অফিস আছে, কর্তা আছে, গ্রাহক ও আমানতকারী আছে, কিন্তু টাকা নেই। অর্থসংকটে অনেকাংশেই দেউলিয়া আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। প্রায় দুই মাস ধরে তাদের নগদ টাকার সংকট চলছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন এর গ্রাহকরা। অনেকেই চিকিৎসা প্রভৃতি জরুরি প্রয়োজনে টাকা তুলতে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরছেন। সেবা দিতে পারছেন না ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। গ্রাহকরা শাখা ম্যানেজারের খোঁজ করলেও তাকে শাখায় পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে।
কর্মকর্তারা তাদের অসহায়ত্বের কথা জানাচ্ছেন। সরকার ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহিত করতে ক্যাশলেস বাংলাদেশের কথা বলছে; এদিকে প্রকৃতার্থেই ‘ক্যাশলেস’ অবস্থা আইসিবির। বিদেশি উদ্যোক্তারা অধিগ্রহণ করার আগে থেকেই ব্যাংকটি সংকটে ছিল। এরপর দেড় দশকেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, কিন্তু ব্যাংকের সংকট কাটেনি। তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকটির পুরনো গ্রাহকদের টাকা অনেক দিন ধরেই আটকে আছে।
গত মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর মতিঝিলে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের প্রধান শাখা প্রায় ফাঁকা দেখা গেছে। ম্যানেজার কিংবা সেকেন্ড ম্যানেজারকে পাওয়া যায়নি। সেখানে কর্মরত একজন বলেন, ‘যা দেখছেন, ব্যাংকের অবস্থা তা-ই। কিছুদিন ধরে সমস্যা চলছে। গ্রাহকদের টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। স্যাররা এ নিয়ে কাজ করছেন।’ আগের দিনও ম্যানেজার নেই বলে জানিয়েছিল সংশ্লিষ্টরা।
এ শাখায় এক মাসে তিনবার এসেও অনেক দিনের জমানো সঞ্চয় ফেরত পাননি প্রবাসী আফসার উদ্দিন। শাখা ম্যানেজারকেও পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান তিনি। গত রবি ও সোমবার দুপুরে পল্টনে অবস্থিত ভিআইপি রোড শাখাতেও একই অবস্থা দেখা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গ্রাহক বলেন, ‘তিন মাস আগে আমার পাঁচ বছরমেয়াদি সঞ্চয় স্কিমের মেয়াদ শেষ হয়েছে। আমাকে টাকা দিচ্ছে না। মাত্র ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা দিতেই যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে এ ব্যাংকের ওপর কীভাবে বিশ্বাস রাখি?’
গত ১৬ মে পল্টন শাখায় গিয়ে দেখা যায়, টাকা ওঠানোর জন্য কর্মকর্তাদের পেছন পেছন ঘুরছেন গ্রাহকরা। কর্মকর্তারা অনিশ্চয়তার কথা জানাচ্ছেন। টাকা তুলতে আসা জাকির হোসেন নামে একজন আমানতকারী বলেন, ‘এখানে আমার ২ লাখ ২০ হাজার টাকা আছে।
এক মাস ধরে ঘুরছি। প্রতিদিনই বলে কাল আসেন, গতকাল বলেছে পরশু আসেন। টাকা দিচ্ছে না। বলছে তাদের ব্যালান্স নেই। বলছে ধৈর্য ধরুন দেখি কী করা যায়। এসব হাবিজাবি।’
আরেক গ্রাহক বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই ঘুরছি। আমার জরুরি টাকা দরকার। তারা শুধু আশ্বাস দেয়। আমাদের দাবি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে এর সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক, গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া হোক।’ ওইদিন শাখায় সকাল থেকে যত গ্রাহক এসেছে কাউকেই টাকা দিতে পারেনি তারা।
শুধু ঢাকাতে নয়, ঢাকার বাইরের শাখাগুলোতেও একই অবস্থা। গত ১৪ মে মৌলভীবাজার শহরের কোর্ট রোডের আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে দেখা যায়, আবদুল হামিদ মাহবুব নামে এক গ্রাহক ৫৫ হাজার টাকা তুলতে গেলে ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাকে বলেন, ‘এত টাকা নেই।’ টাকা না থাকার কারণ জানতে চাইলে কর্মকর্তারা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকে টাকার সংকট রয়েছে।’ প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তারা। তারও আগে হৃদরোগী ছমির মিয়া চিকিৎসার জন্য ব্যাংকে টাকা তুলতে যান। তাকে বলা হয়, ১০ হাজার টাকার বেশি তোলা যাবে না। আবু রায়হান নামে এক শিক্ষার্থী জানান, তিনি তাদের পরিবারের জন্য ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা তুলেছেন প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা করে। তুলতে অনেক সময় লেগেছে।
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘হেড অফিস দুই মাস ধরে বলছে, আমার শাখায় প্রয়োজনীয় টাকা পাঠানো হবে। কিন্তু পাচ্ছি না। আমার এখানে কাস্টমার আছেন প্রায় ৪০০ জন। কিন্তু টাকা নেই। গ্রাহকরা টাকার জন্য মা-বাপ তুলে গালাগালি করছে। হেড অফিস থেকে বলা হয়েছে, বিএফটিএন করতে, তারা আমাদের ৫ লাখ টাকা দেবেন। কিন্তু রাত ১২টা পর্যন্ত টাকা দেওয়া হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ব্যাংক খুলব না। ব্যাংক খুলে গ্রাহকদের মার খাব নাকি! গ্রাহকদের টাকা তারা (হেড অফিস) নিয়ে নিলেন।’
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতির বিষয়ে অবগত আছি। আমাদের ব্যাংকে এখন ৫০ কোটি টাকাও নেই, আমরা অস্বস্তিতে আছি, আমাদের টাকা দরকার। সাপোর্ট, ফান্ড ও সময় পেলে আমরা স্বাভাবিকতায় ফিরতে পারব বলে আশাবাদী।’
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির ঋণের স্থিতি ছিল ৭৯০ কোটি টাকা, এর ৬৬৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকাই খেলাপি। এটি মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৮৭ শতাংশ। ব্যাংকটি নগদ অর্থের সংকটে রয়েছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক ১ টাকা ৪০ পয়সা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে এর প্রভাব পড়তে পারে ভালো ব্যাংকগুলোর ওপর।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যাংকটি ঋণ দিয়ে যে আয় করে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করে আমানতের মুনাফা পরিশোধে। ফলে লোকসানে থাকে ব্যাংকটি। ২০২৩ সালে ব্যাংকটির নিট লোকসান হয় ৫৬ কোটি টাকারও বেশি, যা আগের বছরে ছিল ২৫ কোটি টাকা। এখন ব্যাংকটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৯ কোটি টাকা।
২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মো. রজব আলীকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে পাঠানো হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োজিত পর্যবেক্ষক থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকটির এ দশা হয়েছে। কোনো উন্নতি হয়নি। রজব আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অবজারভারের মূল কাজ হচ্ছে তিন মাস পরপর তাদের যে বোর্ড মিটিং হয় সেখানে তারা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে কি না, তা দেখা। আমাদের আর কিছু করণীয় নেই। তবে ব্যাংকটির অবস্থা ভালো নয়। এটা আমাদের ডস ও বিআরপিডি মনিটর করছে। ব্যাংকটিতে যে অবস্থা চলছে, তার বিষয়ে তারা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমার জানা নেই।’
ব্যাংকটির শুরু ‘আল-বারাকাহ ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে। এরপর নাম হয় ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’, এখন ‘আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড’। সুদমুক্ত শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৭ সালের ২০ মে ‘আল-বারাকাহ ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’-এর কার্যক্রম শুরু। ২০০৪ সালে মালিকানা পরিবর্তন হয়। ২০০৬ সালে সীমাহীন ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ব্যাংকটিতে। ভুয়া নথি আর মিথ্যা তথ্য দিয়ে তৎকালীন উদ্যোক্তারা হাতিয়ে নেন প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। চলে নজিরবিহীন লুটপাট। ফলে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। শৃঙ্খলা ফেরাতে সেখানে প্রশাসক বসায় বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন করে পুনর্গঠন করতে হয় ব্যাংকটিকে। বিক্রি করা হয় বিদেশি একটি গ্রুপের কাছে। ২০০৮ সালে নাম পরিবর্তন করে ‘আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড’ রাখা হয়। তারপরও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ব্যাংকটি। আর্থিক অবস্থারও উন্নতি হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমানতকারীদের টাকা দিতে না পারলে ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া উচিত। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত দুর্বল ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া। গ্রাহকরা হা-হুতাশ করলে এর একটা প্রভাব ভালো ব্যাংকগুলোতে পড়বে। কেন এ অবস্থা হবে? এটা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংক এর দায় এড়াতে পারে না। কিন্তু তারা দায় এড়িয়ে চলছে। বিনিয়োগকারীদের সতর্ক হতে হবে। গ্রাহকদের জানানো উচিত তারা যেন এসব ব্যাংকে টাকা না রাখে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ডিপোজিটরদের টাকা দিতে না পারলে ব্যাংকের অস্তিত্ব রাখাই উচিত নয়। বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভালোভাবে দেখা উচিত। ব্যাংক খাতে মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের একটা আইনি জটিলতা আছে, তাদের শেয়ার নিয়ে আদালতের একটা অবজারবেশন আছে। এজন্য রিস্ট্রাকচারিংটা তারা করতে পারছে না। তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে যে টাকা পাবে, তা ফেরত পাওয়ার একটা প্রক্রিয়া চলছে। আমরাও কথা বলেছি।’