জাতীয় পার্টির (জাপা) দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অধিকাংশ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। জাপার নেতাকর্মীদের দেশ ছেড়ে পালাতে না হলেও রাজনীতিতে দলটির গুরুত্ব কমে গেছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে জাপার। যার সর্বশেষ ফলাফল বৃহস্পতিবার জাপার সঙ্গে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি হামলার পর দলটির অফিসে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা। ফলে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে জাপা কি পরিবর্তিত পরিস্থিতির রাজনীতিতে টিকে থাকবে নাকি হারিয়ে যাবে।
২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্রমেই ঘনিষ্ঠতা বাড়ে জাপার। এ সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বাড়তে থাকে দূরত্ব। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের দাবি আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিবাদের দোসর জাপার এদেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও মনে করেন গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ যতটা গণতন্ত্রকে নষ্ট করেছে জাপার দায় তার কোনো অংশেই কম নয়। আওয়ামী লীগের প্রতিটি নির্বাচন ও অনৈতিক কাজের বৈধতা দিয়েছে জাপা। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর সহানুভূতি হারিয়েছে জাপা।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর শুরুতে সেনাবাহিনী ও পরে অন্তবর্তী সরকারের সংলাপে ডাক পাওয়া জাপার জন্য গুডলাক ছিল। কিন্তু দলটির নেতাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে তারা রাজনীতি থেকে ছিটকে যান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাপে সর্বশেষ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা জাপাকে ডাকেননি। জবাবে দলটি দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহকে রংপুরে অবাঞ্চিত করে। জাপার এ ধরনের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী ছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। জাপার এখন কোনোভাবেই দ্বন্ধে জড়ানো উচিত হবে না। এই পরিস্থিতিতে দলটির উচিৎ সরকার ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরির পথ খুঁজে বের করা। রংপুরে জুলাই আগস্টের গণআন্দোলনে জাপার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সেটা কাজে লাগাতে হবে। না হলে জাপা চলমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে পারবে না। এরপর যদি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বা অন্য কারও সঙ্গে জাপার মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয় তাহলে দলটির নেতাকর্মীরা মামলার বেড়াজালে পড়বেন এবং রংপুর ছাড়া আর কোথাও রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে পারবেন না।
এদিকে বৃহস্পতিবারের ঘটনায় গতকাল শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন ডাকে জাপা। এতে দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বক্তব্য দেন। জি এম কাদের হামলার ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত উল্লেখ করে বলেন, ছাত্রজনতার নাম দিয়ে একদল লোক এ হামলা চালিয়েছে। নাগরিক কমিটির কয়েকজন নেতা হামলায় অংশ নেন বলেও জি এম কাদের তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন আগামী ২ নভেম্বর কাকরাইলে জাপা যে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছিল তার রেশ ধরে এ ঘটনা ঘটানো হতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে জি এম কাদের বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের কোনো অপকর্মের দোসর নয়। তাছাড়া তিনি দীর্ঘদিন ধরে ২৪ সালের নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে যে বয়ান দিচ্ছিলেন সেটাই তুলে ধরেন। তাদের জোর করে ব্ল্যাকমেল করে নির্বাচনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন।
এদিকে জাপার পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২ নভেম্বর জাপা চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ পার্টি নেতৃবৃন্দের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবিতে রাজধানীতে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করবে তারা। তাদের এমন ঘোষণায় কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয় কিনা তা নিয়ে নতুন দুশ্চিন্তা তৈরি হয়। যদিও রাতে তারা সেই কর্মসূচি স্থগিত করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাপার প্রেসিডিয়াম মেম্বার রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমরা আমাদের ঘোষিত কর্মসূচি পালন করব। এতে যদি বাধা আসে তবে আমরা তা উপেক্ষা করে কর্মসূচি পালন করব। কর্মসূচি পেছানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। যদিও রাতে তিনি জানান, আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কর্মসূচি থেকে ফিরে এসেছি।
দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক সময় জাতীয় পার্টিকে নিজেদের সাথে ভেড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে- এমন চিত্র বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছিল বহু বছর ধরেই। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর ক্ষমতায় থেকে দলটি গঠন করেছিলেন।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে তার পতন হলেও জেলে থেকেই এরশাদ দলটির প্রত্যাবর্তনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এরশাদ নিজেও ৫টি আসনে জয়লাভ করেন এবং তার দল ৩৫টি আসন পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এবং দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেও জেনারেল এরশাদ প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতা এবং ভোটের রাজনীতিতে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর এবার রাজনীতিতে টিকে থাকা নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে দলটির।