
প্রথমেই অন্তত দুটো কথা বলে নেওয়া ভালো। প্রথম কথা এই, জনরুচি কথাটার মধ্যে একটা ব্যাপক সার্বিকতা আছে, যা মর্মের দিক থেকে কোনো বিশেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযোগী নয়। রাষ্ট্র বা জাতি ধারণা মাথায় রেখে আমরা বিপুল মানুষকে এক পাল্লায় স্থাপন করে কথাবার্তা বলি বটে; কিন্তু এর মধ্য দিয়ে আদতে একটা বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো কাজের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। মানুষের মধ্যে শ্রেণি ও অবস্থানগত দিক থেকে শুরু করে বহুবিধ ফারাক থাকে। আর রুচি জিনিসটা ওইসব পার্থক্য দিয়ে এতটাই নিয়ন্ত্রিত হয় যে, কোনো সাধারণ মন্তব্য প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় কথাটা হলো, যোগাযোগ-প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উন্নতির পর থেকে মানুষের বিশ্বজনীন যোগাযোগ আর কল্পনার যে বৈপ্লবিক বদল ঘটেছে, আগের অনেক দশক মিলিয়েও সে ধরনের পরিবর্তন শনাক্ত করা যায় না।
এ দুটো দিক বিবেচনায় রেখে বলা যায়, বাংলাদেশে সত্তর আর আশির দশকে নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজে সুরুচির ধারণাটা পশ্চিমা মেজাজ আর কলকাতায় বিকশিত ‘সংস্কৃতি’র যৌথতায় নির্ধারিত হতো। এর পরিচয় আছে উত্তম-সুচিত্রা ধরনের সিনেমায়, ছায়ানট ধরনের সংগীত-চর্চায়, আর ‘দেশ’ পত্রিকার প্রবল প্রতাপে। তবে এ রুচির চর্চাকারীরা সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না; যদিও চর্চার আভিজাত্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল। নাগরিক মধ্যবিত্তের মধ্যে এ ধরনের রুচির বিস্তারের প্রধান সাক্ষ্য বোধহয় পাওয়া যাবে সিনেমার গানে, যার সঙ্গে ষাট-সত্তরের দশকের কলকাতার ‘আধুনিক বাংলা গানে’র প্রবল সাদৃশ্য পাওয়া যাবে, যদিও বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্বভাবতই এর নানারকম রূপান্তরও ঘটেছিল। রূপান্তরের বড় কারণ সম্ভবত দুটি। একদিকে মুসলমান-প্রধান জনগোষ্ঠীর কাহিনি ও ভাবের বাহন হওয়ায় কিছু পরিবর্তন জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে করতেই হতো। অন্যদিকে গ্রামীণ জনসমাজের সংখ্যাধিক্যের কারণে চিত্রিত জীবনচিত্রে গ্রামের একটা প্রাধান্যও থাকত। বিপুল গ্রামীণ জনগোষ্ঠী প্রাত্যহিক জীবনযাপন ও বিনোদনের জন্য নগরের ওপর প্রধানভাবে নির্ভরশীল না থাকলেও উন্নত বা কাক্সিক্ষত রুচির সরবরাহকারী হিসেবে ঢাকার একক প্রাধান্য আসলে স্বাধীনতার আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
পশ্চিমা সংস্কৃতি ঢাকার জনরুচিতে নতুন রূপ নিয়ে ওপরে কথিত রুচিধারার মধ্যে যে ধরনের রূপান্তর ঘটাচ্ছিল, তা বোঝার জন্য সবচেয়ে ভালো উপকরণ সম্ভবত ব্যান্ড সংগীত। পশ্চিমা পপ মিউজিক, তার কথা, সুর, উপস্থাপনা ও উপভোগের কেতা ঢাকার ব্যান্ড সংগীতে খুব ভালোভাবে আত্মীকৃত হয়েছে; উত্তম ফসল ফলিয়েছে; আর সম্ভবত বিপুল তরুণ-সমাজের জন্য কাঠামোবদ্ধ রুচির নিগড় থেকে মুক্তির একটা বার্তাও নিয়ে এসেছিল। পোশাক এবং খাবারের দিক থেকে বাংলাদেশের জনরুচি গত পাঁচ দশকে সম্ভবত খুব একটা বৈপ্লবিক বদলের মধ্য দিয়ে যায়নি। ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতির বিপুল বিস্তার সত্ত্বেও খাদ্যরুচির প্রধান প্রবাহটা আসলে প্রায় সমরূপই আছে। অন্যদিকে পোশাকের রুচিও আসলে বদলেছে ঠিক ততটাই, যতটা আর্থিক সংস্থানের কারণে বদলাতে পারে। বলার মতো যথেষ্ট কারণ আছে, ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলাদেশের নাগরিক জনরুচি শনাক্তকরণের জন্য সাহিত্য বা অন্য বিনোদন-উপাদানের তুলনায় খাদ্য-সংস্কৃতি ও পোশাক-সংস্কৃতি অধিকতর বিশ্বস্তভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। সত্তর ও আশির দশকের অন্তত মধ্যবিত্ত জনরুচির গ্রাম-শহর নির্বিশেষে– সবচেয়ে ভালো আদল পাওয়া যাবে হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকর্মে।
নব্বইয়ের দশক থেকে নগরায়ণের গতি ও প্রকৃতি দ্রুত বদলাতে থাকে। এর অনিবার্য পরিণতি পশ্চিমায়ন। খুব স্বাভাবিক বাস্তবতার কারণেই বাংলাদেশের অভিজাত রুচির ভূগোলে কলকাতার হিস্যা দ্রুত কমতে থাকে। তার স্থান উচ্চবিত্তের ক্ষেত্রে দখল করতে থাকে ইংরেজিবাহিত খাঁটি আমেরিকান সংস্কৃতি; আর নাগরিক মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে অংশত তার অপভ্রংশ। গ্রামীণ
সাংস্কৃতিক উপাদানের নাগরিক রূপান্তরও এসময় থেকে মধ্যবিত্ত নাগরিক সংস্কৃতিতে বড় জায়গা দখল করতে থাকে। সত্তর-আশির দশকে যোগাযোগহীনতার কারণে গ্রামীণ সংস্কৃতি যতটা স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারত, নব্বইয়ের দশক থেকে তার পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকে। এতে করে একদিকে গ্রামীণ জনপদে নগর-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে, আর নগরেও পুনরুৎপাদিত হতে থাকে গ্রামীণ সংস্কৃতির নানা মাত্রা। এর এক কারণ, গ্রাম থেকে গরিব মানুষের ব্যাপক হারে নগরে আগমন। নগরে লোকসংগীত বা লোকসংস্কৃতির চর্চা আগেও ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে গ্রামীণ জনপদের নানা উপাদান নগরে যেভাবে পুনরুৎপাদিত হয়েছে, তা একেবারেই আলাদা জিনিস। নাগরিক মধ্যবিত্ত রুচিতেও তার ব্যাপক সংক্রমণ ঘটেছে। শিল্পী মমতাজ হয়তো এ বাস্তবতারই তুঙ্গ প্রকাশ।
গত এক-দেড় দশকে দুনিয়ার অন্যান্য গরিব দেশের মতো বাংলাদেশেও জনরুচি ও যাপিত সংস্কৃতির বৈপ্লবিক বদল ঘটেছে নতুন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। এর প্রধান নিয়ামক যোগাযোগ-প্রযুক্তি। কিন্তু আমাদের মতো দেশগুলোতে তার আরেক কারণ আছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে এমন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা হয়তো খুবই কম, যারা নিজেদের সম্ভাব্য ইমিগ্রান্ট হিসেবে কল্পনা করে না। এমতাবস্থায় তাদের ভোগ-উপভোগ এবং কল্পিত রুচির মধ্যে বড় ধরনের বদল ঘটাই স্বাভাবিক। যোগাযোগ-প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সেই কল্পনাকে অন্তত অংশত বাস্তবে পরিণত করে দেখাচ্ছে। যোগাযোগ-প্রযুক্তির অভিভাবকত্বে জনমানুষের সামষ্টিক রুচি ও বোধের যেসব পরিবর্তন ঘটে চলেছে, তার কোনো কাঠামোগত বিশ্লেষণের সময় এখনো আসেনি। কিন্তু এটুকু বলা যায়, গ্রাম ও নগরের ব্যাবধান এদিক থেকে খুব বেশি নয়। আর নাগরিক উচ্চশ্রেণির সাথে মধ্যশ্রেণির ফারাকও কমেছে।
কিন্তু বিনোদন-সংস্কৃতি রুচির একাংশ মাত্র। বাস্তবে সুবিধাপ্রাপ্ত উচ্চশ্রেণিটিই কেবল এই নতুন রুচিকে নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারছে। মধ্যবিত্তের যাপিত জীবন আর কাক্সিক্ষত রুচি ও বোধের টানাপড়েন নিশ্চয়ই আগের চেয়ে বেড়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা হবে গ্রামীণ জনপদের বিপুল মানুষ। তাদের পূর্বতন বোধ ও বিনোদন প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে; কিন্তু নতুন আয়োজনগুলোতে অংশ নেওয়ার বাস্তবতাও নিজেদের জীবনে তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের গ্রাম ও নগরে ওয়াজ-সংস্কৃতির বিপুল বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ কি এই শূন্যতা?
আগেই বলেছি, শ্রেণি বা অন্যবিধ ফারাকের আলাপ মুলতবি রেখে জনরুচির আলাপ অর্থহীন। তারপরেও যদি এ নাম ধরে আলাপ করতেই হয়, তাহলে হয়তো বলা যাবে, বাংলাদেশে এমন জনরুচি চিহ্নিত করা খুব সহজ কাজ নয়। পোশাকে-খাবারে তার প্রবল ছাপ আছে; আছে ফোক আর ব্যান্ড মিউজিকে; আছে কথায়-উচ্চারণভঙ্গিতে-কোলাহলময়তায়। কিন্তু সাহিত্য, সিনেমা ইত্যাদি অপেক্ষাকৃত নির্ণয়যোগ্য কাঠামোর মধ্যে তার প্রতিফলন খুব জুতমতো ঘটেনি। ফলে জনপ্রিয় সংস্কৃতির ইন্ডাস্ট্রিয়াল উৎপাদন-পুনরুৎপাদনে বাংলাদেশ শোচনীয়ভাবে পিছিয়ে আছে। এর পেছনে কাজ করে থাকতে পারে, এমন দুটি অনুমান এখানে হাজির করছি। এক. উনিশ-বিশ শতকের কলকাতার সংস্কৃতির প্রবল প্রতাপের কারণে বাঙালি মুসলমান রুচি ও সংস্কৃতি উপস্থাপিত হওয়াটা খুব চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল। পাকিস্তান আমলে ‘ইসলামি’ সংস্কৃতির রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ‘বাঙালি মুসলমান’ সংস্কৃতি তখন এবং পরেও দীর্ঘমেয়াদি অপরায়ণের শিকার হয়েছে। ফলে আমাদের নাগরিক ও অভিজাত রুচি ও সংস্কৃতি জনজীবনের সঙ্গে তুলনামূলক আলগা সম্পর্ক নিয়ে বিকশিত হয়েছে। দুই. বাংলাদেশে নাগরিক সংস্কৃতি জমে ওঠার আগেই বা প্রাক্কালে গ্লোবালাইজেশনের ধাক্কা এসে লাগে। ফলে নাগরিক মধ্যবিত্তের দুই-তিন প্রজন্ম কখনোই ঢাকায় বড় হারে বসতি করে উঠতে পারেনি। প্রধানত এ ধরনের জনগোষ্ঠীই যে কোনো দেশের রুচির নিয়ন্তা হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে ঘটনা না ঘটায় জনরুচির কোনো কাঠামোগত প্রস্তাব বড় হয়ে সামনে আসতে পারেনি। কলকাতা এবং পশ্চিমই রয়ে গেছে প্রধান রেফারেন্স পয়েন্ট। প্রতিক্রিয়া হিসেবে অপেক্ষাকৃত নন-এলিট জোনে ‘ইসলাম’ও তার শেয়ার দাবি করছে। কিন্তু কোনোটিই জনরুচির ভেতর থেকে যাপিত জীবনের রেফারেন্সে কার্যকর হতে পারছে না।
কিংবা হতে পারে, এই নিরাকার আকারই বাংলাদেশের জনরুচি ও সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সময়, পরিস্থিতি, ব্যক্তি-সমাজের প্রয়োজনে পরিবর্তনশীল। অতীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তন ও সভ্যতার অগ্রগতিতে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি রূপ-রূপান্তরের যে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছিল নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে সেই রূপান্তরের ধারা রক্ষা করেছে। বিশেষ করে কভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে যখন করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ে তখন এ দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে যেমন নবরূপ সৃষ্টি হয়েছে তেমনি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি নিজের ঐতিহ্যকে ভিন্নধারায় রূপান্তর করেছে।
বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের পথ ধরে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে উদ্দীপনা গ্রহণের মাধ্যমে নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক সংকট এবং মনুষ্যসৃষ্ট কিছু দুরবস্থাকে অতিক্রম করেছে। যে কোনো পরিস্থিতিতেই এ দেশের মানুষ অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মোকাবিলা করেছে তেমনি রাজনৈতিক সংকটকে অতিক্রম করেছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হতে উদ্দীপনা নিয়ে। এমনকি মনুষ্যসৃষ্ট দুরবস্থা থেকে নিজের অস্তিত্ব¡ টিকিয়ে রাখতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শক্তিকে আশ্রয় করেছে।
ইতিহাসে জানা যায়, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ রাজনৈতিক দুঃশাসনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের লোককবিরা গান লিখে সুর করে পরিবেশনের মাধ্যমে জনগণের মনে উদ্দীপনা সঞ্চারে ভূমিকা রেখেছিলেন। এ ছাড়া ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে ও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকালে এই দুটি আন্দোলনে লোকসংগীতের শক্তিকে ব্যবহার করে লোকশিল্পীরা সময়ের প্রয়োজনে নতুন গান রচনা করে এবং পরিবেশন ও প্রচার করে দেশের সব সাধারণ এবং সংগ্রামী মানুষের মনে অনুপ্রেরণা ও সাহস সঞ্চার করেছিল।
অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তন ও সভ্যতার অগ্রগতিতে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে রূপ-রূপান্তরের যে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছিল একবিংশ শতকে নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে সেই রূপান্তরের ধারা নতুনভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে কভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণে যখন বাংলাদেশের জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে তখন এ দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে নানা ধরনের সংকট যেমন সৃষ্টি হয় তেমনি তা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে সংস্কৃতিতে নতুন ধরনের আবেগ, প্রতিক্রিয়া ও চেতনা সঞ্চারিত হতে থাকে। এ পর্যায়ে সে ধরনের কিছু ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ৫ এপ্রিল তারিখে কিশোরগঞ্জ জেলার রামায়ণ গানের তরুণ সাধকশিল্পী শংকর দে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষার জন্য জনসচেতনামূলক নিজের লেখা-সুর করা ও গাওয়া একটি গান আমাদের মেসেঞ্জারে ইনবক্স করেন। তিনি তার পরিবেশিত গানটি ভাবনগর ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজ বা ইউটিউবে প্রচার করতে অনুরোধ করেন। আমরা তখন শিল্পীকে বলতে চেয়েছিলাম, ‘এই কাজটি তো আপনি নিজেই আপনার ফেসবুকে প্রচার করতে পারেন।’ কিন্তু শিল্পী শংকর দে জানান, তার ফেসবুক তেমন জনপ্রিয় নয়, তাই গানটি বেশি লোক দেখতে পারবে না, আর ভাবনগরে দিলে সারাদেশের লোক জানতে পারবে, সচেতন হতে পারবে। শিল্পী শংকর দে-র এই কথার ভেতর দিয়ে বোঝা যায়, তিনি অধিক সংখ্যক মানুষকে করোনা সম্পর্কে সচেতন করতে চান।
করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষ শুরু থেকে অনেক গুজবের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের ইসলামি বক্তাদের কেউ কেউ বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকে নানা ধরনের গুজব সৃষ্টি করে ছড়িয়ে দিতে থাকে। এদের মধ্যে মুফতি কাজী ইব্রাহিম অন্যতম, তিনি ২০২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের প্রথম দিকে প্রকাশ্য মহফিলে এবং মসজিদে জুমার নামাজের বয়ানে ইতালির মামুন মারুফের স্বপ্নে দেখা করোনা ভাইরাসের সাক্ষাৎকারের বয়ান করেন। এই বয়ানে তিনি পৃথিবীতে করোনা আগমনের কারণ ও সময় সম্পর্কে উল্লেখ করেন। মুফতি ইব্রাহিমের গুজবের পরপরই ৮ মার্চ ২০২০ তারিখে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করা হয় এবং দ্রুত করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে ২৬ মার্চ ২০২০ তারিখ থেকে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন ঘোষণা করে। এরপর সাধারণ মানুষ গৃহবন্দি হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে করোনা মহামারীর মধ্যে যেসব সাধক কবি ও শিল্পী নিজেদের সৃজনশীলতাকে ঘরে অবস্থান নিয়েই রক্ষা করেছেন তাদের মধ্যে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানার আটিবাজার-বামনসুর গ্রামের আরিফ দেওয়ান অন্যতম। ২১ আগস্ট ২০২০ তারিখ বিকালে তার সাক্ষাতে গিয়ে জানা যায় যে, তিনি করোনা মহামারীতে লকডাউনে গৃহবন্দি হয়ে অলস সময় কাটাননি, তার বদলে রচনা করেছেন ৩৭৫টি গান। সব গানের বাণীতে সুর-সংযোজনও করেছেন এই সময়ে, কিছু গান নিজে গেয়ে ফেসবুকে ও ইউটিউবে প্রচার করেছেন। তার গানের হস্তলিখিত পা-ুলিপিগুলোতে প্রত্যক্ষ করা যায় যে, তিনি করোনা মহামারীর সময়কে নিয়েও কিছু গান রচনা করেছেন। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায়, আরিফ দেওয়ান করোনা মহামারী বিষয়ক যেসব গান লিখেছেন তা মূলত ৩ ধরনের, যথা :
১. লকডাউনে সাধুসঙ্গকারী ভাবসাধকদের অবস্থা বর্ণনাকারী গান,
২. করোনা মহামারীতে ত্রাণ লুটকারীদের সমালোচনামূলক গান এবং
৩. করোনা মহামারীতে প্রকৃতির রূপান্তর বিষয়ক গান।
বাংলাদেশের পুঁথি-কবিদের অনেকে করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করে পুঁথিকাব্য রচনা করেছেন। মানিকগঞ্জ জেলার বিখ্যাত সুফিসাধক ও পুঁথিকবি সাইদুর রহমান বয়াতী ‘ভাইরাসনামা’ নামে একটি পুঁথিকাব্য রচনা করেছেন, তার পুঁথিতে ইতিহাসের আলোকে বিভিন্ন যুগের মহামারী সংঘটনের কারণ বর্ণনা করা হয়েছে, সেই সঙ্গে পৃথিবীতে করোনা সংঘটনের কারণ ও তা থেকে প্রতিকারের উপায় পয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী ছন্দে তুলে ধরা হয়েছে। সাইদুর রহমান বয়াতী পুঁথিতে বাংলাদেশের লোকসমাজের নানা অসঙ্গতিকে করোনা মহামারীর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে এই পুঁথিটি হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি নিষ্ঠ এক কবির কথন। এই পুঁথির মাধ্যমে তিনি শুধু করোনা মহামারীকে চিহ্নিত করেননি একই সঙ্গে লোকশিক্ষার প্রতি তার নৈতিক সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
করোনা মহামারীতে সাধক কবি, পুঁথিকারদের পাশাপাশি বাংলাদেশের পটচিত্রশিল্পীদের কেউ কেউ নিজেদের ঐতিহ্যবাহী শিল্প সৃষ্টিতে নতুন রূপান্তর সংযোজন করেছেন। এ ক্ষেত্রে মুন্সীগঞ্জ ও নড়াইল জেলার পটচিত্রশিল্পী শম্ভু আচার্য্য ও নিখিলচন্দ্র দাসের কথা উল্লেখ করা যায়। করোনা মহামারীকে বাংলাদেশের গাজীর পটের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শম্ভু আচার্য্য তুলে ধরেছেন তার চিত্রকলার ক্যানভাসে, তিনি ‘করোনা-অসুর বধ’ নামে একটি চিত্র অংকন করেছেন। এই চিত্রে তিনি হিন্দুধর্মীয় মিথের অপদেবতা অসুরের মুখ ও হাত এঁকে তাতে ১২টি তীর বিদ্ধ করেছেন এবং প্রতি তীরের গায়ে করোনা বিধ্বংসী উপাদান ও উপকরণের নাম লিখে দিয়েছেন।
নড়াইল জেলার পটচিত্রশিল্পী নিখিলচন্দ্র দাস অবশ্য পটগানের আদলে তার জড়ানো-পটচিত্রে করোনাকে অংকন করেছেন। এ ক্ষেত্রে করোনাকে রাক্ষুসে এক অপদেবতার ভয়ংকর খোলা মুখচ্ছবি ১২টি চিত্রের ভেতর করোনাকালে মানুষের দুর্দশা ও মৃত্যুর চিত্র অংকন করেছেন। প্রথম চিত্রে তিনি করোনা-রাক্ষসের খোলা মুখের ভেতর অনেকগুলো মৃত মানুষের লাশ এঁকেছেন, এই চিত্র দিয়ে তিনি করোনা মহামারীর বৈশি^ক রূপকে তিনি অংকন করেছেন।
আমাদের আলোচনার বাইরেও বাংলাদেশের অনেক সাধক কবি করোনা মহামারীর সময় ও সংকটকে নিয়ে বহু ধরনের গান লিখেছেন, তাদের মধ্যে আছেন পাবনা জেলার ফকির আবুল হাশেম, বরিশাল জেলার শাহ আলম দেওয়ান, কুষ্টিয়া জেলার শরিফুল শেখ, সিরাজগঞ্জ জেলার গুঞ্জের আলী জীবন, কিশোরগঞ্জ জেলার ইসলাম উদ্দিন কিস্সাদার প্রমুখ। এ ছাড়া অনেকে পালানাট্য, পুঁথি রচনা করেছেন বলে জানা যায়।
ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির নানান দৃষ্টান্ত পর্যবেক্ষণপূর্বক যে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হয়েছে তার ভিত্তিতে এ কথা বলা চলে, কভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাসজনিত মহামারীকালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে নানা ধরনের ঐতিহ্যিক চালচিত্রের রূপ ও রূপান্তর ঘটেছে। এই রূপ-রূপান্তর অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও শিল্পসম্মত। শুধু তাই নয়, সংকট মোকাবিলার মধ্যে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী
সংস্কৃতির চর্চাকারী জনগোষ্ঠী কতটা সৃষ্টিশীল ও সচেতন মানবিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম তার স্বরূপ এই প্রবন্ধে দৃষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি এ দেশীয় ঐতিহ্যের অন্তর্গত শক্তি তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই কভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাসের ধ্বংসাত্মক বাস্তবতার বিপরীতে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির নবরূপান্তরের কাঠামো নতুনভাবে চিহ্নিত হয়েছে, যা ভবিষ্যতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনায় বিশেষ সহায়ক হবে।
সর্বশেষ ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬,৫০,১৫৯ জন এবং জাতিসংখ্যা ৫০। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সালে শেষ হওয়া ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আদিবাসীদের ৪০টি মাতৃভাষা আছে। এর ভেতর কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং এই ১৪টি আদিবাসী মাতৃভাষা বিপন্ন। সাধারণভাবে প্রশ্ন ওঠে এই ৫০ জাতিসত্তার শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে আমরা কতটা জানি? ১৪টি বিপন্ন ভাষার কোনো সাহিত্যকর্ম বা সৃজনশীল শিল্প আমরা সুরক্ষা করেছি কি? ভাষাগুলো হয়তো খুব দ্রুতই নিদারুণভাবে দুনিয়া থেকে নিরুদ্দেশ হবে। একটি দেশ জানতেও পারবে না তার বহু নাগরিকের শিল্পভুবন বিষয়ে। কিন্তু তারপরও তরতর করে আমরা ‘জাতীয় সাহিত্য’ নিয়ে বাহাদুরি করব। দেশের ৫০ জাতিসত্তার প্রায় চল্লিশেরও বেশি মাতৃভাষার শিল্প-সাহিত্যকে অস্বীকৃত রেখে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীন দেশে প্রশ্নহীনভাবে আমরা জারি রেখেছি ‘জাতীয় সাহিত্যের’ ময়দান। ‘জাতীয় সাহিত্যের’ এই একতরফা অধিপতি চেহারা প্রবলভাবে জাত্যাভিমানী এবং ঔপনিবেশিক। এখানে মূলত বাংলায় রচিত-পরিবেশিত শিল্পসাহিত্যের প্রবলতা দেশের বাঙালি ও বাংলা ভাষা ভিন্ন অপরাপর সব জাতিসত্তার সব
মাতৃভাষার সাহিত্যভুবনকে ‘অপর’ ও প্রান্তিক করে রেখেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সুবর্ণরেখায় দাঁড়িয়ে দেশের আদিবাসী শিল্প-সাহিত্য ভুবনের রক্তাক্ত আহাজারি টের পাওয়া জরুরি। দেশের সব নাগরিকের সমস্বীকৃতির বিকাশেই ‘জাতীয় বলয়’ গড়ে ওঠে। কাউকে দাবিয়ে, আড়াল করে, পেছনে ঠেলে, বাহাদুরি করে নয়। মান্দি আখ্যান কিংবা চাকমা উপন্যাস, সাঁওতালি কবিতা বা মণিপুরী পালা, ম্রো গীত বা পাংখোয়াদের ঘুমপাড়ানি ছড়া বাদ দিয়ে ‘জাতীয় সাহিত্য’ হতে পারে না। সেলিম আল দীনের ‘বনপাংশুল’ জাতীয় সাহিত্যের অংশ হলে, মৃত্তিকা চাকমার ‘বান’ও জাতীয় সাহিত্যের অংশ।
মৌখিক ও মুদ্রিত সাহিত্যের এই প্রধান ধারার ভেতর আমরা এখনো আদিবাসী সমাজে মৌখিক সাহিত্যের চলমান টগবগে দুনিয়াকে প্রবলভাবে টের পাই। পাশাপাশি মুদ্রিত সাহিত্য ইতিহাসেও আদিবাসীদের রয়েছে টানটান বহমান অস্তিত্বময়তা। আমরা এও জানি মুদ্রিত সাহিত্যের বলপ্রয়োগ মৌখিক সাহিত্য পাটাতনকে প্রশ্নহীন কায়দায় দুমড়ে মুচড়ে দেয়। আর এই মুদ্রিত সাহিত্যেরই কেবলমাত্র ‘শিল্প সাহিত্য’ হয়ে উঠবার এক স্পষ্ট রাজনৈতিক ইতিহাস ও বলপ্রয়োগ আছে। মালেয়্যা বলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ভেতর একধরনের সামাজিক জুম সহযোগিতা আছে, ম্রোরা যাকে বলেন কুরপাক-কুরছাক। একজনের জুমে সমাজের দশজনে মিলে কাজ করে দেওয়া। আদিবাসীদের সাহিত্যও এভাবেই এক সামাজিক বোঝাপড়া প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এর ঐতিহাসিক ভিত্তি দাঁড় করিয়েছে। পাশাপাশি এই জনপদের যে সাহিত্য মহাবয়ান যা সব জাতির বৈচিত্র্যময় পালক নিয়ে বিরাজিত রয়েছে তা কোনোভাবেই কোনো জাতির প্রান্তিকীকরণের ভেতর দিয়ে আপন ডানা মেলতে পারে না। উপস্থাপনে অধিপতি ঝাঁজ থাকলেও অনেকে এভাবেও বলেছেন, অনেক উন্নত ভাষার সাহিত্যের মতো চাকমাদেরও রয়েছে প্রাচীনতম সাহিত্য কীর্তি। মধ্যযুগের চাকমা সাহিত্যের অপূর্ব সৃষ্টি গোজেনলামা, সাধক শিপচরণ এর লেখক। চাকমাদের লোকসাহিত্য খুবই সমৃদ্ধিশালী। রাধামন-ধনপুদী পালা, চাদিগাং ছারা পালা, কুগীডর বা চরামিত্ত্যু পালা ও নরধন-নরপুদিপালা, তাহ্লিক শাস্ত্র, শাঙেচ ফুলু তারা, ত্রিপুদুরা, মালমতারা, ৫১টি চাকমা ছড়া, আঘরতারা, পুদুম ফুলু তারা, কদম ফুলু তারা, বুদ্ধ ফুলু তারা, সাঙচ ফুলু তারা, রাকেম ফুলু তারা, ছোট কুরুক তারা, বুদ্ধ ফুলু তারা, সাভাদিঝা তারা, জয়মঙ্গল তারা, আনিজা তারা, সানেক ফুলু তারা, সামেং ফুলু তারা, উদাংপারেত তারা, বুজংগ সূত্র, বরতংদা তারা, রাধামন ধনপুদী পালা (ফুল পারা পর্ব), বিদ্যাসুন্দরপুদী, চান্দবী বার মাস, চাকমা মন্ত্র ফি, সৃত্তি পত্তন, স্বর্গপালা, বুদ্ধপালা, বৌদ্ধ রঞ্জিকা, গোজেনলামা, জ্ঞানপ্রদীপ, কলি চদিঝা, বৈদালী, লদি শাস্ত্র, জ্ঞানভেদ, খঞ্জন বচন, বায়ুভেদ, চাকমা দাগকধা, গোরক্ষ বিজয় পুঁথি, নরপুদীলামা, কাজলপতি বারমাসী, আলসি কবিতা, যুত্তপুদীর বারমাসী, দিনফিউ, কামরতœ ও ঝারা এমন বহু অবিস্মরণীয় প্রাচীন সাহিত্যকর্ম আছে চাকমা সমাজে। পাশাপাশি কবি ফিরিংচানসহ চুনীলাল দেওয়ান, সলিল রায়, মুকুন্দ তালুকদার, ডা. ভগদত্ত খীসা, দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা, ফেলাজেয়া চাকমা, বিজয় কেতন চাকমা, সুহৃদ চাকমা, মৃত্তিকা চাকমা, শিশির চাকমা, শ্যামল তালুকদার, কৃষ্ণচন্দ্র চাকমা, সুগত চাকমা ননাধন, বারেন্দ্র লাল চাকমা, কবিতা চাকমা, সুসময় চাকমা, অমর শান্তি চাকমা, তরুণ কুমার চাকমা, বীর কুমার চাকমা, জগৎ জ্যোতি চাকমা, প্রগতি খীসা, সঞ্জীব চাকমা, সীমা দেওয়ান, কিশলয় চাকমা, রোনাল্ড চাকমা, পদ্মলোচন চাকমা, নিকোলাই চাকমা, রিপরিপ চাকমাদের শিল্পভুবন আমাদের পাঠ করা জরুরি। ত্রিপুরা জাতি কেবল ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষাতে নয়, সাহিত্য আন্দোলনে বাংলাকেও করেছে আপনজন। বিষুকে ঘিরে তঞ্চঙ্গ্যাদের রয়েছে সাহিত্যকর্মের বিশাল ভা-ার। মারমা কবিদের ভেতর ক্যশৈপ্র“, উচহ্লা, মংক্যশোয়েনু নেভী, চ থুই ফ্রু, মংসিংঞ্রো কিংবা উশোপ্রু মারমার কবিতা গুরুত্বপূর্ণ। পাংখোয়াদের ভাষায় প্রবাদ প্রবচনকে থৌংপিং, ধাঁধাকে সিং ইনতেন বা সিং মেথ্রেং বলে। তুইচং ও সুয়ানলু সুয়ানলা পাংখোয়াদের ঐতিহ্যময় লোককাহিনী।
উত্তরবঙ্গের মূলত সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, মাহালী, পাহাড়িয়া, বেদিয়া মাহাতো, কুর্মী মাহাতোদের মুদ্রিত সাহিত্যচর্চার কিছু কিছু হদিস আমরা জানতে পারি। রাজবংশী সংগীতের মধ্যে রয়েছে জাগরণী ভাওয়াইয়া, জাগ, গাজন, হুদুমাগান প্রভৃতি। রাজবংশী সমাজে ছেলে ভুলানো ছড়া, খেলার ছড়া, পারিবারিক-সামাজিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছড়া, ঐন্দ্রজালিক-আচার অনুষ্ঠানমূলক ছড়া, ব্যঙ্গ ছড়া প্রভৃতির প্রচলন রয়েছে। ওঁরাও সমাজে বৈদ্যনাথ টপ্য, অরুণ খালকোর মতো লেখক আছেন। ৭৬৮ সালে ধম্মজেয়ার লেখা লেটঅছেং গীতিকাটিও রাখাইন সাহিত্যের অনন্য কীর্তি। উইধুরা, উইমালা, উককব্যেং, পাইঞাবংশ, সোয়েছের মতো দক্ষিণাঞ্চলের রাখাইন সাহিত্যিকরা ১৭ শতকেই নিজ ভাষায় সৃষ্টি করে গেছেন অমর সাহিত্য। চলতি সময়ে উ তান সিয়েন, সাউ তুন ও, উসিট মং, মং থান ওয়ে, ক্যথিংঅং, মংউসাং, উক্যথিন, অংথিংমং, মংছেনচীং (মংছিন), মংহ্লাপ্র“, তাহান, উএনু, অংক্যচিন, উহ্লামং, উবাচং, উসিট মং, মংছালু লেখকেরা বাংলা-ইংরেজি এবং কেউ কেউ রাখাইন ভাষাতেও লেখালেখি করছেন।
ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর এলাকার মান্দি, কোচ, হাজং, বানাই, ডালু, হদি, রাজবংশী, লেঙাম জনগোষ্ঠীদের ভেতর মূলত মান্দি ও হাজংদের ভেতরেই চলতি সময়ে মুদ্রিত সাহিত্যচর্চা বেশি দেখা যাচ্ছে। মান্দিদের দিগ্গিবান্দি ও শেরানজিংপালা মহাকাব্যদ্বয় এখনো রাষ্ট্রের অধিপতি সাহিত্যবিলাস বিবেচনায় আনেনি। নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ থেকে আদিবাসী সমাজের সাহিত্য দর্পণ ঘোষণা করে প্রায় অনিয়মিত ‘জানিরা’ নামে একটি প্রকাশনা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় মূলত কিছু গান, কবিতা, প্রবন্ধ এবং খুবই গতানুগতিক কিছু আলোচনা থাকে। যার কোনো শ্রেণিদার্শনিক এবং যাপিতজীবনের রাজনৈতিক ভিত্তি ও জোর নেই। মান্দিদের ভেতর জেমস জর্নেশ চিরান, মতেন্দ্র মানখিন, সঞ্জীব দ্রং, জেমস ওয়ার্ড খকসী, বচন নকরেক, বাবুল ডি নকরেক, পরাগ রিছিল, রাখী ম্রং, মিঠুন রাখসামদের কবি ও লেখকরা মূলত বাংলা ভাষাতেই নিজস্ব সাহিত্য আওয়াজ তুলেছেন। তবে কবি ব্যঞ্জন মৃ’র ২০১৭ সালে প্রকাশিত মান্দি ও বাংলায় অনূদিত কবিতার বই ময়ূরব্যঞ্জনা এক্ষেত্রে এক নয়া সংযোজন। ডালুদের অধিকাংশ শিল্পচর্চার কোনো লিখিত রূপ না থাকায় এবং সংরক্ষণের অভাবে কালের আবর্তনে সেইসব চর্চা আজ বিলুপ্তপ্রায়। ব্রিটিশবিরোধী গণচেতনামূলক গানগুলোকে হাজংরা টেংলাগাহেন বলেন। হাজংদের সমাজে প্রচলিত অধিকাংশ ছড়া-কবিতা ও গানের কোনো গীতিকার বা সুরকারের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। ছড়াকে হাজংরা হিংলা বলে। ছেলেভুলানো ছড়া, মেয়েলিছড়াসহ খেলার ছড়াগুলোর পাশাপাশি গীতে প্রেম বিরহ প্রকৃতি বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে। ধাঁধাকে হাজংদের ভাষায় হীলুক বলে। পৌষসংক্রান্তির নিশিরাত জাগরণের সময় হাজং ছেলেমেয়েরা যে উপকথাগুলো বলে থাকে তা নিয়ে লেখক শ্রী হাজং নিখিল রায় ‘জোনাকীর আলো’ নামে একটি বই লেখেন। ১৯৮৬ সালে নেত্রকোনার বিরিশিরিতে অবস্থিত উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি বইটি প্রকাশ করে। সিলেটের আদিবাসীদের ভেতর মূলত মৈতৈ মণিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, খাসি, লালেং, মান্দি, হাজং, লেঙাম এবং চা বাগানের বিশাল আদিবাসী বাগানিয়া জনগণ সাহিত্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন ঐতিহাসিকভাবেই। মৈতৈ মণিপুরী ভাষার বিশিষ্ট কবি একে শেরাম (২০০৮) মণিপুরী সাহিত্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ। মনিপুরী সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের চেয়ে প্রাচীন বলে বিবেচিত। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের মণিপুরী থিয়েটার স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে বেশ লড়াকু নাট্যদল। মৈতৈ এবং বিষ্ণুপ্রিয়া উভয় ভাষায় বহু শিল্পজন দেশের সাহিত্যভুবনকে প্রতিদিন জীবন্ত রাখছেন।
আদিবাসী সাহিত্যের বৈভব নিয়ে আলোচনায় আমাদের প্রথমেই বলতে হচ্ছে বাংলাদেশে আমরা আদিবাসীদের ভাষায় কিংবা বাংলা হরফে বা আদিবাসীদের নিজস্ব হরফ এবং ভাষায় মূলত কবিতা চর্চা করতেই দেখি বেশিরভাগ কবি ও লেখককে। গল্প-উপন্যাস খুব একটা দেখা যায় না। তবে আদিবাসীদের ভেতর অনেকেই গবেষণা প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য, স্মৃতিচারণ, আলোচনা লিখে থাকেন। সম্পূর্ণ চাঙমা বর্ণমালা ও ভাষায় দেবাশীষ চাকমার উপন্যাস ফেবো প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে, এটি প্রকাশ করে পোগাদাঙ, এর প্রচ্ছদ করেছেন হাপং ত্রিপুরা মিলন। এছাড়াও কিছু বাংলায় লেখা গল্প এবং উপন্যাস লিখেছেন কেউ কেউ, বেশকিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাটক এবং নাট্যচর্চা অব্যাহত আছে আদিবাসী ভাষায় এবং আদিবাসী এলাকায়। প্রমোদ সিংহ, চন্দ্রজিৎ সিংহ, এইচ. নানাচা, সোহেল হাজং, ত্রিঝিনাদ চাকমা, পিপিকা ত্রিপুরা ও হরেন্দ্রনাথ সিং মিলে ২০০৯ সালে ‘নৃ-তাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মুখপত্র’ হিসেবে কথা নামে একটি ছোট কাগজ প্রকাশ করেন। কথার ভূমিকায় তারা লিখেছেন, বাংলাদেশের নৃ-তাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় সাহিত্য সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্য রয়েছে। তাদের ভাষা সাহিত্য নিয়ে লেখালেখির চর্চা যে সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে চলে আসছিল, তাকে আরও বেগবান করার উদ্দেশ্যেই মূলত ‘কথা’ প্রকাশ করার উদ্যোগ। পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত পত্রপত্রিকা কিংবা গ্রন্থ দেশের অন্যপ্রান্তের কাছে কোনোভাবে এসে পৌঁছায় না, আবার সিলেট কিংবা ময়মনসিংহ অঞ্চলের মণিপুরী ভাষা, আচিক ভাষা কিংবা হাজং ভাষার পত্র-পত্রিকা কিংবা সাহিত্যচর্চার কোনো খবর গিয়ে পৌঁছায় না দেশের অন্য প্রান্তে, আর সিলেট কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাঠকদের কাছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার কবিতা গল্পের সঙ্গে কোনো পরিচয় নেই, অর্থাৎ একই দেশে থেকেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার লেখক পাঠকদের মধ্যে যোগাযোগ নেই একেবারে। তাছাড়া বাংলাদেশের অপরাপর ভাষার যে সমৃদ্ধ সাহিত্য, কাব্যচর্চা কি গদ্যচর্চার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তা মূলধারার অধিকাংশ পাঠকদের কাছে আজও অজানা। আদিবাসীরা বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় পার্বণ ও উৎসব উপলক্ষে যেসব স্মরণিকা, বিশেষ প্রকাশনা, ছোট কাগজ প্রকাশ করে থাকেন তার অধিকাংশের নামেই বিচ্ছুরিত হয় প্রকৃতি ও প্রতিবেশের বহমান ধারা।
ম্রো ভাষায় ওয়াংনিম মানে বাংলাতে মেঘ। বান্দরবানের মং মং সিং-এর সম্পাদনায় ঞা ঊ ক্রে থেকে ওয়াংনিম নামে একটি ছোট কাগজ বের হয়। ওয়াংনিমের ৩য় বর্ষ ১ম সংখ্যার ভূমিকাতে লেখা হয়েছে, সাহিত্যচর্চা হয় না বলে সাহিত্যমনা জন্ম নেয় না। একটি সুশীল সমাজ বিনির্মাণের আশায় ঞা উ ক্রে জন্ম নেয়। নবীন কলমে সৃষ্টি হয়েছিল বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম। পাঠক সমাজে বিপুল আগ্রহ জাগাতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পাঁচটি সংখ্যার পর এটি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যদি আমরা আদিবাসী সাহিত্যের ওপর থেকে এবং সাহিত্যচর্চাকারীদের যাপিত জীবন থেকে রক্ত-বারুদ আর জলপাই বাহাদুরি সরাই তবেই ওয়াংনিম আর বন্ধ হবে না, চলবে আপন ভাষায় সাহিত্যবিকাশ। আর এই দুঃসহ অধিপতি গরাদ সরাতেও চাই গর্জে ওঠা আদিবাসী সাহিত্য, আদিবাসী সাহিত্যের রাজনৈতিক বিপ্লব। আদিবাসীদের ভেতর যারা নিরন্তর সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন তাদের সৃষ্টি আখ্যানের কোনো রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার এখনো নিশ্চিত হয়নি। রাষ্ট্র ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলতে কেবলমাত্র ‘বাংলা ভাষা ও হরফে রচিত’ সাহিত্যকেই বোঝে এবং বোঝায়। রাষ্ট্রের এই অধিপতি মনস্তত্ত্ব বদলানো জরুরি। প্রতি বছর আদিবাসী ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা জানানো উচিত। আদিবাসী জনগণের ভাষা ও সাহিত্য সুরক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য সম্মাননা’ চালু করার মাধ্যমে মুমূর্ষু ভাষার পাশে ন্যায়পরায়ণতার খ্রাম নিয়ে দাঁড়াক রাষ্ট্র। খ্রাম, দামা, মাদল, প্লু বাজুক আদিবাসী জমিন থেকে জুমে, জুম থেকে বাংলা একাডেমি কি জাতীয় সংসদ অবধি। দেশের ৫০ জাতিসত্তার ৪০টি মাতৃভাষার শিল্পসাহিত্যকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে নিয়েই চলুক জাতীয় সাহিত্যের সর্বজনীন রূপান্তর।
বছর দশেক আগে কয়েক মাসের ব্যবধানে আমি দুইটা দৈনিক-নিবন্ধ লিখেছিলাম, চলতি ভাষায় যাকে কলাম বলা হয়ে থাকে। একটার শিরোনাম ছিল ‘চিলতে হাসির গণতন্ত্র’, আরেকটার ‘রসবোধ আর টিটকিরির ফারাকটা সূক্ষ্ম নয়’। আমার রচনা চাইতেন এমন দুইটা পত্রিকার দপ্তরে পাঠানো ছিল লেখা দুটো, এবং তারা প্রকাশ করেছিলেন। দুটো রচনাতেই মুখ্যত তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর, কিছু ক্ষেত্রে তার পারিষদবর্গের আচরণ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলাম। পারিষদবর্গের গুরুতর রদবদল হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর পদে হয়নি। কিন্তু অস্বীকার করব না যে কাছাকাছি বিষয়বস্তু নিয়ে আমি এখন আর রচনা করতে চাইব না। আমি সাব্যস্ত করেছি যে এমনকি দশ বছর আগের সঙ্গে তুলনা করলেও আরও সন্ত্রস্ত হওয়ার অনুশীলন থাকা দরকার। আমি হতেও শুরু করেছি। ফলে একই রকম বিষয়বস্তুতে আমি আজকের রচনাটি করছি না। এটা স্বতন্ত্র বিষয়। তারপরও যাতে কারও সন্দেহ না থাকে সেই লক্ষ্যে ভেঙে বলছি যে, আজকের এই ক্ষুদ্র রচনাটির বিষয়বস্তু রাজনৈতিক ময়দানের গড়গড়া আচরণবিধি। কোনো নির্দিষ্ট পদাধিকারী বা ব্যক্তিকে মাথায় রেখে এই রচনাটি সাধিত নয়। ওভার অ্যান্ড আউট!
বাংলা অঞ্চল রসালো এরকম একটা ঘোষণা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছিলাম বলে আমার মনে পড়ে। ওদিকে, কপালের দোষ, আমার শিশুকালে আমি মোটের ওপর অত্যন্ত গুরুগম্ভীর একটা শিশু ছিলাম। আমার এখনকার উপলব্ধিতে মনে হয়, আমি যে ধরনের গম্ভীর শিশু ছিলাম তাতে বর্তমান আমার পাল্লায় যদি আমি থাকতাম তাহলে পিটানি না দিয়ে আমাকে মানুষ করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। খুব সহজেই শিশু নির্যাতনকারীর আধুনিক পদবাচ্য আমার কপালে জুটত। গম্ভীর ওই আমিশিশুটির পক্ষে বাংলা অঞ্চলের এই বৈশিষ্ট্যকে ঠিক হৃদয়ঙ্গম করা হয়নি কখনো। যখন রসালো বৈশিষ্ট্য চিনতে খানিকটা শুরু করলাম তখন হতভম্ব হয়ে পড়লাম। লক্ষ করলাম যতই না এখানকার রসঘন বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে লোকে বলতে পছন্দ করুন না কেন, বাস্তবে এখানকার কয়েকটা পেশা ও কাজের বর্গ ভয়াবহ গাম্ভীর্যের একেকটা ডিব্বা উঁচু ক্লাসের শিক্ষক, বিপ্লবী ধারার রাজনীতিবিদ, সাধারণভাবেই রাজনীতিবিদ, সংবাদকর্মী ইত্যাদি। তারা বিপ্লবী ধারার রাজনীতি না-করে এলেও, গত বছরগুলোতে রাষ্ট্র ও সরকারের দুই কর্ণধার ব্যক্তিত্বের মধ্যে রসবোধের পরিচয় পেয়ে আমি ভালো মাত্রার উত্তেজনা বোধ করেছিলাম। তবে এত অজস্র যদি কিন্তু আছে এই রসবোধের মধ্যে যে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলাপ না-করা আমার জন্য মঙ্গল হবে।
রসচর্চার মৌলিক কোনো নীতিমালা নেই। কতটা হলে তা রসিকতা, কতটা গেলে তা টিটকিরি তার কোনো পরিমাপযোগ্য জগৎ নেই। আবার টিটকিরি মাত্রই নির্যাতনমূলক কি না, নির্যাতন হয়ে পড়লে তাকেই বুলিং বা গুণ্ডাগিরি বলে আপনি পার পাবেন কি না তার সর্বজনস্বীকৃত গৃহীত কোনো ব্যবস্থা নেই। যেমন, আপনার শুনতে কোনো কথা দিব্যি মনে হতে পারে গুণ্ডামি বা মাস্তানি হচ্ছে। কিন্তু বক্তা বলে বসতে পারেন ‘আমি কি অস্ত্র নিয়ে এসেছি? গুণ্ডামি আমরা করি না, গুণ্ডামি করে এসেছেন আপনারা।’ তিনি তাহলে ন্যূনতম একটা গুণ্ডামির সংজ্ঞা হিসেবে অস্ত্রধারণকে সাব্যস্ত করেছেন; তার সুবিধামতো। কোনো এক কালে তার সঙ্গে ‘অন্যায়’ হয়েছিল এই কারণটাকে দীর্ঘদিন ধরে গুণ্ডাগিরি করার একটা অজুহাত হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত পরিচিত। স্থানীয় রাজনীতি ময়দানে বিস্তর উদাহরণ যেমন, কেন্দ্রস্থ রাজনীতিতে সবচেয়ে শক্তপোক্ত উদাহরণ পাওয়া যাবে। আপাতত, একটা কাল্পনিক স্থানীয় সংলাপের উদাহরণ হতে পারে এরকম: “অমুক সালের নির্বাচনে আপনারা কী করছেন সবাই জানে; আমাদের ইন্দুরের মতো ধইরা ধইরা পিটাইছেন। জনগণ আপনাদের চিনে রেখেছে। নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে করতে দ্যান। আপনাদের গলায় বিলাইয়ের ম্যাঁও করারও সুযোগ পাবেন না। জনগণ পাড়াইয়া আপনাদের জিবলা বাইর কইরা দেবে।” এই পর্যন্ত শুনে কথিত জনগণের যে অংশ সভাতে আছেন তারা যে বিপুল করতালি দেবেন কেবল তাই-ই নয়, বরং এই দৃশ্যকল্পনাতে ব্যাপক রসিকতা আছে বলেও গণ্য করবেন। এই রকমের ভাষামালা যে কোনো পক্ষ যে কোনো প্রতিপক্ষকেই বাংলাদেশে সুলভ।
কিন্তু অন্যের গলায় পাড়া দিয়ে তার রস নিংড়ে নেওয়ার ব্যবস্থাকে রসচর্চা হিসেবে দেখার সুযোগ আছে কীভাবে? আবার রাজনীতির অঙ্গনের ভাষামালাতে রসবোধের অভাব ছোবড়া-ছোবড়া অনুভূতি দিতে বাধ্য। বাংলাদেশের ভাবগম্ভীর বাম আন্দোলনের ভাষামালার দিকে মনোযোগ দিলে রসের অভাবে সবচেয়ে গুরুগম্ভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরও মনভার হতে বাধ্য। একটা সিরিয়াস লক্ষ্য নিয়ে সমাজবদলের আগ্রহতে এই রাজনৈতিক কর্মীদের গড়পড়তা আলাপ-আলোচনাগুলো বেরসিক হতে হতে ভীতিকর পর্যায়ের হয়ে পড়েছে। বিশেষত, শেষের বছরগুলোতে। পক্ষান্তরে, চলতি রসের জায়গায় এদের রাজনৈতিক ভাষামালাতে হাজির হয়েছে গুরুভার সব জার্গন। এমন সব পদ ও প্রত্যয় যা বহুল ব্যবহারে হয় মলিন হয়েছে, নতুবা সেসব পদপ্রত্যয়ের একটা চলতি রূপকল্পনা শ্রোতাদের পক্ষে আন্দাজ করে নেওয়া কঠিন। গভীরভাবে চিন্তা করলে, বিপ্লবী রাজনীতির এরকম হাস্যরসহীন ভাষামালাতে পর্যবসনকে ঐতিহাসিকভাবে ঠাহর করাও কঠিন। বিশেষত, মার্কসবাদীদের সনাতনী তর্কাতর্কিতে যেরকম উচ্চকিত ঠাট্টা-মশকারা এবং খিস্তিখেউড়সুলভ ছিল।
এই পর্যন্ত বলার পর আমার ঘাড়ে এই দায়িত্বটা বর্তায় যে খিস্তিখেউড় ও ঠাট্টা-মশকারার চর্চাকে আমি কীভাবে দেখি তা স্পষ্ট করা। এটা নিশ্চয়ই খুবই না-হক হবে যে আমি কেবল মার্কসবাদীদের খেউড়কে গ্রহণযোগ্য মনে করি, এবং অন্যদেরটা আপত্তি করি। বিষয়টা আমার জন্য এমন নয়। বরং, রসিকতার একটা জগতে প্রচুর আবছায়া বা ধূসর এলাকা আছে যেখানে খিস্তির গুণপনাকে সহজ কিস্তিতে প্রকাশ করা যায়। চর্চাটা ডেলিকেট। এখানে ‘কী বলা হলো’র থেকে ‘কীভাবে বলা হলো’র অসীম গুরুত্ব। সনাতনী মার্কসবাদী রাজনীতির ধ্রুপদী বইপত্রে যেসব খিস্তিধর্মিতা পাওয়া যায় তার সবগুলোর অন্তরঙ্গ গ্রাহক না হলেও, সিংহভাগই আমার কাছে আকর্ষণীয় লাগে এর সঙ্গে মানানসই সব উপাত্তের কারণে। তাহলে ‘কীভাবে বলা হলো’র টোনালিটি আমার জন্য অত্যন্ত জরুরি জিজ্ঞাসা রাজনীতির ময়দান বুঝতে। অন্তত গলায় পাড়া দিয়ে জিহ্বা বের করার ঘোষণার ভেতরে যে রস আছে সেটাকে প্রতিপক্ষের জন্য প্রয়োগ করার ভাষামালা আমার গুণ্ডাগিরিই লাগে, রস বা শ্লেষ নয়। ঠিক একই ভাবে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অসুস্থতাকে তার ‘খাদ্যাভ্যাসে’র সঙ্গে মিলিয়ে কিছু একটা মন্তব্যকে আমার আর রসিক লাগে না। বরং, সৌজন্য-বিবর্জিত এবং সে সূত্রে বুলিং মনে হয়।
রাজনৈতিক ভাষামালার কুৎসিত উদাহরণ সৃষ্টিতে কিছু সাংসদ বা স্থানীয় রাজনীতিবিদ অন্যদের থেকে যোজন দূরে অবস্থান করছেন। সরল করে বললে, তাদের বাক-আবর্জনা সৃষ্টির সামর্থ্য অন্যদের কুণ্ঠিত, বিপর্যস্ত ও অনীহ করে রাখে। এসব রাজনীতিবিদের এই যোগ্যতার চর্চাকে যারা ‘ব্যক্তিগত’ হিসেবে দেখেন, তাদের সঙ্গে আমার ঘোরতর বিরোধ হবে। আমি এগুলোকে ‘ব্যক্তিগত’ হিসেবে দেখি না। বরং জাতীয়/রাষ্ট্রীয় যে রাজনৈতিক কাঠামো বলবৎ আছে সেখানে তাদের এই ভূমিকা গভীরভাবে কাঠামোগত। ধরা যাক, আমরা একটা কাল্পনিক মন্ত্রিসভার কথা বলছি। সেই মন্ত্রিসভাতে যদি ১০ জনকে নেওয়া হয় ‘স্মিতভাষ্য’ ‘মৃদুহাস্য’ ক্যাটেগরি থেকে, সঙ্গে সঙ্গেই আপনি জেনে যান যে মন্ত্রিসভাতে অন্য ২০ জন থাকবেন ‘কইরা হালামু’ ‘মাইরা হালামু’ ভাষাবর্গের। কীভাবে দুই ক্যাটেগরিতে লোক বাছাই হয় তা নিয়ে বিস্তর ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় না, আমার ব্যাখ্যার জন্য এই নিয়োগগুলো থেমে থাকবে কিংবা আমি ব্যাখ্যা না করলে সরকার বা আপনারা কেউ বুঝতে পারবেন না। ফলে ব্যাখ্যাটা আপনারা নিজেরাই তৈরি করতে পারবেন। এখানে মুখ্য বিষয় হলো কাঠামোগত সামঞ্জস্যবিধান। কেন ও কীভাবে স্মিতহাস্যরা মাইরা-হালামুদের জন্য পরিসর প্রদান করেন সেটা বলতে চাইলাম মাত্র।
এটুকু আলাপের পর আমরা যেন মিডিয়া বা প্রচারমাধ্যমকে (আপনারা গণমাধ্যম বলেন, তো বলুন; আমি আপত্তি করব না আপনাদের অধিকারে) এই বিষয়ে খুব দূরে না দেখতে থাকি। বাস্তবে বুলিং বা গুণ্ডাগার্দির ভাষাকে একটা শিথিল মাত্রায় ‘সহনশীল’ করতে মিডিয়ার ভূমিকা মারাত্মক। এটা বোঝা যাবে ‘টক শো’ নামক অনুষ্ঠানমালাতে ইস্যুর উত্থাপন এবং আলোচকদের সন্নিবেশন থেকে। ইস্যু বাছাইয়ে তারা একটা বেনিফিট অব ডাউট পাবেন, যেহেতু প্রায়শই তারা তথাকথিত ‘সমকালীন’ বিষয়কে বাছাই করেন। এখন একটা রাষ্ট্রে নির্দিষ্ট একটা সময়ে নানাবিধ শর্ত ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে কোনটা যে ‘সমকালীন’ তা বাছাইয়ের নানাবিধ কারিগরি ও জারিজুরি থাকতে পারে। আপাতত সেটা নিয়ে বিশদ না করেও বলা চলে, এই ‘সমকালীনতা’ প্রায়শই ওপরতল্লাশিমূলক। তারপর তারা মেহমানদের দলকে এমনভাবে হাজির করেন যাতে একটা উত্তুঙ্গ কাইজা হাতেনাতে শ্রোতারা পেয়ে যান। কাইজার এই ধরনটা টিভি বা অডিওভিজ্যুয়াল প্রডাক্ট হিসেবে মালিকদের কাছে উৎকৃষ্ট। হয়তো এসব কারণেই পত্রিকার পোর্টালগুলোতেও মন্তব্যের ঘরে অসীম গালমন্দের বন্দোবস্ত আছে। অবারিত অভিব্যক্তির যে জোরদার দাবিনামা মধ্যবিত্ত লিবারেল মানুষজন করতে থাকেন, তার আওতার মধ্যে অনায়াসেই এইসব গালাগালি জায়গা করে নিচ্ছে। কেন্দ্রস্থ রাজনীতিবিদরা বুলিং চর্চা করে চলতে পারছেন এই হুলস্থুলের মধ্যেই। এই বেখাপ্পা আনক্রিটিক্যাল ‘গণতন্ত্রের’ জোস পরিশেষে গুণ্ডাগার্দির পরিবেশ সরবরাহ করতে পারছে। সূক্ষ্ম রস আর শ্লেষের রাজনৈতিক ভাষামালা নিয়ে আপাতত আর আশা না করাই বিবেচকের কাজ হবে।
নদীর সঙ্গে আমাদের সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা প্রভৃতির সম্পর্কের কথা তো তোলাই যায়। কিন্তু নদ-নদী আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে কতটা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে, তার একটি মোক্ষম উদাহরণ হতে পারে ‘ভাতে-মাছে বাঙালি’ প্রবাদটি। প্রবাদটিতে যদিও সংখ্যাগুরু বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নির্দেশ করা হয়েছে, প্রকৃত অর্থে বঙ্গীয় ব-দ্বীপের সব জাতি-গোষ্ঠীর জন্যই এটি সত্য। আর কে না জানে যে, সব সংস্কৃতির আদিতম উৎস হচ্ছে খাদ্য সংস্কৃতি। খাদ্যাভ্যাস থেকেই গড়ে উঠে সভ্যতা ও সমাজের বাকি বিষয়াবলি।
এ দেশে ভাত ও মাছ, দুই প্রধান খাদ্যেরই চূড়ান্ত অনুঘটক নদী। এটা ঠিক, বিল বা সাগরেও মৎস্যসম্পদ রয়েছে; কিন্তু এর যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে নদী। মাছের ধর্ম হচ্ছে, প্রজননকালে আবাসভূমি পরিবর্তন। অর্থাৎ বিলের মাছ নদীতে যায়, কিংবা নদীর মাছ বিলে যায়। যেভাবে সাগরের মাছ ইলিশ প্রজননের জন্য নদীতে আসে আর আমরা ভ্রমবশত পদ্মার ইলিশ বা মেঘনার ইলিশ নাম দিই। নদী না থাকলে এই সংযোগসূত্র ছিঁড়ে যেতে বাধ্য। আবার এই ব-দ্বীপে ধানি ভূমির উর্বরতা রক্ষার মূলে রয়েছে নদী-সিঞ্চিত পলল বা তলানিপ্রবাহ। গভীর-অগভীর নলকূপ আসার পর শুকনো মৌসুমের সেচের জন্য নদী যদিও আগের মতো একমাত্র ভরসা নয়; সেই ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্ভরন ও উত্তোলনযোগ্য স্তর রক্ষায় এখনো সচল নদীর বিকল্প নেই।
আবার আমাদের দেশে নদী-সংস্কৃতির যে রূপান্তর ঘটছে, সেটাও একই প্রবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যেমন : দেশের নদ-নদীর সংকট কী, এই প্রশ্নের জবাবে ছয়টি সংকটের নাম মুখস্থই বলা যায় যে প্রবাহস্বল্পতা, ভাঙন, দখল, দূষণ, বালু উত্তোলন, অপরিকল্পিত স্থাপনা। এসব সংকটের কারণ কী? প্রত্যেকটি সংকট ধরে গুচ্ছ গুচ্ছ অভিসন্দর্ভ লেখা সম্ভব; লেখাও হয়নি কম। কিন্তু এক কথায় যদি উত্তর দিতে হয়, নদীর সব সংকট ও ব্যাধির মূলে রয়েছে সাংস্কৃতিক বিমুখতা।
ছয়টি সংকট ও একটি কারণ, নদ-নদী সম্পর্কিত এই সাতটি প্রপঞ্চ আবার দুষ্টচক্রের মতো পরস্পর সম্পর্কিত। যেমন অপরিকল্পিত স্থাপনা থেকে দেখা দেয় প্রবাহস্বল্পতা। প্রবাহস্বল্পতা থাকলেই একটি নদীতে ভাঙন দেখা দেয়, চর পড়ে। চর পড়া এবং ভাঙন দেখা দেওয়া পরস্পর সম্পর্কিত। চর পড়লে ভাঙন অনিবার্য, আর ভাঙন দেখা দিলে চর পড়া অনিবার্য। চর পড়লে সেখানে দখল হয়; কৃষি, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প স্থাপনা হয়। এসব স্থাপনা থেকে আসে দূষণ। ‘উন্নয়ন’ করার প্রশ্নে আসে বালু তোলার প্রশ্ন। আর সবই ঘটে, আগেই বলেছি, সাংস্কৃতিক বিমুখতার কারণে।
প্রশ্ন হতে পারে, সাংস্কৃতিক বিমুখতা শুরু হয়েছে কখন থেকে? যখন বাঙালির ভাত ও মাছের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক ফিকে হতে শুরু করেছে। যখন কৃষিতে নদী-জলাশয়ভিত্তিক সেচের বদলে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন শুরু হয়েছে, তার সঙ্গে আপদ হিসেবে এসেছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। এতে একদিকে যেমন ভাত গুণ ও স্বাদ হারিয়েছে, অন্যদিকে কৃষিজমি ধোয়া রাসায়নিক ও কীটনাশক জলাশয়ে মৎস্যসম্পদ বিনাশ করেছে।
অনেকে প্রশ্ন করেন, দেশের নদীগুলোর নাম এত সুন্দর কেন? সন্ধ্যা, সুগন্ধা, তিতাস, মালঞ্চ, সোনাভরি, সুরমা, কুহেলিয়া কোথায় পেল তাদের নাম? এর মূলে রয়েছে উপযোগিতা। জীবনদায়ী সুপেয় পানি নদী ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যেত না বলেই সবচেয়ে সুন্দর নামটি নদীর জন্যই বরাদ্দ থাকত। শুধু সুপেয় পানি নয়; সেচ, পলল ও মৎস্যসম্পদের কথা আগেই বলেছি, প্রাথমিক যুগে নৌপথই ছিল যাতায়াত ও বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম। আজও গৃহস্থালি ও শিল্প-কারখানার পানি নদী থেকেই আসে। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে চিত্তবিনোদনে নদীর উপযোগিতা। সাংস্কৃতিক বিমুখতার কারণে এসব উপযোগিতা উপেক্ষিত হতে থাকে।
নদীর ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক বিমুখতার একটি প্রতীকী চিত্র দেখা যায় বুড়িগঙ্গা পাড়ে আহসান মঞ্জিল এলাকায় গেলে। নবাবি আমলের ওই স্থাপনা নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। আর আশপাশে পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা বাকি সব স্থাপনা নদীর দিকে পেছন ফিরিয়ে দাঁড়ানো। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, আমরা কীভাবে নদীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি।
আর নদীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নদী বা জলাভূমি দখলের যে মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠে, সেখানে ধরে নেওয়া হয় অবিলম্ব লাভ ও মুনাফাই উত্তম। এটা অনেকটা কৃষকের সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গল্পের মতো। প্রতিদিন একটি করে ডিম পাওয়ার পর লোভী কৃষক ভেবেছে ওই হাঁসের বুক চিড়ে সব সোনার ডিম একদিনে বের করে নেবে। বাস্তবে দেখো যেখানে নাড়িভুঁড়ি ছাড়া কিছু নেই।
আমাদের নদীগুলো এক-একটি সোনার ডিম পাড়া হাঁস। আবহমানকাল থেকে এখানকার ভূমি গঠন করেছে, এখনো করে চলেছে দক্ষিণে; সেই ভূমির সভ্যতা, সমাজ, সংস্কৃতি, যোগাযোগ, খাদ্যাভ্যাস, উৎপাদনব্যবস্থা, যোগাযোগ, এককথায় প্রকৃতি থেকে প্রতিরক্ষা সবই গড়ে তুলেছে। এখন আমরা ভাবছি, নদীর বুক চিড়ে লাখো কোটি বছরের সম্পদ এক দিনে বের করে নেব। কিন্তু তাতে যে শুধু মুখ ব্যাদান করে থাকা দুর্যোগ ছাড়া কিছুই মিলছে না, এরই মধ্যে তা স্পষ্ট।
নদী থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি দিয়ে আরও স্পষ্ট বোঝানো যায়। যেমন নদী থেকে বালু তোলার মাধ্যমে সেটার মৎস্যসম্পদ, জল-কাঠামো নষ্ট করা হয়। আবার সেই বালু দিয়ে দখল ও ভরাট করা হয় অন্য কোনো নদী বা জলাভূমি। আবার নদী ও জলাভূমি দখল করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ব্যক্তিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক ভারসাম্য এবং অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে। তখন তিনি আইন ও সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিপুল বিক্রমে নদী দখল ও দূষণ চালিয়ে যেতে থাকে।
নদী সংস্কৃতি ও তার ব্যবহারিক মূল্য তখন তার বা তাদের কাছে কৌতুকের বিষয় মাত্র।
এদেশের বিপুল জনমণ্ডলীর ভাবলোকে, ধর্মাচারে ও লাইফস্টাইলে সুফি ভাবধারা বা ফকিরি একটি প্রধান পথনির্দেশক। এ অঞ্চলে ইসলাম বিকশিত হয়েছে সুফি দরবেশদের হাত ধরে। সাম্প্রতিককালে নানা বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতায় সুফিবাদকে অনুধাবন ও এটি প্রয়োগের বিবিধ প্রয়াসও অবধান করা যায়।
সুফিবাদ, ফকিরি বা তাসাউফ হলো ইসলাম ধর্মের কাঠামোয় মর্মবাদ তথা আত্মস্বরূপে পৌঁছাবার পথ। অন্যভাবে বললে, এটি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উপায়।
আধুনিক মানুষেরা অনেকেই আল্লাহ-খোদা-ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, কেউ-বা সংশয়বাদী অথবা এ বিষয়ে নিস্পৃহ। এর একটি কারণ, প্রচলিত ধারণায় আল্লাহ নামক কোনো এক সত্তা সাত আসমানের ওপারে বসে মানব ও বিশ্বজগতের অদৃষ্ট নিয়ন্ত্রণের খেলায় মশগুল। অথচ একটি হাদিসে কুদসি-তে বলা হয়েছে : আমি ছিলাম গুপ্ত ভাণ্ডারে নিহিত। আমি চাইলাম নিজেকে প্রকাশ করতে, তাই সবকিছু সৃষ্টি করলাম এবং প্রকাশিত হলাম। এই ধারণা ভারতীয় দর্শনের সঙ্গেও মেলে। স্রষ্টা সৃষ্টির মধ্যেই নিজেকে বিবর্তিত করেছেন ‘সিফাত’ বা গুণরূপে আর তার ‘জাত’ বা মূলসত্তা মানবের অন্তরে অবস্থান করে বিশুদ্ধ স্বরূপ বা পরমাত্মারূপে। সুতরাং জাত ও সিফাত মিলে অর্থাৎ বস্তুবিশ্ব, প্রাণবিশ্ব ও চেতনাবিশ্বের সমবায়ে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে সমগ্রতা, তারই অপর নাম ঈশ্বর-আল্লাহ-খোদা-ভগবান যা-ই বলি না কেন। বৈদিক ঋষিরা সেই কবেই বলে গেছেন : সত্য এক, ঋষিরা তাকে বিভিন্ন নামে ডাকেন।
তবে কি এই বিশ্বজগতের বাইরে খোদা নেই? থাকতে পারে। কিন্তু অতিবর্তী সে ঈশ্বরকে আমরা বিজ্ঞানে পাই না। বিশ্বজগৎ সম্পর্কে এখন অবধি সবচেয়ে অধিক গৃহীত যে মতবাদ, সেই বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুসারে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে এক পরম ক্ষুদ্র বিন্দু, যার নাম এককত্ব বা সিঙ্গুলারিটি তথা তওহিদ, তা থেকে। তার আগে? ‘তার আগে’ বলে কোনো কিছু বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে (এখন পর্যন্ত) নেই, কারণ ত্রিমাত্রিক দেশ ও সময় সৃষ্টি হয়েছে এই বিগ ব্যাং থেকেই : ‘তার আগে’ বলে কিছু থাকবে কেমন করে? কাজেই তার আগে যা আছে, তা অবোধগম্য বুদ্ধি তা জানতে পারে না, কিন্তু মন অনুভব করে যে নিশ্চয়ই তার আগেও ‘একটা কিছু’ আছে।
সে-ই খোদা পরমসত্তারূপে মানুষের ভেতরে বিরাজ করেন। ধর্মশাস্ত্রের সাক্ষ্য : কোরান বলছে, ‘আমি তোমার শাহারগের কাছেই আছি’, ‘আমি তোমার নফসের সঙ্গেই মিশে আছি, তুমি কি দেখছ না’, ‘আমাকে ডাকো, আমি জবাব দেব।’ এবং হাদিস বলছে, ‘মোমিনের হৃদয়ে আল্লাহর আরশ,’ ‘যে নিজেকে চিনেছে, সে প্রভুকে চিনেছে।’ ইত্যাদি।
তবে তার খোঁজ পাই না কেন? কারণ, আমরা নফসে আম্মারার বশীভূত। বোধগম্য অর্থে, নফ্স হচ্ছে প্রবৃত্তি-আবেগ-বুদ্ধিবৃত্তির সমগ্রতার সঙ্গে চেতন-অচেতন-নির্জ্ঞান মনের সঙ্গমিত অবস্থা। আসলে প্রাণই হলো নফ্স। নফ্স তথা জীবাত্মার কেন্দ্রে আছে ‘আমিত্ব’ বা ইগো। এটি সব সময়েই নিজের চাওয়া-পাওয়া স্বার্থ নিয়ে তাড়িত। সুতরাং আকর্ষণমূলক (কাম, লোভ, মোহ, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা...) ও বিকর্ষণমূলক (ক্রোধ, ঘৃণা, ঈর্ষা, দ্বেষ, ভয়...) মানসিক ভাব ও ভাবনাপ্রবাহে নিমজ্জিত থাকে আমাদের মনোজগৎ। এগুলোকে উসকে দেয় আমিত্ব এবং এরাও প্রভাবিত করে আমিত্বকে। এই আমিত্বই ইবলিস শয়তানের কুমন্ত্রণার প্রধান চাঁদমারি।
এই আমিত্বকে ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে চিনে নেওয়ার ও তাকে অতিক্রম করে শুদ্ধ সত্তাকে উদ্ভাসিত করাই সুফির লক্ষ্য।
চেতন-অচেতন-নির্জ্ঞান মনের অবস্থাসমূহকে পর্যবেক্ষণ করে এগুলোর বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হওয়া হলো সুফির আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্য। এই আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তার ‘কাঁচা আমি’ (রবীন্দ্রনাথের ভাষায়) বা ‘ছোট আমি’ (রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাষায়) ক্রমে ‘পাকা আমি’ বা ‘বড় আমি’তে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ সাধক নফসানিয়াতের শৃঙ্খল থেকে রুহানিয়াতের পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হন। তার জীবাত্মা বা নফ্স তখন পরমাত্মা বা রুহের সঙ্গে মিলিত হয়। অর্থাৎ আমিত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত হলেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে অখণ্ড অদ্বৈত রূপ আছে, তা তার মধ্যে উদ্ভাসিত হয়। সেই অদ্বৈত অবস্থায় সে তার সত্তার মধ্যে পরমকে উপলব্ধি করে, আর সাধক তখনই বলে ওঠে, ‘আনাল হক’, অর্থাৎ আমিই পরম সত্য।
এখন বুঝতে হবে, নমরুদও নিজেকে ‘খোদা’ বলে দাবি করেছে, আবার মনসুর হাল্লাজও তা-ই বলেছেন। ব্যাকরণের দিক থেকে দুটো বাক্যই এক ও অভিন্ন। কিন্তু তাৎপর্যের দিক থেকে একজন বলেছে আমিত্বের বাসনায় ক্ষমতার দম্ভে, আর অন্যজন বলেছেন হৃদয়ে পরম সত্তাকে অনুভব করে। সুতরাং আপন আপাতখণ্ডিত সত্তায় তথা অন্তরে পূর্ণসত্তাকে অনুভব করাই একজন সুফির আকাক্সক্ষা। এই অনুভবের মাধ্যমে সে দৈনন্দিন অহংকেন্দ্রিক ভোগলিপ্সার জগৎ থেকে দিব্য, আনন্দময় প্রজ্ঞা ও প্রেমের রাজ্যে অধিবাসী হন।
প্রেমের বিষয়টা কীভাবে এলো? প্রেমকে তো আসতেই হবে। কারণ, সুফির প্রধান অবলম্বনই প্রেম। পরমের জন্য তার আকুতি। যিনি পরমকে লাভ করেছেন, তিনি তো বিমূর্ত পরমের বাস্তব
প্রতিরূপ। এমন একজন মানুষকেই গুরু হিসেবে বরণ করতে হয়। কেন মানতে হবে গুরু? উত্তর পাই রবীন্দ্রনাথে। গুরুদেব লিখেছেন যে একটি হালের অধীনতা স্বীকার না করার অর্থ লাখ লাখ ঢেউয়ের দাসত্ব করা। এই গুরুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয় এবং তার নির্দেশিত সাধন-ভজন করতে হয়; কারণ,
‘সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার
ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার।’
এই প্রেম জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্কের বাইরের বিষয়। এই প্রেমের চর্যার মাধ্যমেই সুফি মানবিকতার উচ্চতর পর্যায়ে আরোহণ করেন, তিনি অসাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠেন, সৌভ্রাতৃত্বের বোধে সিক্ত হন, সর্বজনীন হয়ে ওঠেন।
আমাদের চেতনায়, জীবন-দর্শন নির্ধারণে, ভাবচর্চায় ও জীবনচর্যায় সুফিবাদ ক্রমে-ক্রমে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বিশেষত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি, জঙ্গিপনা এবং অনুষ্ঠানসর্বস্বতার বাইরে ধর্মচর্চার ও শান্তিলাভের উপায় হিসেবে আগামী দিনগুলোতে এই আত্মদর্শনমূলক ভাবধারা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে উঠবে বলে মনে হয়।
উচ্চশিক্ষায় ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে দুই বছর আগে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা। এ বছর তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা গুচ্ছ ভর্তি। স্বাভাবিকভাবেই তিন বছরে অনেকটাই গুছিয়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু তা তো হয়নি, বরং আরও অনেকটা অগোছালো হয়ে উঠেছে। এমনকি গুচ্ছে থাকা বড় দুই বিশ্ববিদ্যালয় এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আর অনেকটা জোর করেই তাদের গুচ্ছে রাখার চেষ্টা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ফলে গুচ্ছ ভর্তি নিয়েই টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জোর করে হয়তো এ বছর ওই দুই বিশ্ববিদ্যালয়কে গুচ্ছে রেখে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এর ফল ভালো হবে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে তাদের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই অনুযায়ীই এগুনো উচিত।
জানা যায়, গত বছরের এইচএসসির ফল প্রায় সাত মাস দেরিতে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ হয়। অথচ এর আগেই তাদের প্রথমবর্ষের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা শেষ করার তাগিদ দিয়েছিল ইউজিসি। ইতিমধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে। কিন্তু গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা দফায় দফায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সঙ্গে বৈঠক করেও সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। এতে শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের সেশনজটে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দুই-একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেসব কারণ দেখিয়ে গুচ্ছ থেকে সরে আসতে চাচ্ছে তা যুক্তিসংগত নয়। আমাদের প্রত্যাশা, তারা গুচ্ছে থাকবেন। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে রাষ্ট্রপতি নিজেই গুচ্ছ ভর্তি শুরু করার তাগিদ দিয়েছিলেন। যারা গুচ্ছে এসেছিলেন তাদের এখন দায়িত্ব হয়ে পড়েছে, এখানে থাকা। আর গুচ্ছে গত দুই বছর যেসব ত্রুটি ছিল, সেসব ইতিমধ্যেই সমাধান করা হয়েছে। ফলে এ বছর অনেকটাই ত্রুটিমুক্ত হবে গুচ্ছ ভর্তি।’
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। সেখানে আলোচনা হয়েছে, নতুন পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে, তাই বলে এখান থেকে পিছু হটার বা বের হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ বছরও গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ই গুচ্ছে থাকছে। তবে আগামী বছর থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইউনিক পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হবে বলে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সভায় গুচ্ছে থাকার আলোচনা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাস্তব চিত্র ভিন্ন। গুচ্ছে থাকা বড় দুই বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোনোভাবেই গুচ্ছে থাকতে চান না। প্রয়োজনে তারা বড় ধরনের আন্দোলনে যেতেও পিছপা হবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আর আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজছে।
সূত্র জানায়, এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন গ্রহণ শুরুর কথা ছিল। আর জুলাইয়ের শেষ নাগাদ যাতে ক্লাস শুরু করা যায় সে ব্যাপারে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ পর্যন্ত গুচ্ছে থাকবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দেওয়ায় এখনো ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু বা চূড়ান্ত পরিকল্পনা করতে পারছে না গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটি।
গত ১৫ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের বিশেষ সভায় নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সে হিসাবে আগামী ২ এপ্রিলের মধ্যে কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটি গঠন ও ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আল্টিমেটাম বেঁধে দিয়ে উপাচার্য বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে শিক্ষকরা আন্দোলন ও কর্মসূচির মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে দাবি আদায় করার ঘোষণা দিয়েছেন।
শিক্ষকরা বলছেন, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের পরও যদি গুচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থাকে তাহলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৫ সালের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। এই অবস্থায় গুচ্ছে থাকতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন সংশোধন করতে হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সব বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে থাকবে সে কথা বলেই আমাদের গুচ্ছে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না আসায় আমরা আমাদের স্বকীয়তাই হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি। আর গুচ্ছে হাজারো ত্রুটি। এতে দীর্ঘসূত্রতা ও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির পাশাপাশি সারা বছর ধরে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। ফলে গুচ্ছে ভালো ছেলেমেয়েরা আসছে না। অনেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নিজস্ব প্রক্রিয়ায় ভর্তি কার্যক্রম শুরু করার জন্য আগামী ২ এপ্রিল পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিয়েছি। এরমধ্যে ফল না এলে আমাদের আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া পথ থাকবে না।’
২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা নিজস্ব পদ্ধতিতে নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শিক্ষক সমিতি। গত ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ১২৫তম অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভায় সর্বসম্মতভাবে গুচ্ছে না যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে সভায় কয়েকটি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, অনতিবিলম্বে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করা, ১ জুলাই নতুন বর্ষের ক্লাস শুরু করা, আবেদনের জন্য ন্যূনতম ফি নির্ধারণ এবং শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে ভর্তি পরীক্ষার পর শুধু ভর্তি হওয়ার জন্যই ক্যাম্পাসে আসবে এবং বাকি কার্যক্রম অনলাইনে সম্পন্ন করতে হবে।
গত ২৮ মার্চ শিক্ষক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভা থেকে আগামী ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটির সভা আহ্বানের জন্য উপাচার্যকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. তপন কুমার জোদ্দার বলেন, ‘অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত এখনো বহাল আছে। ইতিমধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বর্ষের ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সভা আহ্বান করে দ্রুত ভর্তি কার্যক্রম শুরু করার জন্য ভিসি (উপাচার্য) স্যারকে অনুরোধ জানিয়েছি। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের বাইরে আমরা যাব না।’
জানা যায়, সাধারণ ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছের নাম দেওয়া হয়েছে জিএসটি (জেনারেল, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি)। প্রকৌশল গুচ্ছে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি গুচ্ছের আটটি বিশ্ববিদ্যালয়েও আলাদা ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত চার বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর) গুচ্ছ ভর্তিতে আসেনি। এ তালিকায় আছে বিশেষায়িত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
এ ছাড়া বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স), বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটিও আলাদা পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করে থাকে। অ্যাফিলাইটিং বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আলাদাভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করে থাকে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে সাধারণত ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া জিপিএ’র ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।
গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হলেও পরে আলাদা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদের নিজেদের মতো শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। এতে একই শিক্ষার্থীর নাম একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা তালিকায় আসছে। কিন্তু ওই শিক্ষার্থী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ায় অন্যদের ফের মেধা তালিকা প্রকাশ করতে হচ্ছে। এভাবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই পাঁচ-সাতবার মেধা তালিকা প্রকাশের পরও তাদের আসন শূন্য থাকছে। এমনকি গত বছর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ গুচ্ছভুক্ত একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের আসন পূর্ণ করতে পারেনি।
প্রথম আলোর সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসের মুক্তির দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
শুক্রবার বেলা ৩টায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আরিচাগামী সড়ক অবরোধ করা হয়। সোয়া ৩টার দিকে ঢাকাগামী অপর সড়কটিও অবরোধ করা হয়। এর আগে পৌনে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরাদ চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসের নিঃশর্ত মুক্তিসহ তিন দাবি জানান। তাদের অন্য দাবিগুলো হলো শামসুজ্জামান শামস ও প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা প্রত্যাহার এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক আলিফ মাহমুদ বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানে কীভাবে শামস ভাইকে মুক্ত করতে হবে। আমরা তার নিঃশর্ত মুক্তির আগ পর্যন্ত আন্দোলন জারি রাখব। শামস ভাই দিনমজুরের বরাতে যে কথা লিখেছেন, তা এদেশের কোটি কোটি মানুষের মনের কথা। সত্য বললে তার গলা টিপে ধরার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে মুখ চেপে ধরার সাহস করলে আবার একটি গণ-অভ্যুত্থান দেখবে এই দেশ। অনতিবিলম্বে শামস ভাই এর নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে তাকে তার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দিতে হবে, তা নাহলে জাহাঙ্গীরনগরের এই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে।
এদিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধের খবরে সেখানে অবস্থান নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডিসহ প্রশাসনসংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা।
সুপারস্টার শাকিব খানের জন্মদিন ছিল ২৮ মার্চ। বিশেষ দিনটিতে অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীরা শুভেচ্ছায় সিক্ত হন নায়ক। একই সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির সহকর্মীরাও শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান তাকে।
বিশেষ ওই দিনটি ঘরোয়া আয়োজনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উদযাপন করেন তিনি। পরিবারের সদস্য এবং দুই ছেলে আব্রাম খান জয় ও শেহজাদ খান বীরের সঙ্গে কেক কাটেন তিনি। সমাজমাধ্যম ছড়িয়ে আছে সেসব ছবি।
অভিনেতার জন্মদিনে ছেলে বীরকে নিয়ে শাকিবের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে উঠেছিলেন বুবলী। তারই একটি ভিডিও বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টায় ফেসবুক ভেরিফায়েড পেজে পোস্ট করেছেন বুবলী।
নায়িকা ৩৪ সেকেন্ডের ভিডিও প্রকাশ করে ক্যাপশনে লেখেন—'বাবার জন্মদিনে যখন বাবা ছেলের দুষ্ট-মিষ্টি খুনসুটি।' এর পরই জুড়ে দেন একটি রেড হার্ট ইমো।
বুবলীর পোস্ট করা নজরকাড়া ভিডিওটি ইতিমধ্যে প্রায় চার লাখবার দেখা হয়েছে। এ ছাড়া মন্তব্য পড়েছে প্রায় তিন হাজার।
বর্তমান চ্যাম্পিয়ন গুজরাট লায়ন্স ও চারবারের চ্যাম্পিয়ন চেন্নাই সুপার কিংসের ম্যাচ দিয়ে শুক্রবার মাঠে গড়াবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ষোড়শ আসর।
আহমেদাবাদে আইপিএলের উদ্বোধনী ম্যাচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায়। দশ দলকে নিয়ে আট সপ্তাহে ১২টি ভেন্যুতে এবারের আসরের খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হবে। মোট ম্যাচের সংখ্যা ৭৪টি।
গেল বছর আইপিএলে নতুন দুটি দল যুক্ত হয়- গুজরাট ও লখনউ সুপার জায়ান্টস। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই দারুণ ক্রিকেট খেলে তারা। লিগ পর্ব শেষে টেবিলের শীর্ষে ছিল হার্ডিক পান্ডিয়ার নেতৃত্বাধীন গুজরাট। রাজস্থান রয়্যালসের সাথে পয়েন্ট সমান হলেও রান রেটে পিছিয়ে তৃতীয় হয় লখনউ।
কিন্তু টুর্নামেন্টের ফাইনালে ঠিকই জায়গা করে নেয় গুজরাট। ফাইনালে রাজস্থানকে হারিয়ে শিরোপা জিতে গুজরাট। এবারও শিরোপা ধরে রাখার মিশন গুজরাটের। যথারীতি দলকে নেতৃত্ব দিবেন পান্ডিয়া।
টুর্নামেন্ট ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চারবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মহেন্দ্র সিং ধোনির চেন্নাই। ধোনির নেতৃত্বেই রেকর্ড নয়বার ফাইনালে খেলেছে তারা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দুই বছর আগে অবসর নিলেও এখনও আইপিএল খেলছেন ৪১ বছর বয়সী ধোনি। চেন্নাই দলের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে ধোনির উপর। ধরনা করা হচ্ছে এবারের আইপিএল ধোনির ক্যারিয়ারের শেষ আইপিএল।
আইপিএলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পাঁচবার শিরোপা জয়ের রেকর্ডের মালিক মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। গেল বছর টেবিলের তলানিতে থেকে আসর শেষ করে রোহিত শর্মার দল। দ্বিতীয় সফল দল চেন্নাইও ভালো করতে পারেনি। দশ দলের মধ্যে নবম ছিল চেন্নাই। মুম্বাই শেষ করেছিল সবার শেষে থেকে। এবার এই দুই দলের ওপরই আলাদা নজর থাকবে সবার।
আগামী ২৮ মে ফাইনাল দিয়ে পর্দা নামবে আইপিএলের এবারের আসরের।
পবিত্র রমজান মাস যেহেতু প্রতি বছরই আসে, সেজন্য এটা অনেকের জন্য পরীক্ষার বিষয় হয়ে যায়। কারণ যে কাজ বারবার করা হয় তাতে গভীর মনোযোগ ও একনিষ্ঠতা ধরে রাখা এবং ওই কাজের মাধ্যমে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা এবং সওয়াবের প্রত্যাশা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে পড়ে। তখন অনেকেই এ জাতীয় কাজ করেন অভ্যাসবশত। ফলে ওই কাজের গুরুত্ব ও মর্যাদা আর বজায় থাকে না। তার বিনিময়ে আল্লাহতায়ালার যে ওয়াদা সেটা স্মরণ থাকে না। কিংবা সেই ওয়াদার ওপর বিশ্বাস যথাযথভাবে মনে থাকে না। কারণ কোনো কাজ অভ্যাসজাত হয়ে গেলে তা অনেকটা অভ্যাসের তাগিদেই করা হয়। তাতে অন্য কোনো বিষয় খেয়াল করা হয় না। অথচ স্পষ্টভাবে হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ইমান (বিশ্বাস) ও ইহতিসাব (একনিষ্ঠতা)-এর সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার অতীত গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ -সহিহ বোখারি : ৩৮
বর্ণিত হাদিসে ইমান তথা বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সওয়াবের প্রত্যাশা নিয়ে রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে। এখান থেকে খুব খেয়াল করে শিক্ষাগ্রহণ এবং পুরো রমজান মাস সেই শিক্ষা মনে রাখা।
একটু চিন্তা করা দরকার, মানুষ কেন রোজা রাখে? কেন সে পানাহার ত্যাগ করে? প্রচ- গরমেও সে পানি পান করে না! তীব্র ক্ষুধায়ও খাবার খায় না। অথচ সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। চাইলেই সে যে কোনো কিছু গ্রহণ করতে পারে। এমনিভাবে সে আরও অনেক ধরনের কষ্ট করে। অনেক কিছু সয়ে নেয়। এসব কেন করে?
উত্তর পরিষ্কার। আল্লাহতায়ালার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে। তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। তার কাছ থেকে বিনিময় ও সওয়াবের আশায়।
যারা মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান এবং মানবীয় দুর্বলতার খবর রাখেন, তারা জানেন- যখন কোনো বিষয় ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয় এবং নির্ধারিত রুটিনের আওতাভুক্ত হয়, তখন সেটা অনেক সময়ই উদাসীনভাবে পালন করা হয় এবং অবচেতন মনে আদায় করা হয়। রোজা রাখতে হবে, তাই রাখা। রোজা না রাখলে মানুষ মন্দ ভাববে, ঘরের লোক খারাপ বলবে। মানুষের কাছে লজ্জা পেতে হবে, সমালোচনা শুনতে হবে। তাই সে রোজা পালন করে।
আবার অনেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তেই রোজা রাখে কিন্তু তাদের হৃদয় সবসময় জাগ্রত থাকে না। রোজার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাদের স্মরণ থাকে না। অথচ আমলের হিসাব নেওয়া, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি মনোযোগী হওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবুও মানুষ সেদিকে মনোযোগী হয় না। খেয়াল করে না- কেন সে রোজা রাখছে? কেন সে পানাহার ত্যাগ করছে? চাহিদা ও চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা থাকার পরও সে কেন তা থেকে বিরত থাকছে? রোজাপালনের ক্ষেত্রে এমন উদাসীনতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
রোজার যেসব ফজিলত এবং রোজার মাধ্যমে যেসব বিষয় অর্জনের কথা বলা হয়েছে, তার একটি হলো- তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি। সরাসরি কোরআন মাজিদে এই ফজিলতের কথা এসেছে। আর হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, রোজার অসিলায় কামাই-রোজগারে বরকত হয়। মানব হৃদয় আলোকিত হয়। গোনাহ থেকে বাঁচার শক্তি অর্জিত হয়। আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সহজ হয়ে যায়। সর্বোপরি তাতে আল্লাহর নির্দেশ পালন ও নবী কারিম (সা.)-এর অনুসরণ করা হয়।
আমরা পানাহারে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও যখন শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তা পরিত্যাগ করি, তখন প্রতিটি মুহূর্তে সওয়াব হতে থাকে, আমাদের মর্যাদা উঁচু হতে থাকে। কারণ এই ত্যাগ আল্লাহর কাছে খুবই দামি, তাতে আল্লাহ খুব খুশি হন। বান্দা যখন তার হুকুম পালনার্থে এবং তাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে ক্ষুৎপিপাসার কষ্ট সহ্য করছে- এর মর্যাদা তার কাছে অনেক বেশি।
কিন্তু আফসোসের কথা হলো- অধিকাংশ রোজাদারেরই এসব কথা মনে থাকে না। রোজাদারের মর্যাদা, তার জন্য আল্লাহ কী পুরস্কার নির্ধারণ করেছেন, আল্লাহ তাকে কত ভালোবাসেন ইত্যাদি বিষয়ের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ হয় না। অথচ সেটা খুবই জরুরি। আল্লাহর হুকুমের কথা মনে করা, তার সন্তুষ্টি লাভের নিয়ত স্মরণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যখন একটা অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে শুরু হয়, নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় এবং সবাই তাতে অংশগ্রহণ করে তখন কে কী নিয়তে অংশগ্রহণ করে সেটা স্পষ্ট থাকা জরুরি। প্রত্যেকের মূল্যায়ন হবে তার নিয়তের ভিত্তিতে।
রমজানের রোজার ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেন একধরনের বাতাস আসে এবং সেইসঙ্গে একটি মৌসুম আসে। তাতে চারপাশে নতুন আবহ ছড়িয়ে পড়ে। সবাই ওই আবহে প্রভাবিত হয় এবং সে অনুযায়ী আমল শুরু করে। অথচ আসল উদ্দেশ্য ও নিয়তের কথা সবার মনে থাকে না।
জীবনের সব কাজে এই ‘ইমান (বিশ্বাস) ও ইহতিসাব (একনিষ্ঠতা)’ যদি আমাদের অর্জন হয়ে যায়, তাহলে পুরো জীবন আল্লাহর রহমত ও করুণার বারিধারায় স্নাত হবে। এর প্রকৃত ফায়দা দেখা যাবে কেয়ামতের দিন। যখন সবাই আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে, তখন বুঝে আসবে ‘ইমান ও ইহতিসাব’-এর মূল্য। ছোট ছোট এই আমলগুলোও দেখা যাবে- কত বড় আকারে সামনে আসছে! কারও কোনো ছোট্ট একটি কাজ করে দিয়েছিলাম, কারও সঙ্গে একটু হেসে কথা বলেছিলাম, সেগুলোই দেখা যাবে অনেক সওয়াবের মাধ্যম হয়ে গেছে। এটাই রমজান মাসের প্রথম ও সবচেয়ে বড় হাদিয়া। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তের গুণ অর্জন। এটাই জীবনের জন্য বরকতময় এ মাসের বার্তা।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
সন্ধ্যার আকাশে রহস্যময় চাঁদ দেখে আটকে যায় চোখ। চাঁদের নিচে আলোকরেখার মতো ছোট এক বিন্দু। এ নিয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) সন্ধ্যা থেকেই সোশালে মাতামাতি। এ সংক্রান্ত ছবি সমানে শেয়ার করে চলেছে নেটিজেনরা। সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন নানা রকম মন্তব্য।
কেউ কেউ বলছেন, এটি দেখতে ঠিক আরবি হরফ ‘বা’-এর মতো। আবার কেউ কেউ বলছেন, দৃশ্যটির সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে কাজী নজরুল ইসলামের একটি গান মোর ‘প্রিয়া হবে এসো রানী’র। গানে প্রিয়তমার খোঁপায় ‘তারার ফুল’ দেওয়ার কথা বলেছিলেন বিদ্রোহী কবি।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিকসের বরাত দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, বসন্তের আকাশে ধরা পড়া রহস্যময় এই আলোকরেখা আসলে শুক্র গ্রহ। অবশ্য এই মহাজাগতিক দৃশ্য বিরল। সৌরমণ্ডলের উজ্জ্বলতম গ্রহটি শুক্রবার চলে আসে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের কাছাকাছি। নতুন অবস্থানের কারণেই মানুষের কাছে ভিন্নভাবে ধরা দেয় গ্রহটি। তবে সেটি আবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই হারিয়ে যায়।
এদিন সন্ধ্যার পর বাংলাদেশ-ভারতসহ কয়েকটি দেশে আকাশে চাঁদের নিচে আলোকবিন্দুটি দেখা যায়। এ সময় অনেকেই চাঁদ দেখতে ঘর থেকে বের হয়ে যান। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এই বিরল মহাজাগতিক মিলন দেখার উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিকস টেলিস্কোপ ও ক্যামেরা ব্যবহার করে এই মহাজাগতিক ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করে।
সোশালে সাইফুদ্দিন আহমেদ নামে একজন কলেজ শিক্ষক মন্তব্য করেন, ‘এটিই নজরুলের ‘তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল...। কবি তার একটি গানে লিখেছিলেন, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল / কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল ...।’ গতকাল ছিল চৈত্র মাস, চাঁদ আর শুক্রের সম্মিলিত এই মোহনীয় রূপও ছিল ঠিক তৃতীয়া তিথিতে।
তবে শুধু এই কলেজ শিক্ষকই নন, আরও অনেকে চাঁদ ও শুক্র গ্রহের বিরল এবং যৌথ রূপকে কানের দুলের মতো দেখতে বলে মন্তব্য করেছেন।
এর আগে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে চাঁদের সঙ্গে এক সারিতে দেখা গিয়েছিল শুক্র ও সৌরমণ্ডলের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতিকে। এবার চাঁদের নিচে দেখা মিলল শুক্র গ্রহের। চাঁদের নিচে অবস্থানের পাশাপাশি কিছুক্ষণের জন্য চাঁদের আড়ালেও চলে গিয়েছিল গ্রহটি।
মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা বলছে, গত ১ মার্চ থেকেই খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে বৃহস্পতি ও শুক্র গ্রহ। বিভিন্ন দেশে রাতের আকাশেই দেখা মিলছে এ বিরল দৃশ্যের। সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশের দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে বৃহস্পতি ও শুক্র। আকাশে মেঘ না থাকলে কাছাকাছি আসার দৃশ্য খালি চোখেই দেখতে পারছেন যে কেউ।
বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট অ্যাকিউ ওয়েদার বলছে, পৃথিবীর দুই প্রতিবেশী গ্রহ শুক্র ও মঙ্গল একে অপরের সবচেয়ে নিকটে আসতে চলেছে। একই সঙ্গে এক সারিতে দেখা যাবে শুক্র-মঙ্গল ও চাঁদকে। এমন ঘটনাকে ‘প্ল্যানেটরি কনজাংশন’ বলে আখ্যা করেছেন বিজ্ঞানীরা।
আগামী ২৬ মার্চ, মঙ্গল ও শুক্র গ্রহ নিজেদের কক্ষপথ থেকে সবচেয়ে কম দূরত্বে ও একই সারিতে অবস্থান করবে। ওই দিন সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশে দুটি গ্রহ দৃশ্যমান হবে। এর আগে, ২৫ মার্চ রাতে চাঁদের কাছাকাছি আসবে এই দুই প্রতিবেশী গ্রহ, যা মহাকাশ বিজ্ঞানে বেশ বিরল ঘটনা।