলার মাঠের মতোই গানের মঞ্চগুলো যেন উধাও হয়ে যাচ্ছে! ঢাকাতে গাড়ির তীব্র হর্নের মধ্যে গান শোনা তো আসলে অসম্ভবই বটে। শব্দদূষণ বাদেও ওপেন এয়ার কনসার্ট এখন খুব অপ্রতুল। নাগরিক শ্রোতা ও গায়কদের ভেতরে সুষম সংমিশ্রণের জায়গা খুবই অল্প। তবুও তরুণরা বসে নেই, নতুন অনেক গান তারা তৈরি করছে, প্রকাশ করছে এবং বিভিন্ন মঞ্চে পরিবেশনা করে চলেছে। আপনার কাছে বিকল্প সেইসব মঞ্চের খোঁজ আছে তো? সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইন প্লাটফর্মে গান প্রকাশ করার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার ফলে শ্রোতা এবং শিল্পীর সাধারণ মিলন খুব কম ঘটে। এই লেখাতে ঢাকার অন্যরকম কিছু মঞ্চ নিয়ে আমি কথা বলব যেখানে গায়ক এবং শ্রোতার বাস্তব ও ভার্চুয়াল এই উভয় যোগাযোগই হয়ে থাকে।
ঝিড়ঝিড় ক্যাম্পফায়ার সেশন
২০২২ সালের শেষে শীতকাতুরে সন্ধ্যায় যখন ধলেশ্বরী কায়াকিং রিসোর্টে ঢুকে ঝিড়ঝিড় ক্যাম্পফায়ার সেশনের সেটে যাই তখন বেশ নাটকীয় লাগে পরিবেশটা। দুটি তাঁবু টাঙানো এবং দুপাশে দুটি মশাল জ্বলছে! দুই তাঁবুর ঠিক মাঝ বরাবর ফাঁকা জায়গাটিতে একটি গাছের গুঁড়িতে বসে গায়ক গান গাইবে! পাশেই স্রোতস্বিনী ধলেশ্বরী নদী, আকাশ ভর্তি ঝিকিমিকি অজস্র তারা! নদীর ওপর পেতে রাখা মাচাতে অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে তারা দেখলাম। অনেকক্ষণ গুনগুন করে গান গাইলাম! দু-একটা জোনাক পোকা ঢুকে গেল যেন ঠিক আমার মাথার ভেতরে! মশালের দপদপে আগুনের পাশে নড়ছে আমার ছায়া! ঠিক সে সময়ে আমার ডাক এলো! কিবোর্ডে ছিল জাফরি, হারমোনিতে রুদ্র, আর ভারতীয় মুদ্রায় ঘাসের গালিচায় বসে ভায়োলিন বাজাল প্রাঞ্জল! অ্যাকশন শব্দ শুনে চোখ বন্ধ করে গেয়ে উঠলাম ‘চোখ মেলেছি যেই’! ঝিড়ঝিড় ক্যাম্প ফায়ার সেশনে ঠিক এমনটাই ছিল আমার গানের দৃশ্যপট!
প্রতি বছর শীতে ঝিড়ঝিড় আয়োজন করে ক্যাম্পফায়ার সেশন। ঝিড়ঝিড় একটি অডিও ভিজ্যুয়াল প্ল্যাটফর্ম। ঝিড়ঝিড়ের প্রোডিউসার জাফরি আবেদীন নিজেও একজন মিউজিশিয়ান। সহজিয়া ব্যান্ডের বেস গিটারিস্ট হিসেবে সে কাজ করছে অনেকদিন হলো। পাহাড়ি ম্রো শিশুদের শিক্ষার সহায়তায় পাওমুম থারক্লা স্কুলের তহবিল সংগ্রহের জন্য তারা আয়োজন করেছিল ‘পাওমুমের জন্য গান’। সেই কনসার্টেও আমি গান গেয়েছিলাম।
ঝিড়ঝিড়ের প্লাটফর্ম থেকে অচিরেই বের হচ্ছে আমার সালো অ্যালবাম ‘বাতিঘরে রাত জাগা প্যাঁচা’। এই অ্যালবামের প্রথম গান “প্লাস্টিকে ডুবে আছি”। ঝিড়ঝিড় ইউটিউব চ্যানেল : https://www.youtube.com/@ZhirZhir হাতিরপুল সেশনস
২০১৯ সালের একটি শীতের সকালে আমি তুহিন এবং নাঈম মাহমুদ দেখা করলাম হাতিরপুল কাঁচাবাজারের সামনে। তারপর ছয় তালা সিঁড়ি ঠেঙিয়ে উঠে পড়লাম হাতিরপুল সেশনসের আঁতুড় ঘরে। এর ঠিক তিন দিন আগে আমাকে কল দিয়েছিল হাতিরপুল সেশনস-এর কিউরেটর অনিরুদ্ধ অনু। সে জানাল তারা একটি এভি প্লাটফর্ম করেছে যারা মূলত নিজেদের গান নিয়ে কাজ করছে তাদের জন্য, এছাড়াও ভিন্নধর্মী কভারেও তারা আগ্রহী। সবিনয়ে জানতে চাইল আমি গান করব কি না। আমি সানন্দে জানালাম অবশ্যই করব। তখন হাতিরপুল সেশনস-এর প্রথম সিজনের শ্যুট চলছে, ছাদের উন্মুক্ত সেটে টাঙানো তারে ক্লিপ দিয়ে আটকানো, শার্ট, জামা-কাপড়, প্যান্ট, ওড়না, বাচ্চার ছোট ছোট পাজামা, মোজা ইত্যাদি শুকাচ্ছে। ঢাকার যেকোনো ছাদের রঙিন বাস্তবতার সাধারণ চিত্র এটি। পরিবেশন আর ঢংটি খুবই ভালো লেগে গেল, কেননা নাটক সিনেমা কিংবা হাল আমলের সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্টে যেরকম অতি নাটকীয় জিনিসপত্র দেখি সেরকম কোনো কিছুই এরা রাখেনি। বরং বাস্তবতাকে রঙিন করেছে হাতির পুলের সচেতন নির্দেশনা। একটি জুম রেকর্ডারের সামনে গেয়ে ফেললাম গান, পেছনে অনেক বিল্ডিং-এর ব্যাক ড্রপ নিয়ে এবং একটা বিশাল আকাশ মাথার ওপর রেখে হাতিরপুল সেশনসের প্রথম সিজনে গেয়েছিলাম চিত্রকর গানটি।
২০২২ এর দ্বিতীয় সিজনের পরিবেশনায় একটু ভিন্নতা এনেছে হাতিরপুল সেশরস। এবার একটা ঘরের ভেতরে সেট। রঙতুলির ব্যবহার করে ছাদের হলুদ-কমলা রোদটাকে ওরা ঘরে নিয়ে এলো। এবার তারা হাউজব্যান্ড স্টাইলে কাজ করছে। আর লাইভ রেকর্ডিং সিস্টেমেও এসেছে অভিনবত্ব এবং পেশাদারিত্ব। জুমের বদলে এবার সাউন্ড কার্ড, ল্যাপটপে উঅড এবং সিনেমাটোগ্রাফিতে দুটি ক্যামেরা। এই কাজে ওদের কোনো স্পন্সর ছিল না। নিজস্ব অর্থায়নে সম্পূর্ণ অলাভজনকভাবেই হাতিরপুল সেশন্স এখনো কাজ করে যাচ্ছে।
যাইহোক। হাতিরপুল সেশনসে এবার হোমব্যান্ড পাওয়ার ফলে আমার সঙ্গে যুক্ত হলো বেস গিটারে অমিত হাসান রুদ্র, লিড গিটারে অনিরুদ্ধ অনু, ড্রামসে হাসিন আরিয়ান ও স্যাক্সোফোনে রাহিন হায়দার। তিন চার দিন প্র্যাকটিস করে শুভ একটা ক্ষণ বেছে আমার গান ‘ বিষাদের পরমাণু’ শ্যুট হয়ে গেল। আর সেটি প্রকাশ পেল ডিসেম্বর ২০২২-এর মাঝামাঝি।
হাতিরপুল সেশনসের গানগুলো রিলিজ হয় তাদের ইউটিউব চ্যানেলে। হাতিরপুল সেশনস হাউজব্যান্ড তাদের প্রকাশিত গানগুলো লাইভেও পারফর্ম করে থাকে।
হাতিরপুল সেশনস ইউটিউব : https://www.youtube.com/@HatirpoolSessions যাত্রা বিরতি
মানুষ যাত্রাপথে একটু জিরোয়, একসঙ্গে এক কাপ চা খেতে খেতে জেনে নেয় সহযাত্রীর যাত্রাহেতু। যদি আড্ডা জমে যায় তাহলে আরও এক কাপ চা কিংবা কফির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও বেশ কিছু খাবারের পদ। সহযাত্রীদের নানান ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এবং দার্শনিক আলোচনায় প্রশমিত হয়ে যাত্রীদের ভ্রমণ অবসাদ, ক্লান্তিতে আনে আবেগের রঙিন ছোঁয়া। আর সেই যাত্রা বিরতিতে যদি গায়ক গেয়ে ওঠে গান তাহলে তো কথাই নেই!! তাই না? ঢাকার প্রচ- ব্যস্ত এই নাগরিক জীবনে আমাদের যেন যাত্রা বিরতির সুযোগ নেই কোনো! আর সেই যাত্রা বিরতির একটি সাংগীতিক সুযোগ পাবেন যাত্রা বিরতির মিউজিক লাউঞ্জে।
বহু বছর আগে বনানীর দেশীয় ফ্যাশন হাউজ যাত্রার ছাদে মিউজিক লাউঞ্জ যাত্রা বিরতির যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে যাত্রার ছাদেই গানের আয়োজন ছিল। তবে বিগত বেশ কয়েক বছর হলো চার তলাতে এখন গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। বহুদিন ধরেই ঢাকাতে অন্যরকম গান শোনার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সবার কাছে জনপ্রিয় এই যাত্রা বিরতির মিউজিক লাউঞ্জটি। মঞ্চে নকশিকাঁথার ব্যাকড্রপে ও আধো আলোর রহস্যময় পরিবেশে গায়কের প্রাণবন্ত গানে গানে নাগরিকদের অত্যন্ত প্রিয় একটি জায়গা এই যাত্রা বিরতি। ছাদে তাদের আছে নিরামিষ প্রধান নানান পদের খাবারের একটি রেস্টুরেন্ট।
গত ৩০ দিনের ভেতরেই যাত্রা বিরতিতে আমি তিনবার গান করলাম তিনটা ভিন্ন অনুষ্ঠানে। ‘মাঘের গান’ ‘স্বায়ত্ত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ এবং ‘বসন্তের গান’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে আমি ছাড়াও ছিলেন আরও অনেকে। মাঘের গানে ছিল ব্যান্ড কাকতাল, সানি অ্যান্ড দ্য রেভলিউশনস, শুভ সুলতান, নাঈম মাহমুদ এবং আকাশ গায়েন। আর স্বায়ত্ত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস কলকাতার একটি স্বনামধন্য ব্যান্ড। বেমানান ব্যান্ডের গুণী শিল্পী ও গায়ক স্বায়ত্ত মল্লিকের আরেকটি ব্যান্ড প্রজেক্ট এটি। গিটারে জুবিন ও ইলেকট্রিক গিটারে উৎসব গুহ ঠাকুরতা ও ভোকালে স্বায়ত্ত এই লাইন আপে স্বায়ত্ত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস পারফর্ম করেছিল যাত্রা বিরতিতে। সেদিন যৌথভাবে আরও গান করেন চেতনা রহমান ভাষা, আসির আরমান ও আমি।
আর বসন্তের গানে গান করেছিল কাকতা সানি অ্যান্ড দ্য রেভলিউশনস, আসির আরমান এবং আমি মুয়ীয মাহফুজ। ‘বসন্তের গান’ ছিল আবেশী গানের আসরের দ্বিতীয় পর্ব। বাংলাদেশের বর্তমান সময়কার নিজের গান নিয়ে এগিয়ে চলা কিছু গায়কদের একটি পরিবেশনার সিরিজ হলো এই আবেশী গানের আসর। আবেশী গান হলো সেই গান যা আপনাকে ভাবাবে, আপনি গায়কের আবেগের সঙ্গে একাত্ম হবেন এবং তার আবেশ রয়ে যাবে আরও অনেক দিন। আবেশী গানের আসরের প্রথম আয়োজন হয়েছিল বারবিকিউ স্কাইলাইন-এর রুফটপে। প্রথমবারে গান করেছিল দ্যা রেহমান ডুও, ব্যান্ড কাকতাল, সানি অ্যান্ড দ্য রেভলিউশনস এবং আমি।
আমার কৈশোর ছিল সাইকাডেলিক রক আর হেভি মেটাল মিউজিকের আবহে নিমজ্জিত। আশির দশকে সামরিক জান্তা আর স্বৈরশাসকের নিপীড়ন আর নিষ্পেষণকালের দোহাই দেব না। কিন্তু রাষ্ট্রকে যদি একটা এস্টাবলিশমেন্ট ধরি তাহলে তার সব রুচিগত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিজের পছন্দ-অপছন্দকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আকাক্সক্ষা তো ছিলই। সেই সময়টা পুরোপুরি প্রতিবাদী মানসিকতার কাছে সমর্পিত ছিল। যার প্রভাব আমরা দেখতে পাই আশির দশকজুড়ে। তবে গ্লোবাল স্পেকট্রামে যেসব সাংস্কৃতিক উপাদান বা এক্সপ্রেশন জনপ্রিয় হয় তার ঢেউ বাংলাদেশ অথবা আরও বিস্তৃত করে বললে ভারতীয় উপমহাদেশের তটে আছড়ে পড়ে এক দশক পরে। পশ্চিমে তখন সাইকাডেলিক রক, অলটারনেটিভ রক কিংবা হেভি মেটাল সংগীতের ধারা জনপ্রিয়তার অংশীদার হয়ে গেছে। মূলধারাকে প্রশ্ন করতে অন্য একটা সাংগীতিক এক্সপ্রেশন তখন প্রতিবাদের স্রোত তৈরির রসদ জোগাচ্ছে। মার্কিন মুলুকে থাকা আফ্রো আমেরিকান জনগোষ্ঠীর তরুণরা এক অন্যরকম জীবনধারণের কথা বলতে শুরু করেছে বর্ণবাদ আর সাদার সুপ্রিমেসিকে নাকচের মধ্য দিয়ে। তাকে বেশির ভাগ ক্রিটিকরা হিপহপ সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করতে শুরু করে। এই সংস্কৃতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল সংস্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে জীবনকে উপভোগ।
বাংলাদেশের মানুষ তখন হিপহপ শুনত না এমন নয়। তখনো হিপ হপ সংস্কৃতি সেই অর্থে দ্যোতনা তৈরি করেনি। এমসি হ্যামার কিংবা ডিজে কুলদের বিটনির্ভর উপস্থাপন শুনতাম। কিন্তু ওইভাবে আকৃষ্ট হয়ে শোনা শুরু হয়নি। আর সংস্কৃতিগত ধারণা থেকেই ওই ঘরানার হিপহপকে ঠিক নিজের মনে হতো না।
হিপহপ সংস্কৃতির বেড়ে ওঠা ডায়াসপোরা আর তার ডিস্টোপিয়ান আগ্রহ থেকে। অভিবাসনের মধ্য দিয়ে যে নিঃসঙ্গ তৈরি হয় তার প্রকাশ ঘটে বিমূর্তকরণে; সামাজিক রুচিবোধকে মেনে না নেওয়ার সে এক তীব্র বহিঃপ্রকাশ। বিংশ শতকের প্রায় শেষভাগে পশ্চিমে আফ্রো আমেরিকান বা আফ্রো ব্রিটিশদের মতো, ইন্দো আমেরিকান অথবা ইন্দো ইউরোপিয়ান তরুণরাও হিপহপ করতে শুরু করে আর জনপ্রিয়তার হাতছানি দেখতে পায়। তাদের একজনের নাম না বললেই নয় সেই অ্যাপাচে ইন্ডিয়ান পশ্চিমা ঘরানার র্যাপ কিংবা হিপহপের সঙ্গে পাঞ্জাবি ইন্ডিয়ান মিউজিকের ফিউশন করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর প্রভাবে কয়েক বছর পর আশরাফ বাবু, পার্থ বড়ুয়া আর আজম বাবু এই তিনজন একটা অ্যালবাম রেকর্ড করে। ত্রিরত্নের খ্যাপা নামের সেই অ্যালবাম শহুরে তরুণদের একটা সুনির্দিষ্ট অংশের মধ্যে ভালোই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাদের গানের মূল বিষয় ছিল পুরনোকে অস্বীকার আর ব্যবচ্ছেদ করে তার অপ্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। কিন্তু এই হিপহপ অ্যালবাম কোনো আন্দোলনের অংশ ছিল না। তিন তরুণ সংগ্রামী ব্যান্ড মিউজিশিয়ান ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইংলিশ অ্যাপাচি ইন্ডিয়ানকে অনুসরণ করে দেখতে চেয়েছিলেন হয়তো। যদি ক্যাসেটের বিক্রিবাট্টা ভালো হতো তাহলে আবার কিছু করা যাবে। কিন্তু তাদের সেই আশার গুড়ে বালি দিয়ে প্রজেক্ট সেখানেই সমাপ্ত হয়।
নব্বইয়ের দশকে মার্কিনি সামাজিক সাংস্কৃতিক কারণেই হিপহপ কিংবা জঅচ সব বর্ণের তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করতে শুরু করে। শুধু আফ্রো আমেরিকান নয় নেটিভ আমেরিকানরাও রাইমিং শুরু করে ভালোভাবেই। এখানে বলে নেওয়া ভালো, জঅচ কোনো শব্দ নয়, এর মূল অর্থ জযুসব ধহফ চড়বঃৎু। ছন্দোবদ্ধ করে কবিতা আবৃত্তির মতো করে গান গাওয়া। এই সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বিনোদনদাতারা। শুরুর সময়টায় হিপহপাররা দর্শকদের সঙ্গে কথা বলে বিট তৈরি করে যোগাযোগ করত। তারা মূলত অনুষ্ঠান পরিচালকের ভূমিকা নিত। এ কারণে অনেক জঅচচঊজ। তাদের নামের আগে ইংরেজি বর্ণ এমসি ব্যবহার করত। বাংলাদেশেও শহুরে তরুণদের একটা গ্রুপ নিজেদের ভেতর জঅচ চর্চা করত, আর তারা নিজেদের নাম পাল্টে এমসি অমুক, এমসি তমুক নামে পরিচিত হতে শুরু করল।
পশ্চিমা যেকোনো বিষয়ের চর্চা যেভাবে বাংলাদেশে শুরু হয় এই ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। রাষ্ট্রের উচ্চবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত শহুরে শিক্ষিত তরুণরাই পুরোধা হলো। তাদের অনুপ্রেরণায় কিছু শহুরে মধ্যবিত্তরাও যুক্ত হলো। পশ্চিমে যেমন বিকল্পধারা হিসেবে যেকোনো সাংস্কৃতিক এক্সপ্রেশন শুরু হয়েছে প্রতিবাদী বা পাল্টানোর মানসিকতা নিয়ে; অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে বসা মানুষ অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য চিৎকার করেছে অথবা ছন্দ তৈরি করেছে। বাংলাদেশে অস্তিত্বওয়ালারাই বরং তাদের ঘোষণা আরও পোক্ত করে এসব নতুন ঘরানাকে অভিযোজন করে। বাংলাদেশি এমসিরা মূলত ঘরে বসে ছন্দ তৈরি করা তরুণ হলেও শুরুতে তারা পাশ্চাত্যের মতো এলাকার দখলের ঘোষণা দিয়ে গালাগাল-সমৃদ্ধ কিছু একটা করত। বেশির ভাগ ইংরেজি মাধ্যমে পড়া আরাম-আয়েশে জীবন কাটানো তরুণদের কণ্ঠে এসব গালাগাল খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি প্রথম দশকের শেষ আর দ্বিতীয় দশকের শুরুতে। কিন্তু সরকারি কলোনিতে বড় হওয়া একদল ছেলে নিজেদের আপটাউন লোকালজ বলে যখন জঅচ করতে শুরু করল, তারা সীমিত পরিসরে হিপহপ চর্চারত ধনিক শ্রেণির জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হলো।
বাংলাদেশে হিপহপের পুরোধারা নিজেদের পরিচয় দিত দেশি এমসি হিসেবে। আপটাউন লোকালজদের নাম ছিল বর্ণময় আবার খানিকটা ডার্ক। তবে এর মধ্য দিয়েই হিপহপ সংস্কৃতির বাংলাদেশ চ্যাপ্টার পূর্ণতা পেল। যদিও উপস্থাপন কিংবা সুরে পশ্চিমের অনুবাদ করত উভয় পক্ষই। নিজস্বতা বলে কিছু ছিল না হিপহপারদের। অন্য রক কিংবা মেটাল মিউজিকের মতোই, অনুকরণপ্রিয় হিসেবেই বাংলাদেশি হিপহপারদের উত্থান।
কিন্তু কেউ কেউ যেন অন্যরকম ভাবে। তাউরা সাফা নাম নিয়ে পরিচিত হওয়া এক জঅচচঊজ তেমনি একজন। পুরান ঢাকায় একেবারে স্ট্রিট কালচারে বড় হওয়া সাফা তার অস্তিত্ব জানান দিল দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝিতে। হিপহপাররা জেগে উঠল। দেশের বিভিন্ন কোণে জঅচ করতে শুরু করল তরুণরা। এ সময়টায় সিলেট, ফরিদপুর, কুমিল্লা এমনকি কক্সবাজারেও নতুন হিপহপাররা তাদের জঅচ ইউটিউবে প্রকাশ করতে শুরু করল। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করে তারা যেন নিজেদের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে ব্যস্ত হলো।
আমি আগে জঅচ বা হিপহপকে মিউজিকের ঘরানা হিসেবে গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু জালালি সেট বলে একটা প্রজেক্টের গান শুনে থমকে গিয়েছিলাম ২০১৬-এর গোড়ার দিকে। এই প্রজেক্টের নেতৃত্ব অথবা মূল প্রণেতা ছিল সেই শুরুর জমানার একজন, যে নিজেকে এমসি মাগজ বলে পরিচয় দিত। উচ্চবিত্ত পরিবারের ইংরেজি মাধ্যমে পড়া এই এমসি সমাজের নানা স্তরের আরও চারজন হিপহপারের সঙ্গে মিলে বেশ কিছু ট্র্যাক তৈরি করল। এবার যেহেতু জঅচ-এর একটা ভূমি তৈরি ছিল তাই গালাগাল নিয়ে সমস্যা হলো না। কিন্তু তারা নাড়া দিল সমাজের প্রচলিত নানা সংস্কার নিয়ে। দলবাজি না করেও কেমন রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করা যায় এস্টাবলিশমেন্টকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তার নমুনা হিসেবে একেকটা ট্র্যাক যেন নিজের সঙ্গে পাল্লা দিল।
পরে যারা হিপহপ সংস্কৃতি অথবা জঅচ তৈরির চেষ্টা করছে তাদের অনেকে এই সংস্কৃতিকে জড়িয়ে নিয়েছে নিজেদের জীবনবোধে। আবার অনেকে এটাকে শুধু একটা এক্সপ্রেশন হিসেবে দেখেছে। তবে একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, বাংলাদেশের জঅচচঊজরা এখন শুধু প্রতিবাদ কিংবা পরিবর্তনের কথাই বলে না, তাদের ছন্দোবদ্ধতায় কবিতা তৈরি হয়। তাদের শরীরী ভঙ্গিতেও দেশি ভাব দেখা যায়। দেশি পুঁথিপাঠ কিংবা কবির লড়াইয়ের ধরনে তারা ব্যাটল রাইম করে। সম্ভবত দেশের অনেক হিপহপারই নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে নিজস্ব ধরন তৈরি করেছে। পশ্চিমের অনুকরণ না করে, অনুগত না থেকে কীভাবে একটা সাংস্কৃতিক এক্সপ্রেশনকে নিজেদের করে নেওয়া যায় তার নিদর্শন হিসেবে আপনারা বাংলাদেশি হিপহপার কিংবা জঅচচঊজদের কথা বলতে পারেন নিঃসংশয়ে।
একুশ শতকের প্রথম দশকেই নতুন স্বাদের যে গান বাংলাভাষীদের চাঙ্গা করেছে তা হলো বাংলা র্যাপ। নিউ ইয়র্ক বেজড স্টোয়িক ব্লিসের ‘আবার জিগায়’ নামের হিপহপ ঘরানার গানটি রিলিজের সঙ্গে সঙ্গেই শ্রোতাদের প্লে-লিস্টে উঠে আসে; তবে প্রচুর ইংরেজি শব্দের ব্যবহারের কারণে একে পুরোপুরি বাংলা র্যাপ বলা যাবে না। একই ধারাবাহিকতায় ‘দেশি এমসি’জ’ ‘ব্যানড’ নামের অ্যালবাম রিলিজ করে তাতেও বাংলা র্যাপের ভিত্তি পাকাপোক্ত করার মতো ট্র্যাক ছিল না। তবে এরা বাংলা হিপহপে তাদের জায়গা তৈরি করে নেয়।
ডেডলাইন এন্টারটেইনমেন্ট লেভেল ‘টিওআর’-এর ‘বাংলা হিপহপ জাতি’ এবং ‘আপটাউন লোকলজ’ এর ‘কাহিনি সিনপাট’ নামের দুটি এলবাম রিলিজ করে পরপর। টিওআর-এর অ্যালবামে বাংলা র্যাপের শক্তির জায়গাগুলো পরিষ্কার হয় আর আপটাউন লোকলজ বলা যায় বাংলা র্যাপের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। কাহিনি সিনপাট বাংলা হিপহপে বাংলা র্যাপের একটা পূর্ণাঙ্গ অ্যালবাম। জেসপার আল রাশিদের জাদুকরী মিক্সিং আর মাস্টারিং-এ দুটি অ্যালবাম শ্রোতাদের কানের রুচির স্বাদ মিটিয়েছে।
যদিও মেইনস্ট্রিমে আসার আগে আপটাউন লোকলজ’র সদস্য ব্ল্যাক জ্যাং, তাউড়া সাফাদের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্র্যাক ছিল কিছু। যার মধ্যে ‘ঠোলার পোলা’ নামের একটা গানের জন্য তাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেডকোয়ার্টারেও জবাবদিহি করতে হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। গানগুলো মেমোরি কার্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল, আর ২০০৯-এ অ্যালবাম রিলিজ হলে গান বাজত এফএমে।
কাহিনি সিনপাট অনন্য এর বাংলা ভাষা ব্যবহার আর লোকাল লোকজনের মুখের ভাষা তুলে আনায়। পুরান ঢাকার টোন আর একই সঙ্গে খেটে খাওয়া মানুষের কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার আলাদা উত্তেজনা তৈরি করে। এলিফ্যান্ট রোডের জুতার দোকানিদের নিজেদের মধ্যকার কোড ল্যাঙ্গুয়েজ আছে কিছু; ওখানে বেশ দামাদামি করে জুতা কিনতে হয়, এখানে কখনো ক্রেতা জিতে কখনো বিক্রেতা। হুট করে ‘উস্সাই’ বলে উঠে কোনো কোনো বিক্রেতা, এতে তার সহকর্মী বুঝতে পারে, লাভ হয়েছে বিক্রিতে। এমন আরও কিছু শব্দ কাহিনি সিনপাটে লক্ষ করার মতো। এছাড়াও অ্যালবামের প্রথম থেকে শেষ বেশ একটা হিপহপ জার্নির মতো। গানগুলোর বিষয়বস্তুতে যেমন পার্টি মুড আছে একই সঙ্গে দেশপ্রেম, সমাজ ও প্রতিবাদী চিন্তার প্রতিফলনও ঘটেছে। হিসাবের কথা, সিভিল সমাজ ও পিস্তলের জীবন গানগুলোতে তৎকালীন সময়ের একটা রূপও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তবে এই অ্যালবামের সবচেয়ে জনপ্রিয় হয় ‘এই মামা এই’ গানটি। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এই গানগুলোর প্রভাব থেকে এখনো বের হতে পারেনি বাংলা র্যাপাররা, এতটাই সমৃদ্ধ এই অ্যালবামটি।
আপটাউন লোকলজ ভেঙে যাওয়ার পর সাফা দেশি এমসিজ’র মাগজ’র সঙ্গে নতুন করে দল গোছায়। জালালি নামে দলটির আত্মপ্রকাশের আগেই ‘এলাকা’ নামের একটি ট্র্যাকও প্রকাশ করে ইউটিউবে। পরে সাফার অংশ বাদ দিয়ে আবার একই ট্র্যাক রেকর্ড করে জালালি সেট নামের হিপহপ দলটি। বেশ কিছু গান আনে তারা ইউটিউবে। এর মধ্যেই জালালি সেট সদস্য শাফায়েত মমতাজের সঙ্গে ‘লোকাল বাসের’ মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পায় তবে দল হিসেবে শ্রোতাদের নতুন কিছু দিতে ব্যর্থ হয় তারা। অন্যদিকে ‘ভব’ নামে হিপহপ ক্ল্যান তৈরি করে বেশ কিছু ট্র্যাক রিলিজ করে তাউড়া সাফা। হিপহপ তৎপরতা লক্ষ করা যায় বিভিন্ন অঞ্চলেও; নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, টাঙ্গাইল, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ বেশ কিছু অঞ্চলে সেখানকার আঞ্চলিক ভাষাতেও র্যাপ করা শুরু করে র্যাপাররা। উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছে আপটাউন লোকোলজের ব্ল্যাক জ্যাং, সে বেশ কিছুদিন পরপরই নিজের ট্র্যাক রিলিজ করছে একই সঙ্গে হিপহপের নানা রকম মুভমেন্টের সঙ্গেও জড়িত।
ইংরেজি র্যাপ থেকে সরে এসে হালে বাংলা র্যাপের স্বকীয়তার জায়গা হলো ফোক গানের সঙ্গে ফিউশন ও বাংলার নিজেদের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে বাংলার ভাব ও আঞ্চলিকতা।
বিজ্ঞাপনগুলোতে হিপহপ ড্যান্স ও বাংলা র্যাপের ব্যবহার হচ্ছে প্রচুর। বিটের তালে র্যাপ গানে পণ্যের গুণগান করাটা অভিনব এবং আকর্ষণীয় বটে। তবে পূর্ণাঙ্গ বাংলা র্যাপের যাত্রাটা যেভাবে ধানম-ির ফুটপাত থেকে শুরু হয়েছিল, ভাইরাল ভাইরাস বা বিজ্ঞাপনী সংস্থার হাতে এ গান বেশিদিন থাকবে না। বাংলা র্যাপ হতে যাচ্ছে মুখবন্ধ রাখতে বাধ্য মানুষদের মুখোশ পরে ‘কথা বলার’ মাধ্যম। কথা নিষিদ্ধ জগতে সিধাসাদা কথা বলার জন্য বিটের তাল হলে রাস্তাপ্রিয় লোকদের আর কী চাই!
The culture of all oppressed is the culture of resistance... Thus all artists coming from an oppressed people must represent resistance in their art form.
-Kwame Ture
ঊনসত্তর-একাত্তর হয়ে বাহাত্তরেও যে জঙ্গম বাস্তবতার আঘাত ও ক্ষত দেশের শরীরে দপদপ করছিল, তাকে কোনো সুকুমার ভাষায় প্রকাশ করা কি যেত? সে সময়ের তরুণের মন চিৎকার করছে হাহাকারে, ফেটে পড়ছে বিদ্রোহে, তাদের দরকার ছিল খোলা গলার চিৎকারের ভাষা। ‘হায় আমার বাংলাদেশ’ বলে আজম খান সেটাই দিলেন। আর তাতেই বদলে গেল বাংলা গানের ইতিহাস। তার গান অসন্তোষের তারে বাঁধা হলেও তার তলায় ঠিকই শোনা যায় ভালোবাসার অফুরান কুলকুল জলধারা।
তারপর এক দিন বুকের ভেতর একটা ধস। আজম খান আর নেই। এই ‘নেই’ কি নতুন? অনেক দিনই তিনি তো ছিলেন না বললেই চলে। রোগশয্যায় কোমায় চলে যাওয়ারও আগে, বহুদিন ধরে গানের বাজারের বাজারিরা তো তাকে একরকম ‘কোমা’র মধ্যেই রেখেছিল। তিনি গান বাঁধতেন, কিন্তু কেউ সেধে প্রকাশের গরজ দেখাত না। তিনি সেই বুক তোলপাড় করা আজম খানই ছিলেন, তবু টিভি বা কনসার্টে গাওয়ার ডাক কমে গিয়েছিল। রক্তমাংসের মানুষটি মরে যাওয়ার আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল তার সাংস্কৃতিক মৃত্যুর পরিবেশ। তার দিন সত্যিই ফুরিয়ে আসছিল।
সময় বদলে যাচ্ছিল, মন বদলে যাচ্ছিল, রাজধানী-শহর-মফস্বল সব বদলে যাচ্ছিল। বদলে যাচ্ছিল পপগানের জনপ্রিয়তার ব্যাকরণ। এ যুগ ডিজিটাল, এ মন লিকুইড, এর চাওয়া পিচ্ছিল, এর প্রেম অস্থির। সত্তর বা আশির দশকের সেই রোখা মন, চোখা গায়কি, বুনো আবেগের ভাষায় আর সাড়া দেয় না আজকের তরুণ। তাদের মনের পর্দায় এখন অন্য ছায়া, অন্য ছবি, অন্য সুর। কানে আইপড লাগানো রঙ করা চুলের বাহারি তরুণী কিংবা কোমরঢিলা জিন্স আর ব্র্যান্ডে ব্র্যান্ডে ব্র্যান্ডেড তরুণ মনে আজম খান কতটা সাড়া তুলবেন আর? তিনি তো আর লিকুইড মডার্নিটির তারুণ্যের ভাবভঙ্গি বোঝেন না। তার দিন ছিল সত্তর দশকের অশান্ত ও প্রতিবাদী চৈতন্যে গড়া। দেশায়ত আধুনিকতার সেই যুগে শহুরে তারুণ্য একধরনের প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাবকালচার গড়ে নিয়েছিল। তখনো নাগরিকতার ঠাটবাট থেকে তারা দূরে ছিল, দূরে ছিল পণ্যাসক্ত ভোগবাদিতা থেকেও। সেই দিন, সেই মন যত ফুরাচ্ছিল, ততই তার দিনও বুঝিবা ফুরিয়ে যাচ্ছিল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী উত্তাল সময়ে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া তারুণ্য অশান্ত ও হতাশ হয়ে উঠেছিল। আজম খানের গান তখন তাদের ভাষা দিচ্ছিল, জাগিয়ে রাখছিল। তিনিই ঢাকার তরুণদের চিৎকার করে মনের কথা বলার ভাষা ও ভঙ্গি দিয়েছিলেন। তার পুরুষালি গলা ও ঢং তাকে পুরুষ-তারুণ্যের জননায়ক করে তুলেছিল। সনাতন বাংলা গানের পুতুপুতু সুরেলা আমেজ ভেঙেচুরে শিরায় শিরায় রাগী ছন্দের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বাবা তাকে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে যাচ্ছিস যা, দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না।’ তিনি কথা রেখেছিলেন। গেরিলা যোদ্ধার বেশ আর ছাড়েননি, কেবল রাইফেল-গ্রেনেড ফেলে গিটার তুলে নিয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন আহত কিন্তু প্রতিবাদী বাংলাদেশের তরুণদের প্রতীক। সত্যিই সেই দিন কি আর নেই, সেই তরুণেরাও কি হারিয়ে গেছে? তারা আছে নিশ্চয়, কিন্তু তাদের মনের পিপাসা মেটাবার দায়িত্ব গানের বাজারিরা আর নিচ্ছেন না। কালচার ইন্ডাস্ট্রি এখন ফাঁকা আবেগ আর মোহরতিবাসনার প্রজননক্ষেত্র হয়ে তারুণ্যের দাহিকাশক্তি নিঃশেষ করে ফেলছে। এসব দেখেই দেখেই আজম খানের মনে সংশয় জেগেছিল, ‘আমার গান একসময় মানুষকে জাগাইছে হয়তো, তখন ছিল যুদ্ধের পরবর্তী সময়, মানুষের মধ্যে দরকার ছিল যুদ্ধের চেতনা। এখনকার তরুণদের কাছে আমার গান কী সেটা বুঝলে বুঝবেন আমি আসলে কী করছি। ...আমার গান এখনকার অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের অন্তরকে জাগায় কি না।’
তার স্মরণে অনেক অনুষ্ঠান হলো টিভি চ্যানেলগুলোতে। একটিতে তিনি শিল্পী আসিফের উপস্থাপনায় দুর্বল শরীরে আসিফের কাঁধে ভর দিয়ে গান গাইছিলেন। শেষ গান হিসেবে গাইলেনÑ ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে!’ গাইতে গাইতে এক্কেবারে হৃদয়ের তন্ত্রীতে বাড়ি মেরে যতবার হায় বলছিলেন, মনে হচ্ছিল সেটা তার কলিজাচেরা হাহাকার।
আধুনিক বাংলা গানের রয়েছে অমৃত ভান্ডার। বিশেষ করে, বাংলাদেশে যেসব সুরবোদ্ধা আধুনিক বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করে গেছেন, সেইসব সংগীত ব্যক্তিত্ব জ্বলজ্বল করছেন সুরের আকাশে। বর্তমানেও সেই গানের, জনপ্রিয়তা কমেনি। সেইসব গান শোনামাত্র, আমরা স্মৃতিকাতর হই। খুঁজে বেড়াই, হারানো ভালোবাসা। অথবা উদ্বুদ্ধ হই, গভীর দেশপ্রেমে। সেইসব গান আমাদের ভেতর জাগিয়ে তোলে দ্রোহ, যন্ত্রণা, ভালোবাসার কাতরতা। কখনো আবার স্বপ্ন দেখায়, নতুন জীবনের।
একটি গীতিকবিতা প্রাণ পায়, সুরে। সুরকারের জাদুস্পর্শে তা ধ্বনিত হয়, শিল্পীর কণ্ঠে। হারানো দিনের সেই সব গানের উল্লেখযোগ্য সুরকার নিয়েই এই লেখা। সেইসব গানের অধিকাংশই, স্থান পেয়েছে চলচ্চিত্রে।
সুরকার আলতাফ মাহমুদ একুশের প্রভাত ফেরির গান আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো/একুশে ফেব্রুয়ারি গানে সুরারোপ করে অমর হয়ে থাকবেন।
সুরকার সুবল দাস। ১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানী পরিচালিত আকাশ আর মাটি’ চলচ্চিত্রে প্রথম সংগীত পরিচালনা করেন। এরপর অসংখ্য চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন, সংগীত পরিচালক হিসেবে। জন্ম নিয়েছে, শত শত জনপ্রিয় গান। ঢাকাই চলচ্চিত্র দর্পচূর্ণ ছবিতে তুমি যে আমার কবিতা/ আমারও বাঁশীর রাগিণী/ আমারও স্বপন আধো জাগরণ/ চিরদিন তোমারে চিনি, ‘আলো তুমি আলেয়া’ চলচ্চিত্রে আমি সাতসাগর পাড়ি দিয়ে, যোগ-বিয়োগ চলচ্চিত্রে এই পৃথিবীর পান্থশালায় গানগুলো মনের গভীরে স্থায়ী আসন করে নেয়।
এরপরই আমরা পেয়ে যাই, সুরকার সত্য সাহাকে। যিনি অসংখ্য চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে সুতরাং, নীল আকাশের নীচে, অশিক্ষিত, আবির্ভাব, ছুটির ঘণ্টা, অমর প্রেম, আগুনের পরশমণি, দীপু নাম্বার টু ছবি উল্লেখযোগ্য। এসব চলচ্চিত্রের অনেক গান সমাদৃত হয়েছে মানুষের কাছে।
১৯৬০-এর দশকে দেবু ভট্টাচার্য পাকিস্তানের কণ্ঠশিল্পী গজল সম্রাট মেহেদী হাসান, সুরাইয়া মুলতানীকর ও আহমদ রুশদী এবং বাঙালি সংগীতশিল্পীদের মধ্যে বশির আহমেদ, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, ফেরদৌসী রহমান, রুনা লায়লা প্রমুখের মাধ্যমে উপমহাদেশে বাংলা সংগীত ও সংস্কৃতিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
খন্দকার নুরুল আলম স্বনামধন্য সংগীত পরিচালক ও সুরকার। তার সুর করা চোখ যে মনের কথা বলে, আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে, এতো সুখ সইবো কেমন করে, তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে ইত্যাদি জনপ্রিয় গানের কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও সমাদৃত। তার চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা শুরু হয় উর্দু চলচ্চিত্র দিয়ে। প্রথম সুরকৃত চলচ্চিত্র ইস ধরতি পার। বাংলা চলচ্চিত্রে সুর ও সংগীত পরিচালনা শুরু করেন ১৯৬৮ সালে, অন্তরঙ্গ ও যে আগুনে পুড়ি দিয়ে।
১৯৭০ সালে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানে সুরারোপ করে, আনোয়ার পারভেজ বাঙালির হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেড়ে নেন। ১৯৭০ সালেই খান আতাউর রহমান (খান আতা) ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির বিভিন্ন গানে সুরারোপ করে, সংগীত বোদ্ধাদের নজর কাড়েন। এই ছবির ‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে’ গানটির কণ্ঠশিল্পীও তিনিই ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সমর দাস, মুজিবনগর থেকে পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ও প্রধান পরিচালক ছিলেন। এ সময় বহু গানে তিনি সুর দেন। তার সুর করা গান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও দেশবাসীকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। মুক্তিযুদ্ধে তার সুর করা ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’ প্রভৃতি গান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে।
এরপর আমরা পাই, সুরকার প্রণব ঘোষ ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। তারা চলচ্চিত্রে তেমন সক্রিয়ভাবে যুক্ত না থাকলেও, বাংলাদেশের অডিও শিল্পে স্থায়ী আসন করে নেন। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরারোপিত ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না/ আমি গাইবো’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ টেলিভিশনে ৮টা ও ১০টার সংবাদের আগে এই গানের মিউজিক মানুষের হৃদয়ে সৃষ্টি করে অন্যরকম দ্যোতনা।
নবীন সুরকার: শওকত আলী ইমন, বাপ্পা মজুমদার, প্রিন্স মাহমুদ, রাজেশের সুরে বেশকিছু গান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হারিয়ে যাওয়া সুরকার-সংগীত পরিচালকের উত্তরসূরি হিসেবে, একদিন এইসব গুণী সুরকারও ঠাঁই নেবেন ইতিহাসের পাতায়।
ভাড়া করা বিমানে উড়িয়ে নিয়েও মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রথম ম্যাচে একাদশে রাখল না দিল্লি ক্যাপিটালস। আসরে তাদের শুরুটাও ভালো হলো না। লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে বড় ব্যবধানে হারল মোস্তাফিজবিহীন দিল্লি।
ঘরের মাঠে ৫০ রানের জয়ে আসর শুরু করল লক্ষ্ণৌ। ১৯৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে দিল্লি থামে ৯ উইকেটে ১৪৩ রানে। ৪ ওভারে মাত্র ১৪ রান খরচায় ৫ উইকেট নিয়ে লক্ষ্ণৌয়ের জয়ের নায়ক মার্ক উড।
এদিন দিল্লির ব্যাটিং ছিল পুরো ফ্লপ। দলের অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার ৪৮ বলে ৫৬ রান করেছেন। পাশাপাশি রাইলি রোশো ২০ বলে ৩০ রানের ইনিংস খেলেন। কিন্তু বাকিরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ফলে যা হরার তাই হলো ম্যাচের ফল।
এর আগে স্বাগতিক দলের হয়ে ঝড় তোলেন কাইল মেয়ার্স। এই ক্যারিবীয়ান ৩৮ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলেন। ২টি চারের সঙ্গে হাঁকান ৭টি ছক্কা। এ ছাড়া নিকোলস পুরান ২১ বলে ৩৬ রানের ইনিংস খেলেন। সুবাদে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৬ উইকেটে ১৯৩ রানের পুঁজি গড়ে লক্ষ্ণৌ।
গত অক্টোবরের পর আর্সেনালের জার্সিতে প্রথম গোলের দেখা পেলেন গাব্রিয়েল জেসুস। তার আবার জোড়া গোল। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের জ্বলে ওঠার দিনে লিডস ইউনাইটেডকে উড়িয়ে ম্যানচেস্টার সিটির চেয়ে ফের আট পয়েন্টে এগিয়ে গেল আর্সেনাল।
ঘরের মাঠে শনিবার প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচটি ৪-১ গোলে জিতে আর্সেনাল। স্পট কিকে দলকে প্রথম এগিয়ে দেন জেসুস। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে বেন হোয়াইট ব্যবধান দ্বিগুণ করেন। এর খানিক পরই জোড়া গোল পূর্ণ করেন জেসুস।
এরপর লিডস একটি গোল শোধ করলেও গ্রানিত জাকার গোলে বড় জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে স্বাগতিকরা।
আন্তর্জাতিক বিরতি থেকে ফেরার পর এটিই প্রথম ম্যাচ ছিল আর্সেনালের। বিরতিতে যাওয়ার আগে নিজেদের মাঠে একই ব্যবধানে তারা হারিয়েছিল ক্রিস্টাল প্যালেসকে।
এই জয়ে ২৯ ম্যাচে ৭২ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষস্থান আরও মজবুত করল গানাররা। ২০০৩-০৪ মৌসুমের পর প্রথমবার প্রিমিয়ার লিগ জয়ের স্বপ্ন দেখছে আর্সেনাল। তাদের সঙ্গে গত লিগের চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটির পয়েন্ট ব্যবধান ৮।
গানারদের চেয়ে এক ম্যাচ কম খেলে ৬৪ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে সিটি। একই দিন তারাও নিজেদের মাঠে লিভারপুলকে উড়িয়ে দিয়েছে ৪-১ গোলে।
গাজীপুরের টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীতে ৩৬০ টাকা বেতনে কর্মজীবন শুরু করা আসাদুর রহমান কিরণ এখন গাজীপুর মহানগরের ভারপ্রাপ্ত মেয়র। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর বিভিন্ন দল বদলে ক্ষমতার পাশাপাশি প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন। বিভিন্ন সূত্র মতে, কিরণ এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। তার এত সম্পদের মালিক হওয়ার পেছনে রয়েছে দখলবাজি, জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর দুর্নীতি ও অনিয়ম।
কিরণের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ ৩১টি দপ্তরে যে অভিযোগ জমা পড়েছে, তাতে ডিগবাজি দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসা এই ভারপ্রাপ্ত মেয়রের ৬০০ কোটি টাকার দুর্নীতি-অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য হাইকোর্ট দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দিয়েছে।
২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর নির্বাচিত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। নগরীর ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণ তখন ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পান।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণকে একাধিকবার ফোন করা হয়েছে। মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।
৩১ দপ্তরে অভিযোগ : গত বছর ২০ জুলাই ৩১টি দপ্তরে সচেতন নাগরিক, বাংলাদেশের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন মো. নজরুল ইসলাম। লিখিত অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, দুদক, স্থানীয় সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে দেওয়া হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে গত বছর জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি পালন না করেও সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে টাকা আত্মসাৎ করেছেন কিরণ।
জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার অভিযোগপত্রে ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণের দুর্নীতি ও অনিয়ম চিত্র তুলে ধরেছি।’
কিরণের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র : ভারপ্রাপ্ত মেয়রের চেয়ারে বসে কিরণ দুর্নীতি-লুটপাট, কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। দায়িত্ব নেওয়ার পর তার নজর পড়ে পুবাইলের চিরুলিয়ায় অর্পিত সম্পত্তির ওপর। ২৩ বিঘা জমি নিজের কবজায় নেন কিরণ। এর জন্য ভুয়া জমির মালিক বানান একজনকে। এ জমি নিজের করায়ত্তে নিতে সিটি করপোরেশনের ১৮ লাখ টাকা কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। জানাজানি হয়ে গেলে কিছুদিন আগে কর পরিশোধ করেন। তবে অবৈধ প্রক্রিয়ায় জমির মালিক হওয়ায় ওই জমির খাজনা এখনো দিতে পারেননি কিরণ।
পোশাকশিল্প কারখানার সবচেয়ে বড় নগরী গাজীপুর। সিটি করপোরেশনের আয়ের সবচেয়ে বড় মাধ্যম শিল্প ও হোল্ডিং ট্যাক্স। আর সেখানেই অনিয়মের বড় ক্ষেত্র তৈরি করেছেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র। তিন/পাঁচ কোটি টাকার বকেয়া হোল্ডিং, শিল্প ট্যাক্স অর্ধেকে নামিয়ে এনে করপোরেশনের কোষাগারে মাত্র ৫০ লাখ টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রেহাই দিয়ে দেন করদাতাদের। কিরণের এই কৌশলে বেঁচে যান কর ফাঁকি দেওয়া শিল্প-মালিকরা। কিন্তু রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র। নগরের আটটি জোনে করের টাকা আত্মসাৎ করার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিরণ ২০১৬-১৭ সালে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় একটি টেন্ডার আহ্বান করেন। টেন্ডার নম্বর : জিসিসি/জেড। ওই টেন্ডারের কাজের অগ্রগতি না থাকায় জাহাঙ্গীর আলম মেয়র নির্বাচিত হলে ওই টেন্ডারের কোনো বিল পরিশোধ করতে পারেননি কিরণ। ২০২১ সালে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেন। ওই সময়ের বিভিন্ন ঠিকাদারকে ডেকে তাদের কাছ থেকে কাজের হিসাব করে তার কমিশন আদায় করেন কিরণ। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কিছু চিত্র সিটি করপোরেশনের চেক রেজিস্ট্রার বই ঘেঁটেও পাওয়া গেছে।
উত্তরায় ‘অস্থায়ী কার্যালয়’ : উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে ৭ নম্বর রোডে ১০ নম্বর বাড়ির ছয়তলায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের একটি ‘কার্যালয়’ করেছেন কিরণ। উত্তরার এ কার্যালয়ে বসে ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। লেনদেন-দরবার সবই হয় এ বাড়িতে বসেই। পার্সেন্টেজ ছাড়া যেমন ঠিকাদারদের কাজের বিল পরিশোধ করা হয় না, তেমনি পার্সেন্টেজ ছাড়া ঠিকাদারি কাজও পান না কেউই। কোন কাজ কে পাবে, কে পাবে না, কে কত পার্সেন্ট কমিশন দেবে এসব হিসাব ও মধ্যরাতের প্রমোদ-ফুর্তির যে ব্যয় হয় সিটি করপোরেশনের এলআর ফান্ড থেকে নির্বাহ করা হয়। শিল্পাঞ্চল-সমৃদ্ধ গাজীপুর নগরীর অধিকাংশ ব্যবসায়ী-ঠিকাদার ‘১০ পার্সেন্ট’ হিসাবেও কিরণকে চিনে-জানে।
বর্তমানে গাজীপুর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা সারা জীবন রাজনীতি করেছি দলের জন্য। অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছি কিন্তু মূল্যায়ন পাইনি। একটি কাজের জন্য আমি ছয় মাস ঘুরছি। কিন্তু কিরণ আমাকে কাজ দিচ্ছেন না। কারণ আমার কাছ থেকে পার্সেন্টেজ নিতে পারবেন না।’
শুধু কী তা-ই, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজনের নামে গত বছর ১৭ মার্চ কোনো আয়োজন না করেই কিরণ সিটি করপোরেশনের খরচের তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগও আছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৭৬ জন কাউন্সিলর এবং কিছু কর্মকর্তার সিলেটে পিকনিক আয়োজন করার নামে করপোরেশনের তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ বাবদ দেখিয়ে আত্মসাৎ করার অভিযোগও আছে।
কিরণের সম্পদ : টঙ্গীর পাগাড়, ঢাকার আশুলিয়া এবং গাজীপুরে নিজ নামে, স্ত্রী, শ্যালক ও শ্যালিকার নামে ১১২ বিঘা জমির মালিক কিরণ। টঙ্গীর পাগাড়ে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কিছু জমি রয়েছে, যা নয়ছয় ও ভয়ভীতি দেখিয়ে দলিল করে নিয়েছেন তিনি। নজরুল ইসলামের অভিযোগ অনুযায়ী, উত্তরায় ১১ নম্বর সেক্টরে ৭ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়িটি সাততলা। এটি নির্মাণ করতে কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। একই এলাকার ৭ নম্বর সেক্টরে ১৮ নম্বর রোডে ৯৫ নম্বর বাড়ি রয়েছে। বারোতলা নির্মাণাধীন ওই ভবনের আনুমানিক মূল্য ৩৫ কোটি টাকা। গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কে ফ্ল্যাটের তথ্যও পাওয়া গেছে। ২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাটের মূল্য কমপক্ষে সাত কোটি টাকা।
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় স্ত্রী ও নিজের নামে অন্তত ২০০ বিঘা জমির ওপর ভারপ্রাপ্ত মেয়রের কারখানা রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ৩০০ কোটি টাকা হতে পারে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অধীনে টঙ্গীতে তিনটি কারখানা আছে তার। এগুলোর আনুমানিক মূল্য ৩০০ কোটি কোটি টাকা।
কিরণের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত কয়েকশ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। তিনি নিজের ও স্ত্রীর নামে যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্ক শহরে বাড়ি করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। কিরণ দ্বৈত নাগরিক বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
হাইকোর্টের আদেশ : গত বছরের ২০ জুলাই দুদকে জমা পড়া অভিযোগ লাল ফিতায় আটকে গেলে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন হয়। গত বছর ২১ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করা হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালত কিরণের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। হাইকোর্ট চার মাসের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে সময় বেঁধে দেন। একই সঙ্গে গাজীপুরের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে আদালত।
রাজনীতিতে উত্থান : প্রিন্টিং প্রেস কারখানায় বাইন্ডার-ম্যান হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন আসাদুর রহমান কিরণ। ১৯৮৪-৮৫ সালে এলিট প্রিন্টিং প্রেস নামে ওই কারখানায় চাকরি করা কিরণ ১৯৮৬ সালে রাজনীতিতে আসেন। ওই সময় তিনি জাতীয় পার্টির যুব সংগঠন যুব সংহতির টঙ্গীর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ওই সময় গাজীপুর নিয়ন্ত্রণ করতেন হাসান উদ্দিন সরকার। তিনি জাতীয় পার্টি ও পরে বিএনপির রাজনীতিতেও যুক্ত হন। ওই সময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর হাসান উদ্দিন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা ও তার ঘনিষ্ঠ পরিচিতি লাভ করে শুরু করেন জমি দখল। টঙ্গী, পাগাড় মৌজায় হিন্দু-খ্রিস্টানের মালিকানায় থাকা জমি দখল করে নেন তিনি। পরে প্লট বানিয়ে চড়া দামে বিক্রি করেন। তবে প্রিন্টিং প্রেসের শ্রমিক কিরণ ওই সময় টঙ্গীর বিসিক এলাকায় শ্রমিক নেতা হিসেবেও আধিপত্য বিস্তার করেন। হিন্দু-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কেউ জমি দিতে না চাইলে রাজনৈতিক চাপ ও সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করতেন। পাগাড় শিল্পাঞ্চল এলাকা হওয়ায় ওই এলাকায় টার্গেট করে জমি দখল করেন কিরণ। টঙ্গী পৌরসভা হিসেবে প্রথম ভোটে ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কমিশনারও নির্বাচিত হন। তত দিনে ক্ষমতা-সম্পদ ও অঢেল অর্থের মালিক হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর গুরু পাল্টে কিরণ হয়ে যান সাবেক পৌর মেয়র গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লার ‘মাইম্যান’। এই সুযোগে ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে কিরণের। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে আজমত উল্লা মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক আবদুল মান্নানের কাছে পরাজিত হন। কিরণ মূলত দুর্নীতি-অনিয়ম শেখেন তখন থেকেই। বিএনপি নেতা মান্নান মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত হলে তিনি ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পান। গাজীপুরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচন কেন্দ্র করে আজমত উল্লার সঙ্গেও সুসম্পর্ক নেই কিরণের।
গাজীপুরের মাওনা এলাকার আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চেয়ার ছুঁয়েই কিরণ স্বেচ্ছাচারিতা, লুটপাট, ভূমিদখলসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তিনি করেননি। দলীয় লোককে সরিয়ে রেখেছেন, সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখেছেন। কারণ, কিরণ আওয়ামী লীগ নয়, মূলত সুবিধাবাদী।’
ভারপ্রাপ্ত মেয়রের বিষয়ে জানতে চাইলে আজমত উল্লা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কিরণ অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে এসেছেন সত্যি, তবে তিনি দলের জন্য কাজ করেছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের যে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে সেটা তো প্রমাণ হয়নি এখনো। প্রমাণ হলে তখন মন্তব্য করা যাবে।’
অর্থনৈতিক সংকট আর রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে নতুন বছরে নতুন শুরুর আশা ছিল শ্রীলঙ্কার। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সংকটের অভিঘাত এখনো সইতে হচ্ছে দেশটির। বিদেশি সহায়তার পরও হু হু করে বাড়ছে দেশটির মূল্যস্ফীতি। গেল ফেব্রুয়ারি মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ৫০ শতাংশের ওপরে ছিল। অথচ শ্রমিক-চাকরিজীবীদের বেতন বাড়েনি। অনেকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজ হারানো লোকের সংখ্যাও কম না। এ পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার তরুণদের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশটির সরকারি সূত্র অনুযায়ী, ২০২২ সালেই ৩ লাখের বেশি মানুষ বাইরের দেশে কাজ খুঁজতে গিয়েছে। আর চলতি বছর প্রথম দিনেই দেশ ছেড়েছে আরও ৭৩ হাজার মানুষ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, দেশটি তার বিভিন্ন শিল্প খাতের প্রয়োজনীয় লোকবলই পাচ্ছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে চললে উৎপাদন কমে গিয়ে আরেক দফা সংকটে পড়তে পারে দ্বীপরাষ্ট্রটি।
ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে দেশটির ব্যবসায়ীদের বরাতে বলা হয়েছে, তারা কর্মী সংকটে ভুগছেন, যাদের মধ্যে ম্যানেজার পদও রয়েছে। খালি থাকা ম্যানেজার পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়ার জন্য তাদের আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। কোম্পানিগুলো সাধারণত ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদেরই নিয়োগ দিত এবং এ বয়সের তরুণরাই চাকরি ছেড়ে নতুন চাকরিতে যোগ দিতেন। তবে এখন চল্লিশ এবং পঞ্চাশ বছর বয়সীরাও চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে আইএমএফ-এর ঋণ প্যাকেজের শর্ত হিসেবে বেশ কয়েক দফা কর বাড়িয়েছেন। বর্তমানে দেশটিতে আয়করের হার ৩৬ শতাংশ। এর সঙ্গে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি জনগণকে ফেলেছে ভীষণ চাপে। দ্বিমুখী এই চাপে দেশ ছাড়ছেন নাগরিকরা। দেশটির বিরোধী দল ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার পার্টির ভাষ্য, সরকার অতিরিক্ত করের বোঝা চাপানোয় দলে দলে দেশ ছাড়ছেন মানুষ।
সাময়িকীটি বলছে, শত শত ডাক্তার ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, যার মধ্যে গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসেই গিয়েছেন ৪৭৭ জন। এভাবে এগোতে থাকলে গ্রামীণ অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার সংকট দেখা যাবে।
এদিকে শ্রীলঙ্কান সরকারও এই দেশ ছেড়ে পালানোকে উৎসাহিত করছে। প্রথমত, সরকারি খাতে বেতনের বোঝা কমানোর জন্য এবং দ্বিতীয়ত, বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের আশায়। গত জুন মাসে সরকার মাসে ১০০-৫০০ ডলার রেমিট্যান্স পাঠানোর শর্তে দেশটির ডাক্তারদের পাঁচ বছরের জন্য ছুটি দেওয়ার ঘোষণাও দেয়।
ইকোনমিস্ট বলছে, দেশটির প্রবাসী নিয়োগ মন্ত্রী মনুশা নানায়াক্কার বিভিন্নভাবে শ্রীলঙ্কান কর্মীদের দেশের বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করছেন। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় চাকরির সুযোগের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। চলো বিদেশে যাই- নামের এক ইউটিউব চ্যানেল থেকে জনগণের কাছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিদেশে চাকরির সুযোগ প্রচার করা হচ্ছে। তাতে বলা হচ্ছে, নার্সিং, কেয়ার-গিভিংসহ অন্যান্য সেবামূলক কাজেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে শ্রীলঙ্কান সরকার, যাতে করে কাতার, কুয়েত, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে তারা কাজের ব্যবস্থা করতে পারে। আর এই পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে আশানুরূপ ফলাফল পাচ্ছে শ্রীলঙ্কান সরকার। গত চার মাসে রেমিট্যান্সের হার বেশ খানিকটা বেড়েছে। তবে এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় মেধাবীরা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন, যাদের দেশ পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন।
নানায়াক্কার জানিয়েছেন সেবা এবং উৎপাদন খাতে ইতিমধ্যেই কর্মী সংকট দেখা গিয়েছে। এটি প্রতিরোধের জন্য কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘লয়্যালটি বোনাস’ ঘোষণা করেছে, অর্থাৎ চাকরি না ছাড়লে অতিরিক্ত বেতন দেওয়া হবে।
কুমিল্লার মুরাদনগরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার রাস্তায় ইটের প্রাচীর তুলে প্রতিবেশী দুই পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় প্রভাবশালী দুই সহোদরের বিরুদ্ধে। আর শুধু তাই নয় মাইনুদ্দিন ও শফিকুল ইসলাম নামে ওই দুই সহোদরের তোলা প্রাচীরের কারণে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে একটি মাদ্রাসাও। ফলে নিরুপায় হয়ে মই দিয়ে ৭ ফুট উঁচু সীমানা প্রাচীর পার হয়ে চলাচল করতে হচ্ছে মাদ্রাসাটির শতাধিক শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীকে, যা তাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। অন্যদিকে প্রাচীরে আটকে পড়া দুটি পরিবারের শিক্ষার্থীরাও মই দিয়ে প্রাচীর টপকে তাদের নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এছাড়াও গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে পরিবার দুটি। এমন ঘটনা ঘটেছে উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার রামচন্দ্রপুর উত্তর বাখরাবাদ গ্রামে।
এদিকে প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেলেও স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় এলাকাবাসী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকাবাসী বলছে, প্রত্যেকেরই যার যার বাড়ির নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রয়োজন রয়েছে, তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রতিবেশীদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে তা কারও কাম্য নয়।
জানা গেছে, উত্তর বাখরাবাদ গ্রামের প্রভাবশালী মাইনুদ্দিনের বাড়ির পাশে কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় রাবেয়া বসরী মাদ্রাসা। তার পাশে বসবাস দুটি পরিবারের। মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পরিবার দুটির সদস্যদের চলাচলের একমাত্র রাস্তা ছিল মাইনুদ্দিন ও শফিকুলের জমির ওপর দিয়ে। কিন্তু তিনি হঠাৎই তার বাড়ির চারপাশে ইটের সীমানা দেয়াল তুলে দেন। এতে বাধ্য হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিদিন মাদ্রাসায় যেতে হচ্ছে বাঁশের মই বেয়ে প্রতিবেশীদের দেয়াল টপকে। আবার তাদের বাড়ি ফিরতেও হয় দেয়াল বেয়ে। এরই মধ্যে পা ফসকে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে অনেকেই।
ভুক্তভোগী রাবেয়া বসরী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হাফেজ নজরুল ইসলাম অভিযোগ করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বি চাপিতলা গ্রামের মরহুম হাজি আব্দুর রহমান ২০১৮ সালে ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য রাস্তাটি মৌখিকভাবে দিয়ে যান। কিন্তু তার মৃত্যুর পর ছেলে মাইনুদ্দিন ও তার ভাই শফিকুল ইসলাম মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও প্রতিবেশীদের যাতায়াতের রাস্তাটি বন্ধ করে দেন। সমাধান চেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল সরকারের কাছে বেশ কয়েকবার গেলেও তিনি দুই বছর ধরে আমাকে ঘুরাচ্ছেন। দুই বছর আগে বাড়িসহ জমি কেনার প্রস্তাব দেন তারা। কিনতে রাজি না হওয়ায় সীমানা প্রচীর নির্মাণ করে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেন।’ এ ব্যপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বলেও জানান হাফেজ নজরুল ইসলাম।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য ও রামচন্দ্রপুর রামকান্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক কবির আহমেদ ভূঁইয়া আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ এখানে বসবাস করছি এবং বসবাসের শুরু থেকেই ওই সড়কটি দিয়ে যাতায়াত করে আসছি। হঠাৎ করে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেওয়ায় আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি।’
তবে সীমানা প্রাচীর নির্মাণকারী মাইনুদ্দিন বলেন, ‘প্রাচীর নির্মাণ করে আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমার জমিতে আমি প্রাচীর নির্মাণ করেছি। এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রামচন্দ্রপুর উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল সরকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেশ কয়েকবার আমি চেষ্টা করেছি বিষয়টি স্থানীয়ভাবে মীমাংসা করার। কিন্তু জমির মালিক মাইনুদ্দিন তার জমির ওপর দিয়ে সড়ক দিতে রাজি হচ্ছেন না।’
সার্বিক বিষয়ে মুরাদনগরের ইউএনও মো. আলাউদ্দিন ভূঁইয়া জনী বলেন, ‘অবরুদ্ধ হওয়ার বিষয়টি আমি জেনেছি। তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে বলেছি বিষয়টি স্থানীয়ভাবে মীমাংসা করে দেওয়ার জন্য। এর পরও ভুক্তভোগীরা আদালতের সহযোগিতা নিতে পারেন।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
সময়ের আলোচিত চিত্রনায়িকা নুসরাত ফারিয়া। একাধারে উপস্থাপিকা, নায়িকা এবং সংগীতশিল্পীও। সিনেমার বাইরে তিনটি গান প্রকাশ পেয়েছে তার। সে ধারাবাহিকতায় এবারের ঈদে নতুন গান নিয়ে আসছেন তিনি।
গানের শিরোনাম ‘বুঝি না তো তাই’। বাঁধনের লেখা এ গানটির সংগীতায়োজন করেছেন বলিউড র্যাপার মুমজি স্ট্রেঞ্জার। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ফারিয়া। বাবা যাদবের কোরিওগ্রাফিতে ভিডিওতে অংশ নিয়েছেন ফারিয়া ও মুমজি। আসছে ঈদে উন্মুক্ত হবে গানটি। গানটি প্রকাশ করবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ভেঙ্কটেশ ফিল্মস।
সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে গানটির টিজার, যা দর্শকমহলে প্রশংসা কুড়াচ্ছে। এরমধ্যে সোমবার বিকেলে নিজের ফেসবুকে গান ভিডিওর দৃশ্যের একটি ছবি পোস্ট করেন এ গায়িকা। সেখানে ক্যাপশনে লিখেন, মাই হাইট ইজ ৫' ৩'' বাট অ্যাটিচিউড ৬' ১''।
গানটি প্রসঙ্গে নুসরাত ফারিয়া জানিয়েছিলেন, ‘নতুন এ গানটি বেশ আনন্দের সঙ্গে করেছি। আমার আগের তিনটি গানের মতো এটিও বেশ মজার। আমার বিশ্বাস এটি সবার পছন্দ হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে ‘পটাকা’ গানের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ঘরানার গানে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন নুসরাত ফারিয়া। এরপর ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রকাশ পায় ‘আমি চাই থাকতে’ ও ‘হাবিবি’। আসছে ঈদুল ফিতরে এ অভিনেত্রী গায়িকা হিসাবে চতুর্থবার হাজির হচ্ছেন দর্শক শ্রোতাদের সামনে।
দেশে ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি ইন্টারনেট সেবা চালু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। অন্য অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক একই সেবা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সব মোবাইল অপারেটরই দেশের বেশিরভাগ স্থানে ফোরজি সেবা চালু করেছে। আর সে হিসেবেই তারা ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু গ্রাহকরা ফোরজি ইন্টারনেট কিনলেও দেশের অনেক এলাকায় টুজি-থ্রিজি’র সেবা পাচ্ছেন। তারা অপারেটর কোম্পানিগুলোকে এ ব্যাপারে বারবার অভিযোগ জানালেও এর সুরাহা হচ্ছে না।
জানা গেছে, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে মোটামুটিভাবে গ্রাহকরা ফোরজি সেবা পাচ্ছেন। তবে এসব এলাকায়ও অনেক সময় ফোরজি থাকে না, থ্রিজিতে নেমে আসে নেটওয়ার্ক। তবে জেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ সময়েই থাকে থ্রিজি। আর মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ সময় সেই থ্রিজিও থাকে না, তখন টুজি নেটওয়ার্কই ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইন্টারনেট প্যাকেজ যথাযথভাবে থাকার পর তা কাজ করে না, বাফারিং হয়। এতে গ্রাহকরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো সারা দেশের ব্যবসা একত্রে হিসাব না করে এলাকাভিত্তিক ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা দেখেন, কোন এলাকায় তাদের গ্রাহক সংখ্যা কত, সেখানে কত সিমে ইন্টারনেট চালু আছে। যদি দেখা যায়, তাদের হিসাব মতে তা সন্তোষজনক আছে তাহলে সেখানে ফোরজি সেবা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বহাল রাখে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক টাওয়ার নির্মাণ করে। কিন্তু যদি দেখে সন্তোষজনক গ্রাহক নেই তাহলে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় না, এতে সেই এলাকায় ফোরজি পাওয়া যায় না। অথচ শহর এলাকাগুলোতে তারা বেশি ব্যবসা করলেও সেটাকে হিসাবে ধরে না। কিন্তু মফস্বল এলাকা থেকে কল বাবদ প্রয়োজনের বেশি ব্যবসা হলেও তা ইন্টারনেটের সঙ্গে সমন্বয় করে না।
মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর ফেসবুক পেইজে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অভিযোগ জানান গ্রাহকরা। অভিযোগ অনুযায়ী, অপারেটরদের মধ্যে টেলিটকের নেটওয়ার্কই বেশি দুর্বল। টেলিটকের ফেসবুক পেজের এক পোস্টে মো. ফয়জুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই, নেটওয়ার্ক পাই না সকাল থেকে। মিরপুর-২ নম্বরে বাসা স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে। আর আমার গ্রামের কথা না হয় বাদ দিলাম।’ আরাফাত আলী লেখেন, ‘২জিবি নেট কিনলে দেড় জিবি নষ্ট হয়। মেয়াদ ১৫ দিন তাও ফুরাতে পারি না। তাহলে বুঝেন নেটওয়ার্ক কত ভালো।’ কার্জন চাকমা লেখেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় ফোরজি নিশ্চিত করুন। আমাদের পার্বত্য এলাকাগুলোতে টেলিটকের গ্রাহক সবচেয়ে বেশি, কিন্তু শুধু থ্রিজি-টুজিতে সীমাবদ্ধ।’ রাসেল আহমেদ লেখেন, ‘গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাংগা গ্রামে থ্রিজি নেটওয়ার্ক তো নেই-ই। মাঝেমধ্যে টুজি’ও নেই। বুঝুন অবস্থাটা। আমাদের থ্রিজি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করুন।’
টেলিটকের মহাব্যবস্থাপক (সিস্টেম অপারেশন) নুরুল মাবুদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ফাইভজি রেডিনেস প্রজেক্ট শুরু করেছি। যা শেষ হতে এক বছর বা তার কিছু বেশি সময় লাগতে পারে। এর ফলে আমাদের কাভারেজ এলাকাগুলোতে ফোরজি সেবা নিশ্চিত হবে। এছাড়া আমাদের কাভারেজ বাড়ানোরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে।’
বাংলালিংকের পেজের একটি পোস্টে মাহাদী হাসান তালহা লেখেন, ‘আমার এলাকায় আপনাদের সিম ব্যবহার করতে হলে ফোন গাছের ডালে বেঁধে লাউডস্পিকার দিয়ে কথা বলা লাগে। এত্তো ফাস্ট কেন আপনাদের নেটওয়ার্ক।’ আকরাম হোসাইন লেখেন, ‘ভাই আপনাদের সবই ঠিক, তবে নেটওয়ার্ক সেøা।’
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অফিসার তৈমুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফোরজি সেবার জন্য ২৩০০ মেগাহার্জের স্পেকটার্ম প্রয়োজন হয়। কিন্তু টুজিতে তা লাগে মাত্র ৯০০ মেগাহার্জ। আমরা ইতিমধ্যে ৯৫ শতাংশ কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা নিশ্চিত করেছি। তবে আমাদের আরও বেশি সাইট লাগবে। যদি সব অপারেটর মিলে আমরা টাওয়ার শেয়ার করতে পারি, তাহলে সব গ্রাহকের কাছে ভালো সেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে।’
রবির পেজে এক পোস্টে তানভীর আহমেদ লেখেন, ‘কলাপাড়া থানা শহরে যদি থ্রিজি নেটওয়ার্ক না পাওয়া যায়, এরচেয়ে দুঃখজনক কিছুই হতে পারে না।’ এইচএমএম ইসমাঈল লেখেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার চম্পকনগর ইউনিয়নে রবি সিমের থ্রিজি নেই। অথচ অনেক বছর আগে রবি টাওয়ার বসানো হয়েছে। আমরা রবি সিম দিয়ে ইন্টারনেট চালাতে অক্ষম।’
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলটরি অফিসার শাহেদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা রয়েছে। তবে দেখা যায়, অনেক ফোন ফোরজি সাপোর্ট করে না। আর কাভারেজ এলাকা থেকে যতদূরে যাওয়া যাবে, নেটওয়ার্ক তত কমতে থাকবে। এছাড়া আমাদের কিছু জায়গায় নেটওয়ার্কের কাজ চলছে। পাশাপাশি নতুন কিছু টাওয়ার তৈরির কাজও আমাদের চলছে।’
গ্রামীণের পেইজে একটি পোস্টে রহিদুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই আমি যখন গ্রামে যাই তখন নেটওয়ার্কের ঝামেলা হয়।’ সাইদুর রহমান লেখেন, ‘এমন সার্ভিস হলে চলবে? কলরেট, ইন্টারনেটের দাম তো ঠিকই বেশি আপনাদের, বাকি সব অপারেটরদের থেকে।’
গত বছরের ২৮ এপ্রিল টেলিকম অপারেটররা বহুল প্রতীক্ষিত ‘আনলিমিটেড’ ও ‘মেয়াদবিহীন’ ইন্টারনেট ডাটা প্যাক চালু করেছে। তবে এতে গ্রাহকদের খুব বেশি সুবিধা হচ্ছে না। কারণ এজন্য প্যাকেজের দাম বাড়িয়েছে অপারেটররা। আর মেয়াদহীন ইন্টারনেট পেতে প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একই প্যাকেজ চালু করতে হবে। কিন্তু গ্রাহকের সব সময় একই ধরনের ইন্টারনেট প্যাকেজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে গ্রাহকের কেনা ইন্টারনেট। এছাড়া মেয়াদবিহীন হিসেবে মোবাইল অপারেটররা যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে গ্রাহকদের।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে সচল সিমের সংখ্যা ১৮ কোটি ২০ লাখ ৬১ হাজার। এরমধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৭ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার, রবির ৫ কোটি ৫০ লাখ ১৪ হাজার, বাংলালিংকের ৪ কোটি ৮৫ হাজার এবং টেলিটকের ৬০ লাখ ৬৭ হাজার। আর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৫০ লাখ। এরমধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি ও পিএসটিএন)-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ লাখ ৮৭ হাজার গ্রাহক।