বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের সংখ্যা কত- সে উপাত্ত দেশের অন্য সব আর্থ-সামাজিক পরিসংখ্যানের মতোই গোলমেলে; কেউ বলেন এক কোটি, আবার কেউ বলেন দেড় কোটি। তবে তাদের সংখ্যা যে অনেক তাতে বোধ করি কারও দ্বিমত নেই। দেশে পর্যাপ্ত কর্ম নেই, নেই বেকার ভাতা, নেই মানসম্পন্ন শিক্ষা ও কারিগরি জ্ঞান। তাই যুব সমাজের একাংশ স্ব-উদ্যোগে কর্মের সন্ধানে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আস্তানা গাড়ছে বিদেশ বিভুঁইয়ে। এ কাজে তাদের অর্থ-ব্যয় ও বিড়ম্বনার ফিরিস্তি সীমাহীন। কিন্তু তারপরও কোনো ভাবে সেখানে পৌঁছানোর পর চাকরির বাজারে তাদের অবস্থা হয়ে পড়ে অত্যন্ত নড়বড়ে; দক্ষতার অভাবে সেখানে তাদের অধিকাংশের ভাগ্যে জোটে উঞ্ছবৃত্তির কাজ; যেগুলোর বেতন সামান্য, মর্যাদা নগণ্য, কায়ক্লেশ অসামান্য। দেশেও তাদের সামাজিক মর্যাদা তথৈবচ। অবশ্য ইদানীং ডলার সংকটে নিমজ্জমান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদান নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। অনেককে বলতে শোনা যাচ্ছে যে, সরকারের কাছে আইএমএফের সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে প্রাপ্তব্য ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ওজন প্রবাসীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে প্রাপ্য ২ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে অনেক বেশি বিবেচিত হচ্ছে। দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য না বোঝার ঐতিহ্য তো আমাদের স্মরণাতীত কালের!
প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীর নিরানন্দ জীবনে একঘেয়েমি কাটাতে ইউরোপ প্রবাসী ছেলে প্রতিবারের মতো এবারও আমন্ত্রণ জানায় এই গ্রীষ্মে বেড়িয়ে যেতে। তার পরিকল্পনা ছিল আমাদের নিয়ে ইতালি ভ্রমণ। এ পরিকল্পনায় ছিল বাবা-মা উভয়েরই পছন্দের সম্মিলন। বাবার শখ পুরাণিদর্শন, আর মায়ের ঝোঁক ভূধরন; পুত্র এ দুয়ের সঙ্গে জলধি যোগ করে গড়েছিল এক অপূর্ব প্রবহণ। এগারো দিনের এই ভ্রমণ বিলাসে গন্তব্য ছিল রোম, ফ্লোরেন্স, লা স্পেজিয়া ও মিলান। এর বাইরে ছিল চিঙ্কে টেরে। ইতালিয়ান ভাষায় যার অর্থ হলো পঞ্চগ্রাম; ইতালির উত্তর-পশ্চিমাংশে অবস্থিত লা স্পেজিয়া প্রদেশের পশ্চিমে লিগুরিয়ান সাগরের পাড়ে এই গ্রামগুলো গড়ে উঠেছে। এই যাত্রায় রোমের কলোসিয়াম, রোমান ফোরাম, ভ্যাটিকান সিটি, ফ্লোরেন্সের সান্তা মারিয়া গির্জা, বেল টাওয়ার, উফিজি গ্যালারি, দান্তে মিউজিয়াম, মিলানের ডুমো ডি মিলানো ক্যাথেড্রাল ছিল প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক নিদর্শন। আর লা স্পেজিয়া ও চিঙ্কে টেরের সাগর তীরে দাঁড়ানো পাহাড়ি পল্লীর জনপদগুলো ছিল যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিতরণের আকর।
এই পঞ্চগ্রামের মধ্যখানে অবস্থিত ভারনাজ্জা পল্লীতে ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্ট বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। মালিকের নাম মিস্টার ফেডেরিকো। অত্যন্ত সদালাপী ও বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের এই মধ্যবয়সী ভদ্রলোক কথা প্রসঙ্গে আমাদের দেশের নাম জানতে চাইলেন। বাংলাদেশের নাম শুনে তিনি জানালেন যে, তার এখানে ইল গাঁট্টাচিও নামের একটা রেস্টুরেন্টও আছে, সেখানে মতি নামের একজন খ্যাপাটে, কিন্তু চৌকস বাংলাদেশি শেফ কাজ করেন। আমরা সেখানে খেলে ১৫ শতাংশ রিবেট দেওয়া হবে। আমরা ভাবলাম পর্যটন প্রধান এলাকায় এটাও মুনাফা লোটার একটা কৌশল।
ওখানে বেলা ডোবে পৌনে ১০টার দিকে, কিন্তু ডিনার শুরু হয়ে যায় সাড়ে ৬টায় সূর্যালোকে। রেস্টুরেন্ট সব বন্ধ হয়ে যায় সাড়ে ১০টার মধ্যে। আমরা রাতের আঁধারে ডিনার-খেকো মানুষ, তার ওপর পথের ক্লান্তিতে অ্যাপার্টমেন্টে উঠেই কিছুটা নিদ্রাতুর হয়ে পড়েছিলাম। তাই বের হতে প্রায় ১০টা বেজে গিয়েছিল। তখন দেখি অনেক রেস্টুরেন্ট বন্ধ করার এন্তেজাম শুরু করে দিয়েছে। তবে মতি মিয়াঁরটা তখনো খোলা আছে। ভাবলাম দেশি মানুষ, কত টাকাই আর বেশি নেবেন। তাছাড়া আমার পত্নীদেবীর রয়েছে বিদেশি খাবারে ভীষণ অরুচি। তাই চিন্তা করলাম দেশি বাবুর্চিকে বলে কয়ে যদি তার ভক্ষণ উপযোগী দু’একটা পদ তৈরি করিয়ে নেওয়া যায়, তবে পত্নী সেবাটা মন্দ হয় না। আমরা মতি মিয়াঁর ডেরায় ঢুকে পড়লাম। দেখলাম মাছের ডালাগুলো প্রায় শূন্য; যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তাতে স্যালমন ফিশ নেই। বিদেশি মাছের মধ্যে এই মাছটাই আমার ভার্যার কিছুটা রোচে। মতি মিয়া আমাদের দৃঢ় ভাবে আশ্বস্ত করলেন এবং বললেন, যে কোনো প্রকারে হোক, স্বদেশি মেহমানদের তিনি স্যালমন ফিশ খাইয়েই ছাড়বেন।
আমরা বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওদিকে মতি মিয়াঁ ভিনদেশি ভাষায় গান গাইতে গাইতে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেলেন রেস্টুরেন্ট থেকে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনি আমাদের জন্য মাছ নিয়ে নাচতে নাচতে হাজির হলেন। আর পরবর্তী পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাদের সামনে একটা কমপ্লিমেন্টারি ডিশ এনে হাজির করলেন। ছোট ছোট মাছের সঙ্গে পেঁয়াজ ও লতাপাতা দিয়ে রান্না করা পদটি খেতে গিয়ে দেখি যে, সেটা দারুণ সুস্বাদু। স্বাদ পেয়ে আমার জোরু তো গরুর মতো সেটা গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল। তখন ভাবলাম সঠিক স্থানেই পদার্পণ করেছি। আমরা পরম তৃপ্তি সহকারে পরে দেওয়া পদগুলো আস্বাদন করলাম। পেটের ক্ষুধা নিবারণের সঙ্গে আমরা শাহ্ আব্দুল করিমের ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...’ গানটা শুনে মনের ক্ষুধাটাও মিটালাম। ইচ্ছা ছিল আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে মতি মিয়াঁর গল্প শুনব। কিন্তু সে গুড়েবালি। বাইরে তখনো খদ্দেরদের লাইন। আর তাপদর সেবা দানের জন্য রন্ধন কাজে তিনি মহাব্যস্ত, কিন্তু সেজন্য তার কৌতুক, গান, নাচথ কোনো কিছুই থেমে নেই। তার মধ্যে সাধারণ বঙ্গ সন্তানের আড়ষ্টতা, জড়তা বা হীনমন্যতার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া দেখলাম না। ছোট্ট রেস্টুরেন্টের কাচ দিয়ে ঘেরা পেছনের অংশে তিনি রান্না করেন; কাস্টমাররা তার এই নির্ঝঞ্ঝাট বিনোদনে পরম আনন্দ উপভোগ করেন।
খাওয়া পরিবেশনের সময় সামান্য যে সময় পেয়েছিলাম, তখন জানতে পারি মতি মিয়াঁ প্রায় বাইশ বছর আগে ইতালি আসেন। কুমিল্লা জেলার এই স্বল্প শিক্ষিত লোকটি এখন শুধু রন্ধন শৈলীতেই যে দক্ষ, তাই না, ইংরেজি ও ইতালীয় কথিত ভাষায়ও তার ব্যাপক বুৎপত্তি। জানতে চাইলাম তিনি এই পেশাগত দক্ষতা কোন প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষালাভ করেছেন। তার বক্তব্য এই দক্ষতা কোনো কেতাব থেকে আসেনি, এসেছে ‘গাইতে গাইতে গায়েন, আর বাঝাইতে বাঝাইতে বায়েন’ এই আপ্তবাক্যের চর্চা থেকে; শুরুতে দু’বছরের জন্য তিনি এক অভিজ্ঞ শেফের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তার কাছ থেকে মনোযোগ সহকারে সব কিছু শিখে নিয়েছিলেন। আমরা দেখলাম তিনি এখন গুরু মারা চেলায় পরিণত হয়েছেন; ভারনাজ্জায় সব রেস্টুরেন্ট যখন বন্ধ তখনো তারটায় খাদকদের লাইন। এই জন্য রেস্টুরেন্টের মালিক তার নামকরণ করেছেন ম্যাজিক মতি। পরের দিন আমরা যখন হাইকিং-এর জন্য পঞ্চগ্রামের অন্যতম পল্লী কর্নেলিয়ায় যাচ্ছিলাম, তখন ট্রেনের মধ্যে এক ভারতীয় মার্কিন দম্পতির সঙ্গে দেখা। ভারনাজ্জায় থাকাকালে তারাও মতি মিয়াঁর গুণগ্রাহী হয়ে ওঠেন। আমরা বাংলাদেশি, আর ভারনাজ্জায় থাকছি এ কথা শুনে তারা নিজ থেকে মতি মিয়াঁর প্রসঙ্গ তুলে তার অনেক গুণকীর্তন করলেন। করারই কথা, কারণ “Way to a man’s heart is through his heart”। এখন মতি মিয়াঁ সেখানে সম্মানের সঙ্গে ভালো উপার্জন করেন। তার নিয়ন্ত্রণাধীনে চার-পাঁচ জন ডাচ কর্মী কাজ করেন। বিদেশ বিভুঁইয়ে এই মতি মিয়াঁর মতো একজন স্বনির্মিত বাঙালিকে আবিষ্কার করে আমার বুক গর্বে ভরে ওঠে।
ভারতবর্ষের অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ অসহযোগ আন্দোলনের সময় এলাহাবাদ জেলে বন্দি ছিলেন। জেলে তাকে যে পাচক খাবার রান্না করে খাওয়াতেন, তার হাত যশ ছিল অসাধারণ। জেলে থাকাকালেই তার স্ত্রীর প্রাণবিয়োগ ঘটে। পত্নীবিয়োগে শোকার্ত মাওলানা বাসার রন্ধনকার্য নিয়েও শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত আগে তিনি যখন জেল থেকে ছাড়া পান, তখন তিনি ঐ বাবুর্চিকে সম্মানজনক মর্যাদা ও বেতন দিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়োগ করেন। তার অভিমত ছিল রন্ধন হলো একটা প্রায়োগিক কলা এবং সবাই সেটা সঠিক ভাবে রপ্ত করতে পারেন না। তার লেখা ওহফরধ ডরহং ঋৎববফড়স গ্রন্থে এর উল্লেখ আছে। মতি মিয়াঁকে এই কলা রপ্তকারী একজন গুণী রন্ধনশিল্পী মনে হয়েছে। তিনি হতে পেরেছেন একজন মর্যাদাবান পেশাজীবী। কিন্তু দুঃখের কথা হলো বিদেশে হাজারো ঝুঁকি-ঝামেলা সহ্য করে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরেও অধিকাংশ স্বদেশবাসী মতি মিয়াঁর মতো মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি।
ইতালিতে যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই অনেক অনেক বাঙালির দেখা পেয়েছি। তবে তাদের অধিকাংশের পেশা সম্মানজনক মনে হয়নি। রোম, ফ্লোরেন্স, মিলান, লা স্পেজিয়া সর্বত্র তাদের দেখেছি রাস্তায় রাস্তায় গড়ে ওঠা উন্মুক্ত বাজারে অস্থায়ী দোকান চালাতে বা হকারি করতে অথবা কারখানায় কায়িক শ্রমের কাজ করতে। স্বাগতিক দেশের ভাষাজ্ঞান ও দক্ষতা এবং নৈপুণ্যের অভাবই এই দুরবস্থার প্রধান কারণ। আবার প্রায় সব শহরেই বাঙালিরা অনেক রেস্টুরেন্ট ও হোটেল গড়ে তুলেছেন। সেখানকার খাবারের মান ও স্বাদ বেশ ভালো। কিন্তু সেগুলো যেন একেকটা ক্ষুদ্র বাংলাদেশ; সেগুলো যেন শুধু অভিবাসী বাঙালিদের জন্যই গড়ে তোলা, ভিনদেশি কেউ সেখানে অনাহূত। বিদেশে থেকেও পরিবেশ, পরিবেশনা, সেবার দিক থেকে সেগুলো বাংলাদেশের রেস্টুরেন্টেরই প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে। শুধু মূল্য পরিশোধ করার ক্ষেত্রে কিছুটা আধুনিকতা রয়েছে; সেটা হলো কার্ডে পেমেন্টের ব্যবস্থা। অথচ আমাদেরই আরেক স্বদেশি ভাই জনৈক মামুন প্রাগে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট করেছেন, যেটা বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে সব ভোজন রসিকদের জন্য আদর্শ স্থান হিসেবে গণ্য। এটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত।
দেশে জনসংখ্যা বেশি, কিন্তু কর্মসৃজন হচ্ছে তার চেয়ে অনেক কম। কাজেই আমাদের যুব সমাজের একটা অংশকে কর্মের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি দিতেই হবে। তবে যে দেশেই যান না কেন, যাওয়ার আগে নিজ দেশের বদভ্যাস ও অপসংস্কৃতি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে স্বাগতিক দেশের ভাষা, কৃষ্টি কালচার ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা শিখে আসতে হবে এবং তার চর্চা করতে হবে। তবেই আমরা ভিন দেশেও মতি মিয়াঁর মতো ম্যাজিক দেখানোর উপযুক্ততা অর্জন করতে পারব। মতি মিয়াঁ জিনিয়াস; তিনি অন্যের সাহায্য ছাড়াই নিজের চেষ্টায় এতদূর আসতে পেরেছেন। কিন্তু অন্যদের বেলায় এক্ষেত্রে সুফল পেতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে; গ্রহণ করতে হবে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা ও কর্মসূচি। বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোকে প্রোটোকলের অতিব্যস্ততা থেকে সরিয়ে এনে দেশের মানুষের জন্য কর্ম খোঁজার কাজে লাগাতে হবে। তবেই দেশের কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রমী মানুষ দেশ-বিদেশে লাভজনক ও মর্যাদাপূর্ণ পেশায় লিপ্ত হয়ে নিজের ও দেশের উন্নয়ন সাধন করতে পারবে।
আমস্টারডাম থেকে
লেখক: খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও কলামিস্ট