
১৯৪৩ সালে এডলফ গটলিবের ‘পার্সেফোনির ধর্ষণ’ এবং মার্ক রথকোর ‘সিরীয় ষাঁড়’ চিত্রকর্মদুটি নিউ ইয়র্কের ফেডারেশন প্রদর্শনীতে দেখে একজন শিল্প সমালোচক নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় মন্তব্য করেন যে শিল্পকর্মদুটি দেখে তিনি হতবুদ্ধি এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় বোধ করেছেন। এর প্রতিবাদে ৭ই জুন শিল্পীদ্বয় যৌথভাবে নিউ ইয়র্ক টাইমসের শিল্প সম্পাদকের উদ্দেশ্যে একটি চিঠিতে লেখেন, ‘মানসম্পন্ন কোনো চিত্রকর্ম বিষয়বস্তুহীন হতে পারে না। আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই যে, শিল্পে বিষয়বস্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং কেবল সেসকল বিষয়ই যা বিষাদময় এবং চিরকালীন। এ কারনেই আমাদের কাজের মাধ্যমে আমরা মৌলিক এবং প্রাচীন শিল্পের সাথে আত্মিক একাত্মতা প্রকাশ করি। ফলাফলস্বরূপ, আমাদের কাজে যদি এই বিশ্বাস যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয় তবে নিঃসন্দেহে সেই কাজগুলো যে কাউকে আঘাত করতে পারে যারা গৃহস্থালি সজ্জা, ড্রয়িং রুমের ছবি, আয়নার উপরে সাজানো ছবি, আমেরিকা সম্পর্কিত ছবি, সামাজিক ছবি, শিল্পের বিশুদ্ধতা, পুরস্কারপ্রাপ্ত নিম্নমানের কাজ, জাতীয় একাডেমী, হুইটনি একাডেমী, কর্ণ বেল্ট একাডেমী ঘরানার এবং নিম্নমানের গৎবাঁধা ধরণের শিল্পের সাথে আত্মিক একাত্মতা বোধ করেন।’ বাংলাদেশের সমসাময়িক মধ্যবিত্তদের শিল্পে শিল্পীদের আত্মিক একাত্মতার ধরন খুঁজতে গেলে কিউরেটরের নোট ছাড়া বিশেষ কোনো সম্বল পাওয়া দুষ্কর। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই স্বজনপ্রীতির বলয় কিংবা সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুঁজির উপর ভর করে শিল্পী নিজের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। অথচ নিজের শিল্প চর্চার দর্শন এবং বিশ্বাস সম্পর্কে বোঝাপড়া দাঁড়িয়েছে এমন শিল্পী গুটিকয়েক। স্বীয় কাজ সম্পর্কে এই পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তৃত অভাব একই সাথে বাংলাদেশে শিল্প সমালোচকের অভাবকে যেমন নির্দেশ করে, তেমনি একইসাথে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানীদের কাছ থেকে মুক্তির ৭৫ বছর পরেও বাংলাদেশে নানান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কাঠামো, সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প উদ্যোগ গড়ে উঠলেও হোয়াইট কিউব কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক আধুনিক ‘ফাইন’ শিল্পকলার আছর যে এখনও কাটেনি তারও স্মারক বহন করে। যেমন এই বছরের শুরুতেই বেঙ্গল গ্যালারীতে অনুষ্ঠিত ঢালী আল মামুনের ‘অসম্মতির মানচিত্র’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি বিষয়বস্তুগত দিক থেকে ঔপনিবেশিক ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন উপস্থাপন করলেও পদ্ধতিগত জায়গা থেকে শিল্পের ঔপনিবেশিক ধারাকে মোকাবিলা করতে প্রদর্শনীটি বহুলাংশে অপরাগ। কেননা যে সকল শিল্পকর্মের মাধ্যমে ঢালী আল মামুনের পর্যালোচনা হাজির হচ্ছে, সেগুলো পোস্টমডার্ন, আন্তঃশৈল্পিক ঢং, উপস্থাপন, পৃষ্ঠপোষকতা ও স্বকীয় স্টাইল মিলিয়ে ‘ফাইন আর্টের’ অভিমুখেই যাত্রা করেছে। আবার, পুঁজিবাজার ও সাম্রাজ্যবাদের চাপে প্রাতিষ্ঠানিকতা বিরোধী গণমুখী স্বাধীন শিল্প উদ্যোগগুলো ম্রিয়মাণ ও ক্ষয়িষ্ণু। ১৯তম এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল কিংবা ঢাকা আর্ট সামিট অথবা ছবিমেলায় দর্শকের ঢল দেখলে মনে হতেই পারে যে দেশীয় শিল্পে বৈপ্লবিক রুপান্তর ঘটে গেছে। পরিমান, সংখ্যা ও উদ্যোগের বিচারে ঘটেছে এবং ঘটছে – এটি সত্য তবে অপূর্ণ সত্য। দর্শকের চোখ কি এখনও ড্রইয়িং রুম, ইন্সটাগ্রাম রিল ও স্টোরি অথবা হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্টে ঝোলানো সৌন্দর্যসর্বস্ব শিল্পে আটকে নেই? চারুকলা পড়ুয়া কিংবা অপড়ুয়া কোনো শিল্পী এই অর্থ-যশসমৃদ্ধ সম্মানজনক শিল্প আয়োজনসমূহ হতে সংগ্রাহকের অর্থ, পুরষ্কার এবং ভবিষ্যৎ অংশগ্রহনের সম্ভাবনা বাদেও আর কী অর্জন করেন যা তার শিল্প মানসকে অসাড় কল্পনা হতে চিন্তাশীল কল্পনার দিকে ধাবিত করে?
শিল্পের পর্যালোচনা শিল্পী, আয়োজক এবং শিল্পের দর্শক সকলেরই দেখার চোখ তৈরি করে। একদিকে যেমন বিয়েনাল, উৎসব, প্রদর্শনীর সমারোহ, অপরদিকে অর্থ, পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা উদ্যোগের অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্প পত্রিকা কী বার্তা বহন করে? নিছকই বিদ্যায়তনিক পরিসরে মই বাওয়া শিল্প গবেষণা কিংবা ফেসবুক পোস্ট কখনওবা খিস্তিখেউর ছাড়া বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পে পর্যালোচনার স্পেস কোথায়? আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের শিল্পীদের তুলে ধরার প্রকল্পসমূহ ক্ষমতাধর বৈদেশিক পুঁজির প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেও শিল্প সমালোচনা এবং পর্যালোচনার খাত কেনো বৈদেশিক পুঁজি তো বটেই - দেশীয় শিল্প সংগ্রাহক, মিডিয়া, এমনকি বিদ্যায়তনের নিকটেই অবহেলিত তার প্রধান কারণ দেশে সামগ্রিক পর্যালোচনামূলক চিন্তার স্থান সংকীর্ণ হয়ে পড়া। শিল্প ভোগ করা শ্রেণীগত রুচি অর্জনে সহায়ক হলেও পর্যালোচনা তুলনামূলকভাবে অলাভজনক, এমনকি কখনো কখনো বিপদজনক। ফলে নিজ নিজ অবস্থান, লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়কে উপজীব্য করে লবিং ও নেটওয়ার্কিং ক্ষমতা শিল্প মহলে আরও শক্তিশালী অবস্থান কায়েম করেছে। সাম্প্রতিককালে সমাপ্ত ঢাকা আর্ট সামিটের প্রবেশ ফটক পেরোলেই শিল্পী জয়দেব রোয়াজার জলমগ্ন স্বপ্ন-৮ শীর্ষক স্থাপনাটি একদিকে যেমন উন্নাসিক উন্নয়নের বয়ান, আদিবাসীদের উচ্ছেদ, সামরিক শাসন এবং সর্বোপরি প্রান-প্রকৃতি বিরুদ্ধ রাষ্ট্রীয় জনব্যববস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তেমনি একই ভবনের ঠিক উপরতলায় গার্মেন্টস খাতে শ্রমিক শোষণের ইতিহাসকে চাপা দিয়ে টেকসই, পরিবেশ এবং নারী শীর্ষক যৌথ উপস্থাপনার মাধ্যমে ‘গ্রিনওয়াশ’ বন্দনার বন্দোবস্ত আয়োজকদের জয়দেবের কাজের রাজনৈতিক বিপজ্জনক দিকগুলো হতে রক্ষা করে। আবার আদিবাসী এবং লিঙ্গীয় ও যৌন বৈচিত্র্যময় শিল্পীদের অংশগ্রহন সামিট আয়োজনকে বিচিত্রতা প্রদান করে তা ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্বের অন্তর্ভুক্তিমূক কূটনীতি প্রসারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির ড্রেস রিহার্সেল কিংবা নব্য বুর্জোয়া শ্রেনীর উত্থান যেভাবেই বিয়েনাল, সামিট বা ছবিমেলার প্রদর্শনীর উদ্যোগগুলোকে পাঠ করা হোক না কেন, পর্যালোচনা এবং সমালোচনার অভাবে তার ষোলআনাই মাটি। প্রদর্শনীস্থলে আর্টিস্ট টক কিংবা সমগোত্রীয় আয়োজন স্তুতিময় আলোচনা সভায় পরিণত হয় যখন শিল্প হালের রাষ্ট্র ও রাজনীতির সাথে ভীষণরকম সম্মত, প্রদর্শন সর্বস্ব ও পর্যালোচনা বিমুখ হয়ে পড়ে। এই পর্যালোচনার দুর্ভিক্ষের কীরকম ছবি হবে?
বরেণ্য চিত্রকর মনিরুল ইসলাম। এ শিল্পী পেয়েছেন স্পেনের সম্মানসূচক ‘রয়েল স্প্যানিশ অর্ডার অব মেরিট’। বাংলাদেশ ও স্পেনে তার দুই জীবন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন নিজের শিল্পযাত্রাসহ ইউরোপ-বাংলাদেশের চারুকলা সম্পর্কে। কথা বলেছেন শিল্পভাবনা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিলভিয়া নাজনীন
ছবি আঁকার জগতে আসার শুরুর গল্পটা জানতে চাই।
মনিরুল ইসলাম : আমার মনে আছে ম্যাট্রিক দিলাম ফিফটি এইটে, কিশোরগঞ্জ থেকে। তিনবার ম্যাট্রিক দিতে হয়েছে, তারপর পাস করেছি। আমার জীবনে একমাত্র ইচ্ছা ছিল ছবি আঁকতে হবে। যেহেতু এই ভাবনাটা আমি করছি কিশোরগঞ্জের মতো ছোট একটা শহর থেকে, সে হিসেবে ফ্যামিলির একটু আপত্তি ছিল। বিশেষ করে বাবার। অনেক কিছু চিন্তা করে বাবা বলল, এই ছেলের ফিউচার বলে কিছু নেই। আমাকে ইলেকট্রিক কাজে হেলপার হিসেবে কাজ করতে বলল। তবে আর্ট কলেজে আসার পেছনে মার সম্মতি ছিল। আমাদের শিল্পী হাশেম খানের বাবা আর আমার বাবা কলিগ ছিলেন, তারা পাবলিক হেলথে একসঙ্গে কাজ করতেন। সেই সূত্রে হাশেম খান আমাকে চারুকলায় ভর্তির ব্যাপারে সহযোগিতা করেছিলেন।
চারুকলায় এসে তখন শিক্ষক হিসেবে কাদের পেলেন?
মনিরুল ইসলাম : ঢাকা আর্ট কলেজে যখন আসি আমাদের টিচার ছিলেন আব্দুল বাসেত। খুব কড়া এবং সত্যিই খুব ভালোমানের টিচার ছিলেন। যদিও তিনি খুব কম আঁকতেন। তার ছবিও অত্যন্ত ভালো ছিল। তো বাসেত স্যারের খুব নজর ছিল আমার ওপর। ছাত্রাবস্থায় আমি প্রচুর ছবি আঁকতাম। গাদায় গাদায় আঁকতাম। তখন অ্যানুয়াল এক্সিবিশনে কার কয়টা পেইন্টিং যাবে সেটার হিসাব হতো, কে কতগুলো ছবি আঁকছে তার ওপর। তাই প্রচুর আঁকতাম। তখন তো এত পেইন্টিং করার সুবিধা ছিল না। ওয়াটার কালার করতাম শুধু। বিক্রি করে দিতাম সেগুলো, পঁচিশ টাকা, তিরিশ টাকা করে। এইভাবে আরম্ভ করলাম আমার আর্ট কলেজের জার্নি। তারপর সেকেন্ড ইয়ারে পেলাম মোস্তফা মনোয়ার স্যারকে। তার কাছে আমি দুইটা জিনিস শিখেছি, একটা হলো কালার্স, আরেকটা হলো ফ্রিডম। মোস্তফা মনোয়ার স্যারের হাত ধরেই আমার শিল্পীজীবনের গভীরে অভিনিবেশ ঘটল।
চারুকলার তখন তো জয়নুল আবেদিনও ছিলেন, তার সঙ্গে কোনো স্মৃতি নেই?
মনিরুল ইসলাম : আবেদিন স্যারকে প্রথম দেখি হোয়াইট প্যান্ট আর একটা অলিভ গ্রিন হাওয়াই শার্টে, এলিগেন্ট ওয়েতে আয়রন করা। একটা বক্স-ওয়াগান গাড়ি ওটা বোধহয়, উনি জার্মানি থেকে গিফট পেয়েছিলেন, সেটা থেকে নেমে আসছিলেন। উনি একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন রাত ৯টায়। উনি এইভাবে বলতেন, ‘মনির সাবরে ডাইকা আনো।’ তো আমি গেলাম, স্যার বললেন, ‘মনির, চাঁদপুরে যাইতে হবে।’ আমি বললাম ‘চাঁদপুরে কেন যাবেন স্যার?’ বললেন, ‘আমাকে ছবি আঁকতে যাইতে হবে।’ জানতে পারলাম, বেঙ্গল ট্রান্সপোর্ট বা ইস্ট পাকিস্তান রিভার ট্রান্সপোর্ট বলে একটা কোম্পানি আছে ওটার ক্যালেন্ডার হবে। ঐ ক্যালেন্ডারের জন্য চাঁদপুরের সাবজেক্ট নিয়ে ছবি আঁকতে হবে। স্পেসিফিকলি স্টিমারে আগে যেই চুঙ্গাটা থাকত ব্ল্যাক অ্যান্ড ইয়েলো, এইটা থাকতে হবে ছবিতে। তারপর আমরা সকালে রওনা হলাম। আবেদিন স্যারকে নিয়ে চাঁদপুরে আমাদের বাসাতেও গেলাম। আমরা নৌকা ভাড়া করে রং, তুলি, কাগজ নিয়ে সাবজেক্ট দেখতে গেলাম। সারা দিন আবেদিন স্যার নৌকায় বসে থাকলেন কিছুই আঁকলেন না। সন্ধ্যার আগে বললেন বাসায় ফিরে যাবেন। আমি বেশ অবাক! সারা দিন সময়টা নষ্ট করলেন স্যার? কিছু আঁকলেন না? পরদিন সকালে আবার আমরা বের হলাম। সেদিন স্যার ছবি আঁকা শুরু করলেন। রং খুঁজলেন গ্যামবুজ, প্রুশিয়ান ব্লু, ইন্ডিগো। আমি ভাবলাম, ছবি আঁকার জন্য এই কঠিন রংগুলো স্যার নদীতে কোথায় দেখতে পেলেন? তারপর এই রং দিয়েই স্যার কী অপূর্ব দুইটা ছবি আঁকলেন। আমিও সাহস নিয়ে স্যারের মতো দুইটা ছবি আঁকলাম। বাসায় ফিরে যখন চারটা ছবি বিছিয়ে রাখলাম, স্যার বললেন, ‘এই মিয়া তোমার ছবি কোন দুইটা?’ (হাসি)
চারুকলায় থাকাকালীনই কি আপনি স্কলারশিপ পেয়ে স্পেন চলে যান?
মনিরুল ইসলাম : আমি আর রফিকুন নবী স্যার দুজনেই প্রায় একই সময়ে চারুকলায় শিক্ষকতা শুরু করি। ঊনসত্তরের ঐ সময়টায় আমরা বিভিন্ন পোস্টার করতাম। তো একদিন নবী বললেন, ‘ওই মিয়া, স্পেন যাবা নাকি?’ আমি বললাম, ‘না, আপনে যান না কেন?’ পরে উনি আঙুল দিয়া দেখায় বললেন, ‘এই যে খাজা সাহেব চৌদ্দ বছর ধইরা ফরমই ফিল-আপ কইরা যাইতাছে...’ হা হা। তখন স্কলারশিপের সার্কুলার পাবলিশ করত সাত দিন সময় দিয়ে। সাত দিনে তো সব জমা দেওয়া অসম্ভব। আমি হাফ কাগজ কোনোরকম করে পাঠায় দেই। কেমন করে জানি সিলেক্ট হয়ে যাই। আমার বেতন ছিল দুইশ টাকা আর যাওয়ার জন্য প্লেন ভাড়া লাগত চার হাজার টাকা। কেমনে যাই! আমার এক বন্ধু ছিল নূরুল ইসলাম নামে, যে মোনায়েম খানের সহকারী ছিল, পরে সে বঙ্গবন্ধুর পিএসও হয়েছিল সে আমাকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে দেয়।
স্পেনে গিয়ে কি আবার লেখাপড়া শুরু করলেন?
মনিরুল ইসলাম : স্পেনে তো গেলাম আমি ৯ মাসের জন্য। তখন বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আমি এচিং করা শুরু করলাম। আমি চলে আসব ভাবছিলাম, কারণ পেইন্টিং করতে পারছিলাম না। ওখানে আমি ফ্রেস্কো করতে শুরু করছিলাম। জিনিসটা নতুন ছিল তাই করতে ভালোই লাগত। এরপরে প্রিন্ট শুরু করলাম প্রিন্টমেকার হিসেবে। তবে ওরা আমাকে আর্টিস্ট হিসেবে ট্রিট করত। ৯ মাসের জন্য গিয়ে ফিফটি টু ইয়ারস কাটিয়ে দিলাম।
স্পেনকে আপনার কেমন মনে হয়েছে বসবাসের জন্য?
মনিরুল ইসলাম : স্পেন একটা বিউটিফুল কান্ট্রি। লোকগুলা অত্যন্ত ভালো, ক্লাইমেট ভালো, কিন্তু পড়াশোনার জন্য বেশি ভালো না। স্পেনের অনেক হিস্ট্রি আছে, খাওয়া-দাওয়ার জন্য বিখ্যাত, ফুর্তিবাজ জাতি। রাতে ঘুমায় না। দে এনজয় দেয়ার লাইফ। আর্টের জন্য ওয়ান অফ দ্য ভেরি ইম্পর্টেন্ট প্লেস এখন। ইম্পেশেন্ট, এনার্কিস্ট, ইনডিভিজুয়ালিস্ট এই তিন ধরনের মানুষ ওখানে, তিনটাই কিন্তু খারাপ। স্পেনের এই এনার্কিস্ট গ্রুপটা বেশ সক্রিয়।
বিদেশ গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মনিরুল ইসলাম : বিদেশে গেলেই যে আর্টিস্ট অনেক কিছু শিখে ফেলবে, অনেক বড় হয়ে যাবে এমন না, ইট ডিপেন্ডস সে কতটুকু কন্সিভ করতে পারে। আমি স্পেনে দীর্ঘসময় কাজ করছি। সেখানে আমার একটা কঠিন জার্নি আছে।
স্পেন সরকার আমাকে অনেক সম্মান দিছে। এটা সত্য। ’৯৭-এ এচিং-এর জন্য জাতীয় পুরস্কার, এরপর আরও দুইটা পুরস্কার দিল। করোনার আগে মেরিট পুরস্কার মানে ওখানকার ‘স্যার’ হাইয়েস্ট সিভিলিয়ান অ্যাওয়ার্ড, ওইটাও দিল।
বাংলাদেশে আপনাকে একুশে পদক, শিল্পকলা একাডেমি পদক দিয়ে সম্মানিত করেছে...
মনিরুল ইসলাম : হ্যাঁ, ১৯৯৯ সালে আমি একুশে পদক পাইছি। আমাদের হাইয়েস্ট অ্যাওয়ার্ড, কিন্তু পিপল ফরগেট। মানে প্রাপ্য সম্মানটা আসলে পাওয়া হয় না। বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি কোনোটাই বোধহয় বাকি নাই।
শিল্প কি শুধুমাত্র আনন্দের জন্যই কাজ করে, নাকি মানুষের জন্যও?
মনিরুল ইসলাম : আর্ট আজ যা, পাঁচশো বছর আগেও এমনই ছিল। রাজার ছবি আঁকো, বাগান আঁকো, এখন করপোরেটদের জন্য আঁকো। যতই বলি না কেন আর্টকে জনগণের জীবনের ভেতরে নিয়ে যাও, লাভ নাই। তবে গ্রামের লোকেদের কাছে আর্ট ইজ আ ডেইলি লাইফ। একটা পিঠা বানাবে, পাকন পিঠা তারা ডিজাইন করে খায়। তারপরে ঘরে আলপনা করে। আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছিল, আর্ট ইজ আ বুলশিট বাট এভরি ইঞ্চ অফ লাইফ ইউ নিড ইট।
বাংলাদেশের আর্ট কি বিদেশে আলাদাভাবে এপ্রেসিয়েটেড হয়?
মনিরুল ইসলাম : না, বাংলাদেশি আর্ট বলে ওখানে কোনো কিছু ছিল না। আর পৃথিবী-বিখ্যাত বলে যে ধারণা আছে সেটা আসলে ভুয়া, কেউই পৃথিবী-বিখ্যাত না। এটা একটা ডাম্ব ল্যাঙ্গুয়েজ, আমরা অলওয়েজ বিহাইন্ড ক্যানভাস থাকি। তবে লাস্ট ১০ বছরে কিছুটা শুরু হয়েছে। আজ যারা ভেনিস বিয়েনালে যাচ্ছে, এটা একটা বড় বিষয়। কারণ এটা মিরর অফ অ্যা কান্ট্রি, ওখানে নির্দিষ্ট কোনো আর্টিস্ট বা গ্যালারি যাচ্ছে না, যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে শিল্পীরা। তবে মনে রাখা লাগবে আর্টে এপ্রিশিয়েশন একটা স্লো প্রসেস। এটার জন্য কন্টিনিউটি দরকার।
আমরা যে আর্ট করছি, তার মধ্যে আমরা আসলে কী করছি?
মনিরুল ইসলাম : অ্যাকচুয়ালি আমরা কিন্তু ইউরোপিয়ান আর্ট কপি করতেছি। আসলে আমাদের সিলেবাসটাই তো ওরকম ‘রয়্যাল স্কুল অফ আর্ট’-এর। এখন তো আর্ট গ্লোবালাইজড হয়ে গেছে সবাই বলে। আমি এটার পক্ষপাতী না। সবাই যদি একই ভাষায় কথা বলে তাহলে আলাদা বলে কিছু তো থাকার কথা না। নতুন কিছুও তো পাওয়া যাবে না।
স্পেন আপনার একটা স্টাইলকে গুরুত্ব দিয়ে ‘স্কুল অফ মনির’ বলছে, অথচ সেই স্টাইলটা বাংলাদেশে ওভাবে বিকশিত হয়নি, কেন?
মনিরুল ইসলাম : আমি অনেক সময় ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছি এদেশে। এমন তো না, আমি শিখাইনি।
করোনার পর এই সময়টায় আপনি কী আঁকছেন? কিছু ভাবছেন?
মনিরুল ইসলাম : আমরা মানুষেরা কিন্তু সব ভুলে যাই। ছবিটা আমার কাছে মনে হয় ইউ আর হোল্ডিং দ্য টাইম। এখন সময় চলে গেছে মানুষের আবেদনও চলে গেছে। আমি আসলে গোলাপ আঁকি না, গোলাপের ঘ্রাণ আঁকি। একটা ছবি কখন ছেড়ে দিতে হয় এটা আমরা অনেকেই জানি না। উই আর কিলিং আওয়ার অওন আর্ট। আর লাস্টলি, ডাস্ট ইনটু ডাস্ট। আর আমি এত এত যে আঁকছি, এত করে দেখছি, যে মিরাকেলি কিছু ঘটে কি না! এটার জন্যই ওয়েট করছি। আমার বয়সও তো হয়ে গেল আটাশি।
শিল্পমাধ্যমের যতগুলো শাখা আছে তার সর্বশেষ সংযোজন আলোকচিত্র। ১৮৪০ সালে জাহাজে চেপে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় ক্যামেরা আসে। আর পূর্ববঙ্গে ক্যামেরা আসে গত শতকের ষাটের দশকে ঢাকার নবাব পরিবারে। নবাব আহসান উল্লাহ আর তার ছেলে নবাব সলিমুল্লাহ যে সৃষ্টিশীল আলোকচিত্রচর্চায় নিমগ্ন ছিলেন ইতিহাসে তার প্রমাণ মেলে। দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গে স্বল্প পরিসরে আলোকচিত্রের নান্দনিকচর্চা শুরু হয়। ষাটের দশক থেকে শুরু হয় স্যালোন বা আর্ট ফটোগ্রাফির চর্চা। কিন্তু ছবি দিয়ে যে সমাজজীবনের গল্প বলা যায় এই ধারণা আসে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে।
বর্তমানে বাংলাদেশের আলোকচিত্রীরা বিশ্বের সেরা ফটোগ্রাফার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব এখন এ দেশের আলোকচিত্রীদের কাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। এত কিছুর পরও ফটোগ্রাফিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে রাষ্ট্রীয় শিথিলতা চোখে পড়ার মতো। ফলে অনেকটা ব্যক্তি-উদ্যোগেই এদেশে ফটোগ্রাফিচর্চা বিস্তৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের আলোকচিত্রবিদ্যায় অনন্য অবদান রেখেছেন গোলাম কাসেম ড্যাডি ও মনজুর আলম বেগ। আলোকচিত্রকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে পরিচিত করার জন্য যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি ড. শহিদুল আলম। আলোকচিত্র অঙ্গনে তিনি এদেশে একটা প্রজন্ম তৈরি করেছেন।
সাতচল্লিশ পরবর্তী সময়ে আমানুল হক, নাইবউদ্দীন আহমদ, ড. নওয়াজেশ আহমদ, আনোয়ার হোসেন, বিজন সরকার প্রমুখ সৃষ্টি করে গেছেন অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। বর্তমান প্রজন্মের আলোকচিত্রীদের মধ্যে নাসির আলী মামুন তৈরি করেছেন প্রতিকৃতি আলোকচিত্রের ধারা। প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানমের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছেন অনেক নারী আলোকচিত্রী। আরও অনেক পথিকৃৎ আলোকচিত্রী রয়েছেন যাদের তালিকা বেশ দীর্ঘ। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে তার পুরোটা তুলে ধরা সম্ভব নয়।
শিল্পবিশ্বে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি কোন অবস্থানে রয়েছে তার একটি সামান্য ফিরিস্তি তুলে ধরছি। সত্যি বলতে পৃথিবীর এমন কোনো মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতা নেই, যেখানে বাংলাদেশের আলোকচিত্রীরা জয়ী হয়নি। নেদারল্যান্ডসে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রতিযোগিতা শুরুর কয়েক বছরের মাথায় ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে ওয়ার্ল্ড প্রেসের সার্টিফিকেট অব অনার লাভ করেন বাংলাদেশের আলোকচিত্রী মোজাম্মিল হোসেন। পরের বছর পান মোয়াজ্জেম হোসেন বুলু। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের শফিকুল আলম কিরণ (দুইবার), শোয়েব ফারুকী, জিএমবি আকাশ, এন্ড্রু বিরাজ, তাসলিমা আখতার, রাহুল তালুকদার, সরকার প্রতীক, মো. মাসফিকুর আখতার সোহান, কে এম আসাদ ও ইসমাইল ফেরদৌস ওয়ার্ল্ড প্রেস জিতেছেন। ২০১৮ সালে পুলিৎজার জিতেন মোহাম্মদ পনির হোসেন। বাংলাদেশের আলোকচিত্রীদের মুকুটে আরও যুক্ত হয়েছে ইউজিন স্মিথ ফান্ড, মাদার জোনস, ন্যাশনাল জিওগ্রাফির অল রোভস, পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার এওয়ার্ড, জুপ মাস্টারক্লাস, হিপা, টাইম ম্যাগাজিন পারসন অব দ্য ইয়ারের মতো সম্মানসূচক পালক। ২০২২ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো ফাউন্ডেশনের এশিয়া মহাদেশের আঞ্চলিক সহযোগী হিসেবে যুক্ত হয়েছে দৃক। এশিয়া মহাদেশের এত এত দেশ থাকতে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে নির্বাচন করা কম গৌরবের ব্যাপার নয়।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো আলোকচিত্রী স্বাধীনতা পদক পাননি। একুশে পদক পেয়েছেন মো. কামরুজ্জামান, আফতাব আহমেদ, মনজুর আলম বেগ, মোহাম্মদ আলম, আমানুল হক, গোলাম মুস্তফা, সাইদা খানম ও পাভেল রহমান। বাংলাদেশ শিল্পকলা পদক পেয়েছেন শহিদুল আলম, গোলাম মুস্তাফা, নাসির আলী মামুন, এমএ তাহের ও শফিকুল ইসলাম স্বপন। বাংলাদেশের আলোকচিত্রীদের কাজের যে পরিধি সেই তুলনায় এই সংখ্যাটা অতি নগণ্য।
সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন ২০১২ সালে ঢাকায় প্রথম আর্ট সামিটের আয়োজন করে। সেই বছর সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ড পান খালেদ হাসান। ২০১৬ সালে পান রাসেল চৌধুরী। এ বছর পান ফজলে রাব্বী ফটিক। এছাড়া পৃথিবীর নানা শিল্পকলা উৎসব, বিয়েনাল, ট্রিয়েনাল ও বিশ্ববিখ্যাত মিউজিয়ামে বাংলাদেশি আলোকচিত্রশিল্পীদের কাজ প্রদর্শিত হচ্ছে। ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে শহিদুল আলম, আবীর আবদুল্লাহ, মোনেম ওয়াসিফ, সরকার প্রতীক, সাইফুল হক অমি, শামসুল আলম হেলাল, হাবিবা নওরোজ, শাহরিয়া শারমীন, সালমা আবেদীন পৃথি, তাহিরা ফারহীন হক, রিয়াদ আবেদীন, ফারজানা আখতার, ফায়হাম ইবনে শরীফ, মাশুক আহমেদ, আহমেদ রাসেল, মৃদুল কান্তি গোস্বামী, যোবায়ের জ্যোতি, কাজী রিয়াসাত আলভী, শাহনেওয়াজ খান, তূর্য চৌধুরীসহ অসংখ্য আলোকচিত্রীর কাজ বিশ্বশিল্পমহলে প্রশংসিত হয়েছে।
আজকের শিল্পবিশ্বে বাংলাদেশের যে পরিচিতি তার নেপথ্য ভূমিকা দৃক ও পাঠশালার। ২০০০ সালে দৃক প্রথম আন্তর্জাতিক ছবিমেলার আয়োজন করে। ছবিমেলা এশিয়ার সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র উৎসব। পাঠশালার উত্তরণ দ্বিধাহীনভাবে বাংলাদেশের ‘আলোকচিত্রিক রেনেসাঁ’ বলা যায়। এত কিছুর পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ও শিল্পকলা একাডেমিতে ফটোগ্রাফির জায়গা হয়নি। ঢাকা আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়ে চিত্রকলার বিভিন্ন শাখার সঙ্গে ফটোগ্রাফি বিভাগও চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষক না পাওয়ায় সে সময়ে এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ষাটের দশকের শুরুতে আর্ট কলেজে ফটোগ্রাফির একটা পূর্ণাঙ্গ বিভাগ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ফটোগ্রাফি পড়ানোর জন্য শিল্পী মুস্তফা মনোয়ারকে আর্ট কলেজে নিয়ে আসেন। ওয়ান টুয়েন্টি রোলিকর্ড ক্যামেরা, লাইটিং, আধুনিক এনলার্জারসহ ডার্করুম সরঞ্জাম কেনা হলো। কিন্তু কোথায় যেন ছেদ পড়ল! অনেক দিন অপেক্ষা করে মুস্তফা মনোয়ার ১৯৬৪ সালে চলে গেলেন টেলিভিশনে। ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে আর্ট কলেজে এলে ফটোগ্রাফি বিভাগ প্রতিষ্ঠার আলোচনাটি আবারও জোরালো হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াবহ হত্যাকা-ের পর সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। ফলে চারুকলায় ফটোগ্রাফি আর জায়গা করে নিতে পারল না। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আলোকচিত্র বিভাগ খোলার বিল পাস হয়েছিল। এখন সেটিও কী অবস্থায় আছে কে জানে! আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি হয়ে গেল, সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি নিয়ে এত এত ঘটনা ঘটে গেল কিন্তু দেশের মাটিতে তাদের কোনো মূল্যায়ন হলো না।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় এক দশক আগে থেকে এদেশে আধুনিকতাবাদী ভাস্কর্য চর্চার সূচনা ঘটে। উনিশশো ষাটের দশকের শুরুতে আধুনিক ভাস্কর্যের বিভিন্ন ধরনের সঙ্গে পূর্ববাংলাকে পরিচিত করেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভাস্কর্যবিদ্যা শিক্ষা ও চর্চা ষাট দশকের প্রথমার্ধে (১৯৬৩ সালে) শুরু হয়। অতএব বলা যেতে পারে স্বাধীনতা লাভের এক দশক আগেই এদেশের আধুনিক ও সমকালীন ভাস্কর্যচর্চার পটভূমি রচিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বাংলাদেশের ভাস্কর্যচর্চার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে। বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে উনিশশো একাত্তরের ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তাই স্বাধীনতার পরপরই এই যুদ্ধে জনমানুষের আত্মত্যাগ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বকে স্মরণীয় করে রাখতে গণপ্রাঙ্গণ ভাস্কর্য নির্মাণের তাগিদ অনুভূত হয়। কেননা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বিশালায়তন ভাস্কর্যের উপস্থিতি বোধের ক্ষেত্রে যে ধরনের শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে তা অন্য কোনো শিল্পমাধ্যমে সম্ভব নয়।
একাত্তরে ঢাকার জয়দেবপুর (গাজীপুর) চৌরাস্তার যে স্থানে প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধ সংগঠিত হয় সেই স্থানটিকে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামকরণ করা হয়। ১৯৭২ সালে সেখানে নির্মিত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মারক গণপ্রাঙ্গণ ভাস্কর্য ‘মুক্তিযোদ্ধা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তার বিভাগের শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন। বেদিসহ ৪২ ফুট উচ্চতার সাদা সিমেন্ট-কংক্রিটে ঢালাই করে নির্মিত ভাস্কর্যটি একহাতে রাইফেল অন্যহাতে গ্রেনেড ধরা একজন মুক্তিযোদ্ধার বিমূর্ত অবয়ব। ভাস্কর্যটি নির্মাণ ও স্থাপনে উদ্যোগ, ব্যবস্থাপনা এবং পৃষ্ঠপোষকতায় গাজীপুর অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। গাজীপুরে প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধ থেকে ৯ মাসের যুদ্ধে সমরাঙ্গনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন মেজর জেনারেল আমিন আহম্মেদ চৌধূরী। ভাস্কর্যটি নির্মাণ ব্যবস্থাপনায় তিনি ও তার বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকরা অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। এর কিছুদিন পর ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (ডাকসু) কলাভবনের সামনে অপর একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ভাস্কর অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল্লাহ্ খালিদ তার সহযোগী তরুণ শিল্পীদের নিয়ে ‘অপরাজেয় বাংলা’ নামে সুপরিচিত এই ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ আরম্ভ করেন। তবে জাগ্রত চৌরঙ্গীর ভাস্কর্যটির মতো ‘অপরাজেয় বাংলার’ নির্মাণ সহজে বা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়নি। নির্মাণ ব্যয় সংকুলান, প্রশাসনিক অসহযোগিতা এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ক্রমশ সংগঠিত হতে থাকা ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বাধা মোকাবিলা করে ১৯৭৯ সালে ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। দুজন পুরুষ ও একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা যাদের একজন নাগরিক তরুণ একজন গ্রাম্য যুবক ও অপরজন সেবিকা হিসেবে সামনে অগ্রসরমানÑ এমন তিনটি প্রতিনিধিত্বমূলক অবয়বের সমন্বয়ে আঠারো ফুট উচ্চতার এই ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়। বাংলাদেশে পাবলিক স্কাল্পচার বা গণপ্রাঙ্গণ ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে অপরাজেয় বাংলা ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এটি নির্মিত হওয়ার পর একই ধারায় অনেকগুলো মুক্তিযুদ্ধ স্মারক ভাস্কর্য নির্মিত হয়। তবে প্রাথমিকভাবে যেসব গণপ্রাঙ্গণ ভাস্কর্য নির্মিত হয় তার বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয় ও সেনানিবাসমূহে স্থাপিত হতে দেখা যায়।
সারা বিশ্বেই গণপ্রাঙ্গণ ভাস্কর্যসমূহ ভাস্কর্যের জনপ্রিয় ধারা হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রটি ভিন্ন। ভাস্কর্যবিদ্যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং ভাস্কররা তাদের নিজস্ব স্টুডিওতে যে নিরীক্ষামূলক অনুশীলন চালান তার মাধ্যমে মৌলিক ভাস্কর্যসমূহ সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে তারা সেগুলো জনসম্মুখে উপস্থাপন করেন। এই ভাস্কর্যগুলোর মধ্য থেকে সংগ্রাহকরা নিজস্ব রুচি অনুযায়ী তাদের ব্যক্তিগত শিল্পসংগ্রহ সমৃদ্ধ করেন, রাষ্ট্রীয় অথবা বেসরকারি জাদুঘরসমূহও সংগ্রহ করে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তি ভাস্করদের কমিশন করেন পাবলিক ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য।
বাংলাদেশে আধুনিক ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে এ-ধরনের মৌলিক ভাস্কর্যের চর্চার সংস্কৃতি শুরু হয় মুখ্যত স্বাধীনতার এক দশক আগে। তবে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে তা’ নতুন করে প্রাণ পায়। ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান ভারতের বরোদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাস্কর্যে উচ্চতর পাঠ গ্রহণ শেষে দেশে ফিরে ‘একাত্তর স্মরণে’ শিরোনামে বেশ কিছু ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষা শেষে অলোক রায় সিরামিক মাধ্যমে রিলিফ ও মুক্ত ভাস্কর্য নির্মাণ শুরু করেন। পাশাপাশি দেশে শিক্ষিত ভাস্কররাও নানা ধরনের নিরীক্ষা শুরু করেন। চিত্রকলাসহ অন্যান্য মাধ্যমের বেশ কিছু শিল্পী ভাস্কর্যচর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফলে ১৯৭৬ সালে প্রথম জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনী ও ১৯৮৩ সালে দ্বিতীয় জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ভাস্কর্যের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ক্রমাগত নবীন শিল্পশিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়তে থাকে। বিশ শতকের আশির দশকে ভাস্কর্য শিল্পীদের অনেকেই অন্যান্য দেশ থেকে ভাস্কর্যে উচ্চতর পাঠ গ্রহণ করতে শুরু করেন। জাতীয় ও এশীয় প্রদর্শনীগুলোতে প্রদর্শিত ভাস্কর্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। নব্বই দশকে এসে আমরা ভাস্করদের একক ও যৌথ প্রদর্শনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে দেখি।
তবে একথা অনস্বীকার্য যে, ভাস্কর্যকে সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণ করার সামাজিক প্রস্তুতি, ভাস্কর্যের আধুনিক নিরীক্ষাপ্রবণতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিকশিত হয়নি। ফলে একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে উচ্চতর শিক্ষা বিস্তৃতি পাচ্ছে এবং দেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর প্রায় অর্ধশতাধিক ভাস্কর শিক্ষা সম্পন্ন করে বের হচ্ছেন তখনো ভাস্কর্যচর্চা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত পেশায় পরিণত হয়নি। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে এদেশের প্রতিভাধর নবীন-প্রবীণ ভাস্করদের অনেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভাস্কর্যের জন্য বহু সম্মান বয়ে আনলেও তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তেমনভাবে প্রচারিত হয়নি। বরং সৌন্দর্যবর্ধন ও বিভিন্ন স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণের নামে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, ঠিকাদারি পদ্ধতিতে মানহীন নির্মাণ ভাস্কর্য সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ধারণা বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে।
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর প্রাক্কালে বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশ করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে তখন অন্য সব ক্ষেত্রের মতো ভাস্কর্যের প্রকৃত মানসম্পন্ন বিকাশ ও বিস্তারও প্রত্যাশিত। সেজন্য শুধু উচ্চতর শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে ভাস্কর্যশিক্ষা অব্যাহত রাখলেই চলবে না বরং প্রতিভাবান নবীন-প্রবীণ ভাস্কররা যাতে দেশে-বিদেশে নিজেদের সৃজনকর্ম নির্বিঘেœ অব্যাহত রাখতে পারেন তার প্রকৃতি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। গত শতকের সত্তর দশকে শুরু হয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়া জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনীটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মিত কার্যক্রমে পরিণত করতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আয়োজিত জাতীয় প্রদর্শনীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই প্রদর্শনীর মানকে উন্নত করতে হবে। দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট গ্যালারিগুলোকে ভাস্কর্য প্রদর্শনী আয়োজনে আরও আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। জাতীয় জাদুঘর ও শিল্পকলা একাডেমিকে মানসম্পন্ন ভাস্কর্য সংগ্রহ করা ও নিয়মিত প্রদর্শনের কর্মসূচি নিতে হবে। গণপ্রাঙ্গণে ভাস্কর্য নির্মাণে ঠিকাদারি পদ্ধতি বিলোপ করতে হবে। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যোগ্য ও প্রকৃত ভাস্করদের মানসম্পন্ন কাজ স্বয়ং ভাস্করের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করতে হবে। নগর কর্তৃপক্ষগুলো জাতীয়ভিত্তিক ‘ভাস্কর্য সিম্পোজিয়ামের’ মাধ্যমে মানসম্পন্ন ভাস্কর্য বাছাই ও নির্মাণের মাধ্যমে পার্ক, আইল্যান্ডগুলোকে উন্নত দেশগুলোর মতো নান্দনিকভাবে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন। নগরের বাইরের পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে আরও দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে ভাস্কর্য উদ্যান নির্মাণ একটি শক্তিশালী উদ্যোগ হতে পারে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক স্থানগুলোও ভাস্কর্য উদ্যান নির্মাণের মাধ্যমে আরও সমৃদ্ধ করে তোলা সম্ভব। এসব উদ্যোগ গৃহীত হলে দেশের প্রতিভাবান ভাস্কররা যেমন তাদের শিল্পচর্চায় উৎসাহিত হবেন তেমনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎকর্ষেও শিল্পমাধ্যম হিসেবে ভাস্কর্যের শক্তিশালী ভূমিকা নিশ্চিত হবে।
নব্বই দশকের শুরুতে কলকাতার বাংলাদেশের শিল্পকলার এক আলোচনায়, কবি ও শিল্পী পুর্ণেন্দু পত্রীর একটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন এদেশের শিল্পকলার খতিয়ান তৈরিতে সাহায্য করতে পারে। শিল্পী হাশেম খানের বয়ান অনুযায়ী পত্রীর প্রশ্নটি ছিল মানব অবয়বের অনুপস্থিতি বিষয়ক। ‘কথোপকথন’ খ্যাত কবির খেদোক্তি যে, বাংলাদেশের শিল্পীরা বইয়ের নকশা ও অঙ্গসজ্জায় যেমনটা মানুষের দেহ আঁকেন তেমনটা চিত্রকলায় উঠে আসে না। উত্তরে হাসেম খান জানান যে, আমাদের দেশে নানান মাত্রার ছবির চর্চা আছে তার মধ্যে বিমূর্ত ছবির চর্চা একটি ধারা। এই উত্তর পত্রীকে খুশি না করলেও, প্রখ্যাত শিল্পী সুনিল দাসকে প্রাণিত করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সুনিল দাস নিজে নানান উপায়ে চিত্রতলে মানব অবয়বকে হাজির করে ও অনুপস্থিত রেখে ছবি এঁকে গেছেন। এদেশের শিল্পকলার আদ্যোপান্ত বুঝতে ওপরের তর্কের প্রাসঙ্গিকতার দিকটি আরও খোলাসা করে বলা দরকার।
মূর্ত-বিমূর্ত দ্বৈততার মধ্য দিয়ে এদেশে শিল্পবিষয়ক আলোচনা বরাবরই শিল্পাঙ্গনে নানান মাত্রার চর্চার দিকটিকে অগ্রাহ্য করবার পথ তৈরি করে দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রগতিশীলতার যে লঘু অথচ মতাদর্শিক তাপে উদ্বুদ্ধ কিছু বুদ্ধির চর্চা আজও প্রচলিত আছে তার মধ্যে মানব মূর্তির প্রতি ইসলাম ধর্মের সন্দেহকে সাধারণ বৃত্তিবাদী মওলানার বয়ানের ভুল ব্যাখ্যার বিপরীতে দাঁড় করানোকে ভুল ব্যাখ্যার উদাহরণ বলে আখ্যা দেওয়া যায়। যেমন নবী ইব্রাহিমের প্রবর্তিত পথ, যে পথে আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তা ও তার প্রেরিত পুরুষদের আকৃতি দানের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে; তাকে কাঠমোল্লার বুদ্ধি দিয়েই মানুষ-প্রাণী আঁকা যাবে না এমন তর্ক বারবার উত্থাপন করা হয়। নবীকে পূজনীয় না করে তোলা, এমনকি অদৃশ্যকে দৃশ্যমান না করে তুলে যে তাকওয়াভিত্তিক জীবন তার অপব্যাখ্যার সূত্রে বাংলাদেশের শিল্পে মূর্ত-বিমূর্তের বিরোধ জিইয়ে রাখার শিল্পশিক্ষা যেমন পূর্ণাঙ্গ হয়নি, তেমন শিল্প বিষয়ে দার্শনিক আলোচনা তেমন এগোতে পারেনি।
বিমূর্ততা পন্থিদের পাশ্চাত্যমুখী শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত করার যে সাধারণ প্রবণতা, তার মধ্যেও বিবেচনার দিকটি উহ্য থাকে। এর ফলে নানান মাত্রার অবয়বধর্মী শিল্পীদের এক কাতারে ফেলে দিয়ে বিচারের বাইরে নিয়ে আসার প্রক্রিয়াটা আজও জারি আছে। এ কারণে জয়নুল আবেদিন কেন পাশ্চাত্যের বাস্তবানুগ রীতি শিক্ষা বারবার বাসনা পোষণ করলেন, এমনকি শিক্ষক মুকুল দে’র অনুরোধ অগ্রাহ্য করে কেন বিলাতি কলম শিক্ষা করে পরে নিজ পথ তৈরির করলেন, এর ওপর তেমন গুরুত্বপূর্ণ আলো পড়েনি। ময়মনসিংহের শিক্ষার্থী জয়নুল যখন তিরিশের দশকের শুরুতে শিল্পের পাঠ নিচ্ছেন, তখন প্রাচ্যকলা বলে একটি পদ্ধতি চালু হয়ে গেছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন সেই ধারার মহীরুহের মতন। কিন্তু প্রাচ্যরীতির কোমলতার পাঠ না নিয়ে জয়নুল শিখে নিতে চাইলেন বাস্তবকে তার সব রুক্ষতাসহ আঁকবার পদ্ধতি। রেখার ঋজুতা তিনি অর্জন করলেন রেমব্রার মতো শিল্পী থেকে এবং রেখাকেই মুখ্য করে চিত্রতল থেকে রঙ ও আলোছায়া বিদায় করে দেওয়ার চাতুরীটি শিখলেন চৈনিক ধারার শিল্পী সু থে হং থেকে। এই সাধারণীকরণের পর জয়নুল বিষয়ে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দুই মেরু একের আওতায় নিয়ে আসবার ক্ষমতা, পর সূত্রে তার আপন চিত্রভাষার যা আঙ্গিক তারই সাধনার নিমিত্তে ধরা দিল। প্রাচ্য-প্রতীচ্য বিষয়ক সাধারণীকৃত তর্কও বাংলাদেশের চিত্র, ভাস্কর্য ও বর্তমান সময়ের আন্তঃশৃঙ্খলার সূত্রে তৈরি স্থাপনা বা কনসেপচুয়াল উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ডিসকোর্স তৈরিতে তেমন সাহায্য করে না। ‘দেশজ’ কথাটি এমন এক সামান্যতার জন্ম দিয়েছে যার মধ্যে যে কোনো প্রকার গ্রামীণ বিষয়ের রেফারেন্স বা উল্লেখ শিল্পের ভাষা তৈরিতে সাহায্য না করেও এতে তাৎপর্য দান করেছে ধরে নেওয়া হয়। এশীয় দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনী, কিংবা চারুকলার জাতীয় প্রদর্শনীতে সরা চিত্রের বৃহৎ সংস্করণ কিংবা টেপা পুতুলের উপস্থাপনা এখন দর্শকের আনন্দ বাড়ায়, কিন্তু শিল্পের সৃষ্টিশীলতায় সাহায্য করছে না ধরে নেওয়া যায়। কামরুল হাসানের পর গ্রামীণ কলম ব্যবহার করে নতুনতর সৃষ্টির তেমন কোনো বিশেষ উদাহরণ চোখে পড়ে না। কামরুলই তার স্বভাবসুলভ সহজতায় আধুনিক শিল্পের আয়তনে গ্রামীণ শিল্পীর রেখা ও রঙ ব্যবহার করে নতুন চিত্রকল্প গড়ে তুলেতে পেরেছিলেন। এ অঞ্চলে কামরুল রাজনৈতিক চিত্রভাষারও প্রবর্তক। তার রাজনৈতিকতার সূচনা হয় ইয়াহিয়া খানের মুখাবয়ব আঁকার সূত্রে। যে মানব-জন্তু শিল্পী স্বাধীনতার বছরখানেক আগে আঁকা শুরু করেন, তার জৈবিক মাত্রা অবশেষে (সত্তর দশকের শুরুতে) এক প্রকার বুদ্ধিবৃত্তিক রূপ পায়। এগুলো তার সমাজ বিশ্লেষণমূলক কাজ। স্বাধীনতার পর, নতুন বুর্জোয়া শ্রেণির নতুন মেকি সমাজকে শিল্পী প্রাণী অবয়বের পাশে মানব মূর্তি স্থাপন করে এক প্রকার বহুমাত্রিক ও বহুসংখ্যক মোটিভ-নির্ভর ভাসমান চিত্রকল্প তৈরি করেন। প্রথম দিককার এই ‘ক্রিটিক্যাল ইমেজ’ শিল্পী সাদা-কালো ছাপচিত্র মাধ্যমে করেন। একই প্রবণতার মধ্য দিয়ে কামরুল তার ১৯৭১ স্মরণে আঁকা ১৯৮৩ সালের ক্যানভাসগুলোতে মানবমূর্তির জঙ্গম এক ক্ষেত্র সৃষ্টি করেন। যদি বাংলাদেশে উচ্চরুচির সূত্রে দেখার সমস্যা তৈরি হয়ে থাকে, যদি পদ বিমূর্ততার মধ্য দিয়ে শিল্প বিচারের কোনো প্রকার ব্যত্যয় ঘটে থাকে, তা কামরুলের এই গোয়েরনিকাসুলভ কাজগুলোকে মূল্যায়ন না করার মধ্যে চিহ্নিত করা যায়।
বাংলাদেশে মানব অবয়বের নতুন মাত্রা যোগ করে যারা দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন তারা আশির দশকের কিছু তরুণ। এদের মধ্যে রুহুল আমিন কাজল, জিতেন্দ্র কুমার শর্মা, শিশির ভট্টাচার্য, নিসার হোসেন, ঢালী আল মামুন ও ওয়াকিলুর রহমান অন্যতম। গত দুই দশকে তাদের ভাষার বিবর্তন ঘটেছে। ওয়াকিলুর রহমান মানব অবয়ব ছেড়ে বিমূর্ত ধারার শিল্পী হয়ে উঠেছেন। কাজল ক্যানভাসের কাজের পাশাপাশি কাগজে এমনকি রাস্তায় তার শিল্পের বিস্তার ঘটিয়েছেন। শেষ চারজনের খ্যাতির সূচনা সময় শিল্পী দলের আবির্ভাব কালেই। এই শিল্পীদের অঙ্গীকার ছিল শিল্পে সমাজ বাস্তবতা, রাজনীতি ও বিশ্লেষণী চিন্তার প্রকাশ ঘটানো। পরবর্তী সময়ে তাদের নিজ নিজ চিত্রভাষায় ও নির্মাণ প্রক্রিয়ায় নবতর মাত্রা যুক্ত হয়েছে। তবে যে নারী শিল্পী ‘সময়ে’র সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে নারী অবস্থান নিয়ে জোরালো বক্তব্য হাজির করেছিলেন, সেই দিলারা বেগম জলির কাজে ক্রমশই অবয়ব ও অবয়বহীন তার লীলা তার আন্তরমাধ্যম-নির্ভর শিল্পকে সমৃদ্ধতর করে তুলেছে। তার সাম্প্রতিকতম একক নারী ও জঠর এই দুয়ের সূত্রে যে স্থাপনা ও আলোকচিত্রে অসংখ্য ছিদ্র গড়ে তুলে আপন ওপরের অস্তিত্বর আকারায়ন ঘটিয়েছেন, এমন তুরীয় প্রকাশে মূর্তের সাথে বিমূর্ত একাত্মায় পরিণত।
নারী শিল্পীদের কাজে, এমনকি নারীভাব প্রকাশ করে এমন শিল্পীদের হাতে মূর্ত-বিমূর্তের সীমানা লঙ্ঘিত হতে দেখা যায়। রোকেয়া সুলতানা এবং নাইমা হক, এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দুজনই নারীর চোখে দুনিয়া দেখার দিকটি এমন নিজস্ব ভাষা ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছেন যে, তাদের আপন ভাষারও নানান স্তর তৈরি হয়েছে তা পরখ করে দেখবার অবকাশ থাকে। বিশেষ করে রোকেয়ার মাতৃত্ব থেকে শুরু করে নারী প্রকৃতি ও বৃহত্তর প্রকৃতির ওপর মনোযোগ তাকে ক্রমশ মূর্ততা থেকে বিমূর্ততার দিকে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশে নারী শিল্পীদের বিকাশ ও চিত্রভাষার প্রকৃতি বিষয়ক আলোচনায় আরও যারা জড়িত ছিলেন এবং এখনো আছেন তাদের কেউ কেউ জিজ্ঞাসু দৃষ্টির বদলে অপলক দৃষ্টিতে দেখবার জগৎ তৈরি করতে চেয়েছেন, ফরিদা জামান তাদেরই একজন।
দেখাকে দর্শনে পরিণত করতে পুরুষ শিল্পীরা সম্পূর্ণ বিমূর্ত চিত্রতল তৈরি করে আসছিলেন ষাটের দশক থেকেই। এরাই দ্বিতীয় প্রজন্মের আধুনিক শিল্পী যারা ‘পেইন্টার হিরো’ হিসেবে সমাজে যা চিত্রকলার জগতে আধুনিকতাকে একটি মাত্রায় সমাসীন রেখে দৃুিষ্ট এঁকে গেছেন। মোহাম্মদ কিবরিয়া, কাজী আব্দুল বাসেত এদের পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় ছিলেন যতদিন তারা বেঁচেছিলেন। উল্লেখ্য যে, কিবরিয়ার আজীবন সাধনার ফল যে প্রকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত রঙ ও টেক্সচারের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা উচ্চ কোটির রুচি প্রকাশকারী বিমূর্ত চিত্রভাষাই এদেশের শ্রেষ্ঠ অর্জন হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। ওর অন্য পক্ষ হিসেবেই অবয়ববাদীদের উত্থান ঘটে স্বাধীনতার ঠিক পর পর। নতুন সমাজ গড়ার বাসনালব্ধ যে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ সমাজতন্ত্রকে আধেক ফ্যাশন ও আধেক বাস্তব হিসেবে গ্রহণ করে নিতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের অগ্রগামী অংশ দ্বিধাহীন ছিল তারই পরম্পরায় শাহাবুদ্দিনসহ নতুন প্রজন্মের মানবমূর্তি-নির্ভর চিত্রী ও ভাস্করদের চিহ্নিত করা যায়। আব্দুল্লাহ খালিদ ওই বৃত্তের না হয়েও এর কাছাকাছি অবস্থান থেকে গণপরিসরে তার ভাস্কর্যগুলো নির্মাণ করেছিলেন।
সমাজ-সমালোচনাধর্মী চিত্রভাষা কামরুল হাসানের অবদান। অন্যদিকে শেখ মোহাম্মদ সুলতান বাংলাদেশের চিত্রকলায় ‘আদিম ও আদমকে একই সূত্রে গেঁথে’ ‘মৃত্তিকাপুষ্ট জীবনকে’ (ছফা ১৯৮৫) নতুন কল্পনার নিরিখে সমাজ গড়ার শিল্পী। সমাজ ও সমাজ মানসে সাম্যের খোদ ধারণাট জাগিয়ে তোলার মধ্যদিয়ে সুলতান মানব অবয়বে আদিম সমাজের সত্য ফিরিয়ে এনে নতুন সমাজ গড়ার বীজমন্ত্র গড়ে দিয়েছেন যেখানে কিষাণ-কিষাণীরা নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কামরুনের রাজনৈতিকতায় যদি শ্রেণির বিষয়টি মুখ্যতা পেয়ে থাকে, সুলতানের বৈপ্লবিকতায় ভূমির মালিকানার প্রশ্নটির সুরাহা করতে গ্রামীণ নায়কেরা হয়ে উঠলেন আদিশক্তির প্রতীক। স্বাধীন দেশে মানব অবয়বে ফিরে গিয়ে সমাজ ও চিত্রতলের মধ্যে নতুনতর যোগাযোগ গড়বার আয়োজনে এই দুই শিল্পী নতুন নিশানারও প্রতীক।
স্বাধীনতার আগের আধুনিক শিল্পের উত্থান পর্বের শিল্পী নভেরা আহমেদ আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সোপন গড়ে দিয়েছেন। তার প্রভাব কিছু কিছু নারীশিল্পীর ক্ষেত্রে ভাস্কর্যের জগতে প্রবেশের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। যে যৌথ অজ্ঞানের সূত্রে ষাটের দশকের পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশে বিমূর্তবাদীদের উত্থান লক্ষ করা গেছে, তার সূত্রে আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীরসহ অনেক প্রতিভা অবয়বহীন চিত্রতল গড়ার দিকে ঝুঁকলেন, তা থেকে তফাতে থেকে নভেরা অবয়বের ফর্মাল ভাঙাগড়ার মাধ্যমে তার চিত্রভাষার সুরাহা করলেন। স্বাধীনতার কয়েক বছর আগে এই শিল্পীর দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে যে শূন্যতা তৈরি হলো তা পরবর্তী তিন দশকেও পূরণ হয়নি। নভেরার ভাষার প্রাথমিক ও পরবর্তী বিকাশ লক্ষ করলে হলফ করে বলা যায, তিনিও তার পরবর্তী নারীশিল্পীদের মতোই মূর্ত-বিমূর্তের বৈপরীত্য মেনে না নিয়ে দুই মেরুতেই সহজে গমন করবার সূত্রে আকারায়নের প্রশ্নের সুরাহা করেছেন।
শিল্পে কর্ম বা অর্থ উৎপাদন শিক্ষিত শ্রেণির আদর্শগত পক্ষপাতের ওপর নির্ভরশীল। আশির দশকের তরুণরা ধর্ম-সমাজ অপেক্ষা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের যে পথনির্দেশনা অনুসারে সামরিক শাসন ও ধর্মপন্থি রাজনৈতিক দলের অনাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, তার মধ্যে দিয়েই বিমূর্ত বনাম মানব অবয়বপন্থি শিল্পের বয়ান পাকা ভিত পেল। নারী শিল্পীরাও অবয়বের এমনতর নতুন ব্যবহার সামনে নিয়ে এলেন যেন নারীর অবস্থানের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, যেন চিত্রকল্প প্রচলিত মত ও পথ থেকে সরে এসে নুতন দিকে মুখ ফেরাতে পারে। নাজলী লায়লা মনসুরের পর এই পথে আতিয়া ইসলাম এ্যানিসহ নিরুফার চামান এবং বর্তমান সময়ে বহুপ্রজ শিল্পী দিলারা বেগম জলি।
যে রাজনৈতিক ওজনের ভার শিল্পীরা বহন করবার সাহস দেখালেন, গড়ে তুললেন নতুনতর সমালোচনাধর্মী ইমেজ বা মূর্তি, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়েছে। কিন্তু নব্বই দশকের প্রবণতায় যে মাধ্যমের মিশ্রতা একটা বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখল তা ভিন্ন এক শিল্পজ রাজনৈতিকতার সূত্রে জন্ম নিল। জিএস কবিরের ভূমিকা এখানে স্মরণযোগ্য।
এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের চারুকলার ইতিহাস হিসেবে যা আমাদের সামনে হাজির করা হয় তা মূলত প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। ইউরোপকেন্দ্রিক জ্ঞানের আলোকে আধুনিকতাবাদী ধারণার ওপর ভিত্তি করে এই ইতিহাস তৈরি করা হয়েছে যার মধ্যে ঔপনিবেশিক প্রভাব প্রবল। এর ফল হয়েছে এই যে, বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পধারাকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করা এবং উপযুক্ত স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সেসব শিল্পধারাকে বিকশিত করার অনুকূল পবিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
১৯৪৭ এর দেশভাগের পর বাংলাদেশের চারুকলার ইতিহাসে দুটি বিশিষ্ট/স্বতন্ত্র ধারার উদ্ভব ঘটেছিল। এর প্রথমটির কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক চারুকলার ধারা যেটি বিকশিত হয়েছে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত (১৯৪৮) আর্ট ইনস্টিটিউটকে কেন্দ্র করে (বর্তমানে যেটি চারুকলা অনুষদ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত)। কিন্তু প্রায় একই সময়ে, দেশভাগের পর পর ঢাকার এই শিল্প-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরও কিছু শিল্পশৈলী/শিল্পধারার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল। এটাকে আমরা অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারা বলতে পারি। এই অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারার নেতৃত্ব দিয়েছেন পীতলরাম সুর, আর.কে. দাস, আলাউদ্দিন, আলী নুর, দাউদ উস্তাদ প্রমুখ শিল্পীরা। এইসব অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের মাধ্যমেই বিকশিত হয়েছে এদেশের সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং, রিকশা আর্ট, ট্রাক আর্ট ইত্যাদি। আর এগুলোর মধ্যে যেটি নিজস্ব শিল্পশৈলী, উপস্থাপন রীতি ও বিষয়বস্তুর স্বকীয়তায় ইতিমধ্যে দেশে-বিদেশে সুধীজনের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটি হলো রিকশা আর্ট। এই লেখায় আমরা মূলত রিকশা আর্টের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে কিছু আলোচনা করব।
২.
মূলত চাকা আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে তিন চাকার বাহন রিকশার সূত্রপাত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ১৮৭০ সাল নাগাদ। অবিভক্ত বাংলায় রিকশার প্রচলন ঘটে কলকাতায় বিশ শতকের প্রথম ভাগে। কাছাকাছি সময়ে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডে রিকশার প্রচলন হয় প্রথমে ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জে এবং পরে ঢাকায় (১৯৩৮)। তবে বাংলাদেশে প্রচলন ঘটে সাইকেল রিকশার, মানুষে টানা রিকশা নয়। বাহারি ও শৌখিন পরিবহন হিসেবে ঢাকায় রিকশার আগমন ঘটে এবং ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর ক্রমশ তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত রিকশা পেইন্টিংয়ের সূত্রপাত হয় এই সময় থেকেই। অর্থাৎ ঢাকাকেন্দ্রিক আধুনিক ধারার প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলার পাশাপাশি লোকয়াত শিল্পীদের মাধ্যমে রিকশাচিত্র তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় হতে থাকে। বাংলাদেশে রিকশা পেইন্টিংয়ের প্রবীণ ও বিখ্যাত শিল্পী যেমন আর. কে. দাশ, আলী নূর, দাউদ উস্তাদ, আলাউদ্দিনসহ অন্যরা পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকেই রিকশা পেইন্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী রিকশা পেইন্টিংয়ের চাহিদা ছিল তখন অনেক বেশি। ছবি আঁকার আনন্দ, সেই সঙ্গে এই কাজের ক্রমবর্ধমান চাহিদা তাদের এই পেশায় যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছে। এদের অনেকে আগের পেশা বা পৈতৃক পেশা ছেড়ে এই পেশায় যুক্ত হন। যেমন আর. কে. দাশের পৈতৃক পেশা ছিল চামড়ার কাজ। তিনি ও তার পুত্ররা এসেছেন রিকশা পেইন্টিংয়ের কাজে। লক্ষণীয়, চারুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিল্পীদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই এই বিশেষ শৈলীর উদ্ভব ও বিকাশে।
৩.
করণকৌশলের দিক থেকে রিকশার অঙ্গসজ্জাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এর একভাগে রয়েছে রেকসিন, প্লাস্টিক, আয়না, ঘণ্টা বা বাতিল সিডি ও অন্যান্য উপকরণে রিকশা অলংকরণ (টিন কেটে বিভিন্ন কারুকাজ করার উদাহরণও দেখা যায়) এবং অন্য দিকে রয়েছে রঙের সাহায্যে রিকশাকে চিত্রিত করার বিষয়টি। তবে একটি নতুন রিকশাকে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করে তোলায় রিকশা পেইন্টারদের বিশেষ কৃতিত্ব দিতেই হবে। রিকশা আর্টের মূল লক্ষ্য রিকশাকে সুসজ্জিত ও আকর্ষণীয় করা। আর এজন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তু নির্বাচন করা হয়, বিশেষত পেছনের প্যানেলে আঁকার জন্য। সাধারণত শিল্পীরা মহাজন এবং ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ছবি এঁকে থাকেন।
গত সত্তর বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে রিকশা পেইন্টিং করা হয়েছে। যেমন, ষাটের দশকে রিকশা পেইন্টিং করা হতো মূলত শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র তারকাদের প্রতিকৃতিকে অবলম্বন করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে বিষয়বস্তু করে অনেক ছবি আঁকা হতো রিকশায়। আবার সত্তরের দশকে নতুন দেশের নতুন রাজধানী হিসেবে ঢাকা যখন বাড়তে শুরু করে তখন কাল্পনিক শহরের দৃশ্য আঁকা হতো রিকশায়। পাশাপাশি, সব সময়ই, গ্রামের জনজীবন, প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবিও আঁকা হতো, এখনো হয়। এছাড়াও বিভিন্ন স্টাইলের ফুল, পাখি ইত্যাদি তো আছেই।
বিভিন্ন মিথ বা ধর্মীয় কিংবদন্তিকে বিষয় করে রিকশায় ছবি আঁকতে দেখা যায়। যেমন, মুসলিম উপাখ্যানের দুলদুল, বোরাক কিংবা আরব্য রজনীর উপাখ্যানআলাদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ ও দৈত্য, রাজকন্যা, রাজপ্রাসাদ ইত্যাদি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাদায় আটকে যাওয়া গরুর গাড়ির ছবিটি (‘সংগ্রাম’ নামে পরিচিত) রিকশাচিত্রীরা বিভিন্নভাবে এঁকেছেন। দূরবর্তী ভিনদেশি দৃশ্যও রিকশাচিত্রে দেখা যায়। যেমন, মরুভূমির ভেতর উট নিয়ে চলেছে দুই বেদুইন, কিংবা অচেনা কোনো সমুদ্র সৈকতে খেলা করছে কোনো বালক, জাপানের কোনো বাড়ি, লন্ডন ব্রিজ, আইফেল টাওয়ার, টাইটানিক জাহাজ ইত্যাদি। স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন, শহীদ মিনার ইত্যাদি স্থাপত্য রিকশাচিত্রের বিষয় হয়েছে বহুবার। মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন তাজমহল রিকশা পেইন্টিংয়ের আরেকটি জনপ্রিয় বিষয়। তাজমহল এঁকেছেন বিভিন্ন শিল্পী নিজের নিজের মতো করে বহুবার। ইদানীং রিকশাচিত্রীদের আরেকটি প্রিয় বিষয় যমুনা সেতু (বঙ্গবন্ধু সেতু)। এছাড়া ডাইনোসরের সঙ্গে যুদ্ধরত লুঙ্গিপড়া খালি গায়ের বাঙালি রিকশাচিত্রীদের অপূর্ব কল্পনাশক্তির নিদর্শন।
তবে এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, রিকশায় মানুষ আঁকার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে রিকশা পেইন্টাররা মানুষের পরিবর্তে পশুপাখির ছবি আঁকতে শুরু করেন। যেমন, ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে একটা শেয়াল, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একটা বাঘ, পাশে স্কুল বালকের মতো ব্যাগ কাঁধে খরগোশ ছানা চলেছে স্কুলে। শহরের অতি পরিচিত দৃশ্যশুধু কোনো মানুষ নেই, মানুষের স্থান দখল করেছে বিভিন্ন পশুপাখি। অনেকটা প্রয়োজনের তাগিদে বাধ্য হয়ে আঁঁকা হলেও এই ধারার কাজগুলো বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। এই ধারার কাজগুলোর ভেতর দিয়ে তৎকালীন সমাজ বাস্তবতাকে তুলে ধরা হয়েছে বলেও মনে করেছেন কেউ কেউ।
রিকশা পেইন্টিংয়ের কাজের ধরনের মধ্যে কখনো কখনো বাংলার লোকায়ত ধারার প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে রেখার ব্যবহারে এই প্রভাব অধিক চোখে পড়ে। আবার বিভিন্ন ক্যালেন্ডার বা ছাপা ছবিকে মূল হিসেবে ব্যবহার করে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়েও রিকশা পেইন্টাররা ছবি এঁকে থাকেন। তবে রিকশা পেইন্টংয়ে, বিশেষ করে রঙ নির্বাচনে, সিনেমার ব্যানার চিত্রীদের কাজে প্রভাব পড়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়।
৪.
তবে সরেজমিনে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, শিল্পধারা হিসেবে রিকশা আর্ট ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। ঢাকায় বর্তমানে (২০২৩) আনুমানিক ১০-১২ জন সক্রিয় রিকশাচিত্রী আছেন। ঢাকা ছাড়াও রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর, খুলনা, পাবনা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ইত্যাদি শহরে আরও কিছু রিকশাচিত্রী কমবেশি কাজ করেন। হাতে আঁকা প্লেটের বিকল্প হিসেবে ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যাপক ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় এই বিশেষ রীতির চিত্রকলা আজ হুমকির সম্মুখীন। পেশাগত দিক দিয়ে হুমকির সম্মুখীন রিকশা পেইন্টাররা। ইতিমধ্যে বেশির ভাগ রিকশাচিত্রী পেশা পরিবর্তন করেছেন বা বিকল্প কাজ খুঁজে নিয়েছেন। ঢাকায় যারা এখনো সক্রিয়, তারা মূলত বিদেশি ক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল। বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামীণ দৃশ্য যেমন ধান ভানা, উঠোনে বিশ্রাম নেওয়া, নদীতীরে সূর্যাস্ত ইত্যাদির পাশাপাশি সিনেমার পোস্টারের অনুকরণে আঁকা ছবিতে ক্রেতাদের চেহারার আদল ফুটিয়ে তোলা হয় এসব ছবিতে। এগুলো বিদেশিরা বাংলাদেশের স্মারক হিসেবে কিনে নিয়ে যান। আবার অনেক ক্রেতা পারিবারিক ছবি, বিয়ের ছবি, সন্তানদের বা বন্ধুদের ছবি রিকশা পেইন্টিংয়ের ঢঙে আঁকিয়ে নিতে পছন্দ করেন। তারপরও অনেক শিল্পী চেষ্টা করেন তাদের কল্পনাকে কাজে লাগিয়ে পছন্দসই বিষয়বস্তুর ছবি আঁকতে। বিদেশিদের শখ মেটানো গেলেও, তাতে রিকশাচিত্রীদের জীবনে, দু’য়েকটি বিরল ব্যতিক্রম বাদে, বিশেষ কোনো হেরফের হয়েছেএমনটা মনে হয় না।
৫.
অন্যদিকে, রিকশাচিত্র নিয়ে নতুন সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। দেশের বাইরে রিকশা আর্টের সমাদর লক্ষণীয়। যেমন, ১৯৮৮ সালে লন্ডনে মিউজিয়াম অব ম্যানকাইন্ডে (বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের অন্তর্ভুক্ত) শিরিন আকবরের কিউরেটিংয়ে ঢাকার রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘Traffic Art: rickshaw paintings from Bangladesh’। ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের সুসজ্জিত ও চিত্রিত রিকশা সংগৃহীত আছে। জাপানের ফুকুয়াকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছে এবং এই মিউজিয়ামে রিকশা পেইন্টিংয়ের একটা বড় সংগ্রহ আছে। সম্প্রতি (২০১৩) জাপানের তাকামাৎসু শহরে একটি আর্ট ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের রিকশাচিত্র বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে। নেপালেও হয়েছে বাংলাদেশের রিকশাচিত্রের প্রদর্শনী। তবে বাংলাদেশে রিকশা পেইন্টিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনীটি হয়েছে ১৯৯৯ সালে ঢাকায় অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। এই প্রদর্শনীতে পাঁচশ জন রিকশা পেইন্টার এবং তিরাশি জন বেবিট্যাক্সি (দুই স্ট্রোক বিশিষ্ট অটো রিকশা) পেইন্টারের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছিল। সম্প্রতি জার্মানির ক্যাসল শহরে অনুষ্ঠিত ‘ডকুমেন্টা ১৫’-এ বাংলাদেশের আরও অনেক শিল্পীর সঙ্গে অংশ নিয়েছেন রিকশাচিত্রী তপন দাস ও সিনেমা ব্যানার শিল্পী আবদুর রব খান। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার মিউজয়ামে রিকশাচিত্রের কর্মশালা করেছেন আহমেদ হোসেন। এমনকি, কিছুদিন আগে, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্পী ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী রিকশা আর্ট কর্মশালা যেখানে নতুন শিল্প-শিক্ষার্থীরা সরাসরি রিকশাচিত্রীদের কাছে হাতেকলমে শিখতে পেরেছেন বিভিন্ন কলাকৌশল এবং এই শিল্পের নিজস্ব নান্দনিকতা। এছাড়াও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বৃত্ত আর্ট ট্রাস্ট, যথাশিল্প রিকশাচিত্র নিয়ে নানা ধরনের কাজ করে থাকে।
রিকশা আর্ট বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পশৈলী। আমরা যদি এখনই সুচিন্তিত ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ না করি তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো এর স্থান হবে শুধু জাদুঘরে। আমরা কি সেই দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করব? আমার ধারণা, এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে রিকশাচিত্র বহমানতা বজায় রেখে স্বতন্ত্র শিল্পশৈলী হিসেবে টিকে থাকতে পারবে বলে আশা করা যায়।
ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে জেলেখা বেগম নামে এক বৃদ্ধাকে মৃত দেখিয়ে তার বয়স্ক ভাতার কার্ড বাতিল করা হয়েছে। বিগত ৫ মাস যাবৎ তিনি বয়স্ক ভাতা বঞ্চিত রয়েছেন বলে জানা গেছে। অপরদিকে তার নাম পরিবর্তন করে আমিনা নামে অন্যজনকে বয়স্ক ভাতার কার্ড বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় মেম্বার বাদশার বিরুদ্ধে।
রানীশংকৈল উপজেলার নন্দুয়ার ইউনিয়নের সাতঘরিয়া গ্রাম এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেলেখা বেগম নন্দুয়ার ইউনিয়নের সাতঘরিয়া গ্রামের আ. রহিমের স্ত্রী। পূর্বের চেয়ারম্যান ওই বৃদ্ধার নামে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেন।
ভুক্তভোগী বলেন, আমি ভাতার কার্ড পাওয়ার পর থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর ১৫০০ টাকা করে পেয়েছিলাম। কিন্তু গত তারিখে আমার টাকার কোনো মেসেজ না আসায় আমি উপজেলা সমাজসেবা অফিসে গিয়ে জানতে পারি আমাকে মৃত দেখিয়ে আমিনা নামে ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন মেম্বার বাদশাহ।
ইউনিয়ন পরিষদে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৃত্যুর নিবন্ধন বইয়ের ২০২১ সালের রেজিস্ট্রারে বৃদ্ধার মৃত্যু নিবন্ধিত নেই। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এমন একটি সনদ দেওয়ায় তার ভাতাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তিনি এ বিষয়ে আরও বলেন, আমি জীবিত থাকার পরও মেম্বার বাদশাহ আমাকে মৃত দেখিয়ে আরেকজনের নামে কিভাবে টাকা খেয়ে ভাতার টাকা পরিবর্তন করে দেয়! আমি জীবিত থাকার পরও মেম্বার আমাকে মৃত দেখাল। আমি গরিব মানুষ। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নাই। এই টাকা দিয়ে ওষুধ খেয়ে বেঁচে আছি। আমি এর বিচার চাই।
মেম্বার বাদশাহ বলেন, প্রথমবারের মতো এমন ভুল করেছি। সামনের দিকে সর্তকতার সাথে কাজ করব।
নন্দুয়ার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বারী বলেন, জীবিত মানুষ মৃত দেখিয়ে ভাতার কার্ড পরিবর্তনের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে মেম্বার যদি করে থাকেন তাহলে খুবই খারাপ করেছেন।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুর রহিম বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরিত একটি প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে জানতে পারি, জেলেখা বেগম ৭ ডিসেম্বর ২০২১ এ মৃত্যু বরণ করেন। তাই ভাতাটি বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ওয়েবসাইটে মৃত্যু সনদ যাচাই ছাড়া সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর কাউকে মৃত দেখাতে পারবে না- সাংবাদিকের এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের এভাবেই হয়। আমরা এভাবেই করে থাকি, প্রত্যায়নপত্র দেখে প্রতিস্থাপন করে থাকি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমাজসেবা অফিসে প্রেরিত প্রত্যায়নটির কোনো তথ্য ইউনিয়ন পরিষদের ফাইলে সংরক্ষণ করা হয়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল সুলতান জুলকার নাইন কবির বলেন, এটি সংশোধনের কার্যক্রম চলমান। তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, এটি একটি গুরুতর অভিযোগ। আমরা তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেব।
বিরতি কাটিয়ে আবারও আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফিরছে আর্জেন্টিনা। গত মার্চে ঘরের মাঠে সবশেষ আকাশী-নীলদের দেখা গিয়েছিল তিন মাস পর আগামী জুনে তারা আসছে এশিয়া সফরে। সফরকালে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচও খেলবেন লিওনেল মেসিরা।
আগামী ১৫ জুন বেইজিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামবে আর্জেন্টিনা। চারদিন পর ১৯ জুন জাকার্তায় ইন্দোনেশিয়ার মুখোমুখি হবেন তারা। সেই ম্যাচ দুটিকে সামনে রেখে আজ দল ঘোষণা করেছেন দেশটির কোচ লিওনেল স্কালোনি। লিওনেল মেসিকে অধিনায়ক করে ২৭ সদস্যের দল ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু নাম। এই দলে এই দলে চমক হিসেবে রয়েছে আলেজান্দ্রো গার্নাচো। যিনি বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনার প্রথম প্রীতি ম্যাচের দলে ছিলেন। তবে চোটের কারণে অভিষেকের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে আলো ছড়িয়েছেন গার্নাচো। গত বছরের জুলাইয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মূল দলে জায়গা হয় তার। এখন পর্যন্ত ক্লাবটির হয়ে ৩৫ ম্যাচ খেলেছেন এই লেফট উইঙ্গার। এখন পর্যন্ত নিজে করেছেন ছয়টি গোল, করিয়েছেন আরও ছয়টি। এমন পারফরম্যান্স নজর এড়ায়নি স্কালোনির। তাই জাতীয় দলে জায়গা পেতে বেগ পেতে হয়নি।
দলের তৃতীয় গোলকিপার হিসেবে জায়গা পেয়েছেন ওয়াল্টার বেতিনেজ। এছাড়া বেশ কয়েক বছর পর দলে ফিরেছেন লিওনার্দো বলের্দি। ফরাসি ক্লাব মার্সেইয়ের হয়ে চলতি মৌসুমে তিনি দুর্দান্ত খেলছেন। তবে স্কোয়াডের মাঝ মাঠের ফুটবলারদের নিয়ে কোনো চমক নেই।
তবে এই স্কোয়াডে নেই লাউতারো মার্তিনেজের নাম। গোড়ালির চোটের কারণে এই দুই প্রীতি ম্যাচে তাকে পাচ্ছে না আর্জেন্টিনা। তবে তার জায়গায় মাঠ মাতাতে দেখা যাবে জিওভানি সিমিওনেকে।
আর্জেন্টিনার ২৭ সদস্যের দল
গোলরক্ষক:
এমিলিয়ানো মার্টিনেজ (অ্যাস্টন ভিলা), জেরনিমো রুলি (আয়াক্স), ওয়াল্টার বেনিটেজ (পিএসভি)।
ডিফেন্ডার:
নাহুয়েল মোলিনা (অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ), গঞ্জালো মন্তিয়েল (সেভিয়া), জার্মান পেজেল্লা (রিয়েল বেটিস), ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো (টটেনহ্যাম হটস্পার), লিওনার্দো বলের্দি (অলিম্পিক মার্সেই), নিকোলাস ওতামেন্ডি (বেনফিকা), ফ্যাকুন্ডো মদিনা (আরসি লেন্স), নিকোলাস তাগলিয়াফিকো (লিয়ন), মার্কোস অ্যাকুনা (সেভিলা)।
মিডফিল্ডার:
লিয়ান্দ্রো পেরেদেস (জুভেন্তাস), এনজো ফার্নান্দেজ (চেলসি), গুইডো রদ্রিগেজ (রিয়েল বেটিস), রদ্রিগো ডি পল (অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ), এজেকিয়েল পালাসিওস (বেয়ার লেভারকুসেন), অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার (ব্রাইটন), থিয়াগো আলমাদা (আটলান্টা ইউনাইটেড), জিওভানি লো সেলসো (ভিলারিয়াল)।
ফরোয়ার্ড:
লুকাস ওকাম্পোস (সেভিয়া), অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া (জুভেন্তাস), লিওনেল মেসি (পিএসজি), জুলিয়ান আলভারেজ (ম্যানচেস্টার সিটি), জিওভানি সিমিওনে (নাপোলি), আলেজান্দ্রো গার্নাচো (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), নিকোলাস গঞ্জালেজ (ফিওরেন্টিনা)।
মার্চে ঘরের মাঠে দুটি প্রীতি ম্যাচের পর আন্তর্জাতিক ফুটবলে দেখা যায়নি আর্জেন্টিনাকে। তিন মাস পর আগামী মাসে তারা খেলবে আরও দুটি প্রীতি ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচের জন্য ২৭ সদস্যের দল ঘোষণা করেছেন লিওনেল স্কালোনি। তবে ঘোষিত সেই দলে নেই লাউতারো মার্তিনেজ।
আর্জেন্টিনার ক্রীড়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম টিওয়াইসি স্পোর্টস ও ওলে তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গোড়ালির চোটের কারণে মার্তিনেজ চিকিৎসাধীন আছেন। তাই তাকে জাতীয় দলের স্কোয়াডে রাখা হয়নি।
চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে ইন্টার মিলানের হয়ে গোল করেছিলেন। ফাইনালেও তাকে ইতালিয়ান ক্লাবটির হয়ে খেলতে দেখা যেতে পারে। তারপরই তিনি মাঠের বাইরে চলে যাবেন। ঐ সময়ে তিনি বিশ্রামে থাকবেন। আর তাই কোচ স্কালোনি তাকে দলে রাখবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার শিরোপা জয়ের অন্যতম সদস্য মার্তিনেজ। তবে পুরো টুর্নামেন্টে তিনি ব্যাথানাশক ঔষধ খেয়ে খেলছিলেন।
আগামী ১৫ জুন বেইজিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ও ১৯ জুন জাকার্তায় ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামবে আর্জেন্টিনা।
ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার আজমপুর ইউনিয়নের মদনপুর গ্রামে স্ত্রীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় চাচাতো ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে পলাশ হোসেন (২৮) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন।
শনিবার রাত ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত পলাশ হোসেন ওই গ্রামের মৃত ফজলুর রহমানের ছেলে।
স্থানীয়রা জানায়, নিহত পলাশ হোসেনের চাচাতো ভাই সুমন প্রায়ই পলাশের স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করত। শনিবার সন্ধ্যায় আবারো উত্ত্যক্ত করে। পলাশ বাড়িতে এলে বিষয়টি তাকে জানায় তার স্ত্রী। এ ঘটনায় পলাশ তার চাচাতো ভাইয়ের কাছে বিষয়টির প্রতিবাদ করতে গেলে উভয়ের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে সুমন ছুরি দিয়ে পলাশকে আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই পলাশ মারা যায়।
মহেশপুর থানার ওসি খন্দকার শামীম উদ্দিন বলেন, নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সদর হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। নিহত পলাশ পেশায় ভ্যানচালক ছিলেন, সঙ্গে কৃষিকাজও করত।
রেফারির বাঁশি বাজার তিন মিনিটের মধ্যেই রিয়াল মাদ্রিদের জালে জড়ায় বল। রাফা মিরের দুর্দান্ত এক গোলে লিড পায় সেভিয়া। তবে শেষ অবধি তারা ধরে রাখতে পারেনি সে হাসি। রদ্রিগোর জোড়া গোলে জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে রিয়াল।
রাতে লা-লিগার ম্যাচে সেভিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। খেলার তৃতীয় মিনিটেই লিড পেয়েছিল সেভিয়া। তবে ২৯ মিনিটে রদ্রিগো সমতায় ফেরান রিয়ালকে। সমতা নিয়ে বিরতিতে যায় দুই দল।
বিরতির পর ফের বাড়ে আক্রমণের ধার। যার ফলে ৬৯ মিনিটে দ্বিতীয় গোলের দেখা পায় রিয়াল। এবারও নায়ক রদ্রিগোই। এবারেরটি অবশ্য টনি ক্রুসের সহায়তায়। পরে আর কোনো গোল না হওয়ায় ২-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে মাদ্রিদের ক্লাবটি।
তবে ম্যাচের ৮৩ মিনিটে লাল কার্ড দেখে আকুনা। হারের আগে সেভিয়ার আর্জেন্টাইন এই ডিফেন্ডারের ভুলে ১০ জনের দল নিয়ে খেলতে হয় রিয়ালকে।
শুরুতে গোল হজম করলেও ৬৭ শতাংশ সময় নিজেদের দখলে বল রেখেছিল রিয়াল। ছয়বার আক্রমণে গিয়েছিল তারা, যার মধ্যে তিনটি শট ছিল গোলবার লক্ষ্য করে।
নতুন পে-স্কেল কিংবা মহার্ঘ ভাতা নয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়বে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট অনুযায়ী। তাদের বেতন প্রতি বছর যতটা বাড়ার কথা এবার তার চেয়ে বেশি বাড়বে। আর তা চলতি বছরের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়ানো হবে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশের বাইরে বাড়ানো হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত প্রায় এক বছর ধরে দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের বেশিরভাগের একমাত্র আয় বেতন-ভাতা। বৈশি^ক মন্দার কারণে সরকারও খানিকটা সংকটে আছে। এ পরিস্থিতিতে পে-স্কেল দেওয়ার মতো বড় ধরনের ব্যয় বাড়ানো সরকারের পক্ষে কঠিন হবে। ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হলে সরকারের ওপর চাপ বেশি হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সরকারি কর্মরতদের খানিকটা স্বস্তি দিতে কোন খাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এমন প্রস্তাব চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বাজেটবিষয়ক বিভিন্ন বৈঠকে সরকারি নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে আলোচনা করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাই করে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করে। চলতি মাসে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এ বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী ওই বৈঠকে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে কত বাড়তি ব্যয় হবে তা হিসাব করে পরের বৈঠকে উপস্থাপন করতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বড় ধরনের ব্যয় না বাড়িয়ে একটা উপায় বের করতেও বলেন। শেষ পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে নিজেই জানিয়েছেন।
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা ২০১৫ সালের বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ বেতন কমিশন প্রণীত হয়েছিল। এ কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, আর নতুন বেতন কমিশন গঠন করা হবে না। প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট বা বেতন বাড়ানো হবে। এ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তা হয়ে আসছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাব অনুযায়ী, দেশে সরকারি কর্মচারী ১৪ লাখ। বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে হিসাব করলে প্রায় ২২ লাখ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে নিয়মিত ইনক্রিমেন্টের বাইরে আরও কতটা বাড়ানো যায় তা হিসাব করে নির্ধারণ করা হবে। এ কাজ করতে বাজেট প্রস্তাব পেশ করার পর আলাদা কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে যাচাই-বাছাই শেষে ইনক্রিমেন্টের হার সুপারিশ করবে। এ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে বিদ্যমান ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে প্রতি মাসে বেতন বাড়ানো হবে, নাকি গড় মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে ইনক্রিমেন্টের হার বাড়ানো হবে, তা খতিয়ে দেখা হবে। ২০তম গ্রেড থেকে প্রথম গ্রেড পর্যন্ত সবার জন্য একই হারে বেতন বাড়নো হবে কি না, তা আরও খতিয়ে দেখা হবে। চূড়ান্ত হিসাব অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে প্রকাশ করা হবে। যে তারিখেই প্রকাশ করা হোক না কেন, আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকরী ধরা হবে।
এখানে মহার্ঘ ভাতা ১০ শতাংশ দেওয়া হলে এ হিসাবে ৪ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। ১৫ শতাংশ দেওয়া হলে ৬ হাজার কোটি এবং ২০ শতাংশ দেওয়া হলে ৮ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। অর্থাৎ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে আগামী অর্থবছরে সরকারের ব্যয় বাড়বে। আর এতে সরকার ব্যয় কমিয়েও সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টিতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো পথে হেঁটেছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতা বাবদ রাখা হয়েছে ছিল ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। খরচ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা বাজেট হওয়ার কথা আছে। এ বাজেট সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ ৭৭ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক পদ এখনো খালি আছে। এতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো হলেও সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের চাপ বাড়বে না।
সংলাপে রাজনৈতিক সংকট দূর হওয়ার নজির তৈরি হয়নি এখনো। তবুও নানা সময়ে সংকট নিরসনে রাজনীতিতে সংলাপ করা নিয়ে আলোচনা হয়। সংলাপের আশ্রয় নিতেও দেখা গেছে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভিন্ন মেরুতে অবস্থান থাকায় আবারও রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় আলোচনায় এসেছে ‘সংলাপ’। যদিও প্রধান দুই দলের নেতারা সংলাপে অনীহা প্রকাশ করে আসছেন। আবার আড়ালে আলাপে দুই দলের আগ্রহও দেখা গেছে।
অন্তরালের সংলাপ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার আড়ালে আলাপের মূল কারণ হলো বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বড় একটি অংশ বয়স্ক হয়ে গেছেন। তাদের অনেকের এবারের পরে নির্বাচন করার সক্ষমতা আর থাকবে না। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে গিয়ে সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হয়েছে। এ সময় সংসদ সদস্য হয়ে মর্যাদা নিয়ে চলতে চান তারা। বিএনপির ওই অংশের সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতাও রয়েছেন যারা নির্বাচনে যেতে চান। ফলে নির্বাচনে যেতে আগ্রহী বিএনপির সেই সব নেতা আড়ালে আলাপে থাকতে রাজি আছেন। অন্যদিকে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখতে চাওয়া বিদেশি শক্তিগুলোর সরকারের ওপর চাপ থাকায় বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে চায় আওয়ামী লীগ। ফলে প্রকাশ্যে সংলাপের আগ্রহ না দেখিয়ে আড়ালের আলাপে আগ্রহী দলটির নেতারা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে এক চুলও নড়বে না। অন্যদিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে কোনোভাবেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যাবে না। দুই দলই নিজেদের এমন অনড় অবস্থান দেখাচ্ছে। দুই দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থানে সৃষ্ট সংকট সমাধানে বিদেশি তৎপরতা বেশ আগে থেকেই শুরু হয়েছে। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসতে শুরু করেছে বিদেশি সেই তৎপরতায়ও গতি এসেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি কাউকেই কাছাকাছি অবস্থানে, অর্থাৎ এক মেরুতে আনতে পারেনি এখনো। তবে বিদেশি প্রভাবশালী দেশগুলোর প্রতিনিধিরা সংকট নিরসনে দুই দলকেই সংলাপে বসার জন্য বলছেন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা সংলাপের মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধানের রাস্তা ঠিক করতে দুই দলকেই তাগিদ দিয়েছেন। বিদেশিদের অবস্থান হলো আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চান তারা। সে জন্য রাস্তা তৈরি করতে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই সংলাপে অনীহা দেখিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যে অনীহার কথা জানিয়েছেন। বিএনপিও প্রায় প্রতিদিনই অনীহা প্রকাশ করে বক্তব্য রাখছে।
তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও সংলাপে সমাধান আসেনি। এবারও সংলাপে সমাধান আসার সম্ভাবনা কম। যদি সংলাপের আগেই এজেন্ডা নির্ধারণ করে সংলাপে বসে, সেই সংলাপ সফল হওয়ার পথ থাকে না।
দুই দলের একাধিক সূত্র দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, প্রকাশ্যে সংলাপ না করে এবার আড়ালে সংলাপ হতে পারে। অনেকটা হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এমন ঘটনা ঘটে যেতে পারে-বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন দিয়ে বসতে পারেন।’ তিনি বলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। সেই প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
নির্বাচন সামনে রেখে দেশে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকেরা সংকট নিরসনে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। ওই সব বৈঠকে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দুই দলেরই অবস্থান জানতে চেয়েছেন তারা। একই সঙ্গে দুই দলকে তারা এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে ভিন্নমত থাকলেও স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের স্বার্থে আগামী সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও অবাধ হওয়া জরুরি। এ কারণে নির্বাচনের আগে দুই প্রধান দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার আবশ্যকতা রয়েছে। এই সমঝোতার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, কিংবা উভয় পন্থায় দুই দলের মধ্যে ‘আলাপ’ হওয়া দরকার, তা সেটা সংলাপ বা আলোচনা যে নামেই করা হোক না কেন। এদিকে কূটনীতিকদের কাছে আওয়ামী লীগ অভিযোগ করেছে, বিএনপি কোনো ধরনের সংলাপে আগ্রহী নয়। ২০১৪ সালের নির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপির আচরণ বিদেশিদের কাছে তুলে ধরে সংলাপে বিএনপির অনীহার কথা জানান।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দাবি করছেন, রাজনীতিতে কোনো কিছু আদায় করতে হলে আন্দোলনের মাধ্যমে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীনদের বাধ্য করতে হয়। কিন্তু সেটা বিএনপি পারছে না। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছিল। সেখানে জনগণকে সম্পৃক্ত করে বিএনপিকে পদত্যাগে বাধ্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিএনপি এখন সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে করছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মাঠে আওয়ামী লীগের অবস্থান আছে। জনগণ সরকারের সঙ্গে আছে। আর তাদের সঙ্গে জনগণই নেই। তাই তো খালেদা জিয়াকে এখনো মুক্ত করতে পারেনি।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘যেকোনো সমস্যার সমাধান সংলাপের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব। সংলাপে বসলে হয়তো শতভাগ পাব না। তবে গিভ অ্যান্ড টেক তো কিছু হবেই। গণতন্ত্রে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই।’
তবে দলটির সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, ‘সংলাপ চলছে। মিডিয়ায়, টক শোতে, মাঠে মঞ্চে। এক দল আরেক দলকে উদ্দেশ্য করে যে বক্তব্য দিচ্ছে, তাও এক ধরনের সংলাপ। এসব অনেকেই সংলাপ বলে টের না পেলেও মূলত এটাও সংলাপ।’
আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, সংলাপের ব্যাপারে পশ্চিমা কূটনীতিকেরা তাদের তেমন কোনো পরামর্শ দেননি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘আমরা তাদের (কূটনীতিক) বলেছি সংলাপের উদ্যোগ আমরা নিয়ে কী করব? তাদের (বিএনপি) যদি কোনো দাবি থাকে তাহলে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলতে পারে। নির্বাচন কমিশন যদি সুপারিশ করে, সেটা অবশ্যই সরকারের কাছে আসবে। সরকার দেখবে তখন।’
সংলাপ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের কোনো ভাবনা আমাদের নাই।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি। আর আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচনকালীন এই সরকারই থাকবে এবং তাদের অধীনে নির্বাচনে হবে। নিরপেক্ষ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ অবস্থায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সংকট সমাধানে কূটনীতিকদের দূতিয়ালি চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও ইতিবাচক বিএনপি। সাম্প্রতিক সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জাতিসংঘসহ বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থার দূতসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। ওই বৈঠকগুলোতে কেন এই সরকারের অধীনে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় না তা ব্যাখ্যা করেছে দলটি। বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে যাবে না, সেটিও স্পষ্ট করেছে। একই সঙ্গে কূটনীতিকদের বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হবে সে বিষয়ে সংলাপের আহ্বান আসলে তাতে সাড়া দেবে বিএনপি। আর এই সংকট মোকাবিলায় কূটনীতিকদের ‘রোল প্লে’ (ভূমিকা রাখা) করার সুযোগ আছে বলে মনে করেন দলটির নেতারা। তাদের মতে, প্রকাশ্যে না হলেও পর্র্দার অন্তরালে সংলাপ হতে পারে। কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনেও গুঞ্জন রয়েছে ভেতর-ভেতর সংলাপ হচ্ছে।
সর্বশেষ ১৮ মে গুলশানের আমেরিকান ক্লাবে মার্কিন দূতাবাসের পলিটিক্যাল চিফ ব্রান্ডন স্ক্যাট, পলিটিক্যাল অফিসার ম্যাথিউ বে, পলিটিক্যাল কনস্যুলার ডেনিয়েল শেরির সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ।
জানতে চাইলে শামা ওবায়েদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকগুলোতে তারা আমাদের অবস্থান জানতে চান। আমরাও আমাদের অবস্থান তুলে ধরি। সর্বশেষ তারা জানতে চেয়েছেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে আপনাদের অবস্থান কী। আমরা বলেছি, আন্দোলন চলছে, সেটা আমরা কন্টিনিউ (চালিয়ে যাব) করব। তারা অন্য পক্ষের (ক্ষমতাসীনদের) কথাও শুনছেন। এ অবস্থায় তারা কী করছে (দূতিয়ালি), নাকি অন্য কিছু হচ্ছে সেটা তাদের বিষয়। তবে আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আরেকটি গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসুক, মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত হোক, সে ব্যাপারে তাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকুক।’
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আনুষ্ঠানিক সংলাপের ব্যাপারে কূটনীতিকেরা কোনো বৈঠকেই আমাদের কিছু বলেনি।’
তবে বৈঠকগুলোতে থাকা দলের আরেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা একাধিকবার সরকারের সঙ্গে সংলাপ করেছি। ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনের সংলাপে পর চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের তিন মাস পর নতুন নির্বাচন দেওয়ার কথা বলে তারা প্রতারণা করেছে। তাই এজেন্ডা ছাড়া কোনো সংলাপে আমরা যাচ্ছি না। কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে আমরা বলেছি, আনুষ্ঠানিক সংলাপের বিষয়ে আমরা ইতিবাচক। কিন্তু সেটি হতে হবে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হবে তা নিয়ে।’
ওই নেতার আরও বলেন, ‘সরকার এখন বিভিন্ন চাপে আছে। আন্তর্জাতিক চাপ তো আগে থেকেই আছে। এখন নতুন করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ বেড়েছে। এসব চাপ সামাল দিতে তারা সংলাপের নামে নানা কথা বলবে। কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনায় সরকারের মনোভাবে কিছু হলেও আঁচ করা যায়। হয়তো কয়েক দিন পর সরকার আনুষ্ঠানিক সংলাপের জন্য আমন্ত্রণও জানাতে পারে।’
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে বর্তমানে তার মাসিক বেতন প্রায় ৩৪ হাজার। বাবার আর্থিক অবস্থাও অসচ্চল। কিন্তু তার আছে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, দামি জমিসহ অন্যান্য সম্পত্তি। সবমিলে তিনি অন্তত ১০ কোটি টাকার মালিক। দেশের ভেতরে যাতায়াত করেন বিমানে। ইচ্ছে হলে বিদেশেও যান। মাত্র ২৬ বছরে এত স্বল্প বেতনে চাকরি করেও সম্পদের বিশাল পাহাড় গড়ে সবাইকে তাজ্জব লাগিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী মুহাম্মদ এয়াকুব। একই সঙ্গে তিনি সিবিএর সাধারণ সম্পাদক এবং গ্যাস অ্যান্ড অয়েলস ফেডারেশনের মহাসচিব। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নিয়োগ-পদোন্নতি নিয়ে বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এয়াকুব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করে বিভিন্ন সময়ে ভুয়া অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু তা প্রমাণ হয়নি। আমি নিয়মিত আয়কর দাখিল করি। কোথাও অসামঞ্জস্য থাকলে সেটা আরও আগে ধরা পড়ত। আমি দুর্নীতিবাজ না। তবে আবার সুফিও না। সিবিএর নেতা হয়ে মসজিদের ইমাম সাহেবও হওয়া যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমি পাঁচবার প্রত্যক্ষ ভোটে এবং তিনবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। আমি খুব গরিব ঘরের সন্তান। কিন্তু বেতন-ভাতা ভালো। এর বাইরে প্রতি বছর ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা কোম্পানির লভ্যাংশ পাই। মাছ চাষের জন্য তিনটি পুকুর আছে। গরু পালন করি। দুই ভাই বিদেশে থাকে। এসব টাকা দিয়েই বাড়ি কিনেছি। যমুনা অয়েলের একজন ক্লিনারেরও তো বাড়ি আছে। আমি সিবিএর নেতা। আমার একটা বাড়ি থাকা কি অন্যায়?’
এয়াকুব বলেন, ‘আমি আমার বিরুদ্ধে লেখেন কোনো সমস্যা নেই। মানুষ আজ পড়লে কাল ভুলে যাবে। হয়তো কিছু সম্মানহানি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেও দেশ ও পারিবারিক প্রেক্ষাপটে আজ আমি কেরানি। কমার্স কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেছি। চাইলে আজ থেকে ১০ বছর আগেই কর্মকর্তা হতে পারতাম। কিন্তু সিবিএর নেতা হওয়া একটা নেশা।’
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার বেঙ্গুরা গ্রামের এয়াকুব ১৯৯৪ সালে যমুনা অয়েল কোম্পানিতে অস্থায়ী পদে দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে চাকরি শুরু করেন। মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠানের টাইপিস্ট পদে তার চাকরি স্থায়ী হয়। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রভিডেন্টফান্ড ও অন্যান্য খাতে টাকা কর্তন শেষে মাস শেষে তিনি বেতন পান ৩৩ হাজার ৯০৩ টাকা।
জানা গেছে, এত দিন ৪২ হাজার টাকার ভাড়া বাড়িতে থাকতেন এয়াকুব। সম্প্রতি ভাড়া বাসা ছেড়ে চট্টগ্রাম নগরীর অভিজাত এলাকা লালখান বাজারে তিনটি ফ্ল্যাট কিনেছেন, যার আয়তন প্রায় সাড়ে চার হাজার বর্গফুট। দুটো ইউনিটে তিনি নিজে থাকেন, অন্যটি ভাড়া দিয়েছেন।
স্থানীয়দের দাবি, তিনটি ফ্ল্যাটের আনুমানিক মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার মতো হবে। অভিজাত ফ্ল্যাট দুটি দামি আসবাব দিয়ে সাজানো হয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিষয়টি জানতে চাইলে এয়াকুব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যাংক থেকে এক কোটি টাকা ঋণ এবং নিজের জমানো টাকা দিয়ে চার হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছি।
আরও জানা গেছে, নিজস্ব ফ্ল্যাট ছাড়াও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এক্সেল রোডে এয়াকুবের ৪ কাঠা জমিতে টিনশেডের ঘর আছে। ১০টি পরিবারের কাছে ভাড়া দিয়েছেন তিনি। দুদকের অনুসন্ধানেও এর প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। এয়াকুবের জমি ও ঘরসহ বর্তমানে ওই সম্পত্তির বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা হতে পারে বলে ধারণা দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে তিনি অস্বীকার করে বলেছেন, ওই সম্পত্তির মালিক তিনি নন। জমিটি প্রথমে বায়না করলেও পরে আর কেনেননি।
এর বাইরে পতেঙ্গা, বেঙ্গুরাসহ বিভিন্ন স্থানে এয়াকুবের নামে-বেনামে জমি ও অন্যান্য সম্পদ থাকার তথ্য এসেছে দেশ রূপান্তরের কাছে।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এয়াকুব একটি মাইক্রোবাস ব্যবহার করেন। তবে দেশ রূপান্তরের কাছে তার দাবি, এই গাড়ির মালিক তার পরিচিত। কিন্তু গাড়িটি তার নয়।
অভিযোগ উঠেছে, যমুনা অয়েল কোম্পানির ঠিকাদারের শ্রমিক মো. আবদুল নুর ও মো. হাসান ফয়সালের সহযোগিতায় সিবিএ নেতা এয়াকুব কোম্পানির ডিপোতে চাকরি দেওয়ার নামে ৮ জনের কাছ থেকে কুরিয়ার সার্ভিস ও বিকাশের মাধ্যমে ২০১৯ সালে কয়েক দফায় ২৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু তাদের কাউকে চাকরি দেওয়া হয়নি। ওই টাকাও ফেরত পাননি কেউই। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী ডিপোতে কর্মরত তৎকালীন কর্মচারী তোতা মিয়ার মাধ্যমে এয়াকুবকে ওই টাকা পাঠানো হয়। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর একাধিক রসিদ দেশ রূপান্তরের হাতে এসেছে।
চাকরি না হওয়ায় টাকা ফেরত চাইলে তোতা মিয়া ও চাকরি প্রার্থীদের নানা রকম ভয়ভীতিসহ প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে এয়াকুবসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানায় ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই সাধারণ ডায়েরি করেন মো. তোতা মিয়া।
এয়াকুব দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করে মিথ্যে অভিযোগ করা হয়েছিল। তিনি কোনো ধরনের অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত নন। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় অভিযোগকারী আমার কাছে এবং কোম্পানির দায়িত্বশীলদের কাছে ক্ষমা চেয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
তবে বিষয়টি নিয়ে যমুনা অয়েলের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে দেশ রূপান্তর। তাদের অভিযোগ, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিবিএ নেতা এয়াকুব তোতা মিয়াকে ডেকে বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার নির্দেশ দেন। ওই সময় টাকা ফেরত দেওয়ার শর্তে একটা মীমাংসা করা হলেও পরে ওই টাকা ফেরত দেয়নি এয়াকুব। তবে এয়াকুবের দাবি, তিনি কাউকে চাপ প্রয়োগ করেননি। অভিযোগটি মিথ্যে প্রমাণিত হওয়ায় তোতা মিয়া তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যমুনা অয়েলের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযোগ করেন, সিবিএর কিছু নেতা নানা রকম অনিয়ম-দুর্নীতি করলেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেন না।
এ বিষয়ে জানতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দীন আনচারীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করে, খুদে বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। কোম্পানির ঢাকা কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি দুদকের এক প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যমুনা অয়েল কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, ক্যাজুয়াল ও কন্ট্রাক্টর ক্যাজুয়াল নিয়োগ, ফার্নেস অয়েল, বিটুমিনসহ বিভিন্ন খাতে এয়াকুব মাসোহারা নেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী জানিয়েছেন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় প্রধান তেল স্থাপনা ও দেশের সব ডিপো থেকে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায়েরও মৌখিক অভিযোগ পেয়েছে দুদক। তার এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বদলিসহ নানা রকম শাস্তি দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ থাকার অভিযোগ করেছেন একাধিক কর্মচারী।
দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১-এর সহকারী পরিচালক মো. এমরান হোসেন সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, বিভিন্ন রেকর্ডপত্র এবং সরেজমিন তথ্য পর্যালোচনা করে এয়াকুবের বিরুদ্ধে অভিযোগ সঠিক ও গ্রহণযোগ্য হওয়ায় তা প্রকাশ্যে অনুসন্ধান করা দরকার। তার ওই সুপারিশ আমলে নিয়ে কমিশন আজ রবিবার সকালে চট্টগ্রাম কার্যালয়ে শুনানিতে হাজির হতে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছেন।
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে বর্তমানে তার মাসিক বেতন প্রায় ৩৪ হাজার। বাবার আর্থিক অবস্থাও অসচ্চল। কিন্তু তার আছে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, দামি জমিসহ অন্যান্য সম্পত্তি। সবমিলে তিনি অন্তত ১০ কোটি টাকার মালিক। দেশের ভেতরে যাতায়াত করেন বিমানে। ইচ্ছে হলে বিদেশেও যান। মাত্র ২৬ বছরে এত স্বল্প বেতনে চাকরি করেও সম্পদের বিশাল পাহাড় গড়ে সবাইকে তাজ্জব লাগিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী মুহাম্মদ এয়াকুব। একই সঙ্গে তিনি সিবিএর সাধারণ সম্পাদক এবং গ্যাস অ্যান্ড অয়েলস ফেডারেশনের মহাসচিব। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নিয়োগ-পদোন্নতি নিয়ে বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এয়াকুব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করে বিভিন্ন সময়ে ভুয়া অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু তা প্রমাণ হয়নি। আমি নিয়মিত আয়কর দাখিল করি। কোথাও অসামঞ্জস্য থাকলে সেটা আরও আগে ধরা পড়ত। আমি দুর্নীতিবাজ না। তবে আবার সুফিও না। সিবিএর নেতা হয়ে মসজিদের ইমাম সাহেবও হওয়া যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমি পাঁচবার প্রত্যক্ষ ভোটে এবং তিনবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। আমি খুব গরিব ঘরের সন্তান। কিন্তু বেতন-ভাতা ভালো। এর বাইরে প্রতি বছর ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা কোম্পানির লভ্যাংশ পাই। মাছ চাষের জন্য তিনটি পুকুর আছে। গরু পালন করি। দুই ভাই বিদেশে থাকে। এসব টাকা দিয়েই বাড়ি কিনেছি। যমুনা অয়েলের একজন ক্লিনারেরও তো বাড়ি আছে। আমি সিবিএর নেতা। আমার একটা বাড়ি থাকা কি অন্যায়?’
এয়াকুব বলেন, ‘আমি আমার বিরুদ্ধে লেখেন কোনো সমস্যা নেই। মানুষ আজ পড়লে কাল ভুলে যাবে। হয়তো কিছু সম্মানহানি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেও দেশ ও পারিবারিক প্রেক্ষাপটে আজ আমি কেরানি। কমার্স কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেছি। চাইলে আজ থেকে ১০ বছর আগেই কর্মকর্তা হতে পারতাম। কিন্তু সিবিএর নেতা হওয়া একটা নেশা।’
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার বেঙ্গুরা গ্রামের এয়াকুব ১৯৯৪ সালে যমুনা অয়েল কোম্পানিতে অস্থায়ী পদে দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে চাকরি শুরু করেন। মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠানের টাইপিস্ট পদে তার চাকরি স্থায়ী হয়। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রভিডেন্টফান্ড ও অন্যান্য খাতে টাকা কর্তন শেষে মাস শেষে তিনি বেতন পান ৩৩ হাজার ৯০৩ টাকা।
জানা গেছে, এত দিন ৪২ হাজার টাকার ভাড়া বাড়িতে থাকতেন এয়াকুব। সম্প্রতি ভাড়া বাসা ছেড়ে চট্টগ্রাম নগরীর অভিজাত এলাকা লালখান বাজারে তিনটি ফ্ল্যাট কিনেছেন, যার আয়তন প্রায় সাড়ে চার হাজার বর্গফুট। দুটো ইউনিটে তিনি নিজে থাকেন, অন্যটি ভাড়া দিয়েছেন।
স্থানীয়দের দাবি, তিনটি ফ্ল্যাটের আনুমানিক মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার মতো হবে। অভিজাত ফ্ল্যাট দুটি দামি আসবাব দিয়ে সাজানো হয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিষয়টি জানতে চাইলে এয়াকুব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যাংক থেকে এক কোটি টাকা ঋণ এবং নিজের জমানো টাকা দিয়ে চার হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছি।
আরও জানা গেছে, নিজস্ব ফ্ল্যাট ছাড়াও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এক্সেল রোডে এয়াকুবের ৪ কাঠা জমিতে টিনশেডের ঘর আছে। ১০টি পরিবারের কাছে ভাড়া দিয়েছেন তিনি। দুদকের অনুসন্ধানেও এর প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। এয়াকুবের জমি ও ঘরসহ বর্তমানে ওই সম্পত্তির বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা হতে পারে বলে ধারণা দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে তিনি অস্বীকার করে বলেছেন, ওই সম্পত্তির মালিক তিনি নন। জমিটি প্রথমে বায়না করলেও পরে আর কেনেননি।
এর বাইরে পতেঙ্গা, বেঙ্গুরাসহ বিভিন্ন স্থানে এয়াকুবের নামে-বেনামে জমি ও অন্যান্য সম্পদ থাকার তথ্য এসেছে দেশ রূপান্তরের কাছে।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এয়াকুব একটি মাইক্রোবাস ব্যবহার করেন। তবে দেশ রূপান্তরের কাছে তার দাবি, এই গাড়ির মালিক তার পরিচিত। কিন্তু গাড়িটি তার নয়।
অভিযোগ উঠেছে, যমুনা অয়েল কোম্পানির ঠিকাদারের শ্রমিক মো. আবদুল নুর ও মো. হাসান ফয়সালের সহযোগিতায় সিবিএ নেতা এয়াকুব কোম্পানির ডিপোতে চাকরি দেওয়ার নামে ৮ জনের কাছ থেকে কুরিয়ার সার্ভিস ও বিকাশের মাধ্যমে ২০১৯ সালে কয়েক দফায় ২৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু তাদের কাউকে চাকরি দেওয়া হয়নি। ওই টাকাও ফেরত পাননি কেউই। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী ডিপোতে কর্মরত তৎকালীন কর্মচারী তোতা মিয়ার মাধ্যমে এয়াকুবকে ওই টাকা পাঠানো হয়। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর একাধিক রসিদ দেশ রূপান্তরের হাতে এসেছে।
চাকরি না হওয়ায় টাকা ফেরত চাইলে তোতা মিয়া ও চাকরি প্রার্থীদের নানা রকম ভয়ভীতিসহ প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে এয়াকুবসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানায় ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই সাধারণ ডায়েরি করেন মো. তোতা মিয়া।
এয়াকুব দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করে মিথ্যে অভিযোগ করা হয়েছিল। তিনি কোনো ধরনের অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত নন। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় অভিযোগকারী আমার কাছে এবং কোম্পানির দায়িত্বশীলদের কাছে ক্ষমা চেয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
তবে বিষয়টি নিয়ে যমুনা অয়েলের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে দেশ রূপান্তর। তাদের অভিযোগ, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিবিএ নেতা এয়াকুব তোতা মিয়াকে ডেকে বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার নির্দেশ দেন। ওই সময় টাকা ফেরত দেওয়ার শর্তে একটা মীমাংসা করা হলেও পরে ওই টাকা ফেরত দেয়নি এয়াকুব। তবে এয়াকুবের দাবি, তিনি কাউকে চাপ প্রয়োগ করেননি। অভিযোগটি মিথ্যে প্রমাণিত হওয়ায় তোতা মিয়া তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যমুনা অয়েলের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযোগ করেন, সিবিএর কিছু নেতা নানা রকম অনিয়ম-দুর্নীতি করলেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেন না।
এ বিষয়ে জানতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দীন আনচারীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করে, খুদে বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। কোম্পানির ঢাকা কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি দুদকের এক প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যমুনা অয়েল কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, ক্যাজুয়াল ও কন্ট্রাক্টর ক্যাজুয়াল নিয়োগ, ফার্নেস অয়েল, বিটুমিনসহ বিভিন্ন খাতে এয়াকুব মাসোহারা নেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী জানিয়েছেন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় প্রধান তেল স্থাপনা ও দেশের সব ডিপো থেকে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায়েরও মৌখিক অভিযোগ পেয়েছে দুদক। তার এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বদলিসহ নানা রকম শাস্তি দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ থাকার অভিযোগ করেছেন একাধিক কর্মচারী।
দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১-এর সহকারী পরিচালক মো. এমরান হোসেন সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, বিভিন্ন রেকর্ডপত্র এবং সরেজমিন তথ্য পর্যালোচনা করে এয়াকুবের বিরুদ্ধে অভিযোগ সঠিক ও গ্রহণযোগ্য হওয়ায় তা প্রকাশ্যে অনুসন্ধান করা দরকার। তার ওই সুপারিশ আমলে নিয়ে কমিশন আজ রবিবার সকালে চট্টগ্রাম কার্যালয়ে শুনানিতে হাজির হতে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।