যেখানে টাকা সেখানেই দালাল, প্রতারক। দেশের এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে দালালদের দৌরাত্ম্য নেই। যে কারণে দেখা যায়, দেশের সহজ-সাধারণ মানুষ, যারা একটু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন তারাও একসময় নিজেকে প্রতারিত হিসেবে আবিষ্কার করছেন। একই সঙ্গে বিদেশের মাটিতে কী যে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের, কেবল ভুক্তভোগীই জানেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সোয়া কোটি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা গালফ রিসার্চ সেন্টারের এক প্রতিবেদন বলছে, কেবল সৌদি আরবের শ্রমবাজারেই ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১১ থেকে ২১ লাখ। আর বিশ্বের ১৭৬টি দেশে কর্মরত রয়েছেন ১ কোটি ৪৯ লাখের বেশি কর্মী। এই তারাই ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ২১১ কোটি ৩১ লাখ টাকা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে রেমিট্যান্স।
প্রবাসীদের কষ্ট, হয়রানি আর বিড়ম্বনার শেষ নেই। তাদের বলা হয় ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’। কিন্তু এই যোদ্ধাদের সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সোমবার দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত ‘প্রবাসীদের চোর-পুলিশ জীবন’ প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও অভিবাসী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সজীব বালা জানাচ্ছেন, সম্প্রতি সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিকরা অনেক বেশি প্রতারিত হচ্ছেন। দুই দেশের কর্র্তৃপক্ষ অবৈধ প্রবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে। অনেক অবৈধ প্রবাসী বাংলাদেশিও আটক হয়েছে। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পোশাক রপ্তানি আয়ের পরই ‘রেমিট্যান্স’ বাংলাদেশের প্রধান আয়ের উৎস। শ্রমবাজার সংশ্লিষ্টদের দায়সারা কর্মকা-ের কারণে কিছু এজেন্সি ও দালাল অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে প্রতারণা করছে। জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, ২৬ দেশের কারাগারে বাংলাদেশের ৯ হাজার ৩৭০ শ্রমিক ও প্রবাসী আটক রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি আটক রয়েছেন সৌদি আরবে ৫ হাজার ৭৪৬ জন। সৌদি আরবে এখন বাংলাদেশের শ্রমিকদের অনেকেই দুঃসহ জীবন পার করছে। এর মূলে রয়েছে দালালরা। তাদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব অনেক প্রবাসী শ্রমিক। বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক নতুন করে প্রবাসীর তালিকায় যুক্ত হলেও সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এর জন্য দক্ষ শ্রমিকের অভাব এবং দালালের খপ্পরে পড়ে কাজ না পেয়ে বেকার থাকাকে দায়ী করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৫৪ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ৩৭৬ কোটি ডলারে নেমে আসে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪২ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯০ কোটি ডলারের বেশি। এইভাবে অন্যান্য দেশ থেকে যদি রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে থাকে, তাহলে আমাদের অর্থনীতির সূচক যে পর্যায়ে যাবে সেই কথা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। কারণ এর প্রভাব পড়বে বাজার ব্যবস্থাপনায়। বাড়বে দ্রব্যমূল্য। অবনতি হবে আইনশৃঙ্খলার। এককথায়, দেশের সামাজিক কাঠামো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। ফলে এখনই সময়, এই ধরনের দালাল-প্রতারকদের আইনের মুখোমুখি করে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। দালালদের এই ধরনের প্রতারণা নতুন নয়। শুধু সৌদি আরব নয়, বিশ্বের অনেক দেশে হাজার হাজার শ্রমিক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, আবাসন, শ্রম ও সীমান্ত আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে এখন পর্যন্ত ২৩ হাজার ৪০ জন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত দুই বছরের বেশি সময়ের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চসংখ্যক গ্রেপ্তারের ঘটনা। এইভাবে দালালদের কারণে যেন আর কোনো শ্রমিককে গ্রেপ্তার, কারাবরণ বা দেশে শূন্যহাতে ফিরতে না হয়। তাদের নীরব যন্ত্রণার কথা আমরা কজনই বা জানি? যারা একবুক স্বপ্ন নিয়ে, সহায়-সম্বল বিক্রি করে বিদেশে যান একটু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য, তারা কেন দেশে ফিরে আসছেন, কেন রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে- এসব বিষয়ে সুষ্ঠু পর্যালোচনা করা দরকার। যারা দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশের কারাগারে বন্দি রয়েছেন তাদের ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে দালাল শ্রেণির প্রতারণা যে করেই হোক বন্ধ করা দরকার। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে কোনো সমস্যাই ‘সমস্যা’ না।