২০২৪ সালের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন কিংবা সবচেয়ে বড় বিজয় এসেছে ছাত্রদের হাত ধরে। ১৭ বছরের ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থাকে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে এই ছাত্ররা। তাদের হাত ধরে লেখা হয়েছে দেশের নতুন ইতিহাস। তৈরি হয়েছে ‘৩৬ জুলাই’ অভিধা। ছাত্র-জনতা এটিকে অভিহিত করেছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণ-অভ্যুত্থান দেশের ‘ইতিহাস’ পরিবর্তন। শুরুতে ছিল না এমন ইঙ্গিত। চলতি বছরের জুন মাসে হাইকোর্টের একটি রিটের ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে আসে। এ ঘটনা কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। পরে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও নিজ ক্যাম্পাসে আন্দোলন গড়ে তোলেন। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনটি কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
শেখ হাসিনাসহ তার দলীয় সঙ্গীদের অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এভাবেই সাধারণ একটি ছাত্র আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। গুলিতে নিহত হয়েছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মতো শত শত ছাত্র-জনতা।
আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায় ১৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ‘রাজাকার’ সম্বোধন। সেদিন মধ্যরাতেই রাস্তায় নেমে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। তারা সেøাগান দেন ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার/ আমি কে তুমি কে, রাজাকার-রাজাকার/ কে বলেছে, কে বলেছে সরকার, সরকার।’ আর এর সুযোগ নেয় ছাত্রলীগ। ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশনায় ১৫ জুলাই ঝাঁপিয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর। এর পরই ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। পরদিন এর প্রতিবাদে স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করেন। ওইদিনই বন্ধ করে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ১৭ জুলাইও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল হয়। এতে পুলিশ, ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ হন অনেক শিক্ষার্থী। ঢাবিসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বের করে দেন ছাত্ররা।
সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের নিহতের ঘটনা। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। এরপরও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন থেকে সরে না এলে ১৮ জুলাই থেকে শুরু হয় দমন-পীড়ন, হত্যাকা-। ১৮-২২ জুলাই পাঁচ দিন সারা দেশে চলে তা-ব। ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন দল, সংগঠন ও জনতা। এই পাঁচ দিনে ১৫৭-এর বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সমন্বয়কদের গুম করার অভিযোগ ওঠে। কয়েকজন সমন্বয়ককে জিম্মি করে আন্দোলন প্রত্যাহারের চাপ দেওয়া হয় বলে পরে এমন তথ্য উঠে আসে। সব ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২৮ জুলাই ১০ দিন পর সব ধরনের ইন্টারনেট সচল হয়। এর মধ্যে পুলিশ এবং ছাত্র-জনতার সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০০-তে। ২৩ জুলাই আপিল বিভাগ ৯৩ শতাংশ মেধা এবং ৭ শতাংশ কোটা রেখে রায় দিলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সেতুমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যায় জনতাও। বেশ কয়েকজন মানুষ নিহত হন এ সময়, আহত হন হাজারো মানুষ।
আগস্টের শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পূর্ণভাবে সংহতি জানাতে থাকে বিভিন্ন দল, সংগঠন, শিক্ষক, আইনজীবীসহ প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। শুক্রবারের গণমিছিলে শুধু শহীদ মিনারেই জড়ো হয় অন্তত ১০ হাজার ছাত্র-জনতা। পরে শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রায় এক লাখ মানুষের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তাতে সম্মতি জানায় সবপর্যায়ের মানুষ। তাদের ডাকে এক দফা দাবিতে আইনজীবী, শিক্ষকরাসহ মাঠে নামেন সবাই। ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারান পুলিশ সদস্যসহ ৯৭ জন। এর মধ্যেই সরকার পতনের চূড়ান্ত ডাক ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা করেন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। আর তাতেই ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলে চূড়ান্ত বিজয় আসে ছাত্র-জনতার।
কোটা আন্দোলন থেকে গণ-অভ্যুত্থানের বিষয়টি মূল্যায়ন করতে গিয়ে সমন্বয়ক আবদুল কাদের বলেন, ‘স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার শুধু ছাত্রদের নয়, দেশের সব মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। তাই শুরুতে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন থাকলেও পরে এটি রূপ নেয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা ভাবতেই পারেননি এ আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেবে। ছাত্রদের আন্দোলনে যোগ দিয়ে এ দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ সরকার সব নিপীড়ন নির্যাতনের জবাব দিয়েছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য এই আন্দোলনে আমাদের ভাইয়েরা শহীদ হয়েছেন। দেশে কোনো বৈষম্য থাকবে না এমন স্বপ্ন নিয়ে, তারা নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন। হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমরা আমাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করিনি। আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। দেশকে পুনর্গঠনের যে লড়াই, সেটি আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ না করা পর্যন্ত আমাদের লড়াই শেষ হবে না।’
নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সে রক্ত এবং স্পিরিট বৃথা যেতে দেব না। এখনো ফ্যাসিস্টদের অস্তিত্ব রয়েছে। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের চূড়ান্ত বিজয় আসবে।’