ইরানের তেহরানে নিজ বাসভবনে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া। কাতারের মধ্যস্থতায় গাজা যুদ্ধ অবসানের যে আলোচনা হয়েছে, তার পক্ষে কাজ করছিলেন হানিয়া। তার মৃত্যুতে এখন গাজা যুদ্ধবিরতির কী হবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি নিয়ে গত রবিবার গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি বিষয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে রোমে মিলিত হন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, কাতার ও মিশরের প্রতিনিধিরা। বৈঠকে হামাসের প্রতিনিধিত্ব করে কাতার। কিন্তু দিনব্যাপী আলোচনার পরও কোনো সমাধান আসেনি। শেষমেশ স্থগিত করা হয় আলোচনা।
রবিবার সন্ধ্যায় ইসরাইল সরকার জানায়, রোমে আলোচনা স্থগিত করে ফিরে এসেছেন গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ডেভিড বার্নিয়া। আগামী কিছুদিনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি বিষয়ক আলোচনা আবারো শুরু হবে বলে জানায় তারা। তবে কবে নাগাদ তা হতে পারে সেটি স্পষ্ট করা হয়নি।
ইসরায়েলি গণমাধ্যম হারেয এক প্রতিবেদনে জানায়, যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন প্রশ্নে আরো কঠোর অবস্থানে গেছে তেল আবিব। উত্তর ও দক্ষিণ গাজার কৌশলগত সড়কগুলোতে ইসরায়েলি সেনাদের অনেকগুলো চেকপয়েন্টের দাবি তোলা হয়েছে। এছাড়া গাজা-মিশর সীমান্ত সংলগ্ন কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণও দাবি করেছে ইসরায়েল সরকার। সব মিলিয়ে ভেস্তে যায় এবারের আলোচনা।
এর আগে, যুদ্ধবিরতি কার্যকরে কয়েক দফায় আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ভেস্তে যায়। গাজায় যুদ্ধ বন্ধে রোম আলোচনা ছিল সবশেষ উদ্যোগ। তবে হানিয়ার মৃত্যুর আগে যে প্রেক্ষাপট ছিল সেটি এখন অনেকটাই ভিন্ন। হামাসের এই নেতার মৃত্যুতে গাজায় যুদ্ধবিরতি করা নিয়ে নড়বড়ে যে প্রচেষ্টা চলে আসছে, সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা এখন অনেকটাই স্পষ্ট।
ইসমাইল হানিয়া হয়তো গাজায় মাঠ পর্যায়ে প্রতিদিনের সব ঘটনা দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন না, সেটি দেখার দায়িত্ব ছিল সামরিক কামান্ডার ইয়াহিয়া সিনাওয়ারের। কিন্তু হামাসের নির্বাসিত নেতা হিসাবে তিনি ছিলেন কাতার, মিশর এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় চলমান গাজা যুদ্ধবিরতি আলোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচক।
২০১৭ সালে হানিয়া হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন। তখনই গাজা ছাড়েন হানিয়া। অবরুদ্ধ গাজায় ভ্রমণ বিধিনিষেধ এড়াতে তিনি তখন থেকেই তুরস্ক এবং কাতারের দোহায় যাতায়াত করতে শুরু করেন।
গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুদ্ধবিরতি নিয়ে নানা পক্ষের সঙ্গে তিনি আলোচনা করতে শুরু করেন কিংবা হামাস মিত্র ইরানের সঙ্গেও আলোচনায় অংশ নেন। কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলিস্তিনি সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আদিব জিয়াদেহ বলেছেন, আরব দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে হামাসের হয়ে রাজনৈতিক যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন হানিয়া। হামাসের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। গত ৭ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর কাতারের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য শুরু হওয়া আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন হানিয়া।
কাতার ও মিশর গাজায় যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করেও যে সময়টিতে ব্যর্থ হচ্ছে, ঠিক তখনই হানিয়ার মৃত্যু এই প্রচেষ্টার পাশাপাশি হামাসের জন্যও বড় ধাক্কা। আর এখন ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর পর গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় আশু অগ্রগতি দেখাটা আরও অনেক কঠিন বৈকি।
তবে বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে আল জাজিরা জানায়, হানিয়ার মৃত্যুর কারণে গাজা যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যাবে অথবা এর গতি ত্বরান্বিত হবে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশেষজ্ঞ মাইরাভ জোনসেইন বিশ্বাস করেন, নেতানিয়াহু হানিয়ার হত্যাকাণ্ডকে ইসরায়েলের জন্য "বিজয়" হিসাবে দাবি করার চেষ্টা করতে পারেন। আর এ কারণে তিনি এবং তার পক্ষের লোকজনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার বিষয়টি আরও তীব্র হতে পারে।
ক্রাইসিস গ্রুপের আরেক গবেষক এবং হামাসের বিশেষজ্ঞ আজমি কেশাউই বিশ্বাস করেন, ইসরায়েল শীঘ্রই একটি চুক্তিতে রাজি হবে যদি তারা হানিয়াকে হত্যার বিষয়টি পুঁজি করতে সক্ষম হয়। এছাড়া অনেক ইসরায়েলি গাজায় বন্দিদের উদ্ধার করার জন্য এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ওপর চাপ কমানোর জন্য যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে। এসব কারণ হয়তো যুদ্ধবিরতিকে ত্বরান্বিত করবে।
তবে কেশাউই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, হানিয়া কখনোই কট্টরপন্থী ছিলেন না। তিনি একজন ঐক্যবদ্ধ মানুষ ছিলেন এবং তিনি আপস করতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু এখন তার অনুপস্থিতিতে হামাসের শীর্ষ নীতিনৈতিকতা কার হাতে যাবে সেটা দেখার বিষয়। কারণ তিনি যদি একজন কট্টরপন্থী হন এবং হানিয়ার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চান তবে যুদ্ধবিরতির আলোচনা পিছিয়ে যেতে পারে।