কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে ছয় দিন ধরে দফায় দফায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে এ সময়ে ১৫০ জন মারা যাওয়ার তথ্য থাকার কথা জানিয়েছে সরকার। তবে দেশ রূপান্তরের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১৫৮ জন মারা গেছে। নিহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী, পুলিশ, পথচারী ও শ্রমিক রয়েছেন। সহিংসতার ঘটনায় এখন পর্যন্ত সারা দেশে চার শতাধিক মামলা হয়েছে। ওইসব মামলায় অন্তত তিন লাখ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে অজ্ঞাতনামা আসামি দুই লাখের বেশি।
মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেপ্তার বা আহতদের পরিবারের সদস্য এবং রাজনৈতিক দলগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। অজ্ঞাতনামা আসামিদের সামনে রেখে ‘বাণিজ্য’ করছে। নিরপরাধ লোকজনকে আটক করছে। বাসাবাড়িতে অভিযানের সময় সহায়সম্পদ ভাঙচুর করছে। শিক্ষার্থীদের হয়রানি করছে। এ থেকে বেরিয়ে না এলে সামনের দিনগুলোয় সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তারা আরও বলেছেন, মামলায় পুলিশের অভিযোগ একেবারেই দায়সারা। এটি প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট উপাদান এজাহারে নেই। আদালতের জেরা চলাকালে এ অভিযোগ সাজানো বলে প্রতীয়মান হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। প্রায় সব মামলায়ই সুনির্দিষ্ট সাক্ষীর কোনো বর্ণনামূলক বক্তব্য নেই। ক্ষতির পরিমাণ টাকার অঙ্কে উল্লেখ করা হলেও, সেটি কীসের ভিত্তিতে কোন বিশেষজ্ঞ নির্ধারণ করেছেন, তার উল্লেখ নেই। পুলিশ শত শত রাউন্ড গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপের কথা বললেও এগুলো দিয়ে কী ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তারও উল্লেখ করা হয়নি মামলায়।
মামলার আসামিদের ধরতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘ব্লক রেইড’ দিচ্ছে পুলিশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর কাছ থেকে তালিকা সংগ্রহ করার তথ্যও মিলেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের দাবি, সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই মামলা হচ্ছে। ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে আসামি শনাক্ত করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এভাবে আর কখনো তান্ডবলীলা চালানো হয়নি। এ সহিংসতায় মামলার সংখ্যা বেশি আবার আসামির সংখ্যাও বেশি। সারা দেশের মধ্যে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা মহানগর এলাকায়। তারা বলেন, মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি থাকলে ‘কিছু একটা হয়’ তা সত্য। পুলিশের কোনো সদস্য যাতে এসব অপকর্ম করতে না পারেন, সেদিকে গোয়েন্দা বিশেষ নজর দিয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ঢাকাসহ সারা দেশে ৪০০-এর বেশি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার ৫০ থানায় মামলা ২৭২টির মতো। ওই মামলায় ২ হাজার ৯৫৭ আসামিকে আদালতে পাঠিয়েছে। ঢাকার বাইরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। দায়ের হওয়া মামলাগুলো ঘেঁটে দেখা গেছে, একেকটি মামলায় আসামির কথা বলা হয়েছে দুই-তিন হাজার। আবার কোনোটিতে উল্লেখ আছে আট-দশজন। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের উল্লেখযোগ্য নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নাম থাকলেও বেশিরভাগই অজ্ঞাতনামা।
গত ১৯ জুলাই মিরপুর-১০ মেট্রো স্টেশনে ভাঙচুরের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৯ হাজার জনকে আসামি করে মামলা করেছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া একটি মামলার আসামি আট হাজার, দুটি মামলায় সাত হাজার, আরেকটি মামলায় ছয় হাজার আসামি, আরও তিনটি মামলায় সাত ও পাঁচ হাজার আসামির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। যাত্রাবাড়ী থানার ১৫টি মামলায় অন্তত ৫০ হাজারের বেশি আসামি করা হয়েছে। মৃত্যুর ১ বছর ৭ মাস ১১ দিন পর সাভারে কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বাস পোড়ানোর অভিযোগে আসামি করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (জাকসু) সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস), পাথালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানা বিএনপির প্রয়াত সভাপতি আজগর হোসেনকে। এ মামলায় তার সহযোগী আরও ৫২ জনকে আসামি করা হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই বিএনপি-জামায়াতের পদধারী নেতাকর্মী। সাভার মডেল থানায় মামলাটি করা হয়।
মামলার বাদী আলমগীর হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমার বাড়ি রাজশাহী, থাকি নাটোরে। সাভারে যারা আমাদের মারধর করে বাস পুড়িয়ে দিয়েছে, আমি তাদের কাউকে চিনি না। কোনো দিন দেখিওনি। আমার মালিক বলল, সাভার থানায় যেতে, আমি গেলাম। আর পুলিশ একটা টাইপ করা কাগজ দিয়ে বলল সই দিতে, আমি সই দিলাম। এর বাইরে আমি আর কিছু জানি না।’
গত ১৮ জুলাই রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় নাশকতা মামলায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ছেলে হাসান মওদুদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি উত্তরায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
হাতিরঝিল থানার ওসি শাহ মো. আওলাদ হোসেন বলেন, ১৮ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিকে পুঁজি করে বিএনপি-জামায়াত ও শিবিরের নাশকতাকারী চক্র হাতিরঝিলের রাস্তায় পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা আহত হন।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২০১২, ’১৩, ’১৪ ও ’১৫ সাল এবং ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সারা দেশে ৮ হাজার ১০৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৬৭ মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। এসব মামলায় ১ হাজার ২৪১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ বছরগুলোতে আন্দোলনের সময় গাড়িচালক, চালকের সহকারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সাধারণ মানুষসহ ১৮৮ জন নিহত হন। আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেন ৪ হাজার ৯৭৩ জন।
পুলিশ জানায়, এবারের সহিংসতার ঘটনায় করা বেশিরভাগ মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ‘শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নির্দেশে ও সক্রিয় অংশগ্রহণে’ অজ্ঞাতনামা আসামিরা দলবদ্ধ হয়ে সরকারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের মারধর করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন দিয়েছে।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ প্রকাশ্যে পুলিশের গুলিতে নিহত হলেও মামলার এজাহারে তা এড়িয়ে যাওয়া হয়। উল্টো আন্দোলনকারীর ছোড়া গুলি ও ইটপাটকেলের নিক্ষেপে সাঈদ মারা গেছেন বলে মামলায় দাবি করা হয়েছে। বিভিন্ন থানায় হওয়া বেশিরভাগ মামলায় এসব তথ্য মিলেছে। ২১ জুলাই শেরেবাংলা নগর থানায় শিক্ষার্থীদের আসামি করে মামলা করেন এসআই আখতারুজ্জামান। মামলায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তৌহিদ আহমেদ, আহমেদুল কবির, সৌরভ, শাহরিয়ার, মুজাহিদুল ইসলাম, আলতাফ, সেলিম রেজাসহ ২০ শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়, ২১ জুলাই শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে রাস্তা অবরোধ করা হয়। তাদের ছোড়া ইটের আঘাতে দুই পুলিশ সদস্য আহত হন।
মোহাম্মদপুর থানার এসআই ফাহাদ হোসেন বাদী হয়ে ২১ জুলাই থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলার এজাহারে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মো. আবদুস সালামসহ ৫৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আরও ৭০০ থেকে ৭৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়, মোহাম্মদপুরে আল্লাহকরিম মসজিদ, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডের পশ্চিম মাথা ও টাউন হল এলাকায় জড়ো হয়ে আসামিরা ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম শুরু করে। মোহাম্মদপুর থানায় এসআই মধুসূদন মজুমদারের করা একটি মামলার এজাহারে ৫৩ জন এজাহারনামীয় ছাড়াও অজ্ঞাতনামা ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়, ১৯ জুলাই সকালে বিএনপি, জামায়াত-শিবিরকর্মীর সমর্থকরা লাঠিসোঁটা, লোহার রড, ইটপাটকেলসহ দেশি বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে মোহাম্মদপুরের আল্লাহকরিম মসজিদ থেকে বেড়িবাঁধ তিন রাস্তা মোড় পর্যন্ত দখল করে সরকারবিরোধী স্লোগান দেয় এবং বিক্ষোভ-ভাঙচুর চালায়। পুলিশ তাদের সরে যেতে অনুরোধ করলে তারা হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছোড়ে। সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেটের পাশাপাশি চায়নিজ রাইফেলের গুলি চালায়।
এত মামলা ও লাখ লাখ আসামির বিষয়ে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অজ্ঞাতনামা আসামি করা মামলাগুলো হচ্ছে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের জন্য পুলিশের একটা বড় সোর্স। শুধু নিউ মার্কেট থানার মামলাগুলোয় ৭০০-৮০০ জন করে অজ্ঞাতনামা আসামি।’
তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মামলার তদন্ত কী হবে? বিচার কী হবে? রায় হবে কি না, এগুলো নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা বা গরজ থাকে না। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এগুলো করা হয়।’
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘যাদের ধরছে, যে প্রক্রিয়ায় ধরছে, এতে সুনির্দিষ্ট আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে। সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলো লঙ্ঘন হচ্ছে। অসংখ্য মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ব্লক রেইড দিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে, বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ করে দিয়ে ঘরে ঘরে ঢুকে শিক্ষার্থী পেলে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এগুলো কোথায় আছে, কোন আইনে আছে? এটার তো কোনো সুযোগই নেই।’
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার ও নাশকতার ঘটনায় রাজধানীর ৫০টি থানায় করা মামলায় আরও ১০৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১২ জুলাই থেকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মোট গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২ হাজার ৯৫৭ জনকে।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, ফেনী, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, গাজীপুর, নাটোর, চাঁদপুর ও রংপুরে ১৫ দিনে ২ হাজার ৮৪৬ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।