এখনো দেশের বেশ কয়েক জায়গায় দিনে পাঁচ থেকে সাত বার বিদ্যুৎ চলে যায়। অথচ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকায় জরিমানা স্বরূপ সরকার বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করছে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টিকে স্ববিরোধী বা প্যারাডক্স বলা যেতে পারে। ১ ঘণ্টা পরপর লোডশেডিংয়ের দিনে আমরা নেই। উৎপাদিত হচ্ছে চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ। দীর্ঘকালীন বিদ্যুৎ ঘাটতি থেকে প্রায় এক দশকের মাথায় অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশের জন্য একটি সফলতার গল্প। তবে, বাস্তবতা অন্যরকম।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীনে পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির সরবরাহকৃত বিদ্যুৎব্যবস্থার আওতায় থাকা গ্রাম এবং মফস্বলের মানুষ দুর্বল সঞ্চালন সংযোগের কারণে পূর্ণ সুবিধা পাচ্ছেন না। এ ধরনের বহু অঞ্চলে লোডশেডিং প্রাত্যহিক জীবনের অংশ। বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ চাহিদার অনুমান এবং সেই অনুযায়ী উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনাতে গলদ রয়েছে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে ওঠে না। শীতে সেটি ৮ হাজারে নেমে আসে। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের বেশি কখনোই উৎপাদন করতে হয়নি। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ২১ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি ধরা হয়েছে এবং দরকারের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে ৫০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বছরের বেশিরভাগ সময় অলস পড়ে থাকে। এই কেন্দ্রগুলো থেকে সরকার যে পরিমাণ বিদ্যুৎ নেবে বলে চুক্তি করেছিল, সেটি নেওয়ার দরকার না হলেও চুক্তি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ঠিকই দিতে হচ্ছে। সোমবার দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত হয়েছে ‘অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বাড়াচ্ছে লোকসান’ প্রতিবেদন। চাহিদার চেয়ে দেশে অতিরিক্ত ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হওয়ায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান বাড়ছে, যা অর্থনীতিতে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। রবিবার রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ নিয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে সংস্থার পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার ৭৩৮ মেগাওয়াট, যা প্রয়োজনের চেয়ে ১৪ হাজার (প্রায় ৪৬ শতাংশ) মেগাওয়াট বেশি। এত বিদ্যুৎ ২০৩০ সালেও লাগবে না। তখন চাহিদা দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। এর সঙ্গে ২৫ শতাংশ রিজার্ভ মার্জিন ধরলেও ২৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াট হলেই হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুতের কারণে ২০২৫ সাল নাগাদ পিডিবির লোকসান ১৯৬ শতাংশ বেড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের উন্নয়নের পাশাপাশি স্মার্ট গ্রিড ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি।
২০১০ সালের মহাপরিকল্পনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দিকে বেশি জোর দেওয়া শুরু হয়। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির উৎস হিসেবে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে কয়লা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ছিল। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের সর্বশেষ মহাপরিকল্পনায় ২০৪১ সালের মধ্যে যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, তাতে গ্যাসে ৩৫ শতাংশ, কয়লায় ৩৫ শতাংশ, তেল, বিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বাকি ৩০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপিডিবির নিজস্ব ও যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পর্যাপ্ত সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। ফলে একদিকে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, অন্যদিকে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখা হয়েছে। বিপিডিবি ক্রয়মূল্যের চেয়ে কম দামে গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে। এ লোকসানকে ভর্তুকির মাধ্যমে সমন্বয় করতে হচ্ছে, যা দিনে দিনে বাড়ছে। বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং কেন্দ্র নির্মাণে আমরা কি ভুল পথে হাঁটছি?