নারীর লড়াইয়ে পরিবর্তন এসেছে
অদিতি ফাল্গুনী | ২৬ মার্চ, ২০২২ ০০:০০
‘দেশ রূপান্তর’ থেকে দুদিন আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে একজন নারী বা লেখক হিসেবে আমার ভাবনা সম্পর্কে লিখতে বলা হলে সত্যিই বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। প্রথমত, স্বাধীনতার সংজ্ঞা বেশ কঠিন বিষয়। মানুষ কি না মুক্ত বা স্বাধীন হয়েই জন্মায়। তবে সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত এ কথা বহু আগে বলে গিয়েছিলেন যে ফরাসি দার্শনিক, তিনি নিজেই নারীকে মেধার মাপে পুরুষের সমকক্ষ মনে করতেন না। আজও নাকি পৃথিবীতে একজন মার্কিনির জীবনের মূল্য দুজন ইউরোপীয়, পঞ্চাশজন আরব ও তিনশো আফ্রিকানের সমকক্ষ। তাহলে ‘স্বাধীনতা’-কে কীভাবে ব্যাখ্যা করব?
মনে পড়ছিল ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর নির্যাতিত ও শহীদ হওয়া তরুণ সাংবাদিক ও লেখক, ‘শিলালিপি’ পত্রিকার সম্পাদক সেলিনা পারভীনের কথা। স্বাধীন দেশে একজন নারী লেখক হিসেবে আমাকে কোনো বহিরাগত সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করবে এমন আশঙ্কা অন্তত নেই। কিন্তু এতেই যে বাংলাদেশের নারী সমাজ সব ধরনের সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পেরেছে তেমনও নয়। আবার একাত্তরের এ যুদ্ধেই সেলিনা পারভীনের মাতৃহারা সন্তান সুমনও এই স্বাধীন বাংলাদেশে ফার্মার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার পর, ব্যাংকের এক চাকরিহারা কর্মী হিসেবে হতাশা থেকে মারা গেছেন অথবা রেললাইনে মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন কি না এমন বিতর্ক রয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে কি বাংলাদেশের সব অর্জনই বৃথা? সেটাও বলা খুবই অনুচিত, অন্যায় হবে।
দেশ যখন স্বাধীন হয়, একাত্তরের সেই ভস্মস্তূপ থেকে আমাদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর সময় দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল (-৫.৪৮%) এবং ২০১৯ সালে এটি হয়ে দাঁড়ায় ৮.১৫% ভাগ। তবে কভিডের কারণে ২০২০ সালে আমাদের জিডিপি খানিকটা হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৫.২% শতাংশ। সদ্য স্বাধীন দেশে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় যখন ছিল ১৩৪ মার্কিনি ডলার, ২০২০ সালে সেটি হয়েছে ২০৬৪ মার্কিনি ডলার।
তারাপদ রায়ের ‘দারিদ্র্যরেখা’ কবিতাটি আজও আমাদের হৃদয়ে যত ক্ষোভ ও ক্রোধের ঢেউ তুলুক না কেন, অস্বীকার করা যাবে না যে সত্তরের দশকের শুরুতে বাংলাদেশে জনসংখ্যার আশি ভাগেরও বেশি যখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, ২০১৯ সাল নাগাদ আমাদের জনসংখ্যার মাত্র ২০ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
‘বস্ত্রবালিকা’দের কল্যাণে ২০১৮-১৯ সাল নাগাদ আমাদের রপ্তানি আয় হয়েছে ৪০.৫ বিলিয়ন মার্কিনি ডলার। বর্তমানে পোশাকশিল্পে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ এবং এ অর্জনের গরিষ্ঠ অংশটিই আমাদের নারীশ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
অর্থনীতিবিদদের মতো কৃষি-শিল্প-সেবাসহ নানা খাতের গুচ্ছের পরিসংখ্যান না দিয়ে এটুকু সংক্ষেপে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় সারা দেশের শুধু গ্রামাঞ্চলেই ঘর বা বসতবাটিই ধ্বংস হয়েছিল চার কোটি ত্রিশ লাখে হিসাব বিশ্বব্যাংকের। আজ সেই বাংলাদেশে পদ্মা সেতু তৈরি সম্ভব হয়েছে। ১৯৯১ সালে যেখানে বিদ্যুতে অভিগম্যতা ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ, ২০২১-এ সেটা হয়েছে ৯৯ শতাংশ। এবার শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জেন্ডার সমতার মতো মানবকল্যাণমুখী সূচকগুলোর দিকে তাকানো যাক। স্কুল থেকে ড্রপ-আউট বা ঝরে পড়ার হার আজ মাত্র ১৮ শতাংশ। ১৯৭৪ সালে আমাদের সাক্ষরতার হার যেখানে ছিল মাত্র ২৬.৮ শতাংশ, ২০১৯-এ সেটা হয়েছে ৭৪.৭% শতাংশ। এ ছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার স্তরে অনেকাংশেই জেন্ডার সমতা অর্জন সম্ভব হয়েছে।
স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সক্ষম হয়েছে মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার ৭৫ শতাংশ হ্রাস করতে। ১৯৭৫ সালে যেখানে প্রতি ১ লাখ শিশুজন্মের পরিপ্রেক্ষিতে ৬০০ মা মারা যেতেন, সেই সংখ্যা ১৯৯০-এ হয়েছে ৫৭৪ এবং ২০১৭ সালে মাত্র ১৭৩। ১৯৭৩ সালে প্রতি ১০০০ নবজন্মে যেখানে শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১৬৭, ২০২০ সাল নাগাদ সেই অনুপাত প্রতি ১০০০ নবজন্মে মাত্র ২১-এ নেমে এসেছে। ২০০৩ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ৩ কোটি ৮০ লাখ শিশু টিকা প্রদান কর্মসূচির আওতায় আসে এবং ২০০৬ থেকে বাংলাদেশ পোলিওমুক্ত হয়েছে। জেন্ডার সমতার কথা বলতে গেলে বলতেই হবে যে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরে ‘জেন্ডার গ্যাড ইনডেক্স’ হ্রাসে সম্প্রতি বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো প্রথম হয়েছে। ২০২০ সালের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স’-এ বাংলাদেশ ৭৩ শতাংশ জেন্ডার বৈষম্য ঘোচাতে সক্ষম হয়। ১৯৯৬-২০১৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশে শ্রম খাতে নারীর অংশগ্রহণ ১৫.৮ থেকে ৩৬.৩ শতাংশে উন্নীত হয়, যেখানে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এর গড় হার হলো ৩৫ শতাংশ।
বেগম রোকেয়ার ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ লেখার সময় থেকে আজকে যদি হিসাব করি, তবে প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেত্রীর কথা বাদই দিই, সংসদ-বিচারালয়-পুলিশ-সেনাবাহিনী-প্রশাসন-বিশ্ববিদ্যালয়-উন্নয়ন খাতসহ ঠিক কোথায় যে বাংলাদেশের মেয়েরা মাথা উঁচু করে কাজ করছে না সেটাই বরং বলা কঠিন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের নারীসমাজ কতটা অর্জন করেছে সেটা নিজের ঘরের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। আমার মায়ের কথাই বলি। আমার মাতামহ ঠিকাদারি পেশায় বিপুল অর্থনৈতিক সাফল্য লাভ করেছিলেন দেশভাগের আগেই। আমার আপন মাতামহী আটটি সন্তানের জন্ম দিয়ে খুবই ভগ্ন স্বাস্থ্যে মারা যান আমার মার মাত্র এক বছর বয়সে। মা মানুষ হন মূলত দুই বিমাতার ঘরে। দেশভাগের পর মাতামহ আকস্মিক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হলে তার বাকি দুই স্ত্রীর একজন পুনর্বিবাহ ও দেশত্যাগ করেন এবং আর এক স্ত্রী আমার মাকে বড় করেন। মার আপন সব ভাই ও বোনরা শিশুমৃত্যুর শিকার হয়ে মারা যান। যে বিমাতা তাকে বড় করেন, সেই ঘরে তার আর এক বৈমাত্রেয় বোন ছিল। আমার এই বৈমাত্রেয় মাতামহীর বড় বোন যাকে আমরা ‘বড় দিদিমা’ বলে ডাকতাম, তার পাঁচ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল এবং ন’তেই তিনি বাল্যবিধবা হন ও বাকি জীবন ছোট বোনের সংসারেই চির বিধবা হিসেবে কাটিয়েছেন। স্কুলে ভালো ছাত্রী হলেও ‘পিতা’ তথা অভিভাবকহীন হওয়ার কারণে আমার মার বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৬ বছর বয়সে এবং ১৯৫৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তার প্রথম সন্তান জন্ম হয়। ১৯৭১-এ তার অষ্টম সন্তান বনগাঁয় উদ্বাস্তু শিবিরে এক মাস বয়সে মারা যায় ও মুক্তি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আমি মার নবম ও শেষ সন্তান-যখন মার বয়স ৩৭। স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের তিন বোনের ভেতর বড় বোন ব্রিটিশ ভার্সিটি থেকে পিএইচডি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাসচিব হিসেবে ২০১৯-এ অবসরের পর বর্তমানে আর একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি বিবাহিতা ও দুই সন্তানের জননী। তার দুই কন্যাসন্তানের একজন মার্কিনি এক ভার্সিটিতে অর্থনীতিতে পিএইচডি করছে ও আর এক কন্যাসন্তান বর্তমানে বাংলাদেশে এক আন্তর্জাতিক সংস্থায় খুবই সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। মার অপর দুই কন্যাসন্তান হিসেবে আমি ও আমার ওপরের বোনটি আজও সিঙ্গল। আমার ওপরের বোনও স্বনামধন্যা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যাপক ও ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি। আমিই পেশাগত জীবনে তত সফল নই। একজন অসফল লেখক হিসেবে কবিতা-গল্প-অনুবাদ-প্রবন্ধ মিলিয়ে ৩৪টির মতো বই আছে আর একাধিক সংবাদপত্র, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেছি।
আমার মনে হয় আশপাশের অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারেই আমরা যদি গত পঞ্চাশ থেকে সত্তর বছরের একটি পরিক্রমা নিই বা মাতামহী থেকে দৌহিত্রীদের জীবন পর্যন্ত একটি ছক আঁকি, তাহলেই কতটা বিপুল পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে এই সীমিত সময়ে, তার একটি ভালো আন্দাজ পাওয়া যাবে। আবার মূলত পশ্চিমা আলোকায়নের প্রভাবে নারী শিক্ষা ও নারী কর্মসংস্থানের প্রসারের সমানুপাতিক হারে মেয়েদের ভেতর দেরিতে বিয়ে, আদৌ বিয়ে না করা বা সন্তান না নেওয়ার কোনো নেতিবাচক প্রভাবও সামনে পড়বে কি না সেটাও ভেবে দেখার। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যেও ঘর-সংসার সামলেও মেয়েরা আসছে। হয়তো গৃহশ্রম বা সন্তান জন্মদান ও লালনের বিপুল দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শিল্প-সাহিত্যে অন্তত ছেলেদের সঙ্গে সব সময় সমান তালে সে পেরে ওঠে না, কিন্তু ছেলেরাই যে সবাই ধ্রুপদী সাহিত্য রচনা করে ফেলছেন আশপাশে তেমনও তো না। নানা প্রতিবন্ধকতার ভেতরেও সদ্য প্রয়াত রিজিয়া রহমান বা আজও সচল, সক্রিয় সেলিনা হোসেন থেকে শাহীন আখতার বা নাসরীন জাহান আপারা থেকে আমাদের ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মেয়েরাও কলম-কি-বোর্ড-ক্যামেরা-তুলি হাতে নিয়ে কাজ করার চেষ্টা কিন্তু করে যাচ্ছে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
শেয়ার করুন
অদিতি ফাল্গুনী | ২৬ মার্চ, ২০২২ ০০:০০

‘দেশ রূপান্তর’ থেকে দুদিন আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে একজন নারী বা লেখক হিসেবে আমার ভাবনা সম্পর্কে লিখতে বলা হলে সত্যিই বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। প্রথমত, স্বাধীনতার সংজ্ঞা বেশ কঠিন বিষয়। মানুষ কি না মুক্ত বা স্বাধীন হয়েই জন্মায়। তবে সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত এ কথা বহু আগে বলে গিয়েছিলেন যে ফরাসি দার্শনিক, তিনি নিজেই নারীকে মেধার মাপে পুরুষের সমকক্ষ মনে করতেন না। আজও নাকি পৃথিবীতে একজন মার্কিনির জীবনের মূল্য দুজন ইউরোপীয়, পঞ্চাশজন আরব ও তিনশো আফ্রিকানের সমকক্ষ। তাহলে ‘স্বাধীনতা’-কে কীভাবে ব্যাখ্যা করব?
মনে পড়ছিল ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর নির্যাতিত ও শহীদ হওয়া তরুণ সাংবাদিক ও লেখক, ‘শিলালিপি’ পত্রিকার সম্পাদক সেলিনা পারভীনের কথা। স্বাধীন দেশে একজন নারী লেখক হিসেবে আমাকে কোনো বহিরাগত সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করবে এমন আশঙ্কা অন্তত নেই। কিন্তু এতেই যে বাংলাদেশের নারী সমাজ সব ধরনের সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পেরেছে তেমনও নয়। আবার একাত্তরের এ যুদ্ধেই সেলিনা পারভীনের মাতৃহারা সন্তান সুমনও এই স্বাধীন বাংলাদেশে ফার্মার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার পর, ব্যাংকের এক চাকরিহারা কর্মী হিসেবে হতাশা থেকে মারা গেছেন অথবা রেললাইনে মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন কি না এমন বিতর্ক রয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে কি বাংলাদেশের সব অর্জনই বৃথা? সেটাও বলা খুবই অনুচিত, অন্যায় হবে।
দেশ যখন স্বাধীন হয়, একাত্তরের সেই ভস্মস্তূপ থেকে আমাদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর সময় দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল (-৫.৪৮%) এবং ২০১৯ সালে এটি হয়ে দাঁড়ায় ৮.১৫% ভাগ। তবে কভিডের কারণে ২০২০ সালে আমাদের জিডিপি খানিকটা হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৫.২% শতাংশ। সদ্য স্বাধীন দেশে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় যখন ছিল ১৩৪ মার্কিনি ডলার, ২০২০ সালে সেটি হয়েছে ২০৬৪ মার্কিনি ডলার।
তারাপদ রায়ের ‘দারিদ্র্যরেখা’ কবিতাটি আজও আমাদের হৃদয়ে যত ক্ষোভ ও ক্রোধের ঢেউ তুলুক না কেন, অস্বীকার করা যাবে না যে সত্তরের দশকের শুরুতে বাংলাদেশে জনসংখ্যার আশি ভাগেরও বেশি যখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, ২০১৯ সাল নাগাদ আমাদের জনসংখ্যার মাত্র ২০ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
‘বস্ত্রবালিকা’দের কল্যাণে ২০১৮-১৯ সাল নাগাদ আমাদের রপ্তানি আয় হয়েছে ৪০.৫ বিলিয়ন মার্কিনি ডলার। বর্তমানে পোশাকশিল্পে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ এবং এ অর্জনের গরিষ্ঠ অংশটিই আমাদের নারীশ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
অর্থনীতিবিদদের মতো কৃষি-শিল্প-সেবাসহ নানা খাতের গুচ্ছের পরিসংখ্যান না দিয়ে এটুকু সংক্ষেপে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় সারা দেশের শুধু গ্রামাঞ্চলেই ঘর বা বসতবাটিই ধ্বংস হয়েছিল চার কোটি ত্রিশ লাখে হিসাব বিশ্বব্যাংকের। আজ সেই বাংলাদেশে পদ্মা সেতু তৈরি সম্ভব হয়েছে। ১৯৯১ সালে যেখানে বিদ্যুতে অভিগম্যতা ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ, ২০২১-এ সেটা হয়েছে ৯৯ শতাংশ। এবার শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জেন্ডার সমতার মতো মানবকল্যাণমুখী সূচকগুলোর দিকে তাকানো যাক। স্কুল থেকে ড্রপ-আউট বা ঝরে পড়ার হার আজ মাত্র ১৮ শতাংশ। ১৯৭৪ সালে আমাদের সাক্ষরতার হার যেখানে ছিল মাত্র ২৬.৮ শতাংশ, ২০১৯-এ সেটা হয়েছে ৭৪.৭% শতাংশ। এ ছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার স্তরে অনেকাংশেই জেন্ডার সমতা অর্জন সম্ভব হয়েছে।
স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সক্ষম হয়েছে মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার ৭৫ শতাংশ হ্রাস করতে। ১৯৭৫ সালে যেখানে প্রতি ১ লাখ শিশুজন্মের পরিপ্রেক্ষিতে ৬০০ মা মারা যেতেন, সেই সংখ্যা ১৯৯০-এ হয়েছে ৫৭৪ এবং ২০১৭ সালে মাত্র ১৭৩। ১৯৭৩ সালে প্রতি ১০০০ নবজন্মে যেখানে শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১৬৭, ২০২০ সাল নাগাদ সেই অনুপাত প্রতি ১০০০ নবজন্মে মাত্র ২১-এ নেমে এসেছে। ২০০৩ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ৩ কোটি ৮০ লাখ শিশু টিকা প্রদান কর্মসূচির আওতায় আসে এবং ২০০৬ থেকে বাংলাদেশ পোলিওমুক্ত হয়েছে। জেন্ডার সমতার কথা বলতে গেলে বলতেই হবে যে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরে ‘জেন্ডার গ্যাড ইনডেক্স’ হ্রাসে সম্প্রতি বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো প্রথম হয়েছে। ২০২০ সালের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স’-এ বাংলাদেশ ৭৩ শতাংশ জেন্ডার বৈষম্য ঘোচাতে সক্ষম হয়। ১৯৯৬-২০১৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশে শ্রম খাতে নারীর অংশগ্রহণ ১৫.৮ থেকে ৩৬.৩ শতাংশে উন্নীত হয়, যেখানে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এর গড় হার হলো ৩৫ শতাংশ।
বেগম রোকেয়ার ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ লেখার সময় থেকে আজকে যদি হিসাব করি, তবে প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেত্রীর কথা বাদই দিই, সংসদ-বিচারালয়-পুলিশ-সেনাবাহিনী-প্রশাসন-বিশ্ববিদ্যালয়-উন্নয়ন খাতসহ ঠিক কোথায় যে বাংলাদেশের মেয়েরা মাথা উঁচু করে কাজ করছে না সেটাই বরং বলা কঠিন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের নারীসমাজ কতটা অর্জন করেছে সেটা নিজের ঘরের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। আমার মায়ের কথাই বলি। আমার মাতামহ ঠিকাদারি পেশায় বিপুল অর্থনৈতিক সাফল্য লাভ করেছিলেন দেশভাগের আগেই। আমার আপন মাতামহী আটটি সন্তানের জন্ম দিয়ে খুবই ভগ্ন স্বাস্থ্যে মারা যান আমার মার মাত্র এক বছর বয়সে। মা মানুষ হন মূলত দুই বিমাতার ঘরে। দেশভাগের পর মাতামহ আকস্মিক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হলে তার বাকি দুই স্ত্রীর একজন পুনর্বিবাহ ও দেশত্যাগ করেন এবং আর এক স্ত্রী আমার মাকে বড় করেন। মার আপন সব ভাই ও বোনরা শিশুমৃত্যুর শিকার হয়ে মারা যান। যে বিমাতা তাকে বড় করেন, সেই ঘরে তার আর এক বৈমাত্রেয় বোন ছিল। আমার এই বৈমাত্রেয় মাতামহীর বড় বোন যাকে আমরা ‘বড় দিদিমা’ বলে ডাকতাম, তার পাঁচ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল এবং ন’তেই তিনি বাল্যবিধবা হন ও বাকি জীবন ছোট বোনের সংসারেই চির বিধবা হিসেবে কাটিয়েছেন। স্কুলে ভালো ছাত্রী হলেও ‘পিতা’ তথা অভিভাবকহীন হওয়ার কারণে আমার মার বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৬ বছর বয়সে এবং ১৯৫৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তার প্রথম সন্তান জন্ম হয়। ১৯৭১-এ তার অষ্টম সন্তান বনগাঁয় উদ্বাস্তু শিবিরে এক মাস বয়সে মারা যায় ও মুক্তি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আমি মার নবম ও শেষ সন্তান-যখন মার বয়স ৩৭। স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের তিন বোনের ভেতর বড় বোন ব্রিটিশ ভার্সিটি থেকে পিএইচডি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাসচিব হিসেবে ২০১৯-এ অবসরের পর বর্তমানে আর একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি বিবাহিতা ও দুই সন্তানের জননী। তার দুই কন্যাসন্তানের একজন মার্কিনি এক ভার্সিটিতে অর্থনীতিতে পিএইচডি করছে ও আর এক কন্যাসন্তান বর্তমানে বাংলাদেশে এক আন্তর্জাতিক সংস্থায় খুবই সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। মার অপর দুই কন্যাসন্তান হিসেবে আমি ও আমার ওপরের বোনটি আজও সিঙ্গল। আমার ওপরের বোনও স্বনামধন্যা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যাপক ও ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি। আমিই পেশাগত জীবনে তত সফল নই। একজন অসফল লেখক হিসেবে কবিতা-গল্প-অনুবাদ-প্রবন্ধ মিলিয়ে ৩৪টির মতো বই আছে আর একাধিক সংবাদপত্র, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেছি।
আমার মনে হয় আশপাশের অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারেই আমরা যদি গত পঞ্চাশ থেকে সত্তর বছরের একটি পরিক্রমা নিই বা মাতামহী থেকে দৌহিত্রীদের জীবন পর্যন্ত একটি ছক আঁকি, তাহলেই কতটা বিপুল পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে এই সীমিত সময়ে, তার একটি ভালো আন্দাজ পাওয়া যাবে। আবার মূলত পশ্চিমা আলোকায়নের প্রভাবে নারী শিক্ষা ও নারী কর্মসংস্থানের প্রসারের সমানুপাতিক হারে মেয়েদের ভেতর দেরিতে বিয়ে, আদৌ বিয়ে না করা বা সন্তান না নেওয়ার কোনো নেতিবাচক প্রভাবও সামনে পড়বে কি না সেটাও ভেবে দেখার। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যেও ঘর-সংসার সামলেও মেয়েরা আসছে। হয়তো গৃহশ্রম বা সন্তান জন্মদান ও লালনের বিপুল দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শিল্প-সাহিত্যে অন্তত ছেলেদের সঙ্গে সব সময় সমান তালে সে পেরে ওঠে না, কিন্তু ছেলেরাই যে সবাই ধ্রুপদী সাহিত্য রচনা করে ফেলছেন আশপাশে তেমনও তো না। নানা প্রতিবন্ধকতার ভেতরেও সদ্য প্রয়াত রিজিয়া রহমান বা আজও সচল, সক্রিয় সেলিনা হোসেন থেকে শাহীন আখতার বা নাসরীন জাহান আপারা থেকে আমাদের ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মেয়েরাও কলম-কি-বোর্ড-ক্যামেরা-তুলি হাতে নিয়ে কাজ করার চেষ্টা কিন্তু করে যাচ্ছে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক