বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

শিক্ষাঙ্গনে-অর্থনীতিতে সংকট

সরকারের ওপর চাপের সুযোগ নিতে চায় বিএনপি

  • সুবিধামতো সময়ে সরকারকে চাপে ফেলতে চায় বিএনপি
  • চাপ বাড়াতে প্রতি মাসেই বড় সভা-সমাবেশের পরিকল্পনা
  • সরকার যে নানামুখী চাপে আছে তা সামাল দিতে পারবে না বলে মনে করছেন বিরোধী নেতারা
আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৮ পিএম

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পেনশন আন্দোলন ও শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের কারণে সরকার বর্তমানে নতুন করে চাপে পড়েছে বলে মনে করছে বিএনপি। দলটি বলছে, দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি, অর্থনৈতিক সংকট ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে সামাজিক অস্থিরতায় সরকার আগে থেকেই চাপে রয়েছে। আর সরকারের ওপর এসব চাপের সুযোগ নিতে চায় বিএনপি।

বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পরিস্থিতি বুঝে সুবিধামতো সময়ে সরকারকে চাপে ফেলতে চায় বিএনপি। নানান ইস্যুতে সরকার যত চাপে পড়বে সেই সুযোগে বিএনপিও আন্দোলনের চাপ বাড়াবে। এমন কৌশল নিয়ে দলটি পরবর্তী আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করছে।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। এ সরকার থাকা মানে হচ্ছে, আমাদের দেশ, গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাওয়া। আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে হলে সামনের দিকে অবশ্যই আরও তীব্র থেকে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ আন্দোলনের মাধ্যমেই এদের পরাজিত করতে হবে।’

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে প্রায় দুই বছর বিভাগীয় পর্যায়ে ও রাজধানীতে বড় সমাবেশ, বিক্ষোভ, গণসংযোগ, হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনেও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি বিএনপি। আদায় হয়নি কোনো দাবিদাওয়া। উল্টো এখন নানাভাবে কোণঠাসা দলটি।

তবে দলটির নেতারা মনে করছেন, দাবি আদায়ে এখনো আত্মবিশ্বাসী তারা। জনগণ ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট বর্জন করেছে। তাই প্রাথমিকভাবে তাদের আন্দোলন সফল। ৮ মে থেকে চার ধাপে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচন বয়কটের আহ্বানেও জনগণ সাড়া দিয়েছে বলে দাবি দলটির নেতাদের।

বিএনপি নেতারা মনে করছেন, ‘একতরফা’ ও ‘কারচুপির’ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নতুন সরকার গঠন করলেও বেশি দিন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবে না। কেননা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অর্থনৈতিক সংকট, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, সামাজিক অস্থিরতা ছাড়াও বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক আন্দোলনও মোকাবিলা করতে হবে সরকারকে। এই মুহূর্তে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট, বিনিয়োগ ও ডলার সংকট মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি একটা নাজুক সময় পার করছে। এসব নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সরকারের কর আহরণেও ধস নেমেছে। সবকিছু মিলিয়ে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর বড় চাপ তৈরি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে তা আরও নাজুক অবস্থায় যাবে। আবার টাকার অবনমন ঘটছে।

তারা বলছেন, সংকট মোকাবিলার জন্য সরকারের প্রয়োজন হবে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। নির্বাচন হয়ে গেলেও দেশে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়নি। ভোট বর্জনের জনমতকে সামনে এনে জনসম্পৃক্ত এসব ইস্যুতে সরকার যতই চাপে পড়বে ততই এসব ইস্যু রাজনীতিতে ব্যবহার করবে বিএনপি।

বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতার ভাষ্য হচ্ছে, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচের দাম সেঞ্চুরি করেছে। চালের বাজারে অভিযান চালিয়েও চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। দ্রব্যমূল্যের দামও লাগামহীন। সবকিছু মিলিয়ে সরকার যতই হাঁকডাক দিক না কেন, ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করা বা হুমকি বা কঠোর হওয়ার কথা বলুক না কেন, পরিস্থিতি কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। মানুষ এখন আর সহ্য করতে পারছে না। অর্থনীতির চেহারা ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে উঠছে। সরকার বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণের অবস্থা, ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলাসহ বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট যদি মোকাবিলা না করা যায় তাহলে দ্রুতই পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে আসবে। এমনটি ধরে নিয়েই বিএনপি ধীরে ধীরে এগোতে চায়। এ সময় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিতে জনসম্পৃক্ত ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি পালন করে যাবে দলটি।

সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষকদের সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে বিএনপির সমর্থন রয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেছেন, ‘সরকার শিক্ষকদের অনাহারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষকদের পেনশনবিরোধী প্রতিবাদকে বিএনপি সমর্থন জানায়।’

অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনেও বিএনপির মৌন সমর্থন রয়েছে বলে সূত্রগুলো জানায়। ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলন সমর্থন করে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল।

এসব আন্দোলনে বিএনপির সমর্থন করা নিয়ে অভিযোগও করা হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে এমন অভিযোগ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি কোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ও সর্বজনীন পেনশন নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলনে ঢুকেছে।’

বিএনপি নেতারা বলছেন, জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে কর্মসূচির পাশাপাশি সরকারের কর্মকা-ের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চাপে রাখার কৌশল নেবেন তারা। সরকারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যেসব দেশ প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছে তাদের বিষয়ে আরও বেশি সোচ্চার হওয়ার কৌশল নিয়েছে দলটি। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দেশটির সঙ্গে দুটি চুক্তি, পাঁচটি নতুন সমঝোতা ও তিনটি চুক্তি নবায়নসহ ১০টি চুক্তি সমঝোতা স্বাক্ষরের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিএনপি। এ ইস্যুতে আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া যায় কি না, সে চিন্তা করছে বিএনপি। তবে দলটি ভারতের বিরুদ্ধে নয়, সরকারের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে এমন বক্তব্য দিয়েই প্রচার চালাবে। গত সোমবার বিকেলে শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আকাশ-স্থল ও নৌপথ সবখানে তারা (সরকার) আজকে তাদের (ভারত) পার্টনারশিপ দিয়ে দিয়েছে। এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, কানেকটিভিটিতেও আপত্তি নেই। কিন্তু বাংলাদেশ কী পেল? সেটাই হচ্ছে প্রধান। আমরা তো এখানে কিচ্ছু পাইনি।’

এর আগে গত রবিবার এই ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলন করেছে দলটি। সভা-সমাবেশে এসব বিষয়ে আরও সক্রিয়ভাবে তুলে ধরতে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে শীর্ষ মহল থেকে।

বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, অনেকের ধারণা ছিল নির্বাচনের পর বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো আন্দোলন গুটিয়ে ফেলবে। অন্তত বছরখানেক সময় নিয়ে আবার হয়তো নতুন করে কর্মকা- শুরু করবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। নতুন করে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন শুরু করেছে। নির্বাচনের পর প্রথমবারের মতো গত শনিবার রাজধানীতে দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি দাবিতে বড় সমাবেশ করেছে বিএনপি। আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি পালন করেছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ১ জুলাই সারা দেশের মহানগরে এবং ৩ জুলাই সারা দেশের জেলা শহরে সমাবেশ করবে দলটি। প্রতি মাসেই সরকারের দুর্বলতার ইস্যুকে টেনে এনে বড় ধরনের সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে সবসময় চাপে রাখার চেষ্টা ও পরিকল্পনা করছে বিএনপি। আর চলতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের পর আগাম নির্বাচনের দাবিতে জোরালো আন্দোলনের চিন্তা রয়েছে দলটির।

জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চলতি বছরের শেষের দিকে আমরা নতুন করে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামতে চাই।’

দলটির উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে যায়নি, তার মানে নির্বাচন তারা মেনে নেয়নি। আমরাও চাই জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটুক। এজন্য আমরা সরকারের পদত্যাগ ও আগাম নির্বাচন চাই। শিগগিরই এ দাবিতে আমরা রাজপথে নামব।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত