
প্রথমেই অন্তত দুটো কথা বলে নেওয়া ভালো। প্রথম কথা এই, জনরুচি কথাটার মধ্যে একটা ব্যাপক সার্বিকতা আছে, যা মর্মের দিক থেকে কোনো বিশেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযোগী নয়। রাষ্ট্র বা জাতি ধারণা মাথায় রেখে আমরা বিপুল মানুষকে এক পাল্লায় স্থাপন করে কথাবার্তা বলি বটে; কিন্তু এর মধ্য দিয়ে আদতে একটা বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো কাজের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। মানুষের মধ্যে শ্রেণি ও অবস্থানগত দিক থেকে শুরু করে বহুবিধ ফারাক থাকে। আর রুচি জিনিসটা ওইসব পার্থক্য দিয়ে এতটাই নিয়ন্ত্রিত হয় যে, কোনো সাধারণ মন্তব্য প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় কথাটা হলো, যোগাযোগ-প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উন্নতির পর থেকে মানুষের বিশ্বজনীন যোগাযোগ আর কল্পনার যে বৈপ্লবিক বদল ঘটেছে, আগের অনেক দশক মিলিয়েও সে ধরনের পরিবর্তন শনাক্ত করা যায় না।
এ দুটো দিক বিবেচনায় রেখে বলা যায়, বাংলাদেশে সত্তর আর আশির দশকে নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজে সুরুচির ধারণাটা পশ্চিমা মেজাজ আর কলকাতায় বিকশিত ‘সংস্কৃতি’র যৌথতায় নির্ধারিত হতো। এর পরিচয় আছে উত্তম-সুচিত্রা ধরনের সিনেমায়, ছায়ানট ধরনের সংগীত-চর্চায়, আর ‘দেশ’ পত্রিকার প্রবল প্রতাপে। তবে এ রুচির চর্চাকারীরা সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না; যদিও চর্চার আভিজাত্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল। নাগরিক মধ্যবিত্তের মধ্যে এ ধরনের রুচির বিস্তারের প্রধান সাক্ষ্য বোধহয় পাওয়া যাবে সিনেমার গানে, যার সঙ্গে ষাট-সত্তরের দশকের কলকাতার ‘আধুনিক বাংলা গানে’র প্রবল সাদৃশ্য পাওয়া যাবে, যদিও বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্বভাবতই এর নানারকম রূপান্তরও ঘটেছিল। রূপান্তরের বড় কারণ সম্ভবত দুটি। একদিকে মুসলমান-প্রধান জনগোষ্ঠীর কাহিনি ও ভাবের বাহন হওয়ায় কিছু পরিবর্তন জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে করতেই হতো। অন্যদিকে গ্রামীণ জনসমাজের সংখ্যাধিক্যের কারণে চিত্রিত জীবনচিত্রে গ্রামের একটা প্রাধান্যও থাকত। বিপুল গ্রামীণ জনগোষ্ঠী প্রাত্যহিক জীবনযাপন ও বিনোদনের জন্য নগরের ওপর প্রধানভাবে নির্ভরশীল না থাকলেও উন্নত বা কাক্সিক্ষত রুচির সরবরাহকারী হিসেবে ঢাকার একক প্রাধান্য আসলে স্বাধীনতার আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
পশ্চিমা সংস্কৃতি ঢাকার জনরুচিতে নতুন রূপ নিয়ে ওপরে কথিত রুচিধারার মধ্যে যে ধরনের রূপান্তর ঘটাচ্ছিল, তা বোঝার জন্য সবচেয়ে ভালো উপকরণ সম্ভবত ব্যান্ড সংগীত। পশ্চিমা পপ মিউজিক, তার কথা, সুর, উপস্থাপনা ও উপভোগের কেতা ঢাকার ব্যান্ড সংগীতে খুব ভালোভাবে আত্মীকৃত হয়েছে; উত্তম ফসল ফলিয়েছে; আর সম্ভবত বিপুল তরুণ-সমাজের জন্য কাঠামোবদ্ধ রুচির নিগড় থেকে মুক্তির একটা বার্তাও নিয়ে এসেছিল। পোশাক এবং খাবারের দিক থেকে বাংলাদেশের জনরুচি গত পাঁচ দশকে সম্ভবত খুব একটা বৈপ্লবিক বদলের মধ্য দিয়ে যায়নি। ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতির বিপুল বিস্তার সত্ত্বেও খাদ্যরুচির প্রধান প্রবাহটা আসলে প্রায় সমরূপই আছে। অন্যদিকে পোশাকের রুচিও আসলে বদলেছে ঠিক ততটাই, যতটা আর্থিক সংস্থানের কারণে বদলাতে পারে। বলার মতো যথেষ্ট কারণ আছে, ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলাদেশের নাগরিক জনরুচি শনাক্তকরণের জন্য সাহিত্য বা অন্য বিনোদন-উপাদানের তুলনায় খাদ্য-সংস্কৃতি ও পোশাক-সংস্কৃতি অধিকতর বিশ্বস্তভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। সত্তর ও আশির দশকের অন্তত মধ্যবিত্ত জনরুচির গ্রাম-শহর নির্বিশেষে– সবচেয়ে ভালো আদল পাওয়া যাবে হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকর্মে।
নব্বইয়ের দশক থেকে নগরায়ণের গতি ও প্রকৃতি দ্রুত বদলাতে থাকে। এর অনিবার্য পরিণতি পশ্চিমায়ন। খুব স্বাভাবিক বাস্তবতার কারণেই বাংলাদেশের অভিজাত রুচির ভূগোলে কলকাতার হিস্যা দ্রুত কমতে থাকে। তার স্থান উচ্চবিত্তের ক্ষেত্রে দখল করতে থাকে ইংরেজিবাহিত খাঁটি আমেরিকান সংস্কৃতি; আর নাগরিক মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে অংশত তার অপভ্রংশ। গ্রামীণ
সাংস্কৃতিক উপাদানের নাগরিক রূপান্তরও এসময় থেকে মধ্যবিত্ত নাগরিক সংস্কৃতিতে বড় জায়গা দখল করতে থাকে। সত্তর-আশির দশকে যোগাযোগহীনতার কারণে গ্রামীণ সংস্কৃতি যতটা স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারত, নব্বইয়ের দশক থেকে তার পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকে। এতে করে একদিকে গ্রামীণ জনপদে নগর-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে, আর নগরেও পুনরুৎপাদিত হতে থাকে গ্রামীণ সংস্কৃতির নানা মাত্রা। এর এক কারণ, গ্রাম থেকে গরিব মানুষের ব্যাপক হারে নগরে আগমন। নগরে লোকসংগীত বা লোকসংস্কৃতির চর্চা আগেও ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে গ্রামীণ জনপদের নানা উপাদান নগরে যেভাবে পুনরুৎপাদিত হয়েছে, তা একেবারেই আলাদা জিনিস। নাগরিক মধ্যবিত্ত রুচিতেও তার ব্যাপক সংক্রমণ ঘটেছে। শিল্পী মমতাজ হয়তো এ বাস্তবতারই তুঙ্গ প্রকাশ।
গত এক-দেড় দশকে দুনিয়ার অন্যান্য গরিব দেশের মতো বাংলাদেশেও জনরুচি ও যাপিত সংস্কৃতির বৈপ্লবিক বদল ঘটেছে নতুন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। এর প্রধান নিয়ামক যোগাযোগ-প্রযুক্তি। কিন্তু আমাদের মতো দেশগুলোতে তার আরেক কারণ আছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে এমন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা হয়তো খুবই কম, যারা নিজেদের সম্ভাব্য ইমিগ্রান্ট হিসেবে কল্পনা করে না। এমতাবস্থায় তাদের ভোগ-উপভোগ এবং কল্পিত রুচির মধ্যে বড় ধরনের বদল ঘটাই স্বাভাবিক। যোগাযোগ-প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সেই কল্পনাকে অন্তত অংশত বাস্তবে পরিণত করে দেখাচ্ছে। যোগাযোগ-প্রযুক্তির অভিভাবকত্বে জনমানুষের সামষ্টিক রুচি ও বোধের যেসব পরিবর্তন ঘটে চলেছে, তার কোনো কাঠামোগত বিশ্লেষণের সময় এখনো আসেনি। কিন্তু এটুকু বলা যায়, গ্রাম ও নগরের ব্যাবধান এদিক থেকে খুব বেশি নয়। আর নাগরিক উচ্চশ্রেণির সাথে মধ্যশ্রেণির ফারাকও কমেছে।
কিন্তু বিনোদন-সংস্কৃতি রুচির একাংশ মাত্র। বাস্তবে সুবিধাপ্রাপ্ত উচ্চশ্রেণিটিই কেবল এই নতুন রুচিকে নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারছে। মধ্যবিত্তের যাপিত জীবন আর কাক্সিক্ষত রুচি ও বোধের টানাপড়েন নিশ্চয়ই আগের চেয়ে বেড়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা হবে গ্রামীণ জনপদের বিপুল মানুষ। তাদের পূর্বতন বোধ ও বিনোদন প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে; কিন্তু নতুন আয়োজনগুলোতে অংশ নেওয়ার বাস্তবতাও নিজেদের জীবনে তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের গ্রাম ও নগরে ওয়াজ-সংস্কৃতির বিপুল বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ কি এই শূন্যতা?
আগেই বলেছি, শ্রেণি বা অন্যবিধ ফারাকের আলাপ মুলতবি রেখে জনরুচির আলাপ অর্থহীন। তারপরেও যদি এ নাম ধরে আলাপ করতেই হয়, তাহলে হয়তো বলা যাবে, বাংলাদেশে এমন জনরুচি চিহ্নিত করা খুব সহজ কাজ নয়। পোশাকে-খাবারে তার প্রবল ছাপ আছে; আছে ফোক আর ব্যান্ড মিউজিকে; আছে কথায়-উচ্চারণভঙ্গিতে-কোলাহলময়তায়। কিন্তু সাহিত্য, সিনেমা ইত্যাদি অপেক্ষাকৃত নির্ণয়যোগ্য কাঠামোর মধ্যে তার প্রতিফলন খুব জুতমতো ঘটেনি। ফলে জনপ্রিয় সংস্কৃতির ইন্ডাস্ট্রিয়াল উৎপাদন-পুনরুৎপাদনে বাংলাদেশ শোচনীয়ভাবে পিছিয়ে আছে। এর পেছনে কাজ করে থাকতে পারে, এমন দুটি অনুমান এখানে হাজির করছি। এক. উনিশ-বিশ শতকের কলকাতার সংস্কৃতির প্রবল প্রতাপের কারণে বাঙালি মুসলমান রুচি ও সংস্কৃতি উপস্থাপিত হওয়াটা খুব চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল। পাকিস্তান আমলে ‘ইসলামি’ সংস্কৃতির রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ‘বাঙালি মুসলমান’ সংস্কৃতি তখন এবং পরেও দীর্ঘমেয়াদি অপরায়ণের শিকার হয়েছে। ফলে আমাদের নাগরিক ও অভিজাত রুচি ও সংস্কৃতি জনজীবনের সঙ্গে তুলনামূলক আলগা সম্পর্ক নিয়ে বিকশিত হয়েছে। দুই. বাংলাদেশে নাগরিক সংস্কৃতি জমে ওঠার আগেই বা প্রাক্কালে গ্লোবালাইজেশনের ধাক্কা এসে লাগে। ফলে নাগরিক মধ্যবিত্তের দুই-তিন প্রজন্ম কখনোই ঢাকায় বড় হারে বসতি করে উঠতে পারেনি। প্রধানত এ ধরনের জনগোষ্ঠীই যে কোনো দেশের রুচির নিয়ন্তা হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে ঘটনা না ঘটায় জনরুচির কোনো কাঠামোগত প্রস্তাব বড় হয়ে সামনে আসতে পারেনি। কলকাতা এবং পশ্চিমই রয়ে গেছে প্রধান রেফারেন্স পয়েন্ট। প্রতিক্রিয়া হিসেবে অপেক্ষাকৃত নন-এলিট জোনে ‘ইসলাম’ও তার শেয়ার দাবি করছে। কিন্তু কোনোটিই জনরুচির ভেতর থেকে যাপিত জীবনের রেফারেন্সে কার্যকর হতে পারছে না।
কিংবা হতে পারে, এই নিরাকার আকারই বাংলাদেশের জনরুচি ও সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সময়, পরিস্থিতি, ব্যক্তি-সমাজের প্রয়োজনে পরিবর্তনশীল। অতীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তন ও সভ্যতার অগ্রগতিতে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি রূপ-রূপান্তরের যে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছিল নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে সেই রূপান্তরের ধারা রক্ষা করেছে। বিশেষ করে কভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে যখন করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ে তখন এ দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে যেমন নবরূপ সৃষ্টি হয়েছে তেমনি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি নিজের ঐতিহ্যকে ভিন্নধারায় রূপান্তর করেছে।
বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের পথ ধরে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে উদ্দীপনা গ্রহণের মাধ্যমে নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক সংকট এবং মনুষ্যসৃষ্ট কিছু দুরবস্থাকে অতিক্রম করেছে। যে কোনো পরিস্থিতিতেই এ দেশের মানুষ অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মোকাবিলা করেছে তেমনি রাজনৈতিক সংকটকে অতিক্রম করেছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হতে উদ্দীপনা নিয়ে। এমনকি মনুষ্যসৃষ্ট দুরবস্থা থেকে নিজের অস্তিত্ব¡ টিকিয়ে রাখতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শক্তিকে আশ্রয় করেছে।
ইতিহাসে জানা যায়, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ রাজনৈতিক দুঃশাসনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের লোককবিরা গান লিখে সুর করে পরিবেশনের মাধ্যমে জনগণের মনে উদ্দীপনা সঞ্চারে ভূমিকা রেখেছিলেন। এ ছাড়া ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে ও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকালে এই দুটি আন্দোলনে লোকসংগীতের শক্তিকে ব্যবহার করে লোকশিল্পীরা সময়ের প্রয়োজনে নতুন গান রচনা করে এবং পরিবেশন ও প্রচার করে দেশের সব সাধারণ এবং সংগ্রামী মানুষের মনে অনুপ্রেরণা ও সাহস সঞ্চার করেছিল।
অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তন ও সভ্যতার অগ্রগতিতে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে রূপ-রূপান্তরের যে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছিল একবিংশ শতকে নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে সেই রূপান্তরের ধারা নতুনভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে কভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণে যখন বাংলাদেশের জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে তখন এ দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে নানা ধরনের সংকট যেমন সৃষ্টি হয় তেমনি তা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে সংস্কৃতিতে নতুন ধরনের আবেগ, প্রতিক্রিয়া ও চেতনা সঞ্চারিত হতে থাকে। এ পর্যায়ে সে ধরনের কিছু ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ৫ এপ্রিল তারিখে কিশোরগঞ্জ জেলার রামায়ণ গানের তরুণ সাধকশিল্পী শংকর দে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষার জন্য জনসচেতনামূলক নিজের লেখা-সুর করা ও গাওয়া একটি গান আমাদের মেসেঞ্জারে ইনবক্স করেন। তিনি তার পরিবেশিত গানটি ভাবনগর ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজ বা ইউটিউবে প্রচার করতে অনুরোধ করেন। আমরা তখন শিল্পীকে বলতে চেয়েছিলাম, ‘এই কাজটি তো আপনি নিজেই আপনার ফেসবুকে প্রচার করতে পারেন।’ কিন্তু শিল্পী শংকর দে জানান, তার ফেসবুক তেমন জনপ্রিয় নয়, তাই গানটি বেশি লোক দেখতে পারবে না, আর ভাবনগরে দিলে সারাদেশের লোক জানতে পারবে, সচেতন হতে পারবে। শিল্পী শংকর দে-র এই কথার ভেতর দিয়ে বোঝা যায়, তিনি অধিক সংখ্যক মানুষকে করোনা সম্পর্কে সচেতন করতে চান।
করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষ শুরু থেকে অনেক গুজবের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের ইসলামি বক্তাদের কেউ কেউ বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকে নানা ধরনের গুজব সৃষ্টি করে ছড়িয়ে দিতে থাকে। এদের মধ্যে মুফতি কাজী ইব্রাহিম অন্যতম, তিনি ২০২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের প্রথম দিকে প্রকাশ্য মহফিলে এবং মসজিদে জুমার নামাজের বয়ানে ইতালির মামুন মারুফের স্বপ্নে দেখা করোনা ভাইরাসের সাক্ষাৎকারের বয়ান করেন। এই বয়ানে তিনি পৃথিবীতে করোনা আগমনের কারণ ও সময় সম্পর্কে উল্লেখ করেন। মুফতি ইব্রাহিমের গুজবের পরপরই ৮ মার্চ ২০২০ তারিখে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করা হয় এবং দ্রুত করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে ২৬ মার্চ ২০২০ তারিখ থেকে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন ঘোষণা করে। এরপর সাধারণ মানুষ গৃহবন্দি হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে করোনা মহামারীর মধ্যে যেসব সাধক কবি ও শিল্পী নিজেদের সৃজনশীলতাকে ঘরে অবস্থান নিয়েই রক্ষা করেছেন তাদের মধ্যে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানার আটিবাজার-বামনসুর গ্রামের আরিফ দেওয়ান অন্যতম। ২১ আগস্ট ২০২০ তারিখ বিকালে তার সাক্ষাতে গিয়ে জানা যায় যে, তিনি করোনা মহামারীতে লকডাউনে গৃহবন্দি হয়ে অলস সময় কাটাননি, তার বদলে রচনা করেছেন ৩৭৫টি গান। সব গানের বাণীতে সুর-সংযোজনও করেছেন এই সময়ে, কিছু গান নিজে গেয়ে ফেসবুকে ও ইউটিউবে প্রচার করেছেন। তার গানের হস্তলিখিত পা-ুলিপিগুলোতে প্রত্যক্ষ করা যায় যে, তিনি করোনা মহামারীর সময়কে নিয়েও কিছু গান রচনা করেছেন। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায়, আরিফ দেওয়ান করোনা মহামারী বিষয়ক যেসব গান লিখেছেন তা মূলত ৩ ধরনের, যথা :
১. লকডাউনে সাধুসঙ্গকারী ভাবসাধকদের অবস্থা বর্ণনাকারী গান,
২. করোনা মহামারীতে ত্রাণ লুটকারীদের সমালোচনামূলক গান এবং
৩. করোনা মহামারীতে প্রকৃতির রূপান্তর বিষয়ক গান।
বাংলাদেশের পুঁথি-কবিদের অনেকে করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করে পুঁথিকাব্য রচনা করেছেন। মানিকগঞ্জ জেলার বিখ্যাত সুফিসাধক ও পুঁথিকবি সাইদুর রহমান বয়াতী ‘ভাইরাসনামা’ নামে একটি পুঁথিকাব্য রচনা করেছেন, তার পুঁথিতে ইতিহাসের আলোকে বিভিন্ন যুগের মহামারী সংঘটনের কারণ বর্ণনা করা হয়েছে, সেই সঙ্গে পৃথিবীতে করোনা সংঘটনের কারণ ও তা থেকে প্রতিকারের উপায় পয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী ছন্দে তুলে ধরা হয়েছে। সাইদুর রহমান বয়াতী পুঁথিতে বাংলাদেশের লোকসমাজের নানা অসঙ্গতিকে করোনা মহামারীর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে এই পুঁথিটি হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি নিষ্ঠ এক কবির কথন। এই পুঁথির মাধ্যমে তিনি শুধু করোনা মহামারীকে চিহ্নিত করেননি একই সঙ্গে লোকশিক্ষার প্রতি তার নৈতিক সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
করোনা মহামারীতে সাধক কবি, পুঁথিকারদের পাশাপাশি বাংলাদেশের পটচিত্রশিল্পীদের কেউ কেউ নিজেদের ঐতিহ্যবাহী শিল্প সৃষ্টিতে নতুন রূপান্তর সংযোজন করেছেন। এ ক্ষেত্রে মুন্সীগঞ্জ ও নড়াইল জেলার পটচিত্রশিল্পী শম্ভু আচার্য্য ও নিখিলচন্দ্র দাসের কথা উল্লেখ করা যায়। করোনা মহামারীকে বাংলাদেশের গাজীর পটের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শম্ভু আচার্য্য তুলে ধরেছেন তার চিত্রকলার ক্যানভাসে, তিনি ‘করোনা-অসুর বধ’ নামে একটি চিত্র অংকন করেছেন। এই চিত্রে তিনি হিন্দুধর্মীয় মিথের অপদেবতা অসুরের মুখ ও হাত এঁকে তাতে ১২টি তীর বিদ্ধ করেছেন এবং প্রতি তীরের গায়ে করোনা বিধ্বংসী উপাদান ও উপকরণের নাম লিখে দিয়েছেন।
নড়াইল জেলার পটচিত্রশিল্পী নিখিলচন্দ্র দাস অবশ্য পটগানের আদলে তার জড়ানো-পটচিত্রে করোনাকে অংকন করেছেন। এ ক্ষেত্রে করোনাকে রাক্ষুসে এক অপদেবতার ভয়ংকর খোলা মুখচ্ছবি ১২টি চিত্রের ভেতর করোনাকালে মানুষের দুর্দশা ও মৃত্যুর চিত্র অংকন করেছেন। প্রথম চিত্রে তিনি করোনা-রাক্ষসের খোলা মুখের ভেতর অনেকগুলো মৃত মানুষের লাশ এঁকেছেন, এই চিত্র দিয়ে তিনি করোনা মহামারীর বৈশি^ক রূপকে তিনি অংকন করেছেন।
আমাদের আলোচনার বাইরেও বাংলাদেশের অনেক সাধক কবি করোনা মহামারীর সময় ও সংকটকে নিয়ে বহু ধরনের গান লিখেছেন, তাদের মধ্যে আছেন পাবনা জেলার ফকির আবুল হাশেম, বরিশাল জেলার শাহ আলম দেওয়ান, কুষ্টিয়া জেলার শরিফুল শেখ, সিরাজগঞ্জ জেলার গুঞ্জের আলী জীবন, কিশোরগঞ্জ জেলার ইসলাম উদ্দিন কিস্সাদার প্রমুখ। এ ছাড়া অনেকে পালানাট্য, পুঁথি রচনা করেছেন বলে জানা যায়।
ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির নানান দৃষ্টান্ত পর্যবেক্ষণপূর্বক যে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হয়েছে তার ভিত্তিতে এ কথা বলা চলে, কভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাসজনিত মহামারীকালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে নানা ধরনের ঐতিহ্যিক চালচিত্রের রূপ ও রূপান্তর ঘটেছে। এই রূপ-রূপান্তর অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও শিল্পসম্মত। শুধু তাই নয়, সংকট মোকাবিলার মধ্যে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী
সংস্কৃতির চর্চাকারী জনগোষ্ঠী কতটা সৃষ্টিশীল ও সচেতন মানবিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম তার স্বরূপ এই প্রবন্ধে দৃষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি এ দেশীয় ঐতিহ্যের অন্তর্গত শক্তি তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই কভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাসের ধ্বংসাত্মক বাস্তবতার বিপরীতে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির নবরূপান্তরের কাঠামো নতুনভাবে চিহ্নিত হয়েছে, যা ভবিষ্যতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনায় বিশেষ সহায়ক হবে।
সর্বশেষ ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬,৫০,১৫৯ জন এবং জাতিসংখ্যা ৫০। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সালে শেষ হওয়া ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আদিবাসীদের ৪০টি মাতৃভাষা আছে। এর ভেতর কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং এই ১৪টি আদিবাসী মাতৃভাষা বিপন্ন। সাধারণভাবে প্রশ্ন ওঠে এই ৫০ জাতিসত্তার শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে আমরা কতটা জানি? ১৪টি বিপন্ন ভাষার কোনো সাহিত্যকর্ম বা সৃজনশীল শিল্প আমরা সুরক্ষা করেছি কি? ভাষাগুলো হয়তো খুব দ্রুতই নিদারুণভাবে দুনিয়া থেকে নিরুদ্দেশ হবে। একটি দেশ জানতেও পারবে না তার বহু নাগরিকের শিল্পভুবন বিষয়ে। কিন্তু তারপরও তরতর করে আমরা ‘জাতীয় সাহিত্য’ নিয়ে বাহাদুরি করব। দেশের ৫০ জাতিসত্তার প্রায় চল্লিশেরও বেশি মাতৃভাষার শিল্প-সাহিত্যকে অস্বীকৃত রেখে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীন দেশে প্রশ্নহীনভাবে আমরা জারি রেখেছি ‘জাতীয় সাহিত্যের’ ময়দান। ‘জাতীয় সাহিত্যের’ এই একতরফা অধিপতি চেহারা প্রবলভাবে জাত্যাভিমানী এবং ঔপনিবেশিক। এখানে মূলত বাংলায় রচিত-পরিবেশিত শিল্পসাহিত্যের প্রবলতা দেশের বাঙালি ও বাংলা ভাষা ভিন্ন অপরাপর সব জাতিসত্তার সব
মাতৃভাষার সাহিত্যভুবনকে ‘অপর’ ও প্রান্তিক করে রেখেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সুবর্ণরেখায় দাঁড়িয়ে দেশের আদিবাসী শিল্প-সাহিত্য ভুবনের রক্তাক্ত আহাজারি টের পাওয়া জরুরি। দেশের সব নাগরিকের সমস্বীকৃতির বিকাশেই ‘জাতীয় বলয়’ গড়ে ওঠে। কাউকে দাবিয়ে, আড়াল করে, পেছনে ঠেলে, বাহাদুরি করে নয়। মান্দি আখ্যান কিংবা চাকমা উপন্যাস, সাঁওতালি কবিতা বা মণিপুরী পালা, ম্রো গীত বা পাংখোয়াদের ঘুমপাড়ানি ছড়া বাদ দিয়ে ‘জাতীয় সাহিত্য’ হতে পারে না। সেলিম আল দীনের ‘বনপাংশুল’ জাতীয় সাহিত্যের অংশ হলে, মৃত্তিকা চাকমার ‘বান’ও জাতীয় সাহিত্যের অংশ।
মৌখিক ও মুদ্রিত সাহিত্যের এই প্রধান ধারার ভেতর আমরা এখনো আদিবাসী সমাজে মৌখিক সাহিত্যের চলমান টগবগে দুনিয়াকে প্রবলভাবে টের পাই। পাশাপাশি মুদ্রিত সাহিত্য ইতিহাসেও আদিবাসীদের রয়েছে টানটান বহমান অস্তিত্বময়তা। আমরা এও জানি মুদ্রিত সাহিত্যের বলপ্রয়োগ মৌখিক সাহিত্য পাটাতনকে প্রশ্নহীন কায়দায় দুমড়ে মুচড়ে দেয়। আর এই মুদ্রিত সাহিত্যেরই কেবলমাত্র ‘শিল্প সাহিত্য’ হয়ে উঠবার এক স্পষ্ট রাজনৈতিক ইতিহাস ও বলপ্রয়োগ আছে। মালেয়্যা বলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ভেতর একধরনের সামাজিক জুম সহযোগিতা আছে, ম্রোরা যাকে বলেন কুরপাক-কুরছাক। একজনের জুমে সমাজের দশজনে মিলে কাজ করে দেওয়া। আদিবাসীদের সাহিত্যও এভাবেই এক সামাজিক বোঝাপড়া প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এর ঐতিহাসিক ভিত্তি দাঁড় করিয়েছে। পাশাপাশি এই জনপদের যে সাহিত্য মহাবয়ান যা সব জাতির বৈচিত্র্যময় পালক নিয়ে বিরাজিত রয়েছে তা কোনোভাবেই কোনো জাতির প্রান্তিকীকরণের ভেতর দিয়ে আপন ডানা মেলতে পারে না। উপস্থাপনে অধিপতি ঝাঁজ থাকলেও অনেকে এভাবেও বলেছেন, অনেক উন্নত ভাষার সাহিত্যের মতো চাকমাদেরও রয়েছে প্রাচীনতম সাহিত্য কীর্তি। মধ্যযুগের চাকমা সাহিত্যের অপূর্ব সৃষ্টি গোজেনলামা, সাধক শিপচরণ এর লেখক। চাকমাদের লোকসাহিত্য খুবই সমৃদ্ধিশালী। রাধামন-ধনপুদী পালা, চাদিগাং ছারা পালা, কুগীডর বা চরামিত্ত্যু পালা ও নরধন-নরপুদিপালা, তাহ্লিক শাস্ত্র, শাঙেচ ফুলু তারা, ত্রিপুদুরা, মালমতারা, ৫১টি চাকমা ছড়া, আঘরতারা, পুদুম ফুলু তারা, কদম ফুলু তারা, বুদ্ধ ফুলু তারা, সাঙচ ফুলু তারা, রাকেম ফুলু তারা, ছোট কুরুক তারা, বুদ্ধ ফুলু তারা, সাভাদিঝা তারা, জয়মঙ্গল তারা, আনিজা তারা, সানেক ফুলু তারা, সামেং ফুলু তারা, উদাংপারেত তারা, বুজংগ সূত্র, বরতংদা তারা, রাধামন ধনপুদী পালা (ফুল পারা পর্ব), বিদ্যাসুন্দরপুদী, চান্দবী বার মাস, চাকমা মন্ত্র ফি, সৃত্তি পত্তন, স্বর্গপালা, বুদ্ধপালা, বৌদ্ধ রঞ্জিকা, গোজেনলামা, জ্ঞানপ্রদীপ, কলি চদিঝা, বৈদালী, লদি শাস্ত্র, জ্ঞানভেদ, খঞ্জন বচন, বায়ুভেদ, চাকমা দাগকধা, গোরক্ষ বিজয় পুঁথি, নরপুদীলামা, কাজলপতি বারমাসী, আলসি কবিতা, যুত্তপুদীর বারমাসী, দিনফিউ, কামরতœ ও ঝারা এমন বহু অবিস্মরণীয় প্রাচীন সাহিত্যকর্ম আছে চাকমা সমাজে। পাশাপাশি কবি ফিরিংচানসহ চুনীলাল দেওয়ান, সলিল রায়, মুকুন্দ তালুকদার, ডা. ভগদত্ত খীসা, দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা, ফেলাজেয়া চাকমা, বিজয় কেতন চাকমা, সুহৃদ চাকমা, মৃত্তিকা চাকমা, শিশির চাকমা, শ্যামল তালুকদার, কৃষ্ণচন্দ্র চাকমা, সুগত চাকমা ননাধন, বারেন্দ্র লাল চাকমা, কবিতা চাকমা, সুসময় চাকমা, অমর শান্তি চাকমা, তরুণ কুমার চাকমা, বীর কুমার চাকমা, জগৎ জ্যোতি চাকমা, প্রগতি খীসা, সঞ্জীব চাকমা, সীমা দেওয়ান, কিশলয় চাকমা, রোনাল্ড চাকমা, পদ্মলোচন চাকমা, নিকোলাই চাকমা, রিপরিপ চাকমাদের শিল্পভুবন আমাদের পাঠ করা জরুরি। ত্রিপুরা জাতি কেবল ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষাতে নয়, সাহিত্য আন্দোলনে বাংলাকেও করেছে আপনজন। বিষুকে ঘিরে তঞ্চঙ্গ্যাদের রয়েছে সাহিত্যকর্মের বিশাল ভা-ার। মারমা কবিদের ভেতর ক্যশৈপ্র“, উচহ্লা, মংক্যশোয়েনু নেভী, চ থুই ফ্রু, মংসিংঞ্রো কিংবা উশোপ্রু মারমার কবিতা গুরুত্বপূর্ণ। পাংখোয়াদের ভাষায় প্রবাদ প্রবচনকে থৌংপিং, ধাঁধাকে সিং ইনতেন বা সিং মেথ্রেং বলে। তুইচং ও সুয়ানলু সুয়ানলা পাংখোয়াদের ঐতিহ্যময় লোককাহিনী।
উত্তরবঙ্গের মূলত সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, মাহালী, পাহাড়িয়া, বেদিয়া মাহাতো, কুর্মী মাহাতোদের মুদ্রিত সাহিত্যচর্চার কিছু কিছু হদিস আমরা জানতে পারি। রাজবংশী সংগীতের মধ্যে রয়েছে জাগরণী ভাওয়াইয়া, জাগ, গাজন, হুদুমাগান প্রভৃতি। রাজবংশী সমাজে ছেলে ভুলানো ছড়া, খেলার ছড়া, পারিবারিক-সামাজিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছড়া, ঐন্দ্রজালিক-আচার অনুষ্ঠানমূলক ছড়া, ব্যঙ্গ ছড়া প্রভৃতির প্রচলন রয়েছে। ওঁরাও সমাজে বৈদ্যনাথ টপ্য, অরুণ খালকোর মতো লেখক আছেন। ৭৬৮ সালে ধম্মজেয়ার লেখা লেটঅছেং গীতিকাটিও রাখাইন সাহিত্যের অনন্য কীর্তি। উইধুরা, উইমালা, উককব্যেং, পাইঞাবংশ, সোয়েছের মতো দক্ষিণাঞ্চলের রাখাইন সাহিত্যিকরা ১৭ শতকেই নিজ ভাষায় সৃষ্টি করে গেছেন অমর সাহিত্য। চলতি সময়ে উ তান সিয়েন, সাউ তুন ও, উসিট মং, মং থান ওয়ে, ক্যথিংঅং, মংউসাং, উক্যথিন, অংথিংমং, মংছেনচীং (মংছিন), মংহ্লাপ্র“, তাহান, উএনু, অংক্যচিন, উহ্লামং, উবাচং, উসিট মং, মংছালু লেখকেরা বাংলা-ইংরেজি এবং কেউ কেউ রাখাইন ভাষাতেও লেখালেখি করছেন।
ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর এলাকার মান্দি, কোচ, হাজং, বানাই, ডালু, হদি, রাজবংশী, লেঙাম জনগোষ্ঠীদের ভেতর মূলত মান্দি ও হাজংদের ভেতরেই চলতি সময়ে মুদ্রিত সাহিত্যচর্চা বেশি দেখা যাচ্ছে। মান্দিদের দিগ্গিবান্দি ও শেরানজিংপালা মহাকাব্যদ্বয় এখনো রাষ্ট্রের অধিপতি সাহিত্যবিলাস বিবেচনায় আনেনি। নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ থেকে আদিবাসী সমাজের সাহিত্য দর্পণ ঘোষণা করে প্রায় অনিয়মিত ‘জানিরা’ নামে একটি প্রকাশনা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় মূলত কিছু গান, কবিতা, প্রবন্ধ এবং খুবই গতানুগতিক কিছু আলোচনা থাকে। যার কোনো শ্রেণিদার্শনিক এবং যাপিতজীবনের রাজনৈতিক ভিত্তি ও জোর নেই। মান্দিদের ভেতর জেমস জর্নেশ চিরান, মতেন্দ্র মানখিন, সঞ্জীব দ্রং, জেমস ওয়ার্ড খকসী, বচন নকরেক, বাবুল ডি নকরেক, পরাগ রিছিল, রাখী ম্রং, মিঠুন রাখসামদের কবি ও লেখকরা মূলত বাংলা ভাষাতেই নিজস্ব সাহিত্য আওয়াজ তুলেছেন। তবে কবি ব্যঞ্জন মৃ’র ২০১৭ সালে প্রকাশিত মান্দি ও বাংলায় অনূদিত কবিতার বই ময়ূরব্যঞ্জনা এক্ষেত্রে এক নয়া সংযোজন। ডালুদের অধিকাংশ শিল্পচর্চার কোনো লিখিত রূপ না থাকায় এবং সংরক্ষণের অভাবে কালের আবর্তনে সেইসব চর্চা আজ বিলুপ্তপ্রায়। ব্রিটিশবিরোধী গণচেতনামূলক গানগুলোকে হাজংরা টেংলাগাহেন বলেন। হাজংদের সমাজে প্রচলিত অধিকাংশ ছড়া-কবিতা ও গানের কোনো গীতিকার বা সুরকারের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। ছড়াকে হাজংরা হিংলা বলে। ছেলেভুলানো ছড়া, মেয়েলিছড়াসহ খেলার ছড়াগুলোর পাশাপাশি গীতে প্রেম বিরহ প্রকৃতি বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে। ধাঁধাকে হাজংদের ভাষায় হীলুক বলে। পৌষসংক্রান্তির নিশিরাত জাগরণের সময় হাজং ছেলেমেয়েরা যে উপকথাগুলো বলে থাকে তা নিয়ে লেখক শ্রী হাজং নিখিল রায় ‘জোনাকীর আলো’ নামে একটি বই লেখেন। ১৯৮৬ সালে নেত্রকোনার বিরিশিরিতে অবস্থিত উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি বইটি প্রকাশ করে। সিলেটের আদিবাসীদের ভেতর মূলত মৈতৈ মণিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, খাসি, লালেং, মান্দি, হাজং, লেঙাম এবং চা বাগানের বিশাল আদিবাসী বাগানিয়া জনগণ সাহিত্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন ঐতিহাসিকভাবেই। মৈতৈ মণিপুরী ভাষার বিশিষ্ট কবি একে শেরাম (২০০৮) মণিপুরী সাহিত্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ। মনিপুরী সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের চেয়ে প্রাচীন বলে বিবেচিত। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের মণিপুরী থিয়েটার স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে বেশ লড়াকু নাট্যদল। মৈতৈ এবং বিষ্ণুপ্রিয়া উভয় ভাষায় বহু শিল্পজন দেশের সাহিত্যভুবনকে প্রতিদিন জীবন্ত রাখছেন।
আদিবাসী সাহিত্যের বৈভব নিয়ে আলোচনায় আমাদের প্রথমেই বলতে হচ্ছে বাংলাদেশে আমরা আদিবাসীদের ভাষায় কিংবা বাংলা হরফে বা আদিবাসীদের নিজস্ব হরফ এবং ভাষায় মূলত কবিতা চর্চা করতেই দেখি বেশিরভাগ কবি ও লেখককে। গল্প-উপন্যাস খুব একটা দেখা যায় না। তবে আদিবাসীদের ভেতর অনেকেই গবেষণা প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য, স্মৃতিচারণ, আলোচনা লিখে থাকেন। সম্পূর্ণ চাঙমা বর্ণমালা ও ভাষায় দেবাশীষ চাকমার উপন্যাস ফেবো প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে, এটি প্রকাশ করে পোগাদাঙ, এর প্রচ্ছদ করেছেন হাপং ত্রিপুরা মিলন। এছাড়াও কিছু বাংলায় লেখা গল্প এবং উপন্যাস লিখেছেন কেউ কেউ, বেশকিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাটক এবং নাট্যচর্চা অব্যাহত আছে আদিবাসী ভাষায় এবং আদিবাসী এলাকায়। প্রমোদ সিংহ, চন্দ্রজিৎ সিংহ, এইচ. নানাচা, সোহেল হাজং, ত্রিঝিনাদ চাকমা, পিপিকা ত্রিপুরা ও হরেন্দ্রনাথ সিং মিলে ২০০৯ সালে ‘নৃ-তাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মুখপত্র’ হিসেবে কথা নামে একটি ছোট কাগজ প্রকাশ করেন। কথার ভূমিকায় তারা লিখেছেন, বাংলাদেশের নৃ-তাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় সাহিত্য সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্য রয়েছে। তাদের ভাষা সাহিত্য নিয়ে লেখালেখির চর্চা যে সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে চলে আসছিল, তাকে আরও বেগবান করার উদ্দেশ্যেই মূলত ‘কথা’ প্রকাশ করার উদ্যোগ। পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত পত্রপত্রিকা কিংবা গ্রন্থ দেশের অন্যপ্রান্তের কাছে কোনোভাবে এসে পৌঁছায় না, আবার সিলেট কিংবা ময়মনসিংহ অঞ্চলের মণিপুরী ভাষা, আচিক ভাষা কিংবা হাজং ভাষার পত্র-পত্রিকা কিংবা সাহিত্যচর্চার কোনো খবর গিয়ে পৌঁছায় না দেশের অন্য প্রান্তে, আর সিলেট কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাঠকদের কাছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার কবিতা গল্পের সঙ্গে কোনো পরিচয় নেই, অর্থাৎ একই দেশে থেকেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার লেখক পাঠকদের মধ্যে যোগাযোগ নেই একেবারে। তাছাড়া বাংলাদেশের অপরাপর ভাষার যে সমৃদ্ধ সাহিত্য, কাব্যচর্চা কি গদ্যচর্চার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তা মূলধারার অধিকাংশ পাঠকদের কাছে আজও অজানা। আদিবাসীরা বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় পার্বণ ও উৎসব উপলক্ষে যেসব স্মরণিকা, বিশেষ প্রকাশনা, ছোট কাগজ প্রকাশ করে থাকেন তার অধিকাংশের নামেই বিচ্ছুরিত হয় প্রকৃতি ও প্রতিবেশের বহমান ধারা।
ম্রো ভাষায় ওয়াংনিম মানে বাংলাতে মেঘ। বান্দরবানের মং মং সিং-এর সম্পাদনায় ঞা ঊ ক্রে থেকে ওয়াংনিম নামে একটি ছোট কাগজ বের হয়। ওয়াংনিমের ৩য় বর্ষ ১ম সংখ্যার ভূমিকাতে লেখা হয়েছে, সাহিত্যচর্চা হয় না বলে সাহিত্যমনা জন্ম নেয় না। একটি সুশীল সমাজ বিনির্মাণের আশায় ঞা উ ক্রে জন্ম নেয়। নবীন কলমে সৃষ্টি হয়েছিল বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম। পাঠক সমাজে বিপুল আগ্রহ জাগাতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পাঁচটি সংখ্যার পর এটি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যদি আমরা আদিবাসী সাহিত্যের ওপর থেকে এবং সাহিত্যচর্চাকারীদের যাপিত জীবন থেকে রক্ত-বারুদ আর জলপাই বাহাদুরি সরাই তবেই ওয়াংনিম আর বন্ধ হবে না, চলবে আপন ভাষায় সাহিত্যবিকাশ। আর এই দুঃসহ অধিপতি গরাদ সরাতেও চাই গর্জে ওঠা আদিবাসী সাহিত্য, আদিবাসী সাহিত্যের রাজনৈতিক বিপ্লব। আদিবাসীদের ভেতর যারা নিরন্তর সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন তাদের সৃষ্টি আখ্যানের কোনো রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার এখনো নিশ্চিত হয়নি। রাষ্ট্র ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলতে কেবলমাত্র ‘বাংলা ভাষা ও হরফে রচিত’ সাহিত্যকেই বোঝে এবং বোঝায়। রাষ্ট্রের এই অধিপতি মনস্তত্ত্ব বদলানো জরুরি। প্রতি বছর আদিবাসী ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা জানানো উচিত। আদিবাসী জনগণের ভাষা ও সাহিত্য সুরক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য সম্মাননা’ চালু করার মাধ্যমে মুমূর্ষু ভাষার পাশে ন্যায়পরায়ণতার খ্রাম নিয়ে দাঁড়াক রাষ্ট্র। খ্রাম, দামা, মাদল, প্লু বাজুক আদিবাসী জমিন থেকে জুমে, জুম থেকে বাংলা একাডেমি কি জাতীয় সংসদ অবধি। দেশের ৫০ জাতিসত্তার ৪০টি মাতৃভাষার শিল্পসাহিত্যকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে নিয়েই চলুক জাতীয় সাহিত্যের সর্বজনীন রূপান্তর।
বছর দশেক আগে কয়েক মাসের ব্যবধানে আমি দুইটা দৈনিক-নিবন্ধ লিখেছিলাম, চলতি ভাষায় যাকে কলাম বলা হয়ে থাকে। একটার শিরোনাম ছিল ‘চিলতে হাসির গণতন্ত্র’, আরেকটার ‘রসবোধ আর টিটকিরির ফারাকটা সূক্ষ্ম নয়’। আমার রচনা চাইতেন এমন দুইটা পত্রিকার দপ্তরে পাঠানো ছিল লেখা দুটো, এবং তারা প্রকাশ করেছিলেন। দুটো রচনাতেই মুখ্যত তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর, কিছু ক্ষেত্রে তার পারিষদবর্গের আচরণ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলাম। পারিষদবর্গের গুরুতর রদবদল হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর পদে হয়নি। কিন্তু অস্বীকার করব না যে কাছাকাছি বিষয়বস্তু নিয়ে আমি এখন আর রচনা করতে চাইব না। আমি সাব্যস্ত করেছি যে এমনকি দশ বছর আগের সঙ্গে তুলনা করলেও আরও সন্ত্রস্ত হওয়ার অনুশীলন থাকা দরকার। আমি হতেও শুরু করেছি। ফলে একই রকম বিষয়বস্তুতে আমি আজকের রচনাটি করছি না। এটা স্বতন্ত্র বিষয়। তারপরও যাতে কারও সন্দেহ না থাকে সেই লক্ষ্যে ভেঙে বলছি যে, আজকের এই ক্ষুদ্র রচনাটির বিষয়বস্তু রাজনৈতিক ময়দানের গড়গড়া আচরণবিধি। কোনো নির্দিষ্ট পদাধিকারী বা ব্যক্তিকে মাথায় রেখে এই রচনাটি সাধিত নয়। ওভার অ্যান্ড আউট!
বাংলা অঞ্চল রসালো এরকম একটা ঘোষণা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছিলাম বলে আমার মনে পড়ে। ওদিকে, কপালের দোষ, আমার শিশুকালে আমি মোটের ওপর অত্যন্ত গুরুগম্ভীর একটা শিশু ছিলাম। আমার এখনকার উপলব্ধিতে মনে হয়, আমি যে ধরনের গম্ভীর শিশু ছিলাম তাতে বর্তমান আমার পাল্লায় যদি আমি থাকতাম তাহলে পিটানি না দিয়ে আমাকে মানুষ করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। খুব সহজেই শিশু নির্যাতনকারীর আধুনিক পদবাচ্য আমার কপালে জুটত। গম্ভীর ওই আমিশিশুটির পক্ষে বাংলা অঞ্চলের এই বৈশিষ্ট্যকে ঠিক হৃদয়ঙ্গম করা হয়নি কখনো। যখন রসালো বৈশিষ্ট্য চিনতে খানিকটা শুরু করলাম তখন হতভম্ব হয়ে পড়লাম। লক্ষ করলাম যতই না এখানকার রসঘন বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে লোকে বলতে পছন্দ করুন না কেন, বাস্তবে এখানকার কয়েকটা পেশা ও কাজের বর্গ ভয়াবহ গাম্ভীর্যের একেকটা ডিব্বা উঁচু ক্লাসের শিক্ষক, বিপ্লবী ধারার রাজনীতিবিদ, সাধারণভাবেই রাজনীতিবিদ, সংবাদকর্মী ইত্যাদি। তারা বিপ্লবী ধারার রাজনীতি না-করে এলেও, গত বছরগুলোতে রাষ্ট্র ও সরকারের দুই কর্ণধার ব্যক্তিত্বের মধ্যে রসবোধের পরিচয় পেয়ে আমি ভালো মাত্রার উত্তেজনা বোধ করেছিলাম। তবে এত অজস্র যদি কিন্তু আছে এই রসবোধের মধ্যে যে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলাপ না-করা আমার জন্য মঙ্গল হবে।
রসচর্চার মৌলিক কোনো নীতিমালা নেই। কতটা হলে তা রসিকতা, কতটা গেলে তা টিটকিরি তার কোনো পরিমাপযোগ্য জগৎ নেই। আবার টিটকিরি মাত্রই নির্যাতনমূলক কি না, নির্যাতন হয়ে পড়লে তাকেই বুলিং বা গুণ্ডাগিরি বলে আপনি পার পাবেন কি না তার সর্বজনস্বীকৃত গৃহীত কোনো ব্যবস্থা নেই। যেমন, আপনার শুনতে কোনো কথা দিব্যি মনে হতে পারে গুণ্ডামি বা মাস্তানি হচ্ছে। কিন্তু বক্তা বলে বসতে পারেন ‘আমি কি অস্ত্র নিয়ে এসেছি? গুণ্ডামি আমরা করি না, গুণ্ডামি করে এসেছেন আপনারা।’ তিনি তাহলে ন্যূনতম একটা গুণ্ডামির সংজ্ঞা হিসেবে অস্ত্রধারণকে সাব্যস্ত করেছেন; তার সুবিধামতো। কোনো এক কালে তার সঙ্গে ‘অন্যায়’ হয়েছিল এই কারণটাকে দীর্ঘদিন ধরে গুণ্ডাগিরি করার একটা অজুহাত হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত পরিচিত। স্থানীয় রাজনীতি ময়দানে বিস্তর উদাহরণ যেমন, কেন্দ্রস্থ রাজনীতিতে সবচেয়ে শক্তপোক্ত উদাহরণ পাওয়া যাবে। আপাতত, একটা কাল্পনিক স্থানীয় সংলাপের উদাহরণ হতে পারে এরকম: “অমুক সালের নির্বাচনে আপনারা কী করছেন সবাই জানে; আমাদের ইন্দুরের মতো ধইরা ধইরা পিটাইছেন। জনগণ আপনাদের চিনে রেখেছে। নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে করতে দ্যান। আপনাদের গলায় বিলাইয়ের ম্যাঁও করারও সুযোগ পাবেন না। জনগণ পাড়াইয়া আপনাদের জিবলা বাইর কইরা দেবে।” এই পর্যন্ত শুনে কথিত জনগণের যে অংশ সভাতে আছেন তারা যে বিপুল করতালি দেবেন কেবল তাই-ই নয়, বরং এই দৃশ্যকল্পনাতে ব্যাপক রসিকতা আছে বলেও গণ্য করবেন। এই রকমের ভাষামালা যে কোনো পক্ষ যে কোনো প্রতিপক্ষকেই বাংলাদেশে সুলভ।
কিন্তু অন্যের গলায় পাড়া দিয়ে তার রস নিংড়ে নেওয়ার ব্যবস্থাকে রসচর্চা হিসেবে দেখার সুযোগ আছে কীভাবে? আবার রাজনীতির অঙ্গনের ভাষামালাতে রসবোধের অভাব ছোবড়া-ছোবড়া অনুভূতি দিতে বাধ্য। বাংলাদেশের ভাবগম্ভীর বাম আন্দোলনের ভাষামালার দিকে মনোযোগ দিলে রসের অভাবে সবচেয়ে গুরুগম্ভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরও মনভার হতে বাধ্য। একটা সিরিয়াস লক্ষ্য নিয়ে সমাজবদলের আগ্রহতে এই রাজনৈতিক কর্মীদের গড়পড়তা আলাপ-আলোচনাগুলো বেরসিক হতে হতে ভীতিকর পর্যায়ের হয়ে পড়েছে। বিশেষত, শেষের বছরগুলোতে। পক্ষান্তরে, চলতি রসের জায়গায় এদের রাজনৈতিক ভাষামালাতে হাজির হয়েছে গুরুভার সব জার্গন। এমন সব পদ ও প্রত্যয় যা বহুল ব্যবহারে হয় মলিন হয়েছে, নতুবা সেসব পদপ্রত্যয়ের একটা চলতি রূপকল্পনা শ্রোতাদের পক্ষে আন্দাজ করে নেওয়া কঠিন। গভীরভাবে চিন্তা করলে, বিপ্লবী রাজনীতির এরকম হাস্যরসহীন ভাষামালাতে পর্যবসনকে ঐতিহাসিকভাবে ঠাহর করাও কঠিন। বিশেষত, মার্কসবাদীদের সনাতনী তর্কাতর্কিতে যেরকম উচ্চকিত ঠাট্টা-মশকারা এবং খিস্তিখেউড়সুলভ ছিল।
এই পর্যন্ত বলার পর আমার ঘাড়ে এই দায়িত্বটা বর্তায় যে খিস্তিখেউড় ও ঠাট্টা-মশকারার চর্চাকে আমি কীভাবে দেখি তা স্পষ্ট করা। এটা নিশ্চয়ই খুবই না-হক হবে যে আমি কেবল মার্কসবাদীদের খেউড়কে গ্রহণযোগ্য মনে করি, এবং অন্যদেরটা আপত্তি করি। বিষয়টা আমার জন্য এমন নয়। বরং, রসিকতার একটা জগতে প্রচুর আবছায়া বা ধূসর এলাকা আছে যেখানে খিস্তির গুণপনাকে সহজ কিস্তিতে প্রকাশ করা যায়। চর্চাটা ডেলিকেট। এখানে ‘কী বলা হলো’র থেকে ‘কীভাবে বলা হলো’র অসীম গুরুত্ব। সনাতনী মার্কসবাদী রাজনীতির ধ্রুপদী বইপত্রে যেসব খিস্তিধর্মিতা পাওয়া যায় তার সবগুলোর অন্তরঙ্গ গ্রাহক না হলেও, সিংহভাগই আমার কাছে আকর্ষণীয় লাগে এর সঙ্গে মানানসই সব উপাত্তের কারণে। তাহলে ‘কীভাবে বলা হলো’র টোনালিটি আমার জন্য অত্যন্ত জরুরি জিজ্ঞাসা রাজনীতির ময়দান বুঝতে। অন্তত গলায় পাড়া দিয়ে জিহ্বা বের করার ঘোষণার ভেতরে যে রস আছে সেটাকে প্রতিপক্ষের জন্য প্রয়োগ করার ভাষামালা আমার গুণ্ডাগিরিই লাগে, রস বা শ্লেষ নয়। ঠিক একই ভাবে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অসুস্থতাকে তার ‘খাদ্যাভ্যাসে’র সঙ্গে মিলিয়ে কিছু একটা মন্তব্যকে আমার আর রসিক লাগে না। বরং, সৌজন্য-বিবর্জিত এবং সে সূত্রে বুলিং মনে হয়।
রাজনৈতিক ভাষামালার কুৎসিত উদাহরণ সৃষ্টিতে কিছু সাংসদ বা স্থানীয় রাজনীতিবিদ অন্যদের থেকে যোজন দূরে অবস্থান করছেন। সরল করে বললে, তাদের বাক-আবর্জনা সৃষ্টির সামর্থ্য অন্যদের কুণ্ঠিত, বিপর্যস্ত ও অনীহ করে রাখে। এসব রাজনীতিবিদের এই যোগ্যতার চর্চাকে যারা ‘ব্যক্তিগত’ হিসেবে দেখেন, তাদের সঙ্গে আমার ঘোরতর বিরোধ হবে। আমি এগুলোকে ‘ব্যক্তিগত’ হিসেবে দেখি না। বরং জাতীয়/রাষ্ট্রীয় যে রাজনৈতিক কাঠামো বলবৎ আছে সেখানে তাদের এই ভূমিকা গভীরভাবে কাঠামোগত। ধরা যাক, আমরা একটা কাল্পনিক মন্ত্রিসভার কথা বলছি। সেই মন্ত্রিসভাতে যদি ১০ জনকে নেওয়া হয় ‘স্মিতভাষ্য’ ‘মৃদুহাস্য’ ক্যাটেগরি থেকে, সঙ্গে সঙ্গেই আপনি জেনে যান যে মন্ত্রিসভাতে অন্য ২০ জন থাকবেন ‘কইরা হালামু’ ‘মাইরা হালামু’ ভাষাবর্গের। কীভাবে দুই ক্যাটেগরিতে লোক বাছাই হয় তা নিয়ে বিস্তর ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় না, আমার ব্যাখ্যার জন্য এই নিয়োগগুলো থেমে থাকবে কিংবা আমি ব্যাখ্যা না করলে সরকার বা আপনারা কেউ বুঝতে পারবেন না। ফলে ব্যাখ্যাটা আপনারা নিজেরাই তৈরি করতে পারবেন। এখানে মুখ্য বিষয় হলো কাঠামোগত সামঞ্জস্যবিধান। কেন ও কীভাবে স্মিতহাস্যরা মাইরা-হালামুদের জন্য পরিসর প্রদান করেন সেটা বলতে চাইলাম মাত্র।
এটুকু আলাপের পর আমরা যেন মিডিয়া বা প্রচারমাধ্যমকে (আপনারা গণমাধ্যম বলেন, তো বলুন; আমি আপত্তি করব না আপনাদের অধিকারে) এই বিষয়ে খুব দূরে না দেখতে থাকি। বাস্তবে বুলিং বা গুণ্ডাগার্দির ভাষাকে একটা শিথিল মাত্রায় ‘সহনশীল’ করতে মিডিয়ার ভূমিকা মারাত্মক। এটা বোঝা যাবে ‘টক শো’ নামক অনুষ্ঠানমালাতে ইস্যুর উত্থাপন এবং আলোচকদের সন্নিবেশন থেকে। ইস্যু বাছাইয়ে তারা একটা বেনিফিট অব ডাউট পাবেন, যেহেতু প্রায়শই তারা তথাকথিত ‘সমকালীন’ বিষয়কে বাছাই করেন। এখন একটা রাষ্ট্রে নির্দিষ্ট একটা সময়ে নানাবিধ শর্ত ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে কোনটা যে ‘সমকালীন’ তা বাছাইয়ের নানাবিধ কারিগরি ও জারিজুরি থাকতে পারে। আপাতত সেটা নিয়ে বিশদ না করেও বলা চলে, এই ‘সমকালীনতা’ প্রায়শই ওপরতল্লাশিমূলক। তারপর তারা মেহমানদের দলকে এমনভাবে হাজির করেন যাতে একটা উত্তুঙ্গ কাইজা হাতেনাতে শ্রোতারা পেয়ে যান। কাইজার এই ধরনটা টিভি বা অডিওভিজ্যুয়াল প্রডাক্ট হিসেবে মালিকদের কাছে উৎকৃষ্ট। হয়তো এসব কারণেই পত্রিকার পোর্টালগুলোতেও মন্তব্যের ঘরে অসীম গালমন্দের বন্দোবস্ত আছে। অবারিত অভিব্যক্তির যে জোরদার দাবিনামা মধ্যবিত্ত লিবারেল মানুষজন করতে থাকেন, তার আওতার মধ্যে অনায়াসেই এইসব গালাগালি জায়গা করে নিচ্ছে। কেন্দ্রস্থ রাজনীতিবিদরা বুলিং চর্চা করে চলতে পারছেন এই হুলস্থুলের মধ্যেই। এই বেখাপ্পা আনক্রিটিক্যাল ‘গণতন্ত্রের’ জোস পরিশেষে গুণ্ডাগার্দির পরিবেশ সরবরাহ করতে পারছে। সূক্ষ্ম রস আর শ্লেষের রাজনৈতিক ভাষামালা নিয়ে আপাতত আর আশা না করাই বিবেচকের কাজ হবে।
নদীর সঙ্গে আমাদের সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা প্রভৃতির সম্পর্কের কথা তো তোলাই যায়। কিন্তু নদ-নদী আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে কতটা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে, তার একটি মোক্ষম উদাহরণ হতে পারে ‘ভাতে-মাছে বাঙালি’ প্রবাদটি। প্রবাদটিতে যদিও সংখ্যাগুরু বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নির্দেশ করা হয়েছে, প্রকৃত অর্থে বঙ্গীয় ব-দ্বীপের সব জাতি-গোষ্ঠীর জন্যই এটি সত্য। আর কে না জানে যে, সব সংস্কৃতির আদিতম উৎস হচ্ছে খাদ্য সংস্কৃতি। খাদ্যাভ্যাস থেকেই গড়ে উঠে সভ্যতা ও সমাজের বাকি বিষয়াবলি।
এ দেশে ভাত ও মাছ, দুই প্রধান খাদ্যেরই চূড়ান্ত অনুঘটক নদী। এটা ঠিক, বিল বা সাগরেও মৎস্যসম্পদ রয়েছে; কিন্তু এর যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে নদী। মাছের ধর্ম হচ্ছে, প্রজননকালে আবাসভূমি পরিবর্তন। অর্থাৎ বিলের মাছ নদীতে যায়, কিংবা নদীর মাছ বিলে যায়। যেভাবে সাগরের মাছ ইলিশ প্রজননের জন্য নদীতে আসে আর আমরা ভ্রমবশত পদ্মার ইলিশ বা মেঘনার ইলিশ নাম দিই। নদী না থাকলে এই সংযোগসূত্র ছিঁড়ে যেতে বাধ্য। আবার এই ব-দ্বীপে ধানি ভূমির উর্বরতা রক্ষার মূলে রয়েছে নদী-সিঞ্চিত পলল বা তলানিপ্রবাহ। গভীর-অগভীর নলকূপ আসার পর শুকনো মৌসুমের সেচের জন্য নদী যদিও আগের মতো একমাত্র ভরসা নয়; সেই ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্ভরন ও উত্তোলনযোগ্য স্তর রক্ষায় এখনো সচল নদীর বিকল্প নেই।
আবার আমাদের দেশে নদী-সংস্কৃতির যে রূপান্তর ঘটছে, সেটাও একই প্রবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যেমন : দেশের নদ-নদীর সংকট কী, এই প্রশ্নের জবাবে ছয়টি সংকটের নাম মুখস্থই বলা যায় যে প্রবাহস্বল্পতা, ভাঙন, দখল, দূষণ, বালু উত্তোলন, অপরিকল্পিত স্থাপনা। এসব সংকটের কারণ কী? প্রত্যেকটি সংকট ধরে গুচ্ছ গুচ্ছ অভিসন্দর্ভ লেখা সম্ভব; লেখাও হয়নি কম। কিন্তু এক কথায় যদি উত্তর দিতে হয়, নদীর সব সংকট ও ব্যাধির মূলে রয়েছে সাংস্কৃতিক বিমুখতা।
ছয়টি সংকট ও একটি কারণ, নদ-নদী সম্পর্কিত এই সাতটি প্রপঞ্চ আবার দুষ্টচক্রের মতো পরস্পর সম্পর্কিত। যেমন অপরিকল্পিত স্থাপনা থেকে দেখা দেয় প্রবাহস্বল্পতা। প্রবাহস্বল্পতা থাকলেই একটি নদীতে ভাঙন দেখা দেয়, চর পড়ে। চর পড়া এবং ভাঙন দেখা দেওয়া পরস্পর সম্পর্কিত। চর পড়লে ভাঙন অনিবার্য, আর ভাঙন দেখা দিলে চর পড়া অনিবার্য। চর পড়লে সেখানে দখল হয়; কৃষি, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প স্থাপনা হয়। এসব স্থাপনা থেকে আসে দূষণ। ‘উন্নয়ন’ করার প্রশ্নে আসে বালু তোলার প্রশ্ন। আর সবই ঘটে, আগেই বলেছি, সাংস্কৃতিক বিমুখতার কারণে।
প্রশ্ন হতে পারে, সাংস্কৃতিক বিমুখতা শুরু হয়েছে কখন থেকে? যখন বাঙালির ভাত ও মাছের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক ফিকে হতে শুরু করেছে। যখন কৃষিতে নদী-জলাশয়ভিত্তিক সেচের বদলে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন শুরু হয়েছে, তার সঙ্গে আপদ হিসেবে এসেছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। এতে একদিকে যেমন ভাত গুণ ও স্বাদ হারিয়েছে, অন্যদিকে কৃষিজমি ধোয়া রাসায়নিক ও কীটনাশক জলাশয়ে মৎস্যসম্পদ বিনাশ করেছে।
অনেকে প্রশ্ন করেন, দেশের নদীগুলোর নাম এত সুন্দর কেন? সন্ধ্যা, সুগন্ধা, তিতাস, মালঞ্চ, সোনাভরি, সুরমা, কুহেলিয়া কোথায় পেল তাদের নাম? এর মূলে রয়েছে উপযোগিতা। জীবনদায়ী সুপেয় পানি নদী ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যেত না বলেই সবচেয়ে সুন্দর নামটি নদীর জন্যই বরাদ্দ থাকত। শুধু সুপেয় পানি নয়; সেচ, পলল ও মৎস্যসম্পদের কথা আগেই বলেছি, প্রাথমিক যুগে নৌপথই ছিল যাতায়াত ও বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম। আজও গৃহস্থালি ও শিল্প-কারখানার পানি নদী থেকেই আসে। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে চিত্তবিনোদনে নদীর উপযোগিতা। সাংস্কৃতিক বিমুখতার কারণে এসব উপযোগিতা উপেক্ষিত হতে থাকে।
নদীর ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক বিমুখতার একটি প্রতীকী চিত্র দেখা যায় বুড়িগঙ্গা পাড়ে আহসান মঞ্জিল এলাকায় গেলে। নবাবি আমলের ওই স্থাপনা নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। আর আশপাশে পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা বাকি সব স্থাপনা নদীর দিকে পেছন ফিরিয়ে দাঁড়ানো। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, আমরা কীভাবে নদীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি।
আর নদীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নদী বা জলাভূমি দখলের যে মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠে, সেখানে ধরে নেওয়া হয় অবিলম্ব লাভ ও মুনাফাই উত্তম। এটা অনেকটা কৃষকের সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গল্পের মতো। প্রতিদিন একটি করে ডিম পাওয়ার পর লোভী কৃষক ভেবেছে ওই হাঁসের বুক চিড়ে সব সোনার ডিম একদিনে বের করে নেবে। বাস্তবে দেখো যেখানে নাড়িভুঁড়ি ছাড়া কিছু নেই।
আমাদের নদীগুলো এক-একটি সোনার ডিম পাড়া হাঁস। আবহমানকাল থেকে এখানকার ভূমি গঠন করেছে, এখনো করে চলেছে দক্ষিণে; সেই ভূমির সভ্যতা, সমাজ, সংস্কৃতি, যোগাযোগ, খাদ্যাভ্যাস, উৎপাদনব্যবস্থা, যোগাযোগ, এককথায় প্রকৃতি থেকে প্রতিরক্ষা সবই গড়ে তুলেছে। এখন আমরা ভাবছি, নদীর বুক চিড়ে লাখো কোটি বছরের সম্পদ এক দিনে বের করে নেব। কিন্তু তাতে যে শুধু মুখ ব্যাদান করে থাকা দুর্যোগ ছাড়া কিছুই মিলছে না, এরই মধ্যে তা স্পষ্ট।
নদী থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি দিয়ে আরও স্পষ্ট বোঝানো যায়। যেমন নদী থেকে বালু তোলার মাধ্যমে সেটার মৎস্যসম্পদ, জল-কাঠামো নষ্ট করা হয়। আবার সেই বালু দিয়ে দখল ও ভরাট করা হয় অন্য কোনো নদী বা জলাভূমি। আবার নদী ও জলাভূমি দখল করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ব্যক্তিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক ভারসাম্য এবং অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে। তখন তিনি আইন ও সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিপুল বিক্রমে নদী দখল ও দূষণ চালিয়ে যেতে থাকে।
নদী সংস্কৃতি ও তার ব্যবহারিক মূল্য তখন তার বা তাদের কাছে কৌতুকের বিষয় মাত্র।
এদেশের বিপুল জনমণ্ডলীর ভাবলোকে, ধর্মাচারে ও লাইফস্টাইলে সুফি ভাবধারা বা ফকিরি একটি প্রধান পথনির্দেশক। এ অঞ্চলে ইসলাম বিকশিত হয়েছে সুফি দরবেশদের হাত ধরে। সাম্প্রতিককালে নানা বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতায় সুফিবাদকে অনুধাবন ও এটি প্রয়োগের বিবিধ প্রয়াসও অবধান করা যায়।
সুফিবাদ, ফকিরি বা তাসাউফ হলো ইসলাম ধর্মের কাঠামোয় মর্মবাদ তথা আত্মস্বরূপে পৌঁছাবার পথ। অন্যভাবে বললে, এটি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উপায়।
আধুনিক মানুষেরা অনেকেই আল্লাহ-খোদা-ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, কেউ-বা সংশয়বাদী অথবা এ বিষয়ে নিস্পৃহ। এর একটি কারণ, প্রচলিত ধারণায় আল্লাহ নামক কোনো এক সত্তা সাত আসমানের ওপারে বসে মানব ও বিশ্বজগতের অদৃষ্ট নিয়ন্ত্রণের খেলায় মশগুল। অথচ একটি হাদিসে কুদসি-তে বলা হয়েছে : আমি ছিলাম গুপ্ত ভাণ্ডারে নিহিত। আমি চাইলাম নিজেকে প্রকাশ করতে, তাই সবকিছু সৃষ্টি করলাম এবং প্রকাশিত হলাম। এই ধারণা ভারতীয় দর্শনের সঙ্গেও মেলে। স্রষ্টা সৃষ্টির মধ্যেই নিজেকে বিবর্তিত করেছেন ‘সিফাত’ বা গুণরূপে আর তার ‘জাত’ বা মূলসত্তা মানবের অন্তরে অবস্থান করে বিশুদ্ধ স্বরূপ বা পরমাত্মারূপে। সুতরাং জাত ও সিফাত মিলে অর্থাৎ বস্তুবিশ্ব, প্রাণবিশ্ব ও চেতনাবিশ্বের সমবায়ে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে সমগ্রতা, তারই অপর নাম ঈশ্বর-আল্লাহ-খোদা-ভগবান যা-ই বলি না কেন। বৈদিক ঋষিরা সেই কবেই বলে গেছেন : সত্য এক, ঋষিরা তাকে বিভিন্ন নামে ডাকেন।
তবে কি এই বিশ্বজগতের বাইরে খোদা নেই? থাকতে পারে। কিন্তু অতিবর্তী সে ঈশ্বরকে আমরা বিজ্ঞানে পাই না। বিশ্বজগৎ সম্পর্কে এখন অবধি সবচেয়ে অধিক গৃহীত যে মতবাদ, সেই বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুসারে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে এক পরম ক্ষুদ্র বিন্দু, যার নাম এককত্ব বা সিঙ্গুলারিটি তথা তওহিদ, তা থেকে। তার আগে? ‘তার আগে’ বলে কোনো কিছু বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে (এখন পর্যন্ত) নেই, কারণ ত্রিমাত্রিক দেশ ও সময় সৃষ্টি হয়েছে এই বিগ ব্যাং থেকেই : ‘তার আগে’ বলে কিছু থাকবে কেমন করে? কাজেই তার আগে যা আছে, তা অবোধগম্য বুদ্ধি তা জানতে পারে না, কিন্তু মন অনুভব করে যে নিশ্চয়ই তার আগেও ‘একটা কিছু’ আছে।
সে-ই খোদা পরমসত্তারূপে মানুষের ভেতরে বিরাজ করেন। ধর্মশাস্ত্রের সাক্ষ্য : কোরান বলছে, ‘আমি তোমার শাহারগের কাছেই আছি’, ‘আমি তোমার নফসের সঙ্গেই মিশে আছি, তুমি কি দেখছ না’, ‘আমাকে ডাকো, আমি জবাব দেব।’ এবং হাদিস বলছে, ‘মোমিনের হৃদয়ে আল্লাহর আরশ,’ ‘যে নিজেকে চিনেছে, সে প্রভুকে চিনেছে।’ ইত্যাদি।
তবে তার খোঁজ পাই না কেন? কারণ, আমরা নফসে আম্মারার বশীভূত। বোধগম্য অর্থে, নফ্স হচ্ছে প্রবৃত্তি-আবেগ-বুদ্ধিবৃত্তির সমগ্রতার সঙ্গে চেতন-অচেতন-নির্জ্ঞান মনের সঙ্গমিত অবস্থা। আসলে প্রাণই হলো নফ্স। নফ্স তথা জীবাত্মার কেন্দ্রে আছে ‘আমিত্ব’ বা ইগো। এটি সব সময়েই নিজের চাওয়া-পাওয়া স্বার্থ নিয়ে তাড়িত। সুতরাং আকর্ষণমূলক (কাম, লোভ, মোহ, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা...) ও বিকর্ষণমূলক (ক্রোধ, ঘৃণা, ঈর্ষা, দ্বেষ, ভয়...) মানসিক ভাব ও ভাবনাপ্রবাহে নিমজ্জিত থাকে আমাদের মনোজগৎ। এগুলোকে উসকে দেয় আমিত্ব এবং এরাও প্রভাবিত করে আমিত্বকে। এই আমিত্বই ইবলিস শয়তানের কুমন্ত্রণার প্রধান চাঁদমারি।
এই আমিত্বকে ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে চিনে নেওয়ার ও তাকে অতিক্রম করে শুদ্ধ সত্তাকে উদ্ভাসিত করাই সুফির লক্ষ্য।
চেতন-অচেতন-নির্জ্ঞান মনের অবস্থাসমূহকে পর্যবেক্ষণ করে এগুলোর বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হওয়া হলো সুফির আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্য। এই আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তার ‘কাঁচা আমি’ (রবীন্দ্রনাথের ভাষায়) বা ‘ছোট আমি’ (রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাষায়) ক্রমে ‘পাকা আমি’ বা ‘বড় আমি’তে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ সাধক নফসানিয়াতের শৃঙ্খল থেকে রুহানিয়াতের পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হন। তার জীবাত্মা বা নফ্স তখন পরমাত্মা বা রুহের সঙ্গে মিলিত হয়। অর্থাৎ আমিত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত হলেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে অখণ্ড অদ্বৈত রূপ আছে, তা তার মধ্যে উদ্ভাসিত হয়। সেই অদ্বৈত অবস্থায় সে তার সত্তার মধ্যে পরমকে উপলব্ধি করে, আর সাধক তখনই বলে ওঠে, ‘আনাল হক’, অর্থাৎ আমিই পরম সত্য।
এখন বুঝতে হবে, নমরুদও নিজেকে ‘খোদা’ বলে দাবি করেছে, আবার মনসুর হাল্লাজও তা-ই বলেছেন। ব্যাকরণের দিক থেকে দুটো বাক্যই এক ও অভিন্ন। কিন্তু তাৎপর্যের দিক থেকে একজন বলেছে আমিত্বের বাসনায় ক্ষমতার দম্ভে, আর অন্যজন বলেছেন হৃদয়ে পরম সত্তাকে অনুভব করে। সুতরাং আপন আপাতখণ্ডিত সত্তায় তথা অন্তরে পূর্ণসত্তাকে অনুভব করাই একজন সুফির আকাক্সক্ষা। এই অনুভবের মাধ্যমে সে দৈনন্দিন অহংকেন্দ্রিক ভোগলিপ্সার জগৎ থেকে দিব্য, আনন্দময় প্রজ্ঞা ও প্রেমের রাজ্যে অধিবাসী হন।
প্রেমের বিষয়টা কীভাবে এলো? প্রেমকে তো আসতেই হবে। কারণ, সুফির প্রধান অবলম্বনই প্রেম। পরমের জন্য তার আকুতি। যিনি পরমকে লাভ করেছেন, তিনি তো বিমূর্ত পরমের বাস্তব
প্রতিরূপ। এমন একজন মানুষকেই গুরু হিসেবে বরণ করতে হয়। কেন মানতে হবে গুরু? উত্তর পাই রবীন্দ্রনাথে। গুরুদেব লিখেছেন যে একটি হালের অধীনতা স্বীকার না করার অর্থ লাখ লাখ ঢেউয়ের দাসত্ব করা। এই গুরুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয় এবং তার নির্দেশিত সাধন-ভজন করতে হয়; কারণ,
‘সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার
ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার।’
এই প্রেম জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্কের বাইরের বিষয়। এই প্রেমের চর্যার মাধ্যমেই সুফি মানবিকতার উচ্চতর পর্যায়ে আরোহণ করেন, তিনি অসাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠেন, সৌভ্রাতৃত্বের বোধে সিক্ত হন, সর্বজনীন হয়ে ওঠেন।
আমাদের চেতনায়, জীবন-দর্শন নির্ধারণে, ভাবচর্চায় ও জীবনচর্যায় সুফিবাদ ক্রমে-ক্রমে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বিশেষত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি, জঙ্গিপনা এবং অনুষ্ঠানসর্বস্বতার বাইরে ধর্মচর্চার ও শান্তিলাভের উপায় হিসেবে আগামী দিনগুলোতে এই আত্মদর্শনমূলক ভাবধারা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে উঠবে বলে মনে হয়।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
কুড়িগ্রাম সদরের বেলগাছা ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে সিমিত চন্দ্র (১২) নামের এক স্কুলছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বুধবার (৭ জুন) ভোরে ওই ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বেলগাছা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত এক কিশোরকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া সিমিত চন্দ্র বেলগাছা গ্রামের মানিক চন্দ্র ড্রাইভারের ছেলে। অভিযুক্ত কিশোর (১৬) একই গ্রামের প্রদীপ চন্দ্রের (দর্জি) ছেলে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম আর সাঈদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের গীতা সংঘ অনুষ্ঠান দেখতে যায় সিমিত ও তার বড় ভাই। সিমিতকে অনুষ্ঠানস্থলে রেখে বাড়িতে ফেরে তার বড় ভাই। পরে অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে সিমিতের সঙ্গে অভিযুক্ত কিশোরের কথা কাটাকাটি হয়। এ ঘটনায় সিমিতকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ওই কিশোর। পরে তাদের একটি পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের গর্তে সিমিতের মরদেহ পুতে রাখে। অনুষ্ঠান শেষে সিমিত বাড়িতে না ফিরলে স্বজনরা তার খোঁজে বের হয়। অভিযুক্ত কিশোরকে সিমিতের বিষয়ে জিজ্ঞাস করলে সে অসংলগ্ন আচরণ করে। পরে তার বাবা প্রদীপ চন্দ্র তাদের পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের একটি গর্তে সিমিতের মরদেহ দেখিয়ে দেন। বুধবার ভোরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে।
আটক কিশোরের স্বীকারোক্তিতে সদর থানার ওসি এম আর সাঈদ বলেন, অভিযুক্ত কিশোরের সঙ্গে একটি মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। এ নিয়ে সিমিতসহ অনেকেই ওই কিশোরকে খোঁচা দিত। গত রাতে সিমিত ওই কিশোরের সাথে এ নিয়ে আবারও খোঁচা দিলে সে সিমিতের গলা চেপে ধরে। এত শ্বাসরোধ হয়ে শিশুটি মারা যায়।
তিনি আরও বলেন, অভিযুক্ত কিশোর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনা স্বীকার করেছে। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।