সড়ক চলাচলে নিশ্চয়তা নেই সুস্থ জীবনের। দুর্ঘটনায় যে মানুষ গুরুতর আহত বা নিহত হন কেবল তার পরিবারই জানে, কী দুর্বিষহ বন্ধুর পথ পার করতে হয়। এজন্য কারও কোনো জবাবদিহিতা নেই। দূরপাল্লার বাসের কথা আলাদা। এক-দুই দশক আগেও রাজধানীতে দেখা গেছে, অনেক টাউন সার্ভিসে নিয়ম ছিল, লাইন ধরে টিকিট কাটার। গাড়িতে যত সিট, ততজন যাত্রী। নির্ধারিত ভাড়ায় যাত্রী যাচ্ছেন। গাড়ি থামছে, নির্দিষ্ট স্টপেজে। কিন্তু হঠাৎ করেই তা বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক বছর আগেই, চালক ও কন্ডাক্টরের নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকাসাপেক্ষে বাস চালানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। রহস্যজনক কারণে তাও বন্ধ হয়ে যায়। নিরাপদ সড়কের জন্য ৫ বছর আগে দেশ কাঁপানো আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তখন সরকারের পক্ষ থেকে সড়ক নিরাপদ করতে নানা আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তবে বাস্তবতা ভিন্ন।
বর্তমানে টাউন সার্ভিসের কোনো গাড়ি ট্রাফিক পুলিশকে নিয়মিত চাঁদা দেওয়া ছাড়া রাস্তায় বের করতে পারে না। এখানেই শেষ নয়। প্রতিদিন দেখা যায়, যেখানে সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয়। তখন লাইসেন্সের ভেতরে ভাঁজ করে ২০০-৩০০ টাকা দেন চালক বা কন্ডাক্টর। গাড়ির সমস্যা শেষ! সড়কে চলতে থাকে গাড়ি। যে কারণে আইনের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই পরিবহন শ্রমিকদের। কেন নেই, সেটা কমবেশি সবাই জানেন। কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জানা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চালক ও হেলপার পালিয়ে গেছে। তখন আটক করা হয় গাড়িটিকে। পাঠিয়ে দেওয়া হয় ডাম্পিংয়ে। সেখান থেকে গাড়ি ছাড়িয়ে আনা হয়। বনিবনা না হলে, গাড়ি থানায় জমতে থাকে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে চালকের কঠোর শাস্তি হয়েছে, বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে, এমন জানা নেই। এ বিষয়ে রবিবার দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত হয়েছে, ‘শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ সড়ক আইন পাস হচ্ছে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী’ প্রতিবেদন। প্রশ্ন হচ্ছে, আগের আইন কি অপূর্ণাঙ্গ ছিল! সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির চিকিৎসা সম্পর্কে বলা হচ্ছে ‘কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিলে সংশ্লিষ্ট মোটরযান চালক, কন্ডাক্টর বা তাহাদের প্রতিনিধি তাৎক্ষণিকভাবে দুর্ঘটনা সম্পর্কে নিকটস্থ থানা এবং ক্ষেত্রমত ফায়ার সার্ভিস, চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র বা হাসপাতালকে অবহিত করিবেন এবং আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির জীবন রক্ষার্থে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিকটস্থ চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র বা হাসপাতালে প্রেরণ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ এই আইন থাকা সত্ত্বেও এ পর্যন্ত কোনো সড়ক দুর্ঘটনার পর এমনটি হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিআরটিএর তথ্যমতে, প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে ১৪ জন। আমাদের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৪৯৫টি। এসব দুর্ঘটনায় কমবেশি ৫ হাজার ২৪ জন মানুষ মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন ঠিক সেরকম একটি সংখ্যা।’ দেখা যাচ্ছে, ৫৪৯৫টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫০২৪ জন! এর মানে দুর্ঘটনা মানেই মৃত্যু। আর এসব মৃত্যুর বিচারে কী ধরনের রায় হয়েছে? অথবা আদৌ কোনো সমাধান হয়েছে কি না?
নতুন আইনে চালক-সহকারী, পরিবহন মালিক এবং ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিসহ সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অর্থাৎ কে কোন দায়িত্বে থাকবেন এবং কোন ধরনের গাফিলতিতে কী ধরনের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে, সবকিছুই পরিষ্কার করা হয়েছে। জানা যাচ্ছে, আইনের বিভিন্ন ধারায় সাজা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি দুটি ধারা অজামিনযোগ্য থেকে জামিনযোগ্য করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে বিদ্যমান আইনের অন্তত ১২টি ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইনে বলা আছে, কোনো মোটরযানের কারণে দুর্ঘটনায় কেউ আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিংবা মারা গেলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ বা চিকিৎসা খরচ দিতে হবে। কতজনকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে! যে আইন রয়েছে, তা কি পুরোপুরি সততার সঙ্গে প্রয়োগ করা হয়েছে? এরপরও নতুন আইন হচ্ছে। এর ফলে দুর্ঘটনায় আহত, নিহত যাত্রীর কোনো সুবিধা হলে ভালো। তবে তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে কীনা, তা দেখতে হবে। না হলে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুঝুঁঁকি কমানো কঠিন। একের পর এক আইন হবে, কোনো কাজ হবে না। এক অদ্ভুত মনোবৈকল্য গ্রাস করেছে আমাদের। সর্বক্ষেত্রে চতুরতা, স্বার্থপরতা, ক্রোধ আর সহিংসতা। এ থেকে কীভাবে আমাদের মুক্তি মিলবে, কে জানে!