কিছু দিন পর পর দেশে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এখন কয়েক ধাপে চলছে উপজেলা নির্বাচন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে এই দীর্ঘসময়ে বাংলাদেশে শাসনব্যবস্থা কতটুকু বিকেন্দ্রীকৃত হলো? আদৌ বিকেন্দ্রীকরণের কোনো ইচ্ছা শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে আছে কি না? স্থানীয় সরকারের ভূমিকা মাঠ পর্যায়ে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আদেশ ও নির্দেশ পালন করা। যদিও সংবিধানে স্থানীয় সরকারকে ‘শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের’ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়েছে, তথাপি আমলাতন্ত্রের চাপ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সংসদ সদস্যদের প্রভাব স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিচ্ছে এবং দিনে দিনে তা বাড়ছে।
কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থাপনায় সাধারণ জনগণ সেবাদানকারীদের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারে না, জনগণ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের মধ্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার একটি প্রবণতা তৈরি হয়। তখন জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে যায় শাসক ও প্রজার। ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ এই ধরনের শব্দগুচ্ছ যেন কাগুজে প্রতিশ্রুতি, যা শুধু বিশেষ কিছু স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে হয়তো প্রযোজ্য। বলাই বাহুল্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কদাচিৎ এই ক্ষমতা সম্পর্কের অংশীদার হতে পারে। ফলে সেবা প্রদানের বিপরীতে দেশ জুড়ে তৈরি হয় ‘ভিআইপি সংস্কৃতির’। এই ভিআইপিরা নিজেদের জন্য আলাদা আইন, আলাদা ব্যবস্থাপনা ও আলাদা আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করে এবং এজন্য জনগণের অর্থ ব্যয় করে। সীমিত সম্পদের দেশে ভিআইপি প্রথা যে জনবান্ধব না, অধিকন্তু সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে চাপ তৈরি করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ এই ভিআইপি প্রথাকে নিরুৎসাহিত করে, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার মধ্যদিয়ে একদিকে মৌলিক সেবাগুলোকে আরও বেশি জনগণের কাছাকাছি নেওয়া সম্ভব।
আমাদের বাস্তবতায় স্থানীয় সরকারের অনেকগুলো কাঠামো আছে। কিন্তু কাঠামোগুলো কতটুকু কার্যকর তা নতুন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার আলোকে পর্যালোচনা করা দরকার এবং এই কাঠামোগুলোর সীমাবদ্ধতাগুলো কী কী তাও বিশ্লেষণ করা এখন সময়ের দাবি। বাস্তবতা হচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার সুযোগ খুবই সীমিত যা তাদের নিজস্ব কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যপদ্ধতি পরিচালনা ও উন্নয়নে এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের সেবা প্রদানকারী থেকে কর্মকর্তা ভাবতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এদের অনেকেই ‘স্যার’ সম্বোধন শুনতে চান। সেবা প্রদান তাদের অনেকের কাছে যতটা না দায়িত্ব তার থেকে অনেক বেশি মর্জির ব্যাপার। নিয়মনীতির দোহাই দিয়ে দুর্নীতির চর্চা তো এখানে নতুন কিছু না। আবার দায়িত্বপালনে গাফিলতি ও ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দায়িত্ব নিয়ে ঠেলাঠেলি প্রচলিত চালচিত্র। মূলত এ রকম একটি এককেন্দ্রিক ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা কাতর কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার পক্ষে তৃণমূলে জনগণকে সেবাপ্রদান করা কতটা সম্ভব তা একটি সাধারণ প্রশ্নও বটে।
সাধারণভাবে দেখা যায় সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আবার বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি প্রকট। শহর অঞ্চলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য বেশ কয়েক বছর ধরেই সিটি গভর্নমেন্ট নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য। প্রায় প্রত্যেকটি সংস্থাই নিজ নিজ ক্ষমতার বলয় তৈরি করতে এবং তা টিকিয়ে রাখতেই ব্যস্ত। অনেক ক্ষেত্রেই সেবাপ্রদানের তুলনায় নিয়ন্ত্রণ করা ও অন্যকে দোষারোপ করা যেন প্রধান কর্তব্য হয়ে ওঠে। উপজেলা ব্যবস্থা নিয়ে একসময় এই ধরনের চিন্তা থাকলেও সেই ব্যবস্থাটা এখন অনেক দুর্বল হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের স্থানীয় প্রশাসনের প্রভাবে। ফলে বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ে জনসেবা এখনো যতটা না জনবান্ধব তার থেকে অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণমূলক। সরকারের লক্ষ্য আছে স্মার্ট সরকারব্যবস্থা পরিচালনা করা, বর্তমান এই অবস্থা ধরে রেখে এই স্মার্ট সরকার পদ্ধতিকে কি জনবান্ধব ও কার্যকরী করা যাবে, সেটাও একটা প্রশ্ন।
এক তথ্য মতে বাংলাদেশে জনসেবা সম্পর্কিত বাজেটের ৯০ শতাংশই খরচ করে কেন্দ্রীয় সরকার যেটা সাধারণত নিম্ন আয়ের দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়। অন্যদিকে মাধ্যম আয়ের দেশগুলো ২০ শতাংশের বেশি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে খরচ করে থাকে। বিশ্বব্যাংক বলছে বাংলাদেশ এখন মাধ্যম আয়ের কাতারভুক্ত একটি দেশ অথচ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের একটি বড় যুক্তি হচ্ছে এর বিপুল জনসংখ্যা। এই বিপুল জনসংখ্যার কাছে সরকারি সেবা পৌঁছাতে হলে শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প আছে কি? তবে শুধু বিকেন্দ্রীকরণই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সক্ষমতা তৈরি, উদ্ভাবনী ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা, আর সেটাই হতে পারে স্মার্ট সরকার গড়ার একটি উপায়। জনগণকে সেবাপ্রদান করা ছাড়া এই সময়ে কি কোনো সরকারব্যবস্থা কল্পনা করা যায়? জনসেবা শুধু জনগণের অধিকার আদায় নয়, সমাজ পরিবর্তনে সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি নাগরিকরা তাদের দায়িত্ব পালনে আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের এটাই যথোপযুক্ত সময় কারণ গত দুই দশকে সারা দেশেই অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে উন্নয়ন বৈষম্য অনেকটা কমে এসেছে। ফলে এখন আর সুযোগ-সুবিধা শুধু শহর অঞ্চলেই না, সারা দেশেরই বিস্তৃত। ফলে অবকাঠামোগত এই সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে এখন দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়েও জনগণকে উন্নততর সেবা প্রদান করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকর ও ক্ষমতায়ন করা দরকার। তবে সবার আগে দরকার কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হ্রাস, যা হতে পারে বর্তমান আমলাতন্ত্রের সংস্কারের মাধ্যমে।
আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে এখন সংবিধানে উল্লিখিত ‘স্থানীয় শাসনে’ রূপান্তর করা দরকার। সেজন্য বর্তমানে যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাগুলো কার্যকর আছে তাকে একটি কার্যকরী ও সমন্বিত কাঠামোর মধ্যে আনা যেতে পারে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার কাঠামোকে ক্ষমতায়িত করা ও কার্যপরিধি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে এটা করতে গেলে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবে, বিশেষত বর্তমানের বিশেষ সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে। সেই প্রতিরোধকে মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রস্তুতি। আর এই সম্পর্কিত দৃষ্টান্ত আমাদের আশপাশের দেশগুলোতেই আছে সেই দৃষ্টান্তগুলোকে আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটের আলোকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করলেই সফলতা আসবে।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট