সাধারণ শিক্ষার্থীদের চলমান যে আন্দোলন, তার মূল দাবি ছিল কোটা সংস্কার। এ দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক এবং দেশের সিংহভাগ মানুষের শিক্ষার্থীদের এ দাবির প্রতি সমর্থন রয়েছে। যখন এ দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে, তখন শুরু থেকেই সারা দেশের মানুষ কোটা সংস্কারের বিষয়ে ইতিবাচক সমর্থন জানান। এ সমাধান সরকারের হাতেই ছিল এবং সরকার খুব সহজেই তা করতে পারত। সরকার যদি শুরুতেই একটা কমিশন করে দিত যারা এ বিষয়ে যৌক্তিক সমাধান খুঁজে বের করবেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে যেত। কিন্তু সরকার তা না করে উল্টোপথ বেছে নিয়েছে, যা তরুণ প্রজন্মকে বিক্ষুব্ধ করেছে। একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা দেখলাম সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে কথা বললেন। সেদিন তিনি যে বক্তব্য দিলেন, তা কেন্দ্র করেই পুরো বিষয়টির ভয়াবহ অবনতি হলো।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ধরন শিক্ষার্থীদের পছন্দ হয়নি, ফলে তারা আরও জোরালো আন্দোলনে নামে। এরপরও পুরো বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করা যেত। কিন্তু সে পথে না গিয়ে পরদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশে ছাত্রলীগ মাঠে নামে, যা পুরো পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে কলেজ থেকে স্কুল পর্যায়ে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। এবার আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। সব জায়গায় ছাত্রলীগের চেয়ে বহুগুণ বেশি জমায়েত ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের, যা আমরা গত ১৫-১৬ বছরে দেখিনি। সরকার আলোচনার পথে না গিয়ে দমন করার পথ বেছে নেয়, যার ফলে আজ শিক্ষার্থীদের প্রাণ হারাতে হলো, অনেককেই মারাত্মক জখম নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
এখন শিক্ষার্থীদের এ অবস্থান থেকে সরিয়ে আনতে হলে অবশ্যই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আন্দোলনকারীদের কথাগুলো তাদের ক্ষোভ ও রাগের কারণগুলো উপলব্ধি করতে হবে। তাহলে সুন্দর সমাধান চলে আসবে, শিক্ষার্থীরাও ঘরে ফিরে যাবে। এই যে সংঘাত থামাতে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হলো, হয়তোবা বিশ্ববিদ্যালগুলোও বন্ধ রাখার ঘোষণা আসতে পারে। যদি এমন হয়, তাহলে সরকারের নির্দেশ শিক্ষার্থীরা মানবে বলে মনে হচ্ছে না। এতে সংঘাত আরও বাড়বে, পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সম্ভাবনাই বেশি।
আমাদের আরেকটা বিষয় উপলব্ধি করতে হবে। শিক্ষার্থীরা দেশে ঘটে যাওয়া অনিয়ম, বৈষম্য, দুর্নীতি, নিয়োগবাণিজ্যের কারণে দিনে দিনে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তারা নানাভাবে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম হতাশা-বঞ্চনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কোটা সংস্কারের দাবিতে তারা আন্দোলনে নেমেছে। এখন সরকার যদি বিষয়টি বুঝতে না পারে, অনুধাবন করতে না পারে, তাহলে তা দুঃখজনক। এখন পর্যন্ত সরকার ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিপরীতমুখী। এটা কিন্তু ভালো ফল দেবে না। ছাত্রলীগের অনেক ছেলেও এ আন্দোলনের পক্ষে। শুধু ছাত্রলীগের মাস্তান ও নানা অপকর্মে জড়িত ছেলেগুলোই এ আন্দোলনের বিপক্ষে। ছাত্রলীগকে বিভিন্ন সময় দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে গণশত্রুতে পরিণত করছে আওয়ামী লীগ। এটার দীর্ঘামেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে সমাজে। শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ মনে করলে সমাধান আসবে না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সমাধান আগেও সরকারের হাতে ছিল, এখন একটু জটিল হলেও তা নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।
তবে একটা বিষয় বলতেই হয়, সেদিন শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাজাকার রাজাকার বলে যে সেøাগান তুলেছিল, তা কিন্তু সঠিক ছিল না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কাছে আরও দায়িত্বশীল আচরণ কাম্য ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ ভুল সিদ্ধান্তই সরকারকে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের এটাও বুঝতে হবে যে, সেদিন শিক্ষার্থীরা কিন্তু এ সেøাগানের বাইরে বেশ কিছু সুন্দর সেøাগানও দিয়েছিল। পুরো বিষয়টা না দেখে শুধু একটা সেøাগানে নজর দিলে হবে না। মহান মুক্তিযুদ্ধে কতিপয় রাজাকার-আলবদর ছাড়া গোটা দেশের মানুষের সমর্থন ছিল। সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এখন সরকার দীর্ঘদিন ধরে কিছু ঘটলেই আন্দোলনকারীদের রাজাকার, পাকিস্তানের প্রেতাত্মা কিংবা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করার চেষ্টা করছে। পুরো দেশের মানুষকে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি এবং শুধু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের শক্তি প্রমাণ করতে গিয়ে সরকার জাতিকে বিভ্রান্ত করছে, যা নিন্দনীয়। মানুষকে জোর করে দেশের শত্রু বানিয়ে সরকারের ফায়দা কী, সেটা আমার বোধগম্য নয়। তরুণ প্রজন্মকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে লাভ কোনোকালেই হয়নি।
আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় যে, বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় শিক্ষার্থীরা প্রাণ হারালেও সেখানে অভিভাবক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। নিজের শিক্ষার্থীদের লাশ দেখার পরও শিক্ষকদের যে ভূমিকা, তা নিন্দনীয় ছিল। শিক্ষকদের শিক্ষকসুলভ মেরুদ- হারিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনেও কিন্তু সরকারের দায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয় তাদের যোগ্যতা নয়, দলীয় আনুগত্য দেখা হয়, শিক্ষক নিয়োগেও একই কথা প্রযোজ্য। তবে এবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন, এটা প্রশংসনীয়।
আর শেষে বলব সাধারণ শিক্ষার্থীদের আরও সতর্ক হতে হবে। তারা যেন কোনোভাবেই বিভ্রান্ত না হয়ে, প্ররোচিত না হয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যান। আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত না হয়ে সর্বোচ্চ ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। একই সঙ্গে দেশের মানুষের উচিত এ আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো।
লেখক : শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক