
আশির দশকের বাংলাদেশ ও তার শিল্প যেন আটকে পড়ে যাচ্ছিল একনায়কের বেড়াজালে। তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল থাকলেও তার ফুঁসতে থাকা আগুনের আভাস শিল্পাঙ্গনে সেভাবে পাওয়া যাচ্ছিল না। চারদিকে ছিল শুধু ‘বিমূর্তরীতি’ কাজের জয়গান। ঘটমান সময়ের রাজনৈতিক অপশাসন, দুঃশাসন কিছুই যেন শিল্পীদের চোখে সেভাবে ধরা দিচ্ছিল না। কিন্তু এই চোখ বুজে থাকা আর বেশিদিন থাকল না।
স্বৈরাচারী শাসন ও সামাজিক-রাজনৈতিক সহিংসতার দায় থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি একদল তরুণ চিন্তার শিল্পী। তাই সমচিন্তার কয়েকজন মিলেই গড়ে তুললেন শিল্পের দল, যার নাম দিলেন ‘সময় দল’। নামের সামঞ্জস্য প্রকাশ পেতে শুরু করে তাদের কাজ, কাজের ধরন ও বিষয়ের মাধ্যমেই। চারপাশের ঘটে যাওয়া সময় ও পরিস্থিতি ক্রমাগত প্রকাশ পেতে থাকে ‘সময়’ এর শিল্পীদের কাজে। বিমূর্তধারার কাজকে একপাশে রেখে সরাসরি যেন চোখে আঙুল দিয়ে মানুষকে দেখাতে লাগলেন তার চারপাশের সময়ের গল্প। এ শিল্পীরা তাদের কাজে আবেগের চেয়েও বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন তাদের বুদ্ধিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির।
আশির দশকের এই শিল্পীরা তাদের কাজের ধরনে নিয়ে এলেন আমূল পরিবর্তন। তাদের কাজের ম্যাটেরিয়াল, ফর্ম ও সাবজেক্ট ম্যাটারও হয়ে উঠল অনেক বেশি সমসাময়িক। রাজনৈতিক সহিংসতা সরাসরি প্রকাশ পেতে থাকল তাদের কাজে।
ভিন্ন চিন্তার এই দলের অন্যতম মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন- শিল্পী ঢালী আল মামুন। ‘রাজনীতি ও সমাজ সচেতনতাবোধ’ শিল্পী ঢালী আল মামুনের কাজের প্রধান পরিচায়ক। শিল্পকর্মগুলোকে তিনি তার বক্তব্য উপস্থাপনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন সচেতনভাবেই। নিছক দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যপট নির্মাণে তিনি তেমন আগ্রহী কখনই ছিলেন না। বরঞ্চ দর্শকের চিরায়ত আয়েশি চিন্তাকে বাস্তবতার ঘায়ে আঘাত করাই তার উদ্দেশ্য। বহুমাত্রিক এই শিল্পী তার বক্তব্যের গল্পকথা প্রকাশে চিত্রকলা থেকে শুরু করে আলোকচিত্র, ভাস্কর্য, ভিডিও ও স্থাপনাধর্মী শিল্পমাধ্যমকে বেছে নিয়েছেন। অর্থাৎ মাধ্যমের ব্যবহারেও শিল্পী ঢালী আল মামুন নিজেকে রেখেছন উন্মুক্ত ও স্বাধীন তার চিন্তার মতোই।
গতানুগতিক ধারা বদলের চেষ্টায় বদ্ধপরিকর আরেক শিল্পী দিলারা বেগম জলি। টানাপড়েনের এই উত্তপ্ত সময়ে বেশ চ্যালেঞ্জ নিয়েই শিল্পী জলি অপরাপর পুরুষ শিল্পীদের সমপর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নারী, নারীর ওপর রাজনৈতিক সহিংসতার প্রভাব ও নারীর মনোজগতের নানাবিধ অনুভূতিই তার কাজে ফুটে উঠেছে বারবার। ছাপচিত্রী হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পরে শিল্পী জলি মনোযোগী হয়ে উঠেছেন বিভিন্ন মাধ্যমে চিত্র রচনা, ভাস্কর্য ও স্থাপনাধর্মী মাধ্যমে কাজ করার প্রতি।
সময় দলের আরেক ভিন্ন চিন্তার শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য। সামাজিক ও রাজনৈতিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রবল ভর্ৎসনা শিশির ভট্টাচার্যের প্রধান উপজীব্য। কৌতুক ও হাস্যরসের মাধ্যমে রাজনৈতিক কুৎসিত সত্যকে নিরাভরণ করে দেখিয়েছেন বারবার। মানবশরীর ও অভিব্যক্তির অতিরঞ্জনের মাধ্যমে শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়।
আশির দশকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল পাড়ির মাধ্যমেই আসলে গড়ে ওঠে ‘সময় দল’-এর মতো শিল্পী সংগঠন। যাদের অসামান্য মেধা ও সাহসিকতার হাত ধরে আজকের শিল্পাঙ্গন সমৃদ্ধ বহু গুণী ও প্রতিভাধর শিল্পীদের পদচারণায়। যারা শিখিয়েছে বর্তমানকে শেকল ভাঙার গান গাইবার দৃঢ় সাহস।
বরেণ্য চিত্রকর মনিরুল ইসলাম। এ শিল্পী পেয়েছেন স্পেনের সম্মানসূচক ‘রয়েল স্প্যানিশ অর্ডার অব মেরিট’। বাংলাদেশ ও স্পেনে তার দুই জীবন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন নিজের শিল্পযাত্রাসহ ইউরোপ-বাংলাদেশের চারুকলা সম্পর্কে। কথা বলেছেন শিল্পভাবনা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিলভিয়া নাজনীন
ছবি আঁকার জগতে আসার শুরুর গল্পটা জানতে চাই।
মনিরুল ইসলাম : আমার মনে আছে ম্যাট্রিক দিলাম ফিফটি এইটে, কিশোরগঞ্জ থেকে। তিনবার ম্যাট্রিক দিতে হয়েছে, তারপর পাস করেছি। আমার জীবনে একমাত্র ইচ্ছা ছিল ছবি আঁকতে হবে। যেহেতু এই ভাবনাটা আমি করছি কিশোরগঞ্জের মতো ছোট একটা শহর থেকে, সে হিসেবে ফ্যামিলির একটু আপত্তি ছিল। বিশেষ করে বাবার। অনেক কিছু চিন্তা করে বাবা বলল, এই ছেলের ফিউচার বলে কিছু নেই। আমাকে ইলেকট্রিক কাজে হেলপার হিসেবে কাজ করতে বলল। তবে আর্ট কলেজে আসার পেছনে মার সম্মতি ছিল। আমাদের শিল্পী হাশেম খানের বাবা আর আমার বাবা কলিগ ছিলেন, তারা পাবলিক হেলথে একসঙ্গে কাজ করতেন। সেই সূত্রে হাশেম খান আমাকে চারুকলায় ভর্তির ব্যাপারে সহযোগিতা করেছিলেন।
চারুকলায় এসে তখন শিক্ষক হিসেবে কাদের পেলেন?
মনিরুল ইসলাম : ঢাকা আর্ট কলেজে যখন আসি আমাদের টিচার ছিলেন আব্দুল বাসেত। খুব কড়া এবং সত্যিই খুব ভালোমানের টিচার ছিলেন। যদিও তিনি খুব কম আঁকতেন। তার ছবিও অত্যন্ত ভালো ছিল। তো বাসেত স্যারের খুব নজর ছিল আমার ওপর। ছাত্রাবস্থায় আমি প্রচুর ছবি আঁকতাম। গাদায় গাদায় আঁকতাম। তখন অ্যানুয়াল এক্সিবিশনে কার কয়টা পেইন্টিং যাবে সেটার হিসাব হতো, কে কতগুলো ছবি আঁকছে তার ওপর। তাই প্রচুর আঁকতাম। তখন তো এত পেইন্টিং করার সুবিধা ছিল না। ওয়াটার কালার করতাম শুধু। বিক্রি করে দিতাম সেগুলো, পঁচিশ টাকা, তিরিশ টাকা করে। এইভাবে আরম্ভ করলাম আমার আর্ট কলেজের জার্নি। তারপর সেকেন্ড ইয়ারে পেলাম মোস্তফা মনোয়ার স্যারকে। তার কাছে আমি দুইটা জিনিস শিখেছি, একটা হলো কালার্স, আরেকটা হলো ফ্রিডম। মোস্তফা মনোয়ার স্যারের হাত ধরেই আমার শিল্পীজীবনের গভীরে অভিনিবেশ ঘটল।
চারুকলার তখন তো জয়নুল আবেদিনও ছিলেন, তার সঙ্গে কোনো স্মৃতি নেই?
মনিরুল ইসলাম : আবেদিন স্যারকে প্রথম দেখি হোয়াইট প্যান্ট আর একটা অলিভ গ্রিন হাওয়াই শার্টে, এলিগেন্ট ওয়েতে আয়রন করা। একটা বক্স-ওয়াগান গাড়ি ওটা বোধহয়, উনি জার্মানি থেকে গিফট পেয়েছিলেন, সেটা থেকে নেমে আসছিলেন। উনি একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন রাত ৯টায়। উনি এইভাবে বলতেন, ‘মনির সাবরে ডাইকা আনো।’ তো আমি গেলাম, স্যার বললেন, ‘মনির, চাঁদপুরে যাইতে হবে।’ আমি বললাম ‘চাঁদপুরে কেন যাবেন স্যার?’ বললেন, ‘আমাকে ছবি আঁকতে যাইতে হবে।’ জানতে পারলাম, বেঙ্গল ট্রান্সপোর্ট বা ইস্ট পাকিস্তান রিভার ট্রান্সপোর্ট বলে একটা কোম্পানি আছে ওটার ক্যালেন্ডার হবে। ঐ ক্যালেন্ডারের জন্য চাঁদপুরের সাবজেক্ট নিয়ে ছবি আঁকতে হবে। স্পেসিফিকলি স্টিমারে আগে যেই চুঙ্গাটা থাকত ব্ল্যাক অ্যান্ড ইয়েলো, এইটা থাকতে হবে ছবিতে। তারপর আমরা সকালে রওনা হলাম। আবেদিন স্যারকে নিয়ে চাঁদপুরে আমাদের বাসাতেও গেলাম। আমরা নৌকা ভাড়া করে রং, তুলি, কাগজ নিয়ে সাবজেক্ট দেখতে গেলাম। সারা দিন আবেদিন স্যার নৌকায় বসে থাকলেন কিছুই আঁকলেন না। সন্ধ্যার আগে বললেন বাসায় ফিরে যাবেন। আমি বেশ অবাক! সারা দিন সময়টা নষ্ট করলেন স্যার? কিছু আঁকলেন না? পরদিন সকালে আবার আমরা বের হলাম। সেদিন স্যার ছবি আঁকা শুরু করলেন। রং খুঁজলেন গ্যামবুজ, প্রুশিয়ান ব্লু, ইন্ডিগো। আমি ভাবলাম, ছবি আঁকার জন্য এই কঠিন রংগুলো স্যার নদীতে কোথায় দেখতে পেলেন? তারপর এই রং দিয়েই স্যার কী অপূর্ব দুইটা ছবি আঁকলেন। আমিও সাহস নিয়ে স্যারের মতো দুইটা ছবি আঁকলাম। বাসায় ফিরে যখন চারটা ছবি বিছিয়ে রাখলাম, স্যার বললেন, ‘এই মিয়া তোমার ছবি কোন দুইটা?’ (হাসি)
চারুকলায় থাকাকালীনই কি আপনি স্কলারশিপ পেয়ে স্পেন চলে যান?
মনিরুল ইসলাম : আমি আর রফিকুন নবী স্যার দুজনেই প্রায় একই সময়ে চারুকলায় শিক্ষকতা শুরু করি। ঊনসত্তরের ঐ সময়টায় আমরা বিভিন্ন পোস্টার করতাম। তো একদিন নবী বললেন, ‘ওই মিয়া, স্পেন যাবা নাকি?’ আমি বললাম, ‘না, আপনে যান না কেন?’ পরে উনি আঙুল দিয়া দেখায় বললেন, ‘এই যে খাজা সাহেব চৌদ্দ বছর ধইরা ফরমই ফিল-আপ কইরা যাইতাছে...’ হা হা। তখন স্কলারশিপের সার্কুলার পাবলিশ করত সাত দিন সময় দিয়ে। সাত দিনে তো সব জমা দেওয়া অসম্ভব। আমি হাফ কাগজ কোনোরকম করে পাঠায় দেই। কেমন করে জানি সিলেক্ট হয়ে যাই। আমার বেতন ছিল দুইশ টাকা আর যাওয়ার জন্য প্লেন ভাড়া লাগত চার হাজার টাকা। কেমনে যাই! আমার এক বন্ধু ছিল নূরুল ইসলাম নামে, যে মোনায়েম খানের সহকারী ছিল, পরে সে বঙ্গবন্ধুর পিএসও হয়েছিল সে আমাকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে দেয়।
স্পেনে গিয়ে কি আবার লেখাপড়া শুরু করলেন?
মনিরুল ইসলাম : স্পেনে তো গেলাম আমি ৯ মাসের জন্য। তখন বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আমি এচিং করা শুরু করলাম। আমি চলে আসব ভাবছিলাম, কারণ পেইন্টিং করতে পারছিলাম না। ওখানে আমি ফ্রেস্কো করতে শুরু করছিলাম। জিনিসটা নতুন ছিল তাই করতে ভালোই লাগত। এরপরে প্রিন্ট শুরু করলাম প্রিন্টমেকার হিসেবে। তবে ওরা আমাকে আর্টিস্ট হিসেবে ট্রিট করত। ৯ মাসের জন্য গিয়ে ফিফটি টু ইয়ারস কাটিয়ে দিলাম।
স্পেনকে আপনার কেমন মনে হয়েছে বসবাসের জন্য?
মনিরুল ইসলাম : স্পেন একটা বিউটিফুল কান্ট্রি। লোকগুলা অত্যন্ত ভালো, ক্লাইমেট ভালো, কিন্তু পড়াশোনার জন্য বেশি ভালো না। স্পেনের অনেক হিস্ট্রি আছে, খাওয়া-দাওয়ার জন্য বিখ্যাত, ফুর্তিবাজ জাতি। রাতে ঘুমায় না। দে এনজয় দেয়ার লাইফ। আর্টের জন্য ওয়ান অফ দ্য ভেরি ইম্পর্টেন্ট প্লেস এখন। ইম্পেশেন্ট, এনার্কিস্ট, ইনডিভিজুয়ালিস্ট এই তিন ধরনের মানুষ ওখানে, তিনটাই কিন্তু খারাপ। স্পেনের এই এনার্কিস্ট গ্রুপটা বেশ সক্রিয়।
বিদেশ গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মনিরুল ইসলাম : বিদেশে গেলেই যে আর্টিস্ট অনেক কিছু শিখে ফেলবে, অনেক বড় হয়ে যাবে এমন না, ইট ডিপেন্ডস সে কতটুকু কন্সিভ করতে পারে। আমি স্পেনে দীর্ঘসময় কাজ করছি। সেখানে আমার একটা কঠিন জার্নি আছে।
স্পেন সরকার আমাকে অনেক সম্মান দিছে। এটা সত্য। ’৯৭-এ এচিং-এর জন্য জাতীয় পুরস্কার, এরপর আরও দুইটা পুরস্কার দিল। করোনার আগে মেরিট পুরস্কার মানে ওখানকার ‘স্যার’ হাইয়েস্ট সিভিলিয়ান অ্যাওয়ার্ড, ওইটাও দিল।
বাংলাদেশে আপনাকে একুশে পদক, শিল্পকলা একাডেমি পদক দিয়ে সম্মানিত করেছে...
মনিরুল ইসলাম : হ্যাঁ, ১৯৯৯ সালে আমি একুশে পদক পাইছি। আমাদের হাইয়েস্ট অ্যাওয়ার্ড, কিন্তু পিপল ফরগেট। মানে প্রাপ্য সম্মানটা আসলে পাওয়া হয় না। বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি কোনোটাই বোধহয় বাকি নাই।
শিল্প কি শুধুমাত্র আনন্দের জন্যই কাজ করে, নাকি মানুষের জন্যও?
মনিরুল ইসলাম : আর্ট আজ যা, পাঁচশো বছর আগেও এমনই ছিল। রাজার ছবি আঁকো, বাগান আঁকো, এখন করপোরেটদের জন্য আঁকো। যতই বলি না কেন আর্টকে জনগণের জীবনের ভেতরে নিয়ে যাও, লাভ নাই। তবে গ্রামের লোকেদের কাছে আর্ট ইজ আ ডেইলি লাইফ। একটা পিঠা বানাবে, পাকন পিঠা তারা ডিজাইন করে খায়। তারপরে ঘরে আলপনা করে। আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছিল, আর্ট ইজ আ বুলশিট বাট এভরি ইঞ্চ অফ লাইফ ইউ নিড ইট।
বাংলাদেশের আর্ট কি বিদেশে আলাদাভাবে এপ্রেসিয়েটেড হয়?
মনিরুল ইসলাম : না, বাংলাদেশি আর্ট বলে ওখানে কোনো কিছু ছিল না। আর পৃথিবী-বিখ্যাত বলে যে ধারণা আছে সেটা আসলে ভুয়া, কেউই পৃথিবী-বিখ্যাত না। এটা একটা ডাম্ব ল্যাঙ্গুয়েজ, আমরা অলওয়েজ বিহাইন্ড ক্যানভাস থাকি। তবে লাস্ট ১০ বছরে কিছুটা শুরু হয়েছে। আজ যারা ভেনিস বিয়েনালে যাচ্ছে, এটা একটা বড় বিষয়। কারণ এটা মিরর অফ অ্যা কান্ট্রি, ওখানে নির্দিষ্ট কোনো আর্টিস্ট বা গ্যালারি যাচ্ছে না, যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে শিল্পীরা। তবে মনে রাখা লাগবে আর্টে এপ্রিশিয়েশন একটা স্লো প্রসেস। এটার জন্য কন্টিনিউটি দরকার।
আমরা যে আর্ট করছি, তার মধ্যে আমরা আসলে কী করছি?
মনিরুল ইসলাম : অ্যাকচুয়ালি আমরা কিন্তু ইউরোপিয়ান আর্ট কপি করতেছি। আসলে আমাদের সিলেবাসটাই তো ওরকম ‘রয়্যাল স্কুল অফ আর্ট’-এর। এখন তো আর্ট গ্লোবালাইজড হয়ে গেছে সবাই বলে। আমি এটার পক্ষপাতী না। সবাই যদি একই ভাষায় কথা বলে তাহলে আলাদা বলে কিছু তো থাকার কথা না। নতুন কিছুও তো পাওয়া যাবে না।
স্পেন আপনার একটা স্টাইলকে গুরুত্ব দিয়ে ‘স্কুল অফ মনির’ বলছে, অথচ সেই স্টাইলটা বাংলাদেশে ওভাবে বিকশিত হয়নি, কেন?
মনিরুল ইসলাম : আমি অনেক সময় ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছি এদেশে। এমন তো না, আমি শিখাইনি।
করোনার পর এই সময়টায় আপনি কী আঁকছেন? কিছু ভাবছেন?
মনিরুল ইসলাম : আমরা মানুষেরা কিন্তু সব ভুলে যাই। ছবিটা আমার কাছে মনে হয় ইউ আর হোল্ডিং দ্য টাইম। এখন সময় চলে গেছে মানুষের আবেদনও চলে গেছে। আমি আসলে গোলাপ আঁকি না, গোলাপের ঘ্রাণ আঁকি। একটা ছবি কখন ছেড়ে দিতে হয় এটা আমরা অনেকেই জানি না। উই আর কিলিং আওয়ার অওন আর্ট। আর লাস্টলি, ডাস্ট ইনটু ডাস্ট। আর আমি এত এত যে আঁকছি, এত করে দেখছি, যে মিরাকেলি কিছু ঘটে কি না! এটার জন্যই ওয়েট করছি। আমার বয়সও তো হয়ে গেল আটাশি।
শিল্পমাধ্যমের যতগুলো শাখা আছে তার সর্বশেষ সংযোজন আলোকচিত্র। ১৮৪০ সালে জাহাজে চেপে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় ক্যামেরা আসে। আর পূর্ববঙ্গে ক্যামেরা আসে গত শতকের ষাটের দশকে ঢাকার নবাব পরিবারে। নবাব আহসান উল্লাহ আর তার ছেলে নবাব সলিমুল্লাহ যে সৃষ্টিশীল আলোকচিত্রচর্চায় নিমগ্ন ছিলেন ইতিহাসে তার প্রমাণ মেলে। দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গে স্বল্প পরিসরে আলোকচিত্রের নান্দনিকচর্চা শুরু হয়। ষাটের দশক থেকে শুরু হয় স্যালোন বা আর্ট ফটোগ্রাফির চর্চা। কিন্তু ছবি দিয়ে যে সমাজজীবনের গল্প বলা যায় এই ধারণা আসে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে।
বর্তমানে বাংলাদেশের আলোকচিত্রীরা বিশ্বের সেরা ফটোগ্রাফার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব এখন এ দেশের আলোকচিত্রীদের কাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। এত কিছুর পরও ফটোগ্রাফিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে রাষ্ট্রীয় শিথিলতা চোখে পড়ার মতো। ফলে অনেকটা ব্যক্তি-উদ্যোগেই এদেশে ফটোগ্রাফিচর্চা বিস্তৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের আলোকচিত্রবিদ্যায় অনন্য অবদান রেখেছেন গোলাম কাসেম ড্যাডি ও মনজুর আলম বেগ। আলোকচিত্রকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে পরিচিত করার জন্য যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি ড. শহিদুল আলম। আলোকচিত্র অঙ্গনে তিনি এদেশে একটা প্রজন্ম তৈরি করেছেন।
সাতচল্লিশ পরবর্তী সময়ে আমানুল হক, নাইবউদ্দীন আহমদ, ড. নওয়াজেশ আহমদ, আনোয়ার হোসেন, বিজন সরকার প্রমুখ সৃষ্টি করে গেছেন অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। বর্তমান প্রজন্মের আলোকচিত্রীদের মধ্যে নাসির আলী মামুন তৈরি করেছেন প্রতিকৃতি আলোকচিত্রের ধারা। প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানমের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছেন অনেক নারী আলোকচিত্রী। আরও অনেক পথিকৃৎ আলোকচিত্রী রয়েছেন যাদের তালিকা বেশ দীর্ঘ। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে তার পুরোটা তুলে ধরা সম্ভব নয়।
শিল্পবিশ্বে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি কোন অবস্থানে রয়েছে তার একটি সামান্য ফিরিস্তি তুলে ধরছি। সত্যি বলতে পৃথিবীর এমন কোনো মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতা নেই, যেখানে বাংলাদেশের আলোকচিত্রীরা জয়ী হয়নি। নেদারল্যান্ডসে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রতিযোগিতা শুরুর কয়েক বছরের মাথায় ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে ওয়ার্ল্ড প্রেসের সার্টিফিকেট অব অনার লাভ করেন বাংলাদেশের আলোকচিত্রী মোজাম্মিল হোসেন। পরের বছর পান মোয়াজ্জেম হোসেন বুলু। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের শফিকুল আলম কিরণ (দুইবার), শোয়েব ফারুকী, জিএমবি আকাশ, এন্ড্রু বিরাজ, তাসলিমা আখতার, রাহুল তালুকদার, সরকার প্রতীক, মো. মাসফিকুর আখতার সোহান, কে এম আসাদ ও ইসমাইল ফেরদৌস ওয়ার্ল্ড প্রেস জিতেছেন। ২০১৮ সালে পুলিৎজার জিতেন মোহাম্মদ পনির হোসেন। বাংলাদেশের আলোকচিত্রীদের মুকুটে আরও যুক্ত হয়েছে ইউজিন স্মিথ ফান্ড, মাদার জোনস, ন্যাশনাল জিওগ্রাফির অল রোভস, পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার এওয়ার্ড, জুপ মাস্টারক্লাস, হিপা, টাইম ম্যাগাজিন পারসন অব দ্য ইয়ারের মতো সম্মানসূচক পালক। ২০২২ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো ফাউন্ডেশনের এশিয়া মহাদেশের আঞ্চলিক সহযোগী হিসেবে যুক্ত হয়েছে দৃক। এশিয়া মহাদেশের এত এত দেশ থাকতে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে নির্বাচন করা কম গৌরবের ব্যাপার নয়।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো আলোকচিত্রী স্বাধীনতা পদক পাননি। একুশে পদক পেয়েছেন মো. কামরুজ্জামান, আফতাব আহমেদ, মনজুর আলম বেগ, মোহাম্মদ আলম, আমানুল হক, গোলাম মুস্তফা, সাইদা খানম ও পাভেল রহমান। বাংলাদেশ শিল্পকলা পদক পেয়েছেন শহিদুল আলম, গোলাম মুস্তাফা, নাসির আলী মামুন, এমএ তাহের ও শফিকুল ইসলাম স্বপন। বাংলাদেশের আলোকচিত্রীদের কাজের যে পরিধি সেই তুলনায় এই সংখ্যাটা অতি নগণ্য।
সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন ২০১২ সালে ঢাকায় প্রথম আর্ট সামিটের আয়োজন করে। সেই বছর সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ড পান খালেদ হাসান। ২০১৬ সালে পান রাসেল চৌধুরী। এ বছর পান ফজলে রাব্বী ফটিক। এছাড়া পৃথিবীর নানা শিল্পকলা উৎসব, বিয়েনাল, ট্রিয়েনাল ও বিশ্ববিখ্যাত মিউজিয়ামে বাংলাদেশি আলোকচিত্রশিল্পীদের কাজ প্রদর্শিত হচ্ছে। ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে শহিদুল আলম, আবীর আবদুল্লাহ, মোনেম ওয়াসিফ, সরকার প্রতীক, সাইফুল হক অমি, শামসুল আলম হেলাল, হাবিবা নওরোজ, শাহরিয়া শারমীন, সালমা আবেদীন পৃথি, তাহিরা ফারহীন হক, রিয়াদ আবেদীন, ফারজানা আখতার, ফায়হাম ইবনে শরীফ, মাশুক আহমেদ, আহমেদ রাসেল, মৃদুল কান্তি গোস্বামী, যোবায়ের জ্যোতি, কাজী রিয়াসাত আলভী, শাহনেওয়াজ খান, তূর্য চৌধুরীসহ অসংখ্য আলোকচিত্রীর কাজ বিশ্বশিল্পমহলে প্রশংসিত হয়েছে।
আজকের শিল্পবিশ্বে বাংলাদেশের যে পরিচিতি তার নেপথ্য ভূমিকা দৃক ও পাঠশালার। ২০০০ সালে দৃক প্রথম আন্তর্জাতিক ছবিমেলার আয়োজন করে। ছবিমেলা এশিয়ার সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র উৎসব। পাঠশালার উত্তরণ দ্বিধাহীনভাবে বাংলাদেশের ‘আলোকচিত্রিক রেনেসাঁ’ বলা যায়। এত কিছুর পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ও শিল্পকলা একাডেমিতে ফটোগ্রাফির জায়গা হয়নি। ঢাকা আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়ে চিত্রকলার বিভিন্ন শাখার সঙ্গে ফটোগ্রাফি বিভাগও চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষক না পাওয়ায় সে সময়ে এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ষাটের দশকের শুরুতে আর্ট কলেজে ফটোগ্রাফির একটা পূর্ণাঙ্গ বিভাগ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ফটোগ্রাফি পড়ানোর জন্য শিল্পী মুস্তফা মনোয়ারকে আর্ট কলেজে নিয়ে আসেন। ওয়ান টুয়েন্টি রোলিকর্ড ক্যামেরা, লাইটিং, আধুনিক এনলার্জারসহ ডার্করুম সরঞ্জাম কেনা হলো। কিন্তু কোথায় যেন ছেদ পড়ল! অনেক দিন অপেক্ষা করে মুস্তফা মনোয়ার ১৯৬৪ সালে চলে গেলেন টেলিভিশনে। ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে আর্ট কলেজে এলে ফটোগ্রাফি বিভাগ প্রতিষ্ঠার আলোচনাটি আবারও জোরালো হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াবহ হত্যাকা-ের পর সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। ফলে চারুকলায় ফটোগ্রাফি আর জায়গা করে নিতে পারল না। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আলোকচিত্র বিভাগ খোলার বিল পাস হয়েছিল। এখন সেটিও কী অবস্থায় আছে কে জানে! আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি হয়ে গেল, সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি নিয়ে এত এত ঘটনা ঘটে গেল কিন্তু দেশের মাটিতে তাদের কোনো মূল্যায়ন হলো না।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় এক দশক আগে থেকে এদেশে আধুনিকতাবাদী ভাস্কর্য চর্চার সূচনা ঘটে। উনিশশো ষাটের দশকের শুরুতে আধুনিক ভাস্কর্যের বিভিন্ন ধরনের সঙ্গে পূর্ববাংলাকে পরিচিত করেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভাস্কর্যবিদ্যা শিক্ষা ও চর্চা ষাট দশকের প্রথমার্ধে (১৯৬৩ সালে) শুরু হয়। অতএব বলা যেতে পারে স্বাধীনতা লাভের এক দশক আগেই এদেশের আধুনিক ও সমকালীন ভাস্কর্যচর্চার পটভূমি রচিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বাংলাদেশের ভাস্কর্যচর্চার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে। বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে উনিশশো একাত্তরের ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তাই স্বাধীনতার পরপরই এই যুদ্ধে জনমানুষের আত্মত্যাগ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বকে স্মরণীয় করে রাখতে গণপ্রাঙ্গণ ভাস্কর্য নির্মাণের তাগিদ অনুভূত হয়। কেননা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বিশালায়তন ভাস্কর্যের উপস্থিতি বোধের ক্ষেত্রে যে ধরনের শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে তা অন্য কোনো শিল্পমাধ্যমে সম্ভব নয়।
একাত্তরে ঢাকার জয়দেবপুর (গাজীপুর) চৌরাস্তার যে স্থানে প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধ সংগঠিত হয় সেই স্থানটিকে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামকরণ করা হয়। ১৯৭২ সালে সেখানে নির্মিত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মারক গণপ্রাঙ্গণ ভাস্কর্য ‘মুক্তিযোদ্ধা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তার বিভাগের শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন। বেদিসহ ৪২ ফুট উচ্চতার সাদা সিমেন্ট-কংক্রিটে ঢালাই করে নির্মিত ভাস্কর্যটি একহাতে রাইফেল অন্যহাতে গ্রেনেড ধরা একজন মুক্তিযোদ্ধার বিমূর্ত অবয়ব। ভাস্কর্যটি নির্মাণ ও স্থাপনে উদ্যোগ, ব্যবস্থাপনা এবং পৃষ্ঠপোষকতায় গাজীপুর অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। গাজীপুরে প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধ থেকে ৯ মাসের যুদ্ধে সমরাঙ্গনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন মেজর জেনারেল আমিন আহম্মেদ চৌধূরী। ভাস্কর্যটি নির্মাণ ব্যবস্থাপনায় তিনি ও তার বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকরা অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। এর কিছুদিন পর ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (ডাকসু) কলাভবনের সামনে অপর একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ভাস্কর অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল্লাহ্ খালিদ তার সহযোগী তরুণ শিল্পীদের নিয়ে ‘অপরাজেয় বাংলা’ নামে সুপরিচিত এই ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ আরম্ভ করেন। তবে জাগ্রত চৌরঙ্গীর ভাস্কর্যটির মতো ‘অপরাজেয় বাংলার’ নির্মাণ সহজে বা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়নি। নির্মাণ ব্যয় সংকুলান, প্রশাসনিক অসহযোগিতা এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ক্রমশ সংগঠিত হতে থাকা ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বাধা মোকাবিলা করে ১৯৭৯ সালে ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। দুজন পুরুষ ও একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা যাদের একজন নাগরিক তরুণ একজন গ্রাম্য যুবক ও অপরজন সেবিকা হিসেবে সামনে অগ্রসরমানÑ এমন তিনটি প্রতিনিধিত্বমূলক অবয়বের সমন্বয়ে আঠারো ফুট উচ্চতার এই ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়। বাংলাদেশে পাবলিক স্কাল্পচার বা গণপ্রাঙ্গণ ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে অপরাজেয় বাংলা ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এটি নির্মিত হওয়ার পর একই ধারায় অনেকগুলো মুক্তিযুদ্ধ স্মারক ভাস্কর্য নির্মিত হয়। তবে প্রাথমিকভাবে যেসব গণপ্রাঙ্গণ ভাস্কর্য নির্মিত হয় তার বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয় ও সেনানিবাসমূহে স্থাপিত হতে দেখা যায়।
সারা বিশ্বেই গণপ্রাঙ্গণ ভাস্কর্যসমূহ ভাস্কর্যের জনপ্রিয় ধারা হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রটি ভিন্ন। ভাস্কর্যবিদ্যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং ভাস্কররা তাদের নিজস্ব স্টুডিওতে যে নিরীক্ষামূলক অনুশীলন চালান তার মাধ্যমে মৌলিক ভাস্কর্যসমূহ সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে তারা সেগুলো জনসম্মুখে উপস্থাপন করেন। এই ভাস্কর্যগুলোর মধ্য থেকে সংগ্রাহকরা নিজস্ব রুচি অনুযায়ী তাদের ব্যক্তিগত শিল্পসংগ্রহ সমৃদ্ধ করেন, রাষ্ট্রীয় অথবা বেসরকারি জাদুঘরসমূহও সংগ্রহ করে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তি ভাস্করদের কমিশন করেন পাবলিক ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য।
বাংলাদেশে আধুনিক ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে এ-ধরনের মৌলিক ভাস্কর্যের চর্চার সংস্কৃতি শুরু হয় মুখ্যত স্বাধীনতার এক দশক আগে। তবে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে তা’ নতুন করে প্রাণ পায়। ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান ভারতের বরোদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাস্কর্যে উচ্চতর পাঠ গ্রহণ শেষে দেশে ফিরে ‘একাত্তর স্মরণে’ শিরোনামে বেশ কিছু ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষা শেষে অলোক রায় সিরামিক মাধ্যমে রিলিফ ও মুক্ত ভাস্কর্য নির্মাণ শুরু করেন। পাশাপাশি দেশে শিক্ষিত ভাস্কররাও নানা ধরনের নিরীক্ষা শুরু করেন। চিত্রকলাসহ অন্যান্য মাধ্যমের বেশ কিছু শিল্পী ভাস্কর্যচর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফলে ১৯৭৬ সালে প্রথম জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনী ও ১৯৮৩ সালে দ্বিতীয় জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ভাস্কর্যের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ক্রমাগত নবীন শিল্পশিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়তে থাকে। বিশ শতকের আশির দশকে ভাস্কর্য শিল্পীদের অনেকেই অন্যান্য দেশ থেকে ভাস্কর্যে উচ্চতর পাঠ গ্রহণ করতে শুরু করেন। জাতীয় ও এশীয় প্রদর্শনীগুলোতে প্রদর্শিত ভাস্কর্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। নব্বই দশকে এসে আমরা ভাস্করদের একক ও যৌথ প্রদর্শনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে দেখি।
তবে একথা অনস্বীকার্য যে, ভাস্কর্যকে সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণ করার সামাজিক প্রস্তুতি, ভাস্কর্যের আধুনিক নিরীক্ষাপ্রবণতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিকশিত হয়নি। ফলে একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে উচ্চতর শিক্ষা বিস্তৃতি পাচ্ছে এবং দেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর প্রায় অর্ধশতাধিক ভাস্কর শিক্ষা সম্পন্ন করে বের হচ্ছেন তখনো ভাস্কর্যচর্চা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত পেশায় পরিণত হয়নি। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে এদেশের প্রতিভাধর নবীন-প্রবীণ ভাস্করদের অনেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভাস্কর্যের জন্য বহু সম্মান বয়ে আনলেও তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তেমনভাবে প্রচারিত হয়নি। বরং সৌন্দর্যবর্ধন ও বিভিন্ন স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণের নামে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, ঠিকাদারি পদ্ধতিতে মানহীন নির্মাণ ভাস্কর্য সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ধারণা বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে।
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর প্রাক্কালে বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশ করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে তখন অন্য সব ক্ষেত্রের মতো ভাস্কর্যের প্রকৃত মানসম্পন্ন বিকাশ ও বিস্তারও প্রত্যাশিত। সেজন্য শুধু উচ্চতর শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে ভাস্কর্যশিক্ষা অব্যাহত রাখলেই চলবে না বরং প্রতিভাবান নবীন-প্রবীণ ভাস্কররা যাতে দেশে-বিদেশে নিজেদের সৃজনকর্ম নির্বিঘেœ অব্যাহত রাখতে পারেন তার প্রকৃতি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। গত শতকের সত্তর দশকে শুরু হয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়া জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনীটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মিত কার্যক্রমে পরিণত করতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আয়োজিত জাতীয় প্রদর্শনীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই প্রদর্শনীর মানকে উন্নত করতে হবে। দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট গ্যালারিগুলোকে ভাস্কর্য প্রদর্শনী আয়োজনে আরও আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। জাতীয় জাদুঘর ও শিল্পকলা একাডেমিকে মানসম্পন্ন ভাস্কর্য সংগ্রহ করা ও নিয়মিত প্রদর্শনের কর্মসূচি নিতে হবে। গণপ্রাঙ্গণে ভাস্কর্য নির্মাণে ঠিকাদারি পদ্ধতি বিলোপ করতে হবে। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যোগ্য ও প্রকৃত ভাস্করদের মানসম্পন্ন কাজ স্বয়ং ভাস্করের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করতে হবে। নগর কর্তৃপক্ষগুলো জাতীয়ভিত্তিক ‘ভাস্কর্য সিম্পোজিয়ামের’ মাধ্যমে মানসম্পন্ন ভাস্কর্য বাছাই ও নির্মাণের মাধ্যমে পার্ক, আইল্যান্ডগুলোকে উন্নত দেশগুলোর মতো নান্দনিকভাবে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন। নগরের বাইরের পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে আরও দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে ভাস্কর্য উদ্যান নির্মাণ একটি শক্তিশালী উদ্যোগ হতে পারে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক স্থানগুলোও ভাস্কর্য উদ্যান নির্মাণের মাধ্যমে আরও সমৃদ্ধ করে তোলা সম্ভব। এসব উদ্যোগ গৃহীত হলে দেশের প্রতিভাবান ভাস্কররা যেমন তাদের শিল্পচর্চায় উৎসাহিত হবেন তেমনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎকর্ষেও শিল্পমাধ্যম হিসেবে ভাস্কর্যের শক্তিশালী ভূমিকা নিশ্চিত হবে।
নব্বই দশকের শুরুতে কলকাতার বাংলাদেশের শিল্পকলার এক আলোচনায়, কবি ও শিল্পী পুর্ণেন্দু পত্রীর একটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন এদেশের শিল্পকলার খতিয়ান তৈরিতে সাহায্য করতে পারে। শিল্পী হাশেম খানের বয়ান অনুযায়ী পত্রীর প্রশ্নটি ছিল মানব অবয়বের অনুপস্থিতি বিষয়ক। ‘কথোপকথন’ খ্যাত কবির খেদোক্তি যে, বাংলাদেশের শিল্পীরা বইয়ের নকশা ও অঙ্গসজ্জায় যেমনটা মানুষের দেহ আঁকেন তেমনটা চিত্রকলায় উঠে আসে না। উত্তরে হাসেম খান জানান যে, আমাদের দেশে নানান মাত্রার ছবির চর্চা আছে তার মধ্যে বিমূর্ত ছবির চর্চা একটি ধারা। এই উত্তর পত্রীকে খুশি না করলেও, প্রখ্যাত শিল্পী সুনিল দাসকে প্রাণিত করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সুনিল দাস নিজে নানান উপায়ে চিত্রতলে মানব অবয়বকে হাজির করে ও অনুপস্থিত রেখে ছবি এঁকে গেছেন। এদেশের শিল্পকলার আদ্যোপান্ত বুঝতে ওপরের তর্কের প্রাসঙ্গিকতার দিকটি আরও খোলাসা করে বলা দরকার।
মূর্ত-বিমূর্ত দ্বৈততার মধ্য দিয়ে এদেশে শিল্পবিষয়ক আলোচনা বরাবরই শিল্পাঙ্গনে নানান মাত্রার চর্চার দিকটিকে অগ্রাহ্য করবার পথ তৈরি করে দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রগতিশীলতার যে লঘু অথচ মতাদর্শিক তাপে উদ্বুদ্ধ কিছু বুদ্ধির চর্চা আজও প্রচলিত আছে তার মধ্যে মানব মূর্তির প্রতি ইসলাম ধর্মের সন্দেহকে সাধারণ বৃত্তিবাদী মওলানার বয়ানের ভুল ব্যাখ্যার বিপরীতে দাঁড় করানোকে ভুল ব্যাখ্যার উদাহরণ বলে আখ্যা দেওয়া যায়। যেমন নবী ইব্রাহিমের প্রবর্তিত পথ, যে পথে আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তা ও তার প্রেরিত পুরুষদের আকৃতি দানের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে; তাকে কাঠমোল্লার বুদ্ধি দিয়েই মানুষ-প্রাণী আঁকা যাবে না এমন তর্ক বারবার উত্থাপন করা হয়। নবীকে পূজনীয় না করে তোলা, এমনকি অদৃশ্যকে দৃশ্যমান না করে তুলে যে তাকওয়াভিত্তিক জীবন তার অপব্যাখ্যার সূত্রে বাংলাদেশের শিল্পে মূর্ত-বিমূর্তের বিরোধ জিইয়ে রাখার শিল্পশিক্ষা যেমন পূর্ণাঙ্গ হয়নি, তেমন শিল্প বিষয়ে দার্শনিক আলোচনা তেমন এগোতে পারেনি।
বিমূর্ততা পন্থিদের পাশ্চাত্যমুখী শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত করার যে সাধারণ প্রবণতা, তার মধ্যেও বিবেচনার দিকটি উহ্য থাকে। এর ফলে নানান মাত্রার অবয়বধর্মী শিল্পীদের এক কাতারে ফেলে দিয়ে বিচারের বাইরে নিয়ে আসার প্রক্রিয়াটা আজও জারি আছে। এ কারণে জয়নুল আবেদিন কেন পাশ্চাত্যের বাস্তবানুগ রীতি শিক্ষা বারবার বাসনা পোষণ করলেন, এমনকি শিক্ষক মুকুল দে’র অনুরোধ অগ্রাহ্য করে কেন বিলাতি কলম শিক্ষা করে পরে নিজ পথ তৈরির করলেন, এর ওপর তেমন গুরুত্বপূর্ণ আলো পড়েনি। ময়মনসিংহের শিক্ষার্থী জয়নুল যখন তিরিশের দশকের শুরুতে শিল্পের পাঠ নিচ্ছেন, তখন প্রাচ্যকলা বলে একটি পদ্ধতি চালু হয়ে গেছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন সেই ধারার মহীরুহের মতন। কিন্তু প্রাচ্যরীতির কোমলতার পাঠ না নিয়ে জয়নুল শিখে নিতে চাইলেন বাস্তবকে তার সব রুক্ষতাসহ আঁকবার পদ্ধতি। রেখার ঋজুতা তিনি অর্জন করলেন রেমব্রার মতো শিল্পী থেকে এবং রেখাকেই মুখ্য করে চিত্রতল থেকে রঙ ও আলোছায়া বিদায় করে দেওয়ার চাতুরীটি শিখলেন চৈনিক ধারার শিল্পী সু থে হং থেকে। এই সাধারণীকরণের পর জয়নুল বিষয়ে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দুই মেরু একের আওতায় নিয়ে আসবার ক্ষমতা, পর সূত্রে তার আপন চিত্রভাষার যা আঙ্গিক তারই সাধনার নিমিত্তে ধরা দিল। প্রাচ্য-প্রতীচ্য বিষয়ক সাধারণীকৃত তর্কও বাংলাদেশের চিত্র, ভাস্কর্য ও বর্তমান সময়ের আন্তঃশৃঙ্খলার সূত্রে তৈরি স্থাপনা বা কনসেপচুয়াল উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ডিসকোর্স তৈরিতে তেমন সাহায্য করে না। ‘দেশজ’ কথাটি এমন এক সামান্যতার জন্ম দিয়েছে যার মধ্যে যে কোনো প্রকার গ্রামীণ বিষয়ের রেফারেন্স বা উল্লেখ শিল্পের ভাষা তৈরিতে সাহায্য না করেও এতে তাৎপর্য দান করেছে ধরে নেওয়া হয়। এশীয় দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনী, কিংবা চারুকলার জাতীয় প্রদর্শনীতে সরা চিত্রের বৃহৎ সংস্করণ কিংবা টেপা পুতুলের উপস্থাপনা এখন দর্শকের আনন্দ বাড়ায়, কিন্তু শিল্পের সৃষ্টিশীলতায় সাহায্য করছে না ধরে নেওয়া যায়। কামরুল হাসানের পর গ্রামীণ কলম ব্যবহার করে নতুনতর সৃষ্টির তেমন কোনো বিশেষ উদাহরণ চোখে পড়ে না। কামরুলই তার স্বভাবসুলভ সহজতায় আধুনিক শিল্পের আয়তনে গ্রামীণ শিল্পীর রেখা ও রঙ ব্যবহার করে নতুন চিত্রকল্প গড়ে তুলেতে পেরেছিলেন। এ অঞ্চলে কামরুল রাজনৈতিক চিত্রভাষারও প্রবর্তক। তার রাজনৈতিকতার সূচনা হয় ইয়াহিয়া খানের মুখাবয়ব আঁকার সূত্রে। যে মানব-জন্তু শিল্পী স্বাধীনতার বছরখানেক আগে আঁকা শুরু করেন, তার জৈবিক মাত্রা অবশেষে (সত্তর দশকের শুরুতে) এক প্রকার বুদ্ধিবৃত্তিক রূপ পায়। এগুলো তার সমাজ বিশ্লেষণমূলক কাজ। স্বাধীনতার পর, নতুন বুর্জোয়া শ্রেণির নতুন মেকি সমাজকে শিল্পী প্রাণী অবয়বের পাশে মানব মূর্তি স্থাপন করে এক প্রকার বহুমাত্রিক ও বহুসংখ্যক মোটিভ-নির্ভর ভাসমান চিত্রকল্প তৈরি করেন। প্রথম দিককার এই ‘ক্রিটিক্যাল ইমেজ’ শিল্পী সাদা-কালো ছাপচিত্র মাধ্যমে করেন। একই প্রবণতার মধ্য দিয়ে কামরুল তার ১৯৭১ স্মরণে আঁকা ১৯৮৩ সালের ক্যানভাসগুলোতে মানবমূর্তির জঙ্গম এক ক্ষেত্র সৃষ্টি করেন। যদি বাংলাদেশে উচ্চরুচির সূত্রে দেখার সমস্যা তৈরি হয়ে থাকে, যদি পদ বিমূর্ততার মধ্য দিয়ে শিল্প বিচারের কোনো প্রকার ব্যত্যয় ঘটে থাকে, তা কামরুলের এই গোয়েরনিকাসুলভ কাজগুলোকে মূল্যায়ন না করার মধ্যে চিহ্নিত করা যায়।
বাংলাদেশে মানব অবয়বের নতুন মাত্রা যোগ করে যারা দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন তারা আশির দশকের কিছু তরুণ। এদের মধ্যে রুহুল আমিন কাজল, জিতেন্দ্র কুমার শর্মা, শিশির ভট্টাচার্য, নিসার হোসেন, ঢালী আল মামুন ও ওয়াকিলুর রহমান অন্যতম। গত দুই দশকে তাদের ভাষার বিবর্তন ঘটেছে। ওয়াকিলুর রহমান মানব অবয়ব ছেড়ে বিমূর্ত ধারার শিল্পী হয়ে উঠেছেন। কাজল ক্যানভাসের কাজের পাশাপাশি কাগজে এমনকি রাস্তায় তার শিল্পের বিস্তার ঘটিয়েছেন। শেষ চারজনের খ্যাতির সূচনা সময় শিল্পী দলের আবির্ভাব কালেই। এই শিল্পীদের অঙ্গীকার ছিল শিল্পে সমাজ বাস্তবতা, রাজনীতি ও বিশ্লেষণী চিন্তার প্রকাশ ঘটানো। পরবর্তী সময়ে তাদের নিজ নিজ চিত্রভাষায় ও নির্মাণ প্রক্রিয়ায় নবতর মাত্রা যুক্ত হয়েছে। তবে যে নারী শিল্পী ‘সময়ে’র সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে নারী অবস্থান নিয়ে জোরালো বক্তব্য হাজির করেছিলেন, সেই দিলারা বেগম জলির কাজে ক্রমশই অবয়ব ও অবয়বহীন তার লীলা তার আন্তরমাধ্যম-নির্ভর শিল্পকে সমৃদ্ধতর করে তুলেছে। তার সাম্প্রতিকতম একক নারী ও জঠর এই দুয়ের সূত্রে যে স্থাপনা ও আলোকচিত্রে অসংখ্য ছিদ্র গড়ে তুলে আপন ওপরের অস্তিত্বর আকারায়ন ঘটিয়েছেন, এমন তুরীয় প্রকাশে মূর্তের সাথে বিমূর্ত একাত্মায় পরিণত।
নারী শিল্পীদের কাজে, এমনকি নারীভাব প্রকাশ করে এমন শিল্পীদের হাতে মূর্ত-বিমূর্তের সীমানা লঙ্ঘিত হতে দেখা যায়। রোকেয়া সুলতানা এবং নাইমা হক, এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দুজনই নারীর চোখে দুনিয়া দেখার দিকটি এমন নিজস্ব ভাষা ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছেন যে, তাদের আপন ভাষারও নানান স্তর তৈরি হয়েছে তা পরখ করে দেখবার অবকাশ থাকে। বিশেষ করে রোকেয়ার মাতৃত্ব থেকে শুরু করে নারী প্রকৃতি ও বৃহত্তর প্রকৃতির ওপর মনোযোগ তাকে ক্রমশ মূর্ততা থেকে বিমূর্ততার দিকে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশে নারী শিল্পীদের বিকাশ ও চিত্রভাষার প্রকৃতি বিষয়ক আলোচনায় আরও যারা জড়িত ছিলেন এবং এখনো আছেন তাদের কেউ কেউ জিজ্ঞাসু দৃষ্টির বদলে অপলক দৃষ্টিতে দেখবার জগৎ তৈরি করতে চেয়েছেন, ফরিদা জামান তাদেরই একজন।
দেখাকে দর্শনে পরিণত করতে পুরুষ শিল্পীরা সম্পূর্ণ বিমূর্ত চিত্রতল তৈরি করে আসছিলেন ষাটের দশক থেকেই। এরাই দ্বিতীয় প্রজন্মের আধুনিক শিল্পী যারা ‘পেইন্টার হিরো’ হিসেবে সমাজে যা চিত্রকলার জগতে আধুনিকতাকে একটি মাত্রায় সমাসীন রেখে দৃুিষ্ট এঁকে গেছেন। মোহাম্মদ কিবরিয়া, কাজী আব্দুল বাসেত এদের পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় ছিলেন যতদিন তারা বেঁচেছিলেন। উল্লেখ্য যে, কিবরিয়ার আজীবন সাধনার ফল যে প্রকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত রঙ ও টেক্সচারের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা উচ্চ কোটির রুচি প্রকাশকারী বিমূর্ত চিত্রভাষাই এদেশের শ্রেষ্ঠ অর্জন হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। ওর অন্য পক্ষ হিসেবেই অবয়ববাদীদের উত্থান ঘটে স্বাধীনতার ঠিক পর পর। নতুন সমাজ গড়ার বাসনালব্ধ যে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ সমাজতন্ত্রকে আধেক ফ্যাশন ও আধেক বাস্তব হিসেবে গ্রহণ করে নিতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের অগ্রগামী অংশ দ্বিধাহীন ছিল তারই পরম্পরায় শাহাবুদ্দিনসহ নতুন প্রজন্মের মানবমূর্তি-নির্ভর চিত্রী ও ভাস্করদের চিহ্নিত করা যায়। আব্দুল্লাহ খালিদ ওই বৃত্তের না হয়েও এর কাছাকাছি অবস্থান থেকে গণপরিসরে তার ভাস্কর্যগুলো নির্মাণ করেছিলেন।
সমাজ-সমালোচনাধর্মী চিত্রভাষা কামরুল হাসানের অবদান। অন্যদিকে শেখ মোহাম্মদ সুলতান বাংলাদেশের চিত্রকলায় ‘আদিম ও আদমকে একই সূত্রে গেঁথে’ ‘মৃত্তিকাপুষ্ট জীবনকে’ (ছফা ১৯৮৫) নতুন কল্পনার নিরিখে সমাজ গড়ার শিল্পী। সমাজ ও সমাজ মানসে সাম্যের খোদ ধারণাট জাগিয়ে তোলার মধ্যদিয়ে সুলতান মানব অবয়বে আদিম সমাজের সত্য ফিরিয়ে এনে নতুন সমাজ গড়ার বীজমন্ত্র গড়ে দিয়েছেন যেখানে কিষাণ-কিষাণীরা নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কামরুনের রাজনৈতিকতায় যদি শ্রেণির বিষয়টি মুখ্যতা পেয়ে থাকে, সুলতানের বৈপ্লবিকতায় ভূমির মালিকানার প্রশ্নটির সুরাহা করতে গ্রামীণ নায়কেরা হয়ে উঠলেন আদিশক্তির প্রতীক। স্বাধীন দেশে মানব অবয়বে ফিরে গিয়ে সমাজ ও চিত্রতলের মধ্যে নতুনতর যোগাযোগ গড়বার আয়োজনে এই দুই শিল্পী নতুন নিশানারও প্রতীক।
স্বাধীনতার আগের আধুনিক শিল্পের উত্থান পর্বের শিল্পী নভেরা আহমেদ আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সোপন গড়ে দিয়েছেন। তার প্রভাব কিছু কিছু নারীশিল্পীর ক্ষেত্রে ভাস্কর্যের জগতে প্রবেশের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। যে যৌথ অজ্ঞানের সূত্রে ষাটের দশকের পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশে বিমূর্তবাদীদের উত্থান লক্ষ করা গেছে, তার সূত্রে আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীরসহ অনেক প্রতিভা অবয়বহীন চিত্রতল গড়ার দিকে ঝুঁকলেন, তা থেকে তফাতে থেকে নভেরা অবয়বের ফর্মাল ভাঙাগড়ার মাধ্যমে তার চিত্রভাষার সুরাহা করলেন। স্বাধীনতার কয়েক বছর আগে এই শিল্পীর দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে যে শূন্যতা তৈরি হলো তা পরবর্তী তিন দশকেও পূরণ হয়নি। নভেরার ভাষার প্রাথমিক ও পরবর্তী বিকাশ লক্ষ করলে হলফ করে বলা যায, তিনিও তার পরবর্তী নারীশিল্পীদের মতোই মূর্ত-বিমূর্তের বৈপরীত্য মেনে না নিয়ে দুই মেরুতেই সহজে গমন করবার সূত্রে আকারায়নের প্রশ্নের সুরাহা করেছেন।
শিল্পে কর্ম বা অর্থ উৎপাদন শিক্ষিত শ্রেণির আদর্শগত পক্ষপাতের ওপর নির্ভরশীল। আশির দশকের তরুণরা ধর্ম-সমাজ অপেক্ষা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের যে পথনির্দেশনা অনুসারে সামরিক শাসন ও ধর্মপন্থি রাজনৈতিক দলের অনাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, তার মধ্যে দিয়েই বিমূর্ত বনাম মানব অবয়বপন্থি শিল্পের বয়ান পাকা ভিত পেল। নারী শিল্পীরাও অবয়বের এমনতর নতুন ব্যবহার সামনে নিয়ে এলেন যেন নারীর অবস্থানের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, যেন চিত্রকল্প প্রচলিত মত ও পথ থেকে সরে এসে নুতন দিকে মুখ ফেরাতে পারে। নাজলী লায়লা মনসুরের পর এই পথে আতিয়া ইসলাম এ্যানিসহ নিরুফার চামান এবং বর্তমান সময়ে বহুপ্রজ শিল্পী দিলারা বেগম জলি।
যে রাজনৈতিক ওজনের ভার শিল্পীরা বহন করবার সাহস দেখালেন, গড়ে তুললেন নতুনতর সমালোচনাধর্মী ইমেজ বা মূর্তি, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়েছে। কিন্তু নব্বই দশকের প্রবণতায় যে মাধ্যমের মিশ্রতা একটা বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখল তা ভিন্ন এক শিল্পজ রাজনৈতিকতার সূত্রে জন্ম নিল। জিএস কবিরের ভূমিকা এখানে স্মরণযোগ্য।
এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের চারুকলার ইতিহাস হিসেবে যা আমাদের সামনে হাজির করা হয় তা মূলত প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। ইউরোপকেন্দ্রিক জ্ঞানের আলোকে আধুনিকতাবাদী ধারণার ওপর ভিত্তি করে এই ইতিহাস তৈরি করা হয়েছে যার মধ্যে ঔপনিবেশিক প্রভাব প্রবল। এর ফল হয়েছে এই যে, বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পধারাকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করা এবং উপযুক্ত স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সেসব শিল্পধারাকে বিকশিত করার অনুকূল পবিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
১৯৪৭ এর দেশভাগের পর বাংলাদেশের চারুকলার ইতিহাসে দুটি বিশিষ্ট/স্বতন্ত্র ধারার উদ্ভব ঘটেছিল। এর প্রথমটির কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক চারুকলার ধারা যেটি বিকশিত হয়েছে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত (১৯৪৮) আর্ট ইনস্টিটিউটকে কেন্দ্র করে (বর্তমানে যেটি চারুকলা অনুষদ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত)। কিন্তু প্রায় একই সময়ে, দেশভাগের পর পর ঢাকার এই শিল্প-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরও কিছু শিল্পশৈলী/শিল্পধারার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল। এটাকে আমরা অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারা বলতে পারি। এই অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারার নেতৃত্ব দিয়েছেন পীতলরাম সুর, আর.কে. দাস, আলাউদ্দিন, আলী নুর, দাউদ উস্তাদ প্রমুখ শিল্পীরা। এইসব অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের মাধ্যমেই বিকশিত হয়েছে এদেশের সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং, রিকশা আর্ট, ট্রাক আর্ট ইত্যাদি। আর এগুলোর মধ্যে যেটি নিজস্ব শিল্পশৈলী, উপস্থাপন রীতি ও বিষয়বস্তুর স্বকীয়তায় ইতিমধ্যে দেশে-বিদেশে সুধীজনের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটি হলো রিকশা আর্ট। এই লেখায় আমরা মূলত রিকশা আর্টের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে কিছু আলোচনা করব।
২.
মূলত চাকা আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে তিন চাকার বাহন রিকশার সূত্রপাত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ১৮৭০ সাল নাগাদ। অবিভক্ত বাংলায় রিকশার প্রচলন ঘটে কলকাতায় বিশ শতকের প্রথম ভাগে। কাছাকাছি সময়ে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডে রিকশার প্রচলন হয় প্রথমে ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জে এবং পরে ঢাকায় (১৯৩৮)। তবে বাংলাদেশে প্রচলন ঘটে সাইকেল রিকশার, মানুষে টানা রিকশা নয়। বাহারি ও শৌখিন পরিবহন হিসেবে ঢাকায় রিকশার আগমন ঘটে এবং ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর ক্রমশ তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত রিকশা পেইন্টিংয়ের সূত্রপাত হয় এই সময় থেকেই। অর্থাৎ ঢাকাকেন্দ্রিক আধুনিক ধারার প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলার পাশাপাশি লোকয়াত শিল্পীদের মাধ্যমে রিকশাচিত্র তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় হতে থাকে। বাংলাদেশে রিকশা পেইন্টিংয়ের প্রবীণ ও বিখ্যাত শিল্পী যেমন আর. কে. দাশ, আলী নূর, দাউদ উস্তাদ, আলাউদ্দিনসহ অন্যরা পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকেই রিকশা পেইন্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী রিকশা পেইন্টিংয়ের চাহিদা ছিল তখন অনেক বেশি। ছবি আঁকার আনন্দ, সেই সঙ্গে এই কাজের ক্রমবর্ধমান চাহিদা তাদের এই পেশায় যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছে। এদের অনেকে আগের পেশা বা পৈতৃক পেশা ছেড়ে এই পেশায় যুক্ত হন। যেমন আর. কে. দাশের পৈতৃক পেশা ছিল চামড়ার কাজ। তিনি ও তার পুত্ররা এসেছেন রিকশা পেইন্টিংয়ের কাজে। লক্ষণীয়, চারুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিল্পীদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই এই বিশেষ শৈলীর উদ্ভব ও বিকাশে।
৩.
করণকৌশলের দিক থেকে রিকশার অঙ্গসজ্জাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এর একভাগে রয়েছে রেকসিন, প্লাস্টিক, আয়না, ঘণ্টা বা বাতিল সিডি ও অন্যান্য উপকরণে রিকশা অলংকরণ (টিন কেটে বিভিন্ন কারুকাজ করার উদাহরণও দেখা যায়) এবং অন্য দিকে রয়েছে রঙের সাহায্যে রিকশাকে চিত্রিত করার বিষয়টি। তবে একটি নতুন রিকশাকে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করে তোলায় রিকশা পেইন্টারদের বিশেষ কৃতিত্ব দিতেই হবে। রিকশা আর্টের মূল লক্ষ্য রিকশাকে সুসজ্জিত ও আকর্ষণীয় করা। আর এজন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তু নির্বাচন করা হয়, বিশেষত পেছনের প্যানেলে আঁকার জন্য। সাধারণত শিল্পীরা মহাজন এবং ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ছবি এঁকে থাকেন।
গত সত্তর বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে রিকশা পেইন্টিং করা হয়েছে। যেমন, ষাটের দশকে রিকশা পেইন্টিং করা হতো মূলত শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র তারকাদের প্রতিকৃতিকে অবলম্বন করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে বিষয়বস্তু করে অনেক ছবি আঁকা হতো রিকশায়। আবার সত্তরের দশকে নতুন দেশের নতুন রাজধানী হিসেবে ঢাকা যখন বাড়তে শুরু করে তখন কাল্পনিক শহরের দৃশ্য আঁকা হতো রিকশায়। পাশাপাশি, সব সময়ই, গ্রামের জনজীবন, প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবিও আঁকা হতো, এখনো হয়। এছাড়াও বিভিন্ন স্টাইলের ফুল, পাখি ইত্যাদি তো আছেই।
বিভিন্ন মিথ বা ধর্মীয় কিংবদন্তিকে বিষয় করে রিকশায় ছবি আঁকতে দেখা যায়। যেমন, মুসলিম উপাখ্যানের দুলদুল, বোরাক কিংবা আরব্য রজনীর উপাখ্যানআলাদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ ও দৈত্য, রাজকন্যা, রাজপ্রাসাদ ইত্যাদি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাদায় আটকে যাওয়া গরুর গাড়ির ছবিটি (‘সংগ্রাম’ নামে পরিচিত) রিকশাচিত্রীরা বিভিন্নভাবে এঁকেছেন। দূরবর্তী ভিনদেশি দৃশ্যও রিকশাচিত্রে দেখা যায়। যেমন, মরুভূমির ভেতর উট নিয়ে চলেছে দুই বেদুইন, কিংবা অচেনা কোনো সমুদ্র সৈকতে খেলা করছে কোনো বালক, জাপানের কোনো বাড়ি, লন্ডন ব্রিজ, আইফেল টাওয়ার, টাইটানিক জাহাজ ইত্যাদি। স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন, শহীদ মিনার ইত্যাদি স্থাপত্য রিকশাচিত্রের বিষয় হয়েছে বহুবার। মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন তাজমহল রিকশা পেইন্টিংয়ের আরেকটি জনপ্রিয় বিষয়। তাজমহল এঁকেছেন বিভিন্ন শিল্পী নিজের নিজের মতো করে বহুবার। ইদানীং রিকশাচিত্রীদের আরেকটি প্রিয় বিষয় যমুনা সেতু (বঙ্গবন্ধু সেতু)। এছাড়া ডাইনোসরের সঙ্গে যুদ্ধরত লুঙ্গিপড়া খালি গায়ের বাঙালি রিকশাচিত্রীদের অপূর্ব কল্পনাশক্তির নিদর্শন।
তবে এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, রিকশায় মানুষ আঁকার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে রিকশা পেইন্টাররা মানুষের পরিবর্তে পশুপাখির ছবি আঁকতে শুরু করেন। যেমন, ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে একটা শেয়াল, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একটা বাঘ, পাশে স্কুল বালকের মতো ব্যাগ কাঁধে খরগোশ ছানা চলেছে স্কুলে। শহরের অতি পরিচিত দৃশ্যশুধু কোনো মানুষ নেই, মানুষের স্থান দখল করেছে বিভিন্ন পশুপাখি। অনেকটা প্রয়োজনের তাগিদে বাধ্য হয়ে আঁঁকা হলেও এই ধারার কাজগুলো বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। এই ধারার কাজগুলোর ভেতর দিয়ে তৎকালীন সমাজ বাস্তবতাকে তুলে ধরা হয়েছে বলেও মনে করেছেন কেউ কেউ।
রিকশা পেইন্টিংয়ের কাজের ধরনের মধ্যে কখনো কখনো বাংলার লোকায়ত ধারার প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে রেখার ব্যবহারে এই প্রভাব অধিক চোখে পড়ে। আবার বিভিন্ন ক্যালেন্ডার বা ছাপা ছবিকে মূল হিসেবে ব্যবহার করে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়েও রিকশা পেইন্টাররা ছবি এঁকে থাকেন। তবে রিকশা পেইন্টংয়ে, বিশেষ করে রঙ নির্বাচনে, সিনেমার ব্যানার চিত্রীদের কাজে প্রভাব পড়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়।
৪.
তবে সরেজমিনে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, শিল্পধারা হিসেবে রিকশা আর্ট ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। ঢাকায় বর্তমানে (২০২৩) আনুমানিক ১০-১২ জন সক্রিয় রিকশাচিত্রী আছেন। ঢাকা ছাড়াও রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর, খুলনা, পাবনা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ইত্যাদি শহরে আরও কিছু রিকশাচিত্রী কমবেশি কাজ করেন। হাতে আঁকা প্লেটের বিকল্প হিসেবে ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যাপক ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় এই বিশেষ রীতির চিত্রকলা আজ হুমকির সম্মুখীন। পেশাগত দিক দিয়ে হুমকির সম্মুখীন রিকশা পেইন্টাররা। ইতিমধ্যে বেশির ভাগ রিকশাচিত্রী পেশা পরিবর্তন করেছেন বা বিকল্প কাজ খুঁজে নিয়েছেন। ঢাকায় যারা এখনো সক্রিয়, তারা মূলত বিদেশি ক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল। বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামীণ দৃশ্য যেমন ধান ভানা, উঠোনে বিশ্রাম নেওয়া, নদীতীরে সূর্যাস্ত ইত্যাদির পাশাপাশি সিনেমার পোস্টারের অনুকরণে আঁকা ছবিতে ক্রেতাদের চেহারার আদল ফুটিয়ে তোলা হয় এসব ছবিতে। এগুলো বিদেশিরা বাংলাদেশের স্মারক হিসেবে কিনে নিয়ে যান। আবার অনেক ক্রেতা পারিবারিক ছবি, বিয়ের ছবি, সন্তানদের বা বন্ধুদের ছবি রিকশা পেইন্টিংয়ের ঢঙে আঁকিয়ে নিতে পছন্দ করেন। তারপরও অনেক শিল্পী চেষ্টা করেন তাদের কল্পনাকে কাজে লাগিয়ে পছন্দসই বিষয়বস্তুর ছবি আঁকতে। বিদেশিদের শখ মেটানো গেলেও, তাতে রিকশাচিত্রীদের জীবনে, দু’য়েকটি বিরল ব্যতিক্রম বাদে, বিশেষ কোনো হেরফের হয়েছেএমনটা মনে হয় না।
৫.
অন্যদিকে, রিকশাচিত্র নিয়ে নতুন সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। দেশের বাইরে রিকশা আর্টের সমাদর লক্ষণীয়। যেমন, ১৯৮৮ সালে লন্ডনে মিউজিয়াম অব ম্যানকাইন্ডে (বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের অন্তর্ভুক্ত) শিরিন আকবরের কিউরেটিংয়ে ঢাকার রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘Traffic Art: rickshaw paintings from Bangladesh’। ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের সুসজ্জিত ও চিত্রিত রিকশা সংগৃহীত আছে। জাপানের ফুকুয়াকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছে এবং এই মিউজিয়ামে রিকশা পেইন্টিংয়ের একটা বড় সংগ্রহ আছে। সম্প্রতি (২০১৩) জাপানের তাকামাৎসু শহরে একটি আর্ট ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের রিকশাচিত্র বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে। নেপালেও হয়েছে বাংলাদেশের রিকশাচিত্রের প্রদর্শনী। তবে বাংলাদেশে রিকশা পেইন্টিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনীটি হয়েছে ১৯৯৯ সালে ঢাকায় অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। এই প্রদর্শনীতে পাঁচশ জন রিকশা পেইন্টার এবং তিরাশি জন বেবিট্যাক্সি (দুই স্ট্রোক বিশিষ্ট অটো রিকশা) পেইন্টারের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছিল। সম্প্রতি জার্মানির ক্যাসল শহরে অনুষ্ঠিত ‘ডকুমেন্টা ১৫’-এ বাংলাদেশের আরও অনেক শিল্পীর সঙ্গে অংশ নিয়েছেন রিকশাচিত্রী তপন দাস ও সিনেমা ব্যানার শিল্পী আবদুর রব খান। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার মিউজয়ামে রিকশাচিত্রের কর্মশালা করেছেন আহমেদ হোসেন। এমনকি, কিছুদিন আগে, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্পী ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী রিকশা আর্ট কর্মশালা যেখানে নতুন শিল্প-শিক্ষার্থীরা সরাসরি রিকশাচিত্রীদের কাছে হাতেকলমে শিখতে পেরেছেন বিভিন্ন কলাকৌশল এবং এই শিল্পের নিজস্ব নান্দনিকতা। এছাড়াও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বৃত্ত আর্ট ট্রাস্ট, যথাশিল্প রিকশাচিত্র নিয়ে নানা ধরনের কাজ করে থাকে।
রিকশা আর্ট বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পশৈলী। আমরা যদি এখনই সুচিন্তিত ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ না করি তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো এর স্থান হবে শুধু জাদুঘরে। আমরা কি সেই দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করব? আমার ধারণা, এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে রিকশাচিত্র বহমানতা বজায় রেখে স্বতন্ত্র শিল্পশৈলী হিসেবে টিকে থাকতে পারবে বলে আশা করা যায়।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনকে বলা হয় ‘লাশের সাক্ষ্য’। সেই প্রতিবেদনে প্রায়ই ভুল থাকছে। হত্যা হয়ে যাচ্ছে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা। দেশের মর্গগুলোর আধুনিকায়ন না হওয়া, চিকিৎসকদের অদক্ষতা এবং মর্গে আসার আগেই মরদেহের আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ভুলের অন্যতম কারণ। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য এরকমই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের বেশিরভাগ মর্গে মরদেহের ভিসেরা বা বিভিন্ন নমুনা সংরক্ষণের আধুনিক সুবিধাসংবলিত জায়গা নেই। এসব ধারণের জন্য কনটেইনার, প্রিজারভেটিভ বা রাসায়নিকের সরবরাহও প্রয়োজনের তুলনায় কম। অনেক সময় প্রিজারভেটিভ না থাকলে লবণ পানির সাহায্যে মর্গে লাশ সংরক্ষণ করা হয় এবং হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল ল্যাবে যেসব স্যাম্পল বা নমুনা পাঠানো হয়, সেসব ভালোমানের ফরমালিন দিয়ে সংরক্ষিত করে পাঠানো হয় না। ফলে আলামত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও ভুলের আশঙ্কা বাড়ে। কখনো চিকিৎসক প্রভাবিত হয়েও ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেন।
ময়নাতদন্তসংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলেন, আমাদের দেশে আধুনিক মর্গ ব্যবস্থাপনা নেই। তাছাড়া লাশ মর্গে আসার আগেই অনেক আলামত নষ্ট হয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে প্রথমে থানায় নেয়; তারপর থানা থেকে নেয় মেডিকেল কলেজে। এরপর অ্যাম্বুলেন্স, লেগুনা বা ট্রাকে বা ভ্যানে করে আনে মর্গে। এত আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। এসব কারণে ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসে।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ময়নাতদন্তের ভুল প্রতিবেদনের প্রধান কারণ আধুনিক যন্ত্রপাতি ও আধুনিক মর্গের অভাব। দ্বিতীয় কারণ, লাশ যখন আমাদের কাছে আসে তখন আমরা সিন অব দ্য ক্রাইম (অপরাধের দৃশ্য) ভিজিট করি না। ফলে অনেক ইনফরমেশন ধরা পড়ে না। উন্নতবিশ্বে কোথাও অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে পুলিশ ওই স্থানকে হলুদ টেপ দিয়ে ঘিরে রাখে এবং সবার আগে ভিজিট করে একজন ফরেনসিক স্পেশালিস্ট। ওখান থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগৃহীত হয়ে মর্গে চলে আসে। মর্গে লাশ পাঠায় পুলিশ, পরে পোস্টমর্টেম করে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে মরদেহের ফাইন্ডিংস মিলিয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। সেটাই সঠিক ও নির্ভরযোগ্য হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমন হয় না।’
ময়নাতদন্ত কী : খুন বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর ভুক্তভোগীর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানার জন্য একজন ফরেনসিক চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞ মরদেহের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অঙ্গ বা অঙ্গবিশেষের গভীর নিরীক্ষণ করেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করে মন্তব্যসহ যে প্রতিবেদন দেওয়া হয় তাই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মনে করেন, ময়নাতদন্ত হওয়া জরুরি, তখন মৃতদেহ সিভিল সার্জন বা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়।
সম্প্রতি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা ও রেল দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কথা উল্লেখ থাকা ২২টি মামলা তদন্ত করে পিবিআই জানায়, এগুলো ছিল পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। ওই মামলাগুলোতে পুলিশের অন্যান্য সংস্থা তদন্ত করে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল।
পিবিআইপ্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হত্যা বা অপমৃত্যুর মামলার তদন্তে ময়নাতদন্তের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভালো ময়নাতদন্ত মামলার রহস্য উদঘাটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে ময়নাতদন্ত সঠিক না হলে তদন্ত ভিন্ন পথে মোড় নেয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করে, ঘটনার রহস্য উদঘাটনে দারুণভাবে সহায়তা করে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিটফোর্ড বা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে ২০২১ সালে ৭৪০টি, ২০২২ সালে ৬০০টি ও চলতি বছর ১৫ মে পর্যন্ত ১৪৫টি মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। গত ১৫ মে দুপুরে সেখানকার মর্গে গিয়ে দেখা গেছে জরাজীর্ণ দশা। দুটি মরদেহ পড়ে আছে পোস্টমর্টেমের অপেক্ষায়। মর্গ সহকারী নাম প্রকাশ না করে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মর্গের লাশ রাখার একমাত্র ফ্রিজটি তিন বছর ধরে নষ্ট। ময়নাতদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় মালামালের সংকট সবসময়ই থাকে। নেই আধুনিক কোনো সুবিধা। তিনজন মর্গ সহকারীই বছরের পর বছর চুক্তিভিত্তিতে কাজ করছেন।’
জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য মর্গের দশা একই।
ময়নাতদন্ত সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে পিবিআইয়ের এক প্রতিবেদনে দেশের মর্গসংশ্লিষ্টদের ফরেনসিক বিষয়ে আধুনিক ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণের অভাব, বিশেষজ্ঞ ফরেনসিক চিকিৎসকের তুলনায় লাশের সংখ্যা বেশি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও হিমাগারসহ মানসম্মত অবকাঠামো না থাকাকে ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া মর্গ অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ডোমের স্বল্পতা, জটিল ও চাঞ্চল্যকর মরদেহের ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্ত না করা, আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা থাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ময়নাতদন্ত কাজে অংশ নিতে চান না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ময়নাতদন্ত বিষয়ে পিবিআইয়ের প্রতিবেদন ও দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মর্গগুলোতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ও আলোর ব্যবস্থাসহ আধুনিক অবকাঠামো ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে। অনেক জেলায় মর্গে বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে জেনারেটর নেই। অনেক জেলায় মর্গে পর্যাপ্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নেই। বংশ পরম্পরায় মর্গ অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ডোমরা ময়নাতদন্তের সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও তাদের কোনো মৌলিক প্রশিক্ষণ নেই। তাছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ ব্যস্ত মর্গগুলোতে মর্গ অ্যাসিস্ট্যান্টদের স্বল্পতা প্রকট। অনেক জায়গায় দেখা গেছে, লাশ সংরক্ষণের সুরক্ষিত পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাব। বিদেশি নাগরিক ও বিশেষ ক্ষেত্রে মরদেহ প্রচলিত নিয়মে হিমঘরে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ে। অল্পসংখ্যক মর্গে কুলিং বা ফ্রিজিং বা মর্চুয়ারি কুলার সিস্টেম থাকলেও অধিকাংশ সময় নষ্ট থাকে বলে গরমের সময় লাশে দ্রুত পচন ধরে।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর সম্ভাব্য সময়ের উল্লেখ থাকা জরুরি। মর্গে আধুনিক প্রযুক্তি না থাকায় অভিমত প্রদানে বিশেষজ্ঞদের সমস্যা হয়। পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ১ জুন রাজধানীর কলাবাগান থানা এলাকায় নিজ বাসা থেকে ডা. কাজী সাবিরা রহমান লিপির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি খুন হয়েছিলেন। মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে। খুনের ধরন মোটামুটি স্পষ্ট হলেও ঘটনার রহস্য উন্মোচনে খুনের ‘সম্ভাব্য সময়’ জানার জন্য পিবিআই ঢামেক ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকদের সুযোগ-সুবিধা কম হওয়ায় চিকিৎসা শিক্ষায় এ শাখাটি অবহেলিত এবং কম গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। ফলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ ফরেনসিক ডাক্তারের স্বল্পতা রয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে আরেকটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, সিএমএম আদালতের নির্দেশে ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগরের লালমোহন থানা এলাকা থেকে কামাল মাঝির (৪৫) ৩৮ মাসের পুরনো মরদেহ তুলে ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যায়। সেখানে কর্মরতদের কারও এ ধরনের মরদেহের ময়নাতদন্তের অভিজ্ঞতা না থাকায় মরদেহটি ভোলা থেকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে নেওয়া হয়। দায়িত্বরত প্রভাষক জানান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের পদে কেউ কর্মরত নেই। তিনি মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য অন্য কোনো মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে নেওয়ার অনুরোধ করেন। পিবিআই মরদেহটি বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সংশ্লিষ্ট বিভাগে নিয়ে যায়।
হত্যা কেন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা হিসেবে আসে জানতে চাইলে ফরেনসিক চিকিৎসকরা জানান, কাউকে হত্যা করে রেললাইনে ফেলে রাখলে তার ওপর দিয়ে ট্রেন গিয়ে একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে হাড়গোড় বেরিয়ে দলিত হয়ে যায়। একে চিকিৎসাশাস্ত্রে মিউটিলেডেট লাশ বলে। ওইসব লাশের আলামত বোঝা যায় না। আগের আলামত নষ্ট হয়ে নতুন আলামত তৈরি হয়। তখন রেল দুর্ঘটনাই মনে হয়। এতে অনেক সময় চিকিৎসকরা মিসগাইডেড হয়।
ফরেনসিক বিভাগে চিকিৎসকের সংকট বিষয়ে এক চিকিৎসক বলেন, ‘আমি ঢাকায়ে আছি, অথচ আমাকে কক্সবাজার বা পঞ্চগড় গিয়ে স্বাক্ষর দিতে হচ্ছে। বাইরে যাওয়ার, বিশেষ করে একা, বিপদ আছে অনেক, সংক্ষুব্ধ পক্ষ হামলা চালাতে পারে। এজন্য অনেক চিকিৎসক এ বিভাগে থাকতে চান না। এখানে সুবিধাও অনেক কম। মফস্বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসককে মিসগাইড করে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে রিপোর্ট লেখানো হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রথম সেট ২৫ মিনিট, দ্বিতীয়টি ২৮ মিনিটে জিতলেন কার্লোস আলকারাজ। মনে হচ্ছিল কোয়ালিফায়ার ফ্যাভিও কোবোলিকে বুঝি উড়িয়েই দিচ্ছেন শীর্ষ বাছাই।
না, তৃতীয় সেটতে প্রতিরোধ গড়লেন ইতালিয়ান। সময় গড়ালো ঘন্টায়। শেষপর্যন্ত জয় এসেছে ৬৬ মিনিটে। ৬-০, ৬-২, ৭-৫ গেমে প্রথম রাউন্ডের ম্যাচ জিতে রাফায়েল নাদালের উত্তরসুরি ক্লে কোর্টের সর্বোচ্চ আসর শুরু করলেন।
নাদালের চোটজনিত অনুপস্থিতিতে শীর্ষবাছাই আলকারাজ। ২০২১ এ তৃতীয় রাউন্ড, গতবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন। এবার আরো এগোলে সেমিফাইনালে নোভাক জকোভিচের সংগে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা।
সে দেখা যাবে। আপাতত দ্বিতীয় রাউন্ডে আলকারাজকে টপকাতে হবে জাপানের টি. দানিয়লেকে।
ফ্যাটি লিভার রোগটি এখন ঘরে ঘরে। প্রাথমিকভাবে এই রোগের লক্ষণ না বুঝতে পারলে, অনেক সমস্যাই দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকরা জানান, এই রোগ থেকে বাঁচতে জীবনধারায় বদল আনতে হবে।
কোন কোন উপসর্গ দেখলে সতর্ক হবেন? শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, হঠাৎ ভুঁড়ি বেড়ে যাওয়া, হলুদ রঙের দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব, ওজন অত্যন্ত বেড়ে যাওয়া, সারাক্ষণ ক্লান্তিভাব— এই উপসর্গগুলি ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ হতে পারে। অনেকের ধারণা, মদ্যপান করলেই এই রোগের ঝুঁকি বাড়ে। তবে কেবল মদ্যপান ছেড়ে দিলেই এই রোগের ঝুঁকি কমবে না। কম তেলমশলার খাবার খাওয়া, বাড়ির খাবারে অভ্যস্ত হওয়া, মদ ছেড়ে দেওয়া— এই অভ্যাসগুলিই লিভারকে ভাল রাখার অন্যতম উপায়। এই অসুখকে ঠেকিয়ে রাখতে ডায়েটের ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। তবে এগুলিই শেষ কথা নয়। লিভার ভাল রাখতে মেনে চলতে হয় আরও কিছু নিয়মকানুন। কিন্তু কী কী?
চিনির মাত্রা কমানো
সহজে রোগা হতে চেয়ে অনেকেই নিজের খুশি মতো ডায়েট প্ল্যান বানিয়ে নেন। চিনি বাদ দিয়ে দেদারে কৃত্রিম চিনির উপরেই ভরসা করেন। এতেই আসলে চরম ক্ষতি করছেন শরীরের। অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার অভ্যাস আমাদের লিভারের ব্যাপক ক্ষতি করে। ফ্রুকটোজ হোক কিংবা কৃত্রিম চিনি, লিভারের অসুখ ডেকে আনে।
ব্যথার ওষুধ কম খান
বেশকিছু বেদনানাশক ওষুধ লিভারের ক্ষতি করে। কিছু প্যারাসিটামল বা কোলেস্টেরলের ওষুধও লিভারের প্রভূত ক্ষতি করে। ঘুম না হলে অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘুমের ওষুধ খেতে শুরু করেন। এই অভ্যাসের কারণে লিভারের জটিল রোগে ভুগতে হতে পারে।
পানি বেশি করে খান
শরীর থেকে যতটা দূষিত পদার্থ বার করে দিতে পারবেন, লিভার ততটাই সুস্থ থাকবে। তাই বেশি করে পানি খেতে হবে। তবেই প্রস্রাবের সঙ্গে শরীরের টক্সিন পদার্থগুলি বেরিয়ে যাবে। দিনে কয়েক বার গরম পানিতে পাতিলেবুর রস দিয়ে সেই পানি খান। ডায়েটে রাখুন টক দইয়ের মতো প্রোবায়োটিক।
পর্যাপ্ত ঘুম
সারাদিন কর্মব্যস্ততা আর রাত জেগে মোবাইলে চোখ রেখে সিনেমা দেখা— সব মিলিয়ে ঘুমের সঙ্গে আপস। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, দীর্ঘদিন ঘুমের অভাব হলে তার প্রভাব পড়ে লিভারের উপরেও।
ওজন কমান
শুধু সুন্দর দেখানোর জন্যই নয়, লিভার সুরক্ষিত রাখতে চাইলেও কিন্তু ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আমাদের শরীরে কার্বহাইড্রেট-প্রোটিন-ফ্যাটের সঠিক ভারসাম্য থাকা ভীষণ জরুরি। তবে ইদানিং বাড়ির খাবার নয়, বরং রেস্তোরাঁর খাবার, রেড মিট, বাইরের ভাজাভুজি, প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খেয়ে অভ্যস্ত। আর এর জেরেই শরীরে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা বাড়ছে। লিভারের পক্ষে এই ফ্যাট মোটেই ভাল নয়।
আইপিএলের পঞ্চম শিরোপা জিততে চেন্নাই সুপার কিংসের চাই ১৫ ওভারে ১৭১ রান। আহমেদাবাদে রাত ১২.৪০ মিনিটে শুরু হবে খেলা। গুজরাট টাইট্যান্সের ২১৪ রানের জবাবে খেলতে নেমে ৩ বলে ৪ রান করার পর বৃ্স্টিতে বন্ধ হয় ফাইনাল। অর্থাৎ বাকি ১৪.৩ ওভারে আরো ১৬৭ রান চাই ধোনীর দলের।
দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী লিমিটেড ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের মধ্যকার ফেডারেশন কাপ ফুটবলের ফাইনাল দেখতে কুমিল্লায় উড়ে গেছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন।
কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে আজ বেলা ৩টা ১৫ মিনিটে শুরু হয়েছে ম্যাচটি। সালাউদ্দিন ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা খানেক আগে কুমিল্লায় পৌঁছান।
ঢাকা থেকে সড়ক পথে কুমিল্লায় পাড়ি দিতে মাত্র দুই ঘণ্টা সময় লাগে। তবে সালাউদ্দিন দূরত্বটা পাড়ি দিয়েছেন হেলিকপ্টারে করে। যা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
টাকার অভাবে কদিন আগে নারী ফুটবলারদের অলিম্পিক বাছাইয়ে পাঠায়নি বাফুফে। অথচ ঢাকা থেকে কুমিল্লায় যেতে বাফুফে সভাপতি বেছে নিলেন হেলিকপ্টার।
হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে কুমিল্লার এই যাত্রায় বাফুফে সভাপতির সঙ্গী হয়েছেন সংস্থার নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতি জোর করে হারানো হয়েছে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন তেমনি যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নির্মিত হয়েছে বিশেষ কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘ও ভোরের পাখি’। ঈমাম হোসাইনের প্রযোজনায় এটি উপস্থাপনা করেছেন তামান্ন তিথি। অনুষ্ঠানটিতে আবৃত্তি করেছেন আশরাফুল আলম, মীর বরকত, রফিকুল ইসলাম, পলি পারভিন, শাকিলা মতিন মৃদুলা, মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল, আসলাম শিশির, সংগীতা চৌধুরী, আহসান উল্লাহ তমাল। প্রচারিত হয় ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টায়।
এছাড়াও নির্মিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আমারে দেবো না ভুলিতে’। অনুষ্ঠানটিতে গান, কবিতা ও আলোচনার সমন্বয়ে কবিকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বাচিকশিল্পীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ইয়াসমিন মুসতারী, সালাউদ্দিন আহমেদ, শেলু বড়ুয়া, ছন্দা চক্রবর্ত্তী ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন প্রফেসর মুন্সী আবু সাইফ। মনিরুল হাসানের প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে ২৫ মে দুপুর ১ টা ০৫ মিনিটে। আরও প্রচারিত হবে সংগীতানুষ্ঠান ‘দোলনচাঁপা’ ও ‘সন্ধ্যামালতী’। রাত ৯টায় প্রচারিত হবে নাটক ‘বনের পাপিয়া’ (পুনপ্রচার)।