বোরো চাষাবাদের গোটা মৌসুম জুড়েই ছিল তীব্র খরা। যে কারণে সেচভিত্তিক বোরো চাষে এ বছর ডিজেল ও বিদ্যুতে খরচও বেশি পড়েছে। ফলে তুলনামূলক উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে। তীব্র খরায় বোরোর জমি ফেটে চৌচির হয়েছিল, ছিল রোগবালাইও। শত প্রতিকূলতার মাঝে চাষিদের বোরোর চাষাবাদ করতে হয়েছে। এখন চলছে বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ের ভরা মৌসুম। তীব্র তাপপ্রবাহের পর যদিও দেশের কোথাও কোথাও এখন বৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে বড় আতঙ্ক হলো শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া। দেশের অনেক জায়গায় শিলাবৃষ্টি হওয়ায় পাকা ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষকের যেন দুর্দশার শেষ নেই! এর ওপর আবার ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’র মতো কৃষি শ্রমিকের সংকটে পাকা ধান যথাসময়ে কৃষক কেটে ঘরে তুলতেও পারছে না। আবার একদিকে তীব্র তাপপ্রবাহে কৃষি মজুরদের মাঠে কাজ করতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এমনকি ধান কাটতে গিয়ে জমিতে হিট স্ট্রোকে কৃষি মজুরের মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। ফলে বাড়তি মজুরি দিয়েও ধান কাটার মজুর সহসাই মিলছে না। অন্যদিকে বৃষ্টিতে ফসলহানির সম্ভাবনা তো আছেই।
অথচ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তায় বোরো চাষাবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। একমাত্র সেচভিত্তিক বোরো চাষাবাদের বদৌলতে খাদ্য নিরাপত্তা অনেকাংশেই নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। যদিও বোরো চাষাবাদের অন্যতম নিয়ামক পানির সংকট দিন দিন বেড়েই চলছে। দেশের নদী-নালা খাল-বিলে এখন আর আগের মতো পানি নেই। একমাত্র ভরসা ভূগর্ভস্থ পানি। সেখানেও বিপত্তি, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। আগে যেখানে ২৫-৩০ ফুট গভীরে নলকূপে পানি পাওয়া যেত, এখন সেখানে ন্যূনতম ৫০-৬০ ফুটের নিচে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা উত্তরাঞ্চলসহ দেশের সর্বত্রই। বিশেষ করে নওগাঁ-রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের অবস্থা খুবই খারাপ। যেখানে দেড়-দুই হাজার ফুটের গভীর ছাড়া পানি মিলছে না। এসব কারণে নিকট ভবিষ্যতে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে বোরোর চাষাবাদ নির্বিঘ্নে করা যাবে, তাও মনে হচ্ছে না। যে কারণে কৃষিবিজ্ঞানীদের অভিমত, বোরোর চাষাবাদের পরিমাণ কমিয়ে এনে প্রাকৃতিক পানিতে আমন-আউশের চাষাবাদ বৃদ্ধি করতে হবে। বাস্তবে আমন-আউষের চাষাবাদ বৃদ্ধি করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, যা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এসব বিবেচনায় স্বল্প পানিতে বোরো ধান উৎপাদনের দিকে কৃষি বিজ্ঞানীদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা খাতকে শক্তিশালী করতে হবে। এ জন্য সরকারকে গবেষণা খাতে ব্যয়-বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। স্মরণে রাখতে হবে, এমনিতেই বসতবাড়ি, হাটবাজার, অফিস-আদালত, নগরায়ণ, রাস্তাঘাটের উন্নয়নে প্রতি বছরই আবাদি জমির প্রায় এক শতাংশ করে কমে আসছে। অথচ মানুষ বাড়ছে সমানে।
স্বস্তির জায়গা হচ্ছে, দেশের নদী অববাহিকায় সুবিশাল চরাঞ্চলে এখন ধান, পাট, গম, ভুট্টা, আলু ও নানা জাতের সবজির ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। যদি বালু মিশ্রিত দো-আঁশ মাটিতে স্বল্প সেচ উপযোগী উচ্চ ফলনশীল বা হাইব্রিড জাতের ধান উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়, তাহলে চরাঞ্চল হতে পারে খাদ্য নিরাপত্তার আর এক ঠিকানা। যেমন এখন কুড়িগ্রামের নদী অববাহিকায় প্রায় চারশ চরে ব্যাপকভাবে ভুট্টার চাষাবাদ হচ্ছে। ভুট্টার তৈরি আটা গমের যেমন বিকল্প হতে পারে, তেমনি ভুট্টার আটা যথেষ্ট পুষ্টিসমৃদ্ধ। নানা কারণে দেশে গমের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় বছরের চাহিদার ৭০-৮০ লাখ মেট্রিক টন গমের প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। যেখানে আমদানি করতে খরচ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। অথচ গমের উৎপাদন বাড়ানোর মতো যথেষ্ট সুযোগ থাকার পরও শুধু সরকারি উদ্যোগের অভাব এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে গমের কাক্সিক্ষত উৎপাদন হচ্ছে না। যে স্থান দখলে নিচ্ছে ভুট্টার চাষাবাদ। আমরা মনে করি, সরকারকে গম আমদানির নির্ভরতা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে গমের উৎপাদনের দিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া জরুরি।
আগেই বলেছি, যে চাষাবাদই করি না কেন সব ক্ষেত্রেই কম- বেশি পানির প্রয়োজন পড়বে। পানির এ প্রয়োজনকে গুরুত্ব না দিয়ে কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য দেশের ছোট-বড় সব নদী-নালাকে খনন করে গভীর করতে হবে। যেন বর্ষা মৌসুমের পানি সংরক্ষণ করে চাষাবাদ করা যায়। এ জন্য সরকারকে পানি খাতকে সমৃদ্ধ করতে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে নদী-নালায় পানি সংরক্ষণ করতে হবে। এমনকি ভূগর্ভস্থ পানির আধারকে ধরে রাখতে নদী-নালা ও বৃষ্টির পানি ধরে রেখে খাবার উপযোগী করে নগর-মহানগর-পৌরসভা, উপজেলা পর্যায়েও সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পানির অপর নাম জীবন। যা শুধু পানের জন্যই নয়, বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক খাদ্য উৎপাদনে পানি জীবন রক্ষারও অবলম্বন। এ অবলম্বনকে নির্বিঘ্ন করতে জনসচেতনতাও জরুরি। অর্থাৎ পানির অপচয়ও রোধ করতে হবে।
কৃষি মজুরের সংকটের কথা লিখতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকতার খাতিরে অনেক কথাই লেখা হলো। স্বস্তির খবর হচ্ছে, ইতিমধ্যেই ধান কাটা-মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ছে। বিশেষ করে করোনা ভাইরাসের সময়ে শ্রমিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় হাওরের পাকা ধান কাটতে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়। ফলে ধান কাটা-মাড়াইয়ের জন্য যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু প্রচুর পরিমাণ শুল্ক দিয়ে একটি ধান কাটা-মাড়াইয়ের মেশিন কিনতে টাকার প্রয়োজন পড়ে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। এত বেশি দামে আধুনিক মেশিন কেনা কৃষকদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে স্বল্প খরচে যেন ধান কাটা-মাড়াইয়ের মেশিন চাষিরা কিনতে পারে সে উদ্যোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীরা। তারা সফলও হন। তারা ধান কাটা-মাড়াইয়ের জন্য আন্তর্জাতিকমানের হেডার হোল মডেলের কম্বাইন্ড হারভেস্টার উদ্বোধন করে তা বিপণনও শুরু করেন। ইতিমধ্যেই ধান কাটা-মাড়াইয়ের জন্য অতি হালকা বহনযোগ্য রিপার মেশিনও খুব অল্প টাকায় চাষিরা কিনে ধান কাটার কাজও শুরু করেছেন। তবে এসবের ব্যবহার এখনো সীমিত পর্যায়েই রয়ে গেছে।
লেখক : কৃষি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক