
যেকোনো অঞ্চলের সংস্কৃতি গড়ে উঠতে সেই অঞ্চলের মানুষের পোশাক, কথা, আচার আচরণ যেম ন অনুষঙ্গ তেমন তাদের খাদ্য বা খাদ্যাভ্যাসকে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ধরা হয়। তাই খাদ্যকে সাংস্কৃতিক নির্মাণ বলা যায়। পপুলার কালচার বা জনসংস্কৃতির একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, মানুষের পছন্দের খাবার খুব দ্রুত বদলায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফাস্টফুড কিংবা কন্টিনেন্টাল খাবারের জনপ্রিয়তার তোড়ে দেশীয় অনেক খাবার হারিয়ে যায়। বাংলাদেশেও এমন হয়েছে যে অনেক খাবারের নিত্য ব্যবহার হারিয়ে যেতে বসেছে যেমন পান্তা ইলিশ হয়ে গেছে শুধুমাত্র পহেলা বৈশাখের খাবার অনেকের কাছেই। বাংলাদেশে বিভিন্ন বিভাগের যেসব আঞ্চলিক খাবার বা খাবারের প্রথা আছে সেসবও জনসংস্কৃতির চাপে টিকতে পারছে না বললেই চলে। কিন্তু এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের মেজবানকে বেশ ব্যতিক্রম বলা যায়। যেখানে ফাস্টফুড বা রেস্টুরেন্ট সংস্কৃতির জোয়ারে নিজস্ব খাবারগুলো আমরা ভুলতে বসেছি সেখানে দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় মেজবানের মাংস বা খাবারকে কেন্দ্র করে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালু হয়েছে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান কীভাবে জনসংস্কৃতির সঙ্গে মিশে টিকে গেল এটা একটা বিস্ময়ই বটে! চট্টগ্রাম এবং মেজবান সমার্থক শব্দ যেন। মেজবান চাটগাঁর আঞ্চলিক ভাষায় মেজ্জান বলে পরিচিত শব্দটি এসেছে মূলত ফার্সি ভাষা থেকে যার অর্থ ‘অতিথি আপ্যায়নকারী’ বা ‘নিমন্ত্রণকারী’ আর ‘মেজবানি’ অর্থ ‘মেহমানদারী’। পনেরশ শতাব্দীর প্রাচীন পুঁথি সাহিত্যে ‘মেজোয়ান’ বা ‘মেজোয়ানি’ শব্দ পাওয়া যায় যার মানে আপ্যায়নকারী ও আপ্যায়ন। লেখক রশিদ আনামের প্রবন্ধ থেকে জানা যায় যে ১৪শ শতকের আগে চট্টগ্রাম যা আরাকান রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এর জনসংখ্যার অধিকাংশই ছিল হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। সেই সময় চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে ওঠে এবং প্রসার লাভ করে. সুলতানি আমলে আরব, পারস্য এবং তুরস্ক থেকে বিভিন্ন পীর-আউলিয়া আসেন ইসলাম ধর্ম প্রচারে। ইসলাম ধর্ম প্রচারকরাই মূলত ধর্মান্তরিত মুসলমানদের নতুন খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে ভোজের আয়োজন করেন যার নাম মেজবান রাখা হয়, এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল নব্য মুসলমানদের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। সেই থেকে চট্টগ্রামে বিশাল ভোজের আয়োজন করে লোকজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোকে মেজবান বলা হয়, তবে নতুন মুসলমানের সঙ্গে পরিচিত করানোর উপলক্ষ দিনে দিনে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে মেজবানির আয়োজন করা হয় অন্য কোনো উপলক্ষকে কেন্দ্র করে যেমন কেউ মারা গেলে তার কুলখানি বা চল্লিশায়, মৃত্যুবার্ষিকীতে, জন্মবার্ষিকী, আকিকা, বিয়ে, খৎনা, কান ফোঁড়ানো থেকে শুরু করে যেকোনো উপলক্ষেই চট্টগ্রামে মেজবানির আয়োজন করে প্রতিবেশী এবং আত্মীয় স্বজনদের খাওয়ানোর রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, মেজবান শুধুমাত্র চট্টগ্রামে মুসলিম পরিবার আয়োজন করে থাকে তা নয়, চট্টগ্রামেই কোনো কোনো হিন্দু/বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চলেও হিন্দু বা বৌদ্ধ পরিবারে মেজবানের আয়োজন হয় খাসি, মুরগি, মাছ, শুঁটকি ভর্তা সহযোগে। অনেকেই ভাবেন মেজবান নিজেই একটি খাবারের নাম, আসলে তা না, মেজবান হলো বিশেষ কিছু খাবার পরিবেশন করে যে ভোজ আয়োজন করা হয় তা সেই বিশেষ খাবার কোনো পোলাও কোরমা বিরিয়ানি নয়, একদমই সাধারণ আতপ চালের সাদা ভাত, গরুর মাংস, নলার ঝোল (গরুর পায়ার ঝোল যাকে অন্য অঞ্চলে নেহারি বলে) এবং লাউ-ডাল (মাসকলাই বা বুটের) দিয়ে ছোট হাড়-মাংস মূল পদ। এর সঙ্গে কোনো কোনো মেজবানে কালা ভুনা, মুরগির মাংস বা মাছ পরিবেশন করা হয়, মেজবানের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই, সকাল বা দুপুর বা সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত চলে। মেজবানির উৎপত্তি হয় চট্টগ্রামের বনেদি ধনী পরিবারগুলোয় প্রথম দিকে কিন্তু কালক্রমে তা ছড়িয়ে গেছে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেও। চট্টগ্রামে মেজবান দেওয়াটা যেন অনেকটাই ইজ্জত রক্ষার ব্যাপারও বটে। তখনকার দিনে পিতল বা তামার ডেকচিতে রান্না করা হতো মাংস। যে ডেকচিতেই রান্না হোক না কেন চট্টগ্রামের ভাষায় একে ‘ডেক পাকানো’ বলে। আগে নিচে চাটাই বিছিয়ে বসা হতো আর বালতি ভরে খাবার এনে চামচে বেড়ে দেওয়া হতো। এখন চেয়ার টেবিল পেতে বাটিতে দেওয়া হয় খাবার। এমনকি মেজবান শেষে যদি খাবার রয়ে যেত তবে নিয়ম হলো পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্মীয়দের বাড়িতে টিফিন বক্স ভরে পাঠানো। দাওয়াত দেওয়ার নিয়ম ছিল মাইক বাজিয়ে, এখন কার্ড বা ফোনে দেওয়া হয়। কখনো কখনো প্রতিযোগিতায় রূপ নেয়। যেমন ওই বাড়িতে দুটো গরু দিয়ে মেজবান দিলে এই বাড়িতে ৪টা দিয়ে দেওয়া হবে ধরনের বাড়াবাড়ি চলে। এতে টাকার শ্রাদ্ধ আয়োজনকারীর হলেও মজাটা যারা খেতে আসে তাদের হয় বলাবাহুল্য। মেজবানের মাংস রাঁধতে পুরুষ বাবুর্চির দেখাই মেলে। এর কারণ সম্ভবত কয়েকশ বা হাজার মানুষের জন্য বড় ডেকচিতে বা পাত্রে রান্না করতে যে শক্তি লাগে তা আমাদের সংস্কৃতিতে নারীর পক্ষে সম্ভব না অমন ধারণা থেকে পুরুষ বাবুর্চির হাতেই মেজবানি মাংস রান্না হয়। মেজবানি মাংস রান্নায় বিভিন্ন রকমের মসলার ব্যবহার করা হয় লাল মরিচের সঙ্গে মিশিয়ে। সরিষার তেল বেশি ব্যবহৃত হয়। অনেক সময় ধরে কাঠের চুলায় জাল দিয়ে সেদ্ধ করা হয় যাতে মসলা ভালো করে মাংসের ভেতর ঢুকে মাংস নরম হয় তার জন্য। দীর্ঘ সময় ধরে রান্নার কারণে মাংসের স্বাদ বেড়ে যায়। মাংসের স্বাদের জন্যই সম্ভবত এটি আঞ্চলিক সীমানা পেরিয়ে এখন দেশের সবখানে এবং বিদেশেও জনপ্রিয় হয়েছে।
চট্টগ্রাম শহরে রেস্টুরেন্ট কালচারেও মেজবান ঢুকে গেছে আলাদা মেন্যু হিসেবে। অনেক হোটেলে প্রতি সপ্তাহে বিশেষ করে শুক্রবারে আলাদা করে গরু জবাই করে মেজবানেই মাংস রান্না করা হয়। আবার রেস্টুরেন্টের নাম ‘মেজবান হোটেল’ বা ‘মেজ্জান হাইলে আইয়ুন’ ইত্যাদি রাখা হচ্ছে ভোজনরসিকদের আকৃষ্ট করার জন্য। শুধু পার্থক্য হলো এখানে মেজবানের মাংস ফ্রিতে খাওয়া যায় না যেটা ঐতিহ্যগতভাবে মেজবানের (অর্থ মোতাবেক) বৈশিষ্ট্য। তবে এভাবে হলেও যারা চট্টগ্রামে অন্য অঞ্চল থেকে বেড়াতে আসছেন বা বিদেশ থেকে আসছেন এসব রেস্টুরেন্ট বা হোটেলে মেজবানি মাংস খেয়ে দুধের স্বাদ কিছুটা হলেও ঘোলে মেটাতে পারেন।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সময়, পরিস্থিতি, ব্যক্তি-সমাজের প্রয়োজনে পরিবর্তনশীল। অতীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তন ও সভ্যতার অগ্রগতিতে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি রূপ-রূপান্তরের যে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছিল নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে সেই রূপান্তরের ধারা রক্ষা করেছে। বিশেষ করে কভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে যখন করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ে তখন এ দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে যেমন নবরূপ সৃষ্টি হয়েছে তেমনি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি নিজের ঐতিহ্যকে ভিন্নধারায় রূপান্তর করেছে।
বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের পথ ধরে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে উদ্দীপনা গ্রহণের মাধ্যমে নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক সংকট এবং মনুষ্যসৃষ্ট কিছু দুরবস্থাকে অতিক্রম করেছে। যে কোনো পরিস্থিতিতেই এ দেশের মানুষ অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মোকাবিলা করেছে তেমনি রাজনৈতিক সংকটকে অতিক্রম করেছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হতে উদ্দীপনা নিয়ে। এমনকি মনুষ্যসৃষ্ট দুরবস্থা থেকে নিজের অস্তিত্ব¡ টিকিয়ে রাখতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শক্তিকে আশ্রয় করেছে।
ইতিহাসে জানা যায়, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ রাজনৈতিক দুঃশাসনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের লোককবিরা গান লিখে সুর করে পরিবেশনের মাধ্যমে জনগণের মনে উদ্দীপনা সঞ্চারে ভূমিকা রেখেছিলেন। এ ছাড়া ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে ও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকালে এই দুটি আন্দোলনে লোকসংগীতের শক্তিকে ব্যবহার করে লোকশিল্পীরা সময়ের প্রয়োজনে নতুন গান রচনা করে এবং পরিবেশন ও প্রচার করে দেশের সব সাধারণ এবং সংগ্রামী মানুষের মনে অনুপ্রেরণা ও সাহস সঞ্চার করেছিল।
অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তন ও সভ্যতার অগ্রগতিতে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে রূপ-রূপান্তরের যে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছিল একবিংশ শতকে নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে সেই রূপান্তরের ধারা নতুনভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে কভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণে যখন বাংলাদেশের জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে তখন এ দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে নানা ধরনের সংকট যেমন সৃষ্টি হয় তেমনি তা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে সংস্কৃতিতে নতুন ধরনের আবেগ, প্রতিক্রিয়া ও চেতনা সঞ্চারিত হতে থাকে। এ পর্যায়ে সে ধরনের কিছু ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ৫ এপ্রিল তারিখে কিশোরগঞ্জ জেলার রামায়ণ গানের তরুণ সাধকশিল্পী শংকর দে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষার জন্য জনসচেতনামূলক নিজের লেখা-সুর করা ও গাওয়া একটি গান আমাদের মেসেঞ্জারে ইনবক্স করেন। তিনি তার পরিবেশিত গানটি ভাবনগর ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজ বা ইউটিউবে প্রচার করতে অনুরোধ করেন। আমরা তখন শিল্পীকে বলতে চেয়েছিলাম, ‘এই কাজটি তো আপনি নিজেই আপনার ফেসবুকে প্রচার করতে পারেন।’ কিন্তু শিল্পী শংকর দে জানান, তার ফেসবুক তেমন জনপ্রিয় নয়, তাই গানটি বেশি লোক দেখতে পারবে না, আর ভাবনগরে দিলে সারাদেশের লোক জানতে পারবে, সচেতন হতে পারবে। শিল্পী শংকর দে-র এই কথার ভেতর দিয়ে বোঝা যায়, তিনি অধিক সংখ্যক মানুষকে করোনা সম্পর্কে সচেতন করতে চান।
করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষ শুরু থেকে অনেক গুজবের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের ইসলামি বক্তাদের কেউ কেউ বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকে নানা ধরনের গুজব সৃষ্টি করে ছড়িয়ে দিতে থাকে। এদের মধ্যে মুফতি কাজী ইব্রাহিম অন্যতম, তিনি ২০২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের প্রথম দিকে প্রকাশ্য মহফিলে এবং মসজিদে জুমার নামাজের বয়ানে ইতালির মামুন মারুফের স্বপ্নে দেখা করোনা ভাইরাসের সাক্ষাৎকারের বয়ান করেন। এই বয়ানে তিনি পৃথিবীতে করোনা আগমনের কারণ ও সময় সম্পর্কে উল্লেখ করেন। মুফতি ইব্রাহিমের গুজবের পরপরই ৮ মার্চ ২০২০ তারিখে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করা হয় এবং দ্রুত করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে ২৬ মার্চ ২০২০ তারিখ থেকে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন ঘোষণা করে। এরপর সাধারণ মানুষ গৃহবন্দি হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে করোনা মহামারীর মধ্যে যেসব সাধক কবি ও শিল্পী নিজেদের সৃজনশীলতাকে ঘরে অবস্থান নিয়েই রক্ষা করেছেন তাদের মধ্যে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানার আটিবাজার-বামনসুর গ্রামের আরিফ দেওয়ান অন্যতম। ২১ আগস্ট ২০২০ তারিখ বিকালে তার সাক্ষাতে গিয়ে জানা যায় যে, তিনি করোনা মহামারীতে লকডাউনে গৃহবন্দি হয়ে অলস সময় কাটাননি, তার বদলে রচনা করেছেন ৩৭৫টি গান। সব গানের বাণীতে সুর-সংযোজনও করেছেন এই সময়ে, কিছু গান নিজে গেয়ে ফেসবুকে ও ইউটিউবে প্রচার করেছেন। তার গানের হস্তলিখিত পা-ুলিপিগুলোতে প্রত্যক্ষ করা যায় যে, তিনি করোনা মহামারীর সময়কে নিয়েও কিছু গান রচনা করেছেন। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায়, আরিফ দেওয়ান করোনা মহামারী বিষয়ক যেসব গান লিখেছেন তা মূলত ৩ ধরনের, যথা :
১. লকডাউনে সাধুসঙ্গকারী ভাবসাধকদের অবস্থা বর্ণনাকারী গান,
২. করোনা মহামারীতে ত্রাণ লুটকারীদের সমালোচনামূলক গান এবং
৩. করোনা মহামারীতে প্রকৃতির রূপান্তর বিষয়ক গান।
বাংলাদেশের পুঁথি-কবিদের অনেকে করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করে পুঁথিকাব্য রচনা করেছেন। মানিকগঞ্জ জেলার বিখ্যাত সুফিসাধক ও পুঁথিকবি সাইদুর রহমান বয়াতী ‘ভাইরাসনামা’ নামে একটি পুঁথিকাব্য রচনা করেছেন, তার পুঁথিতে ইতিহাসের আলোকে বিভিন্ন যুগের মহামারী সংঘটনের কারণ বর্ণনা করা হয়েছে, সেই সঙ্গে পৃথিবীতে করোনা সংঘটনের কারণ ও তা থেকে প্রতিকারের উপায় পয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী ছন্দে তুলে ধরা হয়েছে। সাইদুর রহমান বয়াতী পুঁথিতে বাংলাদেশের লোকসমাজের নানা অসঙ্গতিকে করোনা মহামারীর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে এই পুঁথিটি হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি নিষ্ঠ এক কবির কথন। এই পুঁথির মাধ্যমে তিনি শুধু করোনা মহামারীকে চিহ্নিত করেননি একই সঙ্গে লোকশিক্ষার প্রতি তার নৈতিক সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
করোনা মহামারীতে সাধক কবি, পুঁথিকারদের পাশাপাশি বাংলাদেশের পটচিত্রশিল্পীদের কেউ কেউ নিজেদের ঐতিহ্যবাহী শিল্প সৃষ্টিতে নতুন রূপান্তর সংযোজন করেছেন। এ ক্ষেত্রে মুন্সীগঞ্জ ও নড়াইল জেলার পটচিত্রশিল্পী শম্ভু আচার্য্য ও নিখিলচন্দ্র দাসের কথা উল্লেখ করা যায়। করোনা মহামারীকে বাংলাদেশের গাজীর পটের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শম্ভু আচার্য্য তুলে ধরেছেন তার চিত্রকলার ক্যানভাসে, তিনি ‘করোনা-অসুর বধ’ নামে একটি চিত্র অংকন করেছেন। এই চিত্রে তিনি হিন্দুধর্মীয় মিথের অপদেবতা অসুরের মুখ ও হাত এঁকে তাতে ১২টি তীর বিদ্ধ করেছেন এবং প্রতি তীরের গায়ে করোনা বিধ্বংসী উপাদান ও উপকরণের নাম লিখে দিয়েছেন।
নড়াইল জেলার পটচিত্রশিল্পী নিখিলচন্দ্র দাস অবশ্য পটগানের আদলে তার জড়ানো-পটচিত্রে করোনাকে অংকন করেছেন। এ ক্ষেত্রে করোনাকে রাক্ষুসে এক অপদেবতার ভয়ংকর খোলা মুখচ্ছবি ১২টি চিত্রের ভেতর করোনাকালে মানুষের দুর্দশা ও মৃত্যুর চিত্র অংকন করেছেন। প্রথম চিত্রে তিনি করোনা-রাক্ষসের খোলা মুখের ভেতর অনেকগুলো মৃত মানুষের লাশ এঁকেছেন, এই চিত্র দিয়ে তিনি করোনা মহামারীর বৈশি^ক রূপকে তিনি অংকন করেছেন।
আমাদের আলোচনার বাইরেও বাংলাদেশের অনেক সাধক কবি করোনা মহামারীর সময় ও সংকটকে নিয়ে বহু ধরনের গান লিখেছেন, তাদের মধ্যে আছেন পাবনা জেলার ফকির আবুল হাশেম, বরিশাল জেলার শাহ আলম দেওয়ান, কুষ্টিয়া জেলার শরিফুল শেখ, সিরাজগঞ্জ জেলার গুঞ্জের আলী জীবন, কিশোরগঞ্জ জেলার ইসলাম উদ্দিন কিস্সাদার প্রমুখ। এ ছাড়া অনেকে পালানাট্য, পুঁথি রচনা করেছেন বলে জানা যায়।
ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির নানান দৃষ্টান্ত পর্যবেক্ষণপূর্বক যে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হয়েছে তার ভিত্তিতে এ কথা বলা চলে, কভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাসজনিত মহামারীকালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে নানা ধরনের ঐতিহ্যিক চালচিত্রের রূপ ও রূপান্তর ঘটেছে। এই রূপ-রূপান্তর অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও শিল্পসম্মত। শুধু তাই নয়, সংকট মোকাবিলার মধ্যে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী
সংস্কৃতির চর্চাকারী জনগোষ্ঠী কতটা সৃষ্টিশীল ও সচেতন মানবিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম তার স্বরূপ এই প্রবন্ধে দৃষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি এ দেশীয় ঐতিহ্যের অন্তর্গত শক্তি তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই কভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাসের ধ্বংসাত্মক বাস্তবতার বিপরীতে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির নবরূপান্তরের কাঠামো নতুনভাবে চিহ্নিত হয়েছে, যা ভবিষ্যতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনায় বিশেষ সহায়ক হবে।
প্রথমেই অন্তত দুটো কথা বলে নেওয়া ভালো। প্রথম কথা এই, জনরুচি কথাটার মধ্যে একটা ব্যাপক সার্বিকতা আছে, যা মর্মের দিক থেকে কোনো বিশেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযোগী নয়। রাষ্ট্র বা জাতি ধারণা মাথায় রেখে আমরা বিপুল মানুষকে এক পাল্লায় স্থাপন করে কথাবার্তা বলি বটে; কিন্তু এর মধ্য দিয়ে আদতে একটা বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো কাজের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। মানুষের মধ্যে শ্রেণি ও অবস্থানগত দিক থেকে শুরু করে বহুবিধ ফারাক থাকে। আর রুচি জিনিসটা ওইসব পার্থক্য দিয়ে এতটাই নিয়ন্ত্রিত হয় যে, কোনো সাধারণ মন্তব্য প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় কথাটা হলো, যোগাযোগ-প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উন্নতির পর থেকে মানুষের বিশ্বজনীন যোগাযোগ আর কল্পনার যে বৈপ্লবিক বদল ঘটেছে, আগের অনেক দশক মিলিয়েও সে ধরনের পরিবর্তন শনাক্ত করা যায় না।
এ দুটো দিক বিবেচনায় রেখে বলা যায়, বাংলাদেশে সত্তর আর আশির দশকে নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজে সুরুচির ধারণাটা পশ্চিমা মেজাজ আর কলকাতায় বিকশিত ‘সংস্কৃতি’র যৌথতায় নির্ধারিত হতো। এর পরিচয় আছে উত্তম-সুচিত্রা ধরনের সিনেমায়, ছায়ানট ধরনের সংগীত-চর্চায়, আর ‘দেশ’ পত্রিকার প্রবল প্রতাপে। তবে এ রুচির চর্চাকারীরা সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না; যদিও চর্চার আভিজাত্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল। নাগরিক মধ্যবিত্তের মধ্যে এ ধরনের রুচির বিস্তারের প্রধান সাক্ষ্য বোধহয় পাওয়া যাবে সিনেমার গানে, যার সঙ্গে ষাট-সত্তরের দশকের কলকাতার ‘আধুনিক বাংলা গানে’র প্রবল সাদৃশ্য পাওয়া যাবে, যদিও বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্বভাবতই এর নানারকম রূপান্তরও ঘটেছিল। রূপান্তরের বড় কারণ সম্ভবত দুটি। একদিকে মুসলমান-প্রধান জনগোষ্ঠীর কাহিনি ও ভাবের বাহন হওয়ায় কিছু পরিবর্তন জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে করতেই হতো। অন্যদিকে গ্রামীণ জনসমাজের সংখ্যাধিক্যের কারণে চিত্রিত জীবনচিত্রে গ্রামের একটা প্রাধান্যও থাকত। বিপুল গ্রামীণ জনগোষ্ঠী প্রাত্যহিক জীবনযাপন ও বিনোদনের জন্য নগরের ওপর প্রধানভাবে নির্ভরশীল না থাকলেও উন্নত বা কাক্সিক্ষত রুচির সরবরাহকারী হিসেবে ঢাকার একক প্রাধান্য আসলে স্বাধীনতার আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
পশ্চিমা সংস্কৃতি ঢাকার জনরুচিতে নতুন রূপ নিয়ে ওপরে কথিত রুচিধারার মধ্যে যে ধরনের রূপান্তর ঘটাচ্ছিল, তা বোঝার জন্য সবচেয়ে ভালো উপকরণ সম্ভবত ব্যান্ড সংগীত। পশ্চিমা পপ মিউজিক, তার কথা, সুর, উপস্থাপনা ও উপভোগের কেতা ঢাকার ব্যান্ড সংগীতে খুব ভালোভাবে আত্মীকৃত হয়েছে; উত্তম ফসল ফলিয়েছে; আর সম্ভবত বিপুল তরুণ-সমাজের জন্য কাঠামোবদ্ধ রুচির নিগড় থেকে মুক্তির একটা বার্তাও নিয়ে এসেছিল। পোশাক এবং খাবারের দিক থেকে বাংলাদেশের জনরুচি গত পাঁচ দশকে সম্ভবত খুব একটা বৈপ্লবিক বদলের মধ্য দিয়ে যায়নি। ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতির বিপুল বিস্তার সত্ত্বেও খাদ্যরুচির প্রধান প্রবাহটা আসলে প্রায় সমরূপই আছে। অন্যদিকে পোশাকের রুচিও আসলে বদলেছে ঠিক ততটাই, যতটা আর্থিক সংস্থানের কারণে বদলাতে পারে। বলার মতো যথেষ্ট কারণ আছে, ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলাদেশের নাগরিক জনরুচি শনাক্তকরণের জন্য সাহিত্য বা অন্য বিনোদন-উপাদানের তুলনায় খাদ্য-সংস্কৃতি ও পোশাক-সংস্কৃতি অধিকতর বিশ্বস্তভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। সত্তর ও আশির দশকের অন্তত মধ্যবিত্ত জনরুচির গ্রাম-শহর নির্বিশেষে– সবচেয়ে ভালো আদল পাওয়া যাবে হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকর্মে।
নব্বইয়ের দশক থেকে নগরায়ণের গতি ও প্রকৃতি দ্রুত বদলাতে থাকে। এর অনিবার্য পরিণতি পশ্চিমায়ন। খুব স্বাভাবিক বাস্তবতার কারণেই বাংলাদেশের অভিজাত রুচির ভূগোলে কলকাতার হিস্যা দ্রুত কমতে থাকে। তার স্থান উচ্চবিত্তের ক্ষেত্রে দখল করতে থাকে ইংরেজিবাহিত খাঁটি আমেরিকান সংস্কৃতি; আর নাগরিক মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে অংশত তার অপভ্রংশ। গ্রামীণ
সাংস্কৃতিক উপাদানের নাগরিক রূপান্তরও এসময় থেকে মধ্যবিত্ত নাগরিক সংস্কৃতিতে বড় জায়গা দখল করতে থাকে। সত্তর-আশির দশকে যোগাযোগহীনতার কারণে গ্রামীণ সংস্কৃতি যতটা স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারত, নব্বইয়ের দশক থেকে তার পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকে। এতে করে একদিকে গ্রামীণ জনপদে নগর-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে, আর নগরেও পুনরুৎপাদিত হতে থাকে গ্রামীণ সংস্কৃতির নানা মাত্রা। এর এক কারণ, গ্রাম থেকে গরিব মানুষের ব্যাপক হারে নগরে আগমন। নগরে লোকসংগীত বা লোকসংস্কৃতির চর্চা আগেও ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে গ্রামীণ জনপদের নানা উপাদান নগরে যেভাবে পুনরুৎপাদিত হয়েছে, তা একেবারেই আলাদা জিনিস। নাগরিক মধ্যবিত্ত রুচিতেও তার ব্যাপক সংক্রমণ ঘটেছে। শিল্পী মমতাজ হয়তো এ বাস্তবতারই তুঙ্গ প্রকাশ।
গত এক-দেড় দশকে দুনিয়ার অন্যান্য গরিব দেশের মতো বাংলাদেশেও জনরুচি ও যাপিত সংস্কৃতির বৈপ্লবিক বদল ঘটেছে নতুন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। এর প্রধান নিয়ামক যোগাযোগ-প্রযুক্তি। কিন্তু আমাদের মতো দেশগুলোতে তার আরেক কারণ আছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে এমন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা হয়তো খুবই কম, যারা নিজেদের সম্ভাব্য ইমিগ্রান্ট হিসেবে কল্পনা করে না। এমতাবস্থায় তাদের ভোগ-উপভোগ এবং কল্পিত রুচির মধ্যে বড় ধরনের বদল ঘটাই স্বাভাবিক। যোগাযোগ-প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সেই কল্পনাকে অন্তত অংশত বাস্তবে পরিণত করে দেখাচ্ছে। যোগাযোগ-প্রযুক্তির অভিভাবকত্বে জনমানুষের সামষ্টিক রুচি ও বোধের যেসব পরিবর্তন ঘটে চলেছে, তার কোনো কাঠামোগত বিশ্লেষণের সময় এখনো আসেনি। কিন্তু এটুকু বলা যায়, গ্রাম ও নগরের ব্যাবধান এদিক থেকে খুব বেশি নয়। আর নাগরিক উচ্চশ্রেণির সাথে মধ্যশ্রেণির ফারাকও কমেছে।
কিন্তু বিনোদন-সংস্কৃতি রুচির একাংশ মাত্র। বাস্তবে সুবিধাপ্রাপ্ত উচ্চশ্রেণিটিই কেবল এই নতুন রুচিকে নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারছে। মধ্যবিত্তের যাপিত জীবন আর কাক্সিক্ষত রুচি ও বোধের টানাপড়েন নিশ্চয়ই আগের চেয়ে বেড়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা হবে গ্রামীণ জনপদের বিপুল মানুষ। তাদের পূর্বতন বোধ ও বিনোদন প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে; কিন্তু নতুন আয়োজনগুলোতে অংশ নেওয়ার বাস্তবতাও নিজেদের জীবনে তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের গ্রাম ও নগরে ওয়াজ-সংস্কৃতির বিপুল বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ কি এই শূন্যতা?
আগেই বলেছি, শ্রেণি বা অন্যবিধ ফারাকের আলাপ মুলতবি রেখে জনরুচির আলাপ অর্থহীন। তারপরেও যদি এ নাম ধরে আলাপ করতেই হয়, তাহলে হয়তো বলা যাবে, বাংলাদেশে এমন জনরুচি চিহ্নিত করা খুব সহজ কাজ নয়। পোশাকে-খাবারে তার প্রবল ছাপ আছে; আছে ফোক আর ব্যান্ড মিউজিকে; আছে কথায়-উচ্চারণভঙ্গিতে-কোলাহলময়তায়। কিন্তু সাহিত্য, সিনেমা ইত্যাদি অপেক্ষাকৃত নির্ণয়যোগ্য কাঠামোর মধ্যে তার প্রতিফলন খুব জুতমতো ঘটেনি। ফলে জনপ্রিয় সংস্কৃতির ইন্ডাস্ট্রিয়াল উৎপাদন-পুনরুৎপাদনে বাংলাদেশ শোচনীয়ভাবে পিছিয়ে আছে। এর পেছনে কাজ করে থাকতে পারে, এমন দুটি অনুমান এখানে হাজির করছি। এক. উনিশ-বিশ শতকের কলকাতার সংস্কৃতির প্রবল প্রতাপের কারণে বাঙালি মুসলমান রুচি ও সংস্কৃতি উপস্থাপিত হওয়াটা খুব চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল। পাকিস্তান আমলে ‘ইসলামি’ সংস্কৃতির রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ‘বাঙালি মুসলমান’ সংস্কৃতি তখন এবং পরেও দীর্ঘমেয়াদি অপরায়ণের শিকার হয়েছে। ফলে আমাদের নাগরিক ও অভিজাত রুচি ও সংস্কৃতি জনজীবনের সঙ্গে তুলনামূলক আলগা সম্পর্ক নিয়ে বিকশিত হয়েছে। দুই. বাংলাদেশে নাগরিক সংস্কৃতি জমে ওঠার আগেই বা প্রাক্কালে গ্লোবালাইজেশনের ধাক্কা এসে লাগে। ফলে নাগরিক মধ্যবিত্তের দুই-তিন প্রজন্ম কখনোই ঢাকায় বড় হারে বসতি করে উঠতে পারেনি। প্রধানত এ ধরনের জনগোষ্ঠীই যে কোনো দেশের রুচির নিয়ন্তা হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে ঘটনা না ঘটায় জনরুচির কোনো কাঠামোগত প্রস্তাব বড় হয়ে সামনে আসতে পারেনি। কলকাতা এবং পশ্চিমই রয়ে গেছে প্রধান রেফারেন্স পয়েন্ট। প্রতিক্রিয়া হিসেবে অপেক্ষাকৃত নন-এলিট জোনে ‘ইসলাম’ও তার শেয়ার দাবি করছে। কিন্তু কোনোটিই জনরুচির ভেতর থেকে যাপিত জীবনের রেফারেন্সে কার্যকর হতে পারছে না।
কিংবা হতে পারে, এই নিরাকার আকারই বাংলাদেশের জনরুচি ও সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য।
সর্বশেষ ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬,৫০,১৫৯ জন এবং জাতিসংখ্যা ৫০। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সালে শেষ হওয়া ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আদিবাসীদের ৪০টি মাতৃভাষা আছে। এর ভেতর কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং এই ১৪টি আদিবাসী মাতৃভাষা বিপন্ন। সাধারণভাবে প্রশ্ন ওঠে এই ৫০ জাতিসত্তার শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে আমরা কতটা জানি? ১৪টি বিপন্ন ভাষার কোনো সাহিত্যকর্ম বা সৃজনশীল শিল্প আমরা সুরক্ষা করেছি কি? ভাষাগুলো হয়তো খুব দ্রুতই নিদারুণভাবে দুনিয়া থেকে নিরুদ্দেশ হবে। একটি দেশ জানতেও পারবে না তার বহু নাগরিকের শিল্পভুবন বিষয়ে। কিন্তু তারপরও তরতর করে আমরা ‘জাতীয় সাহিত্য’ নিয়ে বাহাদুরি করব। দেশের ৫০ জাতিসত্তার প্রায় চল্লিশেরও বেশি মাতৃভাষার শিল্প-সাহিত্যকে অস্বীকৃত রেখে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীন দেশে প্রশ্নহীনভাবে আমরা জারি রেখেছি ‘জাতীয় সাহিত্যের’ ময়দান। ‘জাতীয় সাহিত্যের’ এই একতরফা অধিপতি চেহারা প্রবলভাবে জাত্যাভিমানী এবং ঔপনিবেশিক। এখানে মূলত বাংলায় রচিত-পরিবেশিত শিল্পসাহিত্যের প্রবলতা দেশের বাঙালি ও বাংলা ভাষা ভিন্ন অপরাপর সব জাতিসত্তার সব
মাতৃভাষার সাহিত্যভুবনকে ‘অপর’ ও প্রান্তিক করে রেখেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সুবর্ণরেখায় দাঁড়িয়ে দেশের আদিবাসী শিল্প-সাহিত্য ভুবনের রক্তাক্ত আহাজারি টের পাওয়া জরুরি। দেশের সব নাগরিকের সমস্বীকৃতির বিকাশেই ‘জাতীয় বলয়’ গড়ে ওঠে। কাউকে দাবিয়ে, আড়াল করে, পেছনে ঠেলে, বাহাদুরি করে নয়। মান্দি আখ্যান কিংবা চাকমা উপন্যাস, সাঁওতালি কবিতা বা মণিপুরী পালা, ম্রো গীত বা পাংখোয়াদের ঘুমপাড়ানি ছড়া বাদ দিয়ে ‘জাতীয় সাহিত্য’ হতে পারে না। সেলিম আল দীনের ‘বনপাংশুল’ জাতীয় সাহিত্যের অংশ হলে, মৃত্তিকা চাকমার ‘বান’ও জাতীয় সাহিত্যের অংশ।
মৌখিক ও মুদ্রিত সাহিত্যের এই প্রধান ধারার ভেতর আমরা এখনো আদিবাসী সমাজে মৌখিক সাহিত্যের চলমান টগবগে দুনিয়াকে প্রবলভাবে টের পাই। পাশাপাশি মুদ্রিত সাহিত্য ইতিহাসেও আদিবাসীদের রয়েছে টানটান বহমান অস্তিত্বময়তা। আমরা এও জানি মুদ্রিত সাহিত্যের বলপ্রয়োগ মৌখিক সাহিত্য পাটাতনকে প্রশ্নহীন কায়দায় দুমড়ে মুচড়ে দেয়। আর এই মুদ্রিত সাহিত্যেরই কেবলমাত্র ‘শিল্প সাহিত্য’ হয়ে উঠবার এক স্পষ্ট রাজনৈতিক ইতিহাস ও বলপ্রয়োগ আছে। মালেয়্যা বলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ভেতর একধরনের সামাজিক জুম সহযোগিতা আছে, ম্রোরা যাকে বলেন কুরপাক-কুরছাক। একজনের জুমে সমাজের দশজনে মিলে কাজ করে দেওয়া। আদিবাসীদের সাহিত্যও এভাবেই এক সামাজিক বোঝাপড়া প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এর ঐতিহাসিক ভিত্তি দাঁড় করিয়েছে। পাশাপাশি এই জনপদের যে সাহিত্য মহাবয়ান যা সব জাতির বৈচিত্র্যময় পালক নিয়ে বিরাজিত রয়েছে তা কোনোভাবেই কোনো জাতির প্রান্তিকীকরণের ভেতর দিয়ে আপন ডানা মেলতে পারে না। উপস্থাপনে অধিপতি ঝাঁজ থাকলেও অনেকে এভাবেও বলেছেন, অনেক উন্নত ভাষার সাহিত্যের মতো চাকমাদেরও রয়েছে প্রাচীনতম সাহিত্য কীর্তি। মধ্যযুগের চাকমা সাহিত্যের অপূর্ব সৃষ্টি গোজেনলামা, সাধক শিপচরণ এর লেখক। চাকমাদের লোকসাহিত্য খুবই সমৃদ্ধিশালী। রাধামন-ধনপুদী পালা, চাদিগাং ছারা পালা, কুগীডর বা চরামিত্ত্যু পালা ও নরধন-নরপুদিপালা, তাহ্লিক শাস্ত্র, শাঙেচ ফুলু তারা, ত্রিপুদুরা, মালমতারা, ৫১টি চাকমা ছড়া, আঘরতারা, পুদুম ফুলু তারা, কদম ফুলু তারা, বুদ্ধ ফুলু তারা, সাঙচ ফুলু তারা, রাকেম ফুলু তারা, ছোট কুরুক তারা, বুদ্ধ ফুলু তারা, সাভাদিঝা তারা, জয়মঙ্গল তারা, আনিজা তারা, সানেক ফুলু তারা, সামেং ফুলু তারা, উদাংপারেত তারা, বুজংগ সূত্র, বরতংদা তারা, রাধামন ধনপুদী পালা (ফুল পারা পর্ব), বিদ্যাসুন্দরপুদী, চান্দবী বার মাস, চাকমা মন্ত্র ফি, সৃত্তি পত্তন, স্বর্গপালা, বুদ্ধপালা, বৌদ্ধ রঞ্জিকা, গোজেনলামা, জ্ঞানপ্রদীপ, কলি চদিঝা, বৈদালী, লদি শাস্ত্র, জ্ঞানভেদ, খঞ্জন বচন, বায়ুভেদ, চাকমা দাগকধা, গোরক্ষ বিজয় পুঁথি, নরপুদীলামা, কাজলপতি বারমাসী, আলসি কবিতা, যুত্তপুদীর বারমাসী, দিনফিউ, কামরতœ ও ঝারা এমন বহু অবিস্মরণীয় প্রাচীন সাহিত্যকর্ম আছে চাকমা সমাজে। পাশাপাশি কবি ফিরিংচানসহ চুনীলাল দেওয়ান, সলিল রায়, মুকুন্দ তালুকদার, ডা. ভগদত্ত খীসা, দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা, ফেলাজেয়া চাকমা, বিজয় কেতন চাকমা, সুহৃদ চাকমা, মৃত্তিকা চাকমা, শিশির চাকমা, শ্যামল তালুকদার, কৃষ্ণচন্দ্র চাকমা, সুগত চাকমা ননাধন, বারেন্দ্র লাল চাকমা, কবিতা চাকমা, সুসময় চাকমা, অমর শান্তি চাকমা, তরুণ কুমার চাকমা, বীর কুমার চাকমা, জগৎ জ্যোতি চাকমা, প্রগতি খীসা, সঞ্জীব চাকমা, সীমা দেওয়ান, কিশলয় চাকমা, রোনাল্ড চাকমা, পদ্মলোচন চাকমা, নিকোলাই চাকমা, রিপরিপ চাকমাদের শিল্পভুবন আমাদের পাঠ করা জরুরি। ত্রিপুরা জাতি কেবল ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষাতে নয়, সাহিত্য আন্দোলনে বাংলাকেও করেছে আপনজন। বিষুকে ঘিরে তঞ্চঙ্গ্যাদের রয়েছে সাহিত্যকর্মের বিশাল ভা-ার। মারমা কবিদের ভেতর ক্যশৈপ্র“, উচহ্লা, মংক্যশোয়েনু নেভী, চ থুই ফ্রু, মংসিংঞ্রো কিংবা উশোপ্রু মারমার কবিতা গুরুত্বপূর্ণ। পাংখোয়াদের ভাষায় প্রবাদ প্রবচনকে থৌংপিং, ধাঁধাকে সিং ইনতেন বা সিং মেথ্রেং বলে। তুইচং ও সুয়ানলু সুয়ানলা পাংখোয়াদের ঐতিহ্যময় লোককাহিনী।
উত্তরবঙ্গের মূলত সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, মাহালী, পাহাড়িয়া, বেদিয়া মাহাতো, কুর্মী মাহাতোদের মুদ্রিত সাহিত্যচর্চার কিছু কিছু হদিস আমরা জানতে পারি। রাজবংশী সংগীতের মধ্যে রয়েছে জাগরণী ভাওয়াইয়া, জাগ, গাজন, হুদুমাগান প্রভৃতি। রাজবংশী সমাজে ছেলে ভুলানো ছড়া, খেলার ছড়া, পারিবারিক-সামাজিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছড়া, ঐন্দ্রজালিক-আচার অনুষ্ঠানমূলক ছড়া, ব্যঙ্গ ছড়া প্রভৃতির প্রচলন রয়েছে। ওঁরাও সমাজে বৈদ্যনাথ টপ্য, অরুণ খালকোর মতো লেখক আছেন। ৭৬৮ সালে ধম্মজেয়ার লেখা লেটঅছেং গীতিকাটিও রাখাইন সাহিত্যের অনন্য কীর্তি। উইধুরা, উইমালা, উককব্যেং, পাইঞাবংশ, সোয়েছের মতো দক্ষিণাঞ্চলের রাখাইন সাহিত্যিকরা ১৭ শতকেই নিজ ভাষায় সৃষ্টি করে গেছেন অমর সাহিত্য। চলতি সময়ে উ তান সিয়েন, সাউ তুন ও, উসিট মং, মং থান ওয়ে, ক্যথিংঅং, মংউসাং, উক্যথিন, অংথিংমং, মংছেনচীং (মংছিন), মংহ্লাপ্র“, তাহান, উএনু, অংক্যচিন, উহ্লামং, উবাচং, উসিট মং, মংছালু লেখকেরা বাংলা-ইংরেজি এবং কেউ কেউ রাখাইন ভাষাতেও লেখালেখি করছেন।
ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর এলাকার মান্দি, কোচ, হাজং, বানাই, ডালু, হদি, রাজবংশী, লেঙাম জনগোষ্ঠীদের ভেতর মূলত মান্দি ও হাজংদের ভেতরেই চলতি সময়ে মুদ্রিত সাহিত্যচর্চা বেশি দেখা যাচ্ছে। মান্দিদের দিগ্গিবান্দি ও শেরানজিংপালা মহাকাব্যদ্বয় এখনো রাষ্ট্রের অধিপতি সাহিত্যবিলাস বিবেচনায় আনেনি। নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ থেকে আদিবাসী সমাজের সাহিত্য দর্পণ ঘোষণা করে প্রায় অনিয়মিত ‘জানিরা’ নামে একটি প্রকাশনা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় মূলত কিছু গান, কবিতা, প্রবন্ধ এবং খুবই গতানুগতিক কিছু আলোচনা থাকে। যার কোনো শ্রেণিদার্শনিক এবং যাপিতজীবনের রাজনৈতিক ভিত্তি ও জোর নেই। মান্দিদের ভেতর জেমস জর্নেশ চিরান, মতেন্দ্র মানখিন, সঞ্জীব দ্রং, জেমস ওয়ার্ড খকসী, বচন নকরেক, বাবুল ডি নকরেক, পরাগ রিছিল, রাখী ম্রং, মিঠুন রাখসামদের কবি ও লেখকরা মূলত বাংলা ভাষাতেই নিজস্ব সাহিত্য আওয়াজ তুলেছেন। তবে কবি ব্যঞ্জন মৃ’র ২০১৭ সালে প্রকাশিত মান্দি ও বাংলায় অনূদিত কবিতার বই ময়ূরব্যঞ্জনা এক্ষেত্রে এক নয়া সংযোজন। ডালুদের অধিকাংশ শিল্পচর্চার কোনো লিখিত রূপ না থাকায় এবং সংরক্ষণের অভাবে কালের আবর্তনে সেইসব চর্চা আজ বিলুপ্তপ্রায়। ব্রিটিশবিরোধী গণচেতনামূলক গানগুলোকে হাজংরা টেংলাগাহেন বলেন। হাজংদের সমাজে প্রচলিত অধিকাংশ ছড়া-কবিতা ও গানের কোনো গীতিকার বা সুরকারের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। ছড়াকে হাজংরা হিংলা বলে। ছেলেভুলানো ছড়া, মেয়েলিছড়াসহ খেলার ছড়াগুলোর পাশাপাশি গীতে প্রেম বিরহ প্রকৃতি বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে। ধাঁধাকে হাজংদের ভাষায় হীলুক বলে। পৌষসংক্রান্তির নিশিরাত জাগরণের সময় হাজং ছেলেমেয়েরা যে উপকথাগুলো বলে থাকে তা নিয়ে লেখক শ্রী হাজং নিখিল রায় ‘জোনাকীর আলো’ নামে একটি বই লেখেন। ১৯৮৬ সালে নেত্রকোনার বিরিশিরিতে অবস্থিত উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি বইটি প্রকাশ করে। সিলেটের আদিবাসীদের ভেতর মূলত মৈতৈ মণিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, খাসি, লালেং, মান্দি, হাজং, লেঙাম এবং চা বাগানের বিশাল আদিবাসী বাগানিয়া জনগণ সাহিত্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন ঐতিহাসিকভাবেই। মৈতৈ মণিপুরী ভাষার বিশিষ্ট কবি একে শেরাম (২০০৮) মণিপুরী সাহিত্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ। মনিপুরী সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের চেয়ে প্রাচীন বলে বিবেচিত। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের মণিপুরী থিয়েটার স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে বেশ লড়াকু নাট্যদল। মৈতৈ এবং বিষ্ণুপ্রিয়া উভয় ভাষায় বহু শিল্পজন দেশের সাহিত্যভুবনকে প্রতিদিন জীবন্ত রাখছেন।
আদিবাসী সাহিত্যের বৈভব নিয়ে আলোচনায় আমাদের প্রথমেই বলতে হচ্ছে বাংলাদেশে আমরা আদিবাসীদের ভাষায় কিংবা বাংলা হরফে বা আদিবাসীদের নিজস্ব হরফ এবং ভাষায় মূলত কবিতা চর্চা করতেই দেখি বেশিরভাগ কবি ও লেখককে। গল্প-উপন্যাস খুব একটা দেখা যায় না। তবে আদিবাসীদের ভেতর অনেকেই গবেষণা প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য, স্মৃতিচারণ, আলোচনা লিখে থাকেন। সম্পূর্ণ চাঙমা বর্ণমালা ও ভাষায় দেবাশীষ চাকমার উপন্যাস ফেবো প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে, এটি প্রকাশ করে পোগাদাঙ, এর প্রচ্ছদ করেছেন হাপং ত্রিপুরা মিলন। এছাড়াও কিছু বাংলায় লেখা গল্প এবং উপন্যাস লিখেছেন কেউ কেউ, বেশকিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাটক এবং নাট্যচর্চা অব্যাহত আছে আদিবাসী ভাষায় এবং আদিবাসী এলাকায়। প্রমোদ সিংহ, চন্দ্রজিৎ সিংহ, এইচ. নানাচা, সোহেল হাজং, ত্রিঝিনাদ চাকমা, পিপিকা ত্রিপুরা ও হরেন্দ্রনাথ সিং মিলে ২০০৯ সালে ‘নৃ-তাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মুখপত্র’ হিসেবে কথা নামে একটি ছোট কাগজ প্রকাশ করেন। কথার ভূমিকায় তারা লিখেছেন, বাংলাদেশের নৃ-তাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় সাহিত্য সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্য রয়েছে। তাদের ভাষা সাহিত্য নিয়ে লেখালেখির চর্চা যে সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে চলে আসছিল, তাকে আরও বেগবান করার উদ্দেশ্যেই মূলত ‘কথা’ প্রকাশ করার উদ্যোগ। পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত পত্রপত্রিকা কিংবা গ্রন্থ দেশের অন্যপ্রান্তের কাছে কোনোভাবে এসে পৌঁছায় না, আবার সিলেট কিংবা ময়মনসিংহ অঞ্চলের মণিপুরী ভাষা, আচিক ভাষা কিংবা হাজং ভাষার পত্র-পত্রিকা কিংবা সাহিত্যচর্চার কোনো খবর গিয়ে পৌঁছায় না দেশের অন্য প্রান্তে, আর সিলেট কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাঠকদের কাছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার কবিতা গল্পের সঙ্গে কোনো পরিচয় নেই, অর্থাৎ একই দেশে থেকেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার লেখক পাঠকদের মধ্যে যোগাযোগ নেই একেবারে। তাছাড়া বাংলাদেশের অপরাপর ভাষার যে সমৃদ্ধ সাহিত্য, কাব্যচর্চা কি গদ্যচর্চার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তা মূলধারার অধিকাংশ পাঠকদের কাছে আজও অজানা। আদিবাসীরা বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় পার্বণ ও উৎসব উপলক্ষে যেসব স্মরণিকা, বিশেষ প্রকাশনা, ছোট কাগজ প্রকাশ করে থাকেন তার অধিকাংশের নামেই বিচ্ছুরিত হয় প্রকৃতি ও প্রতিবেশের বহমান ধারা।
ম্রো ভাষায় ওয়াংনিম মানে বাংলাতে মেঘ। বান্দরবানের মং মং সিং-এর সম্পাদনায় ঞা ঊ ক্রে থেকে ওয়াংনিম নামে একটি ছোট কাগজ বের হয়। ওয়াংনিমের ৩য় বর্ষ ১ম সংখ্যার ভূমিকাতে লেখা হয়েছে, সাহিত্যচর্চা হয় না বলে সাহিত্যমনা জন্ম নেয় না। একটি সুশীল সমাজ বিনির্মাণের আশায় ঞা উ ক্রে জন্ম নেয়। নবীন কলমে সৃষ্টি হয়েছিল বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম। পাঠক সমাজে বিপুল আগ্রহ জাগাতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পাঁচটি সংখ্যার পর এটি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যদি আমরা আদিবাসী সাহিত্যের ওপর থেকে এবং সাহিত্যচর্চাকারীদের যাপিত জীবন থেকে রক্ত-বারুদ আর জলপাই বাহাদুরি সরাই তবেই ওয়াংনিম আর বন্ধ হবে না, চলবে আপন ভাষায় সাহিত্যবিকাশ। আর এই দুঃসহ অধিপতি গরাদ সরাতেও চাই গর্জে ওঠা আদিবাসী সাহিত্য, আদিবাসী সাহিত্যের রাজনৈতিক বিপ্লব। আদিবাসীদের ভেতর যারা নিরন্তর সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন তাদের সৃষ্টি আখ্যানের কোনো রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার এখনো নিশ্চিত হয়নি। রাষ্ট্র ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলতে কেবলমাত্র ‘বাংলা ভাষা ও হরফে রচিত’ সাহিত্যকেই বোঝে এবং বোঝায়। রাষ্ট্রের এই অধিপতি মনস্তত্ত্ব বদলানো জরুরি। প্রতি বছর আদিবাসী ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা জানানো উচিত। আদিবাসী জনগণের ভাষা ও সাহিত্য সুরক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য সম্মাননা’ চালু করার মাধ্যমে মুমূর্ষু ভাষার পাশে ন্যায়পরায়ণতার খ্রাম নিয়ে দাঁড়াক রাষ্ট্র। খ্রাম, দামা, মাদল, প্লু বাজুক আদিবাসী জমিন থেকে জুমে, জুম থেকে বাংলা একাডেমি কি জাতীয় সংসদ অবধি। দেশের ৫০ জাতিসত্তার ৪০টি মাতৃভাষার শিল্পসাহিত্যকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে নিয়েই চলুক জাতীয় সাহিত্যের সর্বজনীন রূপান্তর।
বছর দশেক আগে কয়েক মাসের ব্যবধানে আমি দুইটা দৈনিক-নিবন্ধ লিখেছিলাম, চলতি ভাষায় যাকে কলাম বলা হয়ে থাকে। একটার শিরোনাম ছিল ‘চিলতে হাসির গণতন্ত্র’, আরেকটার ‘রসবোধ আর টিটকিরির ফারাকটা সূক্ষ্ম নয়’। আমার রচনা চাইতেন এমন দুইটা পত্রিকার দপ্তরে পাঠানো ছিল লেখা দুটো, এবং তারা প্রকাশ করেছিলেন। দুটো রচনাতেই মুখ্যত তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর, কিছু ক্ষেত্রে তার পারিষদবর্গের আচরণ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলাম। পারিষদবর্গের গুরুতর রদবদল হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর পদে হয়নি। কিন্তু অস্বীকার করব না যে কাছাকাছি বিষয়বস্তু নিয়ে আমি এখন আর রচনা করতে চাইব না। আমি সাব্যস্ত করেছি যে এমনকি দশ বছর আগের সঙ্গে তুলনা করলেও আরও সন্ত্রস্ত হওয়ার অনুশীলন থাকা দরকার। আমি হতেও শুরু করেছি। ফলে একই রকম বিষয়বস্তুতে আমি আজকের রচনাটি করছি না। এটা স্বতন্ত্র বিষয়। তারপরও যাতে কারও সন্দেহ না থাকে সেই লক্ষ্যে ভেঙে বলছি যে, আজকের এই ক্ষুদ্র রচনাটির বিষয়বস্তু রাজনৈতিক ময়দানের গড়গড়া আচরণবিধি। কোনো নির্দিষ্ট পদাধিকারী বা ব্যক্তিকে মাথায় রেখে এই রচনাটি সাধিত নয়। ওভার অ্যান্ড আউট!
বাংলা অঞ্চল রসালো এরকম একটা ঘোষণা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছিলাম বলে আমার মনে পড়ে। ওদিকে, কপালের দোষ, আমার শিশুকালে আমি মোটের ওপর অত্যন্ত গুরুগম্ভীর একটা শিশু ছিলাম। আমার এখনকার উপলব্ধিতে মনে হয়, আমি যে ধরনের গম্ভীর শিশু ছিলাম তাতে বর্তমান আমার পাল্লায় যদি আমি থাকতাম তাহলে পিটানি না দিয়ে আমাকে মানুষ করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। খুব সহজেই শিশু নির্যাতনকারীর আধুনিক পদবাচ্য আমার কপালে জুটত। গম্ভীর ওই আমিশিশুটির পক্ষে বাংলা অঞ্চলের এই বৈশিষ্ট্যকে ঠিক হৃদয়ঙ্গম করা হয়নি কখনো। যখন রসালো বৈশিষ্ট্য চিনতে খানিকটা শুরু করলাম তখন হতভম্ব হয়ে পড়লাম। লক্ষ করলাম যতই না এখানকার রসঘন বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে লোকে বলতে পছন্দ করুন না কেন, বাস্তবে এখানকার কয়েকটা পেশা ও কাজের বর্গ ভয়াবহ গাম্ভীর্যের একেকটা ডিব্বা উঁচু ক্লাসের শিক্ষক, বিপ্লবী ধারার রাজনীতিবিদ, সাধারণভাবেই রাজনীতিবিদ, সংবাদকর্মী ইত্যাদি। তারা বিপ্লবী ধারার রাজনীতি না-করে এলেও, গত বছরগুলোতে রাষ্ট্র ও সরকারের দুই কর্ণধার ব্যক্তিত্বের মধ্যে রসবোধের পরিচয় পেয়ে আমি ভালো মাত্রার উত্তেজনা বোধ করেছিলাম। তবে এত অজস্র যদি কিন্তু আছে এই রসবোধের মধ্যে যে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলাপ না-করা আমার জন্য মঙ্গল হবে।
রসচর্চার মৌলিক কোনো নীতিমালা নেই। কতটা হলে তা রসিকতা, কতটা গেলে তা টিটকিরি তার কোনো পরিমাপযোগ্য জগৎ নেই। আবার টিটকিরি মাত্রই নির্যাতনমূলক কি না, নির্যাতন হয়ে পড়লে তাকেই বুলিং বা গুণ্ডাগিরি বলে আপনি পার পাবেন কি না তার সর্বজনস্বীকৃত গৃহীত কোনো ব্যবস্থা নেই। যেমন, আপনার শুনতে কোনো কথা দিব্যি মনে হতে পারে গুণ্ডামি বা মাস্তানি হচ্ছে। কিন্তু বক্তা বলে বসতে পারেন ‘আমি কি অস্ত্র নিয়ে এসেছি? গুণ্ডামি আমরা করি না, গুণ্ডামি করে এসেছেন আপনারা।’ তিনি তাহলে ন্যূনতম একটা গুণ্ডামির সংজ্ঞা হিসেবে অস্ত্রধারণকে সাব্যস্ত করেছেন; তার সুবিধামতো। কোনো এক কালে তার সঙ্গে ‘অন্যায়’ হয়েছিল এই কারণটাকে দীর্ঘদিন ধরে গুণ্ডাগিরি করার একটা অজুহাত হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত পরিচিত। স্থানীয় রাজনীতি ময়দানে বিস্তর উদাহরণ যেমন, কেন্দ্রস্থ রাজনীতিতে সবচেয়ে শক্তপোক্ত উদাহরণ পাওয়া যাবে। আপাতত, একটা কাল্পনিক স্থানীয় সংলাপের উদাহরণ হতে পারে এরকম: “অমুক সালের নির্বাচনে আপনারা কী করছেন সবাই জানে; আমাদের ইন্দুরের মতো ধইরা ধইরা পিটাইছেন। জনগণ আপনাদের চিনে রেখেছে। নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে করতে দ্যান। আপনাদের গলায় বিলাইয়ের ম্যাঁও করারও সুযোগ পাবেন না। জনগণ পাড়াইয়া আপনাদের জিবলা বাইর কইরা দেবে।” এই পর্যন্ত শুনে কথিত জনগণের যে অংশ সভাতে আছেন তারা যে বিপুল করতালি দেবেন কেবল তাই-ই নয়, বরং এই দৃশ্যকল্পনাতে ব্যাপক রসিকতা আছে বলেও গণ্য করবেন। এই রকমের ভাষামালা যে কোনো পক্ষ যে কোনো প্রতিপক্ষকেই বাংলাদেশে সুলভ।
কিন্তু অন্যের গলায় পাড়া দিয়ে তার রস নিংড়ে নেওয়ার ব্যবস্থাকে রসচর্চা হিসেবে দেখার সুযোগ আছে কীভাবে? আবার রাজনীতির অঙ্গনের ভাষামালাতে রসবোধের অভাব ছোবড়া-ছোবড়া অনুভূতি দিতে বাধ্য। বাংলাদেশের ভাবগম্ভীর বাম আন্দোলনের ভাষামালার দিকে মনোযোগ দিলে রসের অভাবে সবচেয়ে গুরুগম্ভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরও মনভার হতে বাধ্য। একটা সিরিয়াস লক্ষ্য নিয়ে সমাজবদলের আগ্রহতে এই রাজনৈতিক কর্মীদের গড়পড়তা আলাপ-আলোচনাগুলো বেরসিক হতে হতে ভীতিকর পর্যায়ের হয়ে পড়েছে। বিশেষত, শেষের বছরগুলোতে। পক্ষান্তরে, চলতি রসের জায়গায় এদের রাজনৈতিক ভাষামালাতে হাজির হয়েছে গুরুভার সব জার্গন। এমন সব পদ ও প্রত্যয় যা বহুল ব্যবহারে হয় মলিন হয়েছে, নতুবা সেসব পদপ্রত্যয়ের একটা চলতি রূপকল্পনা শ্রোতাদের পক্ষে আন্দাজ করে নেওয়া কঠিন। গভীরভাবে চিন্তা করলে, বিপ্লবী রাজনীতির এরকম হাস্যরসহীন ভাষামালাতে পর্যবসনকে ঐতিহাসিকভাবে ঠাহর করাও কঠিন। বিশেষত, মার্কসবাদীদের সনাতনী তর্কাতর্কিতে যেরকম উচ্চকিত ঠাট্টা-মশকারা এবং খিস্তিখেউড়সুলভ ছিল।
এই পর্যন্ত বলার পর আমার ঘাড়ে এই দায়িত্বটা বর্তায় যে খিস্তিখেউড় ও ঠাট্টা-মশকারার চর্চাকে আমি কীভাবে দেখি তা স্পষ্ট করা। এটা নিশ্চয়ই খুবই না-হক হবে যে আমি কেবল মার্কসবাদীদের খেউড়কে গ্রহণযোগ্য মনে করি, এবং অন্যদেরটা আপত্তি করি। বিষয়টা আমার জন্য এমন নয়। বরং, রসিকতার একটা জগতে প্রচুর আবছায়া বা ধূসর এলাকা আছে যেখানে খিস্তির গুণপনাকে সহজ কিস্তিতে প্রকাশ করা যায়। চর্চাটা ডেলিকেট। এখানে ‘কী বলা হলো’র থেকে ‘কীভাবে বলা হলো’র অসীম গুরুত্ব। সনাতনী মার্কসবাদী রাজনীতির ধ্রুপদী বইপত্রে যেসব খিস্তিধর্মিতা পাওয়া যায় তার সবগুলোর অন্তরঙ্গ গ্রাহক না হলেও, সিংহভাগই আমার কাছে আকর্ষণীয় লাগে এর সঙ্গে মানানসই সব উপাত্তের কারণে। তাহলে ‘কীভাবে বলা হলো’র টোনালিটি আমার জন্য অত্যন্ত জরুরি জিজ্ঞাসা রাজনীতির ময়দান বুঝতে। অন্তত গলায় পাড়া দিয়ে জিহ্বা বের করার ঘোষণার ভেতরে যে রস আছে সেটাকে প্রতিপক্ষের জন্য প্রয়োগ করার ভাষামালা আমার গুণ্ডাগিরিই লাগে, রস বা শ্লেষ নয়। ঠিক একই ভাবে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অসুস্থতাকে তার ‘খাদ্যাভ্যাসে’র সঙ্গে মিলিয়ে কিছু একটা মন্তব্যকে আমার আর রসিক লাগে না। বরং, সৌজন্য-বিবর্জিত এবং সে সূত্রে বুলিং মনে হয়।
রাজনৈতিক ভাষামালার কুৎসিত উদাহরণ সৃষ্টিতে কিছু সাংসদ বা স্থানীয় রাজনীতিবিদ অন্যদের থেকে যোজন দূরে অবস্থান করছেন। সরল করে বললে, তাদের বাক-আবর্জনা সৃষ্টির সামর্থ্য অন্যদের কুণ্ঠিত, বিপর্যস্ত ও অনীহ করে রাখে। এসব রাজনীতিবিদের এই যোগ্যতার চর্চাকে যারা ‘ব্যক্তিগত’ হিসেবে দেখেন, তাদের সঙ্গে আমার ঘোরতর বিরোধ হবে। আমি এগুলোকে ‘ব্যক্তিগত’ হিসেবে দেখি না। বরং জাতীয়/রাষ্ট্রীয় যে রাজনৈতিক কাঠামো বলবৎ আছে সেখানে তাদের এই ভূমিকা গভীরভাবে কাঠামোগত। ধরা যাক, আমরা একটা কাল্পনিক মন্ত্রিসভার কথা বলছি। সেই মন্ত্রিসভাতে যদি ১০ জনকে নেওয়া হয় ‘স্মিতভাষ্য’ ‘মৃদুহাস্য’ ক্যাটেগরি থেকে, সঙ্গে সঙ্গেই আপনি জেনে যান যে মন্ত্রিসভাতে অন্য ২০ জন থাকবেন ‘কইরা হালামু’ ‘মাইরা হালামু’ ভাষাবর্গের। কীভাবে দুই ক্যাটেগরিতে লোক বাছাই হয় তা নিয়ে বিস্তর ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় না, আমার ব্যাখ্যার জন্য এই নিয়োগগুলো থেমে থাকবে কিংবা আমি ব্যাখ্যা না করলে সরকার বা আপনারা কেউ বুঝতে পারবেন না। ফলে ব্যাখ্যাটা আপনারা নিজেরাই তৈরি করতে পারবেন। এখানে মুখ্য বিষয় হলো কাঠামোগত সামঞ্জস্যবিধান। কেন ও কীভাবে স্মিতহাস্যরা মাইরা-হালামুদের জন্য পরিসর প্রদান করেন সেটা বলতে চাইলাম মাত্র।
এটুকু আলাপের পর আমরা যেন মিডিয়া বা প্রচারমাধ্যমকে (আপনারা গণমাধ্যম বলেন, তো বলুন; আমি আপত্তি করব না আপনাদের অধিকারে) এই বিষয়ে খুব দূরে না দেখতে থাকি। বাস্তবে বুলিং বা গুণ্ডাগার্দির ভাষাকে একটা শিথিল মাত্রায় ‘সহনশীল’ করতে মিডিয়ার ভূমিকা মারাত্মক। এটা বোঝা যাবে ‘টক শো’ নামক অনুষ্ঠানমালাতে ইস্যুর উত্থাপন এবং আলোচকদের সন্নিবেশন থেকে। ইস্যু বাছাইয়ে তারা একটা বেনিফিট অব ডাউট পাবেন, যেহেতু প্রায়শই তারা তথাকথিত ‘সমকালীন’ বিষয়কে বাছাই করেন। এখন একটা রাষ্ট্রে নির্দিষ্ট একটা সময়ে নানাবিধ শর্ত ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে কোনটা যে ‘সমকালীন’ তা বাছাইয়ের নানাবিধ কারিগরি ও জারিজুরি থাকতে পারে। আপাতত সেটা নিয়ে বিশদ না করেও বলা চলে, এই ‘সমকালীনতা’ প্রায়শই ওপরতল্লাশিমূলক। তারপর তারা মেহমানদের দলকে এমনভাবে হাজির করেন যাতে একটা উত্তুঙ্গ কাইজা হাতেনাতে শ্রোতারা পেয়ে যান। কাইজার এই ধরনটা টিভি বা অডিওভিজ্যুয়াল প্রডাক্ট হিসেবে মালিকদের কাছে উৎকৃষ্ট। হয়তো এসব কারণেই পত্রিকার পোর্টালগুলোতেও মন্তব্যের ঘরে অসীম গালমন্দের বন্দোবস্ত আছে। অবারিত অভিব্যক্তির যে জোরদার দাবিনামা মধ্যবিত্ত লিবারেল মানুষজন করতে থাকেন, তার আওতার মধ্যে অনায়াসেই এইসব গালাগালি জায়গা করে নিচ্ছে। কেন্দ্রস্থ রাজনীতিবিদরা বুলিং চর্চা করে চলতে পারছেন এই হুলস্থুলের মধ্যেই। এই বেখাপ্পা আনক্রিটিক্যাল ‘গণতন্ত্রের’ জোস পরিশেষে গুণ্ডাগার্দির পরিবেশ সরবরাহ করতে পারছে। সূক্ষ্ম রস আর শ্লেষের রাজনৈতিক ভাষামালা নিয়ে আপাতত আর আশা না করাই বিবেচকের কাজ হবে।
নদীর সঙ্গে আমাদের সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা প্রভৃতির সম্পর্কের কথা তো তোলাই যায়। কিন্তু নদ-নদী আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে কতটা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে, তার একটি মোক্ষম উদাহরণ হতে পারে ‘ভাতে-মাছে বাঙালি’ প্রবাদটি। প্রবাদটিতে যদিও সংখ্যাগুরু বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নির্দেশ করা হয়েছে, প্রকৃত অর্থে বঙ্গীয় ব-দ্বীপের সব জাতি-গোষ্ঠীর জন্যই এটি সত্য। আর কে না জানে যে, সব সংস্কৃতির আদিতম উৎস হচ্ছে খাদ্য সংস্কৃতি। খাদ্যাভ্যাস থেকেই গড়ে উঠে সভ্যতা ও সমাজের বাকি বিষয়াবলি।
এ দেশে ভাত ও মাছ, দুই প্রধান খাদ্যেরই চূড়ান্ত অনুঘটক নদী। এটা ঠিক, বিল বা সাগরেও মৎস্যসম্পদ রয়েছে; কিন্তু এর যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে নদী। মাছের ধর্ম হচ্ছে, প্রজননকালে আবাসভূমি পরিবর্তন। অর্থাৎ বিলের মাছ নদীতে যায়, কিংবা নদীর মাছ বিলে যায়। যেভাবে সাগরের মাছ ইলিশ প্রজননের জন্য নদীতে আসে আর আমরা ভ্রমবশত পদ্মার ইলিশ বা মেঘনার ইলিশ নাম দিই। নদী না থাকলে এই সংযোগসূত্র ছিঁড়ে যেতে বাধ্য। আবার এই ব-দ্বীপে ধানি ভূমির উর্বরতা রক্ষার মূলে রয়েছে নদী-সিঞ্চিত পলল বা তলানিপ্রবাহ। গভীর-অগভীর নলকূপ আসার পর শুকনো মৌসুমের সেচের জন্য নদী যদিও আগের মতো একমাত্র ভরসা নয়; সেই ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্ভরন ও উত্তোলনযোগ্য স্তর রক্ষায় এখনো সচল নদীর বিকল্প নেই।
আবার আমাদের দেশে নদী-সংস্কৃতির যে রূপান্তর ঘটছে, সেটাও একই প্রবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যেমন : দেশের নদ-নদীর সংকট কী, এই প্রশ্নের জবাবে ছয়টি সংকটের নাম মুখস্থই বলা যায় যে প্রবাহস্বল্পতা, ভাঙন, দখল, দূষণ, বালু উত্তোলন, অপরিকল্পিত স্থাপনা। এসব সংকটের কারণ কী? প্রত্যেকটি সংকট ধরে গুচ্ছ গুচ্ছ অভিসন্দর্ভ লেখা সম্ভব; লেখাও হয়নি কম। কিন্তু এক কথায় যদি উত্তর দিতে হয়, নদীর সব সংকট ও ব্যাধির মূলে রয়েছে সাংস্কৃতিক বিমুখতা।
ছয়টি সংকট ও একটি কারণ, নদ-নদী সম্পর্কিত এই সাতটি প্রপঞ্চ আবার দুষ্টচক্রের মতো পরস্পর সম্পর্কিত। যেমন অপরিকল্পিত স্থাপনা থেকে দেখা দেয় প্রবাহস্বল্পতা। প্রবাহস্বল্পতা থাকলেই একটি নদীতে ভাঙন দেখা দেয়, চর পড়ে। চর পড়া এবং ভাঙন দেখা দেওয়া পরস্পর সম্পর্কিত। চর পড়লে ভাঙন অনিবার্য, আর ভাঙন দেখা দিলে চর পড়া অনিবার্য। চর পড়লে সেখানে দখল হয়; কৃষি, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প স্থাপনা হয়। এসব স্থাপনা থেকে আসে দূষণ। ‘উন্নয়ন’ করার প্রশ্নে আসে বালু তোলার প্রশ্ন। আর সবই ঘটে, আগেই বলেছি, সাংস্কৃতিক বিমুখতার কারণে।
প্রশ্ন হতে পারে, সাংস্কৃতিক বিমুখতা শুরু হয়েছে কখন থেকে? যখন বাঙালির ভাত ও মাছের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক ফিকে হতে শুরু করেছে। যখন কৃষিতে নদী-জলাশয়ভিত্তিক সেচের বদলে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন শুরু হয়েছে, তার সঙ্গে আপদ হিসেবে এসেছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। এতে একদিকে যেমন ভাত গুণ ও স্বাদ হারিয়েছে, অন্যদিকে কৃষিজমি ধোয়া রাসায়নিক ও কীটনাশক জলাশয়ে মৎস্যসম্পদ বিনাশ করেছে।
অনেকে প্রশ্ন করেন, দেশের নদীগুলোর নাম এত সুন্দর কেন? সন্ধ্যা, সুগন্ধা, তিতাস, মালঞ্চ, সোনাভরি, সুরমা, কুহেলিয়া কোথায় পেল তাদের নাম? এর মূলে রয়েছে উপযোগিতা। জীবনদায়ী সুপেয় পানি নদী ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যেত না বলেই সবচেয়ে সুন্দর নামটি নদীর জন্যই বরাদ্দ থাকত। শুধু সুপেয় পানি নয়; সেচ, পলল ও মৎস্যসম্পদের কথা আগেই বলেছি, প্রাথমিক যুগে নৌপথই ছিল যাতায়াত ও বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম। আজও গৃহস্থালি ও শিল্প-কারখানার পানি নদী থেকেই আসে। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে চিত্তবিনোদনে নদীর উপযোগিতা। সাংস্কৃতিক বিমুখতার কারণে এসব উপযোগিতা উপেক্ষিত হতে থাকে।
নদীর ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক বিমুখতার একটি প্রতীকী চিত্র দেখা যায় বুড়িগঙ্গা পাড়ে আহসান মঞ্জিল এলাকায় গেলে। নবাবি আমলের ওই স্থাপনা নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। আর আশপাশে পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা বাকি সব স্থাপনা নদীর দিকে পেছন ফিরিয়ে দাঁড়ানো। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, আমরা কীভাবে নদীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি।
আর নদীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নদী বা জলাভূমি দখলের যে মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠে, সেখানে ধরে নেওয়া হয় অবিলম্ব লাভ ও মুনাফাই উত্তম। এটা অনেকটা কৃষকের সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গল্পের মতো। প্রতিদিন একটি করে ডিম পাওয়ার পর লোভী কৃষক ভেবেছে ওই হাঁসের বুক চিড়ে সব সোনার ডিম একদিনে বের করে নেবে। বাস্তবে দেখো যেখানে নাড়িভুঁড়ি ছাড়া কিছু নেই।
আমাদের নদীগুলো এক-একটি সোনার ডিম পাড়া হাঁস। আবহমানকাল থেকে এখানকার ভূমি গঠন করেছে, এখনো করে চলেছে দক্ষিণে; সেই ভূমির সভ্যতা, সমাজ, সংস্কৃতি, যোগাযোগ, খাদ্যাভ্যাস, উৎপাদনব্যবস্থা, যোগাযোগ, এককথায় প্রকৃতি থেকে প্রতিরক্ষা সবই গড়ে তুলেছে। এখন আমরা ভাবছি, নদীর বুক চিড়ে লাখো কোটি বছরের সম্পদ এক দিনে বের করে নেব। কিন্তু তাতে যে শুধু মুখ ব্যাদান করে থাকা দুর্যোগ ছাড়া কিছুই মিলছে না, এরই মধ্যে তা স্পষ্ট।
নদী থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি দিয়ে আরও স্পষ্ট বোঝানো যায়। যেমন নদী থেকে বালু তোলার মাধ্যমে সেটার মৎস্যসম্পদ, জল-কাঠামো নষ্ট করা হয়। আবার সেই বালু দিয়ে দখল ও ভরাট করা হয় অন্য কোনো নদী বা জলাভূমি। আবার নদী ও জলাভূমি দখল করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ব্যক্তিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক ভারসাম্য এবং অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে। তখন তিনি আইন ও সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিপুল বিক্রমে নদী দখল ও দূষণ চালিয়ে যেতে থাকে।
নদী সংস্কৃতি ও তার ব্যবহারিক মূল্য তখন তার বা তাদের কাছে কৌতুকের বিষয় মাত্র।
আগের ইনিংসের মতোই ব্যর্থ উসমান খাজা। পারেননি ডেভিড ওয়ার্নারও। প্রথম ইনিংসের দুই সেঞ্চুরিয়ানও ফিরে গেছেন। দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিংয়ে তাই খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই অস্ট্রেলিয়া। তবুও তৃতীয় দিন শেষে এগিয়ে আছে তারা।
ওভালে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতকে ২৯৬ রানে আটকে দেওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ উইকেট হারিয়ে ১২৩ রান করে অসিরা। এগিয়ে আছে ২৯৬ রানে।
দ্বিতীয় ইনিংসে বোলিংয়ের শুরুটা ভালো করেছে ভারত। অস্ট্রেলিয়াকে চেপে ধরেছে তারা।
দুই ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার ও উসমান খাজা ফেরেন ২৪ রানের মধ্যেই। মারনাস লাবুশান ও স্টিভেন স্মিথের ৬২ রানের জুটি ভাঙেন রবীন্দ্র জাদেজা, পরে ট্রাভিস হেডকেও ফেরান এই স্পিনার। টেস্ট ক্যারিয়ারে অষ্টমবারের মতো স্মিথকে আউট করেছেন জাদেজা।
তৃতীয় দিন শেষে মারনাস লাবুশানের সঙ্গে অপরাজিত আছেন ক্যামেরুন গ্রিন।
সংক্ষিপ্ত স্কোর: অস্ট্রেলিয়া: ৪৬৯ ও ৪৪ ওভারে ১২৩/৪ (লাবুশেন ৪১*, স্মিথ ৩৪; জাদেজা ২/২৫, উমেশ ১/২১)ভারত ১ম ইনিংস: ৬৯.৪ ওভারে ২৯৬ (রাহানে ৮৯, শার্দূল ৫১, জাদেজা ৪৮; কামিন্স ৩/৮৩, গ্রিন ২/৪৪, বোল্যান্ড ২/৫৯)।
আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিজের পালন করা সাড়ে ২১ মণ ওজনের গরু উপহার দিতে চেয়েছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার চরকাউনা গ্রামের সাধারণ কৃষক বুলবুল আহমেদ ও তার স্ত্রী ইসরাত জাহান। তাদের এই ভালোবাসার প্রতি সম্মান জানিয়ে উপহারের এই গরু গ্রহণে সম্মতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
শুক্রবার (৯ জুন) সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি কৃষিবিদ মশিউর রহমান হুমায়ুন বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী উপহারের গরু গ্রহণে সম্মতি দেন।
প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী খুশি হয়েছেন এবং এই বিরল ভালোবাসার জন্য বুলবুল আহমেদ ও তার স্ত্রীকে ধন্যবাদ দেন।
হাসান জাহিদ তুষার জানান, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা এই গরু বুলবুল আহমেদের নিজ বাড়িতেই থাকবে এবং সেখানেই কোরবানি হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোরবানির গরুর মাংস স্থানীয় দরিদ্র-অসহায় জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
গরুটি ক্রস ব্রাহমা প্রজাতির। এতে আনুমানিক ৮০০ কেজি মাংস হতে পারে বলে জানিয়েছেন বুলবুল আহমেদ। বুলবুল জানান, ২০২০ সালে নেত্রকোনা জেলা থেকে আড়াই লাখ টাকায় প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেওয়ার জন্য তিনি এই গরু কেনেন। গরু কেনার পর কিশোরগঞ্জের বিখ্যাত পাগলা মসজিদে পাঁচ হাজার টাকা মানতও করছিলেন তিনি যেন তার গরুটি সুস্থ থাকে।
তিনি আরও জানান, তিনি ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে মাঠকর্মী হিসেবে কর্মরত তার স্ত্রী ইসরাত জাহান আওয়ামী লীগ সরকারের একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্প থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে এবং নিজের জমানো টাকা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্য এই গরু কেনেন। তারা গত তিন বছর গরুটির নিবিড় পরিচর্যা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আবেগ ও ভালবাসা থেকে তারা এই গরু ক্রয় ও লালন পালন করেছেন বলে জানান।
উপহার হিসেবে তার গরুটি গ্রহণ করার সম্মতি দেওয়ায় বুলবুল আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। বুলবুল আহমেদ কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
বেশ ক'দিন তীব্র তাপদাহের পর গতকাল রাজধানী ঢাকাজুড়ে হয়েছে স্বস্তির বৃষ্টি। এতে তাপমাত্রা এসেছে কমে, পরিচ্ছন্ন হয়েছে পরিবেশ। তবুও আজ সকালে বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষ পাঁচে আছে ঢাকা। বৃষ্টিধোয়া রাজধানী ঢাকা আজ সকাল সাড়ে ৮টায় ১৫৫ স্কোর নিয়ে দূষণের তালিকায় চতুর্থ।
আজ শনিবার (১০ জুন) সকাল সাড়ে ৮টায় বায়ুমানের সূচক (একিউআই) অনুযায়ী ঢাকায় বাতাসের স্কোর ছিল ১৫৫। বায়ুর মান বিচারে এ মাত্রাকে 'অস্বাস্থ্যকর' বলা হয়। একই সময়ে একিউআই স্কোর ১৬৮ নিয়ে প্রথম অবস্থানে আছে পাকিস্তানের লাহোর। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভিয়েতনামের হ্যানয়, স্কোর ১৫৬। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইসরায়েলের তেলআবিব। আর পঞ্চম স্থানে আছে চীনের শেংডু, স্কোর ১৪৯।
একইসময়ে ১৩৮ স্কোর নিয়ে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহেনেসবার্গ। ১৩২ স্কোর নিয়ে সপ্তম স্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। অষ্টম নেপালের কাঠমান্ডু, স্কোর ১২৭। ১১৮ স্কোর নিয়ে নবম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট আর ১১৭ স্কোর নিয়ে দশম সৌদি আরবের রিয়াদ।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার দূষিত বাতাসের শহরের এ তালিকা প্রকাশ করে। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই স্কোর একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের কোনো ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে কি না, তা জানায়।
তথ্যমতে, একিউআই স্কোর শূন্য থেকে ৫০ ভালো হিসেবে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ মাঝারি হিসেবে গণ্য করা হয়। আর সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত 'অস্বাস্থ্যকর' হিসেবে বিবেচিত হয়। একইভাবে একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে থাকলে 'খুব অস্বাস্থ্যকর' এবং স্কোর ৩০১ থেকে ৪০০ এর মধ্যে থাকলে 'ঝুঁকিপূর্ণ' বলে বিবেচিত হয়।
ষাটের দশকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের আগুন তরুণদের বুকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠান ক্ষেত্র তৈরি করতে গড়ে তুলেছিলেন ‘নিউক্লিয়াস’। স্বাধীনতার পর তিনি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের বাঁধভাঙা ঢেউ তুলেছিলেন। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সবকিছু থেকে দূরে আড়ালে চলে যান। রাজনীতিতে তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল রহস্য। সেই রহস্য নায়ক সিরাজুল আলম খান চলে গেলেন চিররহস্যের দেশে।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠক গতকাল শুক্রবার দুপুর আড়াইটার কিছু পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক।
সিরাজুল আলম খানের ব্যক্তিগত সহকারী রুবেল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অসুস্থ অবস্থায় তাকে রাজধানীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে প্রথমে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে গত ১ জুন নেওয়া হয় আইসিইউতে। এরপর গত বৃহস্পতিবার রাতে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন সিরাজুল আলম খানের জন্ম নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে, ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি। তার বাবা খোরশেদ আলম খান ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন গৃহিণী ছিলেন। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সিরাজুল আলম খান।
১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদক হন সিরাজুল আলম খান। ১৯৬৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করেন।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান (মান্না), জনসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণ অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক (নুর)।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তার আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান তিনি। শোক জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন সংগঠন।
প্রয়াত সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠ ও নাট্য পরিচালক সাকিল সৈকত দেশ রূপান্তরকে বলেন, সিরাজুল আলম খানের মরদেহ বিকেলে হাসপাতাল থেকে মোহাম্মদপুরের আল-মারকাজুলে নেওয়া হয়েছে। সেখানে গোসল শেষে রাতে শমরিতা হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে। আজ শনিবার সকাল ১০টায় বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে জানাজা শেষে নোয়াখালীতে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে পুনরায় জানাজা শেষে বেগমগঞ্জের আলীপুরে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হবে রাজনীতির এ নায়ককে।
১৯৪১ সালে জন্ম নেওয়া এ কিংবদন্তি রাজনীতিককে বিগত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত হাসপাতালে যেতে হয়েছে। দেশে এবং বিদেশে দীর্ঘ সময় চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি।
জন্মের কয়েক বছর পর পিতার চাকরির সুবাদে সিরাজুল আলম খুলনায় চলে যান। ১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে এসএসসি ও ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অনার্স ডিগ্রি অর্জনের পর কনভোকেশন মুভমেন্টে অংশ নেওয়ার কারণে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনায় ১৯৬২ ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। পরে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা। বঙ্গবন্ধুরও ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন এ ছাত্রনেতারা। ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন সিরাজুল আলম খান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন তিনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি কখনো নেতৃত্বে না এলেও জাসদ নেতাদের পরামর্শ দিয়ে তাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে খ্যাতি পান। অনুসারী সবাই তাকে ‘দাদা ভাই’ নামেই ডাকতেন।
মূলত নব্বইয়ের দশকে সিরাজুল আলম খান কখনো জনসমক্ষে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন না; আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিতি পান। নব্বই পর্যন্ত একাধিকবার জেল-জুলুম খেটেছেন তিনি।
দাদা ভাইয়ের মৃত্যুত গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চেয়ারপারসন অধ্যাপক আলতাফুন্নেসা, গণফোরাম একাংশে সভাপতি মোস্তফা মোহসিন মন্টু ও সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান।
ব্রাজিলের সান্তোস থেকে বার্সেলোনায় খেলতে এসেছিলেন নেইমার। তখন কাতালানদের মধ্যমণি আর্জেন্টাইন অধিনায়ক লিওনেল মেসি। দুই দেশের রাজনৈতিক বিরোধ চরমে। তবু সেসবকে পাশ কাটিয়ে দুজনে হয়ে ওঠেন বন্ধু।
ক্যাম্প ন্যু ছেড়ে নেইমার পাড়ি জমিয়েছিলেন প্যারিসে। তবুও বন্ধুত্ব ছিল অটুট। তার টানেই মেসিকে যখন বার্সা ছেড়ে দেয়, তখন এই ব্রাজিলিয়ান পার্ক দে প্রিন্সেসে ভেড়াতে মধ্যস্ততা করেন।
পিএসজির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে মেসির। কিংবদন্তি এই ফুটবলার এবার ফুটবল ছেড়ে যাচ্ছেন সকার খেলতে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ইন্টার মায়ামির হয়ে মাঠ মাতাবেন তিনি।
মেসি নিজে সেই ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত তার দলবদল নিয়ে চলছিল নানা নাটকীয়তা। সেই সব রহস্যময় দিনগুলোতে নেইমার কি জানতেন মেসির ঠিকানা হতে চলেছে কোনটা?
এক সাক্ষাৎকারে নেইমার বলেছেন, 'আমি জানতাম মেসি মায়ামিতে যাবে (হাসি)।'
তারপর নেইমার যোগ করেন, 'মেসি আমার সেরা বন্ধুদের একজন। সে আমাকে দারুণ সব মুহূর্ত উপহার দিয়েছে। আমি তার সঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছি এটা আমার সৌভাগ্য। আমি জানতাম সে মায়ামিতে যাচ্ছে, এ নিয়ে আমার সঙ্গে তার কথাও হয়েছে। শহর ও জীবনযাত্রার কারণে মেসি সেখানে দারুণ সময় কাটাবে, এটা তাকে বলেছিলাম। আমি নিশ্চিত তার পদচারণায় দেশটির লিগে আসবে আমুল পরিবর্তন।'
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের মেয়ে অর্পিতা শাহরিয়ার কবির মুমুর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (৮ জুন) রাতে বনানীর বাসা থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। রাতেই পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করেছে পুলিশ।
তবে কী কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।
শুক্রবার সকালে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বনানীর একটি বাসা থেকে অর্পিতা শাহরিয়ার কবির মুমুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়, যা ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। পরে রাতেই পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।
এর আগে, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে স্ত্রী হারান শাহরিয়ার কবির।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের মেয়ে অর্পিতা শাহরিয়ার কবির মুমুর (৪১) ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মৃত্যুর আগে তিনি চিরকুট লিখে গেছেন। তবে সেখানে কি লেখা আছে তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি।
বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর মহাখালীর আমতলী এলাকার বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। রাতেই পরিবারের দাবির প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়ায় মরদেহ হস্তান্তর করেছে পুলিশ। বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. জাহাঙ্গীর আলম। পুলিশের ধারণা, অর্পিতা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ বাসা থেকে লাশটি উদ্ধার করে। পরে স্বজনের অনুরোধে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়।
জানা গেছে, লন্ডনে আইন বিষয়ে পড়ালেখা করতেন অর্পিতা। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মা ফাতেমা কবিরের মৃত্যুর কারণে তিনি দেশে আসেন। এরপর দেশেই ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পর মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ ছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার তার লণ্ডনে ফেরার কথা ছিল। মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া একটি চিরকুটে (সুইসাইড নোট) তিনি আত্মহত্যার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
মেয়ের মৃত্যুতে শোকে বিবহবল লেখক–কলামিস্ট শাহরিয়ার কবির গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। তবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল বলেন, রাজধানীর মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে অর্পিতাকে তাঁর মায়ের কবরে দাফন করা হয়েছে। রবিবার তাঁর কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’