মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৪ ফাল্গুন ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

হাতি কি মৃত সন্তানকে কবর দেয়

আপডেট : ১০ জুন ২০২৪, ১২:৩০ এএম

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় বিজ্ঞানীরা মনে করছেন হাতি তার মৃত সন্তানকে কবর দেয় এবং বিদায় জানায়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অবলম্বনে লিখেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র

প্রাণিজগতে শোক বিষয়টা আছে কিনা তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা বিজ্ঞানীদের নেই। তবে বিভিন্ন ঘটনায় তারা চমকে উঠছেন। প্রাণিজগতের বিচিত্র আচরণ মাঝে মাঝে বিজ্ঞানীদের শুধু বিস্মিতই করে না, উল্টো সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেয়। যেমন সম্প্রতি হাতির ওপর একটি গবেষণার ফলাফল নিয়ে আলোচনা উঠেছে।

বিজ্ঞানীরা এর আগে জেনেছেন, হাতি সম্ভবত তাদের মৃত সন্তান বা অন্য হাতির জন্য শোক করে। আফ্রিকান সাভানা পার্কে হাতিদের কার্যকলাপ দেখে এমন অনুমান তাদের। তবে এশিয়ায় সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, হাতিরা মৃত শিশু হাতিদের কবর দেয়। এ গবেষণায় ২০২২-২৩ সালে পাঁচটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা হয়। যেখানে দেখা গেছে, উত্তর ভারতে হাতির একটি পাল মৃত শিশু হাতিকে খাদে টেনে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাদের কবর দেয়। পাঁচটি ঘটনায় দেখা গেছে মৃত হাতির শরীর মাটিতে ঢেকে রাখা হয়। শিশু হাতির মাথা, শুঁড়, পিঠ মাটিচাপা দেওয়া। তবে তার পায়ের কিছু অংশ তখনো দৃশ্যমান ছিল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাণিজগতে সমাধি বিরল। আফ্রিকান এবং এশিয়া অঞ্চলের হাতিদের মধ্যে এ প্রথা দেখা যায়। পাখিদের মধ্যে ম্যাগপাইও ‘কবর’ দিয়ে থাকে। তারা পাতা দিয়ে মৃত ম্যাগপাইয়ের শরীর ঢেকে রাখে। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের কবরগুলো দুর্বল হয়। নতুন এ গবেষণার সহ-লেখক ও ভারতীয় বন কর্মকর্তা পারভীন কাসওয়ান এবং গবেষণক আকাশদীপ রায় অবশ্য বলছেন, মাটিচাপা দিয়ে মৃত সন্তানকে কবর দেওয়ার এ ঘটনা অভিনব। জার্নাল অব থ্রেটেনড ট্যাক্সায় প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, এটি এশিয়ান হাতিদের সম্পূর্ণ কবর দেওয়ার প্রথম নথিভুক্ত প্রমাণ।  গবেষকদের মতে, এ আচরণ মানুষ ছাড়া অন্য প্রজাতিতে দেখা যায় না। এ আচরণ হাতিকে অন্যদের তুলনায় আলাদা করেছে। এ আচরণ বলে দেয় যে, হাতি প্রিয়জনকে কতটা অনুভব করে।

আছে রহস্য

তবে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, হাতি তার মৃত সন্তানদের কবর দেয় এমনটা প্রমাণের জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’স স্পিসিস সারভাইভাল কমিশনের এশিয়া শাখার হাতি বিশেষজ্ঞ হেইডি রিডল বলেছেন, গবেষকরা যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি যে হাতিরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে মৃতদের সমাধিস্থ করে। বেঙ্গালুরুতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের সেন্টার ফর ইকোলজিক্যাল স্টাডিজের অধ্যাপক রমন সুকুমারও হাতি যে কবর দেয় তা মানতে দ্বিধা করবেন বলে জানান। তিনি বলেন, গবেষণায় বর্ণিত ঘটনা যেমন মৃত শিশু হাতিকে বহন করা বা মৃতদেহের ওপর পা দিয়ে মাটি দেওয়া, এশিয়ান হাতিদের জন্য স্বাভাবিক; কিন্তু এটা কবর দেওয়া নাও হতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, বেশির ভাগ ‘দাফন’ জুলাই এবং নভেম্বরের মধ্যে হয়। এ সময় কৃষক ধান চাষ করে এবং হাতির পাল খাদ্যের সন্ধানে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়। এ সময় দেখা গেছে, হাতির পাল এক চা বাগান থেকে অন্য বাগানে যাচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, সমাধি বা দাফন যা-ই বলা হোক না কেন, হাতিরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এর জন্য জায়গা বেছে নিয়েছিল। মৃত শিশু হাতিকে মানুষ এবং মাংসাশী প্রাণী থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন স্থানে নিয়ে যেতে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল তারা। এরপর সেচের জন্য কাটা নালায় তারা শিশু হাতির মৃতদেহ দাফন করে। চা-বাগানের দায়িত্বরত এস্টেট ম্যানেজার এবং প্রহরীরা রাতে হাতির আওয়াজ শুনতে পান এবং পরদিন মাটিতে ঢাকা মৃত হাতির দেহ খুঁজে পান। অন্য তিনটি ঘটনা আলাদা জায়গায় ঘটে। গবেষকরা বলছেন, হাতি তার মৃত সন্তানকে শুঁড় অথবা পা দিয়ে ঠেলে যেখানে মাটিচাপা দেবে সেখানে নিয়ে যায়। সাধারণত দেড় ফুট গভীর সেচের নালায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মৃত শিশু হাতিদের। এরপর তাদের উল্টো করে শোয়ানো হয় ওই অগভীর নালায়। তারপর শুঁড় এবং পা দিয়ে তাকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এ অবস্থায় মৃত হাতির চারটি পা ওপরের দিকে উঠে থাকে। মাথা, শুঁড় এবং মুখ ও বুক সম্পূর্ণ ঢাকা থাকে। গবেষকরা বলছেন, সম্ভবত বড় ধরনের গর্তের অভাবে হাতি তার সন্তানকে পুরোপুরি কবরস্থ করতে পারে না। যে কারণে পা বের হয়ে থাকে। দেশটির বন বিভাগ মৃত হাতির ময়নাতদন্ত করে জানায়, শিশু হাতিগুলো বিভিন্ন কারণে, যেমন পুষ্টির অভাব এবং সংক্রমণের কারণে মারা গিয়েছিল।

শেষ বিদায়!

হাতি যে শুধু মৃতদের কবর দেয় তা না। তারা ‘শেষ বিদায়’ জানায় বলেও মনে হতে পারে। গবেষকরা ধারণা করছেন, মৃত হাতিকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে টেনে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এ সময় কিছু ‘শেষকৃত্য’ও করে থাকতে পারে তারা। ভারতের গবেষক এবং বন বিভাগের কর্মকর্তারা সমাধিস্থলগুলো পরীক্ষা করেন। যেখানে কবর দেওয়া হয় তার দুই পাশে বিভিন্ন আকারের হাতির পায়ের ছাপ পান তারা। একইভাবে মৃত শিশু হাতির শরীরের ওপর মাটিতেও পায়ের ছাপ পাওয়া যায়। গবেষকরা বলছেন, এর অর্থ হলো তারা সম্মিলিতভাবে কবর দেওয়ার চেষ্টা করে। মৃত হাতিটির শরীরে মাটি রেখে পায়ের চাপে তা সমান করার চেষ্টাও দেখা গেছে। গবেষকরা বলছেন, হাতিরা জানে কতটা চাপ দিতে হবে এবং কোথায় দিতে হবে। অবশ্য গবেষক রিডল বলছেন, তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড হয়তো কোনা কিছু বুঝতে চাওয়ার চেষ্টা, এটা কবর দেওয়ার প্রমাণ নয়। আর গবেষকরা বলছেন, হাতিরা পা বা শুঁড় দিয়ে অনুভব করতে পারে মৃত হাতির অবস্থা। ময়নাতদন্তে মৃত হাতির পিঠে বড় হাতিদের পায়ের আঘাতের চিহ্নও পাওয়া গেছে। তবে তা মৃতের শরীরে কোনো আঘাত তৈরি করেনি।  আর মৃত হাতির শরীরের কিছু ক্ষত ইঙ্গিত করে যে, তাকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। আর টানতে টানতে সে খাদে পড়ে যায়নি, সাবধানেই তাকে রাখা হয়েছিল।

এ বিষয়ে রিডলও একমত যে, শরীরে ক্ষত বা আঘাতের চিহ্ন প্রমাণ করে, মৃত হাতিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বড় ধরনের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি মানে এই নয় যে, তাকে সাবধানে সেচের নালায় কবর দেওয়ার জন্য বসানো হয়েছিল। তিনি বলছেন, জীবিত হাতিরা মৃত হাতিকে টেনে একটি গর্তে উল্টো করে শুইয়ে রেখেছে এ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যদি টেনে নিতে নিতে ওই মৃত হাতি উল্টোভাবে গর্তে পড়ে যায়, তাহলে তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন খুব বেশি থাকবে না। হয়তো পাঁজরের হাড়ে আঘাত লাগবে, যা নির্ণয় করা খুব কঠিন।

তবে এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন বলে জানিয়েছেন একজন। অরিত্র ক্ষেত্রি নিউ ডুয়ার্স টি এস্টেটে এমন ঘটনা দেখেছেন বলে জানান। তিনি বলেন, মরা শিশু হাতিকে সারাদিন ধরে মা হাতি বহন করেছে বলে তিনি দেখেছেন। পরদিন সকালে তিনি এক জায়গায় অসংখ্য হাতির পায়ের ছাপ দেখতে পান। যেখানে ওই মৃত শিশু হাতিকে ‘কবর’ দেওয়া হয়েছিল। তার মতে, এভাবে মৃত হাতিকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মাটিচাপা দেওয়ার ঘটনা কাকতালীয় হতে পারে না। তিনি বলেন, এটি স্পষ্ট যে, হাতিরা তাদের মৃত সন্তানকে কবর দিয়েছিল। কারণ যদি মৃত হাতিটি টেনে নেওয়ার সময় গর্তে পড়ে যেত তাহলে প্রথমে তার মাথা পড়ত খাদে, ঢালে আটকে থাকত পেছনের অঙ্গগুলো।

আরও প্রমাণ

তবে এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য ছবি, ভিডিওসহ অন্য শক্ত প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছে। তারপরও বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাণীরা প্রায়ই এমন কিছু করে, যা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। তাদের সেসব আচরণ মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে ভাবা জরুরি না। তারা তাদের মতো কাজ করে থাকে। যেমন হাতি যে আবেগ প্রদর্শন করে তার কিছু গবেষণা আগেও দেখা গেছে। প্রায় এক দশক আগে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেছে, কুকুর, কাক ইত্যাদি প্রাণীর মতো হাতি সঙ্গী বিরক্ত হলে বুঝতে পারে এবং মৃদু আদর করে সহানুভূতি জানায়। বিজ্ঞানীরা থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই প্রদেশের মায়ে তাং জেলার এলিফ্যান্ট নেচার পার্কে বিভিন্ন বয়সের ২৬টি হাতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। নিরাপত্তার কারণে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হাতিদের বাদ দেওয়া হয়েছিল।

নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে গবেষকরা এসব হাতিকে প্রত্যক্ষ করেন। তারা দেখতে পান, যদি কোনো সাপ হেঁটে যায় ঘাসের বুকে অথবা অন্য কোনো ভয়ের কারণ আবির্ভূত হয় তাদের সামনে, তাহলে হাতিরা লেজ বা কান নাড়ে, কিছু মৃদু শব্দ করে। অনেক সময় মলত্যাগও করে। এমন পরিস্থিতিতে যেসব হাতি নিরাপদে থাকে তারা এগিয়ে এসে আতঙ্কে থাকা হাতিদের জড়িয়ে ধরে। এটা তাদের সহানুভূতির প্রকাশ।

এসব আচরণে মনে হয়, হাতি তার সন্তানকে সমাধিস্থ করে থাকতে পারে। কারণ একটি-দুটি ঘটনা ব্যতিক্রম হতে পারে। পরপর পাঁচটি ঘটনাকে কীভাবে ব্যতিক্রম হিসেবে ধরে নেওয়া যায়! তবে বিষদ গবেষণা এবং আরও তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এটা নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই যে, হাতি তার মৃত সন্তানকে কবর দেয়। বিজ্ঞান এ নিয়েমই চলে। আরও পর্যাপ্ত গবেষণা হাতির স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে আমাদের ধারণা দিতে পারবে। হাতিকে বলা হয়, প্রকৃতির আদি মাতা। কারণ হাতির মধ্য দিয়ে প্রকৃতি বিস্তার লাভ করে। হাতির আচরণে নানা কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।

হাতিদের সঙ্গে মানুষের বৈরি সম্পর্কের কথাও বলে নেয়া ভালো। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের ফল হাতি তার আবাসস্থল হারাচ্ছে। এর ফলে প্রকৃতিতে হাতির উপস্থিতি কমছে। বিশেষত এশিয়া অঞ্চলে। নিজেদের থাকার জায়গা ও খাবার অভাবে হাতি ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। এর ফলে কখনো হাতি মরছে মানুষের হাতে, কখনো মানুষ হাতির আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছে। প্রকৃতি তার স্বাভাবিক চরিত্র কতটা ধরে রখতে পারছে, এটা বুঝা সম্ভব হাতির উপস্থিতি দেখে। তারাই প্রকৃতির আদিরূপ। আগের মতো হাতির পদচারণায় পৃথিবী যত মুখর থাকবে, তত তা মানুষের জন্য বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত