সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ইমানের দিক থেকে মুমিনদের মধ্যে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ওই ব্যক্তি, যে সবচেয়ে সুন্দর চরিত্রের অধিকারী।’ (সুনানে আবু দাউদ ৪৬৮২) অর্থাৎ ইমানের পূর্ণতা চরিত্রের সৌন্দর্যের ওপর নির্ভরশীল। যে যত সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হবে, তার ইমান তত বেশি পূর্ণাঙ্গ হবে। চরিত্রের উন্নয়ন ছাড়া একজন মানুষ যেমন পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না, তেমনি উত্তম নৈতিক চরিত্র ছাড়া একজন শাসক ন্যায়পরায়ণ হতে পারবে না। জীবনের সবক্ষেত্রে সফল হতে হলে উত্তম চরিত্র ও আদর্শের কোনো বিকল্প নেই।
কেয়ামতের দিন ইমানদার ব্যক্তির আমলনামা যখন ওজন করা হবে, তখন উত্তম চরিত্রই ওজনের পাল্লায় ভারী জিনিসরূপে প্রমাণিত হবে। এই উত্তম চরিত্রই তার নাজাতের অসিলা হিসেবে কাজ করবে। এর অর্থ, ইমানদার ব্যক্তি মাত্রই দুনিয়ায় অতি উত্তম চরিত্রবান হবে। কেননা ইমান ও উত্তম নৈতিক চরিত্রের মধ্যে গভীর সম্পর্ক নিহিত। রাসুল (সা.)-এর নবুয়তের মূল লক্ষ্য ছিল, মানব জীবনের সামগ্রিক দিকের জন্য নৈতিক চরিত্রের অপূর্ব ও উজ্জ্বল নিদর্শন সংস্থাপন করা। এখান থেকেই সৃষ্টি হয় ইমানি ভ্রাতৃত্ব ও ভ্রাতৃত্বের দাবি।
এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন মুমিনের জন্য আয়না, (তার কোনো ত্রুটি দেখলে সে তা সংশোধন করে দেয়)। আর এক মুমিন অন্য মুমিনের ভাই, সে তার ভাইয়ের জমিজমাকে সুরক্ষা করে এবং তার ভাইকে তার পেছন থেকে আগলে রাখে।’ (সুনানে আবু দাউদ ৪৯১৮)
আমরা জানি, আয়নার সামনে যে দাঁড়ায়, আয়না তার চেহারার খুঁত ও অসৌন্দর্য তুলে ধরে এবং হুবহু যা, তাই শুধু প্রকাশ করে। একটুও বাড়ায়-কমায় না এবং তা তার সামনেই শুধু প্রকাশ করে, অন্য কারও সামনে তা প্রকাশ করে না। তেমনি মুমিন যেন অন্য মুমিনের দোষ ও ত্রুটি সংশোধনের ক্ষেত্রে হয় আয়নার মতো।
বস্তুত মুমিনদের পরস্পরের সম্পর্ক হলো ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। ভ্রাতৃত্বের এক গুরুত্বপূর্ণ দাবি এই হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। জমিজমা, জীবিকা এসব নিয়ে দুনিয়াতে মানুষের কত আয়োজন, কত দৌড়ঝাঁপ। এটাকে ঘিরে তার কত দুশ্চিন্তা, কত অস্থিরতা! এসব ক্ষেত্রে মুমিন যেন তার মুমিন ভাইকে সুরক্ষা দেয়, তার আড়ালে-অনুপস্থিতিতেও তাকে যেন সে আগলে রাখে। কোনো মুমিনের মাধ্যমে যেন অন্য মুমিনের কোনো ক্ষতি না হয়। কোনো রকম পেরেশানি না হয়। কোনো সন্দেহ নেই যে, এটা যেন ভাইয়ের কাছে ভাইয়ের দাবি, তেমনি তা ভাইয়ের পক্ষ থেকে ভাইয়ের জন্য বড় পাওয়াও বটে!
হজরত উকবা ইবনে আমের (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক মুমিন অন্য মুমিনের ভাই। সুতরাং কোনো মুমিনের জন্য জায়েজ নেই তার ভাইয়ের বিক্রয় প্রস্তাবের ওপর নিজে প্রস্তাব করা এবং তার ভাইয়ের বিবাহ প্রস্তাবের ওপর নিজে প্রস্তাব করা। হ্যাঁ, যদি সে ছেড়ে দেয় (তাহলে সেখানে প্রস্তাব করতে পারে)।’ (সহিহ মুসলিম ১৪১৪)
বিষয়টি স্পষ্ট যে, এটা প্রথমে প্রস্তাবকারী ব্যক্তির জন্য কষ্টের কারণ এবং এটা তার অন্তরে গিয়ে বিঁধে। ভাই কি ভাইকে এভাবে কষ্ট দিতে পারে? আর এমন কাজ দ্বিতীয় ব্যক্তির জন্যও মানবিকতা ও মানসিকতার দিক থেকে বড়ই আশোভন! তাছাড়া এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের মধ্যে বড় ধরনের ফেতনাও হয়ে যায়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ইসলাম মুমিনদের পরস্পরের বিষয়ে এভাবেই খেয়াল রাখে এবং দিকনির্দেশনা দেয়।
একজন মুমিনের কাছে অপর মুমিন কেমন থাকবে, সে বিষয়েও হাদিসে বর্ণনা রয়েছে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন সেই, যার থেকে মানুষ (সবদিক থেকে) নিশ্চিন্ত থাকে, মুসলমান সেই যার জিহ্বা এবং হাত থেকে অপর মুসলমানরা নিরাপদ থাকে। আর মুহাজির হলো ওই ব্যক্তি, যে অন্যায় বর্জন করে চলে।’
(মুসনাদে আহমদ ১৬৫৬১)
মুমিন শব্দটিই নিরাপত্তার অর্থ ধারণ করে আর মুসলিম শব্দটি ধারণ করে শান্তির অর্থ। কাজেই মুমিন ও মুসলিম নামের অধিকারী যিনি হবেন তিনি তো কারও জন্যই শঙ্কা ও অশান্তির কারণ হবেন না। আর যে হিজরত করে দেশ ছেড়েছে, তাকে তো গুনাহ, অন্যায়-পাপাচার ছাড়তেই হবে, এটা ‘মুহাজির’ নামটিরই দাবি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মুমিনের কাছে ইমানের দাবি প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহ এবং শেষ দিবসের প্রতি ইমান রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ইমান রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে। যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ইমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে, আর না হয় নীরব থাকে।’ (সহিহ বোখারি ৬০১৮)
প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেওয়া। প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচার করা এবং অতিথির আতিথ্য, এসব বিষয়কে মনে করা হয় শুধুই ভদ্রতা, সভ্যতা ও সামাজিকতার বিষয়। অথচ আল্লাহর নবী (সা.) হাদিসে বিষয়গুলো কীভাবে উপস্থাপন করেছেন, যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ইমান রাখে সে যেন...। অর্থাৎ এটিও একটি দ্বীনি কাজ এবং ইমানের একটি শাখা।
আরেকটি প্রসঙ্গ হলো, মুমিন হয় ভালো কথা বলবে, না হয় নীরব থাকবে। মানুষের পারস্পরিক জীবনে স্বভাব ও চরিত্রগত যে দিকগুলো সবচেয়ে বেশি সামনে আসে এবং যার প্রভাব বিস্তৃত হয়ে থাকে সেগুলোর একটি হলো, পরস্পর কথা বলা। কোরআন ও হাদিসে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন শিরোনামে এই বিষয়ে শিক্ষা ও নির্দেশনা পেশ করা হয়েছে। কথা বললে হয় ভালো কথা বলব, আর না হয় নীরব থাকব। সর্বস্তরের ও সর্বশ্রেণির মুমিনের জন্য এই আমলের বিষয়ে যতœবান থাকা কর্তব্য। এর সুফল দুনিয়া-আখেরাতে সে লাভ করবে। পক্ষান্তরে এই বিষয়ে সচেতন না হলে পার্থিব জীবনে যেমন অশান্তি দেখা দেবে, তেমনি এজন্য পরকালে জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে।