বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যেভাবে কাজ করে

আপডেট : ১৬ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৮ এএম

বড় ধরনের কোনো ঘটনার পর তা নিয়ে তৈরি হয় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। গবেষণা প্রতিবেদন থেকে লিখেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র 

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টার খবর প্রকাশিত হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে এ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি নাটক সাজিয়েছেন। বিবিস জানাচ্ছে, এই ‘নাটক’ শব্দটি সামাজিক মাধ্যমে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমার্থক হয়ে ওঠে। হামলার পর ২৪ ঘণ্টায় মূলধারার অনলাইন মাধ্যমেও ট্রাম্পের ওপর হামলাকে নাটক অভিহিত করে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বন্যা বয়ে যায়। রাজনীতি বা রাষ্ট্র পরিচালনায় পরিচিত শব্দ এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’। কোনো ঘটনা ঘটলেই তা নিয়ে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। কেন এমন ঘটল, তার নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তৈরি হয়ে যায়। তবে গবেষণা বলছে, এসব তত্ত্বের বেশিরভাগই প্রমাণিত হয় না। এ-সংক্রান্ত সায়েন্টিফিক আমেরিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ‘র‌্যাবিট হোল’ থেকে খুব কমই কোনো কিছুকে বের হয়ে আসতে দেখা গেছে। গবেষকদের বরাত দিয়ে তারা এ মন্তব্য করে।

তবে এ গবেষণাটি করা হয় ষড়যন্ত্রমূলক চিন্তাভাবনা প্রতিহত করার প্রচেষ্টা নিয়ে। তাদের গবেষণার পর্যালোচনায় বলা হয়, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব একবার ছড়িয়ে পড়লে ফ্যাক্ট চেকিং বা সত্য প্রতিষ্ঠার যত কৌশলই নেওয়া হোক না কেন সাধারণ মানুষ সেসবে আর বিশ্বাস করতে চায় না। ষড়যন্ত্রমূলক চিন্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে এ গবেষণায় বলা হচ্ছে, তা শুরুতেই প্রতিরোধ করতে হবে। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ার আগেই জনসাধারণকে সতর্ক করা। তাদের স্পষ্টভাবে শেখানো যে কীভাবে তথ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে সঠিক বা ভুল প্রমাণ করা যায়।

ছিল যুগে যুগে

বিবিসি জানাচ্ছে, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অনেক সময় বৈধ প্রশ্ন হিসেবে দেখা দেয়। যেমন ট্রাম্পের ওপর হামলা নিয়ে অনেক সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীর প্রশ্ন, হামলাকারী কীভাবে ছাদে উঠল? কেন তাকে থামানো হলো না? এই তথ্যের শূন্যতা থেকে জনতার মধ্যে অবিশ্বাস, জল্পনা এবং বিভ্রান্তির ঢেউ বয়ে যায়। যেমন এক্স-এ একজন লিখেছেন, (গুলি হলেও) ভিড়ের মধ্যে কেউ দৌড়ায়নি বা আতঙ্কিত হয়নি। ভিড়ের মধ্যে কেউ প্রকৃত বন্দুকের শব্দও শুনতে পায়নি। আমি এটা (হামলা) বিশ্বাস করি না। আমি তাকে (ট্রাম্প) বিশ্বাস করি না। মূলত এই তথ্যগত অপ্রাপ্তি সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে উসকে দেয়।

বিবিসির কয়েক বছর আগের এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়, যুগে যুগে পৃথিবীজুড়ে বহু রকমের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছিল। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসব তত্ত্বের ধরনে ও বিবরণে পার্থক্য এসেছে। যেমন একটা সময়ের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছিল, ‘ব্রিটেনের রাজপরিবার আসলে ভিনগ্রহ থেকে আসা ক্রমাগত আকৃতি বদলাতে থাকা গিরগিটি। অথবা ইদানীংকার এ ধরনের একটি প্রচারণা হলো, ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের ওপর হামলার ঘটনা ছিল সাজানো, এতে অংশ নিয়েছিলেন অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো’। বিবিসি আরও জানাচ্ছে এ ধরনের কিছু তত্ত্বের কথা। যেমন, গ্রিফন শকুন (দেহ সিংহের আকৃতির, ডানা এবং মুখ শকুনের মতো) ইসরায়েলের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি চালায়, এইডস এবং ইবোলা রোগের জীবাণু তৈরি করেছে সিআইএ, পৃথিবী আসলে গোল নয়, সমতল। মানুষ আসলে কখনো চাঁদে যায়নি।

বিবিসি বলছে, এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সত্যি না হলেও এগুলোর মারাত্মক প্রভাব আছে। যেমন ধরা যাক টিকা বা প্রতিষেধক দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রচারণার কথা। এদের প্রচারণার কারণে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, ফ্রান্স, মাদাগাস্কার এবং অন্যান্য দেশে হামের মারাত্মক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি করোনা মহামারীর সময়েও এ বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে। করোনা টিকার মাধ্যমে বহুজাতিক করপোরেট প্রতিষ্ঠান মানুষের শরীরে বিশেষ ধরনের কোনো চিপ ঢুকিয়ে দিচ্ছে বলে প্রচার ছড়িয়ে পড়ে। গবেষকরা বলছেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তৈরি হওয়ার নানা কারণ থাকতে পারে। সহজ-সরল মনের শূন্যতা থেকে এর শুরু হতে পারে। যখন কোনো একটা বিষয় ব্যাখ্যা করা যায় না বা পর্যাপ্ত তথ্য সামনে থাকে না, তখন সাধারণ মনে নানা কল্পনা জাগে। যা ধীরে ধীরে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের রূপ নেয়। লন্ডনের ওপেন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের লেকচারার ড. জোভান বায়ফোর্ড বলেন, কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য হলো এর পেছনে একটি হীন বা শয়তানি পরিকল্পনা থাকতে হবে। এ পরিকল্পনা করা হবে খুব গোপনীয়তার মধ্যে। এর পেছনে থাকবে ক্ষমতাবান বা ক্ষমতালিপ্সু কিছু ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী। তার মতে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের তিনটি প্রধান ধাপ হলো ষড়যন্ত্রকারী, পরিকল্পনা এবং গণমানুষকে প্রভাবিত করা।

ক্ষতিকর তত্ত্ব

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কারা তৈরি করে এটা একটা বড় প্রশ্ন। এর কোনো সঠিক জবাবও নেই। সাধারণভাবে ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষ গোষ্ঠী রাজনৈতিক নানা ঘটনা নিয়ে অপপ্রচারের নামে তত্ত্ব ছড়ায়। আবার ক্ষমতাসীনরাও তাদের প্রয়োজনে বিরোধী পক্ষের কাউকে বা কোনো ঘটনা নিয়ে এ তত্ত্ব ছড়াতে পারে। তবে একটি গবেষণা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে বলে জানিয়েছে। গবেষক ও’ মোহন বলছেন, ভুল তথ্য হচ্ছে যে তথ্য সঠিক নয়, আর বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হয় ইচ্ছা করে। আর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হলো একটি ‘বিশ্বাস’। যা ছড়িয়ে দেওয়া হয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা বিষয় নিয়ে। যা পরিকল্পিত এবং এর পেছনে ষড়যন্ত্রকারীরা থাকে। এসব তত্ত্ব যে সবসময় ভুল তা নাও হতে পারে। তবে এগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে। যেমন করোনার সময় হয়েছিল আবার যুক্তরাষ্ট্র আদৌ চাঁদে গিয়েছিল কি না তা নিয়েও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নির্মিত হয়েছিল।

গবেষকরা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে জরিপ পরিচালনা করে। সেখানে তারা বেশ কয়েকটি ঘটনার পর্যালোচনা করে। তারা ওই দুই রাষ্ট্রে বসবাসরত বিভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে। ষড়যন্ত্রের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই গুরুত্বপূর্ণ কারণ, ষড়যন্ত্রে বিশ্বাস মানুষকে ক্ষতি করতে উৎসাহী করে। অধ্যাপক এবং পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেনবার্গ পাবলিক পলিসি সেন্টারের পরিচালক ক্যাথলিন হল জেমিসন বলেছেন, উদাহরণস্বরূপ যেসব লোক ৬ জানুয়ারি ২০২১-এ মার্কিন ক্যাপিটল হিলে হামলা করেছিল, তারা বিশ্বাস করেছিল যে ২০২০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে চুরি হয়েছে। এ ছাড়া তিনি বলেন, কভিড ভ্যাকসিন ষড়যন্ত্রে বিশ্বাসীরা টিকা নিতেও অস্বীকার করেছিল।

লণ্ডনের ওপেন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের লেকচারার ড. জোভান বায়ফোর্ড বলেন, কোনো একটা বাড়ির মাটির নিচের ঘরে বসে ইন্টারনেটে নানা রকম তথ্য খুঁজে বেড়াচ্ছে, ষড়যন্ত্র তত্ত্বকারীদের ব্যাপারে বেশিরভাগ মানুষের ধারণাটা এ রকম। বেশিরভাগ মানুষ আসলে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পুরোপুরি বিশ্বাসও করে না, নাকচও করে না, তাদের অবস্থান এই দুয়ের মাঝামাঝি।

মোকাবিলা

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মোকাবিলায় গবেষকরা কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো হলো আবেগের কাছে হার মানবেন না। মানসিকভাবে দুর্বল বা প্রভাবিত করতে পারে এমন কৌশলগুলো চিনতে হবে এবং তাদের ওপর বিশ্বাস কমাতে হবে। এ ছাড়া বলা হয়েছে এসব বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে চলতে। একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের তথ্য বা বিশ্বাস নিয়ে বিতর্ক করা যাবে না। এসব তত্ত্ব প্রতিরোধে মনোযোগ দিতে হবে। সাধারণ মানুষের কাছে আসার আগে অবিশ্বস্ত তথ্য এবং অবিশ্বস্ত উৎসগুলো শনাক্ত করতে হবে। গবেষকরা আরও বলছেন, সাধারণ মানুষের বিশ্লেষণাত্মক ভাবনা জাগাতে হবে। স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে ষড়যন্ত্রের গর্তে একবার প্রবেশ করলে বের হওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের গবেষক পানটাজি বলেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কিন্তু সমাজের জন্য খুব বিপজ্জনক। যারা বিশ্বাস করে যে টিকা দিলে শিশুরা অটিজমে আক্রান্ত হয় এবং শিশুদের টিকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তারা কিন্তু এসব শিশুকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যারা নিজেদের চালাক ভাবেন, যারা ভাবেন তাদের বোকা বানানো সম্ভব নয়, তাদেরও সতর্ক হওয়া দরকার।

অস্ট্রেলিয়ান দার্শনিক স্টিভ ক্লার্ক প্রস্তাব করেন যে, ষড়যন্ত্রমূলক চিন্তা কিছু কারণে ছড়িয়ে পড়ে। নির্দিষ্ট ব্যক্তির অনুপ্রেরণা বা ব্যক্তিত্বের ধরন অনুযায়ী এসব তত্ত্ব বিস্তার লাভ করে। সেসব ব্যক্তি ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করে যা তার মন-মানসিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলে। যে কারণে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ধরে বুঝতে শুরু করলে এটাও জানা যাবে কোন গোষ্ঠী এর ভোক্তা। সে অনুযায়ী অপপ্রচার মোকাবিলা করা সম্ভব।

তবে গবেষকদের আলোচনায় এটাও উঠে এসেছে যে, পর্যাপ্ত তথ্য জনগণের সামনে থাকলে তখন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ডানা মেলতে পারে না। তথ্যে ঘাটতি জনগণ ও সরকারের মধ্যে যে ফাঁপা স্থান তৈরি করে, তা দখলে নেয় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। এই শূন্যস্থান পূরণের মাধ্যমেও কূটকৌশলীদের মোকাবিলা করা সম্ভব।

আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন গত বছরের এক গবেষণায় জানায়, ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা সহজ-সরল বা মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তারা নিয়মিতভাবে কাজ করে। অনেকে বঞ্চিতদের চাহিদা মেটাতে এবং দুর্দশা ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তৈরি করে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত