বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

চাই নিরাপদ মাতৃত্ব

আপডেট : ২৯ মে ২০২৪, ১২:৩৮ এএম

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আমি তোমাদের একটি সভ্য, শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ ফরাসি সম্রাটের কথার মূল ভাবটি ধরে বলা যায় যে, মা যদি সুস্থ হন তবেই একটি স্বাস্থ্যকর জাতির জন্ম হবে। গত কয়েক দশকে দেশে গণস্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি হলেও, নিরাপদ মাতৃত্ব এখনো সুদূরপরাহত। এখনো প্রায় তিনজন শিশুর একজনের জন্ম হয় বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রীর হাতে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে। অন্যদিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব হচ্ছে প্রায় অর্ধেক শিশুর।

নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস নিয়ে দেশ রূপান্তরের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেশে গত এক বছরে মাতৃমৃত্যু হার কমা ছাড়া নিরাপদ মাতৃত্বের আর কোনো সূচকেই উন্নতি হয়নি। এখনো ৩৩ শতাংশ প্রসব হয় বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রীদের হাতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে। ৬১ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা চারবারের বেশি প্রসব-পূর্ব সেবা পান না। মাত্র ৪৯ শতাংশ মায়ের স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব হচ্ছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব হচ্ছে ৫১ শতাংশ মায়ের। নবজাতক, এক বছরের কম এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে। এমনকি নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বাল্যবিয়ে ও কিশোরীদের গর্ভধারণ বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মাতৃমৃত্যু হার কিছুটা কমলেও তা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) থেকে অনেক দূরে। এই লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু ৭০-এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু এখনো অনিরাপদ মাতৃত্ব ও সন্তান প্রসবের কারণে দেশে প্রতি লাখ জীবিত শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৩৬ জন মা মারা যাচ্ছেন। গত পাঁচ বছরে মাতৃমৃত্যু ২৯ জন বা ১৮ শতাংশ কমেছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৫৩। ২০২১ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ১৬৮। একই সঙ্গে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে শিশুমৃত্যুর হার। পাঁচ বছর আগে প্রতি হাজারে ২১ জন করে শিশু মারা গেলেও ২০২৩ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ জনে। গ্রামাঞ্চলে এই হার শহরের চেয়ে বেশি।

অন্যদিকে এক মাসের কম বয়সী প্রতি ১ হাজার জীবিত নবজাতকের মধ্যে ২০ জন মারা যায়। পাঁচ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল ১৫। একই ব্যাপার পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের বেলাতেও। পাঁচ বছর আগের প্রতি হাজারে ২৮ থেকে বেড়ে গত বছর ৩৩-এ পৌঁছে। এই হার বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন সেবা ও প্রসবোত্তর সেবা কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে না। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আটবার প্রসব-পূর্ব সেবা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। কিন্তু দেশের ৬০ শতাংশ গর্ভবতী চারবারও প্রসব-পূর্ব সেবা পান না। বাড়িতে ঝুঁকিপূর্ণ প্রসব, বাল্যবিবাহ এবং কিশোরীদের গর্ভধারণের হার বেড়ে যাওয়াও শিশু ও মাতৃমৃত্যু এবং স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

এ বছরের নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের প্রতিপাদ্য : ‘হাসপাতালে সন্তান প্রসব করান, মা ও নবজাতকের জীবন বাঁচান।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাতৃমৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণ হচ্ছে একলামসিয়া বা গর্ভাবস্থায় খিঁচুনি হওয়া, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী রক্তপাত ও সংক্রমণ। হাসপাতালের উপযুক্ত পরিবেশে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের অধীনে প্রসব সম্পন্ন করা হলে এইসব ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে নিয়ে আসা যায়।

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটির (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নিরাপদ মাতৃত্বের ছয়টি স্তম্ভ আছে। এর মধ্যে প্রসব-পূর্ব সেবা, প্রসব-পরবর্তী সেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও সংক্রমণ প্রতিরোধ মূল। এসব সেবার যদি একসঙ্গে সমন্বিতভাবে উন্নতি না হয়, তা হলে যেখানে আছি, সেখানেই থাকব। অর্থাৎ, কেবল প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এবং সদিচ্ছা থাকলেই হবে না, নিরাপদ মাতৃত্বের মতো অতি জরুরি বিষয়কে নিশ্চিত করার জন্য চাই সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত